আমেরিকান-বাঙালি কথন

প্রাবন্ধিক-গবেষক-শিশুসাহিত্যিক-সম্পাদক আহমাদ মাযহারের সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয়েছে একবারই, কিন্তু টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে অনেক দীর্ঘ আলাপ হয়েছে। ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে আমার সকল প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছেন অসীম ধৈর্যের সঙ্গে। আমার জানার পরিধি প্রতিবারই বেড়েছে শিক্ষকতুল্য ওই মানুষটির সঙ্গে কথোপকথনে।   

তাঁর সাহিত্যকর্মের খুব কমই আমার পড়া আছে। সম্প্রতি আমেরিকান বাঙালি মন নামে তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। জীবনের অধিকাংশ সময় আমেরিকায় বাস করার সুবাদে আমি নিজেই একজন আমেরিকান-বাঙালি। কাজেই তাঁর দৃষ্টিতে আমি কেমন বাঙালি তা জানতে আগ্রহী হয়েই বইটি ঢাকা থেকে আনিয়ে পড়লাম। বইটির সবকিছুই আমি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছি তা নয়, আমার সেই জ্ঞান বা সাহিত্যপাঠও নেই। তা সত্ত্বেও আহমাদ মাযহারের অভয়বাণী এবং আগ্রহ লক্ষ করেই বইটি সম্পর্কে আমি যা বুঝেছি, সে সম্পর্কে কিছু লেখার সাহস পাচ্ছি।

আহমাদ মাযহার আমেরিকায়, বিশেষ করে নিউইয়র্কে বসবাসকারী বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সাংস্কৃতিক জীবন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক সুচিন্তিত প্রবন্ধ লিখেছেন। আলোচ্য গ্রন্থে সেগুলির কোনো কোনোটির পরিশোধিত রূপের সঙ্গে কয়েকটি সাহিত্য, নাট্যকলা, আবৃত্তি ও গানের অনুষ্ঠানের আলোচনা মিলিয়ে মোট ২৮টি রচনায় আমেরিকান-বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে সুচিন্তিত মন্তব্য করেছেন। বাঙালির ইতিহাস-চেতনার অভাবকে সামনে রেখে তিনি বইটি লিখেছেন বলে ধারণা করি। কারণ একাধিক প্রবন্ধে তিনি নিউইয়র্কে ওলন্দাজদের বসতি গড়ার ইতিহাস সংবলিত নিকারবোকার অর্থাৎ ওয়াশিংটন আরভিংয়ের বিখ্যাত লেখার কথা উল্লেখই শুধু করেননি, তিনি একজন আমেরিকান-বাঙালি নিকারবকার হয়ে ওঠারও ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। অভিবাসী বাঙালি সমাজ সেজন্য তাঁর প্রতি সক্রিয় সমর্থন জানিয়ে যাবে এবং এই কাজের জন্য কৃতজ্ঞতাও জানাবে।

প্রবাসী বাঙালিদের অধিকাংশই বাংলাদেশে গ্রামীণ ও কৃষি সংস্কৃতির ধারক। তাঁদের অনেকে বাংলাদেশের ভালো সামাজিক অবস্থান থেকে এলেও এখানকার জীবনসংগ্রামে খাপ খাওয়াতে গিয়ে এবং আমেরিকায় কেউ কেউ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাফল্যের মুখ দেখলেও ‘এক ধরনের উন্নাসিকতাপূর্ণ জীবনবোধে’র কারণে ‘তাঁদের মধ্য থেকে সৃজনশীলতার আকাক্সক্ষা একসময় অবসিত হয়ে পড়ে’ বলে আহমাদ মাযহার লক্ষ করেছেন। বিদেশে বহুদিন বসবাস করলেও এদের মাঝে ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে আদান-প্রদান করে নতুন ও উন্নততর সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রয়াসও দেখা যায় না।    

লেখালেখির ক্ষেত্রে ‘অভিবাসী’ বা ‘প্রবাসী’ লেখকের বদলে তিনি ‘দূরস্বদেশি লেখক’ ব্যবহার করার পক্ষপাতি। বাংলাদেশের নির্বাচনগুলিতে প্রার্থীরা ভোট চাইলেও যেমন ভোটারের মতামতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেন, আহমাদ মাযহার দূরস্বদেশি লেখকদের লেখাতেও পাঠকের বিবেচনার প্রতি দৃষ্টি নেই বলে লক্ষ করেছেন।  একই সঙ্গে পাঠকের চেয়ে লেখকের সংখ্যা বেশি এবং বছর বছর তাঁদের বই প্রকাশিত হলেও সেসব লেখায় ‘উৎকর্ষে’র অভাব তিনি তীব্রভাবে লক্ষ করেছেন। অন্যদিকে তিনি আক্ষেপ করেছেন – ‘যে পাঠক বই পড়লে তাঁদের মতের প্রতিফলন সমাজের চিন্তাক্ষেত্রে দেখা যাবে সেই পাঠক কই?’ এই বিষয়ে আলোচনার সময় তিনি পাশ্চাত্যে বিশেষ করে আমেরিকায় আধুনিক প্রকাশনা জগতের কাজের ধরন সম্পর্কে এক নাতিদীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন, যা পাঠ করাটা বাঙালি লেখক ও প্রকাশকের জন্য উপকারী হতে পারে।

কোনো বিশেষ ব্যক্তি, জীবনধারণ, কথোপকথন, ঘটনা, বই বা অনুষ্ঠানের উল্লেখ বা বিবরণ বিবর্জিত প্রবন্ধগুলিকে লেখকের চিন্তাপ্রসূত নিজস্ব মূল্যায়ন বলা যায়। এগুলি রচনায় তিনি যে যথেষ্ট সময় ব্যয় করেছেন, তাও কিছুটা আঁচ করতে পারি; সেগুলি যে উন্নতমানের তা বলতে আমার বাধা নেই। 

বইটির প্রথম অর্ধেক জুড়ে আমেরিকান-বাঙালিদের জীবনযাপন, জীবন বোধ, সংবাদপত্র ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে নৈরাশ্যজনক পর্যবেক্ষণটি পড়ে এক ধরনের হীনম্মন্যতার জন্ম দিয়েছিল। পাঠকমনে এই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে, আহমাদ মাযহার আঁচ করতে পেরেছিলেন কি না জানি না, তবে বইটির শেষ অর্ধাংশে সংগীত, নাট্যকলা, থিয়েটার, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য এবং কবিতা আবৃত্তির কোনো কোনো অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে উৎকর্ষের প্রশংসামূলক মন্তব্য পড়ে কিছুটা হলেও সেই হীনম্মন্যতা হ্রাস পেয়েছে। শুধু তাই নয়, আমেরিকার মূলধারার কয়েকটি কবিতা-পাঠের অনুষ্ঠানে তিনি ছাড়াও গুটিকয় আরো কিছু আমেরিকান-বাঙালির অংশগ্রহণ ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের বিবরণ পড়ে আনন্দিত ও উপকৃত হয়েছি। আহমাদ মাযহার যদিও প্রথমেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, বইটি শুধু নিউইয়র্কে বসবাসরত বাঙালিদের নিয়েই লেখা হয়েছে। একটি কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে আমাদের ওয়াশিংটন ডিসির এক আবৃত্তিশিল্পী অদিতি সাদিয়া রহমানের প্রশংসা পড়ে আনন্দিত হয়েছি। আমেরিকার মূলধারার টিভি ও স্টেজ শোতে আলাউদ্দিন উল্লাহ এবং মুহসিন খান নামে দুই আমেরিকান-বাঙালির স্থান করে নেওয়া এবং তাঁদের সাক্ষাৎকার দুটি পড়েও গর্ববোধ করেছি।

এক বা দুটি ক্ষেত্রে ‘টাইপো’ ছাড়া ঢাকার ২০২২ সালে ‘অনন্যা’ থেকে প্রকাশিত এই বইটিকে ত্রুটিহীন মনে হয়েছে। বইটি রচনায় লেখক যে কঠোর পরিশ্রম করেছেন তা ১২৪ পৃষ্ঠার বইটির একাধিক পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত মোট ২২৪ জন লেখক, কবি, শিল্পী ও ব্যক্তির নাম সংবলিত নির্ঘণ্টটি দেখলে আঁচ করা যায়। সব্যসাচী হাজরা বইটির মানানসই প্রচ্ছদ এঁকেছেন।