ঘুমঘোরে এলে মনোহর…

সকালটা অন্যরকম। তোমার মুখের মতো সুন্দর। মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর। এভাবেই আজ মনে পড়লো তোমাকে। ভুলে থাকার সব ধরনের চেষ্টা ভণ্ডুল করে দিয়ে। দিনের শুরুতে যখন চোখের পাতা মেলে ধরে বুঝতে পারলাম, তুমি এসেছিলে আমার একান্ত গোপন স্বপন মাঝারে। আমি ঠিক যেভাবে চাই সেভাবেই, আবার যেভাবে চাই না সেভাবেও!  

এতোদিন পরে এমন অপ্রত্যাশিত রোমান্টিকতায় পূর্ণ হয়ে আসবে তুমি ভাবতে পারিনি। খুব একটা আশাও করিনি। করিনি একদম? গতকাল রাতে অনেকদিন পর তোমার কথা ভেবে কি খানিকটা আকুল হয়েছিলাম? ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল মন-প্রাণ? কত দিন ঝরে গেল জীবনের দিনপঞ্জি থেকে, তোমার সঙ্গে দেখা হয় না আমার। শোনা হয় না তোমার মুখের মধুর নির্যাস, প্রিয় গান – ‘শুধু তোমার বাণী নয় হে বন্ধু, হে প্রিয়, মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো।’

তবে এলে তুমি অবশেষে সব বিরহের দুয়ার দু-হাতে ঠেলে। আমার গহন-গভীর প্রেমের কুঠুরিতে সঙ্গোপনে তুমি এলে। আমার সকল হৃদয় ভরিয়ে দিয়ে আবেগ আর আনন্দের উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিয়ে তুমি এলে মনোরম, রমঝম, ঝমঝম।

তারপর তোমাকে ভেবে ভেবে সারাটা দিন ধরে কাজের ফাঁকে অবসরে আবেশ ভরা আলসেমিতে মনে মনে গেয়ে উঠেছি সেই গানগুলি যে-গানগুলিতে কেবল তোমার অপরূপ কান্তি ভেসে ওঠে। আমাকে পাগলপারা ভালোবাসায় ভাসায় আর ডোবায়। চোখের কোলে জমে ওঠে চিকচিক লবণাক্ত মুক্তার দানা। প্রায় তা উপচে পড়ে সিক্ত করে মুখ ও মুখশ্রী। 

‘অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে যেন এক মুঠো রোদ্দুর আমার দুচোখ ভরে তুমি এলে।’ আমার মনের তারে একটানা সুর বেজে যেতে থাকে, ‘কত বেদনার বিষণ্ন মেঘে ভেসে ভেসে, এলে তুমি অবশেষে …।’

দুই

ডুপ্লেক্স বাড়িটার নিচের তলায় লিভিং স্পেসের মতো খোলা জায়গায় অনেক মানুষের সমাগম। বাড়ি, না অফিস, না কোনো বুটিক, হোটেল বা রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার নয়। কেবল বেশকিছু মানুষের জটলা। নারী-পুরুষ মিলিয়ে। এদের মধ্যে দুয়েকজন পরিচিত। নীলাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। একটা সোফার হাতলে বসে খুব হেসে হেসে কারো সঙ্গে কথা বলছে। তার চিরাচরিত ফ্লার্টিং ফ্যাশনে।

বাঁদিকে ঘোরানো সিঁড়িটার এক পাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি। বরাবরের মতো একা, চুপচাপ, ভিড়ের মধ্যেও অদৃশ্য, নিঃসঙ্গ। আমি নিশ্চয় তোমার কথা ভাবিনি তখন। নাকি ভাবছিলাম? 

হঠাৎ তুমি মেঘদূতের মতো কোথা থেকে উদয় হলে। ঠিক আমার পেছনে। তোমাকে দেখতে পেয়ে খুশির দমকে আমি বাকহারা। কাউকে দেখে মানুষ এতো খুশি হয়? তোমার এক হাতে একটা গোল সুপের বাটিতে স্টিকি রাইস জাতীয় খাবার। খুব সুন্দর করে সাজানো।

মনে হলো দুপুরের লাঞ্চ টাইম। তাহলে এটা অফিস। আমার ডান হাতে বাটিটা ধরিয়ে দিয়ে, অনেকটা আলগোছে গুঁজে দেওয়ার মতো, আবার উধাও হয়ে গেলে এক পলকে। আমার খুশি ভরা মুখে অমাবস্যার আঁধার নেমে এলো টের পেলাম। 

আমার হাতে তোমার খাবারের বাটিটা দেওয়ার ভঙ্গি ছিল অনেকটা চুপিসারে। যেন তুমি চাইলে না কেউ দেখুক। কিন্তু চারপাশে এতো মানুষজন। কেউ না কেউ তো দেখবে বা দেখেছে। আমি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকাতেই এমন নিমগ্ন ছিলাম যে আর কেউ দেখছে কি না তা খেয়াল করা হয়নি। এও বুঝতে পারিনি যে, তুমি চাও না কেউ তা দেখুক। কেন? কেউ দেখলে কী হবে?

তারপর তুমি হারালে তো হারালে। আমার উদ্বিগ্ন দৃষ্টি এ-মাথা থেকে ও-মাথা তন্নতন্ন করে খুঁজেও তোমাকে আর কোথাও দেখতে পেল না। বিষণ্নমনে অধোবদনে আমি ঘরটা থেকে বাইরে বের হয়ে এলাম। সামনের সবুজ লনে লাল রঙের ইট বিছানো পথ। তোমাকে আরেকবার দেখতে না পাওয়ার কষ্টে বুকের ওপর আমার বেদনার জগদ্দল পাথর।

দু-পা হেঁটে সামনে এগিয়ে যেতেই প্রাইমারি স্কুলের বন্ধু মহিমার সঙ্গে দেখা। কত বছর পরে মনে নেই। ওকে পছন্দ করতাম ওর মিষ্টি চেহারা আর বুদ্ধিমত্তার জন্য। অন্যদের থেকে আলাদা ছিল। আমি স্কুল বদলে অন্য স্কুলে চলে যাওয়ার পর বহু বছরের যোগাযোগ-বিচ্ছিন্নতা। বছর তিনেক আগে ফেসবুকে আবার যোগাযোগ হলো। কিছুদিন পরে আবার যে কে সেই।

একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে, একটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছে গেলে ছেলেবেলার বা পুরনো দিনের বন্ধুত্ব অনেক সময় আর আগের মতো কাজ করে না। আমার মতো সারাজীবন দলছুট মানুষের জন্য তো নয়ই। আমার কি কখনো তেমন কোনো বন্ধু ছিল? জানি না। তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম সে-কথা। সে-সুযোগই পেলাম না। কেবল একবার খানিকটা সাহস করে বলতে পেরেছিলাম,  ‘বহুদিন পরে বহু ক্রোশ ঘুরে’ এমন একজনকে পেলাম … আমি যা বলতে চেয়েছিলাম তা না বলে অন্য আরো কিছু কথা বলে কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি বুঝতে পেরেছিলে? তাও জানতে পারিনি আজ অবধি। হয়তো আর কখনো জানা হবে না। 

মহিমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেখি সামনে বেশ কিছু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে, খেলছে। ওদের আনন্দমেশানো দৌড়ঝাঁপ আর হুটোপুটি দেখে ভালো লাগলো। তোমাকে আরেকবার ভালো করে না দেখতে পারার কষ্টটা কিছুটা লাঘব হলো। হয়তো, হয়তো নয়। মহিমার বাচ্চা দুটোও আছে ওই দলের মধ্যে। তাহলে কি এটা কোনো রিসোর্ট?

তিন

আরেকবার তোমাকে খুঁজে পাই কি না শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাইলাম। তোমার সঙ্গে দেখা হলো, কিন্তু কোনো কথা বলতে পারলাম না সেটা ভেবে কিছুতেই মনকে বোঝাতে পারছিলাম না। আমি আবার সেই ডুপ্লেক্স বাড়িটার ভেতরে ঢুকে যেখানে আমাদের দেখা হয়েছিল সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম।

লিভিং স্পেসের সামনের দিকের খোলা প্রশস্ত জায়গা জুড়ে টেবিল-চেয়ার বসানো। ভালো করে তাকাতেই চোখকে একদম বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমার কাছ থেকে প্রায় একশ হাত দূরে একটা টেবিলে চা বা কফির কাপ হাতে তুমি বসে আছো। পাশ ফিরে আছো বলে আমাকে দেখতে পাচ্ছো না। তোমার ও-পাশে কাচের স্বচ্ছ দেয়াল। তোমার ভাবুক চোখজোড়া সেদিকেই নিবদ্ধ। ‘তুমি কি এখন আমার কথা ভাবছ? দুটি চোখের তারায় শুধু আমাকেই দেখছ?’ জানি না। আমি একবার ঢোক গিলে গলায় সবটুকু জোর এনে তোমাকে ডাকতে চাইলাম। আবার কী মনে করে চুপ হয়ে গেলাম। তোমার যদি ভালো না লাগে? যদি তুমি বিব্রত হও, অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করো?       

তারপর? 

চার

আমরা দুজন একেবারে সামনাসামনি মুখোমুখি। এতো কাছে যে পরস্পরের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তোমার ফরসা মুখে একপ্রস্থ অন্ধকার লেপটে আছে। আমার বুকের ভেতর ঢিবঢিব শঙ্কা। আমি বুঝতে পারছি না কেন। তোমাকে এতো কাছে পাওয়ার সুখে আমার বলতে গেলে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। অথচ তোমার কোনো বিকার নেই, সাড়া নেই। কিছুটা বিরক্ত তুমি। আমার হৃৎপিণ্ড কাঁপছে দ্রুততর গতিতে। আমি কি কেঁপে কেঁপে উঠছি? তোমাকে এতো কাছে পাওয়ার তীব্র আনন্দে, তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ঙ্কর দুর্ভাবনায়। জানি না।

কী হয়েছে তোমার? এতো গম্ভীর কেন তুমি? আমার আশঙ্কামিশ্রিত জানতে চাওয়া।

নীলা কি দেখেছে আমি যখন তোমাকে খাবারের বাটিটা দিই? তুমি গোমড়া মুখে জানতে চাইলে।

ও, তাহলে এই ব্যাপার।

আমি খেয়াল করিনি। হয়তো দেখেছে। ও তো সামনেই ছিল।

নীলার দেখে ফেলাটাই ছিল আমার অপরাধ। তোমার বিরক্ত হওয়ার কারণ। আমার কাছ থেকে পালিয়ে থাকার হেতু।

আশ্চর্য, তুমি তো সবার সামনেই দিলে। এখন কেউ দেখে ফেললে আমার কী করার আছে বা থাকতে পারে।

পরিষ্কার দেখলাম, আমার জবাব তোমার পছন্দ হলো না। তুমি মুখ কালো করেই থাকলে। অথচ, এখানে আমার দোষটা কোথায় বা আমার কী করার ছিল সেটিও বুঝতে পারছিলাম না। যদি কেউ না দেখুক আমাদের এই লেনদেন এটিই তুমি চেয়ে থাকো, তাহলে আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে খাবারটা দিতে পারতে। মনে মনে বললাম। কিন্তু তোমাকে আর রাগাতে চাইলাম না বলে চুপ করে থাকলাম।

রাগ বা বিরক্ত হওয়ার কথা আমার, অথবা অভিমান (আমাদের সম্পর্ক কি অভিমান পর্যায়ে গেছে?)। অথচ উলটো তুমি আমার সঙ্গে অদ্ভুত আচরণ করছ। তোমার চরিত্রের এই দিকের কথা অর্থাৎ তোমার হেঁয়ালিপূর্ণ আচরণের বিষয়ে আমি দুয়েকজনের কাছে কিছুটা শুনেছি। তোমাকে তো খুব বেশিদিন জানি না আমি। এখন দেখলাম কিছু ব্যাপার মিলে যাচ্ছে।

আমার মনে পড়লো, প্রায় দু-মাস আগে তোমার সঙ্গে যেদিন শেষ দেখা হলো সেদিনের কথা। আমি আরেকবার ঢোক গিললাম ঘটনাটা মনে করে। তোমার সেদিনের সেই ভীষণ দুর্বোধ্য আচরণের কোনো ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত আমি খুঁজে পাইনি। কেবল আমার মতো করে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চেয়েছি। শেষতক কোনো কূল-কিনারা করতে পারিনি। তারপর তুমি এলে এভাবে।  

পাঁচ

কী আনন্দ নিয়েই না তোমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম সেদিন। ঠিক এক মাস পরে। তোমার রুমে একজন সাংবাদিক বসেছিল, যে তোমার এলাকার পূর্বপরিচিত। নতুন পত্রিকা বের করছে ওরা। একটা খবর নিয়ে তোমার মতামত চাইলো। তোমার যা বলার বললে। সাংবাদিক চাইছিল, তোমার নাম উল্লেখ করতে। বহু কষ্টে তাকে নিবৃত্ত করা গেল। সেই আলোচনায় আমিও অংশ নিলাম। তারপর একসময় সাংবাদিক বিদায় নিলে তুমি আমাকে তোমার টেবিলের সামনের চেয়ারে গিয়ে বসতে বললে।

তোমার মুখোমুখি বসার আমার বরাবরের দ্বিধা সক্রিয় হয়ে উঠলো। যে সোফাটায় বসেছিলাম, এর আগে যে তিনবার তোমার রুমে গিয়েছি সেখানেই বসেছি। যদিও তোমার সঙ্গে কথা বলতে গেলে ঘাড় খানিকটা বাঁকা করে আড়াআড়ি অবস্থান নিতে হয়, আমি তবুও সেখানেই আরাম বোধ করেছি সবসময়। তারপর সেদিন তোমার কণ্ঠে সর্দিজনিত ঈষৎ নাকিসুর। কিছুক্ষণ পরপর নাক টেনে উঠছো। তুমি ভাবলে করোনার এই সময়ে আমি বুঝি এই ব্যাপারটাই ভয় পাচ্ছি। জোরে কথা বলতে তোমার কিছুটা কষ্ট হচ্ছে বলে আবার আমাকে সামনের চেয়ারে গিয়ে বসতে বললে। এবার কিছুটা বিরক্ত তুমি একই অনুরোধ একাধিকবার করতে হচ্ছে বলে।

এটা আমার অ্যালার্জির সমস্যা। ভয় পেয়ো না, তোমার হবে না। তুমি চাইলেও হবে না। তোমার সেই হৃদয়-মোচড়ানো হাসি ঠোঁটের কোনায় এনে আমাকে অভয় দিতে চাইলে।

তোমার অনুরোধ রাখতে আর বিরক্তি না বাড়াতে সামনের চেয়ারটায় বসতে গিয়ে আমি তোমার অদ্ভুত কথাগুলো শুনতে শুনতে ভাবলাম, এর কোনো অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আছে কি না। নাকি কেবলই কথার কথা। তুমি চাইলেও হবে না শব্দগুলোর সঙ্গে তোমার সেই মিষ্টি হাসির মিশেল আমার বুকের ভেতরে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ তুললো। তুমি হয়তো জানলেও না।

কী খাবে বলো? চা, কফি, কোক? কী অসম্ভব মায়া তোমার সেই জিজ্ঞাসার একেকটা ছোট শব্দে। আমি নিজেকে ক্রমশ ঘোরের ভেতর হারিয়ে ফেলছি মনে হয়। এ কি স্বপ্ন, না সত্যি? নিজের ওপর সবটুকু নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। যেন কিছুতেই কোনো আবেগের স্পষ্ট প্রকাশ না ঘটে যায়। আমি বরং দেখি, তুমি আমার জন্য কতটা এবং কীভাবে নিজেকে প্রকাশ করো।   

না, কিছু লাগবে না। শুধু গ্রিন টি নিতে চাই। বিস্কিট আছে? দুপুরে কিছু খাইনি তো। তাই খালি পেটে চা খাওয়া ঠিক হবে না। আমি বললাম তোমার অমন আন্তরিক আতিথেয়তার জবাবে।

এরকম অনিয়ম করলে তো শরীর ভেঙে পড়বে তোমার। কত বয়স হয়েছে? চল্লিশ হয়েছে না? (তোমার মুখে চল্লিশ শুনে আমার এতো হাসি পেল! সেটা অবশ্য প্রকাশ করিনি। চল্লিশ সেই কবে পার করেছি!) দুপুরে খাইনি শুনে তোমার কণ্ঠে ঝরে পড়লো ভালোবাসায় ভরা উদ্বেগ। আমি আরেকবার মুগ্ধ হলাম।

তারপর বিস্কিট আছে কি না সেই প্রশ্নের জবাবে যা করলে তার জন্যও প্রস্তুত ছিলাম না একদম।

না, বিস্কিট নেই। আচ্ছা, দাঁড়াও, আরমানের রুম থেকে আনিয়ে দিচ্ছি। বলে তুমি তোমার অফিস সহায়ককে ডেকে আমার জন্য পাশের রুমের অফিসারের কাছ থেকে বিস্কিটের কৌটাটা আনতে বললে। আমার অভিভূত হওয়ার পালা চূড়ান্ত পর্বে উপনীত হলো।  

এরপর তুমি যেন এক নিশ্বাসে আমার সব খবর শুষে নিতে চাইলে। বাবা-মা কেমন আছে থেকে শুরু করে আমার সাম্প্রতিক বিদেশ সফরের সর্বশেষ হাল-হকিকত। ঠান্ডা-সর্দির কারণে তোমার কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছিলো বেশ। তারপরও তুমি একটানা কথা বলেই গেলে। আমি শুনলাম মন দিয়ে, তোমার কথার জবাব দিলাম আর যা করি সবসময়, তোমাকে দেখলাম নয়ন ভরে।

তারপর কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে জানতে চাইলাম সেই প্রজেক্টটার ব্যাপারে যেটা নিয়ে আমাদের দুজনের একসঙ্গে কাজ করার কথা। যেটি নিয়ে কাজ করার জন্য তোমার আগ্রহ থেকেই আমাদের এই যোগাযোগের যাত্রা শুরু। এর মধ্যে বোকা মেয়ে আমি অর্ধেকটাই তোমার প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাবার দশা। আশ্চর্য! প্রেম এরকম একতরফা হয়? তুমি হয়তো এরকম কোনো চিন্তাভাবনার ধারপাশ দিয়েও যাওনি। অথচ আমি কি না তোমার প্রেমে হবো কলঙ্কভাগী অবস্থা!

আমার জিজ্ঞাসার জবাবে তুমি যা শোনালে তাতে আমার মুগ্ধতার সবটুকু পূর্ণ হলো। কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছিলাম প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে। তোমার জাদুমাখা কণ্ঠে তুমি হাল ছাড়তে নিষেধ করলে। আমাকে অবাক করে দিয়ে গেয়ে উঠলে গান, ‘হাল ছেড়ো না, বন্ধু …।’ বন্ধু? আমাকে তুমি বন্ধু বলে সম্ভাষণ করলে? মনে হলো, আমার বুকের সমুদ্রে আছড়ে পড়লো এক ভয়ঙ্কর তুফান সবকিছু তোলপাড় করে দিয়ে। বাইরে আমার শান্ত-ধীর-স্থির সুরত দেখে তুমি তা কল্পনাও করতে পারলে না।

তোমার মুখে অকস্মাৎ ওই গানের এক কলি শুনে আমি এতোটাই অবাক আর হতবুদ্ধি হয়ে পড়লাম যে, সে-মুহূর্তে গায়কের নাম মনে করতে ভুল করলাম। যেটা আমার সচরাচর হয় না।

অঞ্জন?

না, সুমন।

কিন্তু …।

সুমন। এটা সুমনের গান।  গানপ্রিয় তোমার আত্মবিশ্বাসী জবাব। 

তোমার কথার মাঝখানেই ইন্টারকমটা বেজে উঠলো। মাত্র একটা বিস্কিটে অর্ধেক কামড় দিয়েছি। গ্রিন টির কাপে এখনো হাত দেওয়া হয়নি। টেলিফোনের কথা শুনে বুঝলাম, তোমাকে পাশের এক রুমে যেতে হবে যেখানে বিশেষ এক দিবসের অংশ হিসেবে কেক কাটার আয়োজন করা হয়েছে। আমার মন খারাপ হলো। সেটি প্রকাশ হতে দিলাম না। এসেছিলাম তোমার সঙ্গে কথা বলতে। সাংবাদিক সাহেব বেশ কিছু সময় নিলেন। এরপর এলো একাধিক ফোনকল। তারপর দুজনের যৌথ আড্ডা শুরু হতে না হতেই কেক কাটার নিমন্ত্রণ। আমার যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না একদম। তারপরও তোমার পীড়াপীড়িতে যেতে বাধ্য হলাম। সেই যাওয়াটাই হলো সব সর্বনাশের কারণ। তোমার সঙ্গে আমার সংক্ষিপ্ত আলাপের অকালমৃত্যু। তোমার দিক থেকে যোগাযোগের সব দুয়ার বন্ধ। আক্ষরিক অর্থে। আমার এক বুক হাহাকার শূন্যে বিলীয়মান।   

ছয়

কেক কাটার রুমে বেশ কিছুক্ষণ অকারণ কথাবার্তা হলো। ছবি তোলা হলো। ছবি তোলার সময় তোমার কাছে সরে আসতে বলেছিলে ক্ষীণ স্বরে। মনে আছে তোমার? একদম তোমার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে গিয়ে আরেক দিনের কথা মনে পড়লো। সেদিন তোমার রুমে একটা প্রোগ্রাম ছিল। প্রোগ্রামের আগে-পরে বেশ কিছু মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠলো। সেদিন তুমিসহ গ্রুপে কয়েকটা ছবি তোলা হলেও ঠিক তোমার পাশে দাঁড়িয়ে কোনো ছবি তোলা হয়নি। সেদিনের প্রতিটি ছবি ছিল চমৎকার। বিশেষ করে সবকটি ছবিতেই তোমার দেবরূপ কান্তি ঝলমল করে উঠেছিল প্রাণ-উচ্ছল হাসিতে। সত্যি কথা বলি, যেটি তোমাকে আর বলার সুযোগই পেলাম না, ওরকম প্রাণবন্ত স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে তোমাকে আমি আগে কখনো হাসতে দেখিনি। এরপরে তোমার আরো কিছু ছবি আমি দেখেছি। না, সেদিনের সেই অপূর্ব হাসিমুখের তোমাকে আমি আর কোথাও খুঁজে পাইনি।

ছবিগুলিতে তোমার অমন উজ্জ্বল উপস্থিতি নিয়ে তোমাকে আমি মেসেজে লিখেছিলাম, ইউ আর স্পার্কলিং লাইক এনিথিং। তুমি বলেছিলে এভাবে না ভাবতে। আমি বলেছিলাম, ভাবনাটা আমার, তাই আমাকে এভাবেই ভাবতে দাও। সেদিনও বুঝতে পারিনি, দুদিনের মাথায় তোমার সঙ্গে আমার সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। মাঝেমধ্যে ছবিগুলো বের করে দেখি আর কল্পনায় মনে করতে চেষ্টা করি, এরকম একটা অসম্ভব আনন্দময় দিন কি সত্যি আমার জীবনে এসেছিল? এরকম দিন যেদিন তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করেছিলে, আমাকে ফোনে না পেয়ে মেসেজে উষ্মা প্রকাশ করেছিলে দেরি করছি বলে আর তারপর ছবি তোলার সময় তুমি হেসেছিলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুপুরুষের হাসি। হয়তো এরকম একটা দিন এসেছিল আমার জীবনে, হয়তো না। হয়তো সবই ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্নের মায়াজাল। 

সেদিন ছবি তোলার পর কেক পিস করে কাটার কাজটা তুমিই করলে তোমার সুচারু হাতে। কেক কাটায় তোমার দক্ষতার প্রমাণ আমরা স্বচক্ষে দেখলাম। তারপর আবার খানিকটা গল্প আর আড্ডার ছলে কিছু সময় পার করা। মনে মনে আমি অস্থির হয়ে উঠেছি, কখন তোমার রুমে গিয়ে বসবো আর আমাদের নিজেদের বলতে চাওয়া কথার ঝাঁপি খুলে বসবো। একসময় তুমি উঠে তোমার রুমে চলে গেলে। যাওয়ার সময় আলতো স্বরে আমাকে তোমার রুমে আসতে বললে। তারপর থেকে আমার অস্থির অপেক্ষা কখন সেখান থেকে বের হতে পারবো।

যার রুমে বসেছিলাম, সে-সহ আরেকজনের সঙ্গে যে-আলোচনা চলছিল, তাতে আমি কিছুতেই অংশগ্রহণ করতে পারছিলাম না। আবার চক্ষুলজ্জার ভয়ে মাঝপথে চলেও যেতে পারছিলাম না। একসময় তুমি আবার এলে। এই রুমে রেখে যাওয়া তোমার ফোনটা নিতে। আমার অধৈর্য অস্থিরতা তখন তুঙ্গে। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে পাঁচটা ছেড়ে পৌনে ছটার কাছাকাছি।

সাত

অবশেষে একসময় দম বন্ধ করে সেই রুম থেকে ছাড়া পেয়ে যখন তোমার রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালাম, দরজার ওপরের কাচ দিয়ে ভেতর দিকটা অন্ধকার দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো। আমি নিশ্চিত, তুমি রুমেই আছো। আমার রেখে যাওয়া অর্ধসমাপ্ত বিস্কিট আর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া গ্রিন টি সামনে নিয়ে তুমি ঠিক আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছো। এর অন্য কিছু আমার পক্ষে চিন্তা করার কারণ ছিল না। তবে দরজার নবে হাত রেখে বুঝলাম, আমার ধারণা ভুল। অফিস রুমের বাতি আর দরজা বন্ধ করে আমাকে না জানিয়েই তুমি চলে গেছো সেই রুমটার সামনে দিয়ে যেখানে আমি তখনো বসে আছি কখন তোমার রুমে এসে আবার বসবো বলে।

আমার সঙ্গে এমন অপ্রত্যাশিত অস্বাভাবিক আচরণ তুমি করতে পারো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। হতভম্ব হয়ে তোমার রুমের দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেই তোমাকে ফোন করলাম। একবার, দুবার, তিনবার। প্রতিটি কল পুরো সময় ধরে বেজে থেমে গেল। তুমি ধরলে না। আশাহত আমি তোমাকে মেসেজ পাঠালাম, আমাকে না বলে চলে গেলে?

গোটা ব্যাপারটাই আমার কাছে একটা গোলকধাঁধা মনে হলো। কোনো কূল-কিনারা করতে পারছিলাম না। অফিস থেকে ধীর পায়ে বের হয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসলাম। মাথার ভেতর সবকিছু ফাঁকা হয়ে যাওয়ার অনুভূতি নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চাইলাম, ওকে, ইটস ওকে। কিন্তু মনের ভেতর থেকে কেউ একজন গুমরে কেঁদে বলে উঠছিল, নো, ইটস নট ওকে। ইট কান্ট বি। নিজেকে বোঝাতে বারবার ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ শেষ চেষ্টা হিসেবে অর্ধেক পথ এসে তোমাকে আরেকবার ফোন করলাম। না, এবারো ধরলে না। বুঝলাম, ইচ্ছা করেই ব্যাপারটা তুমি ঘটিয়েছ। আমার ফোন কল কিছুতেই রিসিভ না করাতে ধারণা পাকাপোক্ত হলো। শুধু কিছুতেই যা মাথায় ঢুকছিল না, এরকমটা কেন করলে।

সেদিন তুমি অসুস্থ বোধ করছিলে, দেখেছি। হয়তো সে-কারণেই চলে গেছো। কিন্তু যাওয়ার সময় আমাকে তো একবার বলে যেতে পারতে। তুমি ভালো করেই জানো, আমি সেদিন তোমার সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমাদের কথা মাত্র শুরু হতে না হতেই সেই কেক কাটার রুমে আমাকে অনেকটা জোর করেই নিয়ে গেলে। সবশেষে আমাকে আবার তোমার রুমে যেতে বললে। যখন ফিরে গেলাম, তখন তুমি আর নেই। আমাকে না জানিয়েই বিদায় নিয়েছ। যখন ফোন করেছি, রিসিভ করোনি। কিছু কি বোঝার মতো আছে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে নিছক তোমার হেয়ালি ছাড়া?

একটা সময় ভীষণ রাগ হলো তোমার ওপর। তারপরও নিজেকে বুঝিয়ে আরেকটা মেসেজ করলাম, তোমার সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিলাম। তোমার রুমে যেতে বলে আমাকে না বলে কীভাবে চলে যেতে পারলে? এরকম কিছু কথার একটা মেসেজ। কয়েক ঘণ্টা পরে তোমার যে উত্তর পেলাম, তাতে আমি আরো বেশি স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম, আসতে বলেছিলাম? তাহলে সরি। কথা বলার মতো আর তেমন কিছু ছিল না মনে হয়। প্রচণ্ড চপেটাঘাতেও এতোটা কষ্ট পেতাম না যেটা পেলাম তোমার মেসেজের শেষ বাক্যটা পড়ে। তাহলে এটাই কারণ যে, আমাদের কথা বলার আর তেমন কিছু ছিল না বলেই তুমি অমন চুপিসারে আমাকে না বলে চলে গিয়েছিলে। তুমি এমনটা ভাবলেও আমি তা মনে করি না। এর পেছনে তোমার কোনো অভিমান বা আর অন্য কোনো আবেগ কাজ করেছে কি না আমি নিশ্চিত নই। যেহেতু এরপরে তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি, কথাও নয়।

আট

তারপর সেদিন, শুক্রবারের সেই সকালে তুমি অমন করে এলে আমার নয়ন সমুখে। প্রিয়তম, নীপসম, নিরুপম। আমি তোমার সঙ্গে যেচে আর কোনো যোগাযোগ করবো না ঠিক করেই ফেলেছি। এর মধ্যে দেড় মাসের বেশি সময় চলে গেছে, তুমি আমার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগের চেষ্টা করোনি। আমি তোমার শেষ মেসেজটার অর্থ বারবার বুঝতে চেয়েছি এবং এর আগের গত চার মাসের ঘটনাবলির সঙ্গে সেই মেসেজের কোনো যোগসূত্র মেলাতে পারিনি বলে শেষাবধি ব্যাপারটিকে তোমার চরিত্রগত হুইমজিক্যাল আচরণের বহিঃপ্রকাশ বলে মেনে নিয়ে নিজেকে প্রবোধ দিতে চেয়েছি। আমাকে তুমি এভাবে তোমার জীবনে টেনে না আনলেও পারতে। তোমাকে আমি যত দিন ধরে জানি, সব সময় দূর আকাশের তারা বলেই ভেবেছি। সেটি তোমাকে একবার বলেওছি। আমার প্রতি তোমার আপাত ভালো লাগার প্রকাশেও তেমন কোনো কার্পণ্য দেখিনি। বরং, আমার প্রতি তোমার বিশেষ এক ধরনের ভালো লাগা আছে জেনে ভীষণ অবাক হয়েছি।

তারপর সেদিন যে কী হলো তোমার! তুমি নিজে থেকে না জানালে আর কোনোদিনই জানা হবে না। তোমার সর্বনাশা সৌন্দর্যের কাছে গিয়ে আমি আর মানসিকভাবে পরাজিত হতে চাই না। যে-কাজের স্বপ্ন নিয়ে আমাদের কথা হয়েছিল কিছুটা, তা না হলেও কোনো দুঃখ রাখতে চাই না মনে। তুমি এ-বিষয়ে এতোটাই আগ্রহ দেখিয়েছিলে যে, সেটিই বাকি জীবন আমাকে প্রথম দিনের মতো সুখ ও আনন্দ দিয়ে যাবে।

কিন্তু মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলেও আমার স্বপ্নের মহলে তোমার আসা-যাওয়া বন্ধ হয় না কিছুতেই। সেদিন যেমন এলে। আর এসে তুমি ঠিক যেমন তেমনটাই আচরণ করলে। সবার সামনে আমাকে দুপুরের লাঞ্চের খাবার হাতে ধরিয়ে দিলে। আবার সবাই কেন সেটা দেখে ফেললো সেই অপরাধে আমার কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলে। আবার যখন ফিরে এলে, তখন একদম যেন সত্যিকারের অভিমানী প্রেমিক হয়েই এলে।

আমরা দুজন দুজনের মুখোমুখি। আধো আলো-অন্ধকারের অস্পষ্ট ছায়ায় মনে হলো, আমরা দুজন একে অন্যের মুখের ওপর ঝুঁকে আছি। পরস্পরের নিশ্বাসের শব্দ আমাদের দম যেন খানিকটা বন্ধ করে দিতে উদগ্রীব। কিন্তু সেই আবছা আলোতেও আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, তোমার ক্লিনশেভড ফরসা মুখে একফালি কালিমার ছাপ। তোমাকে এতো কাছে পাওয়ার অসম্ভব সুখে আমি প্রায় স্তব্ধ, বাকহীন। অথচ তুমি কেমন যেন নির্বিকার, নিরুত্তাপ। মনে হচ্ছে, খানিকটা বিরক্ত। আমার কোনো আচরণে? কিছুই বুঝতে পারছি না। থেকে থেকে শরীর কেঁপে উঠছে আমার। মনে হচ্ছে, এই বুঝি আমার অধরে তোমার অধর নেমে আসবে পরিপূর্ণ। একসময় উত্তেজনায়, শিহরণে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

তারপর?

আমি স্পষ্ট শুনলাম তোমাকে বলছি, আমার সঙ্গে এভাবে রাগ করছো কেন? নীলা দেখে ফেললে আমার কী করার আছে? তুমি আমার না? তুমি আমার নও? এরপর চোখ খুলে কেবল তোমার অপরূপ মুখটাই দেখতে পেলাম। আর মাথার ভেতরে একটানা বেজে যাচ্ছে, ‘আপকি নাজরোমে সামঝা, পেয়ার কি কাবিল মুঝে …।’