কবিতার রূপশ্রেণি

(গত সংখ্যার পর)

১.৫. চরিতকাব্য (biographical poetry)

মধ্যযুগের আখ্যানকাব্যের একটি বিশেষ ধারা হচ্ছে চরিতকাব্য। কাব্যের মাধ্যমে সাধু পুরুষদের জীবনকাহিনি বর্ণনার মাধ্যমে মধ্যযুগে যে-সাহিত্য গড়ে উঠেছে তাই চরিতকাব্য বা জীবনীকাব্য নামে অভিহিত হতে পারে। তবে এগুলি কোনো ব্যক্তিত্বের সত্যকারের জীবনী হয়ে ওঠার চেয়ে বহুলাংশে হয়ে উঠেছে সন্তজীবনী (hagriography)। এসব চরিতকাব্যে সাধু, সন্ত বা ধর্মবেত্তার জীবনের ঘটনা অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করা হয়। তাতে ব্যক্তির গুণাবলির প্রশংসাই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এ-ধরনের চরিতকাব্যে ভক্ত কবি কাব্যের মূল চরিত্রের লৌকিক আচার-আচরণের চেয়ে অলৌকিক মাহাত্ম্য প্রচারেই নিয়োজিত থাকেন বেশি। ‘চরিতের’ চেয়ে ‘চরিতামৃত’ই থাকে তার অন্বিষ্ট। এই প্রবণতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলায় চরিতকাব্য লেখার ঐতিহ্য দুর্লক্ষ্য নয়। পরোক্ষভাবে চরিতকাব্য লেখার প্রবণতা লক্ষ করা যায় বাংলা অনুবাদ কাব্য ও মঙ্গলকাব্যগুলিতে। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত কাব্য এক অর্থে তার পৃষ্ঠপোষক রাজা রামপালের আংশিক জীবনকাহিনি। ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যের তৃতীয় অংশে ইতিহাস ও জনশ্রুতি মিলিয়ে বস্তুত রাজা মানসিংহের চরিতকাব্যই রচনা করেছেন।

বাংলায় চরিতকাব্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হচ্ছে আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব‌ শ্রীচেতন্য ওরফে বিশ্বম্ভর মিশ্রকে নিয়ে লেখা কাব্যগুলি। এক্ষেত্রে প্রথম উল্লেখযোগ্য চরিতকাব্য হচ্ছে বৃন্দাবন দাস-রচিত চৈতন্যভাগবত। ২৪০০০ চরণে রচিত এই কাব্যে কৃষ্ণদাস কেবল চৈতন্যের কর্মলীলা ও গুণলীলাসহ  গৌড়ীয় বৈষ্ণবতত্ত্ব উপস্থাপন করেননি, চৈতন্যের প্রেমবিহ্বল ও ভাবতন্ময় যে রূপ তিনি অঙ্কন করেছেন তাতে চৈতন্যভক্ত ও কাব্যরসিক মুগ্ধ না হয়ে পারেন না। বিষয়বস্তু, রচনাশৈলী ও সাহিত্যগুণে এটি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।

অন্যান্য চৈতন্য চরিতকাব্যের মধ্যে লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল কাব্যে চৈতন্যদেবের অতিরঞ্জনহীন মানবীয় রূপটি প্রধানভাবে চিত্রিত হয়েছে। জয়ানন্দ তাঁর চৈতন্যমঙ্গলে ভক্তিরসের প্রাবল্যে চৈতন্যদেবের ভাবময় অলৌকিক রূপ এঁকেছেন। এটি তিনি রচনা করেন পালাগান হিসেবে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য চৈতন্য চরিতকাব্য হলো : গোবিন্দদাসের কড়চা ও চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়।

১.৬ রূপক কবিতা (allegorical poetry)  

কবিতায় উপরিতলে বর্ণিত কাহিনির মধ্য দিয়ে কোনো গূঢ় বা বিশেষ অর্থ ব্যঞ্জিত হলে তাকে বলা হয় রূপক কবিতা। রূপকের প্রতিশব্দ ইংরেজি allegory কথাটি এসেছে গ্রিক allos (অন্য) এবং agoreucin (বলা) থেকে। এর অর্থ ‘অন্যভাবে বলা’। তাই দেখা যায়, রূপক কবিতায় আপাতবর্ণিত কাহিনির অন্তরালে অন্য একটি অর্থের ব্যঞ্জনা প্রচ্ছন্ন থাকে। এই ধরনের কাহিনি-কবিতার চরিত্র, ঘটনা বা পরিপাশর্^ কোনো না কোনো বিমূর্ত বৈশিষ্ট্যের ধারক হয়ে থাকে। রূপক কবিতায় যে নিহিত অর্থ থাকে তা হতে পারে নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা ব্যঙ্গাত্মক। কাহিনিতে বর্ণিত চরিত্রগুলি প্রায়শ লোভ, ঈর্ষা, আশা, দয়া, ধৈর্য, মনোবল ইত্যাদির প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়! এভাবে রূপক কবি দুটো তলে দু-ধরনের অর্থগত কৌতূহলকে ধারণ করেন : ১. উপরিতলে বর্ণিত কাহিনি, চরিত্র ও ঘটনা এবং ২. গভীরতলে এগুলির মাধ্যমে প্রতীকায়িত অর্থ। অবশ্য কখনো কখনো গীতিকবিতার আদলেও রূপক কবিতা রচিত হয়ে থাকে।

ইংরেজি সাহিত্যে এলিজাবেথীয় যুগের কবি এডমন্ড স্পেন্সার রচিত ‘Faerie Queene’ সবচেয়ে সুপরিচিত রূপক কবিতা। এই কবিতার বহিরঙ্গে প্রাচীনকালে রাজা আর্থারের কাহিনি থাকলেও এটি আসলে নারী এলিজাবেথের প্রশস্তি ও দেশাত্মবোধের রূপক। ইতালীয় কবি দান্তের ‘Divina Commedia’ পৃথিবী-বিখ্যাত ধর্মীয় রূপক কবিতা। সতেরো শতকের ইংরেজ কবি ড্রাইডেনের Absalom and Achitophel রাজনৈতিক রূপক ব্যঙ্গকাব্য। বাইবেলে বর্ণিত রাজা ডেভিডের কাহিনিকে ড্রাইডেন তাঁর কাব্যে সমকালীন রাজনৈতিক সংকটের ব্যঙ্গরূপক নির্মাণের কাজে ব্যবহার করেছেন। রাজসিংহাসনের জন্য দ্বিতীয় চার্লস জারজপুত্র মানমাউথ এবং চক্রান্তকারী শ্যাফটবেরির আঁতাতের এই কাহিনিতে অ্যাবসালেম ও অ্যাকিটোফেল যথাক্রমে মনমাউথ ও শ্যাফটবেরির প্রতিরূপ। ড্রাইডেনের ‘The Hind and the panther’ আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় রূপক কবিতার উদাহরণ। বিশ্বসাহিত্য পশুপাখিদের নিয়ে বহু রূপক কাহিনি সৃষ্টি হয়েছে। চসারের ক্যান্টারবেরি গল্পগচ্ছের অন্তর্গত মোরগ দম্পতি ও ধূর্ত শিয়ালের গল্প অবলম্বনে রচিত ‘The Nun’s Priest’s Tale’ এ-ধরনের রূপক কাহিনি-কবিতা।

বাংলা সাহিত্যে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়াময়ী দান্তের ‘Divina Commedia’ কবিতার কাহিনি অবলম্বনে রচিত রূপক কাব্য। তাঁ‌র আশাকানন ও রূপক কাব্যের পর্যায়ভুক্ত। তবে রূপক কাব্য হিসেবে এগুলি শিল্পসার্থক নয়। সে-তুলনায় স্পেন্সারের ‘Faerie Queen’ কবিতার আদর্শে রচিত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্নপ্রয়াণ শিল্পগুণান্বিত রূপক কাব্য। মধুসূদনের ‘যশোর মন্দির’ রূপক কবিতা হিসেবে বিবেচ্য। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘ভারতী’কে রাজনৈতিক রূপক কবিতা এবং মোহিতলাল মজুমদারের ‘আহবান’কে সামাজিক রূপক কবিতা বলা যায়।

রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কবিতা রূপকধর্মী। তার ‘সোনার তরী’ কবিতায় জীবন ও সৃষ্টির রহস্য রূপক তাৎপর্যে বিশিষ্ট। ‘খাঁচার পাখী’ ও ‘দুই পাখী’ কবিতায় বন্দি জীবন ও মুক্ত জীবনের তাৎপর্য রূপক বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। তবে এসব কবিতায় কাহিনি বা গল্পাংশ তেমন বিশদ নয়। তাই কেউ কেউ এগুলিকে রূপক কবিতা না বলে সাংকেতিক (symbolic) কবিতার পর্যায়ে ফেলতে চান। জীবনানন্দ দাশের ধূসর পাণ্ডুলিপির ‘জীবন’ কবিতায় জীবনকে দেখা হয়েছে রূপকের আধারে। নজরুলের ‘খেয়াপারের তরণী’ ও ফররুখ আহমদের ‘পাঞ্জেরী’ কবিতায় রূপক বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

২. গীতিধর্মী কবিতা (lyric poetry)

প্রবল আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাসের প্রত্যক্ষ ও স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ গীতিধর্মী কবিতার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এগুলি সাধারণত ছোট ও সংহত হয়ে থাকে। তবে গীতিধর্মী কবিতা অনেক সময় একক ভাবাবেগের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, তা ভাবানুভূতির নানা পরিবর্তনকেও ধারণ করে। এমন ক্ষেত্রে গীতিধর্মী কবিতা দীর্ঘ ও জটিল রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। প্রবল আবেগময় বলে এ-ধরনের কবিতায় কাব্য-উপকরণের প্রখর ও ব্যাপক ব্যবহার চোখে পড়ে। চমৎকার উপমা ও চিত্রকল্প, অপূর্ব ছন্দমাধুর্য, চিত্তাকর্ষক অন্ত্যমিল এবং গীতল সুরধ্বনি প্রায়শ এই ধরনের কবিতাকে আকর্ষণীয় ও সুষমামণ্ডিত করে। এই ধরনের কবিতা হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে সযত্নচয়িত শব্দ ব্যবহারের ওপর।

ঐতিহ্যের দিক থেকে গীতিকবিতার সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ও অনানুষ্ঠানিক রূপ হচ্ছে সংগীত। সুরধ্বনিময় এ-ধরনের কবিতা রচিত হয় বাদ্যন্ত্রসহকারে গীত হওয়ার জন্যে। আদি রূপের দিক থেকে গান ছিল লোককবিতার একটি বিশেষ শাখা। পরবর্তীকালে অনেক কবি এসব গানকে কাজে লাগিয়ে অনেক ভাবসমুন্নত কবিতা রচনা করেছেন। বিশেষ বিষয় ও অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করেও গান রচিত হয়ে থাকে। প্রার্থনা সংগীত (hymn) ধর্মীয় আবেগকে কেন্দ্র করে রচিত এক ধরনের সমুন্নত সংগীত।

গীতিধর্মী কবিতাকে রূপশ্রেণি বিচারে বেশ কয়েকভাবে ভাগ করা চলে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : ১. স্তোত্র বা ওড, ২.  শোক কবিতা, ৩. সনেট, ৪. পত্রকাব্য ইত্যাদি।

২.১ স্তোত্র বা ওড (ode)

পাশ্চাত্য লিরিক বা গীতিকবিতার অন্তর্ভুক্ত একটি বিশেষ ভাবব্যঞ্জক কবিতা হলো স্তোত্র বা ওড। একে স্তুতি কবিতাও বলা চলে। কারো বা কোনো কিছুর বন্দনা করার জন্যে কিংবা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনো উপলক্ষে রচিত ভাব ও ছন্দোময়, দীর্ঘ অথচ সংহত আবাহনধর্মী গীতিকবিতাকে স্তোত্র বা ওড বলা হয়। স্তোত্র একই সঙ্গে কবিতার রূপ ও রীতিগত বৈশিষ্ট্য নির্দেশক। স্তোত্র সযত্নে রচিত কল্পনাসমৃদ্ধ মহিমাব্যঞ্জক কবিতা। গঠন রূপের দিক থেকে স্তোত্র প্রায় সব ধরনের গীতিকবিতার তুলনায় জটিল-বিন্যস্ত।

ইংরেজি ‘ওড’-এর একটা রূপগত বিশিষ্টতা হচ্ছে তা তিনটি স্তবক বা অংশে বিভক্ত। তা এসেছে মূলত প্রাচীন গ্রিক নাট্য কবিতা থেকে। প্রাচীন সে ‘ওড’ ছিল তিনটি স্তবক সংবলিত এক ধরনের সম্মেলক গান বা কোরাস। কোরাস গায়করা তা বাদ্যযন্ত্রসহকারে গাইত। তারা প্রথম স্তবক গাইত বাঁয়ে ঘুরতে ঘুরতে। একে বলা হতো strophe বা দিক-পরিবর্তন। তারপর তারা দ্বিতীয় স্তবক গাইত ডানে ঘুরতে ঘুরতে। একে বলা হতো anti-strophe বা বিপরীত দিক-পরিবর্তন। তারপর তারা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ভিন্ন সুরে তৃতীয় স্তবক গাইত। একে বলা হতো epode বা স্থিরতা। এ উপস্থাপন-রীতি ছিল উৎসারিত আবেগের ঊর্ধ্বায়ন বা নিম্নায়নের মাত্রাকে জোরালোভাবে প্রকাশের একটি পন্থা। এই রীতির অনুসরণে নাতিদীর্ঘ এমনকি দীর্ঘ স্তোত্রকেও তিনটি স্তবকে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে অবশ্য এই রূপগত বিভাজন অক্ষুণ্ন থাকেনি।

ইংরেজি সাহিত্যে তিন ধরনের ওড দেখা যায় : (ক) পিন্ডারীয়, (খ)  হোরেসীয়, (গ) অনিয়মিত।

(ক) পিন্ডারীয় স্তোত্র : গ্রিক ট্র্যাজেডির কোরাসের সংগীতের পরিবর্তমান স্তবকরীতি অনুসরণে পঞ্চম শতকে কবি পিন্ডার যে দীর্ঘ ভাবগম্ভীর স্তোত্র রচনা করেন তা পিন্ডারীয় স্তোত্র নামে পরিচিত। পিন্ডারের এই স্তোত্রগুলি ছিল আনুষ্ঠানিক এবং তিনি এগুলি রচনা করেছিলেন অলিম্পিক ক্রীড়ার বিজয়ীদের সম্মানে এবং অন্যান্য গণ-অনুষ্ঠান উপলক্ষে।

পিন্ডারীয় স্তোত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা জটিল ত্রিস্তর ছকে বিন্যস্ত। গঠনরূপের দিক থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় স্তবক তথা  স্ট্রোফি ও অ্যান্টিস্ট্রোফি সমচরণবিশিষ্ট ও সমদৈর্ঘ্যরে।

তৃতীয় স্তবক বা ইপোডের চরণসংখ্যা ও গঠনরূপ তা থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। এই জাতীয় ওড নিয়মিত ওড নামেও পরিচিত। ইংরেজি সাহিত্যে মিল্টন, গ্রে, কলিন্স প্রমুখ এই রীতিতে স্তোত্র রচনা করেছেন। এই ধরনের স্তোত্রের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ কলিন্স-এর ‘ওড টু লিবার্টি’।

(খ) হোরেসীয় স্তোত্র : এ ধরনের স্তোত্র পিন্ডারীয় ত্রিস্তবক রীতি অনুসরণ করে না। এগুলি সাধারণত একটি স্তবকবিশিষ্ট হয়ে থাকে। একাধিক স্তবকবিশিষ্ট হলে তাতে একই ধরনের স্তবকের নিয়মিত পুনরাবৃত্তি হয়ে থাকে। এই ধরনের স্তোত্রের বিষয় সমাজ, প্রকৃতি, কিংবা ব্যক্তিবিশেষ। এতে থাকে ক্লাসিক গাম্ভীর্য ও শব্দ-ব্যবহারে থাকে সচেতন সংযম। ইংরেজি সাহিত্যে মার্ভেল-এর ‘হোরাসিয়ান ওড আপন ক্রমওয়েলস রিটার্ন ফ্রম আয়ারল্যান্ড’, কিটস্-এর ‘ওড টু এ নাইটিঙ্গেল’, ‘ওড অন এ গ্রিসিয়ান আর্ন’, ‘ওড টু অটাম’, কোলরিজের ‘ওড টু ফ্ল্যান্স’ ইত্যাদি হোরেসীয় ওডের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।

(গ) অনিয়মিত স্তোত্র : এই ধরনের স্তোত্র পিন্ডারীয় স্তোত্রের স্টোফি, অ্যান্টিস্টোফি ও এপোড নামের তিন স্তবক-বিভাজন অনুসরণ করে না কিংবা হোরেসীয় স্তোত্রের মতো স্তবকের পুনরাবৃত্তি মেনে চলে না। এই ধরনের স্তোত্রে সংখ্যা কিংবা  দৈর্ঘ্য উভয় ক্ষেত্রেই স্তবক-কাঠামোর ইচ্ছামতো পরিবর্তন ঘটতে পারে। ইংরেজি সাহিত্যে ড্রাইডেনের ‘আলেকজান্ডার্স ফিস্ট’, ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘ওড অন দি ইন্টিমেশন্‌স্‌ অব ইম্মরট্যালিটি’, টেনিসনের ‘ওড অন দ্য ডেথ অব দি ডিউক অব ওয়েলিংটন’, কোলরিজের ‘ডিজেকশন : এন ওড’ অনিয়মিত স্তোত্রের উদাহরণ।

উনিশ শতকের শেষ দিকে ইংরেজি ওড-এর অনুসরণে বাংলা সাহিত্যে কিছু ওড-জাতীয় কবিতা রচিত হয়েছে। এই ধারার অনুবর্তন বিশ শতকেও চলে এসেছে। বিহারীলালের ‘সারদামঙ্গল’ ও ‘বঙ্গসুন্দরী’কে স্তোত্র কবিতার পর্যায়ভুক্ত করা চলে। ব্রজাঙ্গনা কাব্যে মধুসূদন পাশ্চাত্য ওডের রূপবৈচিত্র্যকে ধারণ করেছেন। বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক স্তোত্র রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ‘উর্বশী’, ‘ছবি’, ‘বসুন্ধরা’, ‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘বর্ষশেষ’, ‘শাজাহান’, ‘পৃথিবী’ বাংলা স্তোত্র কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘মাতৃস্তুতি’, মোহিতলাল মজুমদারের ‘নারীস্তোত্র’, অক্ষয়কুমার বড়ালের ‘মানব বন্দনা’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘নমস্কার’ প্রভৃতি স্তোত্র কবিতা হিসেবে উল্লেখের দাবি রাখে।

আধুনিক বাঙালি কবিদের রচনায়ও স্তোত্র কবিতার ভাব ও রীতির প্রকাশ লক্ষ করা যায়। বুদ্ধদেব বসুর ‘কঙ্কাবতী’, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘ক্রেসিডা’, বিষ্ণু দে-র ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’ ওড জাতীয় রচনা।

২.২. শোককবিতা (elegy)

মৃতের জন্য আর্তি বা শোকবিধুরতাকে প্রকাশ করে লেখা এক ধরনের গীতিকবিতা। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘এলিজি’ (elegy), এসেছে গ্রিক elegeia থেকে, যার অর্থ শোক করা। সাধারণত কোনো বন্ধু, সুহৃদ, আত্মীয় বা বিশিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যুজনিত বিষাদ কিংবা ব্যক্তিগত দুঃখবেদনা অবলম্বনে শোককবিতা রচিত হয়। ব্যাপক অর্থে সমাজ ও জাতির সংকট এবং বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটেও শোককবিতা রচিত হতে পারে। স্মৃতিচারণ কিংবা স্মরণমূলক স্তুতিবাচনও এই ধরনের কবিতায় দেখা যায়। প্রাচীন গ্রিক ও লাতিন সাহিত্যে মৃত, প্রেম, যুদ্ধ এমনকি তথ্য উপস্থাপন নিয়েও এলিজি লেখা হতো। আবার ধ্রুপদী সাহিত্যে এলিজি বলতে সে-ধরনের কবিতাকে বোঝাতো যা বষবমরধপ ছন্দে রচিত হতো। ইংরেজি সাহিত্যে এলিজাবেথীয়রা প্রেমের কবিতা হিসেবে বিশেষ করে অভিমান-অনুযোগ প্রকাশে এই ধরনের কবিতা রচনা করেছেন। সতেরো শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত ইংরেজি সাহিত্যে এলিজি বলতে যুগপৎ প্রেমের কবিতা ও শোকের কবিতা বোঝাত। এরপর থেকে এলিজি বলতে মূলত শোককবিতাই বোঝায়।

এলিজি ব্যক্তিগত বন্ধু কিংবা বিশিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যুজনিত শোকের অভিব্যক্তি হিসেবে রচিত হতে পারে। ইংরেজি সাহিত্যে এই ধরনের কবিতার উল্লেখযোগ্য উদাহরণের মধ্যে রয়েছে : জন মিল্টনের ‘লিসিডাস’ (আইরিশ সমুদ্রে বন্ধু এডওয়ার্ড কিং-এর মৃত্যুতে), শেলির ‘আ্যাডোনেইস’ (কবি জন কিটসের মৃত্যুতে), লর্ড টেনিসনের ‘ইন মেমোরিয়াম’ (বন্ধু আর্থার হ্যালামের মৃত্যুতে), ওয়াল্ট হুইটম্যানের ‘হোয়েন লাইলাক্স্‌ লাস্ট ইন দ্য ডোরইয়ার্ড বুম্ড্’ (আব্রাহাম লিংকনের মৃত্যুতে)।

বাংলা সাহিত্যে এ-ধরনের শোককবিতার উদাহরণ বিহারীলাল চক্রবর্তীর ‘বন্ধুবিয়োগ’, গোবিন্দ দাসের ‘বঙ্কিম বিদায়’, (অক্ষয় কুমার বড়ালের এষা স্ত্রী-বিয়োগে), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্মরণ’ (স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুতে), নজরুল ইসলামের ‘চিত্তনামা’ (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুতে)।

এলিজির মাধ্যমে প্রয়াত সাহিত্যিকদের গুণাবলি বর্ণনার পাশাপাশি যদি তাঁর সাহিত্যকর্মের সৌন্দর্যবিচার করা হয় তবে তাঁকে সমালোচনামূলক শোককবিতা বলা চলে। ইংরেজি সাহিত্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর্নল্ডের ‘হেইনেজ গ্রেইভ’ এবং স্যার উইলিয়াম ওয়াটসনের ‘ওয়ার্ডসওয়ার্থস গ্রেইভ’।

বাংলায় এ-ধরনের শোককবিতার উদাহরণ হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মধুসূদনের স্বর্গারোহণ’ ও ‘বিদ্যাসাগর’, নবীনচন্দ্র সেনের ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’, রবীন্দ্রনাথের ‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’, নজরুলের ‘গোকুল নাগ’ ও ‘রবিহারা’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুতে), সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পাথরের ফুল’ (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে) ইত্যাদি।

আর একধরনের শোককবিতা আছে। একে বলা হয় রাখালিয়া শোককবিতা। এ-ধরনের কবিতায় রাখালিয়া চিত্রকল্প প্রধান হয়ে ওঠে, কবিতার ভাষা হয় ভাবগম্ভীর এবং কোনো বন্ধু বা বিশিষ্ট ব্যক্তির বিয়োগব্যথা কবিতার মূল বিষয় হিসেবে গণ্য হয়। প্রয়াত ব্যক্তির স্মরণে রাখাল তথা মেষপালকের মুখে বেদনাঘন ভাষা প্রযুক্ত হতো। প্রয়াত ব্যক্তি ও শোকসন্তপ্ত কবি উভয়েই চিত্রিত হতেন মেষপালক রূপে। পরিবেশও অঙ্কিত করা হয় রাখালিয়া। মিন্টনের ‘লিসিডাস’ এ-ধরনের কবিতার বিশিষ্ট উদাহরণ। এর মাধ্যমে এই ধরনের কবিতার প্রচলিত গঠনরীতি সম্পর্কে ধারণা করা যাবে : কবিকল্পনার অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে আবাহন, মেষপালকের মৃত্যুতে সমগ্র প্রকৃতির বিলাপ, শোকপালনকারীদের মিছিল,  দৈবী প্রজ্ঞা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন, বিচিত্র ফুলশোভিত মৃতের শবাধারের বর্ণনা, অনিবার্য পরিণতি মেনে নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা প্রদান, সমস্ত দুঃখ-বেদনার লক্ষ্য মঙ্গলময় পরিণতি – এমনি খ্রিষ্টীয় আস্তিক্যবাদে কবিতার পরিসমাপ্তি। এ-ধরনের কবিতায় গঠনগত রূপভিন্নতাও কিছু কিছু দেখা যায়। অনেক কবিতায় মেষপালকের মধ্যে কবিরই প্রতীকী রূপায়ণ ঘটে। রাখালিয়া শোককবিতার উদ্ভাবক গ্রিক কবি বিয়োন। বিয়োনের ‘ল্যামেন্ট ফর অ্যাডোনিস’, শেলির ‘অ্যাডোনিস’, স্পেন্সারের ‘অনাস্ট্রাফেল’, আর্নল্ডের ‘থেরসিস’ রাখালিয়া শোককবিতার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

সাধারণ শোকাবহ ঘটনা নিয়েও শোককবিতা রচিত হতে পারে। একে বলা যেতে পারে সাধারণ শোককবিতা। এ-ধরনের শোককবিতা কোনো ব্যক্তিবিশেষের মৃত্যুতে শোকার্ত আবেগ প্রকাশে সীমিত থাকে না, বরং সার্বিকভাবে বিষাদঘন ভাবগম্ভীর ও চিন্তামূলক ধরনের হয়ে থাকে। ইংরেজি সাহিত্যে টমাস গ্রে-র ‘এলিজি রিটেন ইন এ কান্ট্রি চার্চইয়ার্ড’ এ-ধরনের শোককবিতার উজ্জ্বল নিদর্শন। এতে কবি কোনো ব্যক্তিবিশেষের মৃত্যুতে শোকবিহ্বলতা প্রকাশ করেননি, জীবন, মৃত্যু ও ভাগ্য নিয়ে কথা বলেছেন। অখ্যাত পল্লির খ্যাতিহীন, কীর্তিহীন, নামহীন সাধারণ অধিবাসীদের উদ্দেশে শোককবিতা রচনা করে তিনি সাধারণভাবে মৃত্যুর অনিবার্যতা ও মানবজীবনের নশ^রতার দিকটি তুলে ধরেছেন। ইংরেজি সাহিত্যে এটি একটি বিখ্যাত শোককবিতা এবং সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা।

২.৩ সনেট (sonnet) বা চতুর্দশপদী কবিতা

মন্ময় বা গীতিকবিতার একটি বিশিষ্ট রূপশ্রেণি হচ্ছে সনেট। চোদ্দো বা আঠারো অক্ষরবিশিষ্ট এবং বিশেষ ছন্দোরীতিতে রচিত চোদ্দো লাইনের গীতিকবিতাকে বলা হয় সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা। এটি গীতিকবিতার বিশেষ ধরনের রূপশ্রেণি। সনেট শব্দটি এসেছে ইতালীয় ‘সননেতো’ (sonneto) শব্দ থেকে। এর অর্থ মৃদু ধ্বনি। ত্রয়োদশ শতকে ইতালিতে এর জন্ম। চতুর্দশ শতকে ইতালীয় কবি পেত্রার্ক সনেটের গঠনশৈলীর যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধন করেন। তখন থেকে তা পেত্রার্কীয় সনেট নামে অভিহিত হতে থাকে। পরবর্তীকালে তা স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে প্রবর্তিত হয়। ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে ইংরেজ কবি স্যার টমাস ওয়াট পেত্রার্কীয় সনেটের ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং নিজেও বেশ কিছু সনেট রচনা করেন। এই সময় ইংরেজ কবি আর্ল অব সারে সনেটের রূপগত কিছু পরিবর্তন ঘটান। পরে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের হাতে সনেটের আরো রূপগত পরিবর্তন ঘটে।

পাশ্চাত্য সনেটের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পঙ্ক্তিমিল যোজনা। কিন্তু কেবল মিল যোজনার ওপর সনেটের সার্থকতা নির্ভর করে না। ভাবকল্পনাকে সুসংহতভাবে চোদ্দো পঙ্ক্তির মধ্যে উন্নত ছন্দোবন্ধের সাহায্যে প্রকাশ করার মধ্যেই সনেটের সার্থকতা নির্ভরশীল।

রূপরীতির দিক থেকে সনেট দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত : (ক) পেত্রার্কীয় বা ইতালীয়, (খ) শেক্সপিয়ারীয় বা ইংরেজি।

(ক) পেত্রার্কীয় সনেট : এই ধরনের সনেটের গঠনগত বিশিষ্টতা হচ্ছে এর চোদ্দো পঙ্ক্তি দুই ভাগে বিভক্ত। আট পঙ্ক্তি সংবলিত প্রথম স্তবককে বলা হয় অষ্টক (octave)। এই অংশে থাকে ভাবের প্রস্তাবনা, প্রবাহ বা ভাবসংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন। অষ্টকের আট পঙ্ক্তি আবার দু-ভাগে বিভক্ত। চার পঙ্ক্তি সংবলিত প্রতিটি ভাগের নাম চতুষ্ক (quatrain)। ছয় পঙ্ক্তিবিশিষ্ট দ্বিতীয় অংশকে বলা হয় ষটক (sestet)। ষটক আবার তিন পঙ্ক্তি সংবলিত দুটি ত্রিপদিকায় (tercet) বিভক্ত। ষটক অংশে প্রস্তাবনাকে বিশদ করে উপসংহার টানা হয় কিংবা অষ্টকে উত্থাপিত প্রশ্নের সমাধান নির্দেশ করা হয়। সব মিলিয়ে একটিমাত্র অখণ্ড ভাবকল্পনাকে গাঢ় ও সংহত রূপবন্ধে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। সমগ্র সনেটে অখণ্ড ভাব প্রকাশিত হলেও অষ্টক ও ষটকে কিছুটা ভাববৈচিত্র্য ঘটতে পারে।

পেত্রার্কীয় সনেটে অন্ত্যমিলের বিন্যাসের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলা হয়। অষ্টকের পঙ্ক্তিমিলের ছক এরকম : ক খ খ ক ক খ খ ক। অন্ত্যমিলের এই ছকের ব্যতিক্রম দেখা যায় না। তবে ষটকের অন্ত্যমিলে কিছুটা স্বাধীনতা থাকে। যেমন, গ ঘ ঙ গ ঘ ঙ কিংবা গ ঘ গ ঘ গ ঘ। তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, শেষ দুটি চরণে কোনো রকম অস্ত্যমিল থাকে না।

(খ) শেক্সপিয়ারীয় সনেট : শেক্সপিয়ারীয় সনেটের গঠন-বৈশিষ্ট্য পেত্রার্কীয় সনেটের চেয়ে ভিন্নতর। এ-ধরনের সনেটে কবিতার চোদ্দো লাইনকে চারটি স্তবকে বিভক্ত করা হয়। প্রথম বারোটি লাইন গঠিত হয় চার লাইনের তিনটি স্তবক বা চতুষ্ক (quatrain) মিলে। প্রতিটি চতুষ্কে অযুগ্ম সংখ্যক পঙ্ক্তির সঙ্গে অযুগ্ম সংখ্যক পঙ্ক্তির এবং যুগ্ম সংখ্যক পঙ্ক্তির সঙ্গে যুগ্ম সংখ্যক পঙ্ক্তির অন্ত্যমিল হয়ে থাকে। তিনটি চতুষ্কের অন্ত্যমিল সাধারণত এরকম : কখ কখ গঘ গঘ ঙচ ঙচ। শেষ দুটি পঙ্ক্তি উপসংহারমূলক এবং এগুলি পরস্পর মিলযুক্ত। এর ধরন এরকম : ছছ। এ-ধরনের মিল পেত্রার্কীয় সনেটে দেখা যায় না।

শেক্সপিয়ারীয় সনেটের কিছুটা জটিলতর রূপ দেখা যায় এডমন্ড স্পেন্সারের নামাঙ্কিত স্পেন্সারীয় (Spenserian) সনেটে। শেক্সপিয়রীয় সনেটের মতোই এতে তিনটি চতুষ্ক ও একটি দ্বিপদী (couplet) থাকে। তবে এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চতুষ্কগুলিতে অন্ত্যমিলগত যোগসূত্র থাকে। অর্থাৎ প্রথম চতুষ্কের দ্বিতীয় অন্ত্যমিলটি দ্বিতীয় চতুষ্কের প্রথম অন্ত্যমিল হয় এবং দ্বিতীয় চতুষ্কের দ্বিতীয় অন্ত্যমিল তৃতীয় চতুষ্কের প্রথম অন্ত্যমিল হয়। অন্ত্যমিলের ছক তুলনা করলে এটি স্পষ্ট হবে :

শেক্সপিয়রীয়     : abab cdcd efef

স্পেন্সারীয়        : abab bcbc cdcd ee

স্পেন্সারীয় সনেট খুব বেশি দেখা যায় না। আধুনিককালে ইংরেজি সাহিত্যে রিচার্ড উইলবার এই রীতিতে লিখেছেন ‘Praise in Summer’।

কোনো কোনো কবি পেত্রার্কের অনুসরণে একটিমাত্র ভাবের আধারে এবং ভাবপরম্পরা বজায় রেখে একাধিক সনেটের মালা রচনা করেছেন। এগুলি সনেটগুচ্ছ (sonnet sequence) নামে পরিচিত। ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত সনেটকাররা হলেন ফিলিপ সিডনি, এডমন্ড স্পেন্সার, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, জন ডান, জন মিলটন, উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ, জন কিটস, ডি-জি রসেটি, উইলিয়াম মেরিডিথ, ডব্লিউ. এইচ. অডেন, জিওফ্রি হিল। মার্কিন লেখকদের মধ্যে হেনরি লংফেলো, কামিংস, রবার্ট ফ্রস্ট, বেরিম্যান প্রমুখ শ্রেষ্ঠ সনেট রচয়িতা হিসেবে খ্যাত। গুচ্ছ সনেটের উল্লেখযোগ্য উদাহরণের মধ্যে রয়েছে শেক্সপিয়রের ‘sonnet’, ফিলিপ সিডনির Astrophil and Stella, স্পেন্সারের Amoretti রসেটির The House of Life, এলিজাবেথ বেরেট ব্রাউনিংয়ের Sonnets from the Portuguese, জর্জ মেরেডিথের Modern Love ইত্যাদি।

বাংলা সাহিত্যে সনেটের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি তাঁর সনেটের নাম দেন চতুর্দশপদী কবিতা। ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত তাঁর চতুর্দশপদী কবিতাবলী গ্রন্থে ১০২টি সনেট সংকলিত হয়। ইতালীয় সনেটকার পেত্রার্ক, ফরাসি কবি পিয়েরে দ্য বসার্ড ও জোয়াশিম দ্য বেলে, ইংরেজ কবি শেক্সপিয়র ও মিল্টন প্রমুখের সনেট পড়ে তিনি সনেট রচনায় উদ্বুদ্ধ হন। সনেট রচনায় তিনি পেত্রার্কীয় ও শেক্সপিয়রীয় উভয় রীতিই অনুসরণ করলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বকীয়তারও পরিচয় রেখেছেন। তাঁর অনেক সনেটে মিল্টনের প্রভাব লক্ষ করা যায় – বিশেষত পঙ্ক্তি মিলের ক্ষেত্রে। মধুসূদন সনেটের মধ্যেই যেমন পেত্রার্ককে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন তেমনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কবিদের স্মরণ করেছেন। অন্ধকার রাত্রি, মৃত্যু, হিন্দু প্রথা ইত্যাদি যেমন তাঁর সনেটের বিষয় হয়েছে তেমনি ছেলেবেলার ধাত্রীসম কপোতাক্ষ নদ, গ্রাম্য উৎসব-অনুষ্ঠান, দেশের অতীত গৌরব ও বর্তমান দুর্দশা ইত্যাদি নিয়ে তাঁর অন্তরের একান্ত ভাবস্পন্দন ও আবেগ-অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। তাঁর ব্যক্তিমনের বেদনাময় আকুলতা ও

ভাব-বিহ্বলতা কখনো কখনো রূপায়িত হয়েছে সনেটের রূপকল্পে।

দেবেন্দ্রনাথ সেন ও অক্ষয়কুমার বড়াল পেত্রার্কীয় ও শেক্সপিয়রীয় রীতিকে গ্রহণ করে যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে সনেট রচনা করেন। দেবেন্দ্রনাথের রোমান্টিক সনেটে পাওয়া যায় রঙের বৈচিত্র্য ও মাধুর্য, সেইসঙ্গে সুরের মূর্ছনা। পক্ষান্তরে অক্ষয়কুমার বড়ালের সনেট কিছুটা ধ্রুপদী ধরনের, তাতে ফুটে ওঠে শান্ত সমাহিত ভাব। সনেট রচনায় তাঁর সচেতনতা ও দক্ষতাও চোখে পড়ে।

রবীন্দ্রনাথ সনেটের কাঠামো ও ভাবসংহতির দ্বারা আকৃষ্ট হলেও মিলযোজনা পদ্ধতিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। তিনি যেমন প্রচুর সনেট রচনা করেছেন তেমনি অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিদেশি সনেটের ব্যাকরণ হুবহু মান্য করেননি।

মিলযোজনার ক্ষেত্রে তিনি অনেক বেশি স্বাধীনতা নিয়েছেন। চৈতালি কাব্যে অন্ত্যমিলযুক্ত সাতটি দ্বিপদী যোগে সনেট রচনা করেছেন তিনি। নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থে ধ্রুপদী রীতি সচেতনভাবে পরিহার করেছেন। বাংলা সনেটের ক্ষেত্রে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ ব্যবহারই ছিল প্রচলিত রীতি। রবীন্দ্রনাথ সনেট রচনায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দের পরীক্ষা যেমন করেছেন (পাবনায় বাড়ি হবে, গাড়ি গাড়ি ইট কিনি, ‘খাপছাড়া’), তেমনি স্বরবৃত্ত ছন্দেরও পরীক্ষা করেছেন (‘অন্ধকারের সিন্ধুতীরে একলাটি ওই মেয়ে’ – ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘ছড়ার ছবি’, ‘ফসল কাটা হলে সারা মাঠ হয়ে যায় ফাঁকা’ – ১৮-সংখ্যক কবিতা, আরোগ্য)। দুটি স্তবকে সাত-সাতটি পঙ্ক্তির সনেটও তিনি রচনা করেছেন (‘মালা হতে খসে-পড়া ফুলের একটি দল’ – ৩৪-সংখ্যক কবিতা, গীতালি)। রবীন্দ্রনাথের শেষদিকের রচনায় মিলহীন চতুর্দশপদী কবিতাও পাওয়া যায়। উদাহরণ : প্রান্তিক কাব্যের ৩-সংখ্যক কবিতা (‘এ জন্মের সাথে লগ্ন’), আরোগ্য কাব্যের ৮-সংখ্যক কবিতা (‘একা বসে সংসারের প্রান্ত জানালায়’), জন্মদিন কাব্যের ২৩-সংখ্যক কবিতা (‘জীবনবহন ভাগ্য নিত্য আশীর্বাদে’)। ‌

কামিনী রায়ের অশোক সঙ্গীত ও জীবনপথে কাব্যগ্রন্থে বেশ কিছু ভালো সনেট আছে। এসব সনেটে কবির রচনারীতির সারল্য ও আবেগের অকৃত্রিমতার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে সনেট রচনার ক্ষেত্রে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সনেটে ফরাসি সনেটকারদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এ-ধরনের সনেটে অষ্টক পেত্রার্কীয় রীতি অনুসারী কিন্তু ষটক শুরু হয় দ্বিপদী দিয়ে। ফলে সনেটের স্তবক বিন্যাস দাঁড়ায় এরকম : প্রথমে দুটি চতুষ্ক, এরপর একটি দ্বিপদী, শেষে একটি চতুষ্ক। মিলযোজনার ছক দাঁড়ায় এরকম : কখখক কখখক গগ ঘঙ ঘঙ। এ-ধরনের সনেট রচনায় প্রমথ চৌধুরী যথেষ্ট দক্ষতা ও কুশলতা প্রদর্শন করেছেন। শব্দচয়নের নৈপুণ্য ও ভাবের সংযত প্রবাহ প্রমথ চৌধুরীর সনেটের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। মোহিতলাল মজুমদার বেশ কিছু চমৎকার সনেট রচনা করেন। ক্লাসিক্যাল গঠনশিল্প, ভাবকল্পনার সংযত ও সংহত বিন্যাস তাঁর সার্থক সনেটগুলির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতীয়মান।

আধুনিক কবিরাও সনেট রচনায় আগ্রহ দেখিয়েছেন। কেউ কেউ এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালিয়েছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সনেটের ভাবসমুন্নতি লক্ষণীয়। জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের বেশির ভাগই সনেট। জীবনানন্দ সনেটের পর্ববিভাগ, মাত্রা বিন্যাস ও পঙ্ক্তিমিল নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর সনেটে প্রচলিত রীতির বাইরে আঠারো, কুড়ি এমনকি ততোধিক অক্ষরের পঙ্ক্তি রচনার প্রয়াস লক্ষণীয়। বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, দিনেশ দাস, অরুণ মিত্র, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখও সনেট রচনায় অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশে সনেট রচনার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন আবদুল কাদির, শাহাদত হোসেন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ। সৈয়দ শামসুল হক সনেটে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের সম্ভাবনা পরীক্ষা করেছেন।

২.৪ পত্রকাব্য বা লিপিকবিতা (verse epistle)

পত্রকবিতা বা লিপিকবিতা একধরনের গীতিকবিতা। দূরের কোনো প্রিয়জন বা অনুরাগী, কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে কবিতার আদলে লেখা পত্রই পত্রকাব্য বা লিপিকবিতা হিসেবে বিবেচ্য। এই বিশেষ ধরনের কবিতার আদিস্রষ্টা রোমক কবি হোরেস।

সাহিত্যের ইতিহাসে পত্রকাব্যের দুটো প্রধান রূপ দেখা যায়। একটির উপজীব্য নৈতিক, দার্শনিক বা তান্ত্রিক বিষয়। এর আদিমতম নিদর্শন হচ্ছে হোরেসের epistles।

রেনেসাঁসের যুগে ড্রাইডেন, কনগ্রিভ প্রমুখ কবি এই ধারায় পত্রকাব্য রচনা করেছিলেন। বেন জনসনের Epistle to Elizabeth, Countess of Rutland,, আলেকজান্ডার পোপের Epistle to Arbuthnot ইংরেজি সাহিত্যে এই ধারার পত্রকাব্যের চমৎকার নিদর্শন। পরবর্তীকালে এ-জাতীয় পত্রকাব্যের উদাহরণ অডেনের ঘবি New Year Letter ও লুইস ম্যাকনিসের Letters from Island  ইত্যাদি।

অন্য ধারার পত্রকাব্যের উপজীব্য রোমান্টিক উচ্ছ্বাসময় ভাবুকতা। এর আদিমতম নিদর্শন ইতালীয় কবি ওভিদ-এর ‘হেরোইদস’ (Heroids)। এটি ছিল পুরাণ বা লোককথায় উল্লিখিত নায়িকাদের পক্ষ থেকে তাদের পতি বা প্রেমিকদের উদ্দেশে পত্রাকারে লেখা কবিতা। সপ্তদশ শতকের ইংরেজ কবি ডান পত্রকাব্য রচনায় ওভিদের হেরোইদসকে অনুসরণ করেছিলেন। মাইকেল ড্রেইটনের ‘England’s Heroical Epistles’ এবং আলেকজান্ডার পোপের ‘Elioisa to Abelard’ ওভিদীয় ধারার পত্রকাব্যের নিদর্শন।

ওভিদের হেরোইদস-এর আদর্শে ও অনুকরণে রচিত মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্য বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রকাব্য এবং এই ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এতে আছে ১১টি পূর্ণপত্রসহ কয়েকটি অসমাপ্ত পত্র। প্রতিটি পত্রের লেখিকা পৌরাণিক ও মহাকাব্যিক নায়িকা। এরা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্রভাবে সংলাপের মাধ্যমে তাদের আবেগ, অনুরাগ, অভিযোগ, হতাশা, ক্ষোভ, কামনার জীবন্ত অভিব্যক্তি ঘটিয়েছে স্ব-স্ব পত্রকাব্যে। এসব পত্রকাব্যে প্রত্যেক নারীর জীবনে প্রেমের বহুবিচিত্র এক-একটি রূপ যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি আধুনিক জীবনদৃষ্টি ও মানবিকতায় প্রতিটি চরিত্র হয়ে উঠেছে সজীব। অপূর্ব কবিকল্পনায় এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের ঘনপিনদ্ধ গঠনকে কাজে লাগিয়ে মধুসূদন যে অপরিসীম কুশলতায় নায়িকাদের হৃদয়াবেগকে প্রকাশ করেছেন তা অভিনব ও সার্থক।

পত্রাকারে লেখা হলেও নায়িকারা একক সংলাপ বা মনোকথনের মাধ্যমে যে উৎরোল ভাবাবেগ, মন্দ্রিত আত্মোৎসারণ ও উচ্ছ্বসিত বেদনার অভিব্যক্তি ঘটিয়েছে তাতে লিপিগুলিকে নাটকীয় একোক্তি (dramatic monologue) বলে গণ্য করা চলে। বাংলা সাহিত্যে পত্রকবিতার অন্যান্য নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজকুমার নন্দী-রচিত ‘বীরাঙ্গনা পত্রোত্তর’, রবীন্দ্রনাথে ‘শিলঙের চিঠি’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পুরীর চিঠি’, রাধারাণী দেবীর ‘পরিণীতার পত্র’ ইত্যাদি।

৩. নাট্যধর্মী কবিতা (dramatic poetry)

নাট্যধর্মী বা নাট্যিক কবিতা কথাটি সীমিত অর্থে কবিতায় ব্যবহৃত নাটকীয় রূপ কিংবা নাটকীয় কৌশলকেই বোঝায়। এর অন্যতম উদাহরণ নাটকীয় একোক্তি (dramatic monologue)। কবিতায় সংলাপ, একোক্তি, তেজোদীপ্ত শব্দাবলি, অমিত্রাক্ষর ছন্দ ইত্যাদির ব্যবহারের ফলে কিংবা উত্তেজনা-উৎকণ্ঠা ও আবেগময় দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ টান টান পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কবিতা নাটকীয় গুণসম্পন্ন হয়ে ওঠে। নাটকীয় উপাদানের উপস্থিতির কারণেই ইংরেজ কবি ব্রাউনিং তাঁর Bells and Pomegranates-এর তৃতীয় খণ্ড সম্পর্কে ‘dramatic lyrics’ বা নাটকীয় গীতিকবিতা উপশিরোনামটি ব্যবহার করেছিলেন। অবশ্য নাট্যিক কবিতা কথাটির পরিসর এত ব্যাপক যে এতে সহজেই শেক্সপিয়রের The Tempest নাটকটিকে অন্তর্ভুক্ত করা চলে, যেটিকে আরো যথাযথভাবে অভিহিত করলে কাব্যনাটক বলাই সংগত হবে। শুধু তাই নয়, নাট্যিক কবিতার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে রবার্ট ব্রাউনিংয়ের Pippa Passes যাকে সাধারণভাবে বলা হয় পাঠ্য নাটক (closet drama)।

নাট্যধর্মী কবিতা সাহিত্য-শিল্পের সেই প্রজাতি যেখানে কবি মন্ময় কবিতার মতো নিজেই নিজের কথা ব্যক্ত করেন না, কিংবা আখ্যানমূলক কবিতার মতো নৈর্ব্যক্তিকভাবে কাহিনি বর্ণনা করেন না। এ-ধরনের কবিতায় তিনি চরিত্রের মাধ্যমে নিজের কথাকে ব্যক্ত করেন। এদিক থেকে নাট্যধর্মী কবিতা সরাসরি কবির ভাব-ভাবনাকে প্রত্যক্ষভাবে অভিব্যক্তি দেয় না। বরং সংলাপ, চরিত্র, দৃশ্য, পরিবেশ ইত্যাদি নাটকীয় উপাদানের সাহায্যে কবির ভাবনা পরোক্ষভাবে ব্যক্ত হয়।

নাট্যধর্মী কবিতার রূপশ্রেণির মধ্যে পড়ে – ১. কাব্যনাট্য ও ২. নাটকীয় একোক্তি।

৩.১ কাব্যনাট্য (Poetic drama)

সাধারণভাবে সম্পূর্ণ বা প্রধানত কাব্যে রচিত অভিনয়-উপযোগী নাটক কাব্যনাটক হিসেবে পরিচিত। এ-ধরনের নাটকের চরিত্রের সংলাপ ছন্দোময় কবিতায় উচ্চারিত হয়। এদিক থেকে কবিতায় রচিত যথার্থ নাটকই কাব্যনাট্য হিসেবে গণ্য।

সূক্ষ্ম অর্থে কাব্যনাট্য ও নাট্যকবিতা সমার্থক নয়। নাট্যকাব্য বা নাট্যকবিতা মূলত নাট্যগুণসম্পন্ন কবিতা। এ-ধরনের কবিতা সংলাপনির্ভর। তবে এগুলি মঞ্চায়নের উপযোগী বলে বিবেচিত হয় না। এর উদাহরণ পাঠ্য নাটিকা (closet drama) রবীন্দ্রনাথের চিত্রা কাব্যগ্রন্থের ‘আবেদন’, ‘সতী’, ‘নরকবাস’, ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ ইত্যাদি সংলাপনির্ভর কবিতা বা নাট্যকবিতা। তাঁর কর্ণকুন্তী সংবাদও এ-ধরনের রচনা।

মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশের পাশাপাশি আধুনিককালে কাব্যকলা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নতুন আঙ্গিক-অন্বেষার প্রেক্ষাপটে কাব্যনাট্যের জন্ম। এর পটভূমিতে রয়েছে গাদ্যিক বাস্তববাদী নাট্যকলার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টা। সাহিত্যের এই রূপশ্রেণিতে কবি ও নাট্যকাব্যের দ্বৈতভূমিকার মেলবন্ধন ঘটে। কাব্যনাটক একাধারে যুগপৎ কবিতা ও নাটক হলেও এই আঙ্গিকে নাটকের চেয়ে কবিতার ভূমিকাই প্রধান। এটি মূলগতভাবে কবিতারই এক নতুন আঙ্গিকগত প্রকরণ – দৃশরূপে ব্যক্ত কবিতারই এক নতুন রূপশ্রেণি।

কাব্যনাট্য নাট্যকাব্যের মতো নাটকের আঙ্গিকে কবিতা নয়। একে কবিতার আঙ্গিকে নাটকও ঠিক বলা চলে না। বহিরঙ্গে কাব্যনাট্য নাটক হলেও এর বিশিষ্টতা কাব্যগুণে। নাট্যকাব্যে নাটক ও কবিতা অবিচ্ছেদ্যভাবে পরস্পর সংগ্রথিত। তবে নাটকের তীব্র গতিময়তা ও নাট্যিক উৎকণ্ঠা এ-ধরনের নাটকে প্রধান হয়ে ওঠে না। অন্যদিকে কবিতার ক্ষেত্রে এখানে নতুন প্রত্যাশা যুক্ত হয়। কবিতাকে কেবল আবৃত্তিযোগ্য হলে চলে না, তাকে দৃশ্যরূপে উদ্ভাসিত হওয়ার যোগ্যও হতে হয়। এভাবে নাটকের অবদমিত তীব্র গতি ও উৎকণ্ঠা পূরণে এগিয়ে আসে কবিতার অনুভবযোগ্য দৃশ্যমান অভিব্যঞ্জনা।

কাব্যনাট্য নাট্যগুণ ও কাব্যগুণ মিলিয়ে আধুনিক মানুষের ব্যক্তিজীবনের অন্তর্লোকের দ্বন্দ্ব-সংঘাতজনিত ক্ষতের অনুভবের রূপায়ণ-প্রয়াসী। এদিক থেকে কাব্যনাট্যকারের প্রধান কাজ চরিত্রের অন্তর্লোকের রূপায়ণ। এ-ধরনের নাটকে কাব্যনাট্যকার পুরোপুরি নৈর্ব্যক্তিক বা নিরাসক্ত থাকেন না, প্রায়শ চরিত্রের মধ্যে তাঁর প্রবল উপস্থিতি চোখে পড়ে। এদিক থেকে কাব্যনাটক এক ধরনের অন্তর্নাটক – যা নাট্যকারের অন্তর্চেতনা প্রকাশে ব্রতী।

ইংরেজি সাহিত্যে কাব্যনাটকের তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা, নাট্যরচনায় এর কুশলী প্রয়োগ ও বিশেষ পরিণতিময় বিকাশ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন টি. এস. এলিয়ট। এলিয়টের মতো গদ্য নাটক সাময়িক ও বহির্বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে; আর কাব্যনাটকে রূপায়িত হয় মানবজীবনের স্থায়ী ও চিরন্তন বিষয়। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ – এই ত্রিস্তর কালপর্যায়ে অবাধে যাতায়াত করতে পারে কেবল কাব্যনাট্য। এলিয়টের মতে, দৈনন্দিন বাস্তবতা কাব্যনাট্যের বিষয় হতে পারে। তবে সেেেক্ষত্রে বহির্বাস্তবতা ও বহির্সত্যের চেয়ে অন্তর্বাস্তবতা ও অন্তর্সত্যের স্বরূপই রূপায়িত হওয়া প্রয়োজন। এলিয়টের কাব্যনাট্যেও দেখা যায় সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা সেগুলিতে প্রধান নয়, প্রধান হয়ে উঠেছে অন্তর্গত বাস্তবতা। মার্ডার ইন দ্য ক্যাথেড্রালে বেকেটের নিজের সঙ্গে নিজের অন্তর্দ্বন্দ্বই প্রধান। দ্য ফ্যামিলি রিইউনিয়নে প্রধান হয়ে উঠেছে হ্যারির অপরাধবোধের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা। দ্য এলডার স্টেটসম্যানে পরিস্ফুট হয়েছে লর্ড ক্লেভারটনের মারাত্মক শূন্যতাবোধ ও আতঙ্কবিহ্বল মনোবাস্তবতা। এলিয়ট কাব্যনাট্যের ভাষা হিসেবে কবিতাকে এই অর্থে বিশেষ উপযোগী মনে করেছেন যে, তুঙ্গ আবেগঘন মুহূর্তে মানুষের ভাবপ্রকাশের ভাষা হচ্ছে কবিতা। তাই তাঁর মতে, মানুষের আবেগঘন মুহূর্তকে, জীবনের সমগ্রতার বোধকে অভিব্যক্তিদানের ক্ষেত্রে গদ্যের চেয়ে কবিতা অনেক বেশি উপযোগী। গদ্য সাময়িক উত্তেজনা-উদ্বেগকে ধারণ করতে পারে। কারণ গদ্য জীবনের বাস্তবতার সঙ্গেই বেশি সম্পৃক্ত। কিন্তু বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ – দুটোকে সামগ্রিকভাবে ধরতে গেলে বিশেষ করে অন্তর্লোকের লিরিক মুহূর্তগুলিকে অভিব্যক্তি দিতে গেলে কবিতা অনেক বেশি উপযোগী হতে পারে।

ইংরেজি সাহিত্যে ইয়েটস, ইশারউড, অডেন, স্পেন্ডার ও এলিয়ট; ফরাসি সাহিত্যে ক্লোদেল ও ককতো; জর্মন সাহিত্যে ব্রেখট হফমানস্থাল, ইতালীয় সাহিত্যে দান্নুৎসিও, স্পেনীয় সাহিত্যে লোরকা প্রমুখ কাব্যনাটের ধারাটিকে লালন ও বিকশিত করেছেন। বিশেষ করে এলিয়ট, লোরকা ও ব্রেখটের কাব্যনাটক বাংলা কাব্যনাটককে উদ্দীপ্ত ও প্রভাবিত করেছে।

পাশ্চাত্য আধুনিক কাব্যনাটক রচনার আগেই রবীন্দ্রনাথ উনিশ শতকের উপান্তে প্রকৃতির প্রতিশোধ রচনার মধ্য দিয়ে কাব্যনাট্য রচনার সূচনা করেন। এতে অন্তর্মুখী ও অন্তর্চেতনার প্রকাশ লক্ষণীয়। তাঁর রাজা ও রানী, বিসর্জন ও মানিনী কাব্যনাটকের সম্ভাবনা চিহ্নিত।

বাংলা কাব্যনাট্যের ধারায় সৃষ্টিধর্মী কুশলতার পরিচয় রেখেছেন বুদ্ধদেব বসু। মানবজীবনের মহিমা ও সংকট, যন্ত্রণা ও বিষাদকে তিনি জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে রূপায়ণ করার প্রয়াসে কাব্যনাট্য রচনায় হাত দেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যনাটকগুলির মধ্যে রয়েছে : তপস্বী ও তরঙ্গিনী, কালসন্ধ্যা, অনামী অঙ্গনা, প্রথম পার্থ, সংক্রান্তি, সত্যসন্ধ ইত্যাদি। আধুনিককালের অপরাজনীতি ও নীতিহীনতা রূপায়িত হয়েছে মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের একলব্য কাব্যনাট্যে। রামবসুর কাব্যনাট্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বারোটি কাব্যনাট্যের সংকলন একগুচ্ছ কাব্যনাট্য। বিশ শতকের মানুষের অন্তর্লোকের সংকট ও অসহায়তাকে রামবসু দেখেছেন আত্মসচেতন কবিমন নিয়ে। ফররুখ আহমদের উল্লেখযোগ্য কাব্যনাট্য নৌফেল ও হাতেম। সৈয়দ শামসুল হক কাব্যনাট্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যনাট্য হচ্ছে : পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নূরল দীনের সারাজীবন ও গণনায়ক।

৩.২ নাটকীয় একোক্তি (dramatic monologue)

কোনো নাটকীয় পরিস্থিতিতে কোনো চরিত্র তার আত্মকথনের মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে থাকে তাকেই বলা হয় নাটকীয় একোক্তি। যে পারিপাশির্^ক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে আমরা বক্তার নাটকীয় একোক্তি শুনতে পাই তাতে বক্তার মনের গভীরে আমরা দৃষ্টিপাত করতে পারি।

নাটকীয় একোক্তি, স্বগতোক্তি (soliloquy) ও পত্রকাব্যের (epistle) তিনটিতেই নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যক্ত একক চরিত্রের আত্মকথন আমরা শুনতে পাই। কিন্তু স্বগতোক্তি ও পত্রকাব্যের সঙ্গে নাটকীয় একোক্তির সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। নাটকে সাধারণভাবে যে স্বগতোক্তি বা একোক্তি ব্যবহার করা হয় তা নিছকই আত্মকথন – নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা। তাতে কোনো শ্রোতা থাকে না। কিন্তু নাটকীয় একোক্তিতে বক্তা এক নীরব শ্রোতার উদ্দেশে তাঁর হৃদয়কে উন্মোচিত করেন। নীরব শ্রোতার উপস্থিতি স্বগতোক্তি থেকে নাটকীয় একোক্তিকে আলাদা করে। অন্যদিকে পত্রকাব্যে আত্মকথন থাকলেও তাতেও একজন উদ্দীষ্ট প্রাপক বা শ্রোতা থাকেন। তাছাড়া পত্রকাব্যে নাটকীয়তা প্রধান নয়, প্রায়শই আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটে বলে তাতে গীতিধর্মিতা প্রধান হয়ে ওঠে।

গীতিকবিতার সঙ্গেও নাটকীয় একোক্তির পার্থক্য রয়েছে। গীতিকবিতায় কবি নিজের অন্তর্লোকের ভাবানুভূতিকে প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু নাটকীয় একোক্তির বক্তা বা চরিত্র কবি নিজে নন, তার কোনো মুখচ্ছদ (persona) মাত্র। নাটকীয় একোক্তিতে কবির অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয় না, উদ্ভাসিত হয় মূর্তি পরিগ্রহণকারী চরিত্রের অন্তর্লোক। চরিত্রের যে-ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে তা ফুটে ওঠে তার অজ্ঞাতসারে। এবং এটাই গীতিকবিতার সঙ্গে নাটকীয় একোক্তির পার্থক্য নির্দেশ করে।

নাটকীয় একোক্তি সাহিত্যের অনেক পুরনো রূপশ্রেণি। দান্তের কমেডিতে বিশেষ করে ইনফার্নো গ্রন্থের উদাহরণ রয়েছে। পাশ্চাত্য লোকগীতিকায়ও এই রীতির নিদর্শন পাওয়া যায়। ইংরেজি সাহিত্যে একে উঁচুমানের সাহিত্যরূপ দেন রবার্ট ব্রাউনিং। এক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট সুপরিচিত। তাঁর ‘My Last Duchess’ ও ‘Andrea Del Sarto’ নাট্যশ্লেষের সেরা নিদর্শন। টেনিসন কখনো কখনো এই রূপশ্রেণি ব্যবহার করেছেন। তাঁর ‘Ulysses’ কবিতাটি নাটকীয় একোক্তির উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। আধুনিক কবিরাও এ-ধরনের কবিতা রচনায় আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাঁর প্রমাণ রয়েছে রবার্ট ফ্রস্ট, আ্যালেন টেট ও টি এস এলিয়টের রচনায়। ইংরেজি সাহিত্যে নাটকীয় একোক্তি রচনায় অন্যান্য যাঁরা পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : এডগার লি মাস্টার্স, এডউইন এ. রবিনসন, কার্ল স্যান্ডবার্গ, কনরাড আইকেন, এমি লোয়েল, রবার্ট লোয়েল প্রমুখ। টি. এস. এলিয়টের ‘The Love-song of J. Alfred Prufrock’ কবিতাটিকে কেউ কেউ নাটকীয় একোক্তির উদাহরণ হিসেবে গণ্য করেন। তবে উচ্চারণগুলি ঠিক নাটকীয় মুহূর্তের নয় বলে অন্য কিছু সমালোচক একে নাটকীয় একোক্তি হিসেবে গণ্য করার চেয়ে অন্তর্ভাষণ (interior monologue) কিংবা ধ্যানমগ্ন কবিতার (mediative poetry) শ্রেণিভুক্ত করতে চান।

৪. অন্যান্য রূপশ্রেণির কবিতা

কবিতার আরো কিছু বিচিত্র রূপশ্রেণি আছে যেগুলি ঠিক কাহিনিকবিতা, গীতিকবিতা বা নাট্যকবিতার মধ্যে পড়ে না। এই ধরনের রূপশ্রেণির মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ১. নীতিকবিতা, ২. প্যারোডি, ৩. আবোলতাবোল কবিতা, ৪. লিমেরিক, ৫. রাখালি কবিতা, ৬. ছড়া।

৪.১ নীতিকবিতা (didactic poetry)

কোনো কবিতার উদ্দেশ্য যদি মুখ্যত কোনো বিষয়ে পথ নির্দেশনা বা উপদেশ প্রদান, শিক্ষাদান কিংবা তত্ত্বপ্রচার হয় তবে সে-কবিতাকে বলা হয় নীতিকবিতা। প্রায়শ নীতিকবিতা ও অ-নীতিকবিতার মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করা সহজ হয় না। তা মূলত কবিতাটির উদ্দেশ্য বিচার করেই নির্ধারণ করতে হয়।

সাহিত্যমাত্রই কোনো না কোনোভাবে ভাবধারণা, উপলব্ধি ইত্যাদি প্রকাশ করে থাকে। তাই কোনটি নীতিশিক্ষামূলক তা নির্ধারণ নির্ভর করে রচয়িতার উদ্দেশ্যের ওপর এবং পাঠকের পক্ষে সেটা বুঝে নেওয়া কষ্ট হয় না। যদি কোনো রচনার উদ্দেশ্যের নীতিশিক্ষা দান হয় তবে তাকে সহজেই নীতিশিক্ষামূলক রচনা বলে গণ্য করা যায়।

সাহিত্যে নীতিকবিতার স্থান ও মূল্য নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে সমালোচকদের মধ্যে বিতর্ক চলে আসছে। অনেকে মনে করেন, সাহিত্য যদি উদ্দেশ্যের দিক থেকে নীতিশিক্ষামূলক হয় তাহলে তা প্রচারসাহিত্যে পরিণত হতে পারে। কেউ কেউ আবার মনে করেন, সত্যিকার সাহিত্য উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে ওঠে। শুষ্ক তত্ত্ব বা জ্ঞানের বিষয়ও আবেগ-অনুভূতি ও কল্পনার মাধুরীযুক্ত হয়ে মহৎ জীবনবোধ হয়ে দেখা দিতে পারে। উদ্দেশ্য যাই হোক সাহিত্যকে আসলে সাহিত্যপদবাচ্য হতে হয়। তবে কেউ কেউ আছেন সাহিত্যে নৈতিকতাকে অপরিহার্য মনে করেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য নৈতিকতাবাদীরা এবং মার্কসবাদীরা। সাহিত্যের নীতিশিক্ষামূলক ভূমিকার সপক্ষে তাঁদের অবস্থান। পাশ্চাত্য সাহিত্যে সুপ্রাচীন কাল থেকেই সাহিত্যে নীতিশিক্ষার বিষয়টি কম-বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

যাই হোক, এটা স্পষ্ট যে, কেবল শিক্ষাদান বা নীতি প্রচারের উদ্দেশ্যে কোনো কবিতা লেখা হলে তাকে আদৌ কবিতা বলতে অনেকেই নারাজ হন। অন্যদিকে সত্যিকারের কবির হাতেও যে নীতিকবিতা উচ্চাঙ্গের কাব্যরসমণ্ডিত কবিতা হতে পারে তার উদাহরণ বিশ্বসাহিত্যে অঢেল পাওয়া যায়।

নীতিকবিতায় কবি সুভাষণের মাধ্যমে জ্ঞানগর্ভ তত্ত্ব, অনুসরণীয় উপদেশ, কিংবা নৈতিক চেতনা ব্যক্ত করে পাঠককে সচেতন করতে কিংবা শিক্ষাদানে প্রয়াসী হন। সে-কবিতা হতে পারে ভাবগম্ভীর ও ধীর লয়ের, হতে পারে লঘুরসাত্মক ও হালকা চালের। নীতি শিক্ষা প্রচারের কাজটি ক্ষুদ্র গীতিকবিতার মাধ্যমে হতে পারে, আবার তা হতে পারে নাতিদীর্ঘ কিংবা দীর্ঘ কাহিনি কবিতার মাধ্যমে। রূপক কবিতা কিংবা ব্যঙ্গ কবিতার মধ্যেও কবির তাত্ত্বিক, দার্শনিক, জ্ঞানগর্ভ কিংবা নীতিমূলক উপদেশ নিহিত থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে নীতিশিক্ষা উদ্দেশ্য হলেও তা যত বেশি কবিতার কাব্যমাধুর্যের আড়ালে নিহিত বা প্রচ্ছন্ন থাকবে ততই কবিতা হবে সার্থক ও ব্যঞ্জনাময়।

প্রাচীনকালে অধিকাংশ সাহিত্যই নীতিমূলক উদ্দেশ্যে লেখা হতো। প্রাচীন গ্রিসে অনেক কবিতা লেখা হতো নাগরিকদের ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, কলাবিদ্যা, এমনকি সাধারণ প্রয়োগবিদ্যা (জ্যোতিবিদ্যা, কৃষি, পশুপালন ইত্যাদি) শেখানোর জন্য। প্রাচীন গ্রিসে হেসোইডের ‘Works and Days’ ছিল কৃষিবিদ্যা সংক্রান্ত কবিতা। কবি ভার্জিলের Georgics কৃষিবিদ্যা বিষয়ক জ্ঞান ও পরামর্শে সমৃদ্ধ। ইংরেজি সাহিত্যে নীতিকবিতার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ আলেকজান্ডার পোপের কবিতা ‘Essay on Criticism‘ ও রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা ‘Mending Wall’।

বাংলা সাহিত্যে নীতিকবিতার উদাহরণ অনেক। ছোট পরিসরে লেখা উচ্চাঙ্গের অনেক নীতিকবিতার নিদর্শন রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কণিকা কাব্যগ্রন্থে। কণিকা কাব্যগ্রন্থ থেকে নীতিকবিতার একটি উদাহরণ :

অদৃষ্টেরে শুধালেম, চিরদিন পিছে

অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে?

সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলাম থামি

সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।

এখানে মাত্র কয়েকটি পঙ্ক্তিতে জীবনের গূঢ়তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘প্রতিনিধি’, ‘নিষ্ফল উপহার’ ইত্যাদি কবিতায় কাব্যমাধুর্যের আড়ালে নীতিকথা নিহিত রয়েছে। কাহিনি-কাব্যের মাধ্যমেও তিনি যে নীতিশিক্ষা দিতে চেয়েছেন তা ‘সামান্য ক্ষতি’, ‘পুরাতন ভৃত্য’, ‘দুই বিঘা জমি’ ইত্যাদি কবিতা পাঠ করলেই বোঝা যায়। বাংলা সাহিত্যে নীতিকবিতার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংকলন হচ্ছে : কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সদ্ভাবশতক, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতিকুসুযাঞ্জলী, রজনীকান্ত সেনের অমৃত, সুরেন্দ্রনাথ সেনের মাদকমঙ্গল ইত্যাদি।

৪.২ প্যারোডি বা লালিকা (parody)

প্যারোডি বা লালিকা বলতে বোঝায় কোনো রচনার ব্যঙ্গাত্মক বা হাস্যরসাত্মক অনুকৃতি। চিত্রশিল্পে কার্টুন বা ক্যারিকেচারের যে ভূমিকা সাহিত্যে প্যারোডির ভূমিকাও তেমনি। এ-ধরনের রচনায় অন্য কোনো রচনার মূল গঠনরূপ ও রচনারীতি মোটামুটি অবিকল রেখে বিষয় ও ভাবগত অতিরঞ্জন ঘটিয়ে কিংবা তাকে কিছুটা উদ্ভট রূপ দিয়ে তার হাস্যরসাত্মক রূপান্তর ঘটানো হয়ে থাকে। প্যারোডির মাধ্যমে কখনো লেখক ও তাঁর রচনাশৈলীকে আক্রমণ করা হয়। তখন তা পরিণত হয় হুলফোটানো পরিহাসে। যখন কোনো রচনার বিষয়বস্তুর প্যারোডি করা হয় তখন তা ওই রচনার পরোক্ষ সমালোচনায় পরিণত হতে পারে। কখনো কখনো কবি তাঁর প্যারোডির মাধ্যমে মূল লেখককে চাটুকারিতাময় স্তুতিও করতে পারেন। সমকালীন প্রেক্ষাপটে রচিত রাজনৈতিক প্যারোডি অনেক সময় এতই শক্তিশালী ও প্রভাবব্যঞ্জক হয় যে তা আসল রচনাকে ছাড়িয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গান কিংবা কবিতারই প্যারোডি হয়ে থাকে। তবে কখনো কখনো নাটক, উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পেরও প্যারোডি হতে পারে।

কালে কালে বিশ^সাহিত্যে প্যারোডি একটা সুনির্দিষ্ট আসন করে নিয়েছে। তা একসময় জনপ্রিয় সাহিত্য প্রকরণ হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। প্যারোডির মাধ্যমে কৌতুক সৃষ্টি কাব্যসাহিত্যে একটি সুপরিচিত রীতি। এই রীতি কমবেশি অপরিবর্তিত। এই রীতি সমুন্নত বিষয়বস্তুকে তুচ্ছ বা হেয় করার ক্ষমতা রাখে।

প্যারোডি রচনার প্রয়াস চলে আসছে সুপ্রাচীন কাল থেকে। অ্যারিস্টোফেনিসের সময়েও প্যারোডি রচিত হয়েছে পরিহাস ও উদ্ভটত্ব সৃষ্টির কড়া হাতিয়ার হিসেবে ইংরেজি সাহিত্যে প্যারোডির উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য মিল্টনের ‘Paradis Lost’ কবিতার শৈলীর অনুকরণে লেখা জন ফিলিপ্সের কবিতা ‘The Splendid Shilling’, ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘Peter Bell কবিতার ব্যঙ্গ অনুকৃতিমূলক শেলির কাব্যগ্রন্থ Peter Bell The Third, রবার্ট সাউদির Vision of Judgment কাব্যগ্রন্থের বায়রনকৃত প্যারোডি কবিতা ‘The Vision of Judgment’ ইত্যাদি।

বাংলা সাহিত্যে কবিতার ক্ষেত্রে প্যারোডি রচনায় অনেকেই কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুকরণে অনেকেই প্যারোডি রচনা করেছেন। মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি যদি জন্ম নিতাম ক্যাবলা কলুর কালে’, কালিদাস রায়ের ‘কেন বঞ্চিত হব ভোজনে’, সজনীকান্ত দাসের ‘হে বিরাট গদী’, সতীশ ঘটকের ‘সোনার ঘড়ি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কয়েকটি কবিতার প্যারোডি করে যতীন্দ্রনাথ গুপ্ত কাব্যরসিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘শরৎ’ ও তার প্যারোডি যতীন্দ্রনাথের ‘শরতে বঙ্গভূমি’ মিলিয়ে পড়লে প্যারোডি কবিতার স্বরূপবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হবে :

(ক) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শরৎ’

আজি কি তোমার মধুর মুরতি

হেরিনু শারদ প্রভাতে!

হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ

ঝলিছে অমল শোভাতে।

পারে না বহিতে নদী জলধার,

মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর –

ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল

তোমার কাননসভাতে!

মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী,

শরৎ কালের প্রভাতে ॥

খ) যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘শরতে বঙ্গভূমি’ :

আজি কি তোমার বিধুর মুরতি

হেরিনু শারদ প্রভাতে!

হে মাত বঙ্গ, মলিন অঙ্গ

ভরে গেছে খানা ডোবাতে।

পারে না বহিতে লোকে জ¦র-ভার

পেটে পেটে পিলে ধরে নাকো আর,

দিবসে শেয়াল গাহিছে খেয়াল

বিজন পল্লী-সভাতে।

এক পাশে তুমি কাঁদিছ জননী

শরৎকালের প্রভাতে ॥

৪.৩ আবোল-তাবোল কবিতা (nonsense verse)

ছোট পরিসরের লঘু কবিতার একটি বৈচিত্র্যময় রূপশ্রেণি হচ্ছে আবোল-তাবোল কবিতা। প্রবল ছন্দোময়তা এবং বাছবিচারহীন কথার ফুলঝুরি এর বিশেষ আকর্ষণ। কৌতুকধর্মী এ-ধরনের কবিতা রচিত হয় সচেতনভাবে ব্যবহৃত অদ্ভুত ও অস্তিত্বহীন শব্দ ও যুক্তিহীন ভাবকল্পনার সাহায্যে। এ-ধরনের কবিতায় অনেক সময় সদ্য উদ্ভাবিত জোড়কলম শব্দ (হাঁস + সজারু = হাঁসজারু) এবং বিভিন্ন ভাষা থেকে নেওয়া শব্দের মিশেল বা সংকর শব্দের প্রয়োগ বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। ফলে অর্থ বা ব্যঞ্জনার চেয়ে উদ্ভটত্ব ও ধ্বনিসুষমাই যেন প্রধান হয়ে ওঠে।

এ-ধরনের কবিতাকে আবোল-তাবোল রচনা নামকরণ একদিক থেকে অত্যুক্তিজনক অন্যদিক থেকে ভ্রান্তপরিচয়জ্ঞাপক। কারণ, সত্যিকার অর্থে আবোল-তাবোল হলে এ-ধরনের রচনা পুরোপুরি অবোধগম্য হওয়ার কথা।

আবোল-তাবোল কবিতার ক্ষেত্র ছেলে-ভোলানো ছড়া থেকে শুরু করে ডাডাবাদী আন্দোলনের অক্ষর-কোলাজ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ-ধরনের কবিতার প্রবণতা কখনো মজাদার, কখনো ব্যঙ্গাত্মক কখনো বা পুরোপুরি নাস্তিবাদী। লিমেরিক আবোল-তাবোল কবিতার একটি বিশেষ শ্রেণি।

ইংরেজি সাহিত্যে আবোল-তাবোল কবিতা লিখে প্রথম খ্যাতির শীর্ষে ওঠেন এডওয়ার্ড লিয়ার ও লুই ক্যারল। লুই ক্যারল শব্দ ব্যবহারে এবং এডওয়ার্ড লিয়র উদ্ভট চরিত্র ও পরিস্থিতি সৃজনে চমকপ্রদ উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় দেখিয়েছেন। আবোল-তাবোল কবিতার ধ্রুপদী নিদর্শন এডওয়ার্ড লিয়রের ‘The Owl and the Pussy-Cat’ কবিতাটি। পরবর্তীকালে এদের অনুসরণে আবোল-তাবোল কবিতা রচনা করেছেন জি কে চেস্টারটন ও অগডেন ন্যাশ।

বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল কাব্যগ্রন্থের প্রায় সব ছড়া আবোল তাবোল বা ‘ননসেন্স ভার্স’-এর চমকপ্রদ উদাহরণ। এসব রচনায় তিনি আমাদের চেনাজানা অর্থের জগৎ থেকে নিয়ে যান আজগুবি এক জগতে। সে জগতে আপাত-অসঙ্গতির মধ্যে আমরা কৌতুকরস অনুভব করি। যেমন ‘বোম্বাগড়ের রাজা’ ছড়াটি :

কেউ কি জান সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা –

ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা?

রানীর মাথায় অষ্টগ্রহর কেন বালিশ বাঁধা?

পাউরুটিতে পেরেক ঠোকে কেন রানীর দাদা?

কেন সেথায় সর্দি হলে ডিগবাজি খায় লোকে?

জোছনা রাতে সবাই কেন আলতা মাখায় চোখে?

ওস্তাদেরা লেপ মুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে?

টাকের ’পরে পণ্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে!

রাত্রে কেন ঢ্যাঁকঘড়িটা ডুবিয়ে রাখে ঘিয়ে?

কেন রাজার বিছনা পাতে শিরীষ কাগজ দিয়ে?

সভায় কেন চেঁচায় রাজা ‘হুক্কা হুয়া’ বলে?

মন্ত্রী কেন কল্‌সী বাজায় ব’সে রাজার কোলে?

সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি?

কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসী?

রাজার খুড়ো নাচেন কেন হুঁকোর মালা প’রে?

এমন কেন ঘট্ছে তা কেউ বলতে পার মোরে?

৪.৪ লিমেরিক (limerick)

লিমেরিক হচ্ছে এক ধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণ লঘু হালকা কৌতুকময় ছোট কবিতা। এর গঠনগত নির্দিষ্ট ধাঁচ রয়েছে।

এ-ধরনের কবিতার আদি উৎস ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে। যতদূর জানা যায়, লিমেরিক নামটি এসেছে আয়ারল্যান্ডের লিমেরিক শহরের নাম থেকে। শহরটিতে বিনোদনের জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল আসরে-অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের ছড়া কাটা ও কবিতা আবৃত্তির পাল্লায় শামিল করা। সেখানকার জনপ্রিয় সম্মেলক বুলি ছিল ‘লিমেরিকে লাগো দেখি।’ এভাবে প্রথমে মুখে মুখে লিমেরিক রচিত ও সম্প্রচলিত হয়। এবং অনেকটা ছিল প্রবচন সংগীতের মতো।

লিমেরিক কবিতায় মোট পাঁচটি পঙ্ক্তি থাকে। প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম পঙ্ক্তি ত্রিপর্বিক এবং একই ধরনের মিলযুক্ত। আর দ্বিতীয় ও চতুর্থ পঙ্ক্তি দ্বিপর্বিক ও অন্ত্যমিলযুক্ত। অন্ত্যমিলের ছক এ-রকম : কক খখক। পাঁচ লাইনের কবিতা বলে বুদ্ধদেব বসু লিমেরিকের বাংলা নামকরণ করেছিলেন ‘পঞ্চপদাবলী’। কখনো কখনো চার লাইনের লিমেরিকও পাওয়া যায়। তবে সে-রকম ক্ষেত্রে তৃতীয় লাইনটিকে সহজেই দুই লাইন বলে গণ্য করা চলে। লিমেরিক পাঁচ লাইনের হলে কখনো কখনো পঞ্চম লাইনটি প্রথম লাইনের পুনরাবৃত্তি হয়ে থাকে।

লিমেরিকের বিষয়বস্তুর পরিধি বহুব্যাপক। যা কিছু নিয়ে হালকা কৌতুক ও বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরস হতে পারে তার সবই লিমেরিকের বিষয় হতে পারে। তবে, প্রধানত যে-কোনো আবোল-তাবোল বিষয়, ব্যক্তির আচার-আচরণ, নৈতিকতা, কাল্পনিক কোনো ব্যক্তি বা তাঁর নাম, ব্যক্তিগত কোনো অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য, কোনো স্থান নাম, অশ্লীল মজাদার কোনো প্রসঙ্গ ইত্যাদি নিয়ে লিমেরিক রচিত হয়। ইংরেজি সাহিত্যে বহু কৌতুক রসাত্মক অশ্লীল লিমেরিক রয়েছে। এগুলির অধিকাংশই অজানা কবির রচনা। এ-ধরনের একটি স্থূল লিমেরিকের উদাহরণ :

There was a young fellow named Menzies

Whose kissing sent girls into frenzies;

But a virgin on night

crossed her legs in a fright

And fractured his bi-focal lenses.

ছেলে-ভোলানো ছড়া ‘ঐরপশড়ৎু উরপশড়ৎু উঁপশ’ সম্ভবত প্রাচীনতম লিমেরিক। ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম মুদ্রিত লিমেরিকের নিদর্শন পাওয়া যায় ১৮২০ সালে প্রকাশিত অহবপফড়ঃবং ধহফ অফাবহঃঁৎবং ড়ভ ঋরভঃববহ ণড়ঁহম খধফরবং এবং ঞযব ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঝরীঃববহ ডড়হফবৎভঁষ ঙষফ ডড়সবহ প্রকাশিত হলে। তবে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ১৮৪৬ সালে এডওয়ার্ড লিয়রের ইড়ড়শ ড়ভ ঘড়হংবহংব প্রকাশিত হওয়ার পর। পরবর্তীকালে ইংরেজি সাহিত্যে প্রচুর লিমেরিক রচিত হয়েছে। ইংরেজি লিমেরিক রচয়িতাদের মধ্যে রবার্ট ফ্রস্ট, ডব্লিউ এইচ অডেনসহ অনেক বিশিষ্ট আধুনিক কবি রয়েছেন।

লিমেরিক ইংরেজি সাহিত্যের নিজস্ব সম্পদ হলেও বিশে^র অন্যান্য ভাষায়ও লিমেরিক রচিত হতে দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যেও অনেক বাঙালি কবি শখ করে লিমেরিক লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের খাপছাড়া গ্রন্থে লিমেরিক ধরনের কবিতা দেখা যায়। যেমন :

হাত দিয়ে পেতে হবে কী তাহে আনন্দ – ক

হাত পেতে পাওয়া যাবে সেটাই পছন্দ। ক

আপিসেতে খেটে মরা –  খ

তার চেয়ে ঝুলি ধরা   –   খ

ঢের ভালো – এ কথায় নাই কোনো সন্দ। ক

অন্নদাশঙ্কর রায় বেশ কিছু লিমেরিক রচনা করেছেন। তাঁর বহু ছড়া লিমেরিকের বৈশিষ্ট্যে প্রভাবিত। বাংলাদেশের অনেক কবিও লিমেরিক রচনায় নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। খোন্দকার মুজাম্মিল হক-রচিত অজারাজার দেশে বাংলাদেশে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য লিমেরিক সংকলন।

৪.৫ রাখালি কবিতা (pastoral poetry)

রাখালি কবিতায় গ্রামীণ জীবনে মেষপালক বা গরুর রাখালদের জীবনের পরিবেশ ও অনুভূতিকে আবেগময়তা দিয়ে প্রকাশ করা হয়।

রাখালি কবিতা দু-ধরনের হয়ে থাকে – বিচ্ছেদ ও খেয়াল। বিচ্ছেদ কবিতার ভাবসম্পদ গভীর। সেগুলি রাখালেরা সাধারণত বাঁশিতে উদাস সুরে গায়। খেয়াল কবিতার ভাবসম্পদ তেমন গভীর নয়।

ইংরেজি সাহিত্যে রাখালি কবিতায় উদাহরণ টমাস গ্রে’র ‘Elegy on a country churchyard’, শেলির ‘Adonais’ এবং ম্যাথু আর্নল্ড-এর ‘Thyrsis’।

বাংলায় রাখালি কবিতার বিশিষ্ট উদাহরণ জসীম উদ্দীনের রাখালি।

৪.৬ ছড়া (folk-verse)

ছড়া মূূলত ছিল মৌখিক সাহিত্যের নিদর্শন – মুখে মুখে উচ্চারিত ছন্দোময় পদ্য। এটি সাহিত্যের একটি প্রাচীন শাখা। ছড়া জাতীয় কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য ধ্বনিময়তা ও সুরঝংকার। ছড়ায় অর্থময়তা গৌণ।

পদ্য কবিতা এবং ছড়ার মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে, পদ্যের বক্তব্য সহজবোধ্য ও স্পষ্ট কিন্তু ছড়ায় থাকে অস্বচ্ছতা, রহস্যময়তা ও অসংলগ্নতা।

লোকসমাজে ছড়া ছিল ভাবপ্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। অনেকেই ছড়াকে লোকসাহিত্য বলে গণ্য করেন। আধুনিক সাহিত্যিকরা তা মানতে নারাজ। তাঁরা মনে করেন, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটকের মতো ছড়াও সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট শাখা। এই শাখা অন্যান্য শাখার চেয়ে যথেষ্ট জনপ্রিয়।

বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে ছড়ার দুটি প্রধান ধারা চোখে পড়ে। একটি ধারা লোকজ সাহিত্য থেকে উৎসারিত অন্যটি সমাজসচেতনমূলক বক্তব্যে ঋদ্ধ। পূর্ব বাংলার পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন-শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ধারায় সমাজমনস্ক ছড়ার ধারাটি ক্রমে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এছাড়াও ছড়াকে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা হয়। যেমন, শিশুতোষ ছড়া, রাজনৈতিক ছড়া, কবিতাধর্মী ছড়া

প্রভৃতি। বাংলায় ‘ছেলে-ভোলানো ছড়া’, ‘ঘুমপাড়ানি ছড়া’ ইত্যাদি ছড়া দীর্ঘকাল যাবৎ প্রচলিত। 

১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সরকার লোকছড়াকে প্রথম গ্রন্থভুক্ত করেন খুকুমণির ছড়া গ্রন্থে। এই গ্রন্থটির ভূমিকায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ছড়াকে সর্বপ্রথম সাহিত্যের অন্যতম শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। একসময় ছড়াকে মনে করা হতো শুধুই লোকসাহিত্য। সাম্প্রতিককালে বাংলাসাহিত্যে ছড়া তার নিজস্ব স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে।

কবি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের হাতে শিশুতোষ ছড়া সমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছড়াকার হলেন সুকুমার রায় ও অন্নদাশঙ্কর রায়। বাংলাদেশে ছড়ার সার্থক রূপকারদের মধ্যে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, এখলাসউদ্দিন আহমদ, রফিকুল হক, সুকুমার বড়ুয়া, আলম তালুকদার, সৈয়দ শামসুল হক, আখতার হুসেন, রহীম শাহ, লুৎফর রহমান লিটন, রাশেদ রউফ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।