উদ্বাস্তুর স্বপ্নযাত্রা

খবরটা কে আনে, জানি না।

তবে আমি জানি এ-সময় কী করতে হবে। বোনকে একটা মাটির গর্তে লুকিয়ে রেখে নিজে ঢুকে যাই গভীর জঙ্গলে। বর্বরদের হাত থেকে আগে জীবন রক্ষা করতে হবে।

জমাট অন্ধকার। আকাশ দেখা যায় না। দেখা গেলে হয়তো আলো আসত। গভীর বনের ভেতর রাতে এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না? রাতটা কোনো রকমে একটা গাছে কাটিয়ে দিলে হয় না! ভোর হলে সাহস ফিরে আসবে। রাতের অন্ধকারে অসহায় লাগছে। মৃত্যুর বিভীষিকা চোখ থেকে এখনো সরে যায়নি! আর মরণ-অন্ধকারটাও চোখে বসে আছে যেন! কবরে কি এর চেয়েও বেশি অন্ধকার?

এখন এসব কিছু নিয়ে ভাবার মতো সময় নেই। আগে জীবন বাঁচাতে হবে।

আমার ভয় লাগছে না। ভয় কেটে গেছে। মানুষের ছিন্নমুণ্ডু দেখে শরীরের ভেতর যে অস্বস্তি লেগেছিল, তা এখন আর নেই। অবিরল রক্তের ধারা এখনো চোখের ভেতর। মৃত্যুর এতো কাছে থেকে ফিরে এসে ভয় আর থাকে কি! ভাবনা পরে। আগে গাছটাতে ওঠার ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু ওঠার আগে একটা লম্বা শক্ত লতা নিয়ে উঠতে হবে। নিজেকে গাছের সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। না হয় ঘুমালে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। খুঁজে খুঁজে একটা মোটা লতা বের করে আনলাম। টেনে ছিঁড়তেও অনেক শক্তি লাগে। হাত জ¦লতে থাকে।

 পেট জ¦লতে থাকে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে। এতো ক্লান্তি, এতো ঘুম কোত্থেকে এলো। সারারাত পোকামাকড়ের কামড় খেয়ে আবার সেই নিজেদের ঘরবাড়িতে ফিরতে হবে। একটু শান্তি চেয়েছিলাম। নিরাপদ আশ্রয় চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই মহিলাটি তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ওর চেহারা মনে উঠলেই মনে হচ্ছে আমি কোনো ডাইনির চেহারা দেখছি। এ নিয়ে এখন বিশ্বরাজনীতি তোলপাড় হবে। বিবিসি, সিএনএন, আরো যারা আছে তারা সংবাদের বন্যা বইয়ে দেবে। বিশ্ববাসী জানবে আর আহা, উহু, করবে। হয়তো কোনো কোনো শহরে তাদের জন্য মিছিল হবে। প্ল্যাকার্ড ধরে সবাই হেঁটে যাবে। কিন্তু তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। সবাই দেন-দরবার করবে। কেউ কেউ  কোকিল (উকিল) বাপ সাজবে। আবার কেউ কেউ তাদের নিয়ে ভোটাভুটিও করবে। আসলে সব হচ্ছে ক্ষমতার লড়াই। ক্ষমতা আর সুবিধাভোগী মানুষগুলি সব সময় নিজেদের লাভটাই চায়। আজ হয়তো অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এমন করুণ অবস্থায় আছি। না হয় সুযোগ পেলে আমরাও মনে হয় অন্যদের মতো হয়ে যেতাম। তখন অন্যেরাও আমাদের হিংস্র কিংবা জাতি হিসেবে খুব নিকৃষ্টের দলে ফেলে দিত।

দুই

আমি আকাশ দেখি। আকাশের ওপারে চোখ ফেলে রাখি। আকাশের শেষ কোথায়? জানি না। শুধু মনে হয়, এই আকাশের অন্যপ্রান্তে সুখ আছে, শান্তি আছে। আকাশের দিকে তাকালে আমার এক শক্তিমানের কথা মনে হয়। কেউ একজন সর্বশক্তিমান এর আড়ালে রয়েছেন। যিনি পর্যবেক্ষণ করছেন সবকিছু। তবে কেন জানি মনে হয়, তিনিও নিরপেক্ষ নন! পৃথিবীতে আসলে আমরা কেউ নিরপেক্ষ নই। কারো না কারো পক্ষে আমাদের অবস্থান।

হায় সৃষ্টিকর্তা! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বুকের ভেতর হাজার দীর্ঘশ্বাসের কারখানা। এতটুকু বুকের ভেতর মানুষের এতো অনুভূতি কীভাবে জন্ম নেয়, তা আমি বুঝতে পারি না। আমাদের মতো ছিন্নমূল মানুষের কথা ভেবে সৃষ্টিকর্তা সময় ক্ষেপণ করতে চান না। এমনটা ভাবতে আমার কষ্ট হয়। তাই আমি বারবার তওবা করি। ভেতরে অনুশোচনা হয়। ইস্, এমন করে সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করা ঠিক নয় বুঝি! এটা আমাদের কপালের লিখন। অকর্মা মানুষের মতো আমিও কপালকে দোষারোপ করি। আসলেই তো অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। আমি শয়তানকে দুয়ো দিই। শয়তান আমাকে যেন প্রলোভন না দেখায়। আমি মহান শক্তিমান সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখতে চাই। আমি খোবায়েত। ভাগ্যবিড়ম্বিত আরকান থেকে তাড়া-খাওয়া এক যুবক। আমি একজন সুন্দর মানুষ হতে চেয়েছিলাম। আমি জন্মভূমিকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। আমি দেশের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলাম। আমার দু-চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল। আমার স্বপ্নেরা কী মরে গেছে? মরেনি। আমি মরতে দেব না। আমি মহান শক্তিমানের কাছে শক্তি চাই।

ভাবনায় তবু আসে সেদিনের কথা। এমন করুণভাবে ডেকেছে সবাই মহান শক্তিমান শুনতে পাননি কেন? আমাদের ডাকে তিনি সাড়া দেননি। তার সাড়া দিতে কত সময় লাগে? আসলে তো নিজেরাই নিজেদের সাহায্য করার মতো সুযোগ নেই, অন্যের সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের করার কিছু নেই।

অবশ্য কাবুল আমাকে বলেছে, ‘আল্লার বিচার আস্তে আস্তে। মরণের পরে। এই দুইন্যার মানুষের বিচার ফুরাইলে আল্লার বিচার শুরু অইব। বাঁচি থাইলে মানুষ বিচার গরে আর মরি গেলে আল্লাহ শাহেনশাহ হইব। পৃথিবীত তো সময় কম আর মরণের পরে অনন্তকাল। খেলা চলিব হেডে।’

কাবুল আমার খেলার সঙ্গী। আমার চেয়ে কাবুল একটু বেশি বুদ্ধি ধরে। তাই ওর কথা আমি আমলে নিই।

কাবুলের অনেক কথাই আমি বুঝি না।

‘আইচ্ছা, আঁই কী তোর তুন ছোড না?’

‘ক্যানে জানি!’

কাবুল বলে, ‘এই পৃথিবীত জোর যার, মুলক তার।’

আর এ-কথাটাই আমার বুঝতে এতোদিন সময় লেগেছে।

সবকিছু জোরজবরদস্তি করে দখল নিতে হবে কেন? কেন আমরা সভ্য হয়ে বসবাস করতে পারি না। পৃথিবীর জন্ম হয়েছে কত বছর হয়েছে? মানুষগুলি এখনো বুনোই রয়ে গেছে। কারটা মেরে খাওয়া যায়, সে-চেষ্টাই করে। নিজেরটা নিয়ে কেউই সন্তুষ্ট নয়।

তাহলে মানুষ শিক্ষিত হয় কেন? উন্নত দেশের মানুষগুলিও বুঝি এমন। ওরাও এমন জোরজবরদস্তি করে? অকারণে মানুষ মানুষকে মারে? আমরা না হয় একটা দেশের সংখ্যালঘু হিসেবে নিগৃহীত হয়েছি, অন্যেরা কী করে?

মাথার ভেতরে ভাবনার একটা জট পাকিয়ে যায়। আর ভাবতে পারি না।

আমি মনে করি, সংখ্যালঘু হিসেবে যারা থাকে তাদের ওপর ঝুঝি কারণে-অকারণে এমনই অত্যাচার নেমে আসে। আর এই অত্যাচারের পর আমার কেবল ধর্মের ওপরেই মন খারাপ হয়। এমন কী হতো পৃথিবীতে ধর্ম না থাকলে? সবার ধর্ম হতো মানবতা। কিন্তু তা বুঝি কখনো হওয়ার নয়!

তাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যা মনে হয় ধর্ম। ধর্মের বিদ্বেষ মানুষকে জাতিগত সহিংসতায় লিপ্ত করে। মানুষ তার আচরণ দিয়ে ধর্মকে অহংকারী বানিয়ে ফেলেছে। একশ্রেণির মানুষের ওপর আমার বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। সেটা আমি টের পাই। নাকি ধর্মের জন্য পৃথিবীব্যাপী মার খাওয়ার জন্য আমার মনের এই দশা? কে জানে – হলে হতেও পারে!

আমার মনে প্রায়ই এমন একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়, ধর্ম বড় নাকি মানুষ বড়? কিন্তু পাপ হবে ভেবে এসব নিয়ে বেশি কিছু ভাবতে চাই না আমি। চোখের সামনে থেকে সেই রাতের নারকীয় ছবিটা সরতে চায় না। কিছু কিছু স্মৃতি আছে এমনি। মানুষ ভুলে যেতে চায়। কিন্তু সেসব ভোলা যায় না। এটা মানুষের ক্ষেত্রেই শুধু হয়। কারণ অন্য কোনো প্রাণীর এই স্মৃতি নিয়ে জাবরকাটা নেই মনে হয়। হয়তো থাকলেও থাকতে পারে। মানুষ কোনো কিছুই ভুলে যায় না। হয়তো বিস্মৃত হয়। কিছুদিন বুকের ভেতর কিংবা এটা মাথার ভেতর ঘুম পাড়িয়ে রাখে স্মৃতিগুলিকে।

চোখে ভাসছে মানুষের হুটোপুটি। কাকুতি-মিনতি আর মর্মান্তিক চিৎকার। সেদিন বোধ-বুদ্ধি সব যেন থমকে গিয়েছিল। মাথার ভেতর একটা ক্রোধ চেপে বসেছিল। সবার ওপর এতো ক্রোধ কেন আমার। জানা-অজানা সকল অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করেছিলাম অন্যায়কারীদের ওপর। তাতে ওদের কিছুই হয়নি। গালিতে কারো কিছু হয় না। পৃথিবীর মোড়লরা শুধু ক্ষমতার দম্ভ করতেই জানে। তাদের লাভের অংকটাই বেশি মানবিকতার চেয়ে। না হয় এতো নিরীহ জনগণের ওপর ওরা অন্যায়ভাবে হামলা করলো, এতো এতো মানুষ মারলো, তাতে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। দেশটিকে কেউ ধমক পর্যন্ত দিলো না। বিশ্বমানবতা চুপ মেরে আছে। কারো কিছুই করার নেই। কিছু সাহায্য পাঠিয়ে দিয়ে সবাই দাতা হাতেম তাঈ সাজতে চায়। এর চাইতে আর কিছু নয়। নিজেদের রক্ত নিজেদেরই ঢালতে হবে। যদি তারা এক টুকরো জমি চায়। নিজেদের দেশ চায়।

কেন তারা ওই দেশের নয়? এ-ভাবনা ওই বর্বরদের মাথায় এলো কী করে?

‘খোবায়েত খোবায়েত।’

কে যেন নাম ধরে ডাকে। কে ডাকে? কেন ডাকে? মনে হয় সেই দূর গ্রাম থেকে কেউ আমাকে ফিরে যেতে ডাকছে। পরিচিত সেই গ্রাম। সবুজ মাঠ। জঙ্গলঘেরা মাঠ। নদীর উচ্ছল কলতান। ডাকছে আমাকে। চেতনার ভেতরে একটা নদী বয়ে যায়। নদীর পাশে ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি। কত সুখ, কত স্বপ্ন খেলা করে। বাবা-মা আর দাদির মুখ ভেসে ওঠে। তাদের করুণ মুখ আমাকে নানারকম গল্পের ভেতর টেনে নিয়ে যায়। মানুষের মন কী অদ্ভুত, যতই দিন যায় ততই এরা ভুলে যায় সব দগদগে ক্ষত। ক্ষতের ওপর সময় মলম লাগিয়ে দেয়। আপনজনকে আমরা কেমন ভুলে যাই। আসলে ভুলি না। তারা আমাদের স্মৃতিতেই থাকেন। শুধু তার অনুপস্থিতি আমরা কত সহজে মেনে নিই। বারবার সেই রাখাইন পাড়ার দৃশ্যগুলি আমাকে একটা নিদারুণ কষ্টের মধ্যে ফেলে দেয়।

তার পরপরই চোখে ভাসে নিহত শিশুর রক্তাক্ত লাশ। ওরা স্বার্থের জন্য আমাদের বিতাড়িত করেছে। জায়গা খালি করেছে। ধনসম্পদ আরো বাড়াবে বলে। কিছু মানুষের ভাগ্য আর অধিকার কেড়ে নিয়েছে। দেশের সঙ্গে দেশের চুক্তি হবে। স্বার্থের চুক্তি। লাভ আর লাভ। মানুষ লাভ ছাড়া আর কিছু বোঝে না।

একটা প্রশ্ন মাথার ভেতর কুটকুট করতেই থাকে। নিজেই তার উত্তর দিই, মানুষ আছে যতদিন, যুদ্ধও থাকবে ততদিন। সেনাদের দম্ভের ছবিগুলি মাথা থেকে সরে না। ভয়ংকর কুকুর এক একটা। মানুষের মাংসখেকো হায়েনা যেন। নারীদের কীভাবে নির্যাতন করছিল। তারই কয়েকটা টুকরো ছবি মাথায় গেঁথে গেছে। সেনাদের সঙ্গে স্থানীয় বখাটেরাও সুবিধা নিচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ জৈবিক কাজগুলিও সেরে নিচ্ছে। তারপর উলঙ্গ নারীশরীরে রক্তের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। নারীর স্তন কেটে নিয়ে একজন লোক কামড়ে খাচ্ছিল – সেই ভয়ংকর ছবিটা মাথা থেকে কিছুতেই সরে না। কী জঘন্য!

নিষ্পাপ শিশুরা কী ক্ষতি করেছে ওদের। কেন ওদেরকে আগুনে ছুড়ে মারবে? বাঁচার অধিকার তো প্রত্যেকেরই আছে। তাহলে কেন একজনের বাঁচার অধিকার আরেকজন কেড়ে নেবে? ধর্মের কারণে একটা জনগোষ্ঠীকে আরেকটা জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের মদদে এভাবে আক্রমণ করতে পারে? এটাই বর্বরতা। প্রশ্নই আছে আমার কাছে, কোনো উত্তর নেই। ‘তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিকম্যান’ বলে কেউ নেই। যদি কেউ থাকতো তাহলে এর উত্তর দিতে পারতো। কিংবা এ থেকে আমাদের উদ্ধার করতে পারতো। নিজেকে একজন পুরুষ ভাবতে স্বস্তি পাই না আমি। তার কষ্ট হয়। পুরুষ মানেই শক্তি আর দম্ভের মিথ্যে কুশপুত্তলিকা!

তিন

ফোঁস-ফোঁস-ফোঁস। নিশ্বাস পতনের শব্দ, নাকি সাপের হিসহিসানি! কাঁধে ভারি বোঝা। আরো ভারি হয়ে যেন কাঁধে চেপে বসেছে। টপটপ করে কপাল চুঁইয়ে ঘাম ঝরছে। নোনা ঘাম চোখে ঢুকে জ¦ালা ধরায়। করার কিছু নেই। হাতের চেটোয় মুছতে থাকি। এক চোখ মুছলে আবার অপর চোখে গড়িয়ে ঢোকে নোনাজল। কাঁধের ভারটা আজ খুব লাগছে। পেটের মধ্যেও মোচড়াচ্ছে। এই মুহূর্তে আমার স্বপ্নের কথা কল্পনা করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু স্বপ্নগুলি এখানে খাঁচায় বন্দি। এখানে স্বপ্ন দেখারও স্বাধীনতা নেই। স্বপ্নের ইজারা নিয়েছে শাসকগোষ্ঠী। তাদের দেশ যেন এটা নয়। জন্মের পরেই তারা পরবাসী। জন্ম নিলেই কি স্বদেশ হয়? প্রশ্নটা তার জন্য কঠিন। জন্মসূত্রে কি সে দেশ পায়নি? তাহলে দেশ কীভাবে পাওয়া যায়? নিজ দেশে নিজেরাই পরবাসী। হায়রে, হতভাগার দল। মানুষ বুঝি এতো হতভাগা হয়? ভাবি, মানুষই তো এমন হতভাগা হয়, অন্য কোনো প্রাণীর তো এতো কিছুর ভাবার অবকাশ নেই। এদেশে যেন তাদের ঠাঁই অনেক কষ্টে, তিলার্ধ পরিমাণ জায়গা নিতে পেরেছে। তারপরেও নাগিনীর নিশ্বাস চতুর্দিকে। প্রতিনিয়তি বিষাক্ত ছোবল মারার জন্য ফণা তুলে আছে।

এ-বিষয়টি মাথায় আসতেই সে একটা চেহারা চোখের ভেতর কল্পনায় দেখতে পায়। মনে হয়, ও কোনো ভ্যাম্পায়ার। রক্ত চুষে সব ছিবড়ে বানিয়ে ফেলবে। মানুষের প্রতি মানুষের এতো হিংস্রতা কেন? এ-প্রশ্ন কোথায় গিয়ে কাকে জিজ্ঞেস করবো? কেউ এ-প্রশ্নের উত্তর দেবে না। কিন্তু যারা লুকিয়ে অস্ত্র নিয়ে আর্মিদের ওপর হামলা করার স্বপ্ন দেখে তাদের সঙ্গেও তো যেতে পারলাম না। তাদের সঙ্গে যেতে পারলে একটা লড়াইয়ে শামিল হওয়া যেত। দুর্গম পাহাড়ে ট্রেনিং নিত। তারপর ওদের ওপর হামলা করতো। কিংবা চোরাগোপ্তা আক্রমণ করে রক্তের নেশায় মাতাল হয়ে উঠতো।

আহ্, দেশ পাওয়ার লড়াই! এ- লড়াইয়ে কীভাবে অংশ নিতে হয়, আমি জানি না। কারা, কাদের নিয়ে এই লড়াকু বাহিনী করেছে, সেও জানি না। যদি জানতাম তবে আমিও যেতাম। এভাবে বেঁচে থাকাকে বেঁচে থাকা বলে না। যার দেশ নেই, যার আকাশ নেই, যার কথা বলার স্বাধীনতা নেই। সে তো মানুষ নয়। যার বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার অধিকার নেই, যার খেলার অধিকার নেই, পড়ার অধিকার নেই। সে তো কিছু নয়। একে বেঁচে থাকা বলে না। তবে দেশ উদ্ধারে আমিও কঠিন ব্রত পালন করবো। মনে মনে এই আশা আমি পোষণ করি।

আমার জগৎ বলতে মংডুর এক কাউয়ার বিল গ্রাম। গাদা গাদা পোলাপানের কোলাহল, নারী-পুরুষের

 ঝগড়া-ফ্যাসাদ এই-ই তো। এর বাইরে লুকিয়ে একদিন বন্ধু জোহার সঙ্গে টেকনাফ গিয়েছিলাম। অবশ্য সেটা বাংলাদেশ। আহা, কী যে শান্তি! যেন সেখানে কত সুখ শুয়ে আছে। একটা স্কুল দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। ছেলেমেয়েদের লম্বা সারি। সাদা পোশাক। ধবধবে পোশাকে ওরা নীল আসমানের নিচে পাঠ নিচ্ছিল জ্ঞানের। যেন একদল দেবশিশু।

‘স্বরে অ। স্বরে অ-তে অজগর। অজগর ওই আসছে তেড়ে। স্বরে আ। স্বরে আ-তে আম। আমটি আমি খাব পেড়ে।’

পুত-পবিত্র দেবশিশুরা। উন্মুক্ত প্রকৃতিতে মানুষ হওয়ার পাঠ নিচ্ছে।

যদি আমিও পড়তে পারতাম। আরো আরো অনেক পড়া। তবে এই বুকের কষ্টের ইতিকথাটুকু লিপিবদ্ধ করে যেতে পারতাম। আমার খুব লিখতে ইচ্ছে করে। মানুষের অন্ধকার দিকগুলির কথা। আলোর কথা লিখতে ইচ্ছে করে।

‘পৃথিবীর মানুষ শোনো, আমরা কী হালে আছি। আমাদের বেদনার ইতিহাস তোমরা শোনো। তোমরা যারা উন্নত দেশে বসে আছো, তারা কল্পনাই করতে পারবে না, আমাদের জীবন। তোমাদের রাজনীতিতে আমাদের জীবনের গুরুত্ব নেই। আমরা মানুষ হিসেবে খুব নগণ্য। জাতি হিসেবেও তাই। না হলে আজকে অন্য কেউ হলে অন্য কোনো জাতি হলে তোমরা ঝাঁপিয়ে পড়তে। আমাদের কান্না তোমাদের কাছে পৌঁছায় না। তোমরা কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? আমি তৃতীয় বিশ্বের ক্ষুধাজর্জরিত এক দেশের বাসিন্দা। ধর্ম-বর্ণের কারণে আমরা নিপতিত হয়েছি। শক্তির কাছে আমাদের পরাজয় ঘটেছে। আমাদের মনুষ্যত্ব খুব দুর্বল।’

কিন্তু এখন কে শোনে কার কথা? এ দুঃখের ইতিহাস ফুরোবার নয়। কুতকুতে সেনাদের ভয়ে মানুষগুলি প্রাণ নিয়ে ছোটে। এক টুকরো শান্তির জন্য, একটু আশ্রয়ের জন্য তারা দলবেঁধে নারী-পুরুষ, বাচ্চা-কাচ্চা, বুড়ো-বুড়ি, পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে পড়িমড়ি করে ছোটে। কে, কার আগে ছুটবে। দূর থেকে দেখলে, কেউ হয়তো দেখবে একদল পিঁপড়ের মতো ছন্নছাড়া মানুষ আশ্রয়ের জন্য, তাদের বসতভিটা ছেড়ে অজানার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। পথে পথে যে-বিপদ সেই ইতিহাস বর্ণনার বাইরে। দুঃখে আর কষ্টে যাদের জীবন ভরা তাদের কষ্টই কী, দুঃখই কী? তাই সবাই দেশ ছেড়ে জীবন বাঁচাবার জন্য ছুটছি। হয়তো বেঁচে থাকলে কোনো একদিন দেশ পাবো – এই আশাও ভেতরে ভেতরে পোষণ করি।

চার

সেদিনের ছবিটা এরকমই ছিল।

রাজুমা বিকেলের রোদে বাচ্চার কাপড় মেলে দিচ্ছিল। কী সুন্দর কমলা রঙের বিকেল। ঠিক তখনি একদল লোকের হই-হট্টগোল শোনা গেল। রাজুমা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেশ কয়েকটা ঘরে আগুন জ¦লে উঠল। রাজুমা হতচকিত হয়ে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। কিন্তু দ্রুত সে ঘরের ভেতর ঢুকে তার ঘুমন্ত শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে এলো। সবার পোশাক এক। কমলা কাপড় পরা উন্মত্ত যুবক। হাতে লম্বা লম্বা কিরিচ। রাজুমার কোল থেকে কেড়ে নিল বাচ্চাটা। তারপর আগুনের ভেতর ছুড়ে মারল। বাচ্চাটার কোনো শব্দই রাজুমা পেল না। ঘাড়ের ওপর একটা কোপ খেয়ে পড়ে রইল। ছবিটা একটু দূর থেকেই দেখছিলাম আমি। রক্তের সে কী তেজ। মাটি ভিজিয়ে গড়িয়ে নামছিল। মাথাটা কি একটু ঘুরে উঠেছিল? কেমন বমি বমি লাগছিল। কিন্তু বমিটা আসেনি। মুখ থুবড়ে পড়ার আগেই চোখে আরো কিছু দেখার জন্য তাকিয়ে ছিলাম। আরো দেখার বাকি ছিল নিশ্চয়ই। যারা তেড়েফুঁড়ে আসছে, তারা সবাই চড়াও হয়েছে কিছু নারীর ওপরে। নারীদের তারা উলঙ্গ করেছে। কাপড়গুলো ছুড়ে মারছে অগ্নিকুণ্ডে। আবার কেউ রমণে লিপ্ত হয়েছে। চিৎকার-চেঁচামেচি সব মিলিয়ে মনে হলো এটা নরকের একটা খণ্ডিত চিত্রমাত্র। বাড়ির কথা মনে হতেই দৌড়ে সেদিকে গেলাম। মায়ের মাথার অংশটা পেলাম। ধরটা কোথাও খুঁজে পেলাম না। মায়ের চোখজোড়া অবিশ্বাসে ঠাসা। দৌড়ে গিয়ে চোখটা বন্ধ করে দিলাম। মা চোখ বন্ধ করল। বাবা আর দাদিমার কোনো খোঁজ পেলাম না। সামনে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। সেই আগুনের আঁচ এসে শরীরে লাগছে। আমাকে দেখে শুধু ছুটে এলো কাঞ্চনী।

চারপাশে লাশের বীভৎস ছবি। রক্ত। খণ্ডিত মস্তক। মানুষের পোড়ামাংসের গন্ধ। বাতাসে নাক টানা দায়। এতো গন্ধে শ্বাস নেওয়া কষ্ট। এসব ছবি স্থিরচিত্র হয়ে একদিন গ্যালারিতে ঠাঁই পাবে। কিছু মানুষ আহা, উহু করবে। এর বেশি কিছু তো নেই। কালের বুকে আর কী লেখা থাকবে? এই পৃথিবীতে সবাই ক্ষমতা চায়। ক্ষমতাবান হতে চায়। কার চাইতে কে বেশি মরণাস্ত্র বানাতে পারবে সে প্রতিযোগিতায়ই চলছে এখানে। মানুষের কথা কেউ কি ভাবছে? এখানে সবাই শক্তি বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে। মানুষ মারার অস্ত্র আবিষ্কার করছে। কে কত ভয়ংকর অস্ত্র আবিষ্কার করতে পারে – এই চিন্তা অনেকের।

পাঁচ

টেকনাফের পাহাড়-বন-জঙ্গল কেটে সাফ করা হয়েছে। উদ্বাস্তুদের বাসস্থান হবে। সারি সারি বস্তি। ভাগ্যাহত লাঞ্ছিত জনগণের মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে। অনিশ্চয়তার জীবন। গণ্ডা গণ্ডা বাচ্চা হবে মহিলাদের। মানবেতর জীবনযাপন হবে। শুধু দু-বেলা দু-মুঠো খাবে। এটাই কি জীবন? মুক্ত হাওয়া নেই। কোথাও যাওয়ার স্বাধীনতা নেই। গেলেই পুলিশ হাতকড়া লাগিয়ে দেবে। অন্যের দেশে এসে অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না। কিন্তু সবাই কি এটা মানবে? কত বিপদ যে আসবে। আর কত কিছু যে দেখতে হবে। তা বলে শেষ করা যাবে না।

এবার দেনদরবার শুরু হবে। অন্তত প্রাণে বেঁচেছি এটুকুই সান্ত্বনা। সব মিলিয়ে কত হবো সংখ্যায়? কেউ বলছে, তেরো লাখ আবার কেউ কেউ বারো লাখ।

এটাও তো একটা গরিব রাষ্ট্র। আর বিশ্বের মোড়লরা বড় বড় দেশ হলেই কি মনের দিক দিয়ে তারা বড়? শক্তিধর দেশগুলির অনেকেই তাদের সহ্য করতে পারে না। সেখানে মানুষের চেয়েও ধর্ম বড়। কোনো কোনো রাষ্ট্র এ-কাজটি করলে সাধারণ মানুষের ওপরও এর প্রভাব পড়ে। আর আস্তে আস্তে তা বৃহৎ আকার ধারণ করে। তখন দেশেরই বদনাম হয়।

একটা আশ্রয়কেন্দ্র। লোকে লোকারণ্য। এ-পৃথিবীতে তাদের বসবাসের জায়গার অভাব। চ্যাঁ-ভোঁ, ক্যাঁ-কোঁ, আরো কত রকমের শব্দ যে আছে, প্রকাশ করার মতো ভাষা নেই। মানুষের মাথা মানুষ খায়। আরেকটি দেশের সেনাদের টহল। সেবাকর্মীদের খাদ্য বিতরণ সব কর্মই দেখে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নানা জল্পনাকল্পনা করে। কেউ ডাকাত হতে চায়। কেউ স্থানীয়দের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে জড়াতে চায়। তারা বলে, তারা এমনিও মরেছে, অমনিও মরেছে। তবে মরার আগে বাঁচার শেষ চেষ্টা করে দেখবে। এই কথাগুলি কেমন মূল্যহীন মনে হয় আমার কাছে। জন্ম নিয়েও তো জন্মভূমি বিচ্যুত। আমাদের কোনো দেশ নেই। আমাদের কোনো দেশ থাকতে নেই। প্রতিদিন বড় হয়ে উঠছিল যেখানে সেখান থেকেই তো বিতাড়িত হয়েছে। এখন আরেক দেশে ওদের ক্ষতি করে ওদের খেয়ে-পরে অনুগ্রহ নিতে ইচ্ছে করে না। তাই আমার মন খারাপ।

সারি সারি ঘর পাহাড়ের ওপর অদ্ভুত লাগে। বিতাড়িত মানুষের আখ্যান এখানে শুরু হয়েছে যেন! এদের প্রচুর প্রাণশক্তি। এই প্রাণশক্তি যে-কোনো দেশের জাতীয় শক্তিকে বেগবান করতে পারে। কিন্তু সে-চিন্তা তো কারো মাথায় আসবে না। হয়তো আসবে সে-খবর কিন্তু আমরা কেউ জানব না। আমি অল্পবিদ্যার মানুষ অত কঠিন ভাবনা কি ভাবতে পারবো? আমি ভাবি, এই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে কিভাবে ভালো থাকা যায়। বোনটির দিকেও চোখ রাখতে হবে। ওর বয়স পনেরো হলে বোনটির বয়স আঠারো। ওর বিয়ের বয়স হয়েছে। বাবা-মা বেঁচে থাকলে সে চেষ্টা হয়তো করতো কিন্তু খোবায়েত কী করবে। এখন মেয়েমানুষ কতক্ষণ আর চোখে চোখে রাখবে। চারদিকে তো পুরুষগুলোর ছোঁক-ছোঁক অবস্থা। গড়ে কতজন যে শিশু জন্মগ্রহণ করছে এখানে, তার হিসাব কে রাখে? হয়তো এনজিওকর্মীদের কাছে সে-হিসাব আছে; কিন্তু আমার কাছে সেসব নেই। তবে আমার বক্তব্য হলো, এদের মধ্যে কতগুলি সম্পর্ক বৈধ আর কতগুলি অবৈধ তা জানলে যে কারো হয়তো চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে। সেই ভয়টাই করছে আমার। যদি বোনটারও তেমন কিছু হয়ে যায়!

রাতে ঘুম হয় না আমার। জেগে থাকি চুপচাপ। বোনের নড়াচড়া চলাফেরা সব খেয়াল করি। যদি বোনটি উঠে কোথাও চলে যায়। তখন আটকাতে পারব তো! কিন্তু এভাবে কতদিন পাহারা দিয়ে রাখব? একদিন ঠিকই মনে হয় সে বের হয়ে চলে যাবে। মানুষ কেউ কাউকে পাহারা দিয়ে রাখতে পারে না। এরই মধ্যে দেখেছি কয়েকজন যুবক কাঞ্চনীর পেছনে লেগেছে। তারা অদ্ভুত কৌশলে কাঞ্চনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। ভাইয়ের জন্য নাকি মা-বাবার হারানোর ব্যথায় কাঞ্চনী ও-পথে পা বাড়ায় না শুধু। কিন্তু আমি জানি, খবিসগুলি ঠিকই কাঞ্চনীকে ও-পথে টেনে নেবে একদিন।

রিলিফ যা পাই তা দিয়ে ভাইবোনের হয়ে যায়। আরো কিছু জিনিস বাজারে বিক্রি করি। এটা-ওটা আরো কত কী লাগে। আসলে পরিশ্রম করার মতো কাজের সুযোগ নেই। এখানে যত মানুষ আছে, যে-কোনো কারখানার উন্নয়ন করে দিতে পারতো এরা। কিন্তু সে-চিন্তা কারো মাথায় আসে না।

কাবুলই প্রথম খবরটা আনে। তখন প্রকৃতিজুড়ে হেমন্তের বাতাস বইছে। পাহাড়ের চূড়ায় বস্তির মতো ঘরবাড়ির সারি নিচ থেকে চোখে পড়ে না। তবে টেলিভিশনে দেখা গিয়েছিল। কেমন যেন লাগে এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলিকে। কাবুল এসে বলল, ‘ইতারা বেগ্গুনে দইজ্যা ভাইয়ারে বৈদশত যারগই। দালালেরে টিয়া দিয়ানে যাইতেগই পাইল্যে বালা অইতো।’

‘দালাইল্যা টিয়া খাঁই ফেলাইলে? দালালর টিয়া ফেরত পাবি না?’

‘কিল্লাই লাগের দে? আঁইতো যাইতাম চাইর। টিয়া কিল্যাই ফেরত লারদে।’

‘হডে যাইতা চঅর? কিয়া ট্রলারত গরি হিতারা লই যাইব। মালয়েশিয়া আরব-আমিরাত যে যেন্ডে যাইতে চার হেন্ডে লই যাইব। দ্যাশ বুঝিয়ানে টিয়া দেওন পড়িবু।’

‘দালাল ধরি যওন বঅর সুক্কর কাম নঅ। বহুত কষ্ট। দইজ্যার দয়া অইলে যাবিদে। নইলে ডুবিয়ানে মরিবি।’

কাবুল খ্যাক-খ্যাক করে হাসে। ‘মইল্যে মইল্যামদে আরি। অন আঁরা বাঁচি আছি নে? ইবারে বাঁচা নঅ কয়। ইবা হদ্দে একডইল্যা মরি থন। এত্তুন দইজ্যাত মরি যানগই বহুত ভালা। আর বাঁচি থাইলে সুক্কর জীবন পাইয়্যুম!’

কাবুলের কথায় আমার চিন্তা হয়। আমি কোথায় যাব? অতো টাকা-পয়সা পাব কোথায়? দালালকে দেওয়ার মতো পয়সা আমার নেই। তারচেয়ে আমি অন্য স্বপ্ন দেখি। আমার স্বপ্ন এখানে এই আশ্রয়কেন্দ্রে। যেসব শিশু জন্মগ্রহণ করছে, তাদের ঘিরে। ওদের নতুন শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ওদের লেখাপড়া শিখিয়ে সভ্য জনগোষ্ঠী হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। একঝাঁক আলোর বিহঙ্গ পেছন পেছন ঘুরছে, সে-রকম স্বপ্ন দেখি আমি। ওরাই হবে আমার জন্মভূমি ফিরিয়ে আনার আগামীর তুর্কি সেনা।

কাবুল কয়েকজনের সঙ্গে মিলে দালাল ধরলো, যা সঞ্চয় আছে, তা দিয়ে ওরা পাড়ি জমাতে চায় বিদেশে। বড় বড় নৌকায় ওদের রাতের বেলা পার করে দেবে দালালরা। এ হলো হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে বেরিয়ে পড়া। আমি আশ্রয়কেন্দ্রের ছেলেমেয়েদের এক করতে থাকলাম। বিশ-পঁচিশজনের একটা দল গঠন করলাম। এবার ওদের প্রতিদিন সকালবেলা কিছু পড়াশোনা করাতে লাগলাম। অক্ষর চেনাতে লাগলাম। সার করে দাঁড় করিয়ে শপথ করাতে লাগলাম। আর স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ পড়াতে লাগলাম। প্রতিদিন সকালে ওদের স্বরে অ। স্বরে অ-তে অজগর। অজগর ওই আসছে তেড়ে। স্বরে আ। স্বরে আ-তে আম। আমটি আমি খাব পেরে। হ্রস ই। হ্রস ই-তে ইঁদুরছানা। ইঁদুরছানা ভয়ে মরে। দীর্ঘ ঈ। দীর্ঘ ইতে ঈগল পাখি। এসব পড়াতে লাগলাম।

এভাবে প্রতিদিন আমার চেষ্টা চলতে থাকে। নিরলস চেষ্টা। কত রকমের কত কিছু কানে আসে। আমি গা করি না। আমার আলোর পাখিরা একদিন বড় হবে। একদিন ওরা অহিংসার পৃথিবী গড়ে তুলবে। এ-স্বপ্ন নিয়েই আমি প্রতিদিন ওদের বোঝাই।

সেদিন আমার পাঠশালা না ফুরাতেই হন্তদন্ত হয়ে এলো কাবুল। আমি ইশারায় ওকে বসতে বললাম। কাবুলের চোখেমুখে উত্তেজনা। একটু পরেই আমি ছেলেমেয়েদের ছুটি দিয়ে দিলাম। ছেলেমেয়েরা যেতেই কাবুল আমাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয় যেতে লাগল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে কাবুলের?

‘কিরে হেং গরি টানর কিয়া। কি অইয়্যে কবিই না?’

‘হালার পোয়া দালাইল্যা আঁর টিয়া মারি দিয়ে।’

‘তো আঁই ক্যাং গইত্তাম হেডে?’

‘তুই থাইলে বালা অইব।’

দালাল স্থানীয় একজন। আমরা কয়েকজন গিয়ে দাঁড়াতেই সে মারমুখী হয়ে উঠল। এই মারে তো সেই মারে। কাবুলও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে বারবার হুমকি দেয়। তার টাকা ফেরত না দিলে সে ওর লাশ ফেলে দেবে।

দালাল তখন ক্ষেপে ওঠে। চোখমুখ লাল, খিঁচিয়ে গালি ঝাড়ে – ‘ওডা হোরের পুয়া তোরার দ্যাশ হডে? তোরা তো রোইঙ্গা, তোরা রিউজি আঁরার দ্যাশত কিল্লাই আইষ্যুজ? আঁরে চোখ রাঙ্গার দঅনা। কি বাল হারাবি? যা, যাগই, পাইরলে হারগই। কাবিলগিরি নঅ দেখাইছ।’

লোকটা আরো কুৎসিত কদাকার শব্দ উগড়ে দিলো। আমার চোখ ফেটে জল এলো। আসলেই তো আমাদের দেশ নেই। আমরা তো এখানে অন্যের গলার কাঁটা। রোহিঙ্গা, রিফিউজি। তার মানে আমরা রিফিউজি? হুম আমরা উদ্বাস্তু।

মাথা নিচু করে রইলাম। আমি ভাবছি, ক্যাম্পের বাইরের পৃথিবীটা কতটুকু নিরাপদ! চোখ বেয়ে টপাটপ জল গড়িয়ে নামছে।

কাবুল ডাকল, ‘খোবায়েত চলি আয়।’

পরাজিত কুকুরের মতো লেজ নিচু করে গলা নামিয়ে আমরা ফিরে আসি। বুকের ভেতর তীব্র অপমানের জ¦ালা কামারের পোয়ানোর মতো ধিকিধিকি ধস ধস শব্দ তুলে আগুন জ¦ালাতে থাকে।

আমার আলোর বিহঙ্গরা কবে বড় হবে? কবে আমরা দেশে ফিরে যাবো? কবে স্বাধীনতার আস্বাদ লাভ করবো? এতো প্রশ্ন মাথার ভেতর জট পাকিয়ে ফেলল। তারপর আবার তারা আমাকে হতাশার দিকে নিয়ে যেতে চাইল, আমি নিজেকে বাঁধ দিলাম। সেই ম্যাজিক বুড়োর কথা মনে পড়ল আমার। যে আমাকে রাখাইন পাড়ায় শান্তির কথা শোনাত। অলৌকিক মানুষের গল্প শোনাত। অক্ষরজ্ঞান দিত। তিনি বলতেন, ‘আসা-যাওয়া সবাই করবে। কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য ঠিক করে নিতে হবে। এ-পৃথিবীতে যখন একবার চলেই এসেছে, তবে কিছু না কিছু দিয়ে যেতে চেষ্টা করো। আর সেটা সম্ভব তোমার বিশ্বাসগুলি তোমার বৈশিষ্ট্যগুলি কারো মধ্যে চালান করে দিয়ে। কিন্তু তোমাকে চালান করতে হবে সেটা সাবধানে। মাধ্যম একটাই কথা। তাই কথাটাকে শানানো ছুরি বানাতে হবে। কথা শিখতে হবে তোমাকে। তোমার কথায় গোলাপ ফোটাতে হবে। মানুষের চিত্ত না ফুটলে তুমি কিছুই রেখে যেতে পারবে না।’

আমি অবাক হয়ে সেই ম্যাজিক মানুষের কথা শুনতাম। আমার রবিন বুড়োকে ম্যাজিকম্যান মনে হওয়ার পেছনে এসব আখ্যান জরুরি ভূমিকা পালন করে। আমি দিনের একটা অংশ তাই রবিন বুড়োর সঙ্গে কাটাতাম। তার কাছ থেকে মানুষ হওয়ার দীক্ষা নিতাম। আমি মনে মনে নিজেকে ফিরিয়ে আনার জন্য নিজেকে নিজে কমান্ড দিতে থাকি। শান্তি, শান্তি, শান্তি। মেজাজ কিছুটা শীতল হয়। কিন্তু সেটা আরো দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে একটু সময়ের ব্যবধানে।

যখন আমি আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছি, তখন নারী-পুরুষ আর বাচ্চা-কাচ্চাদের একটা ভিড় আমার পেছন পেছন আসতে থাকে। কী হয়েছে, আমি বুঝতে চেষ্টা করি। কেউ কিছু বলে না আমাকে। ঘরের কাছাকাছি আসতেই কয়েকজন মহিলা চিৎকার করতে থাকে। তারা যা বলে সেটা হচ্ছে, আমার একমাত্র আপনজন, আমার সহোদরা আমাকে এ-পৃথিবীতে একা রেখে নিজেকে হনন করেছে। এ বড় কষ্টের সময়। মহিলাদের কথায় কানাঘুষায় যেটা আমার কানে আসে সেটা হলো, কাঞ্চনীকে কেউ নষ্ট করেছে। কিন্তু নষ্ট করা মানে কী? মানুষকে মানুষ নষ্ট করে কীভাবে? আরো গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করে বুঝলাম কথাটা, কাঞ্চনীর সঙ্গে কারো শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। এর ফলে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে। পরে পুরুষটি তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার জানালে কাঞ্চনী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। আমি ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে পারিনি। যদি জানতাম কাঞ্চনীকে বাঁচানোর জন্য কোনো পথ নিশ্চয়ই খুঁজে বের করতাম। কিন্তু আমি সে-ধরনের কোনো সুযোগ পাইনি!

আমার চোখে কান্না আসে না। বুকের ভেতর একটা চাপা ক্ষোভ বাড়তে থাকে। আমি ম্যাজিক বুড়োর দর্শন আওড়াতে থাকি। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। সে-পাপ করতে নেই। যেমন কর্ম তেমন ফল। এসব শুনিয়ে শুনিয়ে মনটাকে সান্ত্বনা দিই।

একঝাঁক আলোর বিহঙ্গ আমার পিছু নেয়। আমি ওদের নিয়ে ম্যাজিক বুড়োর দর্শন শোনাই। ওরা শোনে। মন দিয়ে শোনে। আমাকে একটা নতুন মানুষের দল গঠন করতেই হবে। যে-মানুষগুলি সত্য-সুন্দর আর স্বাধীনতার কথা বলবে। আমাদের জন্মভূমির মুক্তির কথা বলবে। শিগগির আমি ওদের নিয়ে জন্মভূমির পথে যাত্রা শুরু করবো।