শিল্পী মিজানুর রহিমের একক চিত্রপ্রদর্শনী ‘সৃজনে প্রত্যাবর্তন’

বয়স এখনো তাঁর টানটান তারুণ্যের রাশ টানতে পারেনি! আটাত্তরেও তিনি নবীন শিল্পীর মতো নতুন নতুন ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলাদেশের নদী, বৃষ্টির মুখরতা, তুলোট মেঘ ও মেঘের মেদুরতা, আকাশের নীল আর নিসর্গের স্নিগ্ধ সবুজ!

আশ্চর্য, এসবেই থেমে থাকা নয় – তাঁর চিত্রকর্মে আমরা আরো দেখতে পাই নদী আর আকাশের মাখামাখি দিগন্ত, গোধূলিবেলার রক্তিম আকাশ ও জলাধার, সমুদ্রের ফেনিল কল্লোল, নিরেট পাথরের কাঠিন্যে সৌন্দর্য অন্বেষণ! শেষোক্ত কাজ করেছেন শিল্পী তাঁর অস্ট্রেলিয়ার পর্বতগৃহের ইমেজ নিয়ে।

এতসব বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পেলাম শিল্পী মিজানুর রহিমের চিত্রপটে, ঢাকার গ্যালারি চিত্রকে আয়োজিত তাঁর একক চিত্রপ্রদর্শনীতে। গত ২৮ জুন থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত এই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে।

মিজানুর রহিম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন, ডিন হয়েছেন।

চারুশিল্পের একজন শিক্ষক হিসেবে অ্যাকাডেমিক কাজ ও শিক্ষাদানে ছিল তাঁর ব্যস্ততা।

১৯৪৬ সালে তাঁর জন্ম ময়মনসিংহে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছোট ভাই জাহিদুর রহিমের পুত্র।

তিনি ঢাকার তৎকালীন চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে চিত্রকলায় স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৭১ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে।

তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত লিথোগ্রাফিতে বিশেষ শিক্ষা নেন বেলজিয়ামের অন্টার্পের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস থেকে। দেশে ফেরার পর সেই আশির দশকেই তাঁর লিথোগ্রাফি ছাপচিত্র মাধ্যমের চিত্রকর্মের একটি প্রদর্শনী হয়েছিল ঢাকায়। সেই প্রদর্শনী আমি দেখেছি তখন। যেসব চিত্রকর্ম দেখেছি তাঁর, সেগুলোর কতক ছিল ফিগারেটিভ এবং কতক ছিল ব্রান্টসিয়েনা ও কালচে বর্ণের সঙ্গে কাগজের সাদার মধ্যে আলোছায়ার মায়াবী খেলা। এসব চিত্রকর্মের কতক নমুনা এবারের প্রদর্শনীতেও জায়গা পেয়েছে।

শিল্পী মিজানুর রহিম ১৯৮০ সালে দেশে ফিরে তাঁর কর্মস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং ২০১০ সালে সেখান থেকে অবসর নিয়ে ২০১২ সালে ঢাকার বেসরকারি শান্ত মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ডিন হয়ে ২০১৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকেন।

দীর্ঘ বিরতির পর পুত্র ও পুত্রবধূর তাগিদে মাত্র দুই বছর ধরে ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রং নিয়ে সৃজনে মেতে উঠেছেন। ৪২ গুণিতক ৪৮ এবং ৪২ গুণিতক ৪২ ইঞ্চির বড় ক্যানভাসে কাজ করেছেন। বড়মাপের ক্যানভাসে আঁকা চিত্রকর্মগুলোর বেশিরভাগ এ-বছরের কাজ এবং এগুলো মোটা ব্রাশে নানা বর্ণ নিয়ে শিল্পীর স্বাধীন খেলার মতো করে আঁকা বর্ণিল বিন্যাস। শিরোনাম দিয়েছেন – প্রিজম অব পসিবিলিটিস, চেজিং রেইনবোজ, হিউজ অব হোপ, ভারমিলিয়ন ভরটেক্স, এনহানটেড মিডোজ, দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড প্রভৃতি। শেষোক্ত চিত্রটি যেন কোনো এক পাহাড়ের গুহাগাত্র থেকে আলো ফোটার আগে দেখা নিচের জমিন আর উপরের আকাশের দৃশ্য! ‘এনহানটেড মিডোজ’ চিত্রে সবুজ বর্ণের চমৎকার প্রয়োগে যে স্নিগ্ধতার আবেশ তৈরি করেছে তাতে দর্শকের চোখ জুড়িয়ে যায়।

প্রকাশবাদী বিমূর্ততার প্রকাশ-ধরন থেকে বাস্তবতায় উঁকি দেওয়া কিছু ছবিও লক্ষ করা গেল। যেমন – পিসফুল পারসিসটেন্স, পিন্যাকল অব সলিট্যুড, লস্ট ইন দ্য মেইজ প্রভৃতি।

২০২৩ সালে আঁকা আনুভূমিক আয়তাকার কিছু কাজে নিসর্গদৃশ্য দেখা যায়। তুলির সঙ্গে স্পেচুলার ব্যবহার করে এঁকেছেন বলে টেক্সচার এসেছে এবং খানিকটা দূর থেকে দেখে প্রকৃতির বৈভবকে উপলব্ধি করা যায়। বাস্তবিক ধরনের এসব কাজে শিল্পী সমতল বাংলার জীবন ও সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন যেন জলরঙে আঁকা কাজের ন্যায় দ্রুততায়। এসব কাজের মধ্যে আছে – ওশান এমব্রেস, ট্রানকুয়িল হরাইজন, রুরাল সেরেনাদে, হুইসপারস অফ ওয়াইল্ড, টাইডাল মরোস, মর্নিং ভিউড্রপস, ফলেজ ফ্যান্টাসি, মার্শল্যান্ড মেলোডি, স্টর্ম অ্যাপ্রোচ প্রভৃতি।

এসব চিত্রকর্মে শিল্পী আমাদের শান্ত ও অশান্ত নিসর্গ, নিসর্গসংলগ্ন মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর কাজ ও উপস্থিতির যে বর্ণনা করেছেন সেগুলো চোখের দেখায় মন্দ লাগে না।

অ্যাক্রিলিক রঙে শিল্পী মিজানুর রহিম কিছু ফিগারেটিভ ছবি এঁকেছেন, যারা সান্ধ্য ছায়ায় বসে আছে, একে অন্যের সঙ্গযাপন করছে। ভালোবাসার সময় ও পরিবেশকে রোমান্টিক কায়দায় তুলে ধরেছেন প্রবীণ এই তরুণ! যেন সেই তারুণ্যকে তিনি আবারো স্পর্শ করতে চেয়েছেন শিল্পনিবেদনে। বাঙালির চিরকালের প্রেমিকা জীবনানন্দ দাশের ‘মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’ যেন এই শিল্পীর ক্যানভাসে এসে জায়গা নিয়েছে তাঁর ‘শেয়ার্ড গেজ’ নামের চিত্রকর্মে!

তাঁর নতুন ছবির মধ্যে আরো কিছু ফিগারেটিভ কাজের দেখা পাওয়া গেল – যেগুলো তাঁর অতীতে আঁকা অংকনধর্মী কাজের গঠন ও গড়নকে মনে করায়।

পঁয়তাল্লিশ বছর আগে কাগজে চারকোলে আঁকা ‘আর্টিস্টি অব ফর্ম’ শিরোনামের কয়েকটি অংকন আমাদের অতীতে নিয়ে যায়। আমার মনে পড়ে, সে-সময় আমি চারুকলায় পাঠ নিতে শুরু করেছি। এর পরপরই বেলজিয়াম থেকে ফিরে কাছাকাছি সময়ে শিল্পী মিজানুর রহিম ঢাকায় একটি একক চিত্রপ্রদর্শনী করেছিলেন, সেখানে আমি তাঁর অংকনপ্রধান কাজ দেখে বিমোহিত হয়েছিলাম। সেই ভালো লাগার বোধ স্মৃতিসমেত আবারো ফিরে এলো অনেক দিন পর তাঁর পুরনো ড্রয়িং অবলোকন করে।

এগুলো মডেল দেখে দেখে আঁকা হলেও কয়লায় লাইন দিয়ে স্বচ্ছন্দে আঁকা হয়েছে বলে দর্শক ও শিল্পবোদ্ধাদের ভালো লাগবে। এক্ষেত্রে পুরনোর গ্রহণযোগ্যতাও তো আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।

সব মিলে একজন অগ্রজ শিল্পীর ফিরে আসাকে স্বাগত জানানোই উত্তম আমাদের শিল্পী ও শিল্পের সমঝদারদের। আর শিল্পীর কাছে আমাদের চাওয়া – তিনি যেন সচল থাকেন সৃজনে ও চলায়, বলায়।