দুঃসময়ের গাথা

বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের এক বিশেষ তাৎপর্য আছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা এবং পাকিস্তানের দাসত্বশৃঙ্খল ছিন্ন করে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে অনাদিকাল ধরে। যে ত্যাগ ও তিতিক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে সমগ্র জাতিকে তার নজির হাজার বছরের বঙ্গজীবনে একান্তই বিরল। অথচ এই যুদ্ধ এবং আত্মক্ষয় নিরীহ বাংলা ও বাঙালির জীবনে একেবারেই চাপিয়ে দেওয়া। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরপরই শুরু হয় বিভেদ ও বিসম্বাদের রাজনীতি। পাকিস্তানি শাসকদের একতরফা নিপীড়ন ও শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে অনিবার্য হয়ে পড়ে এই মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আনুপূর্বিক নানা বিশ্লেষণ ও বিবরণ আমরা পেয়েছি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক ও চলচ্চিত্রে। এখনো লেখা হচ্ছে সাধারণ মানুষের মুখনিঃসৃত কথা, যাকে চলতি কথায় বলা হচ্ছে ‘ওরাল হিস্ট্রি’। বাংলাদেশের ইতিহাসের এই অধ্যায় ধাপে ধাপে লিখিত হয়েই চলেছে এবং আমরা জানি এই প্রক্রিয়া নিরন্তর বহমান থাকবে। নইলে মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরেও কেন এইভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে সেই সময়ের আত্মত্যাগের কথা, মরণপণ কৃচ্ছ্রসাধনের কথা!

এই কথাগুলি যে-বইয়ের ভূমিকা হিসেবে এসে গেল তার নাম কাহিনি – যুদ্ধের নয় জীবনের। লেখক তাপস মজুমদার। এক কিশোরের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তীকালের কিছু কথা স্মৃতিগদ্যের আকারে এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। একাত্তরে যে ছিল নিতান্তই এক স্কুলপড়ুয়া বালক তাঁরই পরিণত বয়সে পেছন ফিরে দেখার ইতিকথা যেমন কৌতূহলোদ্দীপক তেমনই অপরিসীম কষ্টের। ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া যখন ওই শিশুটির করে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তে যাওয়ার কথা তখন তাকে পরিবারের সবার সঙ্গে ঘর থেকে বেরোতে হচ্ছে প্রাণরক্ষার তাগিদে। দেশজুড়ে তখন শুরু হয়েছে যুদ্ধবাজ নিপীড়কদের নির্মম অত্যাচার। ভিটেমাটি ছেড়ে শুধু প্রাণটুকু হাতে নিয়ে ভিনদেশে পাড়ি দেওয়ার সেই কাহিনি আমরা জেনেছি নানাজনের লেখায়। স্বচক্ষে দেখেছি শরণার্থীদের অবর্ণনীয় কষ্ট। শুনেছি অসংখ্য অত্যাচারের দুর্বিষহ কথা। মৃতদেহ পায়ে দলে, অজস্র নারীর সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে প্রায় এক কোটি মানুষ যখন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছে তখন সেখানকার নানা পত্র-পত্রিকায় বিধৃত হয়েছে সেইসব লাঞ্ছিত-নিপীড়িত মানুষের করুণ কাহিনি।

সেই অজস্র কাহিনির মধ্যে খানিকটা হলেও অনন্যতার দাবি করে তাপস মজুমদারের এই স্মৃতিগদ্য। কেননা পরিণত বয়সে এসে তিনি তাঁর স্মৃতি হাতড়ে এই বইতে হাজির করেছেন তাঁর কৈশোরকালের এক অকথিত গাথা। বড় বিস্ময়কর সেই স্মৃতিচারণ। এক বালকের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা এবং বোধের এই ব্যাপ্তি সত্যিই আমাদের চমকিত করে। বুকের মধ্যে যিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে লালন করেছেন তাঁর সেই কিশোরবেলার দুঃসহ যাপন ও কালাতিপাতের অভিজ্ঞতা, পরিণত বয়সে তাকেই তিনি যেন উপুড় করে ঢেলে দিয়েছেন একেবারে নিরুত্তাপ ভাষায়। যে ক্লিন্ন অভিজ্ঞতা তাঁকে একসময় এই পৃথিবীর পথে হাঁটতে শিখিয়েছিল, হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়েও পথভ্রষ্ট না হয়ে স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছিল, স্মৃতি হাতড়ে সেইসব কথাকেই তিনি একটির পর একটি করে সাজিয়ে দিয়েছেন এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থ তাই দুর্বহ এক কালখণ্ডের ইতিহাসই কেবল নয়, সাহিত্যগুণে ভরা একটি জাতির উঠে দাঁড়ানোর এক গৌরবগাথা।

গ্রন্থের শুরুতেই লেখক যে কয়েকটি কথা লিখেছেন তা থেকে আমরা সহজেই অনুমান করে নিতে পারি নিতান্ত এক আন্তরিক তাগিদে মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতাকে লিপিবদ্ধ করতে প্রয়াসী হয়েছেন তিনি। লেখক জানিয়েছেন, ‘… প্রাথমিকের চতুর্থ শ্রেণি পেরিয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠা শান্ত নিবিড় গ্রামীণ জীবনের আকস্মিক শেকড়ছেঁড়া এক কিশোরের নিজের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের নির্মম সামাজিক ঘটনাবলি এ লেখার প্রেক্ষাপট।’ বস্তুত এই সোজাসাপ্টা আত্মকথনই আমাদের বইটি পড়তে কৌতূহলী করে তোলে। পড়তে শুরু করে আমাদের সেই কৌতূহল ক্রমশ বাড়তে থাকে। বইটি শেষ করতে উৎসাহ দেয়।

লেখক তাঁর লেখা শুরু করেছেন কোভিডকালের এক মা দিবসে। জানিয়েছেন, ‘… এই মা দিবসে, হাতে পাওয়া একটু অবসরে, ইচ্ছে হচ্ছে ১৯৭১-এর মাকে একটু স্মরণ করি। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে অন্তরে লালন করছি সেই স্মৃতি। কৈশোরের সেই কাহিনি যুদ্ধের নয় জীবনের।’ এরপরেই তাঁর লেখায় ফুটে ওঠে ’৭১-এর এক অতি চেনা চিত্রকল্প। ‘শয্যাশায়ী বৃদ্ধবাহী সারি বাঁধা গোরুর গাড়ি, বোঁচকা বাঁধা সাইকেল, শিশুবাচ্চা কোলে ছুটন্ত কৃশকায় মা, বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা বহন করা যুবকের কাঁধে বাঁক, এসবের সাথে প্রাণভয়ে ছুটে চলা হাজার হাজার মানুষের ভিডিও দেখলে আজ আমার মনে হয়, ওই দলে আমিও আছি। আর পাঁজরভাঙ্গা ব্যথা নিয়ে সাথে ছুটছেন আমার মা।

যদি থেকেও থাকি ওইসব ছবির মধ্যে আমি, তবু আজ আর নিজেকে চিনব না। হয়তো বাবা-মাকেও না। চেনার কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা ঐসব শিশুদের প্রত্যেকের মতোই আমি নই কি! ওইসব সর্বস্বান্ত বাবা-মায়ের মতোই আমার বাবা-মা নন কি?’

এই জীবন্ত বর্ণনায় আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ’৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়কার ছবি। প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে শরণার্থী হয়ে ভারতে আসার সেই বিপন্ন মিছিলের ছবি একবার দেখলেই মনে পড়ে যায় – এমনই দুঃসহ কষ্টের ছিল সেই জীবন! কোনো ভান-ভনিতায় না গিয়ে লেখক তাঁর গ্রন্থের শুরুতেই এই চিত্রকল্প রচনা করে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন আসলে তিনি কী বলতে চেয়েছেন। 

অধ্যায় তিন-এ স্কুলপড়ুয়া বালকের একদিনের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে চিত্রিত। ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে ওঠার পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার আনন্দ-উদ্বেল এক বর্ণনা আমাদের নিয়ে যায় সেদিনের ঘনায়মান ঘোর বিপদের মধ্যেও এক টুকরো আনন্দঘন সময়ে। কিন্তু একাত্তরের মার্চের আগুনঝরা সেই দিনে বাংলাদেশ জুড়ে যে অশান্তির আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল, তার উত্তাপ যশোরের ওই অখ্যাত গ্রামে গিয়েও পৌঁছাল। মহা উৎসাহ নিয়ে যে ছেলেটি নতুন ক্লাসে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তার সেই স্বপ্ন আর সফল হচ্ছে না। দেশজোড়া অশান্তির কারণে স্কুল খুলছে না মোটেই। লেখকের ভাষায়, ‘… আর এদিকে স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে বাংলার ঘরে ঘরে। দোসরা মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উঠল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশে। আমার আর কোনো দিন ফিরে যাওয়া হলো না পাঁচবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। হঠাৎ করেই কৈশোর মোড় নিলো বহুরেখ দিশাহীন দিকে।’ (পৃ ২১)

এর পরের অধ্যায়ের নাম ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’। এর থেকে আর কী ভালো শিরোনাম হতে পারে অধ্যায়টির! ভিটেমাটি ছেড়ে একেবারে প্রাণের দায়ে কাতারে কাতারে মানুষ যখন ভিনদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তখন পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে এই কিশোরও বেরিয়ে পড়ল অজানার উদ্দেশে। পেছনে পড়ে রইল বাড়িঘর, বন্ধুবান্ধব আর তার প্রিয় স্কুল। মাতৃভূমিকে বিদায় জানিয়ে রাতের অন্ধকারে তাদের বেরিয়ে পড়তে হলো। সে এক কঠিন সময়। দলে দলে মানুষ নিরাপদে সীমান্ত পেরোনোর কঠিন চেষ্টায় রত। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, অনাহারে, অসুখে কত মানুষ দলছুট হয়ে গেল। কত মানুষ হারিয়ে গেল, ধরা পড়ে প্রাণ হারাল। লেখকের সেই সময়কার দৃষ্টিতে ধরা রইল সেই প্রাণ হাতে করে অন্য দেশে চলে যাওয়ার আনুপূর্বিক বর্ণনা। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘… আমার মনে আছে, তিনি যখন বলছেন ‘ঐদিকে চলো’ তখন যে সে ঠিক কোনদিক তা বুঝে নেওয়ার কোনো উপায় নেই … আমার বাবা নিঃশব্দে বলছেন, ‘যাও বাবা যাও’। অথচ তিনি জানেন না ঠিক কোথায় যেতে বলছেন। যেন অনন্ত শূন্যের পথে যাত্রার নির্দেশ।’ (পৃৃ ২৩)

দুঃসহ সেই যাত্রাপথের বর্ণনা এখানে নাইবা দিলাম। যশোরের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে ভারতের ২৪ পরগনার এই সীমান্তে আসা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। দূরত্ব অল্পই কিন্তু ঝুঁকি অনেক। সেই ঝুঁকি নিয়েই অসংখ্য মানুষের মিছিলে শামিল হয়ে লেখকও একদিন এপারে চলে আসেন তাঁর পরিবারের সঙ্গে। এসে কোথায় যাবেন? গন্তব্য একটাই, আত্মীয়-পরিজনের বাড়ি। প্রসঙ্গত লেখক জানিয়ে রাখেন, তাঁর কাকা-জেঠারা আগে থেকেই ভারতে রয়েছেন। তাঁর বাবাও একসময় এই দেশে চাকরিসূত্রে থাকতেন। দেশভাগের পরে তিনি নিজের দেশেই ফিরে যান, পিতৃপুরুষের ভিটেমাটির মায়ায়। ১৯৪৭ থেকে ’৭১ সেখানেই থাকা। কিন্তু একাত্তরের দুর্বিপাকে তাঁকেও পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে আসতে হলো নিকটাত্মীয়ের কাছে। ঠাঁই একটা হলো বটে, কিন্তু তা বড় সুখের নয়। এপারের এঁরা তেমন কিছু সচ্ছল জীবন যাপন করতেন না। তবু সেখানেই মাথা গোঁজার জায়গা মিলল এবং তারপর সেই নতুন দেশে নতুন পরিবেশে লেখকের শুরু হলো নতুন এক জীবন। লেখক তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় লিখেছেন, ‘…আমাদের নতুন জীবন শুরু হলো … প্রথম কিছুদিন আমরা দুই জেঠার বাড়িতেই ভাগাভাগি করে থাকলাম। একটু একটু করে ওদের জীবন, ভাষা, আচরণ, পরিবেশ আমাদের কাছে পরিচিত হতে থাকল। একটি নতুন দেশ, নতুন সমাজ, তার কৃষ্টি এবং সর্বোপরি পরিবর্তিত অবস্থা আমাদের কাছে একটু একটু করে উন্মোচিত হতে থাকল।’ (পৃ ৫৪-৫৫)

এরপর লেখকের কলমে উঠে এসেছে নতুন দেশে নতুন পরিবেশে নতুন মানুষদের সঙ্গে নানা ব্যাপারে নানা অসংগতির কথা। যদিও লেখক সেইসব বিষয়কে হালকা ভাষায় বিবৃত করেছেন, ‘… আমরা তো একেবারে খাঁটি গেঁয়ো ভাষায় কথা বলতাম … ওরা খুব কথা ধরত আমাদের।’ ঠিক আগের অধ্যায়ে কাকভোরে হরিণঘাটার বোতলে ভর্তি দুধ আনতে যাওয়ার এক চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। পূর্ববঙ্গের মানুষের কাছে এইভাবে বোতলবন্দি দুধ দেখার অভিজ্ঞতা একেবারেই অভিনব। জয় বাংলা থেকে আসা বালকের সামনে নানা মানুষের নানান কৌতূহলী প্রশ্ন। তিনি লিখেছেন, ‘… বয়সী মানুষদের একটি কমন প্রশ্ন থাকত। ‘বড়ো হয়ে কী হবে তুমি?’ উত্তরে আমি কিছুই বলতে পারতাম না। হরিণঘাটার দুধের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা উদাসীন এক কিশোর ভাবতো, ‘আমি আবার কী হবো? আমি তো স্কুলে যাইনে।’ (পৃ ৫৯) এক বালকের এই অকপট স্বীকারোক্তির মধ্যে বলা বাহুল্য অনেক গূঢ় ইতিকথা ব্যক্ত হয়ে গেছে।

কিশোর বালকের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কলকাতা হাওড়ায় অবস্থানের সময় নানারকম ঘটনা বাসা বেঁধেছে। ছোট্ট বালক দেখেছে বিশ্বকর্মা পুজোতে ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম, অন্যদিকে দুর্গাপুজোর ধুন্ধুমার আয়োজন দেখেও তার তাক লেগেছে। পাশাপাশি নকশাল আন্দোলনের নানা কীর্তি ও অপকীর্তির বিবরণ এসেছে তার লেখায়। পুজো উপলক্ষে প্রকাশিত নানান শিল্পীর গানে মাতোয়ারা হয়েছেন তিনি। (‘… চারদিকে মাইকে নানা শিল্পীর গাওয়া আধুনিক বাংলা গানের আওয়াজ যখন বাতাসে ভাসত, নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম স্বপ্নের ঘোরের মতো’) পাশাপাশি তখনকার দিনের জনপ্রিয় রেডিও অনুষ্ঠানের কথাও তিনি লিখেছেন। রেডিওর খবর তথা সংবাদ পরিক্রমার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এম আর আখতার মুকুলের অত্যন্ত জনপ্রিয় কথিকা ‘চরমপত্রে’র কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। এইভাবে ভিনদেশের নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে সরকারি সাহায্য আর আত্মীয়-পরিজনের আশ্রয়ে দিন গুজরান করতে করতে একসময় তাদের নিজেদের আস্তানা গড়ার জন্য বনগাঁয়ে আসতে হলো। কলকাতা ছেড়ে চলে আসার আগে ঠিক হলো লেখকের বড় জেঠার বাড়িতে সবাই একত্রে মিলিত হবেন। সেই সম্মিলনে যেমন একদিকে ছিল বিচ্ছেদ বেদনার সুর, অন্যদিকে সেই সময়েই ঘটেছিল তাদের পরিবারের একজন অত্যন্ত গুণী মানুষের দুর্ঘটনায় মৃত্যু। তাঁর নাম অরুণাভ মজুমদার। বড় জেঠার জ্যেষ্ঠ পুত্র। একসময়কার বিখ্যাত শিল্পী, মূকাভিনয়ে যিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সেই বড় দাদার আকস্মিক মৃত্যুর শোকাবহ এক বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। কলকাতা ছেড়ে চলে আসার প্রাক্কালে এই দুঃখবহ ঘটনা বলা বাহুল্য সবাইকে বেদনার্ত করেছিল। লেখক অত্যন্ত দরদি ভঙ্গিতে সেই শোকের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।

কলকাতার পাট চুকিয়ে তাঁরা এসে কিছুদিন বনগাঁয় ছিলেন। তখনকার জীবন খুব সুখের হয়নি লেখকের কাছে। ‘… কলকাতার জন্যে মন পুড়তে থাকে। একটা নব পরিচিত জীবন ছিল সেখানে। নতুন বন্ধু! নতুন দেখা। নতুন ছন্দও এসেছিল। হোক তা আপাত-অর্থহীন। কিন্তু বৈচিত্র্যে ভরা। তাই বনগাঁতে প্রথম কয়েকটা দিন কেমন তালহীন সুরহীন ঠেকল। বারবার শুরু করাটাই বুঝি মানুষের জীবন! সময় চলে যায়।’ (পৃ ৮১) এই শেষ কথাটির মধ্য দিয়ে লেখক যেন অনেক কথাই আমাদের বলে দিয়েছেন। সেই সময় রিলিফ নেওয়ার লাইনেও দাঁড়াতে হয়েছে এই বালককে। ট্রাক থেকে খিচুড়ি দেওয়া এবং তা নেওয়ার জন্যে লাইনে দাঁড়ানোর কথাও তিনি লিখেছেন মর্মস্পর্শী ভাষায়। ‘… আমার মাথায় তখন গ্রাম, শিশুকাল আর নির্মল জীবন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যুদ্ধের পরিণতির কথা কি মাথায় এসেছিল? হয়তো না। কিন্তু তবু তো পৃথিবীর শতশত যুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ মরেছে। ভয়ে আতঙ্কে লাখো মানুষ স্বদেশভূমি ছেড়ে পালিয়েছে। মানুষের পৃথিবী শ্মশান হয়েছে। বেঁচে ফেরা মানুষ ভারাক্রান্ত পাগল হয়েছে। অপরদিকে মানুষে মানুষে জন্মেছে ঘৃণা, অবিশ্বাস, ঈর্ষা ও প্রতিশোধ স্পৃহা।’ (পৃ ৮৯) একজন বালকও যে কতখানি অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়ে এমন সব ভাবনার শরিক হয়েছে একথা ভেবে অবাক হই। তাই কেবল মনে হয়, জীবনের পাঠ নিতে নিতে এমন করেই হয়তো মানুষ বড় হয়ে ওঠে। এক একজন এক একভাবে। যে যেভাবে বেড়ে উঠুক না কেন, সত্যসন্ধ জীবনের এও এক ধরনের অর্জন।

অবশেষে অনেক ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের অবসানে একদিন তাঁদেরও দেশে ফেরার সময় ঘনিয়ে এলো। সেই ফেরার ইতিবৃত্ত আরো করুণ এবং কষ্টের। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে তখন কেবল চারদিকে অভাব আর অনটনের হাহাকার। তবু সেই হা হা রবের মধ্যে একটিই কেবল সান্ত্বনা – দেশ স্বাধীন হয়েছে। শত সহস্র শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। দেশ পুনর্গঠনের সে এক মহা কর্মযজ্ঞ। ‘ভয় হতে তব অভয়মাঝে নূতন প্রাণ’ অর্জনের সে এক মহাপরীক্ষা। দেশে ফিরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা, সেখান থেকে উঠে গিয়ে আবার অন্যত্র – এইভাবে চলতে চলতে বিপুল অভাব আর অনটনের মধ্যে দুর্বহ জীবনের খেয়া বাইতে হয়। তবু চলিষ্ণু জীবন থামে না। অন্যায়-অবিচার, দারিদ্র্য আর বহু রকমের ঘাত-সংঘাতের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে এগোতে থাকে জীবন। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করা সেই জীবনের সেও এক মহা সন্ধিক্ষণ ছিল। সেই পরীক্ষার সেতু পার হয়ে নতুন দেশ বাংলাদেশ আজ বিশ্বের মানচিত্রে নতুন করে জায়গা করে নিয়েছে। লক্ষ লক্ষ প্রাণ আর অগণন মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আজ এক বাস্তব সত্য। লেখকের মতো অজস্র মানুষের দেখা সেই টুকরো টুকরো বর্ণনা দিয়েই গাঁথা হয়ে চলেছে মুক্তিযুদ্ধের অকথিত ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বর্ষপূর্তিতে তাই এমন একটি গ্রন্থের আত্মপ্রকাশকে মুক্তকণ্ঠে স্বাগত জানাই।

লেখালিখির জগতে তাপস মজুমদার নবাগত। কিন্তু তাঁর লেখনশৈলী বেশ দৃঢ় ও পাকাপোক্ত। বোঝা যায়, তিনি তৈরি হয়েই কলম ধরেছেন। তাঁর ভাষা অত্যন্ত প্রাঞ্জল। দেখার চোখটাও বেশ স্বচ্ছ। সোজা কথাটা তিনি খুব সোজাভাবেই বলতে পারেন। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাঝে মাঝেই যখন তাঁর লেখায় কবিস্বভাব উঁকি দেয়। সেই কবিত্ব আর নিজের চোখে দেখা বাস্তবের কঠিন ও কঠোর অভিজ্ঞতার অসম মেলবন্ধন তিনি তাঁর প্রথম গ্রন্থেই ঘটাতে পেরেছেন। লেখালিখির জগতে তাঁর এই আবির্ভাবকে খোলামনেই স্বাগত জানাই।