জন্মশতবর্ষে কবি আবুল হোসেন ও তাঁর কাব্যচেতনার কয়েকটি দিক

২০২২ সালে কবি আবুল হোসেন শতবর্ষে পা রাখলেন। নিজের জন্মসন আর তারিখ নিয়ে কবি একদম অকপটে আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘পৃথিবীর মুখ দেখেছিলাম … শুক্রবারে, শ্রাবণের এক বর্ষণহীন সকালে। [আম্মা] মনে করতে পারেননি সঠিক সন-তারিখ। বলেছিলেন, ঝড়ের বছর, ১৫ই শ্রাবণ। আব্বা বললেন, আগস্ট ১৯২২। আম্মার তারিখ আর আব্বার বছর নিয়ে জন্মদিনটা হয়ে গেল ১৫ই আগস্ট, ১৯২২।’ ঘটনাটা এখানেই কিন্তু শেষ নয়, আবুল হোসেন আরো বলেছিলেন, ‘আমি যখন প্রথম স্কুলে ভর্তি হই, ভর্তির ফরমে আব্বা আমার জন্মদিন লিখেছিলেন ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২। সেটা প্রথম জানতে পারি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাসের সার্টিফিকেট পেয়ে। কেন এই তারিখটা বসিয়েছিলেন আব্বা কেউ জানে না।’ আর সেইজন্যেই ‘১ ফেব্রুয়ারিই আমার সরকারি জন্মদিন হয়ে রইল। সেটা আর কোনদিন সংশোধন করা হয়নি। আমার পাসপোর্ট, সরকারি নথিপত্রে, দলিল-দস্তাবেজে ১ ফেব্রুয়ারির আধিপত্য।’

জীবনের বেশিরভাগ সময় শহরে কাটলেও কবির জন্ম কিন্তু গ্রামে। এ-সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমার প্রায় সারা জীবন কেটেছে শহরে। বলতে গেলে আমি শহরেই মানুষ। বেড়ে উঠেছি তিনটি ছোট-বড়-মাঝারি শহরে : কৃষ্ণনগর, কুষ্টিয়া ও কলকাতায়। বন্ধুর বাড়ানো হাতের মতো ইট-কাঠ-বালি-সিমেন্ট, কাচ, ধুলো-কাদা, কলের পানি, পিচের রাস্তা, খোলা নর্দমায় আকীর্ণ আমার শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য ও প্রথম যৌবনের দিনগুলো।’ আর সেই কারণেই চল্লিশের দশকের পরিব্যাপ্ত আধুনিকতাকে তাঁর আত্মস্থ করতে বেশ সুবিধা হয়েছিল। কবি আবুল হোসেন তাঁর সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানিয়েছিলেন, ‘চল্লিশের দশকে আমাদের সমাজে কবিতার যে রূপান্তর তা সম্ভব হয়েছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গড়ে ওঠা আশা-আকাক্সক্ষা, আবেগ-অনুভূতিকে অবলম্বন করে।’ এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেছিলেন, ‘সমসাময়িক বর্ধিষ্ণু হিন্দু সমাজের সাহিত্যিক, শৈল্পিক, সামাজিক অভিযানের আদর্শ তো তার সম্মুখে ছিলোই, সেই প্রেরণার দোসর হয়ে এলো দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের বিপ্লবাত্মক প্রতিক্রিয়া। চল্লিশের মুসলমান তরুণেরা সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলো। আর তার ফলে আমাদের সমাজের সাহিত্যে ও শিল্পে আধুনিকতার সূচনা।’ আবুল হোসেনের এই ভাষ্যের মধ্যে দিয়ে শুধুই সাহিত্যিক নয়, একটা ঐতিহাসিক সত্যতাও প্রতিফলিত হয়েছে, যা কি না চল্লিশের দশকের অন্য কবিদের বেলায়ও সত্যি, বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুসলিম কবিদের বেলায়।

২.

‘রসের ধর্ম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ শিল্প-সাহিত্যের গতি ও সৌন্দর্যকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একেবারে তাঁর নিজস্ব ধরনে বলেছিলেন, ‘ঝর্ণার যে গতি সে তার নিজেরই গতি  – সেইজন্যেই এই গতিতেই তার ব্যাপ্তি, মুক্তি তার সৌন্দর্য। এইজন্য গতিপথে সে যত আঘাত পায় ততই তাকে বৈচিত্র্য দান করে। বাধায় তার ক্ষতি নেই, চলায় তার শ্রান্তি নেই।’ এরই সূত্র ধরে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘মানুষের মধ্যেও যখন রসের আবির্ভাব না থাকে তখনই সে জড়পিণ্ড। তখন ক্ষুধা তৃষ্ণা ভয় ভাবনাই তাকে ঠেলে ঠেলে কাজ করায়, সে কাজে পদে পদেই তার ক্লান্তি। সেই নীরস অবস্থাতেই মানুষ অন্তরের নিশ্চলতা থেকে বাহিরেও কেবলই নিশ্চলতা বিস্তার করতে থাকে।’ তাহলে মানুষের এই নিশ্চলতা, এই জড়ত্ব ঘোচানোর পথটা কোথায়? এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথের অভিমত হচ্ছে, ‘রসের আবির্ভাবে মানুষের জড়ত্ব ঘুচে যায়। সুতরাং তখন সচলতা তার পক্ষে অস্বাভাবিক নয়; তখন অগ্রগামী গতিশক্তির আনন্দেই সে কর্ম করে, সর্বজয়ী প্রাণশক্তির আনন্দেই সে দুঃখকে স্বীকার করে।’

ঠিক একইভাবে আবুল হোসেনের রচনায় আমরা বাঙালি মুসলমানের একটা ‘সর্বজয়ী প্রাণশক্তির আনন্দের’ প্রবাহ দেখতে পেয়েছিলাম। তাঁর প্রথম কবিতার বই নব বসন্ত বেরিয়েছিল ১৯৪০ সালে। এই সালটি নানা কারণেই আমাদের এই উপমহাদেশের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। চতুরঙ্গ (পৌষ, ১৩৪৮) পত্রিকায় এই কাব্যের আলোচনা করতে গিয়ে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান লিখেছিলেন, ‘নব বসন্তের কয়েকটি রসোত্তীর্ণ কবিতা পাঠে মন সত্যি খুশি হয়। রবীন্দ্র-ভাস্বরে দীপ্ত কবির বলিষ্ঠ রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গী, ধ্বন্যাত্মক শব্দ-গাঁথার পটুতা, সুছন্দ-বয়ন, আশাবাদের উচ্চগ্রাম – রসিকজনের হৃদয়কে আকর্ষণ করে। বইয়ের নামকরণ সার্থক।’ অন্যদিকে, বিনয় সরকারের মতো প্রাজ্ঞ অধ্যাপক এবং মনীষী আবুল হোসেনের কাব্যশক্তি সম্পর্কে তাঁর বিশিষ্ট ভঙ্গিতে জানিয়েছিলেন, কবির ‘কল্পনা আছে। এই হচ্ছে বড় কথা। ‘নব-বসন্ত’র অন্যান্য কবিতায়ও আবুলের কল্পনা-শক্তি মূর্তি পেয়েছে। তথাকথিত গদ্য-কাব্য এসব নয়। সিঁড়ি-কাটা গদ্যের মতন যেগুলা দেখায়, সেগুলার ভেতরও ছন্দের গতিভঙ্গী আছে। ছান্দসিক সংযমও আছে, রসও আছে। পড়বার সময় হোঁচট খেতে হয় না। হড়-হড় করে পড়া যায়। আবুলের বিষয়বস্তু রকমারি।’

এই বইয়ের তিনটে কবিতা সেই সময়ের পাঠক-সমালোচকের মনে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, সে-তিনটি কবিতা হচ্ছে – ‘বাংলার মেয়ে’, ‘ঘোড়াসওয়ার’ ও ‘ডাইনামো’। ‘বাংলার মেয়ে’ কবিতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিনয় সরকার বলেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীর শ্রেণী-সংগ্রামের যুগেও সমাজ-সচেতন ছোকরা কবি বুঝেছে যে, মান্ধাতার আমলের রাজকুমার-খোঁজ দস্তুর-মতনই বজায় আছে। মেয়েদের রাজকুমার-স্বপ্ন বা রাজকুমার-নেশা একমাত্র মধ্যযুগের মাল নয়। সাহিত্যের রাজকুমার-সৃষ্টিকে সামন্ত-যুগের একচেটিয়া মানসবিলাস সম্ঝে রাখা আহাম্মুকি। এ চিজ হচ্ছে সনাতন ও সার্বজনিক। এখানে একাল-সেকাল ফারাক করা ঝকমারি।’ (বিনয় সরকারের বৈঠকে, মে, ১৯৪৪) সেই ‘ঝকমারি’ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে আবুল হোসেন তাঁর কাব্যে আবেগ ও কল্পনার মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা ছিল একজন তরুণ কবির জন্যে বিরাট একটি পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় আবুল হোসেন খুব সার্থকভাবে উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন। এর প্রধান একটি কারণ হচ্ছে, একদম শুরু থেকেই আবুল হোসেন ছিলেন আত্মসচেতন একজন কবি। তাঁর সেই সচেতনতার শৈল্পিক দৃঢ়তা অপূর্বভাবে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম কাব্যের সর্বশেষ কবিতা ‘দিক নির্ণয়’-এ। যেখানে শুরুতেই সংশয়-পীড়িত কবি ভাবছেন –

কোন্ দিকে যাব, ডাইনে না বাঁয়ে

অথবা যে পথ সোজা চলে যায়,

যে পথে গেছেন পিতা পিতামহ,

যে পথে পথিক চলে অহরহ।

কবিতাটি শেষ হয়েছে একজন তরুণ কবির আত্মবিশ^াস অর্জনের মধ্যে দিয়ে, যেখানে তাঁর বক্তব্য এমন –

পথটা সোজা না বাঁয়ে না ডাইনে

জানিনে জানিনে জানতে চাইনে।

শুধু জানি এই সেটা নিজেকেই

নিতে হবে চিনে যথা সময়েই।

ওই একবারই, তারপর কবিকে আর সংশয় নিয়ে পেছন দিকে তাকাতে হয়নি। পরবর্তী সময়ে নিজের কাব্য-প্রবণতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমার পণ ছিল রবীন্দ্রনাথ বর্জন। তাঁর ছাপ যেন কোথাও না থাকে।’ আর তার পাশাপাশি ‘সেই বয়সেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, আমাকে ভিন্ন পথ ধরতে হবে।’ আজকের দিনে এটিকে একটা সামান্য কাজ মনে হলেও সে-দিনের বিচারে তা ছিল খুব বড়ো একটি অর্জন। আবুল হোসেন বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে তাঁর সময়ে এড়িয়ে অথবা পাশ কাটিয়ে যাওয়া যে কী কঠিন ব্যাপার ছিল, তার সাক্ষী দেবে তিরিশের প্রধান কবিদের প্রথম পর্যায়ের লেখাগুলো। ‘নববসন্তে’ই শুরু, তবে নিজের কথা নিজের মতো করে বলতে আমার আরও কিছু সময় লেগেছিল।’ আর সেই অভিজ্ঞতার সূত্র ধরেই তাঁর এই অকপট স্বীকারোক্তি – ‘যখন আমার নিজের ভঙ্গিটি আমার পুরোপুরি রপ্ত হয়নি, অথচ আমি আমার পূর্বসূরিদের কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে আসছি। সেটাই নববসন্তের সময়।’

বুদ্ধদেব বসু খুব সংগত কারণেই তাঁর আধুনিক বাংলা কবিতা সংকলনের ভূমিকায় খানিকটা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমাদের সাম্প্রতিক কবিরা কত বিচিত্রভাবে সৃষ্টিশীল। এই বৈচিত্র্যর উপর আমি একটু জোর দিতে চাই, কেননা এর মূল্য শুধু অলংকার হিশেবে বা স্বাদ-বদলের তাগিদে নয়, প্রাণের ঐশ^র্যের নামই বৈচিত্র্য।’ রবীন্দ্রনাথ কাব্যের মধ্যে যে-সচলতার কথা বলতে চেয়েছিলেন, বুদ্ধদেব বসু তাকেই খানিকটা ভিন্ন নাম দিলেন – ‘বৈচিত্র্য’। এই সৃষ্টিশীল বৈচিত্র্যকেই তাঁর মনে হয়েছিল আধুনিকতার একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য। সেইদিকে খেয়াল রেখে তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘সকলেই জানেন, সমকালীন এবং ঐতিহাসিক অর্থে একই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত কবিতের মধ্যেও ব্যক্তিস্বরূপের বৈশিষ্ট্যগত প্রচুর পার্থক্য দেখা যায়, সে-প্রভেদ কখনো বা এতই বৃহৎ যে ঐতিহাসিক সম্বন্ধ খুঁজে পাওয়াও সহজ হয় না।’ তাঁর বক্তব্যটিকে আরো খানিকটা বিস্তারে বলতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওর্ডসওয়ার্থের সঙ্গে কিটসের প্রায় কিছুই মেলে না, তার চেয়েও কম মেলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তী, অথচ জন্মক্ষণের সামীপ্য ছাড়া আর কোন কারণে তাঁরা একই আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হলেন, তা নিয়ে সমালোচক নিশ্চয়ই চিন্তা করবেন, কিন্তু কোনো পাঠক যদি উভয়ের কবিতাই আনন্দের সঙ্গে পড়ে উঠতে পারেন, আমি বলবো সেটুকুই সাচ্চা লাভ।’ আর সে-কারণেই আধুনিক বাংলা কবিতা নিয়ে তাঁর আশাবাদকে তিনি আর গোপন রাখতে চাননি, বরং প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন, ‘আধুনিক বাংলা কবিতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা যেন সবিস্ময়ে এই কথাটা উপলব্ধি করি যে ঐক্যের মধ্যেও বিপরীতের স্থান আছে, বিরোধের মধ্যেও সংহতির সম্ভাবনা।’ কাব্যে বুদ্ধদেবের সেই সংহতির সম্ভাবনাকে আবুল হোসেন তাঁর সমগ্র কাব্যজীবন জুড়ে জাগিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। সেজন্যে তাঁকে বিস্তর সংগ্রাম আর সাধনাও করতে হয়েছে। আমরা দেখবো, প্রথম কাব্য প্রকাশের প্রায় তিরিশ বছর পরে, তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ বিরস সংলাপ (অক্টোবর : ১৯৬৯) প্রকাশিত হয়েছে।

আবুল হোসেনের বিরস সংলাপ কাব্যের সময় থেকে তাঁর মধ্যে আঙ্গিক-সচেতনতার প্রকাশ নানাভাবে দেখা গিয়েছে। এই সময় থেকেই তিনি কবিতায় নিজস্ব কাব্যভাষা ও প্রকরণ নির্মাণ করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। এ-বিষয়ে কবি বিষ্ণু দে বলেছিলেন, ‘শিল্পসাহিত্যে কিঞ্চিৎ স্থায়ী বন্দোবস্তের কারণ মানবচৈতন্যেরই … স্থাবরতার দিকে ঝোঁক। ভাষার একটা স্বাভাবিক স্থিতিপ্রবণতার জন্য রচনার গতিতে আসে দ্বিধা। গতিতে গা ভাসালে অবশ্য খুঁটিতে বাঁধা মনের দ্বিধাও নিষ্প্রয়োজন।’ আবুল হোসেন নিশ্চিতভাবেই এর বিপরীতে নিজেকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার নিদর্শন বিরস সংলাপের কবিতাগুলিতে প্রত্যক্ষ করি আমরা। এর একটি অনুপম দৃষ্টান্ত ‘মেহেদীর জন্য’ কবিতাটি। যেখানে কবি নিজের ভেতরের টানটান আবেগ ও উত্তেজনাকে সংযমের প্রখরতায় আবেষ্টিত রেখে বলেছেন –

মেয়ে, তোমার সরাও বাহু দুটি।

বাহু তো আর শিকল নয়, বলেছে তাকে লতা

এবং লতা বড় নরম,

টানতে গেলে ছিঁড়বে কুটিকুটি।

কবিতাটির সমাপ্তি টেনেছেন কবি এইভাবে –

দেহ তোমার সরাও বিছানায়।

দেহ তো আর পাথর নয়, মাংস আর মেদ,

এবং মাংস মোমের মতো,

একটুখানি তাপেই গলে যায়।

সজীব আর সতেজ কবিতা বলতে আমরা যা-যা বুঝে

থাকি, এই কবিতাটি যেন তার সবকটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়েছিল। এখানে ভাব-ভাষা-ছন্দ – এসবের কোনোটিরই অভাব যেমন নেই, তেমনই নেই এসবের বাহুল্য। আমাদের মনে পড়ে, কবি বিষ্ণু দে-র সেই অমোঘ মন্তব্য – ‘সজীব রচনাতে তাই শিল্প ও শিল্পবস্তু, বিষয় ও টেকনিকে টান পড়ে জ্যাবদ্ধ টঙ্কারে ধনু ও ছিলার টানের মতো।’ তাঁর কবিতায় ‘ধনু ও ছিলার সেই টান’ আবুল হোসেন আমৃত্যু বজায় রাখার জন্যে প্রাণপণে যুদ্ধ করে গিয়েছেন। যে-কারণে আমরা তাঁর কবিতায় আবেগের পরিচর্যা দেখি, কিন্তু উচ্ছ্বাসকে দেখতে পাই না; কবির কবিতায় কল্পনা আর অভিজ্ঞতার সমন্বিত নিদর্শন দেখা যায়, কিন্তু ভাবালুতা দেখা যায় না। আমরা বলতে পারি, তাঁর লিখনভঙ্গিমায় এই প্রবণতার প্রকাশ দেখা গিয়েছিল বলেই তিনি পাঠক ও সমালোচক – দু-তরফের পক্ষ থেকেই সেদিন প্রশংসিত হয়েছিলেন।

৩.২

অন্যসব আধুনিক কবির মতো আবুল হোসেনও যে রোমান্টিক ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বুদ্ধদেব বসু বিশ^াস করতেন যে, ‘ ‘রোমান্টিক’ বলতে আমি বুঝি – শুধু একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন নয়, মানুষের একটি মৌলিক, স্থায়ী ও অবিচ্ছেদ্য চিত্তবৃত্তি।’ একজন কবির সেই অবিচ্ছেদ্য চিত্তবৃত্তি থেকেই রচিত হয় ‘দুর্লভা বল্লভা’র মতো কবিতা। যার শুরুটা হয়েছে ঠিক এইভাবে –

তোমাকে চাই তোমাকে চাই ওগো দুর্লভা বল্লভা আমার,

রূপে নয়, সাজে নয়, সায়াহ্নের অন্ধকারে অস্পষ্ট আধো

                                                        আধো

পরিচয় স্বপ্নের মতো, রহস্যনিবিড় বসন্তের লাবণ্যবিলাসে

তৃপ্ত দেহ আকাশে মেলে পাখা, সে প্রণয় আমার তো    

                                                    নয়।

তোমাকে জড়াবো বুকে নিবিড় আলিঙ্গনে, রোমাঞ্চিত

উত্তপ্ত জঘনে জ্যোৎস্নাজ¦লা বোর্খাহীন স্তব্ধ রাতে

গলে যাবে থরথর কপোতি শরীর নিঃশ্বাসে নিঃশ্বসে।

আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্যে এরকম আবেগঘন কিন্তু সংযত আর সংযমের মিশ্রণে রচিত কবিতা খুব বেশি লেখা হয়নি। এরও একটি কারণ রয়েছে। আবুল হোসেন দৃঢ়ভাবেই বিশ^াস করতেন যে, ‘নবীন কবিকে ভিন্ন হতেই হয়। অন্যের মতো হলে তার চলে না। তাকে তার ফর্ম নিজেকেই আয়ত্ত করতে হয়।’ সেটা কীভাবে আয়ত্ত করতে হবে? – এর উত্তরে আবুল হোসেন জানিয়েছিলেন, ‘কবিতায় নতুন পথ খুঁজতে, নতুন সুর, স্বর যোগ করতে হলে ফর্ম বদলাতে হয়, বলার ভঙ্গি, বলার শব্দ, বলার কথা পাল্টাতে হয়।’ কিন্তু সেই পাল্টানোটাও এমনভাবে শৈল্পিক দক্ষতায় করতে হবে ‘যাতে শুধু আদলই নয়, তার ভেতরের বস্তুটাও নতুন হয়ে ওঠে। আনকোরা হয়ে দেখা দেয়। এটা খুবই দুরূহ ব্যাপার। এর জন্যে প্রচুর খাটতে হয়, মাথা ঘামাতে হয়।’ কবির সাধনা সেই পরিশ্রমেরই সাধনা, মাথা খাটানোরই সাধনা। সেক্ষেত্রে আবুল হোসেন সফল হয়েছিলেন।

মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্ট (Robert Frost) একজন সফল কবিকে ‘systematic thinker’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। কারণ তাঁর কাব্যচেতনার মধ্যে সবসময়ই একটা গাম্ভীর্য থাকে (inner seriousness), যার অনেকটাই অন্তর্গূঢ়, অপ্রকাশ্য। এইটিই তাঁর কবিতায় আবেগের ভারসাম্য রক্ষা করে চলে, আঙ্গিকের সমান্তরালে। প্রখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসু মনে করতেন, শিল্প-সাহিত্যের বেলায় শুধু ‘টেকনিকের তলোয়ার খেলাই যথেষ্ট নয়। আবার, ভালো খেলোয়াড় যে, তার খেলাও অন্যরকম – বাইরের নিয়ম-কানুন খতিয়ে বোঝা যায় না।’ তিনি এ-ও বলতেন, ‘যে ব্যক্তি শত্রুর চোখ দেখে বোঝে, তলোয়ার দেখে না, সেই ওস্তাদ – তার কখনও ভুল হয় না।’ আর তাই তিনি শিল্পীর প্রতিভার সঙ্গে মনীষার এক অভিন্ন সংযোগ চেয়েছিলেন সবসময়। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, ‘শিল্পলক্ষ্মীর বাসা হৃদয়ে, তার চলার রাস্তা হৃদয় হতে হৃদয়ে। ঐশ^র্যে নয়, পাণ্ডিত্যে নয়, জ্ঞানে নয়।’ আর এরই সূত্রে তিনি বলেছিলেন, ‘গাছের ফুল যেমন সহজভাবে ফোটে, আসল শিল্পসৃষ্টিও সেইরকম সহজভাবে হতে চায়। হওয়ার পথে বাধা অনেক। বাহিরের বাধা তো আছেই, সব চেয়ে মনের বাধা এড়ানো বড়ো কঠিন। মনের সমতা এলে মন শান্ত হলে তাতেই শিল্পীর প্রেরণা বেগে কাজ করতে পারে।

স্থির-স্বচ্ছ মনে প্রেরণার ছাপও অনেকটা পরিস্ফুট হয়।’

৩.৩

আবুল হোসেন স্বীকার করেছিলেন যে, ‘আমি একসময় বেশ জাঁক করে বলেছিলাম আমি প্রেরণার বসে কবিতা লিখি না।

কথাটা বোধহয় আর কারও হবে। প্রতিধ্বনি আমার। … অভিজ্ঞতা যত বেড়েছে, বুঝেছি কবিতা লেখার বেলায় প্রেরণাই মুখ্য।’ এর কারণ হিসেবে তিনি এই মত প্রকাশ করেছেন, ‘প্রেরণা ছাড়া কবিতা লেখা যায় না বলেও বলব, প্রেরণা পাওয়ার পর অনেক কাজ বাকি থেকে যায়। প্রেরণা নিয়ে কবিকে অনেক মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়।’ আমরা বুঝতে পারি যে, কবিতা রচনার সময় কবির আবেগ, অভিজ্ঞতা, কল্পনা, প্রেরণা সবকিছুর গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েও, আবুল হোসেন পরিশ্রমকে বাদ দিতে পারেননি। কবিতা রচনার সঙ্গে অন্য অনেক কিছুর মতোই তিনি পরিশ্রমের ব্যাপারটিকে নানাভাবে স্বীকার করতেন।

আবুল হোসেন তাঁর কাব্যভাষায় মুখের ভাষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তথাকথিত কাব্যিক ভাষায় বা কৃত্রিম ভাষায় যে আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশটুকু, তা কখনোই স্বাচ্ছন্দ্য পায় না – এইটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।

‘যে-ভাষায় আমরা সারাক্ষণ কথা বলি, আমাদের কাজকর্ম সারি,

আলাপ-আলোচনা করি তা-ই সরাসরি কবিতায়’ নিয়ে এসেছেন আবুল হোসেন। রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে অডেন (W. H. Auden) জানিয়েছিলেন, ‘Frost’s poetic speech is the speech of a mature mind, fully awake and in control of itself.’ সেইসঙ্গে তিনি এটিও মনে করতেন এই কাব্যিক ভাষা ‘is not the speech of dream or of uncontrollable passion’ কবি আবুল হোসেনের কবিতার বেলাতেও আমরা এই প্রসঙ্গটি যদি অনায়াসে যুক্ত করি, সেটা কখনোই খুব অবান্তর মনে হবে না। তাঁর ‘কিমাশ্চর্যম’ কবিতার কয়েকটি চরণ এখানে উদ্ধৃত করছি, আমরা দেখবো কী অনায়াস দক্ষতায় তিনি প্রতিদিনের মুখের বচনকে কাব্যিক ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন – ‘বেঁচে আছি,/ শিরায় শিরায়/ এখনও দুরন্ত রক্তে নাচে,/ ঝাঁঝরা বুকের নীচে হৃৎপিণ্ড আজও/ ডুগডুগি বাজায়,/ এর চেয়ে আশ্চর্য কী আছে।’ এখানে বলে নিই, রবার্ট ফ্রস্ট ছিলেন আবুল হোসেনের অন্যতম প্রিয় কবি। কাব্যে শব্দের, ছন্দের ধ্বনিময়তাকে ফ্রস্ট সবসময়ই গুরুত্ব দিতেন। তিনি মনেও করতেন যে, ‘I think sound is an element of poetry, one but for which imagination would become reason.’ আবুল হোসেনও তাঁর কাব্যে এই বৈশিষ্ট্যটি নানাভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন এবং সেক্ষেত্রে তিনি সফলও হয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত ‘ডি. এইচ. রেলওয়ে’ কবিতাটি কবির সেই সজ্ঞান ধ্বনি ব্যবহারেরই এক উপযুক্ত স্বাক্ষর, যা কি না পাঠকের দিক থেকে তাঁর কবিতায় অন্তর্লীন সুর-মূর্ছনার অভিযোজনের একটি সার্থক শৈল্পিক অভিজ্ঞতাও বটে। এই কবিতায় একটি অংশে এসে কবি শব্দ, ধ্বনিকে এইভাবে ব্যবহার করেছিলেন –

বারবার ছাড়বার নামবার থামবার ঘূর্ণিত চক্রে

চক্ষে বক্ষে অন্তরীক্ষে পর্বত ঘর্ঘর

পর্বত পর্বত পর্বত বর্বর বর্বর ঝরঝর পাথ্বর

ঝক্মক্ ঝিক্মিক্ চিক্চিক্ কাঞ্চন ঝন্ঝন্ জংঘা

বর্ষায় ঝম্ঝম্ জানালায় চিত্তের পর্বতে

ঝাউ আর পাইনের হাততালি ডুবিয়ে

উজবেকী একি নাচ নাচেরে

এ কি উড়ো গাড়িরে!

কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক রশীদ করীম এই কবিতাটির প্রসঙ্গে, অনেক বছর আগে বলেছিলেন, ‘ঠিক এই কবিতাটির সঙ্গে তুলনীয় দ্বিতীয় কোনো কবিতা বাংলা সাহিত্যে নেই। সমস্ত ছন্দকে ছত্রখান খানখান নানা খানা করে দিয়েছেন কবি।’ সেইসঙ্গে তিনি এটিও বলতে কোনো ধরনের দ্বিধা করেননি যে, ‘লাইনের শেষে মর্জি মতো মিল বসেছে, উঠে গেছে। যে প্রতিভা সব নিয়মকে লঙ্ঘন করেও নিজের জন্যে এক আলাদা নিয়ম তৈরি করে নেয়, এখানে সেই প্রতিভাকেই দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘অত্যাশ্চর্য অনিয়মের যাদুতে কবিতাটির প্রতিটি শব্দের সঙ্গে পরবর্তী শব্দের মিল কানে সিম্ফনির মতো বাজতে থাকে।’ রশীদ করীম আমাদের সামনে যে-উদাহরণ পেশ করেছিলেন তাতে এরচেয়ে ভালো বিশ্লেষণ এ-রকম কবিতার বেলায় আর হয় না।

কেন হয় না? তার কারণ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর সেই মন্তব্যটি আমরা স্মরণ করতে পারি। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘বলতে গেলে, কবিতা সম্বন্ধে “বোঝা” কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা “বুঝিনে”; কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের কিছু “বোঝায়” না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা “বোঝা” যাবে না, “বোঝানো” যাবে না।’ রবার্ট ফ্রস্ট সম্ভবত এ-কারণেই বলেছিলেন, ‘ÔThe figure a poem makes. It begins in delight and ends in wisdom.Õ’ বুদ্ধদেব বসুও নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিলেন যে, ‘কবিতার ক্ষেত্রে জ্ঞানের কোনো নিজস্ব মহিমা নেই; জ্ঞানের রাসায়নিক সার উজ্জীবিত হয়ে কবিতা হয়ে উঠলে তবে সেটা গ্রাহ্য হয়। শেষ ফল হয় কবিতাই, কবিতাই হচ্ছে আসল।’ কবি আবুল হোসেনের কাব্যচিন্তাও এরচেয়ে খুব বেশি পৃথক ছিল না।

আবুল হোসেন বিশ^াস করতেন যে, ‘আমরা যা কিছু করি তার পেছনে কোনো-না-কোনো একটা প্রেরণা অথবা তাড়না থাকে। … সব কাজের মধ্যে একটা তাগিদ আছে। সেটা কখনও শারীরিক, কখনও-বা মানসিক। যেটা শারীরিক সেটা নিছক প্রয়োজনের ব্যাপার। মানসিক তাগিদের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক, তখন সেটা হয়ে পড়ে ইচ্ছের ব্যাপার। তার ভিত্তি খুশি।’ ব্যক্তির মন ও মননের এই ভালো লাগাটাকেই আবুল হোসেন বলতে চেয়েছেন ‘খুশির ব্যাপার’। তাঁর মতে, ‘ওটা অনেকখানি মনের জিনিস, রুচির ব্যাপার। লেখাটা ব্যাপারটাও একটা কাজ। সুতরাং কেন লিখি তা বলতে গেলে এই প্রয়োজনের ব্যাপারটা যেমন আসবে তেমনি প্রয়োজন ছাড়িয়ে যে তাগিদটা তার কথা উঠবে।’ এই কথাটি বিশদে বলতে গিয়ে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘একজন লোক জীবনধারণের জন্য যেমন ইঞ্জিনিয়ার হয়, ডাক্তার হয়, মাছ ধরে, চাষাবাদ করে, কুমোর হয়, কামার হয়, তেমনি একজন লোক কলম চালায়। লেখাটা তাঁর পেশা হয়ে পড়ে। আর সব পেশার মতোই লেখককে মাথার ঘাম ফেলে লিখেই খেতে পরতে হয়। এই ব্যাপারটা সব সময় আমাদের খেয়াল হয় না।’ আর তারপর নিজের প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি লিখি, লিখতে আমার ইচ্ছে হয় বলেই। কিন্তু অভ্যেসের বশে কখনও লিখি না। জীবিকা অর্জনের জন্যেও না। … লেখাটা আমার নিছক প্রয়োজনের ব্যাপার নয়। … লেখা আমার পেশায় পরিণত হয়নি।’

আমরা বলতে পারি, আবুল হোসেন নিশ্চিতভাবেই এই বিষয়ে সৌভাগ্যবান ছিলেন। যে-কারণে বলতে পেরেছিলেন, ‘লেখাটা আমার খুশির ব্যাপার বলেই আমি কারও মুখ চেয়ে, কারও ফরমাশে লিখি না। কারও উপদেশ-নির্দেশেও উঠি না, বসি না। তার মানে এই নয় যে কারও কথা আমার কানে ঢোকে না। আমি সব কথা, সকলের কথা শুনি। কিন্তু আমি … কারও মন যুগিয়ে কথা বলতে চাই না।’ তাহলে তিনি কবির দায়িত্ব বলতে কী বুঝিয়েছেন? এর উত্তরে আবুল হোসেন বলেছিলেন, ‘আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, লেখক হিসেবে আমার নিজের কাছে ছাড়া আর কারও কাছে আমার কোন দায়িত্ব আছে বলে আমি স্বীকার করি না। যেহেতু আমি সমাজে বাস করি সুতরাং আমার চারপাশে যা ঘটছে, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়ে আমার উপায় কোথায়? আমার চিন্তা, আমার ভাবনা, আমার অভিজ্ঞতা, প্রাত্যহিক জীবনে যাদের সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয় অথবা আমি যা যা দেখি, তাদের সকলের বিবেক এবং চেতনা আমার কবিতায় প্রতিফলিত, প্রতিধ্বনিত হবেই। শুধু তা-ই নয়, এমনকি হয়তো যাদের অথবা যা আমি একান্তভাবে আমার হৃদয়, মনের চোখে ছাড়া দেখিনি, তারও প্রতিফলন ঘটতে বাধ্য।’ কবি-অধ্যাপক-সমালোচক টেইট (Allen Tate) মনে করতেন, কবির কাজ হচ্ছে, ‘he must recreate for his age the image of man, and he must propagate standards by which other men may test that image, and distinguish the false from the true.’ একইভাবে আবুল হোসেনও মনে করতেন ‘কবিও কর্মী হতে পারেন, তবে কবিতা লেখাই তাঁর আসল কাজ।’ তিনি আরো মনে করতেন, ‘কবির একটা সামাজিক ভূমিকা আছে। সমাজের আর পাঁচজনের মতো কবিও সামাজিক জীব। সেও সমাজে বাস করে। সমাজে তারও একটা কাজ আছে। সমাজে যেমন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার দরকার, ময়রা-মুদি-মেছুনি চাই, তেমনি কবিও দরকার। তাঁদের প্রত্যেকের কাজ অবশ্য ভিন্ন। কিন্তু ভিন্ন বলেই কারও কাজ কারও চেয়ে কম অথবা বেশি, দামি কিংবা দরকারী মনে করার কারণ নেই।’ অ্যালেন টেইটও বিশ^াস করতেন, ‘If poetry makes us more conscious of the complexity and meaning of our experience, it may have an eventual effect upon action, even political action.’ টেইট তাঁর বিশ^াসের সঙ্গে এটুকু আরো যুক্ত করেছিলেন, ‘Ôpoetry may influence politics, we conclude that poetry is merely politics, or a kind of addlepated politics.

আবুল হোসেন এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্যের উপসংহারে বলেছিলেন, ‘কবিও কর্মী। কবিতাই তাঁর কাজ। সমাজে তাঁর কাজ কবিতা লেখা। সে কাজটা সে যত ভাল করে করবে, তাঁর সামাজিক দায়িত্ব সে সেই পরিমাণে পালন করল বলতে আমি দ্বিধা করব না। কবির সামাজিক ভূমিকাকে আমি এভাবেই দেখি।’ তাঁর এই দেখাটা ছিল একজন আধুনিক কবির দেখা, তাঁর অভিজ্ঞতার পর্যবেক্ষণ।

অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মধ্যস্থতায় আমরা জানতে পারছি যে, অ্যারিস্টটল ‘অর্থনীতির সঙ্গে, মানুষের সম্পদ আগ্রহের সঙ্গে যোগস্থাপন করেছিলেন মানুষের জীবনের লক্ষ্যের। কেননা, তাঁর চোখে রাজনীতিই ছিল পরম শিল্প। বলেছেন রাজনীতি যেন অর্থনীতি সমেত অন্যান্য বিজ্ঞানকে তার কাজে ব্যবহার করে।’ আবার সেইসঙ্গে সামাজিক সাফল্যের বিষয়ে তিনি মনে করতেন, ‘একজন একক মানুষের নিজের লক্ষ্যটা অর্জনের তো নিশ্চয়ই মূল্য আছে। কিন্তু একটা জাতি বা একটা নগর রাষ্ট্রের অর্জনটা আরো বেশি সুন্দর, আরো ঐশ^রিক।’ কিন্তু অ্যারিস্টটলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও অনেকেই বিশ^াস করতে বাধ্য যে, কবির কাজ একান্তভাবেই তাঁর নিজের কাজ, একক ব্যক্তির কাজ; সমষ্টির ধারণা এখানে খুব একটা-বেশি খাপ খায় না।

অনেকটা সেই কারণেই নিজের সম্পর্কে রবার্ট ফ্রস্ট বলতেন, ‘I am so ordinary. I like the middle way, as I like to talk to the man who walks the middle way with me.’ আবুল হোসেনের চিন্তার মধ্যেও ফ্রস্টের মতোই সেই একই অনুভূতির একটা প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। নিজের সম্পর্কে তাঁর শেষ কথা ছিল এরকম : ‘আমি শুধু নিজের কাজটুকু করতে চেয়েছি।’ এসবের কাব্যময় প্রকাশ তাঁর কবিতায় নানাভাবে দেখা যায়। আর কিসের অপেক্ষা (আগস্ট, ২০০০) কাব্যের সর্বশেষ কবিতায় আবুল হোসেন বলেছিলেন –

আমিও তো সারাজীবন শব্দে শব্দে কথায় কথায়

কখনও ছন্দে, কখনও ছন্দ ছাড়াই

কখনও মিল দিয়ে, কখনও মিল না দিয়েই

কখনও ছন্দ দলি মাত্রা বাক্য পঙ্ক্তি স্তবক

নিশে মশগুল হয়ে

কাটিয়ে দিলাম দিন

সমান উৎসাহে।

আর কীসের অপেক্ষা?

আমি তো আমার কাজ করে গেলাম।

মহাকাল সাক্ষী রইলো, আবুল হোসেন, তাঁর সেই কাব্যনিষ্ঠার প্রতিদান একদিন হয়তো পাবেন। আবার না-ও পেতে পারেন; কিন্তু তাতে ক্ষতি তো নেই। আমাদের সামনে নিজের কাজের প্রতি চূড়ান্ত নিষ্ঠার যে-দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করে রেখে গেলেন, এই প্রজন্মের কাছে তার মূল্য কোনো অংশেই কম নয়। জন্মশতবর্ষে আবুল হোসেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।

সহায়ক-গ্রন্থ

ক. আবুল হোসেন, কবিতাসমগ্র, মনজুরে মওলা-সম্পাদিত, ঢাকা : গতিধারা, ২০১০।

খ. আবুল হোসেনের সঙ্গে কথোপকথন, তারেক মাহমুদ সম্পাদিত, ঢাকা : সূচীপত্র, ২০১০।

গ. আবুল হোসেন : কবির পোর্ট্রেট, জুনান নাশিত-সম্পাদিত, ঢাকা : মিজান পাবলিশার্স, ২০১১।

ঘ. রশীদ করীম, আর এক দৃষ্টিকোণ, ঢাকা : বাংলা একাডেমি, ১৯৮৯।