ঊন-শিথানে রুপালি চাঁদমাছ

আমার ঘরের পাশ দিয়ে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটা শাঁ করে উড়ে গেল। আমি জানি কোনো বিশেষ মানুষের নিথর শরীর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই সাদা রঙের গাড়ি। মোহন – এক অভিমানী নক্ষত্র। সূর্য ওঠার আগেও ধানমণ্ডি সাতাশ নম্বরে ছিল সে। আর এখন? কিছুদূর এগিয়েই গাড়িটা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে আছে। এই মহামারিকালে থেমে থাকা অ্যাম্বুলেন্স দেখেই লোকজন আতঙ্কে ছুটে যাবে দূরে – এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মোহনের ক্ষেত্রে এর উল্টোটা হওয়ারই কথা ছিল। বর্তমানের অবস্থা এমন, যেন পৃথিবীতে মরে যাওয়ার জন্য মহামারি ছাড়া আর কোনো রোগবালাই নেই, সবই অচ্ছুত। আমি লাশটার সাজগোজ দেখেই ফিরেছি ঘরে। কাউকে জানানো হয়নি – এই মৃত মানুষটির জন্য শোক প্রদর্শনে কিছু আপনজন দরকার। আর বলেই বা কী হতো, সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে কাটা মাছের মতো তড়পাতে তড়পাতে মরে গেলে একটা ব্যথাতুর অনুভূতি বয়ে বেড়ানোর মতো কারণ ঘটতো। কত রথী-মহারথী মরলো এই মড়কে অথচ সেখানেও নাম থাকবে না ওর, ভাবা যায়! নিজের ঘরে বসে ডিপ্রেশনজনিত জটিলতায় আত্মহত্যা করলেও কিছু মানুষ কনসার্ন হয়ে বেশ শোরগোল করতো মোহনের নামে। কিন্তু এখন? এই আয়োজনহীন মৃত্যুতে কী লাভ হবে তার? কিছুই না। মোহনের জন্য এমন মৃত্যু একেবারেই বেমানান। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, রুগ্ণ মোহনকে এদেশের কোনো ডাক্তার, নার্স এমনকি আমজনতাও চেহারায় চিনলো না। টিভি খুলে লোকজন তবে কাদের দেখে রোজ? মোহনের আত্মশ্লাঘা ভীষণ আঘাতে লুকিয়ে ফেলেছে তার পূর্বেকার নামধামসহ সকল পরিচয়। কী অদ্ভুত! কী নির্মম বাস্তব! এই কদিন কত জায়গায়ই না ঘুরলাম ওকে নিয়ে। এখানে ডাক্তার নেই তো ওখানে নেই স্টাফ। এমবাসিতে নেই ভিসা আর পারমিট। আমার নিজের পরিচয়ে পর্যাপ্ত লোক ধরাধরি করে শেষ পর্যন্ত সুরাহা যা হলো তার নাম ব্লাড ট্রান্সফিউশনজনিত সমস্যায় এক উজ্জ্বল তারকার অকাল প্রয়াণ। যাক, আমার কী! আমি এখন রেস্ট নেব আরাম করে। অযথা সময় খরচ করতে তোয়ালে খোঁজার বাহানায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকব অনেকক্ষণ, আকাশ দেখব, গাড়ি দেখব, লকডাউনে মানুষের গাদাগাদি ভিড় দেখব, আরো যত কিছু আছে দেখার সব দেখব। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া এই প্যাসেজটা আমার বেশ পছন্দের। ছোট খালা মানুষটা ভালোই শৌখিন। একটা মধুমঞ্জুরির লতা ঝুলিয়ে দিয়েছেন ডালপালাসমেত। নিচে পোটেড পার্পল, গোল্ডেন ব্লুম অর্কিডের অনেক টব সাজানো। সবই সুন্দর। কেবল ঝামেলা একটাই; সময় সময় সাদা রঙের মাঝখানের কাঞ্চন রঙের ঢেউ ঠিকরে বের হয়ে আমার মগজে আগুন ধরিয়ে দিতে ছুটে আসে ধেয়ে, আমি তখন সজোরে লাথি মারি ফুলের গায়ে। বুড়ো নখের লাল তরল চমৎকার কম্বিনেশন আমার ব্যর্থ আক্রোশ চিড়বিড়িয়ে বাড়িয়ে দেয় আরো অক্ষমতার অসুখ।

জানি, আমি কখনোই মোহন হতে পারবো না। কখনোই না। পায়ের নখে বরফ লাগিয়ে নিজেকে প্রবোধ দিই – কিক মারা তো আমার কম্মো নয়। আমি কি মোহন? তাহলে এই উন্মাদ রাগ, অভিমানের অর্থ কী? এসবে কী হয় শেষে? মোহনের জীবনে যতবার বিপর্যয় এসেছিল সবটার পেছনে এই আত্মবিধ্বংসী স্বভাব। বাঘের মতো হালুম-হুলুম করেই অশান্তি ডাকতো সে। আপস ছিল না কোথাও। অবশ্য ওকে মানাতোও ওসবে। পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে বিছানায় কাতরাতে কাতরাতে কোনো দুর্বল মুহূর্তেও দেখিনি কখনো ফিসফিস করে জপছে ঈশ্বর, মা বা কোনো প্রেয়সীর নাম। ঘোর নাস্তিক নাকি ঘোর অমাতৃক-অপ্রেমী; কোনটা সে কে জানে! সরাসরি ফেডারেশন থেকে যেবার বহিষ্কার করা হলো, সেবারের কথাই ধরা যাক। খেলার মাঠে পেছন থেকে রেফারির মাথা ভাঙতে বল ছুড়ে মেরেছিল মোহন। প্রিমিয়ার লিগে আরামবাগের হয়ে খেলতে নেমেছিল, রেফারি টানছিল আবাহনী লিমিটেড। ব্যস লেগে গেল ধুন্ধুমার। রেফারির এহেন আচরণের পেছনে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ঘটনা আছে কি না তলিয়ে দেখলো না বোর্ড। বহিষ্কারাদেশের টানা পাঁচ মাস মোহন ডুব মেরে ছিল সেসময়। কাউকে একটা খবরও দেয়নি। তার নিজের লজ্জা তাকে একা বইতে হবে গোপনে; এই ছিল তার একমাত্র ‘যুক্তি’।

আচ্ছা মোহনের কি দর পড়ে গিয়েছিল সেসময়, নাকি মাঠে তার কোনো বাবা বা বড় ভাই ছিল না পেছন থেকে টেনে তোলার। ওর তো এখনো নেই কেউ। ইন্ডিয়ান সুপার কাপে কেরালার হয়ে খেলে পপুলার রেসপন্স নিয়ে যখন ফিরলো তখনই অনুমান করা উচিত ছিল মোহনের দিন আসছে দরপতনের। এখানে হিরো থেকে জিরোতে নামিয়ে দেওয়া খুব কঠিন কিছু না। এমন না সে নিয়মিত কোকেন নিত কিংবা ওর ব্যাগ তল্লাশি করলেই পাওয়া যেত ফেনসিডিলের বোতল! শেষকালে শোনা গেল, মোহন ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা প্র্যাকটিস করতে চেয়েছিল বলেই লোকচক্ষুর অন্তরাল হয়েছিল। মোহন জানত, এই মাঠের কোলাহল আবার তাকে ডাকবেই। ওর বিশ্বাস সত্যি ছিল। ন্যাশনাল টিমের ম্যানেজার তাকে জানিয়েছে, ফেডারেশন তার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে কারণ দেশের ক্ষমতাসীন একটা ক্লাব এ-বছর তাদের মিডফিল্ডে মোহনকে চাইছে।

যাক! বসার ঘরের টিভি ফুল ভলিউমে বাজছে। সেখানে ভরপুর লাইফবয়ের গান, তিরিশ টাকার রবির অফার আর করোনা আক্রান্ত রোগীর খবরাখবর। মোহন মারা গেছে, এই খবরটা কি কোথাও বাজবে না আজ? আমার কেমন যেন লাগে, ঠিক পুরোটা রাগও না, অভিমানও না। বুকের ভেতরে শূন্য-শূন্য একলা-লাগা বোধ। মোহন অন্যরকম ছিল খুব। ও কখনো আমার সঙ্গে গোল্ডেন বুট, গোল্ডেন বলের গল্প করেনি। পেলে-ম্যারাডোনার লিজেন্ডারি কাহিনি নিয়ে পার করে দেয়নি চমৎকার দিনের অর্ধবেলা। সাম্প্রতিক খেলার হালচাল নিয়ে গল্প জুড়ে দেওয়া মানুষ মোহনের একদম পছন্দ ছিল না। ওকে দেখলে খেলোয়াড় নয়, দার্শনিক বা কবি মনে হওয়াটাই বেশি স্বাভাবিক। একবার শুধু খুব আগ্রহ নিয়ে ক্রিস্টোফার কেমের কথা বলেছিল। ট্যাকলিংয়ে নাকি খুব চমৎকার ছিল ওই নাইজেরিয়ান প্লেয়ার। লোকটার নিঃশব্দ মৃত্যু মোহনকে ব্যথিত করেছিল। করেছিল বিস্মিত।

নব্বইয়ের দশকে কলকাতায় খেলতো লোকটা, বাংলাদেশেও নাকি এসেছিল কবার। ইস্ট  বেঙ্গল, মোহনবাগান, মোহামেডান দাপিয়ে বেড়ানো একজন প্লেয়ারের কেমন করে এমন স্বজনবিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ মৃত্যু হয় – এটাই ছিল তার জন্য দুঃখিত হওয়ার মূল কারণ। মোহন নিজের জন্য কখনো এমন মৃত্যু চায়নি, বীরের মতো ধনে-জনে-মনে পরিপূর্ণ হয়ে মরতে চাইতো ও। মোহন বলতো, ওর জন্য সবচেয়ে সুখকর মৃত্যু হবে যদি খেলার মাঠে খেলতে খেলতে মরে যাওয়া যায়। আর সেটা যদি হয় বিশ্বকাপের মাঠ তবে মরার পর স্রষ্টাকে অবশ্যই সে একটা স্পেশাল স্যালুট দেবে, মস্তক নত করে করবে কুর্নিশ। লাল-সবুজ একটা পতাকায় সতীর্থরা তাকে আবেগে মুড়ে নিয়ে আসবে এই দেশের মাটিতে, সেই মহান মৃত্যু স্মরণ করে মাঝে মাঝেই তার চোখ ভিজে উঠত আবেগে!

ওর এসব অসম্ভব-অলৌকিক ঘোরলাগা কল্পনায় আমি অভ্যস্ত ছিলাম। সময় সময় মোহন যেন হয়ে উঠতো এমনি কোনো রূপকথার খেয়ালি রাজকুমার অথবা কোনো অন্ধকারে জ্বলে ওঠা জোনাকপাখি। ওর গল্পে কখনো কখনো মানুষেরা হারিয়ে যেত। থাকতো স্বচ্ছ দিঘি, ফসলের মাঠ আর ডাহুকের গান। মোহন বলতো, মৃত্যুর পর সে মাছ হতে চায়। রুপালি চকচকে ছোট্ট একটা চাঁদমাছ। বরফশীতল পানি ওর ভীষণ প্রিয়।

ব্রাদার্স ইউনিয়নের আতিক ভাই ফোন দিয়েছেন। কী জানি তিনি কেমন করে জানলেন আজ আমার কারো ফোন প্রয়োজন। তিনি মনে হয় সর্বেশ্বর অন্তর্যামী। অথচ ঘরোয়া লিগে খেলতে গেলে এই লোকটার সঙ্গেই মোহনের লাগতো খুব। মধ্যমাঠের রক্ষণভাগের পাশর্^ীয় আর কেন্দ্রীয় সেনাদের ভেতরকার জটিলতা আমি বুঝতাম না। শুধু দেখতাম আতিক ভাইয়ের সঙ্গে কিছু হলে কেমন বিমর্ষ হয়ে যেতো মানুষটা। যাক, এখন আর হর্ষই কী, বিমর্ষই কী। আতিক ভাইয়ের প্রতি ওর নরম অনুভূতির কথা মনে করে আমার অস্থির লাগতে শুরু করে। এমন লাগছে কেন? মোহন তো মরে গিয়ে বেঁচেই গেল। এখন আর তার কোনো ঈর্ষা নেই, প্রণয় নেই। বুড়োকাল পর্যন্ত বেঁচে থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরার রিস্ক নেই। চারপাশের এতো নাই নাই দেখার দায় নেই। মিডিয়ার চাপ নেই। ক্যারিয়ারের ভয় নেই। আহা, কী চিরশান্তির অন্তিম প্রস্থান!

শেষবেলায় মোহনের প্রোপার ট্রিটমেন্ট হয়নিই বলা যায়। রক্ত জোগাড় করা যাচ্ছিল না একদম আর পেলেও প্রি-ডোনেশন স্ক্রিনিং, রেডসেল কনসেনট্রেটের সঙ্গে একই গ্রুপের প্লাজমা মেশানো হোলব্লাড প্রবলেম আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল। চারপাশে এতো অসহযোগী প্রতারক মানুষের দল! এদিক-সেদিক ছুটতে ছুটতে কতবার যে নিশপিশ করেছে আমার পায়ের পাতা – সেটুকু বোঝানোর মতো কাউকে পাইনি কাছে। আমার নিজের ইন্টার্নশিপও শেষের দিকে। সিস্টেমের ভেতরকার জটিলতা যে বুঝি না তাও কিন্তু না। তবু মোহনকে এভাবে দেখে কত আর মাথা ঠান্ডা রাখা যায়। মোহন হয়তো বুঝেছিল সব। আমাকে আমার ফুলব্যাকে কোথাও আর ছুটতে দিলো না। মাঠ ছেড়ে একেবারেই ঢুকে গেল অফসাইডে।

চোখ জ্বলছে। রাগ যাচ্ছে না। পা থেকে গায়ে এসে বাড়ছে কেবল। এই যে ও আমার কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে অসুখী হওয়ার অসুখ এর কোনো মানে হয়। মনে হচ্ছে, তার ঘামে ভেজা সাত নম্বর জার্সি আমাকেই টানতে হবে অনন্তকাল। কী সৌভাগ্য আমার! এতোদিনে মোহন কিছু একটা দিলো আমায়। নিজেকে লাকি সেভেন ভেবে চিয়ারআপ করতে ইচ্ছে করছে খুব। তার ধুলোয় আটকে থাকা ভারি মোজা আমার পায়ে সেঁটে আছে শক্ত হয়ে – এর জন্য কাকে ধন্যবাদ দেব আমি। যাক, কী আর করা গিলে ফেলি সব, হজম করি আগের মতোই অভিমান-রাগ, অপমান আর অপ্রাপ্তির মতো সামূহিক অনুভূতি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে বারান্দা ছেড়ে কিচেনে যাই। একটু হাউমাউ করে কাঁদা প্রয়োজন আমার। অস্থির লাগছে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে ভেঙে পড়ছে। সবকিছু রেখে ঘরের পর্দা ফেলে একটু ঘুমিয়ে নেওয়াটাই যৌক্তিক। নিজেকে পিটি পুওর উমেন ভেবে দুঃখ দুঃখ ভাব করাটা ঠিক হচ্ছে না একদম। বরং এভাবে হুট করে মরে যাওয়ার জন্য মোহনকে কঠিন থেকে কঠিনতর অভিশাপে ওর ইহলোক-পরলোক ছারখার করে দেওয়া উচিত। যদিও ইহলোকে আর নেই কিছুই। পচনশীল আস্ত একটা নিষ্প্রাণ দেহ আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি – এইটুকুই যা। মোহন যে আমার কে হয় এটা জানা গেলে আর একটু নিশ্চুপ থাকা যেত। মোহন আর আমার গণ্ডগোলের রসায়ন ওর ক্যারিয়ারের মতোই প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির বাটখারায় সবসময়ই অসমান ছিল। ওর পছন্দ ছিল শক্তপোক্ত অ্যাথলেট ঘরানার মেয়ে। আমার মতো তন্বী-শ্যামা-শিখরি-দশনা পক্ববিম্বাধরোষ্ঠীরা ওর বিরক্তিই বাড়াতো কেবল। সবটাকে তো আর ভাগ্যের দোষ বলা যায় না। আমার নিজের দায় কিছুটা। ওকে দেখলে সবসময় আমি উল্টে যেতাম। গোপন নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতো সবসময়। কত দীর্ঘ পথচলা দুজনের, তবু অচেনা এক মানুষ লাগতো ওকে সবসময়। সেই ফ্রক আর হাফ প্যান্টের গার্লস-বয়েজের সময় থেকে একসঙ্গে আমরা। ও আসতো একটা সাইকেল নিয়ে। টুংটাং করে বাজাতো বেল, ওই সর্বনাশা শব্দে তখনই তো বিগড়ে গিয়েছিল আমার বোধ-বুদ্ধির হিসাব।

একটা যৌথ সাদামাটা জীবনের ভবিষ্যৎ কল্পনায় কত কত ছটফট করেছি একা, মোহনকে বুঝতেও দিইনি। মোহন জানলে তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দেবে – এই শঙ্কা-লজ্জার চেয়েও বেশি ছিল আতঙ্কের। আমি জানালার কাচে নিজের মুখ দেখি, আমাকে কি চায়নি মোহন কখনো? কী জানি, ওর গাঢ় চোখের আবেদন সবটা তো আর কঠোর নয়। কত ঘটনায় কতবার বুক কেঁপেছে থরথর, তার মূল্যও তো কম নয়।

যেবার বাংলাদেশ এশিয়া কাপে রানারআপ হওয়ার গৌরবে রৌপ্য পদক পেল, সেবার মোহনের জীবনে এক বিশেষ অধ্যায় রচিত হওয়া কথা ছিল, অথচ হয়ে গেল আমার। মোহন অনূর্ধ্ব-২৩-এ চ্যাম্পিয়ন পাওয়া উঠতি প্লেয়ার হওয়া সত্ত্বেও ম্যাচে যেতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু কাপে ল্যাং খেয়ে ঠ্যাং ভেঙে অনেকদিন পড়ে ছিল বিছানায়। আমি জানি ওইটুকু, শুধু ওইটুকু সময়ের বিনিময়ে আমি যতবার জন্ম নেব পৃথিবীতে ততবারই নিজেকে নিঃস্ব করে মোহনে বিলিয়ে দিতে পারব আত্মসুখ। আমার লজ্জিত বা অপমানিত হওয়ার ভয় এই অনুভূতির কাছে একেবারেই তুচ্ছ। যদিও মোহনকে আমার প্রেমিক না ভেবে বরং বন্ধু ভাবাটাই ওর জন্যে বেশি সুবিধের। তবু বন্ধু বোধটা আসে না আমার। সেই কৈশোরকালেই প্রথম যেদিন দুম করে শুনলাম মোহন নীলফামারীর টিম থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড করে এসেছে, আমার কেমন যে মন খারাপ হয়েছিল সেদিন কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। স্বপ্নভঙ্গের বিপর্যস্ত যন্ত্রণায় একা একা কেঁদেছি সারাদিন, হেঁটেছি কত পথ একা একা। দাঁতে দাঁত চেপে দেখেছি মোহনের উল্লসিত মুখ। মানুষটাকে কখনো আমার চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে হয়নি, তখনো না, এখনো না। ও কেন সকলের হবে, একা আমার হলে কীসের এতো ক্ষতি পৃথিবীর!

ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচে মোহনকে যখন প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে খেলতে যেতে হলো, সেবারও আমার অবস্থা হলো দেখার মতো। লাহোর তো খুব বেশি দূরের কিছু নয়, তবু ঘ্যানঘ্যান করে বিরক্ত করে মেরেছিলাম ওকে। এক কথা একশবার একই স্বরে।

‘তুই দেশের বাইরে যাবি না মোহন।’

‘কেন যাবো না, তুই কোন রসগোল্লা যে তোর কথা শুনতে হবে?’

‘আমি আমিত্তি, রসগোল্লা, চমচম কিছু না। তবু তুই যাবি না।’

‘হলেও সমস্যা নাই। তোকে ডিপফ্রিজে তুলে রেখে যাব। আমাকে যেতেই হবে।’

মোহন এমনই। ওর ভেতর মিথ্যে নেই, ভান নেই, খাদ নেই। প্রেমের মোহময় আবেশে প্রেমিকাকে ডুবিয়ে রাখার চাতুরী নেই। যতটুকু আছে ততটুকু সলিড বলেই মেনে নেওয়া যায়। একটু বেশি মেধা, যথেষ্ট লাবণ্য এবং হৃদয়ভরা আবেগ থাকলে একজন ভালো ‘আমি’ হওয়া যায় কিন্তু ‘মোহন’ হওয়া যায় না। যাক সেসব। একেবারে শেষের দিনগুলোতেও কি মোহন বদলেছিল? একদম না। অসুখটাকে সে খুব প্রেসটিজ ইস্যু হিসেবে দেখছিল। তার ভেতরে খুব বিশ্রী হীনম্মন্য বোধ জন্ম নিয়েছিল এই অসহায় করুণ শুয়ে থাকার সময়টায়। মোহন ভাবতো, এখানে খেলার মাঠে পা বা কোমর ভাঙার গৌরব নেই, ঝাঁক ঝাঁক ফ্যান-ফলোয়ারের অস্থির অপেক্ষা নেই। এখানে আছে বিশ্রী অসহায়ত্ব। এটাকে লোক দেখিয়ে বেড়ানোতে সিমপ্যাথেটিক আহা-উহু মার্কা শব্দই বাড়বে কেবল। লাভ কিছু হবে না। আমার রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখ দেখে বিরক্তি বাড়তো ওর। মেয়েলি স্বভাবের জন্য বকতো খুব, অথচ ও বুঝতেই চাইতো না আমি তো আদতে একটা মেয়েই। মোহন বলতো, ‘ডাক্তারদের কলিজায় সোলেমানি মোহর লাগানো থাকে, দয়ামায়ারা সব ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায় ওই মোহরে, আর তোর কলিজায় শুধু নরম শিমুল তুলার ফ্যাতফ্যাতা অনুভূতির জঙ্গল।’

‘তো জঙ্গল হলে কী করব, মরে যাব?’

‘যাওয়াই উচিত!’

মোহন আমার বাহু ঝাঁকিয়ে প্রবোধ দিত – ‘কুল, ম্যান কুল।’

নাহ আমার আর কুল হওয়া হলো না। আমি ততক্ষণে জেনে গেছি মোহন এভাবেই মরবে। জীবনকে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে বলেই মৃত্যু তাকে ভালোবেসেছে। উল্কা হয়ে জন্মে যারা পতনের অপেক্ষায় জেগে থাকে তাদের জাতই আলাদা। আমার সাধ্য কী এমন কাউকে বাঁধি।

আমার হাতের চা শেষ। ট্রাভেল ব্যাগ গোছাতে হবে; অ্যাম্বুলেন্সটা আদাবর থামবে কিছুক্ষণ। ওখানে ওর বড় আপার বাসা। ওটাকেই ধরতে হবে, এতো দূর জার্নিতে এখন আর নিজে ড্রাইভ করার এনার্জি নেই! শর্টকাট সমাধান ওর লাশের সঙ্গে চলে যাওয়া! এতোটা পথ যেতে হবে – এটা ভেবে একটু কেমন কেমনও লাগে। যদিও এ-বছর কোথাও যাওয়া হয়নি। এমনকি কোনো ব্লাড ডোনেট ক্যাম্পেইন বা আই কেয়ার স্পেশাল কোর টিমের হয়ে এদিক-সেদিক কোথাও নয়। সাড়ে সাত সপ্তাহের মিসক্যারেজের ধকল এখনো শরীরে! এই অনাকাক্ষিত বাচ্চাটা মোহন নিতে দেয়নি। মোহন বলতো, ‘ওসব বাচ্চাকাচ্চা, ঘর-সংসার, শাদি মোবারক আমাকে দিয়ে হবে না। প্রেম করতে এসেছিস করেছি। বারো বছর পর শকুন্তলার মতো অঙ্গুরীহস্তে পুত্রসমেত উপস্থিত হওয়ার ধান্দা করিস না। তোকে এমন দেখতে ভাল্লাগে না। যদি কখনো বাংলাদেশের জন্য গোল্ডকাপ নিয়ে আসতে পারি, কথা দিলাম, দেশের মাটিতে পা রেখেই তোকে আগে কবুল বলবো। তোর বাচ্চার কোঁকড়া চুলে বিনুনি করে মিরপুরের স্টেডিয়ামে বাঘ দেখাতে নিয়ে যাব।’

হাহ্! ওর এসবে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া উচিত আমার, যাইনি। কী হবে গায়ে মেখে সব। ওকে তো আর বলিনি বিয়ে কর আমায় এক্ষুনি, এই সমাজে সিঙ্গেল মাদার হওয়া খুব কঠিন কিছু না হয়তো। আমার কি মনের জোর নেই যুদ্ধ করার। পেশি-বাহু নরম হলেই শিমুল তুলা হয়ে যায় কেউ? আমি দেখিয়ে দেব। নাহ, পারিনি দেখাতে। মোহন অসুখে পড়ল আর সবকিছু বদলে গেল ম্যাজিকের মতো। আমার আর ভালো লাগে না এসব ভাবতে, ক্লান্তি লাগে।

এতোক্ষণে মোহনের মৃত্যুসংবাদ পৌঁছেছে সব জায়গায়। আতিক ভাই-ই করছে সব। মোহনের সমস্ত সতর্কতা সত্ত্বেও আতিক ভাই কেমন করে জানলো মোহনের এই অন্তর্জলীযাত্রা – সেও এক বিস্ময়। মোহনের লাশ চলছে, গাড়িতে সব মিলে আমরা পাঁচজন। আমি আর মোহন ছাড়া আছেন ড্রাইভার সাহেব, পুলিশের এক হাবিলদার আর এই দুর্মূল্যের দিনেও একজন নার্স। সে কেন লাশের সঙ্গে এসেছে এখনো আমি বুঝে উঠতে পারিনি। ব্রাদার্স, ওয়ান্ডারার্স, ওয়ারী, কিংস, আরামবাগ, ফরাসগঞ্জ – এতোদিন যাদের হয়ে যেখানে যেখানে খেলেছে সে, সবাই ফোন দিচ্ছে তার সাইলেন্ট করা ফোনে। মিডিয়াতেও এখন পৌঁছে যাবে হয়তো। আমার ইচ্ছে হচ্ছে না কোনো ফোন তুলে কারো সান্ত্বনাবাক্য শুনি। মোহন আর আমার কমপ্লিকেটেড রিলেশন কারোই অজানা নেই আর। মোহন এদেশের বেঙ্গল টাইগার্সদের একজন, এতো এতো ফোন আসাই উচিত। আমি সংক্রান্ত স্ক্যান্ডালের বাইরে ওর অর্জনও কি কম? দক্ষিণ এশীয় গেমসে খেলেছে। দেশের বাইরের পেশাদার লিগেও খেলেছে বেশ কবার। করাচির পিপলস স্টেডিয়ামে ভুটানের বিপরীতে গোল দিয়ে হইচই ফেলেছিল মোহন। সাফে তার পারফরম্যান্স এতোই মনোমুগ্ধকর ছিল যে, দেশের বড় বড় পত্রিকার ফ্রন্ট পেজেও চলে এসেছিল তার নাম। সেই মিডফিল্ডার এখন শুয়ে আছে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যমাঠে। আহা মোহন! কার ওপর অভিমান ছিল তোর। কেন জানাসনি বোর্ডকে? এটা কি এক ধরনের আত্মহত্যা না? তোর লাল-সবুজ পতাকাটা কই? একটু দিবি ছুঁয়ে দেখতে আমায়?

আমার খুব ইচ্ছে হয় ওর পাশে শুয়ে থাকি। মোহনের দাদাবাড়ির গল্প শুনেছিলাম একবার। খুব লোভ হয়েছিল যাওয়ার। এই তো আজ যাচ্ছি ওর সঙ্গেই। ওদের উঠোনে গিয়েই একটা কাঁথা পাড়বো আমি, নকশি কাঁথা। খুব রোদ হলে উঠোনময় ছড়িয়ে দেব সিদ্ধ ধান, কাক তাড়াব। ঢেঁকিতে পাড় দেব, গরম গরম পিঠা বানাবো মাটির চুলোয়। যদিও জানি না ও-গ্রামে এখন ওসব হয় কি না। এখন তো সব গ্রামই কেমন শহর শহর! সবার বাসায়ই দেখি ডিশ অ্যান্টেনা, মাইক্রোওভেন।

আচ্ছা, এখন কি পূর্ণিমা তিথি? মোহন বলেছিল, ওদের গ্রামের বাড়িতে চাঁদের আলোয় পুকুরভরা চকচকে মাছ থকথক করে। ফিসফিস করে কথাও বলে তারা। মধ্যরাতে বড় কোনো চাঁদ উঠলে মনে হবে পুকুরটা ছুটে আসছে কোলের কাছে। মাছেরা ভেসে ওঠে হাতের তালুকে, তাদের গা থেকে টপটপ করে পড়ে পানি।

আমার পা ভেজা ভেজা লাগে। কফিন চুইয়ে পানি পড়ছে, বরফ গলা পানি। গরমে সেদ্ধ হওয়া ঝাঁঝালো চা-পাতা আর মানবশরীরের গন্ধে আমার কী যেন হয়ে যায়। হড়হড় করে বমি করে ফেলি কফিনের গায়েই। ড্রাইভার আচমকা ব্রেক কষে। আমার শরীর খারাপ কি না জানতে চায়? অদ্ভুত কথা! আমার কেন শরীর খারাপ হবে? কে করবে খারাপ? গরম আবহাওয়া, নাকি সূর্যের আলো? ওরা কি ভাগ্যের কথা বলছে, নাকি সুপ্রিম গডের কথা? শুনেছি দুর্যোগ, মহামারি, অসুখ-বিসুখে তাদেরই হাত থাকে। এসব লৌকিক-পারলৌকিক ব্যাপারগুলো আমার আরো একটু পরিষ্কার জানা উচিত। কিন্তু প্রশ্নটা করবো কাকে? ড্রাইভার, নার্স, নাকি হাবিলদারকে। আচ্ছা ওরা কি পারে না আমাকে মোহনের সঙ্গে বেঁধে দিতে একসঙ্গে। মোহন তো এখন মাছ হয়ে গেছে। আমিও ওর মতো মাছ হয়ে যাব। পানিতে ভাসব। নাচতে নাচতে চলে যাব স্বর্গপুরীতে। দেবতাদের ধ্যানভঙ্গ করে জানতে চাইবো, একটা মশার কামড়ে কেমন করে এতো সম্ভাবনাময় একটা প্রাণ চলে যায় এভাবে। জীবনের এতো আয়োজন, এতো রং হুট করে মুছে দেয় কে? কার এতো ঈর্ষা মানুষের বর্ণিল জীবনের প্রতি। একটা তুচ্ছ পতঙ্গ কী করে একটা বিষধর সাপের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, আমি জানতে চাইব। ওরা কি বলবে আমায় সব; কেন মোহন মরে গেল এভাবে সামান্য ডেঙ্গুজ্বরে? কেন? নার্স মেয়েটি এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে। এই প্রথম আমি কেঁদে উঠতে পারি ডাক ছেড়ে। মনে হয়, আমার যত অভিযোগ যত অনুযোগ এই লাশবাহী গাড়ির ড্রাইভার, হাবিলদার আর নার্স বয়ে নিয়ে যাচ্ছে মোহনের সঙ্গে। আমি রাস্তার দুপাশে উন্নয়নের জোয়ার দেখতে দেখতে যাচ্ছি। ফোর লেন স্ট্রিট, ওভারব্রিজ, পাতাল রেল। দেয়ালে দেয়ালে এল ক্লাসিকোর উন্মাদনা। রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার গ্রাফিতি। বাসার ছাদ, রিকশা, ভ্যান, টংয়ের চায়ের দোকান, জার্সিতে এখনো বিশ্বকাপ। বিবর্ণ রংজ¦লা হলুদ-নীলে পতপত করে উড়ছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল। বিলবোর্ডে হাসছে মেসি, রোনালদো, বেকহামদের মুখ, সব আছে ঠিকঠাক কেবল আমার মোহনই নাই কোথাও। দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই, ভেসে ভেসে যাই দূরে, এদিক হাতড়াই ওদিক হাতড়াই, বেহুলার মতো প্রণয়ীর ঊন-শিথানে খুঁজি পুনর্জীবনের হাড়। ওই তো আর একটু এগোলেই সারিয়াকান্দি পায়রা দিঘির ঘাট।