বিশুদ্ধতার অন্তর্নিহিত সংযম

স্বাধীনভাবে আকৃতি, গঠন, রং এবং রেখার মধ্যে সুষম কম্পোজিশন ঘটিয়ে শিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দিন অনুভূতি এবং অভিব্যক্তির প্রকাশ করেন তার চিত্রপটে। এই অভিব্যক্তি শিল্পীর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনশীল। নানাসময় যেসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শিল্পী গিয়াস গিয়েছেন, সেটা তার দৃশ্যপটকে নতুন নতুন অনুভূতির সঙ্গে সমন্বিত করে তুলছে।

সভ্যতার মানদণ্ডগুলো তৈরির আগে, প্রাগৈতিহাসিক সময়ের চিত্রকলা থেকে শুরু করে শিল্পের সমস্ত ইতিহাসেই শিল্পচিন্তার যে-ইঙ্গিতগুলো ছিল, বিংশ শতকে পৌঁছে তার মধ্যে একটি মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়। পোস্ট ইম্প্রেশনিজমের আমল পর্যন্ত শিল্পীদের ভাবনাচিন্তা, প্রতীক এবং উপমার আশ্রয়ী হলেও ভাষাগত জায়গায় শিল্পীরা বিমূর্ত ভাষার প্রকরণকে বেছে নেননি। অর্থাৎ শিল্পীরা ‘অবক্তব্য’কে বক্তব্য হিসেবে উপস্থাপন করেননি।

বিংশ শতকে বিমূর্ত চিত্রকলা শিল্পের এই আয়তনকে বিস্তৃত করে তুলল। শুধু ভাষাগত নৈপুণ্য নয়, বরং উপলব্ধির জায়গায় শিল্প নির্ধারিত সত্যের বাইরেও অধরা এক সত্যে পৌঁছাতে চাইল। শিল্পী যেখানে অভিপ্রায় হিসেবে তাঁর আত্নমগ্ন অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করতে শুরু করলেন, যেখানে সরাসরি বস্তুর গাঠনিক প্রক্রিয়া উপস্থাপিত না হয়ে বস্তুকে অবলোকনের দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। শিল্পীর মনোজগৎ প্রকাশিত হতে থাকল আকার, রং আর ফর্মের স্থবিরতার মধ্য দিয়ে, ব্যক্তি তাই আর কংক্রিট ফিগার হিসেবে না থেকে হয়ে উঠলেন সর্বজনীন।

অর্থাৎ বিমূর্ত চিত্রকলা প্রাকৃতিক জগতে একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি, স্থান বা বস্তুকে চিত্রিত করার চাইতে, এমনকি বিশিষ্ট কোনো চিন্তা নির্মাণের প্রয়াসের চাইতে শিল্পীর অনির্ধারিত চিন্তাগুলোকে প্রকাশ করে, এবং চিন্তাও ঠিক নয় বরং অনূভূতির চিত্রায়ণকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। শিল্পী গিয়াসের চিত্রকর্মও তার ব্যতিক্রম নয়।

গিয়াস তাঁর ছবিতে বিমূর্ত শিল্পকলার সাধারণ সূত্রগুলোকে নিজের ভাষা দিয়ে উন্মোচিত করেছেন। বিষয়ভিত্তিক বাস্তবতা বা কংক্রিট রূপ নয়, বরং তিনি তাঁর চিত্রপটকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, যেন দর্শকের ওপরেও সেটার উপলব্ধিগত বিনির্মাণের দায়িত্ব অবশিষ্ট থাকে। দর্শকের মধ্যে গিয়াসের চিত্রপট বিবিধ প্রতিক্রিয়া, বোধ ও তৎপরতা উৎপাদন করে। শিল্পীর সঙ্গে সঙ্গে এখানে দর্শক, দর্শকের মনোজগৎ এবং তার প্রতিবেশ ইত্যাদি নানারকম ভূমিকায় উপস্থিত থাকে। শিল্পী গিয়াস তার কম্পোজিশনে নিজস্ব যে-অনুভূতিমালাকে উপস্থাপন করেন, দর্শক যেন তার চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন অনুভূতির স্বাদও গ্রহণ করতে পারে– গিয়াস সেই সুযোগ রেখে যান। এক্ষেত্রে বলা চলে, তার ছবির মধ্যে দর্শক এক নতুন জগতের সন্ধান পায়, যা দর্শকের মনোজগতে আত্মমগ্নতার আনুক্ল্যূ তৈরি করে।

শিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দিনের চিত্রপট প্রসঙ্গে আরেকটি তাৎপর্যের কথা উল্লেখযোগ্য। নিছক বিমূর্ততা বা অবারিত চিন্তারাশি উৎপাদনের সুযোগ তৈরি নয়, একই সঙ্গে এখানে শিল্পীর অনুভূতিগত নির্মোহ অথবা প্রাণচাঞ্চল্য উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য হিসেবে হাজির থাকে। যা শিল্পীর দর্শকের কল্পনার বিস্তারকে নির্দিষ্ট কিছু ইঙ্গিতেও সীমাবদ্ধ করে। যেমন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বুঝব্যবস্থার জায়গাটিকে শিল্পী তাঁর চিত্রপটে মানবিক সংশ্লেষের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। ফলে দেখা গেছে, এখানে দর্শকের অন্তর্জগত প্রকৃতির সার্বিক মগ্নতার মায়াজালেও আটকা পড়ছে। এই মায়াজাল শিল্পী গিয়াসের ছবিতে চেতন কিংবা অবচেতন দুভাবেই মূর্ত।

গিয়াসের এই ধারা দর্শকের চোখে কখনো অস্পষ্ট, কখনো বা স্পষ্ট অনুভূতিজ্ঞাপক। ব্যক্তিত্ব এবং মেজাজের ওপর নির্ভর করে ব্যক্তিভেদে তা ভিন্ন ভিন্ন হয়। ফলে শিল্পী একই সঙ্গে তাঁর দৃশ্যজগৎ থেকে ‘আদর্শিক চাপ’কেও প্রত্যাহার করে নেন।

দুই

সম্প্রতি শিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দিনের ‘দ্য ওয়ার্ক অব ক্রিয়েশন টু’ শীর্ষক একটি প্রদর্শনী শুরু হয়েছে কামরুল হাসান এক্সিবিশন হল, বেঙ্গল শিল্পালয়ে। এই প্রদর্শনীতে শিল্পী উপস্থাপন করেছেন তাঁর সাম্প্রতিক সময়ের ১৭৫টি চিত্রকর্ম।

মানব ইতিহাসের একটি কঠিন সময়, কোভিড অতিমারিকালে ও তার পরবর্তী বছরগুলোতে শিল্পীর মনোজগৎ কীভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, কিংবা পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে, তার অনুপ্রেরণার উৎসগুলো কী – এসবই দেখার সুযোগ তৈরি হয় এই প্রদর্শনীতে। শিল্পী গিয়াসের এই চিত্রকর্মগুলো আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা প্রদান করে। মলিন আর ধুসরতা নয়, বরং রঙিন আর আলোকিত সময়কেই যেন শিল্পী গিয়াস এখানে ব্যক্ত করতে চান।

বিশ্বের সামগ্রিক এই পরিস্থিতিতে শিল্পী হতাশার অন্ধকার উপস্থাপন করেননি। তিনি হাজির হয়েছেন ইতিবাচক বার্তা নিয়ে। শিল্পীর প্রচলিত আঙ্গিক এবং রূপচেতনার বাইরে এসে তিনি এবার যে চিত্রজমিন নির্মাণ করেছেন, তা নিরীক্ষা করতে চাইছে ইতিবাচক ধারায়। নান্দনিকতার এক গভীর ছন্দ আর সৌন্দর্যের নিবিড় বহিঃপ্রকাশ আছে শিল্পীর এই ছবিগুলোতে।

এই প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলো তিনি কাগজে করেছেন। মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন জলরং, তেলরং, আর কোলাজ। জাপানের ঐতিহ্যবাহী নিহঙ্গা রীতি তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে। বাংলাদেশের নকশিকাঁথা থেকে তিনি পেয়েছেন তেলরঙের জমিন তৈরির অনুপ্রেরণা।

যে-ধরনের বস্তু ও বাস্তবতা দিয়ে আমরা একটি দৃশ্য দেখতে পাই, শিল্পী গিয়াসের চিত্রকর্মকে তা থেকে কিছুটা ভিন্নমাত্রায় আমাদেরকে অবলোকন করতে হয়। যেহেতু তিনি ব্যক্তিগত অনুভব, ধ্যান ও উৎসারিত আবেগকে উপজীব্য করে দৃশ্য নির্মাণ করেন, ফলে তাঁর দেখার ভঙ্গিতে একধরনের বার্ডস আই ভিউ থাকে। তাঁর দৃশ্যে নেই কোনো পথঘাট, কোনো জনমানুষ, গাছ, কলরব বস্তুত নেই, কিন্তু এসব কিছুরই বিকল্প ছবির উন্মোচন ঘটতে থাকে সেখানে। রং আর রেখার যে-বুনট তিনি ছবিতে তৈরি করেন, তাতে জড়িয়ে থাকে শুদ্ধতা। গভীরতা, ব্যাপ্তি, নির্জন শূন্যতা। আর এইসব নিয়ে এক সুগভীর অর্থপূর্ণতা।

শিল্পী গিয়াসের শিল্পদর্শনে জাপান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ কথা উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। দীর্ঘ জাপানজীবন, জাপানের আচার ও

ভূপ্রকৃতির রং ইত্যাদির সন্নিবেশ ঘটেছে তাঁর শিল্পকর্মে।

আমরা গিয়াসের ছবিতে এই ‘বিশুদ্ধ-বিমূর্ত-শিল্প’কে পরিশীলিত, পরিমার্জিত ও পরিমিত রূপে উপস্থিত হতে দেখি। যেখানে শৃঙ্খলা, বিশুদ্ধতা, সরলতা এবং আধ্যাত্মিকতার মতো গুণাবলিও বিশেষভাবে তাৎপর্যশীল। শিল্পী তাঁর চিত্রতল নির্মাণ করেছেন স্বাধীন ও মুক্তভাবে। সাধারণ দৃশ্যশৈলী নয়, দৃশ্য তৈরির সাধারণ প্রক্রিয়া নয়, অন্বেষণের এক নিবিষ্ট সাধনায় শিল্পী গিয়াসউদ্দিন নির্মাণ করে চলেছেন তারে একান্ত শিল্প-অন্তর্জগৎ।