নরকের উত্তাপের মতো শরীর ভীষণ গরম হয়ে আছে। জ্বর এলে এমন হয় আমার। মা বলতেন, ছেলেটার এতো জ্বর ওঠে যে ডিম ভেজে ফেলা যাবে। 

আমার মনে পড়ে স্কুলে থাকতে প্রথম স্টাডি ট্যুরের কথা। গারো পাহাড়ের কাছে একটা অবকাশযাপন কেন্দ্রে ঘুরতে গিয়েছি। বাস থেকে নেমে সারিনি, আর গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। ক্লাস টিচার এতোটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে, ভেবেছিলেন, আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি। এরপর ওরকম দিন কত যে এলো তার হিসাব কি আমি আর রেখেছি?

হেলফেরিওন আমার সঙ্গে থাকতে শুরু করার পর এমন জ্বর অবশ্য এবার প্রথম। মা কাছে নেই। অনেক বলেও মাকে শহরে আনতে পারিনি। এলেই দু-একদিন পর কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়। অবশ্য হবে না কেন? অফিসে চলে গেলে মায়ের কিছু করার থাকে না। আর মফস্বলে তার সব আছে। এখন পাশে থাকলে মা নিশ্চয় বহুবার বলা তার পুরনো কথাটাই বলতেন। যদিও মায়ের কাছে আমার কখনো জানতে চাওয়া হয়নি কেন জ্বরের সঙ্গে তিনি ডিম ভাজার মিল খুঁজে পেয়েছিলেন, যেখানে তিনি ডিম খেতেই পারতেন না।

ডিম ভেজে ফেলার কথা কি হেলফেরিওনকে বলেছি? আজকে ভেজে দিতে পারলে মন্দ হতো না। মনে হচ্ছে দীর্ঘকাল না খেয়ে আছি। সমস্ত শরীর শিরিষ কাগজের মতো শুষ্ক হয়ে আছে। পুরো বাড়িটা অরণ্যের গভীরের মতো নির্জন। বাসায় মাত্র দুটো ঘর। একটা ডাইনিং। আমার ঘরের দরজাটা আলতো করে খোলা। বাইরের বারান্দার কিটো ডায়েটে থাকা চিকন পথ দিয়ে তারচেয়েও সরু সূর্যের আলো এসে ঢুকছে। আশেপাশে হেলফেরিওনকে দেখছি না। ওকে অবশ্য আমি হেলফেরিওন নামে ডাকি না। আমি ডাকি হেল বলে। এতে সে খুব রাগ করে।

বলে, ‘তাহলে তুমি আমাকে নরক বলে ভাবছ?’

‘তা ভাবছি না।’

আমার এই উত্তর হেল পছন্দ করে না। সে কিছু একটা বলতে বলতে তার তৃতীয় চোখ চুলকাতে শুরু করে। হেল যে রাগ করলে ওর তৃতীয় চোখ চুলকাতে শুরু করবে এবং চোখটা থাকবে কপালের মাঝখানে এটা অবশ্য আমারই তৈরি করা, আমি এমনভাবেই চেয়েছি। এনিমের প্রাণীগুলোর মতো বানিয়েছি ওকে, সঙ্গে দিতে চেষ্টা করেছি কিছু নিজস্বতা।

এই মুহূর্তে হেলকে ডাকব সেই শক্তিও পাচ্ছি না। আমি ঠিক কতদিন এভাবে শুয়ে আছি? ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে এগারোটা বেজে আছে আজ অনেকদিন। ব্যাটারি কেনার কথা মনে থাকে না। সম্ভবত এই কারণে আমার জীবনে ১২টা বাজছে না, আমি বেঁচে থাকছি।

হেল প্রায়ই বলে, ‘ব্যাটারি কিনে এনো না আবার। ১২টা বাজলে জীবনে কী দুর্যোগ নেমে আসবে বলা যায়?’

হেলের প্রতিটি বুদ্ধিদীপ্ত কথা আমাকে আনন্দ দেয়। আমার আর কোনো সৃষ্টি এতোটা পরিপূর্ণতা পায়নি। যেমন আমি একবার কথা বলা তেলাপোকা বানিয়েছিলাম। তার ভেতরে বুদ্ধিও দিয়েছিলাম।

আমাকে একবার মাস্টারবেট করতে দেখে বলল, ‘এতো অল্পতে চলে তোমার?’

আর রাখিনি তাকে। অন্য যাদের বানিয়েছি তারা সামান্য অসুখে চলে গেছে আমাকে ছেড়ে। শুরুতে যাকে বানিয়েছিলাম তার নাম দিয়েছিলাম ব্রি। ছোট্ট একটা মাছ। তবে কথা বলতে পারত। বেঁচে ছিল একদিন। ব্রি মারা যাওয়ার পর আমি দুদিন না খেয়ে ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু হয়েছে কেবল। নিজের সৃষ্টির মৃত্যু মেনে নেওয়ার মতো মানসিক শক্তি আমার ছিল না। এ-কথাও ঠিক, নিজে যে সৃষ্টি করতে পারি এই চমকটাও আমার জন্য হজম করা কঠিন ছিল। কীভাবে পেরেছিলাম, সেই কথা এখন আর মনে করতে চাই না। হেলকে বানানোর আগ পর্যন্ত আমি কোনোদিন সন্তুষ্ট হতে পারিনি। হেল আমার সৃষ্টিসত্তাকে পূর্ণ করেছে। পূর্ণ করবে না কেন? হেলের ছয় মাসে তার সর্দি পর্যন্ত হয়নি। হেল আমাকে খাবার বানাতে, ঘরের কাজে সাহায্য করে। যদিও তাকে আমি মূলত রেখেছি গল্প করার জন্য। সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য প্রতিটি বিষয়ে তার কথা আমাকে মুগ্ধ করে। বই পড়ে, সিনেমা দেখে ক্রমাগত নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে ।

এই মুহূর্তে হেলকে আমার দরকার। জ্বর একটু ছাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। আজ খাবার বানিয়ে দিলে মন্দ হতো না। অথচ হতচ্ছাড়াকে দেখছিও না।

হাতের কাছে ফোন আছে। চার্জ শেষ। চার্জারটা একটু দূরে আছে জানি, যদিও অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার মানেই রাত নয়। আমার ঘরটা এরকমই। বাইরের ঘরের বারান্দার ওই লোনলি আলো পথ ভুলেও এই ঘরে আসে না।

হেল! হেল! হেল!

শেলডন কুপারের মতো তিনবার করে ডাকি। কয়েকদিন আগে দুজন মিলে বিগ ব্যাং থিওরি দেখছিলাম। সেখানে শেলডনের তিনবার ডাকার দৃশ্যটা দেখে হেল মজা পেয়েছিল। এরপর থেকে তাকে তিনবার করে ডাকতে হয়।

আজ তিনবার ডেকেও সাড়া পেলাম না। হেল কি তাহলে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে? জ্বর আসার দুদিন আগেও ওকে ভীষণ বকা দিয়েছিলাম। প্রার্থনায় গণ্ডগোল করে ফেলেছিল। আমি যে ওকে সৃষ্টি করেছি এজন্য তাকে বলেছিলাম প্রার্থনা করতে যেন আমাকে খুশি রাখতে পারে।

সে বিস্মিত হয়ে বলেছিল, আমি তোমার সঙ্গে থাকছি, কাজ করে দিচ্ছি, আমি তোমার বন্ধুর মতো, তারপরও প্রার্থনা করতে হবে?

ওর এই কথার উত্তর দিইনি। যা বলেছে ভুল বলেনি। প্রার্থনা করতে বলাটা আমার মনের খেয়াল। এই খেয়াল থেকে অনেক সময় রাগ তৈরি হয়। আর রাগ খুব বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার। রাগের কারণেই বাবাকে হারিয়েছি। আমি রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম আর আমার পেছনে পেছনে বাবা। আমি ফিরে এলেও বাবা ফিরে আসেনি।

একটা গাড়ি তাকে কেড়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল।

দুই

যমের সঙ্গে যুদ্ধ করে দুই থেকে তিনদিন পর জ্বর থেকে মুক্তি পেলাম। এই তিনদিনের কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই। প্রায় অচেতন অবস্থা থেকে চোখ খুলে দেখি আমি হাসপাতালে। পাশে মাকে দেখে চমকানোর কথা থাকলেও হই না। হেল না এলেও মা চলে এসেছিলেন।

আধো চেতনায় আমি এতোটুকুন বুঝতে পারছিলাম, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। কারা যেন কথা বলছিল পাশে, বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, বিছানার পাশে তর্ক চলছে।

মায়ের কাছে জানতে চাইলাম, ‘কীভাবে বুঝলে আমি অসুস্থ?’

মা কিছু বললেন না।

হাসপাতালটা সুন্দর। মনে হচ্ছে ফাইভ স্টার হোটেলে আছি। জানালার সাদাটে পর্দা, সেন্ট্রাল এসির মোলায়েম বাতাস আর নাম-না-জানা কোনো একটা পারফিউমের সুবাস বুঝতেই দিলো না আমি অসুস্থ। হাতের ক্যানোলা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। একটা স্যালাইন মৃদু বৃষ্টির মতো পড়ছে আর আমার শিরায় ঢুকে যাচ্ছে।

‘তোর কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে?’

আমি বললাম, ‘ডিম ভাজি।’

মা শুনে হাসলেন। কতদিন পর মাকে হাসতে দেখলাম!

নার্সকে ডাকতে গেলে আমি টিভিটা ছেড়ে দিলাম। ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে – মানুষের মতো দেখতে এক অদ্ভুত প্রাণী নাকি ধরা পড়েছে। প্রাণীটার বর্ণনা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এটা তো হেলের কথা বলছে!

হেল কীভাবে মানুষের হাতে ধরা পড়ল? উঠে বসতে চাচ্ছিলাম, শক্তি পেলাম না। আরেকটু হলেই স্যালাইনস্ট্যান্ড আমার মাথার ওপরে এসে পড়ত।

আমাকে কাঁপতে দেখে ফেললেন মা। ছুটে এসে বললেন, ‘আবার জ্বর আসছে?’

‘না। তুমি কি ব্রেকিং নিউজ দেখেছ?’

মা বললেন, ‘হ্যাঁ। দেখেছি তো। তুই এটা নিয়ে অস্থির হচ্ছিস কেন? ’

এরপর আমার বলার আর কিছু থাকে না। সত্যি তো আমি কেন অস্থির হচ্ছি। আমার এই দীর্ঘ এই গোপন যাপনের কিছু মায়ের জানা নেই। মা কেন, পৃথিবীর কেউ কিছু জানে না। আমি এই ক্ষমতা যেদিন থেকে পেয়েছি সেদিন থেকেই জানি কাউকে কিছু বলা যাবে না।

 আমি অনেককেই হারিয়েছি আগে, তবে হেলের মতো করে এভাবে নয়। ওকে বারবার বলে রেখেছি যেন ঘরের বাইরে পা না রাখে, যদিও পা রাখতে হয় তবে যেন বোরকা পরে বের হয়, শোনেনি। কেন শোনেনি সেটা সম্ভবত আমি আর কোনোদিন জানতে পারব না। হতে পারে, আমি অসুস্থ দেখে হাসপাতালে চলে গিয়েছিল অ্যাম্বুলেন্স আনতে কিংবা আমি অসুস্থ হওয়ার আগে সেদিন বকা খেয়ে চলে গিয়েছিল রাস্তায়। আর ভুলে গিয়েছিল বোরকা পরতে।

মানুষের হাতে ধরা পড়েছে, তাও এই দেশের মানুষ, এই দেশের সরকার, ওকে বাঁচাবে কে?

এরপর হাসপাতালে যতদিন থাকতে হলো, ততদিন প্রতি মুহূর্তে আমি মোবাইলের নিউজফিডে আর টিভিতে চোখ রেখে কাটালাম। নানা মুখরোচক খবর। কেউ বলছে, হেল হয়তো নারী; কেউ বলছে, হেল হয়তো পুরুষ কিংবা নারী-পুরষের মিশ্রণ। কেউ বলছে, তার তিনটা চোখ; কেউ বলছে, তার চারটা হাত। কিন্তু হেলের ছবি কেউ দেখাতে পারছে না। একজন কার্টুনিস্ট অবশ্য বেশ কাছাকাছি ধরনের ক্যারিকাচার করতে পেরেছে। আমি ভেবেছি তাকে আমার আর হেলের একটা ছবি পাঠিয়ে দেব। তাকে অভিনন্দিত করব। যে-কোনো শিল্প আমার খুব পছন্দ, দুর্বলতার জায়গা।

সবশেষে আমার হাসপাতালের বিল যখন দেওয়া হলো তখন জানতে পারলাম, হেলকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমেরিকা। এর ভেতরে সরকারের তরফ থেকে কেউ একটিবারের জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। হেল কি একবারের জন্য আমার কথা বলেনি? প্রথমে খুশি হলাম তার সততা দেখে। পরে মন খারাপ হলো এটা ভেবে, হেল হয়তো তার সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে গেছে। আমরা জানি, সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে গেলে নরক সুনিশ্চিত। হেল এবার সত্যি সত্যি নরকযাপন করছে। আমেরিকা নিয়ে গেলে ওরা কি হেলকে কেটে ফেলবে?

তিন

সরকারি অফিসের সামনে জুতো ক্ষয় হতে শুরু করল, মনে পড়ল অফিসে না যেতে যেতে আমার চাকরিটা চলে গেছে। কতদিন ধরে আমি শৈশবের স্কুল ফাঁকির মতো করে অফিস ফাঁকি দিচ্ছি?

রাশভারি প্রধান শিক্ষকের চেহারাটা মনে পড়ল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিবের চেহারা দেখে।

‘আপনাকে আমি বোঝাতে পারছি না, প্রাণীটির সঙ্গে কোনোভাবেই দেখা করা সম্ভব নয়। প্রাণীটির কী কী ক্ষমতা আছে সেই সম্পর্কে আমরা এখনো নিশ্চিত নই।’

‘আমি নিশ্চিত। গল্প করা, রান্নাবান্নায় সাহায্য করা আর বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলা ছাড়া তার তেমন কোনো ক্ষমতা নেই।’

সচিব আমার কথা না শুনে বের করে দিলেন।

সিনিয়র সাংবাদিকের কপালের বাঁপাশে কালো তিল দেখে আমার মনে পড়ল অংক শিক্ষকের কথা, যিনি আমাকে মুখস্থ করতে শিখিয়েছিলেন অংক। সাংবাদিক বললেন, ‘প্রাণীটা যদি সত্যি আপনি বানিয়ে থাকেন তাহলে আরেকটা বানিয়ে ফেলুন।’

এভাবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ঘুরতে ঘুরতে আমার বয়স বেড়ে যেতে থাকে। প্রতিদিন খবরের বুলেটিনে শুনতে থাকি, আজকেই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে আমেরিকা। আমেরিকা যেন এক অলীক দেশ, ওখানে গেলেই হবে সব সমস্যার সমাধান। চাকরি হারানো রাতের বেলা আমার তাই মন খারাপ হয়। মা চলে গেছেন একরাশ নির্জনতা নিয়ে। আমার ছোট ঘরের ছোট বিছানায় শুয়ে আমার আচমকাই মনে হয়, হেল ভাবছে না তো সৃষ্টিকর্তা কেন এতোটা চুপ? ভাবুক। হেলের জানা থাকার কথা, সৃষ্টিকর্তা সবসময় নিশ্চুপই থাকে।