মেসিডোনিয়ায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের প্রসঙ্গ

ভারদার নদীর পাড়ে পাথরে বাঁধানো প্রমেনাদ ধরে আমরা হাঁটি। আজ মাত্র ঘণ্টা তিনেক পর ইউরি মাতসুইয়ামা হোটেল থেকে চেক আউট করবে। সে লেক অহরিদের দিকে বেড়াতে যাচ্ছে। জাপান থেকে দুদিন আগে ইউরি মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কোপিয়াতে এসেছে। তার কাঁধ থেকে ঝুলছে অনেক লেন্সে পূর্ণ একটি চামড়ার ব্যাগ।

ভোরের প্রথম আলোয় আমরা হোটেল ছেড়েছি। একটু হেঁটে, ইউরির প্ররোচনায় অতঃপর আমরা ঢুকে পড়ি ভিন্ন একটি বহুতলবিশিষ্ট বেজায় ব্যয়বহুল হোটেলে। লিফট ধরে সটান চলে আসি উনিশ কিংবা বিশ তলার রুফ-টপ পানশালায়। ওখানকার লুকআউট-ডেকে কাকভোরে জড়ো হয়েছেন জনাচারেক ক্যামেরা-কাঁধে পর্যটক। এরা ট্রাইপড সেট করে, লেন্স তাক করে আছেন ভারদার নদীতে আধুনিক কায়দায় নির্মিত পরপর দুটি ব্রিজের দিকে। ইউরি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে হাতে তুলে নেয় ক্যামেরা। নাট্যমঞ্চের পর্দা উঠে যাওয়ার মতো জোড়া ব্রিজের তলায় ঝিলমিল করে বাঁকা হয়ে বয়ে চলা নদীর জল।

মেয়েটি ছবি তুলতে ভালোবাসে, সে হামেশা খোঁজ করে, যেসব জায়গায় ঐতিহাসিক কারণে ছড়িয়ে আছে স্মৃতিময় সংবেদন, তার সুনির্দিষ্ট লোকেশন। ইউরির ভাষায়, ‘আই লাইক টু ইউজ মাই ভিনটেজ লেন্সেস্ টু ক্যাপচার নট অনলি দ্য হিস্টোরিক্যাল আসপেক্টস্ বাট অলসো নস্টালজিক ফিল অব অ্যা লোকেশন।’ আমি তাকে অটোমান জামানার কিছু নোনাধরা স্থাপত্যের আবহে ভরপুর লেক অহরিডের দিকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। ইউরির সঙ্গে ভবিষ্যতে আমার দেখা-সাক্ষাতের সম্ভাবনা ক্ষীণ, তাই কাকভোরে আমরা সেরে নিচ্ছি মর্নিংওয়াক।

নদীজলে ভাসছে জলদস্যুদের জাহাজের কায়দায় নির্মিত একটি পাল ছড়ানো জাহাজ। তার মাস্তুলে রীতিমতো মচ্ছব করছে সুরুজের সাত-সাতটি রং। রশ্মির কিছু চোখ-ধাঁধানো বিম বাঁকা হয়ে ঠোক্কর খাচ্ছে স্টোন ব্রিজের আধডোবা খাম্বায়। ইউরি হাঁটতে হাঁটতে বারবার থেমে পড়ে – ক্যামেরায় ধারণ করছে : পত্রিকা বিলি করা হকার, তাজা রুটির চালান নিয়ে এগোতে থাকা ভ্যান ও বাঁধানো ফুটপাতে বেডরোল ও কম্বল গুটানো হোমলেস মানুষদের খণ্ডচিত্র।

ইউরির সঙ্গে আমার পার্টি-পরব ও ক্লাসরুমে সামাজিকভাবে মিথস্ক্রিয়ার স্মৃতি বোধ করি বছর দশেক আগের। বয়সের নিরিখে সে সম্ভবত বারো কিংবা তেরো বছরের কনিষ্ঠ। এতে কিন্তু বাধাপ্রাপ্ত হয়নি আমাদের অন্তরঙ্গতা। ইউরি ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনে জাপান থেকে এসেছিল মাস্টার্স করতে। আমি তখন ছাত্রত্ব অতিক্রম করে পুরো সেমিস্টার জুড়ে শিক্ষকতা করছি। যতটা মনে পড়ে – আমার একটি ক্লাসে সে ছিল শিক্ষার্থী। পরবর্তী সেমিস্টারে আমি যখন ‘ইন্টারন্যাশনেল এডুকেশন’ শিরোনামে একটি কোর্স পড়াচ্ছি, তখন সে হয়ে উঠেছিল টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট বা সহশিক্ষক।

ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনের কোর্সটিতে ছাত্রসংখ্যা ছিল প্রচুর, আমার ওপর প্রতি সপ্তাহে তথ্যাদি গুছিয়ে পাঠপরিকল্পনা করার চাপও ছিল তুমুল। ওয়ার্মআপ অ্যাক্টিভিটি তৈরি করে শ্রেণিকক্ষে বৈচিত্র্য আনার মতো মানসিক অবকাশ আমার ছিল না। ইউরি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রতিটি ক্লাসে কখনো কীভাবে চপস্টিক দিয়ে সুশি সয়ি-সচে চোবাতে হয়, কিংবা এক নিশ^াসে পেইন্টব্রাশ দিয়ে আঁকতে হয় জাপানে প্রচলিত বৌদ্ধ ধর্মের একটি শাখা – ‘ঝ্যান’ মার্গের প্রথা মোতাবেক বৃত্ত, অথবা কটো মিউজিকের সঙ্গে মুখোশ পরে মৃদু নৃত্যের কলাকৌশল প্রভৃতি সাবলীলভাবে প্রেজেন্ট করতো। একবার তো পুষ্পিত চেরির নকশা আঁকা কিমানো পরে, নারী শিক্ষার্থীদের কীভাবে চোখে-মুখে নির্লিপ্ত ভাব ফুটিয়ে তুলে, কাগজের হাতপাখাটি নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে অপ্রত্যক্ষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়; এবং পুরুষ শিক্ষার্থীদের কীভাবে শিষ্টাচার বহাল রেখে একটি তরুণীকে তার দেহসৌষ্ঠবের তারিফ জানাতে হয়, এ সামাজিক পদ্ধতিটি বাতলে দিয়ে সেনসেশন সৃষ্টি করেছিল।

 প্রমেনাদের এদিকে আছে হাঁটাপথ ঘেঁষা পাথরে উঁচু করে বাঁধানো কয়েকটি কেয়ারি করা ঝোপঝাড়ে পুষ্পিত প্ল্যান্টার। ইউরি লাফ দিয়ে একটি প্ল্যান্টার-ওয়ালে উঠে পড়ে; ক্যামেরা তাক করে পা টিপে টিপে সে হেঁটে যাচ্ছে, আর সমস্ত শরীর জুড়ে তার তৈরি হচ্ছে তারুণ্যবিচ্ছুরিত দোলন। ইউরি টেলিলেন্সে আধডোবা খাম্বায় বসে থাকা বিরাট আকৃতির জোড়া হাঁসের অন্তরঙ্গতার ছবি তুলছে।

আমি অনেক বছর পর ফের তার দেহবল্লরী খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করি। ইউরির পিতা জাপানিজ-আমেরিকান, তবে মা শে^তাঙ্গ নারী – যিনি বেড়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীতে যুক্ত পিতামাতার তত্ত্বাবধানে জাপানের ওকিনাওয়া নগরীর একটি মিলিটারি বেসে। তাই মেয়েটির অ্যাথলিট-শোভন ফিগারে মিশে আছে প্রাচ্যদেশীর নারীদের ফেমিনিন সুষমা। বিষয়টা ক্লাসরুমেও ছেলেদের মধ্যে তৈরি করত আবেশস্নিগ্ধ মুগ্ধতা। বিশেষ করে ডিপ কাটের ভি-নেক টপ পরে সে যখন কীভাবে সৃষ্টি করতে হয় ইকেবানার পুষ্পিত বিন্যাস, কিংবা নৃত্যের বিশেষ কোনো মুদ্রা হাতেকলমে দেখাতো, তখন নীরবে ছড়িয়ে পড়তো চাপা এক্সাইটমেন্ট।

 ইউরি এবার ঘুরপথ ধরে ঢুকে পড়ে একটি অপ্রশস্ত গলিতে। মহল্লাটি পর্যটকদের কাছে ‘গ্রাফিটি ওয়াল’ নামে পরিচিত। আমরা দেয়ালে ফ্রেস্কো করে আঁকা বিমূর্ত সব নকশাচিত্রের দিকে নজর রেখে পা বাড়াই। সমাজতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার কঠোর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হওয়ার পর নাকি স্কোপিয়া নগরীর দেয়ালগুলিতে সদ্য শিল্পের স্বাধীনতা পাওয়া চিত্রকররা ইচ্ছামতো আঁকাজোকা করছিলেন, তো হালফিল পৌর কর্তৃপক্ষ তাদের সুবিধার্থে এ-মহল্লার দেয়ালগুলি গ্রাফিটি বা দেয়ালচিত্র আঁকার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।

দ্রুত হেঁটে আমরা চলে আসি অন্য একটি ছায়াচ্ছন্ন সরণিতে। সড়কের মাঝ বারবর জুতা পালিশ করা একটি ছেলের মূর্তি। আমি স্ট্যাচুটির বয়সের দিকে তাকিয়ে ভাবি, তবে কী সমাজতান্ত্রিক জমানায় স্কোপিয়া নগরীতে চালু ছিল জুতা পালিশের ব্যাপারটি?

মিনিট কয়েকের ভেতর আমরা মুখোমুখি হই ফের আরেকটি স্ট্যাচুর। এ-মূর্তির মানুষটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে তুমুলভাবে সক্রিয় মননঋদ্ধ একটি মন। জানতে ইচ্ছা হয়, জীবদ্দশায় ইনি কী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কোনো আন্দোলনের? কিন্তু ইউরি ফটাফট স্ন্যাপশট নিয়ে যেভাবে আগুয়ান হচ্ছে, বিশেষ কিছু জানা হয় না, তবে স্কোপিয়া নগরীর ভাস্কর্যগুলির বেদি ফের ভিজিট করার বাসনা হয়।

আমরা আবার পা চালাই। ব্যাটারিচালিত দুটি ভ্যান ওপেন-এয়ার ক্যাফেগুলিতে থেমে থেমে সরবরাহ করছে তাজা ফুল। সৌরভের সঙ্গে ছোট্ট গাড়ি দুটির চেসিস থেকে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি। ইউরি ফের বিরতি নিয়ে জুমলেন্স ঘোরায় বহতা নদীজলের দিকে। কেল্লার দিক থেকে কয়েকটি আলোর বৃত্ত ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে স্রোতজলে। একটি কায়াক-জাতীয় নৌকা হৃৎপিণ্ডের প্রতীকী-নকশাটি ছেদ করা তীরের মতো রশ্মি-বিচ্ছুরিত গোলক ভেদ করে ছুটে যায়। ভাংচুর হওয়া বৃত্তে এবার যেন এলোপাতাড়ি সাঁতার কাটছে অজস্র গোল্ডফিশ।

পরপর শাটার টেপার চেনা শব্দের ভেতর দেখি, একরাশ আওয়ারা আলো এসে রাঙিয়ে দিচ্ছে পিংকিশ-অরেঞ্জ কালারের সানড্রেস পরা ইউরির দেহবল্লরী। আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেই ফেলি, ‘দিস রোজ কালার লুকস্ ফেবুলাস অন ইয়োর লাভলি স্কিন … ইউরি।’ ক্যামেরা গোটাতে গোটাতে বেজায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সে রেসপন্স করে, ‘ড. সুলতান, ইউ লস্ট ইয়োর কালার সেন্স। রংটি রোজ না, আমি পরে আছি পিচ কালারের ক্যাজুয়েল সান-গাউন।’

ভোরবেলা হার স্বীকার করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়, তাই পাল্টি দিই, ‘কালার চিনতে আমার ভুল হয়নি ইউরি, এ কালারের গোলাপ-প্রজাতিটিকে বলা হয় সুইট মাদমোয়াজেল …। বিশ^াস না হলে গুগল ঘেঁটে দেখতে পারো।’

হাসিতে রাজ্যের কমনীয়তা ফুটিয়ে ইউরি প্রস্তাব করে, ‘আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড ইন রোজেস। তবে আমার ছোট্ট একটি প্রস্তাব আছে।’ সে নদীপাড়ে খালি গায়ে ব্যয়াম করা পুরুষদের দিকে ইশারা করে বলে, ‘ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু বি টোটালি টপ-লেস। শুধু শার্টের সব বোতাম খুলে পাড়ঘেঁষে একটু হেলে দাঁড়ালে, আমি কয়েকটি স্ন্যাপশট নেবো।’ আমসি-মুখে জানতে চাই, ‘দেন হোয়াট?’ যেন দোকানের কোনো পণ্যের দামদর করতে গিয়ে ব্যাপক আগ্রহ না দেখানোর ভান করছে, এমন ভঙ্গিতে কাঁধটি মৃদু ঝাঁকিয়ে ইউরি বলে, ‘নো বিগ ডিল, একটি জুতসই শট পেলে ম্যাগাজিনে বিক্রি করতে পারতাম।’ আমি মাথা হেলিয়ে ইশারায় অসম্মতি জানাই।

ফের হাঁটতে হাঁটতে সে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘আই ডোন্ট রিয়েলি আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াই ইউ সেইড নো। সুইমিংপুলে তো আমার সঙ্গে দু-একবার গেছো, তখন খালি গায়ে তোমাকে দেখিনি?’ আমি প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য মুখ সিরিয়াস করে জানতে চাই, ‘হোয়াই ইউ লাইক টু পাবলিশ ইয়োর পিকচারস ইন দিস পার্টিকুলার ম্যাগাজিন?’

খুব ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে সে যা জানায় তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে : জাপানের গ্লসি পেপারে ছাপা এ-ম্যাগাজিন অনেকটা প্লেগার্ল ম্যাগাজিনের মতো। পুরুষদের নগ্ন-অর্ধনগ্ন ছবি এতে মুদ্রিত হয়। নারীদের মধ্যে কাটতি দেদার, একটি ছবি ছাপা হলে পাওয়া যায় বেশ খানিকটা অর্থকড়ি। জাপানি কলেজে ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ইন্সট্রাকটর হিসেবে কাজ করে এক কামরার অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করা যায়, কিন্তু সঞ্চয় কিছু থাকে না। তো ইউরি ওখানে ছবি ছাপিয়ে যা উপার্জন করছে, তা দিয়ে বছরে একবার অন্তত সে বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর ব্যয় খানিকটা বহন করে।

ইউরি কীভাবে তার বিদেশভ্রমণ ফাইন্যান্স করে, এ নিয়ে নির্দ্দিষ্ট কোনো মতামত দেওয়া যেমন আমার অধিকারের বাইরে, তেমনি অধিক কৌতূহল দেখানোও মনে হয় শিষ্টাচারের পরিপন্থী। তাই বিশেষ কিছু না বলে ফের পা চালাই। ইউরি একাধিক ক্যামেরা ও লেন্সের ভারে ঈষৎ কুঁজো হয়ে চুপচাপ হাঁটছে। তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমার মাথায় ঘুরপাক করে।

তরুণ বয়সে ইউরির পিতামহ জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করতে এসে অভিবাসী হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ বাধলে, জাপ এয়ারফোর্স হাওয়াই দ্বীপের পার্ল হারবারে বোমাবর্ষণ করে ডুবিয়ে দেয় অনেক আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ। প্রতিক্রিয়ায় ১৯৪২ সালে, আমেরিকার তৎকালীন নেতৃত্ব তথা প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট জাপানিজ-আমেরিকান অভিবাসীদের বন্দিশিবিরে পাঠান। মোট দশটি ক্যাম্পে বিভক্ত বন্দিশিবিরগুলি ‘ইন্টার্নমেন্ট ক্যাম্প’ নামে ইতিহাসে উল্লিখিত। বন্দি জাপানিজ-আমেরিকান  Ñ যাদের আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘এনিমি রেস’ নামে – তাদের সংখ্যা ছিল এক লাখ ২০ হাজার জন। তাদের  অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ইউরির পিতামহের পরিবার, তার বাবার বয়স ছিল দুই বছর তিন মাস। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শেষ হলে এদের বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।

অনেকদিন আগে আমরা যখন বিশ^বিদ্যালয়ে একত্রে একটি কোর্স পরিচালনা করছিলাম, তখন কোর্সের পয়লা দিকে ‘ফ্যামিলি ট্রি’ নামে একটি অ্যাক্টিভিটিতে আমাদের শামিল  হতে হয়েছিল। ছাত্র-শিক্ষক সকলে – গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে, পোস্টার-পেপারে বৃক্ষের প্রতীক এঁকে – আমাদের পরিবারের শিকড় কোন কোন দেশে, তারপর কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন দেশে পরবর্তী প্রজন্মের ছড়িয়ে পড়া – এসব নিয়ে সমবেতভাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম, এবং এই সূত্রে জেনেছিলাম ইউরির পিতামহের পরিবারের ইন্টার্নমেন্ট ক্যাম্পে বন্দি হওয়ার কথা।

এ-ঘটনা ইউরির বেড়ে ওঠাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে, তা জানতে অনেকদিন হলো আমার মধ্যে দানা বাঁধছে কৌতূহল। কিন্তু প্রসঙ্গটি তোলার কোনো সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এ মুহূর্তে ইউরি ফুটপাতের প্রতিটি ডিটেইলসের দিকে নজর দিয়ে, চোখেমুখে বেজায় কনসেনট্রেশন নিয়ে হাঁটছে। ভাবি, দিস ইজ রং টাইমিং, এখন জটিল কোনো প্রশ্ন করে ইউরির মুড নষ্ট করে দেওয়া উচিত হবে না।

অনেকক্ষণ হাঁটা হলো। একটি ওয়াটারফ্রন্ট ক্যাফেতে মাত্র ‘ওপেন’ লেখা বাতিটি জ¦ালানো হয়েছে। আধমরা  গাছের খণ্ডিত ছায়ায় পাতা টেবিলটিতে আমরা বসে পড়ি। বৃক্ষটি মাইনে বাকি পড়া কনিষ্ঠ কেরানির মতো মন খারাপ করে বসা মাত্র ঝরিয়ে দেয় গোটা সাতেক হলদে পাতা। ইউরি আলতো হাতে পাতাগুলি তুলে নিয়ে সাবধানে তা ছড়িয়ে দেয় গাছটির গোড়ায়। উর্দিপরা একজন ওয়েটার কফির ধোঁয়া ওড়া জারটি নিয়ে টেবিলে আসেন। আমি চিজ মেশানো কোঁয়াসোর সঙ্গে মিষ্টি ম্যাকরুনের অর্ডার করি।

আমাদের টেবিলে কয়েকটি নিরীহগোছের পিঁপড়া হাঁটাচলা করছে। ওয়েটার একখানা আর্দ্র ঝাড়ন নিয়ে আসেন। ইউরি ইশারায় মাঝপথে তাকে থামিয়ে দেয়। সে গাছটির গোড়া থেকে এইমাত্র ছড়িয়ে পড়া দুটি ঝরাপাতা কুড়িয়ে নিয়ে তাতে ভীষণ হুঁশিয়ারির সঙ্গে তুলছে পিঁপড়াগুলিকে। ঝরাপাতার ভেলায় চড়া পিঁপড়াদের সাবধানে গাছতলায় ঘাসে ছেড়ে দিয়ে ইউরি এমন হাসিমুখে আমার দিকে তাকায় যে, মনে হয়, ভেজা ঝাড়নটির আঘাতে আহত-নিহত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে পিঁপড়াগুলিকে বাঁচাতে পেরে সে দারুণ খুশি হয়ে উঠেছে।

ইউরি মগভর্তি গরম পানি চেয়ে নিয়ে পার্স থেকে বের করে ফারমেন্টেড গ্রিন-টির কৌটা। সে এবার দারুণ মনোযোগে মগটিতে ফেলছে একটি-দুটি করে চায়ের শুকনা পাতা। বিশ^বিদ্যালয় জীবনের ছোট্ট একটি স্মৃতি ফিরে আসে আমার করোটিতে। একজন অধ্যাপকের বাড়ির পেছন দিকের আঙিনায় জমেছিল ছাত্র-শিক্ষকদের বৈকালিক পার্টি। কাঠের পাটাতনের ওপর নির্মিত প্রশস্ত ডেকটিতে বসেছে বার-বি-কিউ ও বিয়ারের হল্লা-কৌতুকে মশগুল জলসা। জনাকয়েক ছাত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছে সংলগ্ন লিভিংরুমের ফায়ারপ্লেসটি ঘিরে। আমরা দু-একজন বসেছি ছাঁটা ঘাসের প্রাঙ্গণে সাজিয়ে রাখা ডেক-চেয়ার কিংবা বেঞ্চে।

ততদিনে দক্ষ ফটোগ্রাফার হিসেবে ইউরি প্রিয় হয়ে উঠেছে সতীর্থদের মধ্যে। পার্টিতে ঘুরে ঘুরে পোলারয়েড ক্যামেরায় সে একেকজনের ছবি তুলছে আর প্রিন্টটি শুকালে ফটোগ্রাফটি উপহার দিয়ে ইন্সট্যান্টলি প্রশংসাভাজনও হচ্ছে।

পার্টিতে অত্যধিক পানের প্রতিক্রিয়ায় কোলাহল প্রবল হয়ে উঠলে আমি সরে আসি প্রাঙ্গণের এক প্রান্তে। চুপচাপ বসেছিলাম ওক গাছের নিচে ফেলা রাখা বিরাট পাথরের ওপর। গোধূলির রং পুরোপুরি মুছতে না মুছতেই শুরু হয় চারদিকের ঝোপঝাড়ে নানাবিধ পতঙ্গের ঝিম-ধরা শব্দ। মৃদু পদক্ষেপে ইউরি এসে আমার পাশে বসে পড়ে। মনে হয়, রাজ্যের মানুষজনের ছবি তুলে তুলে সে ক্লান্ত।

ইউরি বসা মাত্র তাকে ঠিকমতো হ্যালো বলারও অবকাশ পাইনি, শুরু হয় অপ্রত্যাশিতভাবে তুষারপাত। না, বর্ষণের তোড় বিরাট কিছু না, তবে আকাশ থেকে যেন গড়িয়ে নামছে ধবধবে সাদা আকারের খুব ছোট্ট ছোট্ট পুতির মতো তুষারের বল। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই শুভ্র বলগুলি ‘ফ্লারি’ নামে পরিচিত। সারা গায়ে – জামা-কাপড়ে, বোতাম ও পকেটের ভাঁজে নিমেষে জমতে থাকে ছোট্ট ছোট্ট গোলক। এগুলি গায়ে নিয়ে বসে থাকলে কাপড় আর্দ্র হয়ে উঠবে। তাই আমি ঝেড়ে-মুছে ঠুসকি দিয়ে সরানোর চেষ্টা করি।

ইউরি খপ করে আমার হাত ধরে, তার চোখে ফুটে ওঠে আন্তরিক অনুনয়। মেয়েটির বিনীত আবেদন হচ্ছে, মাইক্রো মাপের শুভ্র এ-বলগুলির জীবনের মেয়াদ মাত্র মিনিট দুয়েক। আপনা-আপনি গলে যাওয়ার ভেতর দিয়ে এদের শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্তির দিকে যেতে দেওয়াই উচিত। ঠুসকি দিয়ে ঝেড়ে ফেললে আকৃতি ভেঙেচুরে এরা শুধু আহতই হবে না, জীবনের মেয়াদও তাদের হবে অপ্রত্যাশিতভাবে সংক্ষিপ্ত।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিলাম, ‘ঝ্যান’ মার্গের বৌদ্ধরীতিতে নিয়মিত মেডিটেশনের ফলে তবে কী ইউরির মধ্যে তৈরি হয়েছে পিঁপড়া কিংবা বরফকুঁচির মতো সামান্য সব প্রাণের প্রতি তার অসামান্য সংবেদন? সচেতন হয়ে উঠি যে, ইউরি নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। জানতে চাই, ‘হোয়াটস আপ?’ জবাব আসে, ‘ইউ ডিডন্ট আনসার মাই ই-মেইল, এর অর্থ কী আমার রিকমেন্ডেশন তোমার মনে ধরেনি।’ আমি কাজের চাপ জাতীয় একটি অজুহাত দিতে যাই। সে আমাকে চুপ করতে ইশারা দিয়ে বলে, ‘জবাবটা একটু চিন্তা-ভাবনা করে দিলে আমি খুশি হবো।’

বছর কয়েকের বিরতির পর ম্যাসাচুসেটসে একটি অ্যালামনাই রিইউনিয়নের উসিলায় আমরা ফি-বছর বিনিময় করছি তিন-কিংবা চারটি ই-মেইল। কোনো দেশ আমার মনে ধরলে, আমি তাকে শুধু ভ্রমণসংক্রান্ত তথ্য দিয়ে সাহায্যই করি না, বরং যুক্তি দিয়ে এনকারেজ করি ওই দেশটিতে সে যাতে সফরের উদ্যোগ নেয়। বিষয়টি একতরফা নয়, সেও আমাকে পাঠাচ্ছে ভ্রমণের সম্ভাবনায় ভরপুর কোনো না কোনো দেশের তথ্য। বছর দুয়েক আগে আমি ইউরিকে লিখেছিলাম যে, আমি নানা দেশের হরেক কিসিমের দ্বীপপুঞ্জে ঘুরে বেড়িয়ে তা নিয়ে একটি বই লেখার পরিকল্পনা করেছি। সেই সূত্রে ইউরি প্রশান্ত মহাসাগরীর একটি দ্বীপপুঞ্জের বিষয়-আশয় বিস্তারিতভাবে লিখে আমাকে সেখানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে।

ইউরি চোখমুখে বিরক্তি ফুটিয়ে মন্তব্য করে, ‘আই অ্যাম শিওর ইউ ডিডন্ট বদার টু রিড মাই ই-মেইল কেয়ারফুলি?’ আমি তার দিকে তাকাই, মুচমুচে কোঁয়াসোর টুকরা-টাকরা শুধু তার ঠোঁটেই নয়, কয়েকটি ছিটকে পড়ে বেমক্কাভাবে আটকে আছে স্তনবিভাজিকায়ও। আমি তা ঠুসকি দিয়ে ফেলে দেওয়ার প্রলোভন সামলে পেশাদারি ভঙ্গিতে জবাব দিই, ‘তুমি প্রশান্ত মহাসাগরের পিলেলু দ্বীপের কথা লিখেছো, মনোযোগ দিয়েই পড়েছি, মোট ৩৪০টি দ্বীপের সমাহারে সৃষ্ট দ্বীপদেশটির নাম পালাও। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর এটি হয়ে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দখলকৃত টেরিটরি, ১৯৯৪ সালে পালাও লাভ করেছে স্বাধীনতা।’

তার ই-মেইলে বর্ণিত উপাত্ত মনে রাখার দক্ষতায় সে বিশেষ একটা ইমপ্রেসড হয় না, বরং বিদ্রƒপ করে বলে, ‘৩৪০টি দ্বীপে ঘোরাফেরা করার কোনো প্রয়োজন নেই, মাত্র ১৬টি দ্বীপে আছে জনবসতি, তোমাকে শুধু পিলেলু দ্বীপে যেতে লিখেছিলাম, জাস্ট আনসার মি হোয়াই ইউ ইগনোরড মাই রিকোয়েস্ট, যাওনি কেন?’

ইউরির এ ত্যাঁদড়গোছের স্বভাবের সঙ্গে আমি পরিচিত, তাই কাউন্টার অফেন্সিভের উদ্যোগ নিই, ‘তোমাকে মন্টিনিগ্রো সম্পর্কে তথ্য পাঠিয়েছিলাম, ছোট্ট এই দেশটি মেসিডোনিয়ার সীমান্তের কাছেই, যেতে তো তুমিও কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছো না ইউরি, হোয়াই?’

ক্যামেরার ডিজিটাল স্ক্রিনে কী একটা খুঁজতে খুঁজতে ইউরি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলে, ‘ইটস্ বাজেট, জাস্ট অ্যা লিটিল মানি …, তোমার মতো ফেন্সি কনসালট্যান্সির কোনো সুযোগ আমার নেই, আই ক্যান্ট ফাইন্যান্স দ্য কস্ট অব গোয়িং টু মন্টিনিগ্রো।’  সে চুপ করে স্ক্রিনে কিছু স্ক্রল করলে আমি বলেই ফেলি, ‘কনসালট্যান্সির রোজগার থেকে আমারও কিছু উদ্বৃত্ত থাকে না যে চাইলেই ফ্লাই করতে পারি পিলেলু দ্বীপে … ওখানে ট্র্যাভেল করতে হলে … বুঝলে … আমাকে অশে^র আত্মজীবনী লিখে রাহাখরচ সংগ্রহ করতে হবে।’

আমার এ-মন্তব্যে বোধ করি পরিবেশ একটু হালকা হয়। ফুটে ওঠা কলিটির মতো সারামুখে হাসি ছড়িয়ে ইউরি বলে, ‘মাই স্টোরি ইজ প্রিটি মাচ দ্য সেম। মন্টিনিগ্রোতে যেতে হলে … আমাকে খুঁজে পেতে বের করতে হবে গোটা ছয়েক সুঠাম সুদর্শন পুরুষ … যারা নিরাভরণভাবে ম্যাগাজিনের ছবির জন্য পোজ দিতে আগ্রহী … দিস ইজ দ্য অনলি ওয়ে আই ক্যান আর্ন সাম এক্সট্রা মানি টু ফাইন্যান্স মাই ট্রাভেল টু মন্টিনিগ্রো … ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?’

আমি কাজের কথায় আসি, ‘হোয়াট এলস ওয়ান মাইট সি ইন পিলেলু আইল্যান্ড? দর্শনীয় বিষয়বস্তু নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত বলো তো ইউরি?’ মøান হেসে সে টিপ্পনী কাটে, ‘ইউ ক্লিয়ারলি ডিডন্ট ডু ইয়োর হোমওয়ার্ক …। ই-মেইলে অ্যাটাচ করে দুটি জং-ধরা ভাঙাচোরা ট্যাংকের ছবিও পাঠিয়েছিলাম। তাও মনে হয় ওপেন করোনি।  দ্বীপটি সুন্দর, কিন্তু থ্যাইল্যান্ডের পুকেট বা কোসামুই আইল্যান্ডের মতো পিলেলুর সেক্সি কোনো ডাইমেনশন নেই।’ একটু অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করি, ‘তাহলে একজন পর্যটক ওখানে যাবে কেন? নিশ্চয়ই ঐতিহাসিক কিছু আছে ওখানে, প্লিজ স্পেল ইট আউট ফর মি … ইউরি।’

ক্যামেরাটি আমার নাকের ডগায় সেট করতে করতে সে বলে, ‘ইটস অল অ্যাবাউট সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার। পিলেলু ছিল জাপ (জাপানি) সৈনিকদের দখলে। আমেরিকার মেরিন বাহিনী ওখানে ল্যান্ড করতে যায়, বাধে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। তো আমেরিকান আর্মি যখন পিলেলু দখল করতে সমর্থ হয় … ততদিনে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়েছে এক হাজার ৭৯৪ জন মেরিন সৈনিক; অন্যদিকে জাপবাহিনীর নিহতের সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৬০০ জন।’

জানতে চাই, ‘ই-মেইলে পিলেলুর সঙ্গে তোমার কী একটা পারিবারিক যোগাযোগের কথা আবছাভাবে লিখেছিলে?’  প্রশ্নের মাঝ বরাবর আমাকে থামিয়ে দিয়ে সে অনুরোধ করে, ‘ফার্স্ট আই লাইক ইউ টু লুক অ্যাট দিজ পিকচারস।’ আমি তার ক্যামেরার স্ক্রিনে সøাইড শোর দিকে নজর দিই। ভেসে যেতে থাকে জাপ-আর্মি ও আমেরিকান মেরিন সৈনিকদের জং ধরা হেলমেট, সবুজ মসে আচ্ছাদিত ব্যাংকার, সৈকতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সমরাস্ত্র, পাড়ে তোলা আধভাঙা গানবোট, ভূপাতিত জঙ্গিবিমান প্রভৃতির চিত্র।

আমি মনোযোগ দিয়ে জলপ্রপাতের তলায় নিহত জাপানি ও আমেরিকান সৈনিকদের পাশাপাশি কবরগুলির দিকে নীরবে তাকিয়েছিলাম, ইউরি ফিসফিসিয়ে বলে, ‘পিলেলু হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ বিষয়ক ওপেন-এয়ার মিউজিয়াম। ওখান থেকে সমরাস্ত্র বা অন্য কোনো স্মারক – কিচ্ছুু সরানো হয়নি। যুদ্ধক্ষেত্রে যেভাবে পড়ে ছিল, ঠিক ওইভাবে এগুলিতে নীরবে জং ধরছে। যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতিতে মিত্র হওয়া দুই দেশ তথা জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি তহবিল দিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’

আমি যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকা একটি জাপানি হেলমেটের দিকে তাকিয়েছিলাম। তাতে নীড় বেঁধে ডিমে তা দিচ্ছে পালক ফুলানো মা-পাখি। ইউরি ফের কথা বলে, ‘এই হেলমেটটি পরে যুদ্ধ করতে পিলেলুতে গিয়েছিলেন আমার বাবার এক নিকট-আত্মীয়, তাঁর কংকাল সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সমাহিত করা হয়েছে। কিছু গুলিবিদ্ধ হেলমেটটি যেভাবে পড়ে ছিল, ঠিক ওইভাবেই রাখা হয়েছে। আমাদের আরেক আত্মীয় মিসোনি সো-তো তোমমি পিলেলু দ্বীপে ফিরে গিয়ে ছবি তুলতে শুরু করে। তার ছবির প্রদর্শনী যুক্তরাষ্ট্রেও সুনাম কুড়িয়েছে।’

আমি স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে বলি, ‘আই অ্যাম ফাইন্ডিং পিলেলু আইল্যান্ড এক্সট্রিমলি ইন্টারেস্টিং।’ সে হাসিমুখে জানায়, ‘আই নো ইউ উড বি ইন্টারেস্টেড। আরেকটি তথ্য দিচ্ছি, হেলমেটের নীড়ে বসা পাখিটি পরিযায়ী, আমেরিকার মেইনল্যান্ড থেকে প্রতিবছর পিলেলু দ্বীপে উড়ে গিয়ে এরা নীড় বাঁধে, জন্ম দেয় ছানা, মাঝে মধ্যে আমেরিকার পাখিগুলি জাপানি সৈনিকদের পড়ে থাকা হেলমেটে বাসা বাঁধতে পছন্দ করে।’ আমি বলে ওঠি, ‘ওয়াও … গুড গড … মৃত জাপানি সৈনিকের হেলমেটে আমেরিকা থেকে উড়ে যাওয়া পরিযায়ী পাখির নীড়। আই অ্যাম শিওর আই মাস্ট সি দিস।’

সকাল নয়টা বাজতে আরো মিনিট দশেক বাকি আছে। আমরা বিল মিটিয়ে দিয়ে হোটেলের দিকে পা বাড়াই। যেতে যেতে ইউরি বলে, ‘আরেকটি তথ্য খেয়াল করে শুনে নাও। পিলেলু আইল্যান্ডে পর্যটন বাড়ানোর জন্য জাপানি বা আমেরিকার সাবেক সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজনদের তিরিশ শতাংশ ছাড়ে ভ্রমণের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। প্রমাণাদি সাবমিট করলে ইলেকট্রনিক্যালি দেওয়া হয় একটি কোড নাম্বার। তুমি চাইলে আমার নাম্বারটি ব্যবহার করতে পারো, দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে যাওয়ার ফ্লাইট, হোটেল সব কিছুতে ইন্সট্যান্টলি ছাড় পাবে।’ হোটেলের লবিতে ঢুকতে ঢুকতে আমি ইউরির কব্জিতে চাপ দিয়ে বলি, ‘নাউ আই অ্যাম টোটালি হুকড্ টু দ্য আইডিয়া টু ফ্লাই টু পিলেলু, কুল।’

লবিতে ঢোকামাত্র রিসেপশন থেকে এক হোটেলকর্মী নিয়ে আসে আমার জন্য একটি মেসেজ। আমেরিকান কলেজের ফ্যাকাল্টি ব্র্যানডন রাইসনার রিং করে মেসেজটি রেখেছেন। আমি চিরকুটে চোখ রাখি। কথা ছিল সাড়ে দশটার দিকে আমেরিকান কলেজের ফ্যাকাল্টি লাউঞ্জে গিয়ে আমি তার সঙ্গে দেখা করবো। তিনি রোমা সম্প্রদায় বা জিপসিদের পল্লি সুটো ওয়াজিরির কারো সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবেন। তার মাধ্যমে হয়তো আমি ইসলাম ধর্ম পালন করা রোমাদের মসজিদে যাওয়ার সুযোগ পাবো।

মেসেজ পড়ে মনে হয়, ব্র্যানডন মসজিদের যোগসূত্রের তালাশ পেয়েছেন। একজন রোমা নারীও রাজি হয়েছেন পারিতোষকের বিনিময়ে আমাকে মসজিদে নিয়ে যেতে। পরিকল্পনাতে একটু অদলবদল হয়েছে, আমাকে আর আমেরিকান কলেজে যেতে হবে না। নিকোলেতা বিথুন নামে একটি রোমা-নারীকে নিয়ে দশটার সময় ব্র্যানডন হোটেল লবিতে আসবেন।

দশটা পনেরো মিনিটে স্কোপিয়া থেকে একটি বাস যাচ্ছে লেক অহরিডের দিকে। হোটেলে থেকে বাসস্টপের দূরত্ব মিনিট পাঁচেকের। তো আমি ও ইউরি পরস্পরকে গুডবাই বলে প্রস্তুতি নিতে যার যার রুমের দিকে ছুটি।

কাপড়চোপড় চেঞ্জ করে ব্র্যানডনের অপেক্ষায় বসেছিলাম হোটেলের লাউঞ্জে। লাগেজের ট্রলিটি ঠেলে ঠেলে গেটের দিকে যাওয়ার পথে ইউরি আমাকে দেখতে পেয়ে থেমে পড়ে। আমি ফের গুডবাই বলতে হেঁটে যাই তার দিকে। আমরা পরস্পরের দিকে তাকাই, সে গণ্ডদেশ বাড়িয়ে দিলে আমি তাতে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে খেয়াল করি, তার চোখের কোলে ভেসে ওঠা বয়সের ছাপে লাইট কালারের শ্যাডো ও মৃদু মাসকারা। বিদায় জানিয়ে লাউঞ্জের সোফার ফেরার পথে আমি দাঁড়িয়ে পড়ে ঘাড় ঘোরাই। সিঁড়ি ধরে নেমে যাচ্ছে সে গাড়িবারান্দায়, তাই পুরোপুরি আর তাকে দেখতে পাই না। কাচের দুটি স্বয়ংক্রিয় পাল্লা বন্ধ হয়ে আসছে, তার ফাঁক দিয়ে ইউরির পেইজবয় কাটে কান ছাপিয়ে ঘাড়ের দিকে নেমে আসা জেটব্ল্যাক চুলের একটি গুচ্ছ যেন ঝলসে ওঠে।