এই গল্পটা নিঝুম নামে আমার খালাতো বোনের হতে পারত, হলো না কারণ ও যখন গল্পটা বলতে চেয়েছে আমি দিশাহারা হয়ে খালি বাধা দিয়ে বলি, পরে শুনব। তারপর সে গত কয়েকদিনে বলতে শুরু করে, আমিও শুনি। মাস দেড়েক আগে বলার সময় যেমন একটা অসহায় স্বর ফুটিয়ে রাখত এখন তেমন নয়, যেন মুক্তি মিলেছে। মুক্তি পেয়ে বন্দিদশার গল্প বলায় একটা স্বস্তি থাকে – কিছুটা তেমন। দুলাভাই কর্তৃক প্রতিরাতে ধর্ষিত হওয়ার গল্প! এটা এক লাইনের গল্প নয়, নয় রসিয়ে কারো সামনে উপস্থাপন করার। ভেতরে নরপিশাচের উদ্বাহু নৃত্য আর দুই বোনের প্রতিদিন একটু একটু করে আত্মিক মৃত্যু কখনো সুইসাইডের পরিকল্পনা কিংবা তাকে হত্যার! সেই পরিকল্পনাও এমন অভিনব ও লোমহর্ষক যে, আমি শুনতে শুনতে শিউরে উঠি। এর মধ্যে নাজু নামে আমার আরেক পুরোনো বন্ধু আমাকে বলছে তার বন্ধুর জীবন। এই গল্পটাও ভয়ংকর, আমার মতো একজন সাধারণ লেখক কীভাবে লিখবে ভেবে না পেয়ে ওর কাছ থেকে বিস্তৃত শোনা ছেড়ে দিয়ে নিজেকে বললাম, এই গল্পটা তুমি ভুলে যাও নিলু! সব গল্প লিখতে হয় না!
কিন্তু সময় এবং সুযোগ পেলেই মাঝে মাঝে এমন ঘূর্ণি দিয়ে আসে ঘটনাগুলো! এসে মাথায় ঘাপটি মেরে বসেই থাকে না, পর্যুদস্ত করে ফেলে। তখন আমি তাকে মুষ্টিবদ্ধ করতে এগিয়ে যাব কি যাব না ভাবতে ভাবতে ফেলে রাখা খসড়া গল্প পড়ি, নিজেকে শান্ত রাখি। ফলাফল, দেখি ওগুলো কোন চুলায় দেওয়া যায়, চুলাটুলা পেয়েও যাই। এই যে এত কথা লিখলাম বেহুদা, কেন! সত্যি বলতে, সাহস সঞ্চয় করছি নাজুর বন্ধুর গল্পটা আপনাদের বলার, সত্যি। বলুন, জীবনের কোন সত্যটা আমরা ঠিকঠাক বলতে পেরেছি! সত্য এত কঠিন, এত কঠিন যে, তাকে বলার কথা বলে কত ফালতু কথা বলে চলি! একটু আগেও আমি জানতাম এই কয়দিন আমি সেলাই করে কাটিয়ে দেব, কেননা এটা রোজার মাস, রোজার মাসে বাজে কথা লিখব না, সহি সহি একটা মন থাকবে সরল চিন্তায়। লেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখব তো বটেই অন্তত এই রকম ভয়াবহ গল্প থেকে! কিন্তু নিজের ভেতরে বোধ কি বোধি এসব অতন্দ্র তো, স্বস্তি দেয় না। আজকে আমায় জাপটে ধরেছে, বলা চলে পেড়ে ফেলেছে। নিঝুমই এর জন্য দায়ী। কয়েকদিন ধরে নিঝুম আমাকে যা বলেছে এবং আমি শুনতে শুনতে অতলে পড়তে পড়তে কখনো বলেছি আজ থাক নিঝুম, আমি নিতে পারছি না আর। নিঝুম বলে আরেকটু শোনো আপু! এইভাবে জানি না সে স্বাধীনভাবে সবটা বলতে পেরেছে কি না। কিন্তু এটা সত্য যে, আমার পক্ষে খুব দুরূহ ছিল ওকে শোনা। নিঝুমের চিন্তাই আমাকে নাজুর বন্ধু প্রীতির কথা মনে করিয়েছে, নিঝুমকে বারবার ওভারটেক করে! নিঝুমের গল্প বলব একদিন হয়তো। ওটা আপাতত ঠান্ডাঘরে থাক।
নাজুকে বলি আপনাদের, বলব বলেই বসেছি তো, কতটা বলতে পারব জানি না। নাজু আমার দশ বছরের সহকর্মী এবং কাজের ফাঁকে ওর গল্প শুনতে শুনতেই আমাদের বন্ধুত্ব। সে আমার অনেক গল্পের বীজদাতা, কখনো হয়তো পুরো গল্পই। চার বছর আগে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আমি চলে আসার পর ও শুধু বলে, বন্ধু তোমাকেই শুধু মনে পড়ে এইসব দিনে! আমি বলি, আমার আনন্দ ও বেদনা তো এখানেই বন্ধু! এমন সব বীভৎস গল্প তুমি আমাকেই বলবে বলে ঠিক করে রেখেছ! ও গম্ভীর গলায় বলে, আর কাকে! আমি তোমাকেই শুধু খুঁজে পাই যে, বিশ্বাস করো!
দুই
নাজু ভারতেশ^রী হোমসে পড়ত, সেখানকার নিয়মকানুন সে পছন্দ করত এবং নানা অনুষ্ঠান উদ্যাপনে ও ছিল প্রথম সারির শিল্পী। সেখানকার নিয়মকানুন ভালো, শিক্ষক পড়াশোনা ভালো, খাবারও ভালো। সেখানে যে বাগান আর ফুল, সেসবও দারুণ, বহুদিন নানাভাবে শুনিয়েছে। আমি শ্রোতা হিসেবে ভালো আবার ফুলপাখিতেও মন ভরে। তো সব ভালোর মধ্যে ওর বেশি ভালো লম্বা ছুটির আগে কর্তৃপক্ষের বাগান উন্মুক্ত করে দেওয়া। ছাত্রীরা খুশিতে আটখানা হয়ে বাগানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ফুল তোলে, রাতভর মালা গাঁথে, অনেক গল্প। একবার ফুল তুলতে গিয়ে ও খুব বিপদে পড়েছিল, মানে ওকে নাকি ফুলপরীরা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল গাছের গুঁড়িতে। নির্দোষ রক্তকরবী ডালসহ ছিঁড়তে গেলে ঘটনা, পরদিন বাড়িতে গেলে ঘুম থেকে উঠে দেখে মাথায় জট, জট মানে সেই রকম জট! জটাধারী শিব, যা হোক।
হোমের এক বন্ধু প্রীতির গল্প এটা, গল্প! হা জীবন, গল্পই! প্রীতি কর্মকার। প্রীতি দেখতে সুন্দর, শ্যামলাবরনে অপূর্ব একটা লালিত্য সমস্ত শরীর জুড়ে, হেঁটে যাওয়ার সময় নাকি তাকিয়ে দেখে মেয়েরাও! ওরা হোম থেকে এসএসসি পাশ করে বেরিয়ে যায় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি, কলেজ পর্যন্ত যোগাযোগ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, মোবাইলের যুগ আসেনি সেভাবে যে! বছর পনেরো পর যখন দেখা হয় নাজুর সঙ্গে তখন প্রীতি একটা কর্পোরেট অফিসে বড় চাকুরে। স্বামী ব্যবসাদার, প্রেমের বিয়ে। দুটো সন্তান তাদের ভালো স্কুলে পড়ে। নাজু বলে, প্রীতি আমাদের দাওয়াত দেয় একদিন, সঙ্গে আরো তিন সহপাঠী-বন্ধু। তাও দশ বছর আগের কথা। প্রীতিকে দেখে আমাদের এত ভালো লাগে। ওর জীবন সফল, সফল জীবন দেখলে কারো কারো চোখ টাটায় কিন্তু সেদিন বরং গর্ব হয়েছিল আমাদের। প্রীতির মা ছিলেন প্রীতিদের সঙ্গে। মাসিমাকে বিশেষভাবে মনে ছিল কেননা, তিনি হোমে আসতেন মাঝে মাঝে। যেমনি সুন্দর তেমনি পরিপাটি। বস্তুত বাড়িটা মাসিমার। প্রীতির একটাই ভাই, সে টরন্টো থাকে। এই বাড়িটা প্রীতির মা তাই প্রীতিকে লিখে দেবেন বলে মনস্থির করেছেন, প্রীতি কথায় কথায় বলেছে আমাদের। ভাই সে-দেশে বিশাল চাকরি করে, তার কোনো আপত্তিও নেই এই সিদ্ধান্তে। ঢাকার অদূরে মানিকদির একটু ভেতরে এই দেড়তলা বাড়িটা এমন আহামরি কিছু না। অনেকখানি জমি চারপাশে। মাসিমার বানানো বাগান দেখে আমরা বিস্মিত, যেমন গাছগাছালি ফুলফল শোভিত, তেমনি বাগান ঘিরে বসার জায়গা স্থানে স্থানে, কাঠের, কংক্রিটের গাছের গুঁড়ির। বাড়িটা পুরনো, বাড়িসহ অনেকখানি জমি মেসোমসাই নাকি কিনেছিলেন খুব অল্পদামে কষ্টে উপার্জনের টাকা আর গ্রামের জমি-ভিটা বিক্রি করে। ভিটা কেউ বিক্রি করে! মাসিমা এ-কথা এড়িয়ে বলেছিলেন, জানো তো, আমার উদ্দেশ্য ছিল বাগানের, মানে একটু খোলা জায়গার, একটা লাউয়ের মাচা, দুই সারি লাল দোপাটি, একটা বেলির ঝাড়, কোনার দিকে একটা শিউলি, গেটের কাছে একটা কিশোর কদম, দু-চারটে ফলের গাছ। বলো জীবন কয়দিনের! এই সব সঙ্গ ছাড়া আমার তো চলবে না, তোমার মেসো বুঝতে পেরেছিলেন বোধহয়! মাসিমা তাঁর ইচ্ছামতো বাগান করেছিলেন, গেটের একপাশে কদমটা দেখতে পেয়ে মনে জেগেছিল বর্ষার মেদুর আকাশের কথা। আমাদের মনের কথা ধরতে পেরে বলেছেন, এসো কিন্তু বর্ষায়, চারপাশ এমন সবুজে ভরে যায় কী বলব! বাতাসে সবুজের ঘ্রাণ যেন! আমরা হেসে ফেলি মাসিমার বলার ভঙ্গিতে, মনে মনে সবুজের ঘ্রাণ শুঁকে! মাসিমার হাতের রান্না অপূর্ব, শুক্তো দিয়ে ভাত খেয়ে এসেছিলাম, সেই প্রথম শুক্তোয় হাতেখড়ি, খুব যত্ন করে শিখিয়েছিলেন মাসিমা।
নাজু বলে যায়, তারপর যোগাযোগ মোটামুটি নিরবচ্ছিন্নই, গুলশান-বনানীতে কফি, গেট টুগেদার, একবার সিলেট ভ্রমণ দুর্দান্ত! কত কিছুই হলো এতগুলো বছরে। বছর কয়েক আগে একদিন টিভিতেই দেখি প্রীতির দুর্ঘটনার খবর, ছুটে গেলাম হাসপাতালে। আমাদের বন্ধুত্ব মজবুত, সবাই এলো দেখতে; কিন্তু হায় প্রীতি জানতেও পারল না আমরা তাকে কতটা ভালোবাসি, কতটা মুষড়ে পড়েছি বন্ধুর বিপদে। মস্তিষ্কে আঘাত, দশ দিনে জ্ঞান ফিরলেও সে অন্য এক প্রীতি। সম্পূর্ণ স্থবির, শুধু তাকিয়ে থাকে চোখ ভরা কথা নিয়ে; কিন্তু কিছু বলতে পারে না, বুঝতে পারছে কি না তাও বোঝা যায় না। হাসপাতাল থেকে বাড়ি গেলে আমরা যথারীতি দু-চারজন মিলে ওকে দেখতে যাই। ওর সার্বিক পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপের দিকে সবাই বুঝতে পারি। প্রায় প্রতি মাসেই আমরা কেউ না কেউ যাই, ঢাকা থেকে একটু দূরে হওয়ায় দু-তিনজন মিলেই যাওয়া হয় বেশি। এভাবে বছরখানেক কেটে যায়, একদিন হঠাৎ আমি একা যাই কাউকে কিছু না জানিয়ে। নিলু, তোমাকে আমি কীভাবে এই বর্ণনা দেবো! কে আমাকে বিশ্বাস করবে! কেমন করেই বা এই কথা আমি কাউকে বলব! সকাল দশটায় ওর বাসার দরোজায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে যখন ঠিক করেছি ফিরে আসব তখন ভেতর থেকে দরোজা খুলল একটা সাদা চুল বুড়ি, তাকে চিনতে কষ্ট হয়! আমি হিসাব করে দেখি রোজা, রোজার ঈদে গ্রামে যাওয়া সব মিলিয়ে দুই মাস কোনো খবর নিতে পারিনি। বোধহয় অন্য বন্ধুরাও যায়নি, গেলে জানতে পারতাম। ইনি প্রীতির মা! আমি হতবাক হয়ে চেয়ে দেখি, ইনি দুই মাস আগে দেখা আমাদের মাসিমা! আমার কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে না তো! তিনি কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, কেন এসেছ! এসো না, কেউ এসো না! আমার হাতে ফল ছিল সেগুলো মেঝেতে পড়ে গেলে তিনি রুগ্ণ হাতে তাড়াতাড়ি তুলে কোথায় লুকালেন তারপর ফিসফিস করে বললেন, এদিকে এসো। আমাকে টেনে রান্নাঘরের ভেতরে একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করিয়ে বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে থাক, বেরুবে না, শয়তানটা একটু পর বাইরে যাবে, তখন তোমাকে প্রীতির কাছে নিয়ে যাব। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম নিশ্বাস বন্ধ করে, সারা শরীর ঝিমঝিম করে, পা শক্তিহীন। এমনি আমার পালস আটচল্লিশ পঞ্চাশে ঘোরাঘুরি করে, এবার মনে হলো আরো কম, বেড়েই চলেছে ড্রপবিট। সময় যেন কাটে না, জানি না কত সময় পর, ঘড়ির দিকে তাকাইনি, অসহ্য সময়। অনেকক্ষণ পর পাগলের মতো দেখতে মাসিমা এলেন, বললেন, এসো।
শেষ মাথায় ঘরটা, দরোজাটা বাইরে থেকে টানা। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল, যেন একটা জাল জলে পড়ার শব্দ, ঝুপ! ঝুপ করে কখনো দরজা খোলে! শেকল দেওয়া ছিল বাইরে থেকে! খুলে না গিয়ে যদি চিরকাল আমাকে বাইরে থাকতে হতো নিলু, সেটা তাহলে অনেক ভালো হতো কিংবা যদি বলত প্রীতি মারা গেছে চলে যাও, সেটাও ভালো হতো! আমার চোখ পুড়ে গেল, বুক জ¦লে গেল, পা থরথর করে কাঁপতে থাকল আর আমার পালস! জানি না। শুধু জানি আমি দু-হাত দিয়ে চোখ ঢাকলাম। আর্তনাদ করে উঠলান ‘ও মাগো ও মাগো’ বলে। মাসিমা আমাকে চেপে ধরে রাখলেন শক্ত করে। আমার এখন মনে হচ্ছে আমি যাতে ভেগে না যাই সেজন্যই ধরে রেখেছিলেন কি না! আমি কি পালাতাম! আমি মাসিমাকে বললাম, মাসিমা গো, একি অবস্থা! আমি কী দেখছি মাসিমা, ও মাসিমা গো!
একটা বদ্ধঘর, হলুদ বাতির নিচে হাত-পা বাঁধা একটা কঙ্কালসার উলঙ্গ মানুষ, উলঙ্গ মানে উলঙ্গ, এক ফোটা সুতা নাই সারা শরীরে। চোখ দুটো আধবোজা। চলৎশক্তিরহিত মানুষটাকে বেঁধেই বা কেন রাখা, এই অশ্লীল ভঙ্গিতেই বা কেন! আমি কাছে যেতে পারি না দুর্গন্ধে, নাকের পশম পুড়ে যাওয়ার দশা। এক পা আগাই, দাঁড়াই, আবার কিছুটা আগাই, দাঁড়াই। মাসিমা যেন আমাকে সাহস দিচ্ছেন, যাও না কাছে যাও, ভয় কি! পাঁচ-ছয় হাত দূরে থাকতেই আমি আর্তনাদের স্বরে ডেকে উঠি, প্রীতি … প্রীতি প্রীতি … আমি নাজু, তাকা আমার দিকে! মাসিমা একটা আগরবাতি ধরালেন গন্ধ দূর করতে, ফ্যান ছাড়লেন হালকা করে, গন্ধটা যেন আরো তীব্র হলো। বর্ষাকাল বলেই বাতাস ভেজা, দেয়াল মেঝে সব ভেজা! নাকি বর্ষাকাল নয়! আমি ভাবছি বর্ষাকাল, চারদিকে হয়তো সবুজ, মনমাতানো সবুজ! মাসিমার গাছগাছালি ছোঁয়া সবুজ বাতাস আর দু-চারটে ভেজা গাঢ় সবুজ পাতা ঝরে পড়েছে ঘাসে, একদিন প্রীতি আমার হাত ধরে গেয়ে উঠেছিল, তখন পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু ঝরে জল …! মাত্র বছর দুই আগে!
আমার ডাকে ওর চুল উড়ল, পায়ের আঙুল বুঝিবা কেঁপে উঠল, নাকি ভুল, কিছুই নড়েনি, কিছুই কাঁপেনি। মেঝেতে একটা শতরঞ্জির ওপর ধূসর নীল ওয়েলক্লথ বিছানো তার ওপর দুই পা ফাঁক করে ও বসে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। দেয়ালের দিকে পিঠের নিচে কিছু থাকতে পারে, বালিশ কিংবা অন্য কিছু। আমি কাছে গিয়ে বসতে মাসিমা এক টুকরা কাপড় ওর কোলের ওপর ছুড়ে দিতে দিতে বললেন, শুয়োর একটা, এই অবস্থায়ও মেয়েটাকে একদিনের জন্য ছাড়ে না। আমি এবার নিজের চোখকে বিশ্বাস করলাম, আমি দেখেছি ও পথ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে সাদা কিছু, ওয়েলক্লথেও অনেকটা পড়ে আছে। চামড়া ভেদ করে সামান্য মাথা উঁচিয়ে থাকা স্তনের নানা জায়গায় কামড়ের দাগ দগদগে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাসিমা বালতিতে পানি এনে গামছা ভিজিয়ে প্রীতিকে মোছাতে লাগলেন পরম মমতায়। একবার উঠে গিয়ে একটা বড় ওড়না এনে ওর গায়ে ফেলে রাখলেন আরেকটু আব্রু দিতে। মনে হলো প্রীতির চোখের কোনায় পানি, গড়িয়ে পড়ছে কিংবা পড়ার উপক্রম। আমি অনেকক্ষণ ধরে ওর অশ্রু গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম। গড়িয়ে পড়ুক, পড়লে বুঝব ও সব বুঝতে পারছে, বুঝতে পারলেই তো ও এসব থেকে জেগে উঠতে চাইবে, বাঁচতে চাইবে! সুস্থ থাকতে হলে চৌকস মানুষ একজন, ওকে জেগে উঠতে হবে না! আমরা ওর পাশে থাকব, পাশে থাকা দায়িত্ব আমাদের!
সামান্য ফলের রস, জাউ ইত্যাদি খাইয়ে ওকে বাঁচিয়ে রাখেন মাসিমা। সব সময় যে গিলতে পারে তাও না, খুব কষ্ট খাওয়াতে, একটা লড়াই রীতিমতো।
ওখানে বসেই দুই বন্ধুর সঙ্গে কথা হলো মোবাইলে। গায়ে ওড়না দেওয়া দু-একটা ছবি তুলে পাঠালাম ওদের। তোমাকেও একটা ছবি দিয়ে কথা শুরু করেছিলাম নিলু, মনে আছে! যখন আমরা আইনজীবী খুঁজছি হন্যে হয়ে!
মাসখানেক আগে চাপে পড়ে বাড়িটা মেয়েকে দানপত্র করে দিয়েছেন মাসিমা। বলেছে, মা-মেয়ে বাঁচতে চাইলে এটাই শেষ চেষ্টা তোমাদের! তারপর থেকেই মাসিমার ওপর মানসিক নিপীড়ন। বিষয়টা আসলে জটিল, বাড়িটা প্রীতির নামে করিয়ে ওর স্বামী ওকে পুঁজি করে ফেলেছে। আর মাসিমা বেঁচে আছে অক্ষম হাতের পুতুল হয়ে। বাইরে যাওয়া নিষেধ কড়া ভাবে। চোখে চোখে রাখে যাতে বাড়িটা হাতছাড়া না হয়ে যায় আর যত রকম অত্যাচার আছে করে চলে। মাসিমার শরীর ভীষণ খারাপ, চিকিৎসা দূর উল্টো রাতদিন গালমন্দ। বাইরে থেকে মেয়েমানুষ পর্যন্ত নিয়ে আসে চোখের সামনে দিয়ে এই ঘরে, অতি নিম্ন শ্রেণির মেয়েমানুষ, এমন কুরুচি! প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেছে বহুদিন, তারা সব জানলে পুলিশে খবর দেওয়া অসম্ভব নয়। বাচ্চাদের পল্লবী ফুপুর কাছে রাখায় তারা এসবে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না, এটাও কম মর্মান্তিক নয় মাসিমার জন্য!
আমরা বেশ চেষ্টা-তদবির করে প্রীতির জন্য একটা হোমের ব্যবস্থা করলাম, মাসিমাসহ থাকতে পারবে। এই বাড়িটা ভাড়া দিতে পারবে দশ হাজার টাকায় বাকি দশ কি বারো হাজার আমরা পনেরো জন একটা ফান্ড করে ওর চিকিৎসাসহ সব কিছু চালিয়ে নেব। সবচেয়ে বড় কথা, ওই দানবের হাত থেকে রেহাই পাবে, রেহাই পাবে ওর পাশবিক অত্যাচার থেকে।
আমরা যখন প্রীতিকে বাসা থেকে উদ্ধার করে হোমে দেওয়ার সব চেষ্টায় বিফল হলাম, তখন তোমাকে গল্প বলা শুরু করেছিলাম নিলু, হোয়াটসঅ্যাপে ওর বীভৎস ছবি পাঠিয়েছিলাম, বস্তুত তোমার কোনো আইনজীবী আছে কি না, সাহায্য করতে পারবে কি না, এটাই তখন প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
এত কিছু পরিকল্পনা, কিছুই কাজে লাগল না, কথা বলে জেনেছি আইন আমাদের পক্ষে নয়। সে স্বামী, তার অধিকার সবার আগে, তার ইচ্ছার বাইরে কেউ যেতে পারবে না। কেউ না, আমরা নাকি একেবারেই ফালতু, বৃথা নাক গলানো!
আমাদের সমস্ত উৎসাহ মাটি হয়ে গেল তার স্বামীত্বের পাশবিকতার কাছে। এর মাসকয় পর মাসিমা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলে আমরা অথৈ জলে পড়লাম, শেষ ভরসাটুকুও নিভে গেল। আমার কোনো কোনো বন্ধু বলেছে, মাসিমাকে ওই শয়তানটা হয়তো গলা টিপেই মেরেছে। কে দেখার আছে! আমরা প্রতি মাসে যাই ওর জন্য ডায়াপার ফলের জুস নিয়ে। সারা মাসের ডায়াপার সারা মাসের ফলের জুস আর গোটা চারেক ম্যাক্সি। ওর গায়ে শুধু হাড়গুলো হা-হা করে তাকিয়ে থাকে, আর এমন দুর্গন্ধ, বীভৎস পরিবেশ করে রাখে যেন কেউ দ্বিতীয়বার যাওয়ার সাহস কি চেষ্টাও না করে। শয়তানটা বিয়ে করে বউ এনেছে মাসিমা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর। এভাবে আরো মাস ছয়েক। ওকে দেখতে যাই প্রতি মাসে পালা করে
তিন-চারজন করে, সাহস নেই কারো একা যাওয়ার! একা যাওয়া সত্যি অসম্ভব, এখনো উলঙ্গ করে রাখে, এখনো ওইভাবে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখে। এখন কুঁকড়ে একটা কিম্ভুতকিমাকার প্রাণীর মতো দেখায় ওকে। কতদিন ভেবেছি পুলিশ নিয়ে যাব কিন্তু শুনেছি থানায় আমাদের নামে জিডি করেছে তার পরিবারে অনধিকার হস্তক্ষেপের অপরাধ ও দলবদ্ধ হয়ে বাড়িটা পর্যন্ত আত্মসাতের অভিযোগে।
ততদিনে আমাদের দলটা বড় হলেও আমাদের অসহায়ত্ব কমেনি একটুও। বলতে গেলে আমরা প্রীতির জন্য কিছুই করতে পারলাম না শুধু আইনের কারণে। এমনকি বলেছি, প্রীতিকে আমাদের দিয়ে দিন। একথা বলতে যাওয়ায় তো আরো তেড়ে এসে বলে, বাড়িটা আত্মসাৎ করার তালে আছো তো! বেশিরভাগ সময় আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারই করে না, আকারে-ইঙ্গিতে বোঝাতে চায়, আমাদের আসার দরকার কি, বিকাশে টাকা পাঠালে সে-ই সব কিনেটিনে দিতে পারে!
একটা সময় দেখি এমনকি নতুন বউটাও স্বামীর আড়ালে বদনাম করে আমাদের কাছে, কুৎসিত গাল দেয়, বলে, সে থাকা সত্ত্বেও কঙ্কালসার প্রীতিকে বলাৎকার নিয়মিতই!
প্রতিবার দেখে ফেরার সময় মনে হয় প্রীতির জীবনের অবসান হলেই বরং ভালো, এই ঘৃণ্য কুৎসিত জীবন থেকে ও মুক্তি পেত।
মাস দুই পর ওর জন্য জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে ফিরে আসি চারজন, গত সপ্তাহে প্রীতির চার বছরের দুর্বিষহ জীবনের যবনিকা হয়েছে, প্রীতি বেঁচে গেছে, আমাদেরও সমাপ্তি হলো অপারগতার গ্লানির।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.