রায়পুরা থেকে ময়মনসিংহ

একত্রিশ

শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে বেশ কয়েকটি বছর অজয় রায়ের কেটেছে বারানসিতে। আগেই বলেছি, অজয় রায়ের বাবা ড. প্রমথনাথ রায় ছিলেন বারানসির হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আন্তর্জাতিক মানের এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এশিয়ার বৃহত্তম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অজয় রায়ও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তবে পিতামাতার অকালমৃত্যুতে পড়াশোনা শেষ না করেই ছোট ভাইবোনদের নিয়ে তাঁকে দেশে ফিরতে হয়েছিল। তাই বারানসির প্রতি আজীবন ছিল তাঁর একটি বিশেষ টান। সময়-সুযোগ পেলেই সেখানে ছুটে যেতেন। দু-চারদিন থেকে, দেখে স্বস্তি নিয়ে ফিরতেন।

সত্তরের দশকের শেষ দিকে তাঁর সঙ্গে আমি প্রথম বারানসি যাই। আর শেষ গিয়েছি ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। তখনই অজয় রায়ের শরীর বেশি ভালো যাচ্ছিল না। তিনি বলেছিলেন, আর হয়তো আমার বারানসি আসা হবে না। ভ্রমণের ধকল শরীর আর নিতে পারছে না। তাঁর আশঙ্কাই সত্য হয়েছে।

অপূর্ব এক শহর এই বেনারস বা বারানসি। অনেকের কাছে এই শহরটি কাশী নামেও পরিচিত। ভারতের উত্তর প্রদেশে গঙ্গা নদীর তীরে এই শহরটিকে পৃথিবীর একটি প্রাচীনতম শহর বলে মনে করা হয়। মার্ক টোয়েন লিখেছেন, বারানসি ইতিহাসের চেয়েও পুরনো, ঐতিহ্যের চেয়েও পুরনো, এমনকি কিংবদন্তির চেয়েও পুরনো।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বেনারস বা কাশী একটি তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। এখানে রয়েছে বিখ্যাত মন্দির। এখানে গঙ্গাস্নান করলে পুণ্যলাভ হয় বলে ধারণা প্রচলিত আছে। ফলে অনেক পুণ্যার্থীর ভিড় এখানে লেগেই থাকে। তাছাড়া স্বাস্থ্যোদ্ধার, কেনাকাটার জন্যও কলকাতাসহ ভারতের অন্য জায়গা থেকে অনেকে নিয়মিত বারানসিতে যাওয়া  –  আসা করেন। নামকরা বেনারসি শাড়ির দোকান কাঞ্জিলালও বাঙালি মেয়েদের সেখানে আকর্ষণ করে। অজয় রায়রা যখন ছিলেন তখন তাঁর কলকাতার আত্মীয়রা তীর্থ, বিয়ের বাজারসহ নানা উপলক্ষে সেখানে গিয়ে সময় কাটিয়েছেন।

অনেক বিশিষ্ট ভারতীয় দার্শনিক, কবি, লেখক, সংগীতজ্ঞ বারানসিতে হয় জন্মগ্রহণ করেছেন অথবা দীর্ঘকাল বসবাস করেছেন। পঞ্চদশ শতকের ভক্তিবাদী কবি কবীরের জন্ম বারানসিতে। রবিদাস, তুলসী দাস, মীরাসহ আরো অনেক ধর্মগুরু, কবি, পর্যটক বারানসিতে জন্মগ্রহণ করেছেন অথবা ভ্রমণ করেছেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীতের জন্মও এই শহরে। সংগীত ও বাদক হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জনকারী পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান, ঠুমরিসম্রাজ্ঞী গিরিজা দেবীর স্মৃতিধন্য এই শহরে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি।

প্রথমবার যখন আমি অজয় রায়ের সঙ্গে বারানসি যাই, তখন তিনি খুঁজে পেতে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। শিবালয় নামক একটি এলাকায় এক সুন্দর দোতলা বাড়িতে আমার শ্বশুর পরিবার নিয়ে বাস করতেন। তাঁর একটি বড় লাইব্রেরি ছিল ওই বাড়ির নিচতলায়। তিনি পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। পড়াশোনা করেই সময় কাটাতেন। তাই লাইব্রেরিতে তাঁর বইয়ের সংগ্রহ ছিল ঈর্ষণীয়। পরে অবশ্য ওই বাড়িটি বেদখল হয়ে যায়। এখন সেখানে বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে।

অজয় রায় আমাকে তাঁর পুরনো আবাস এবং বেড়ে ওঠার জায়গা দেখাতে নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলেছিলেন। তাঁর শৈশব-কৈশোরের কিছু কথা সে-কারণেই জানতে পেরেছিলাম। আত্মপ্রচারে ছিল তাঁর চরম অনীহা। ঢোল পেটানো মনে হয়, তেমন কিছুই বলতেন না। একবার একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। আমার শ্বশুর অজয় রায়ের হাতে টাকা দিয়ে দোকান থেকে মাসকাবারি বাজার আনতে দিয়েছিলেন। দোকান থেকে বাজার আনলেও দোকানে টাকা পরিশোধ করেননি অজয় রায়। পরের মাসে আমার শ্বশুর নিজে দোকানে গেলে দোকানি আগের মাসের বাকি টাকার কথা বলায় আমার শ্বশুর বিস্মিত হন। কারণ তিনি তো টাকা দিয়েছিলেন। টাকা বাকি থাকার কথা জানতে চাইলে অজয় রায় বলেছিলেন, তিনি টাকা দিয়ে একটি ফুটবল এবং নেট কিনেছেন আর অবশিষ্ট টাকা ক্লাবে চাঁদা হিসেবে দিয়েছেন।

আমার শ্বশুর বলেছিলেন, তোমার টাকা লাগলে আমার কাছে চাইতে পারতে। তুমি দোকানে টাকা বাকি রাখায় আমাকে তো ছোট হতে হলো।

অজয় রায় বলেছিলেন, আমি তো কোনো খারাপ কাজে টাকা ব্যয় করিনি। খেলাধুলার জন্যই টাকাটা খরচ করেছি। আমি ভেবেছিলাম, ফুটবল কেনার জন্য টাকা চাইলে তুমি দেবে না। যা হোক, দোকানে বাকি রাখার বিষয়টি বাবাকে জানানো উচিত ছিল বলে অজয় রায় স্বীকার করেছিলেন।

রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টিও অজয় রায় তাঁর বাবার কাছে প্রথমে গোপন রেখেছিলেন। তবে তাঁর মা সব জানতেন। বলা যায়, তাঁর সব কাজে অজয় রায় মায়ের সমর্থন সব সময় পেয়েছেন। সংসার, সন্তানদের সামলানোর ভার ছিল আমার শাশুড়ির ওপর। আমার শ্বশুর যখন ছেলের রাজনীতিতে উৎসাহী হওয়ার কথা জানতে পারেন, তখন বলেছিলেন, আগে পড়াশোনা শেষ করো। শিক্ষা ছাড়া দেশের কাজও করা যায় না। ভারতবর্ষে গান্ধী-নেহেরু, নেতাজী, দেশবন্ধুসহ যাঁরাই রাজনীতি করেছেন, তাঁরা সবাই শিক্ষাজীবন শেষ করেই দেশের কাজে নেমেছেন।

অজয় রায় তাঁর বাবাকে বলেছিলেন, আমি পড়ালেখাও করবো, রাজনীতিও করবো। আবেগতাড়িত না হয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল অজয় রায়ের স্বভাবের অন্তর্গত। তিনি আমৃত্যু এ থেকে বিচ্যুত হননি।

ছেলের দৃঢ় মনোবল দেখে বাবা আর বাধা দেননি। বারানসির সাংস্কৃতিক আবহে বড় হওয়ায় অজয় রায়ের মানসগঠন হয়েছিল উন্নত রুচিবোধের মধ্য দিয়ে। তিনি যে সংস্কৃতিমনস্ক হয়েছিলেন, তা বারানসির পরিবেশ থেকেই পেয়েছিলেন। তাঁদের ঘুম ভাঙতো সানাই-সেতারের মধুর ধ্বনি শুনে।

নানা কারণে বারানসি আমারও ভালো লেগেছে। দশরথ ঘাটে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় সূর্য আবাহন বা বিদায়ের যে  –  আয়োজন তা দেখে চোখ জুড়িয়ে যেতো। বিশেষ করে সন্ধ্যায় পঞ্চপ্রদীপের আলো যখন গঙ্গার জলে প্রতিবিম্বিত হতো, তখন এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের সৃষ্টি হতো। ভজন বা কীর্তনের সুর মনকে মোহিত করতো।

বারানসির রাবরিও আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। কুটিরশিল্পের নানা ধরনের উপকরণের জন্যও বারানসি বিখ্যাত। সেখানকার রেশম, সোনারুপার কাজ করা অলংকার, কাচের চুড়ি, পিতল-তামার বাসনপত্র, কাঠের তৈরি খেলনা  –  সবই খুব আকর্ষণীয়। পান এবং নানা স্বাদের জর্দার জন্যও বারানসি প্রসিদ্ধ ছিল। শিল্পী বারীন মজুমদার পান পছন্দ করতেন। আমি দু-একবার তাঁর জন্য পান-জর্দা এনেছি বারানসি থেকে।

বারানসি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটাও আমার খুব ভালো লেগেছিল। কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই এটা বেশি পরিচিত। দ্বারভাঙ্গার মহারাজা রামেশ্বর সিংহ, মদন মোহন মালব্য, সুন্দর লাল প্রমুখের উদ্যোগে ১৯১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেকটা শান্তিনিকেতনের মতোই পরিবেশ। মূল ক্যাম্পাস ১ হাজার ৩০০ একর জমিজুড়ে অবস্থিত। নরেশপ্রভু নারায়ণ সিংহ নামে এক ব্যক্তি এই জমি দান করেছেন।

খোলামেলা পরিবেশ। ভবনগুলো সব একতলা, সুদৃশ্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শ্বশুর যখন অধ্যাপনা করতেন, তখন উপাচার্য ছিলেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান, বিখ্যাত দার্শনিক, যিনি পরে ভারতের রাষ্ট্রপতির পদও অলংকৃত করেছিলেন। আমার শ্বশুরের মৃত্যুর পর তাঁর সংগৃহীত সব বই এই বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করা হয়েছিল। তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির নামকরণ করা হয়েছে ‘ড. প্রমথনাথ রায় লাইব্রেরি’। অজয় রায়ের সঙ্গে গিয়ে ওই লাইব্রেরিও আমি দেখে এসেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।

আমার ছেলে অমিতাভ নরেন্দ্রপুরে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফুটবল টিমের একজন খেলোয়াড় ছিল। সে ভালোই খেলতো। প্লেয়ার হিসেবেও তার সুনাম ছিল।  একবার তাদের টিম বারানসি বিশ্ববিদ্যালয় টিমের সঙ্গে খেলতে গিয়ে ট্রফি জিতেছিল। তার দাদু এবং বাবার স্মৃতিবিজড়িত ওই ক্যাম্পাসে গিয়ে অমিতাভ খুবই উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। তারপর খেলায় জিতে ট্রফি পেয়ে সেই খুশির মাত্রা আরো বেড়ে গিয়েছিল। পুত্রের আনন্দে পিতা অজয় রায়ও তাঁর আনন্দ গোপন রাখতে পারেননি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে পরে তিনি একাধিকবার বারানসি গিয়েছেন। নস্টালজিয়া তাঁকে পেয়ে বসেছিল।

অজয় রায় শেষদিকে কলকাতা যেতেও পছন্দ করতেন। বছরে অন্তত দুবার তাঁর কলকাতা যাওয়া হতো। ডাক্তার দেখানো ছাড়াও বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সান্নিধ্য তিনি পছন্দ করতেন।

আমি চাকরির কারণে ছুটিছাটার সমস্যায় সব সময় তাঁর সঙ্গে যেতে পারতাম না। তিনি একাই যেতেন এবং ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও বেশ সময় কাটাতেন। জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর সঙ্গেও দেখাসাক্ষাৎ করেছেন। তাঁরা পূর্বপরিচিত ছিলেন। সে-সুবাদে অজয় রায় কলকাতা গিয়ে সরকারি অতিথিশালায় থাকারও সুযোগ পেয়েছেন। সিপিএম নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত ছাড়াও আরো অনেক কমিউনিস্ট নেতা এবং বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। বিদ্যাসাগর পরিবারের সদস্য গৌতম চট্টোপাধ্যায়, নৃপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসূন মজুমদারসহ আরো অনেকের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। এঁদের সঙ্গে আড্ডা, রাজনৈতিক আলোচনা করতে উৎসাহ বোধ করতেন। বারানসির বন্ধুদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল চলচ্চিত্র  –  পরিচালক পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনিও কলকাতায় থাকতেন।

এই বন্ধুদের সঙ্গে হয় কলকাতায়, না হলে শান্তিনিকেতনে গিয়েও গল্প করে তিনি আনন্দ পেতেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি দেশ ছাড়লে না, আত্মীয়দের ছাড়লে। এখন এতো কলকাতার প্রতি টান কেন? শুধু আত্মীয়  –  বন্ধু সান্নিধ্য, নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?

ছোট্ট জবাব দিয়েছিলেন, দেশে কথা বলার মতো লোক কমে গেছে।

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয় এবং দেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তারে তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন। রাজনীতি বা অন্য বিষয়ে কথা বলার মতো চিন্তাভাবনা করার মানুষও কমে আসায় তিনি কিছুটা নিঃসঙ্গ বোধ করতেন। আমৃত্যু বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন, তবু অনেক কিছু মানতে পারতেন না, অনেক কিছুর সঙ্গে নিজেকে মানিয়েও নিতে পারতেন না। তাই কলকাতায় গিয়ে আত্মীয় এবং প্রগতিমনা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, কথা বলে এবং ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে শেষজীবনে ভালো বোধ করতেন। শান্তিনিকেতন গেলে তিনি পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’তে যেতে ভুল করতেন না। সেখানে মূলত মেয়েদের উদ্যোগে রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে নানা কৃষিপণ্য উৎপাদিত হতো। গরুর খাঁটি দুধ এবং ঘিসহ দুগ্ধজাত সামগ্রী পাওয়া যেতো সুলভমূল্যে।

স্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেখানে মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া, নাড়ু, দইসহ টাটকা সব খাবার বিক্রি করতো মেয়েরা। কলকাতা থেকে অনেকেই সেখানে গিয়ে কলাপাতা বা শালপাতায় পরিবেশিত সেসব খাবার পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেতেন। অনেক বিদেশিরও আনাগোনা ছিল বঙ্গলক্ষ্মীতে। প্রসূন মজুমদার বা অন্য কারো সঙ্গে শান্তিনিকেতনে গেলে অজয় রায় বঙ্গলক্ষ্মীতে অবশ্যই ঢুঁ মারতেন। ওখানকার গল্প করতেন দেশে ফিরে। জায়গাটি যে তাঁর পছন্দের সেটা বেশ বুঝতে পারতাম।

ভাইফোঁটার সময় কলকাতা যাওয়াও অজয় রায় নিয়ম করে ফেলেছিলেন। সল্টলেকে তাঁর ছোট ভাই বরুণ রায়ের একটি বেশ বড়সড়ো বাড়ি ছিল। সেখানে ভাইবোনরা ভাইফোঁটা উপলক্ষে একত্র হতো। দুই বোনই সব খরচ বহন করতো। অজয় রায় পরিণত বয়সে এসে ভাইবোনের এই আদর-ভালোবাসা উপভোগ করতেন। মজা পেতেন। জীবনের একটি বড় সময় জেলজুলুমে কাটিয়ে শেষদিকে এসে কেমন স্নেহ-ভালোবাসার কাঙাল হয়েছিলেন।

ননদ-দেবররা আমাকেও যাওয়ার জন্য আবদার করতো। আমি অফিস থেকে ছুটি না পাওয়ায় যেতে পারতাম না। বলতাম, আমার জন্য চিতল মাছের পেটি এবং মুইঠা তরকারি জোগাড় করে রেখো, আমি সময় পেলে যাবো এবং খেয়ে আসবো।

মামাতো বোনেরাও তাদের বাড়িতে অজয় রায়কে না নিয়ে ছাড়তো না। অজয় রায় ছিলেন সবার প্রিয় ‘চুনিদা’। আমার মামিশাশুড়ি বলতেন, চুনি আমাদের পরিবারের আদরের বড় ছেলে। ওর মতো কৃতী সন্তান কয়টি পরিবারে হয়? আমি মামির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, চুনি নাম কেন হলো? মামি বললেন, আমার শাশুড়ি কল্যাণী রায়ের ডাকনাম ছিল চিনি। চিনির বড় ছেলে বলেই হয়তো চুনি নাম দেওয়া হয়েছিল। চুনি আসলে লাল রঙের এক প্রকার দামি পাথর। অজয় রায় ছিলেন আত্মীয়  –  পরিবারের কাছে রত্নের মতোই। অত্যন্ত মেধাবী ও মননশীল মানুষ অজয় রায় রাজনীতি ও লেখালেখিতে তাঁর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি কি পেয়েছেন?

বত্রিশ

জননী এবং জন্মভূমি ছিল অজয় রায়ের কাছে স্বর্গের চেয়েও বড়। নিজের জন্মদাত্রী মায়ের সেবা করার সুযোগ তাঁর হয়নি। অজয় রায়ের বাবা এবং মা দুজনই মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে মৃত্যুবরণ করেন। অজয় রায় তখন কেবল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তাঁর বাবা, আমার শ্বশুর মারা গিয়েছিলেন খাদ্যে বিষক্রিয়ায়। রাতে খাবার খেয়ে ফুড পয়জনিং হয়। তাঁকে আর বাঁচানো যায়নি। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে কীভাবে সংসার চালাবেন, সে-দুর্ভাবনায় আমার শাশুড়ি সম্ভবত খুব অসহায় বোধ করতেন। অধ্যাপনা ছাড়া আমার শ্বশুর আর কিছু করতেন না। ফলে মৃত্যুকালে হয়তো তেমন কোনো সঞ্চয় রেখে যাননি। তাই তাঁর মৃত্যু হলে ছেলেমেয়েকে কীভাবে মানুষ করবেন, সেটা ভেবে ভেবে আমার শাশুড়ি খুব কষ্ট পেতেন। শাশুড়ির শরীর ভেঙে যেতে থাকে। তিনি শোকতাপ সইতে পারছিলেন না। কয়েক মাসের মধ্যে তিনিও এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। তাঁর জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থাও হয়তো করা সম্ভব হয়নি। প্রচণ্ড আত্মসম্মান বোধ থেকে তাঁরা আত্মীয়স্বজনের কাছেও সমস্যার কথা তুলে ধরেননি। বাবা-মায়ের বিদায় অজয় রায়ের জন্য এক বড় ধাক্কা ছিল। তিনি বারানসি ত্যাগ করে অসহায় ভাইবোনদের নিয়ে কিশোরগঞ্জের বনগ্রামে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন।

অজয় রায় বাবার কথা মাঝে মাঝে বললেও মাকে নিয়ে খুব একটা মুখ খুলতেন না। মায়ের প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি চুপ করে থাকতেন। মায়ের জন্য কিছু করতে না পারার একটি দুঃখবোধ সম্ভবত তাঁকে কুরে কুরে খেতো। মায়ের জন্য তাঁর গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। তাঁর মা-ই তাঁকে কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছিলেন।

কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?

মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর।

রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,

আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনই পুড়িতে হয়।

প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে

স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়েঘরে।

এই কবিতাটি মায়ের কাছ থেকে তিনি একাধিকবার শুনে মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। মায়ের জন্য কিছু করতে না পারার গোপন ব্যথা অজয় রায় আজীবন বহন করেছেন। 

আমি অনেক পরে জেনেছি, মানুষের বিপদের কথা শুনলে অজয় রায় যে-কষ্ট পেতেন, তাদের জন্য কিছু করার জন্য বিচলিত হয়ে উঠতেন, সেটা ওই মাতৃভক্তি থেকেই। প্রথমদিকে তাঁর নিজেরই তেমন কোনো আর্থিক স্থিতি ছিল না বলে কাউকে হয়তো টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারতেন না। পরে আমার ছেলেমেয়ে ভালো চাকরি, আয়-উপার্জন শুরু করলে তারা বাবার জন্য নিয়মিত টাকা পাঠাতো। অজয় রায় তখন গোপনে অনেককেই চিকিৎসা কিংবা সন্তানের পড়ালেখার জন্য আর্থিক সহায়তা করেছেন। এ-কারণে তিনি অনেক মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছেন। নব্বইয়ের দশকের দিকে কলকাতায় যাওয়া  –  আসা বাড়লে সেখানেও কিছু মানুষের সঙ্গে তাঁর এমন হার্দ্যকি সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, যা জেনে আমি বিস্মিত। অজয় রায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে তাদের কেউ কেউ হাউমাউ করে কেঁদেছে। তারা সবাই তাঁর বয়োকনিষ্ঠ ছিল, কেউ কাকা বলতো, আবার দাদাও বলতো। সবাই তাঁর আপনজন হয়ে উঠেছিল। তাদের দু-একজন এখনো আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। এর মধ্যে শাহজাহান এবং আলী আকবরের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। তারা দুজনই নরেন্দ্রপুর মিশনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করেছে। শাহজাহান সিপিএমের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। তার বোনের ছেলে বাবন তো অজয় রায় কলকাতা গেলে পারলে তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে থাকতো। বয়সের কারণে একা পথেঘাটে চলতে অসুবিধা হবে মনে করে বাবন তাঁর কাকার সঙ্গে প্রহরীর মতো লেগে থাকতো। আলী আকবর রাজনীতি না করলেও উদার, অসাম্প্রদায়িক মনের মানুষ। ছবি আঁকে, ভালো শিল্পী। বয়সের অনেক তফাৎ থাকা সত্ত্বেও তারা ছিল অজয় রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো।

কলকাতা গেলে অজয় রায় পাহাড়ি এলাকায় বেড়াতে পছন্দ করতেন। প্রসূনদা, নৃপেনদা বা অন্য কাউকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বের হতেন। কলকাতার বন্ধুরাই গাড়ির ব্যবস্থা করতেন। মঞ্চনাটক এবং ভালো সিনেমা দেখারও তাঁর আগ্রহ ছিল। এসব দেখার জন্যও তিনি কলকাতার প্রতি টান অনুভব করতেন।

অজয় রায় ছিলেন প্রচণ্ড আশাবাদী মানুষ। তিনি হবে না শুনতে চাইতেন না, সব সময় বলতেন ‘হবে’। তারপরও তাঁর কি অতৃপ্তি বা বেদনাবোধ ছিল না?  ছিল। যে-বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখতেন, তা দেখে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর চার রাষ্ট্রীয় নীতির সমর্থক ছিলেন বলেই অসাম্প্রদায়িক সাম্যভিত্তিক একটি সোনার দেশের জন্য কাজ করে গেছেন সারাজীবন। তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল সমাজতন্ত্র। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন তাঁকে ভীষণভাবে আহত করেছিল। তত্ত্বের কঠিন বন্ধন থেকে কিছুটা মুক্ত হয়ে সবাই মিলে এক থেকে সাম্য চিন্তা করার জন্য তিনি আকুল ছিলেন। কিন্তু তাঁর চেষ্টা সফল না হয়ে পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার পর তিনি মানসিক পীড়নের মধ্যে ছিলেন। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারতেন না, ছটফট করতেন, দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলতেন। 

কমিউনিস্ট পার্টির বিভক্তি তাঁর মধ্যে নতুন চিন্তার স্ফুরণ ঘটায়। তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে ঘরে বসে থাকার মানুষ ছিলেন না। কাজ করা ছিল তাঁর কাছে নেশার মতো। সংকীর্ণ দলীয় বৃত্ত ভেঙে একটি বৃহত্তর প্লাটফরমের মাধ্যমে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। জঙ্গিবাদী তৎপরতা বেড়ে গেলে জঙ্গিবাদবিরোধী মঞ্চের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। দেশের যেখানেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতো, সেখানেই তিনি ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর কোনো অন্যায়-অবিচার হলে তার প্রতিবাদ করতেন। দেশের শীর্ষ স্থানীয় বুদ্ধিজীবী এবং মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ, ড. আনিসুজ্জামান, ডা. হায়াৎ মামুদ, ড. অজয় রায়, ডা. সারওয়ার আলী, সুলতানা কামালসহ অনেকের সঙ্গেই তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। রোজ সকালে অনেককে ফোন করতেন। কোথাও খারাপ কিছু ঘটলে, হোক সেটা রামুতে বৌদ্ধদের ওপর হামলা, কিংবা নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার, কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতা, বা  অন্য কোনো উপায়ে মানবাধিক হরণের ঘটনা  –  অন্তত বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানানোর চেষ্টা করতেন। রাজনীতিতে বিভেদ ও অনৈক্য বাড়তে থাকায় তিনি উদ্বেগবোধ করতেন। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে একমত না হয়েও অনেকে তাঁর নিষ্ঠার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বাম ঘরানার বাইরেও কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, পরামর্শ নিতেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে অজয় রায়ের ভালো সম্পর্ক ছিল। সৈয়দ আশরাফ তাঁকে সম্মান করতেন। দেখাসাক্ষাৎ কম হলেও টেলিফোনে তাঁদের কথা বলতে আমিও অনেক দেখেছি।

অজয় রায় খুব নিয়ম মেনে চলতেন। সময় মেনে চলা ছিল তাঁর একটি বড় গুণ। নিয়মিত পড়াশোনা করতেন, লেখালেখি করতেন। কতজনের সঙ্গেই না কত বিষয়ে কথা বলতেন।

মা এবং দেশ ভক্ত অজয় রায়ের একটি প্রিয় গান ছিল :

বাংলার মাটি, বাংলার জল,

বাংলার বায়ু, বাংলার ফল,

পুণ্য হউক, পুণ্য হোক, পুণ্য হউক হে ভগবান।

তিনি এই দেশকে এবং দেশের মাটিকে ভালোবাসতেন। তাই দেশত্যাগী হননি। মাটি কামড়ে থেকেছেন। মৃত্যুর আগে তাই তিনি বলেছিলেন, ‘আমার এই দেহটি বাংলার মাটিতেই মিশিয়ে দিও।’ দেহটি পুড়িয়ে ছাই না করে তা মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের জন্য দান করার কথাও তিনি ভেবেছিলেন। জটিল আনুষ্ঠানিকতার জন্য তা সম্ভব হয়নি। তবে দেশজননীকে ভালোবেসে দেশের মাটিতেই নিয়েছেন শেষশয্যা।

তেত্রিশ

আমি দুবার সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। অজয় রায় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার সুবাদে আমি দুবার তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র দেখেছি, সেদেশের মানুষের সঙ্গে সামান্য হলেও মিশতে পেরেছি। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সোভিয়েত জনগণের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছিল, তা বোঝার চেষ্টা করেছি। আমরা ছিলাম সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির অতিথি। ভিআইপি মর্যাদা দিয়ে আমাদের যাওয়া-আসা এবং থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাশিয়া শীতপ্রধান দেশ হওয়ায় মস্কো যাওয়ার আগে আমাকে গরম কাপড় সংগ্রহ করতে হয়েছিল। আগে মস্কো গিয়েছেন এমন কারো কাছ থেকে একটি ওভারকোটও নিয়েছিলাম। অজয় রায় আগেও মস্কো গেছেন, তাই তাঁর শীতবস্ত্র ছিল। 

মস্কোতে আন্তর্জাতিক মানের হোটেলে আমাদের থাকা-খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ বিশেষ দর্শনীয় স্থান দেখারও ব্যবস্থা ছিল। সবমিলিয়ে রাজকীয় ব্যবস্থাই বলতে হবে। সেদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়িত্বে ছিলেন কমরেড বাইদাকভ। তিনি আমাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখতেন। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত একজন দোভাষী আমাদের সঙ্গে থাকতেন। আমাদের দোভাষী মেয়েটি দেখতে-শুনতে বেশ সুন্দরী এবং চটপটে ছিলেন। তিনি অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন দোভাষীর কাজ করতেন। বাংলাটা তিনি মোটামুটি ভালোই রপ্ত করেছিলেন।

মস্কোতে তখন অনেক বাঙালি ছেলেমেয়ে পড়তে যেতো। কেউ কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে, কেউ বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির পক্ষ থেকে, কেউ আবার সরকারি বৃত্তি নিয়েও পড়তে যেতো। এই বাঙালি ছাত্রীরাও দেশ থেকে কেউ বেড়াতে গেলে তাঁকে সঙ্গ দিতে পছন্দ করতো। এতে তারা বাংলায় কথা বলার সুযোগ যেমন পেতো, তেমনি দেশের খবরাখবরও জানতে পারতো। আমরা অনেক বাঙলি ছাত্রের সহযোগিতা পেয়েছি। অজয় রায় নেতা এবং একজন লেখক হওয়ায় তাঁর প্রতি সবারই অন্যরকম শ্রদ্ধাবোধ ছিল। একতা পত্রিকা সেখানে যেতো। তাই অজয় রায়ের লেখালেখির সঙ্গে বাঙালি ছাত্রদের পরিচয় ছিল।

নিসর্গপ্রেমী এবং লেখক দ্বিজেন শর্মাও তখন মস্কোতে ছিলেন। তিনি বিখ্যাত প্রগতি প্রকাশনীতে চাকরি করতেন। রুশ ভাষার বিখ্যাত অনেক বই তিনি অনুবাদ করেছেন। প্রগতি প্রকাশনীর বই বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় ছিল। মস্কো  থাকাকালে প্রায় সন্ধ্যায় আমরা তাঁর বাসায় আড্ডা দিতাম। নানা বিষয়ে সেখানে প্রাণবন্ত আলোচনা হতো। এসব আড্ডা, আলোচনা অজয় রায় খুব উপভোগ করতেন।

মস্কো ছাড়াও আমরা আরো কিছু জায়গায় গিয়েছি। এর মধ্যে আরজারবাইজানের রাজধানী বাকু আমার খুব ভালো লেগেছে। কাস্পিয়ান সাগরের উপকূলে অবস্থিত বাকু একটি প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ নগরী। বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বাকু প্রসিদ্ধ। সমুদ্রপথে ব্যবসা করতে ভারত থেকেও অনেকে বাকুতে গিয়েছেন। জৈন সম্প্রদায়ের কিছু ব্যবসায়ী সেখানে স্থায়ীভাবে বসতিও গড়েছেন। তেল পরিশোধন বাকুর প্রধান শিল্প। রাশিয়ার তেলশিল্পের কেন্দ্র হিসেবে তখন বাকু পরিচিতি পেয়েছিল। তাছাড়া তুলা, চামড়া এবং খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতের কারখানাও ছিল অনেক। বাকুতে বিভিন্ন মসলা এবং পেস্তাবাদামও প্রচুর পাওয়া যায়। 

জরুথুষ্ট্র, আরবি, পারসিক এবং রুশ সংস্কৃতির মিশ্রণে গড়ে উঠেছিল একটি চমৎকার সভ্যতা। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বাসের কারণে বাকুতে সুদৃশ্য মিনার এবং মসজিদও দেখেছি। আজারবাইজান ১৯২০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর বাকুর উন্নতি হয়েছিল চোখে পড়ার মতো। সেখানকার অপেরা ভবন, নাট্যমঞ্চ, জাদুঘর, পাতালরেল  –  সবই দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতো। আমাদেরও করেছিল। জাদুঘরে পুরনো ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে সংরক্ষিত খানদানি হুঁকা, তাকিয়া, সুদৃশ্য কার্পেট আমার নজর কেড়েছিল।

বাকুতে আমাদের জন্য প্রচুর আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল। সুপেয় ও রঙিন শরবতের কথা যেমন কোনোদিন ভুলবো না, তেমনি মুরগির রোস্ট ও বিরিয়ানির স্বাদও জিভে লেগে আছে আজো। ওদের খাবার অনেকটা পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো।

বাকুতে আমরা একটি মসজিদ দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানকার একজন কর্মকর্তা অজয় রায়কে তাঁদের ঐতিহ্যবাহী একটি আলখাল্লা জাতীয় পোশাক উপহার দিয়েছেন। মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া হয় কি না এবং কত সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হন, সেটা অবশ্য আমি জানতে চাইনি।

আমরা কৃষ্ণসাগরের পাড়ে একটি স্বাস্থ্যনিবাসেও দিনসাতেক ছিলাম। পূর্ব ইউরোপ, ককেসাস ও পশ্চিম এশিয়া দ্বারা বেষ্টিত ব্ল্যাক সি বা কৃষ্ণসাগর তীরে আমার খুব ভালো লেগেছিল। কৃষ্ণসাগরের জল খুব শান্ত। বিভিন্ন দেশ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির অতিথিরা রাশিয়া গেলে তাঁদের কৃষ্ণসাগরপাড়ের স্বাস্থ্যনিবাসে দিন কয়েক রেখে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা হয়। একবার ঠান্ডা জল আবার গরম জলে ভিজিয়ে ওয়াটার থেরাপির মাধ্যমে শরীরকে চাঙ্গা করার ব্যবস্থা আর কোথাও আছে কি না, আমি জানি না। কৃষ্ণসাগরের তীরে শান্ত জলে নেমে ছেলেমেয়েরা সাঁতার কাটে। ওয়াটার ব্যালে নামের নৃত্যে অংশ নেয়। বল নিয়ে জলে খেলা করে। অজয় রায় সাঁতার জানতেন না। তবে আমি কৃষ্ণসাগরের জলে সাঁতার কেটেছি।

এক রাতে আমাদের আবাসস্থলের রুমের জানালা দিয়ে হঠাৎ বাইরে চোখ গেলে একটি অপূর্ব দৃশ্য আমার চোখে পড়ে। জ্যোৎস্নার আলো সাগরের জলে এমনভাবে ভাসছে যে, মনে হলো রাত নয়, দিন। স্পষ্ট দেখলাম একটি মেয়ে তীরে বসে জলে পা ডুবিয়ে আছে। জ্যোৎস্নার আলো মেয়েটির ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। অমন দৃশ্য আমি আর দেখিনি।

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে ওই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়। আমি আমাদের দোভাষীকে রাতে দেখা ছবির মতো ঘটনাটি বলি। দোভাষী ওই মেয়েটিকে সেটা জানান। মেয়েটি তখন লাজুক হেসে বলে, সে সাঁতার জানে না বলে লজ্জায় দিনের বেলা সাগরতীরে না গিয়ে রাতে একাকী জলের সৌন্দর্য দেখতে গিয়েছিল। মেয়েটি মঙ্গোলিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।

লেনিনগ্রাদে গিয়েও আমার ভালো লেগেছিল। সুন্দর ছিমছাম সাজানো শহর। বাল্টিক সাগরের অন্তর্গত ফিনল্যান্ড উপসাগরের মাথায় নেভা নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরটির আগের নাম ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ। ১৯২৪ সালে এর নাম বদলে লেনিনগ্রাদ করা হয়। এটি রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ রুশ সমুদ্রবন্দর। এটি ইউরোপের একটি প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। নরওয়ের কাছাকাছি হওয়ায় এখানেও রাতের পরিধি কম। আনুমানিক চার ঘণ্টা রাত থাকে। ১৯১৮ সাল পর্যন্ত রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ। তারপর মস্কোতে রাজধানী সরানো হয়।

মস্কোতে অবস্থানকালে খাওয়া নিয়ে আমার সমস্যা ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার বলে গণ্য ক্যাভিয়ার আমার মোটেও ভালো লাগেনি। ক্যাভিয়ার এক ধরনের সামুদ্রিক মাছের ডিম, যা অত্যন্ত দামি। এই ডিমকে নোনা জল এবং চাটনিতে রসিয়ে প্যাকেটজাত করে তবেই পরিবেশন করা হয়। অজয় রায়ের খুব পছন্দ ছিল ক্যাভিয়ার। কিন্তু আমার মুখে কেন যেন এটি রুচতো না। আমি বরং পাউরুটি এবং ডিমের অমলেট পছন্দ করতাম। ওখানে মাখনের বেশি ব্যবহার দেখেছি। সকাল, দুপুর, রাত সব সময়েই খাবার আইটেমে মাখন কমন থাকতো। তাছাড়া ছিল আলু এবং প্রচুর সালাদ। জুস এবং চকলেটও থাকতো।

রাশিয়ায় গিয়ে আমরা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুফল দেখার চেষ্টা করতাম; কিন্তু আমাদের চলাচল, দেখাশোনা সবই পূর্বনির্ধারিত এবং নিয়ন্ত্রিত বলে আমার মনে হয়েছে। বিদেশি অতিথিদের কেনাকাটার দোকানগুলোতে রাশানদের ঢুকতে দেওয়া হতো না বলে শুনেছি। বিদেশি এবং দেশিদের জন্য পণ্যের দাম এবং মানও একরকম ছিল না বলে আমার কানে এসেছিল। এ-ব্যাপারে খুব বেশি কৌতূহলী না হওয়ার পরামর্শ আমাকে অজয় রায় আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। 

ওখানে লোকজনকে কিছুটা চাপা স্বভাবের বলে মনে হয়েছে। বাঙালিদের মতো তারা আড্ডাপ্রিয় নয়। সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তবে মস্কোতে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি কর্মমুখর এবং হাসিখুশি দেখেছি। দোভাষীর মাধ্যমে এ  –  ব্যাপারে জানতে চেয়ে যেটুকু জানতে পেরেছিলাম তা হলো, মেয়েরা ঘরের কাজ এবং বাইরের কাজে যতটা চটপটে ও স্বতঃস্ফূর্ত, ছেলেরা তা নয়। ছেলেরা ঘরের কাজ না করে সন্ধ্যায় ভদকা খেয়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করতো।

আমরা শহরাঞ্চলের বাইরে কিছু জায়গায়ও গিয়েছি। কৃষি খামার দেখেছি। সেসব জায়গায় হাসিমুখেই আমাদের বরণ করা হয়েছে। মানুষ খুব অভাব বা দারিদ্র্যের মধ্যে আছে বলে মনে হয়নি।

মেয়েদের প্রতি সেখানে কারো কোনো নেতিবাচক মনোভাব দেখিনি। গর্ভবতী এবং বয়স্ক নারীদের প্রতি বিশেষ মনোযোগের বিষয়টি আমার নজর এড়ায়নি। ছোট ছোট বাচ্চার প্রতিও সবার ভালোবাসা ছিল। মস্কোতে সামারে থাকতো ফুলের সমারোহ। ফুলের প্রতি যেমন ছিল রাশানদের ভালোবাসা, তেমনি ফুলের মতো শিশুদের জন্যও ছিল বুক উজাড় করা ভালোবাসা। কোনো শিশুকে কাঁদতে দেখলে অপরিচিত মানুষকেও বিচলিত হতে দেখেছি। 

মস্কোতে যাবো অথচ ব্যালে নৃত্য দেখবো না, তা কি হয়। বিশেষ করে আমরা ছিলাম ভিআইপি গেস্ট। কমিউনিস্টশাসিত দেশে কমিউনিস্ট পার্টির অতিথি। অ্যারোফ্লোতের আরামদায়ক আসনে আসা-যাওয়া ছাড়াও মনোরঞ্জনের কোনো আয়োজনই বাদ থাকতো না। আমি মুগ্ধ হয়ে ব্যালে নৃত্য দেখে চোখ জুড়িয়েছি। আবার নানা দেশ থেকে আসা কমিউনিস্ট পার্টির অতিথিদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগও পেয়েছি। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে যাওয়া প্রতিনিধিদের সঙ্গে একধরনের বন্ধুত্বও তৈরি হয়েছিল। তাঁরা আমাকে নিজ নিজ দেশে ভ্রমণের আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। তবে কারো আমন্ত্রণই রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। না হোক সেটা, জীবনে যা পেয়েছি তা কম কিসে! (চলবে)