গোমতী বানের চাঁদ

জ্যোৎস্নার শাদা আলোতে গাছপালার সবুজ কেমন শীর্ণ হয়ে উঠেছে। আকাশে আস্ত একটা চাঁদ, কিন্তু পুকুরের জলের বিচ্ছিন্ন ঢেউয়ের ভেতর চাঁদটা ক্রমাগত ভাঙছে। মৃদুমন্দ বাতাসে বাঁশঝাড়ের মাথা নড়ছে- তির তির, তির তির। 

পুকুরটা তেমন বড় নয়। চৌকোণা, দীঘপাশ প্রায় সমান। একপ্রস্থ জল ভেদ করে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে তাকালে পাড়ের সীমানা অস্পষ্ট হওয়ার কোনো কারণই থাকে না। এমনকি অঝোর ধারার বৃষ্টির দিন বা ঘন কুয়াশার দিনেও নয়। 

পুকুরের পশ্চিম প্রান্তে মূলত মনসুর পাগলার ভিটে। মনসুর পাগলার দোচালা ছনের ঘরটা হেলে গিয়ে উঠোনের দিকে অনেকটাই নুইয়ে পড়েছে। তার একটা মাত্রই ঘর। ঘরটা উঠোনের দক্ষিণে। পাশেই ছোট্ট একটা হেঁশেল। হেঁশেল ঘেঁষে পুকুর থেকে তোলা পলিমাটির দেয়াল।

মনসুর পাগলার মা রমিজা খাতুন উঠোনের পাশে হেঁশেলের দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে। সে বসে আছে একটা পিড়ির ওপর, গুটিসুটি মেরে। খোলা আকাশের নিচে বিধবার ঘোমটা। তার দৃষ্টিটা পুকুরের পুব পাড়ে, কালা মিয়ার বাড়ির দিকে। তার একমাত্র ছেলে মনসুর পাগলা আজ বর সেজেছে। কালা মিয়ার বড়মেয়ে সিতারা বেগমের সঙ্গে তার বিয়ে।

এটা মনসুর পাগলার প্রথম বিয়ে নয়, তৃতীয় বিয়ে। প্রথম বিয়ে উজানপুরের মাজেদা সঙ্গে হয়। দ্বিতীয় বিয়ে হয় রসুলপুরের সালেহার সঙ্গে। তার প্রথম বউ মাজেদা মারা যায় কোনো এক বর্ষার বানে, গোমতী নদীতে। দুর্ঘটনাটা ঘটে দিনের ঠিক মধ্যভাগে। মাজেদা তখন নৌকায় করে বাপের বাড়ি যাচ্ছিল। নৌকাটা মনসুর পাগলাই বাইছিল।

মাজেদার লাশ পাওয়া যায় একদিন পর। ভাটির গ্রাম নেয়ামতপুরের ঘাটে। লাশ পেয়ে মনসুর পাগলার সে কি কান্না। কান্নারও যে একটা অদ্ভুত সুর হয়, সেদিন অনুতপুর-নেয়ামতপুরের মানুষ মন ভারি করে শুনেছিল। 

মনসুর পাগলার দ্বিতীয় স্ত্রী সালেহা মারা যায় এক উঠতি রাতে। সেরাতে জ্যোৎস্নার অদ্ভুত সুন্দর আলো ছিল। তখনো গোমতীতে বর্ষার বান ছিল। বৈদ্যনাথ বিল হয়ে নেমে আসা উত্তরের জোয়ারের জলে সেবার গোমতী নদী কূল হারিয়েছিল। সে সালেহাকে নিয়ে নৌকায় করে পুনোয়ারার মেলা দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু নৌকাটা নদীর ভাটিতে আসতেই বিচ্ছিন্ন স্রোতের পাঁকে পড়ে পুরোপুরি উল্টে যায়। নৌকাডুবির পর মধ্যরাতে মনসুর পাগলার সে কী আর্তনাদ! সাতদিন পর্যন্ত খুঁজেও সালেহার লাশ পাওয়া যায়নি।

তারপর দীর্ঘদিন মনসুর পাগলা আর বিয়ে করেনি। প্রায় দশটা বছর। আজ দশবছর পর সে সিতারাকে বিয়ে করছে।

দুই

পুকুরের উত্তরপারের বাঁশঝাড়টা যেখানে শেষ হয়েছে, ঠিক সেখান থেকে বাঁক ফিরতেই পুবপারে কালা মিয়ার ভিটে। কালা মিয়ার বসতঘরটা টিনের। উত্তরের ভিটে। অবশ্য দক্ষিণের ভিটে তার আরেকটা ছনের ঘর আছে। দুই ঘরের মাঝখানে এক চিলতে উঠোন। উঠোনের পরে কচুর জংলা আর গোড়ালি অবধি ডেবে যাওয়া জলের খাঁদ। তারপরই বৈদ্যনাথের বিল।

কালা মিয়ার মেয়ে সিতারা বেগম হাঁটু দুটো ভাঁজ করে হোগলার চাটিতে বসে আছে। শোলার বেড়া ঘেঁষে বাঁশের একটা খুঁটিতে তার শরীরটা হেলান দেওয়া। তার পরনে পাঁচ বছর আগের সেই বিয়ের শাড়িটা। ব্লাউজ-পেটিকোটও সেই পাঁচ বছর আগের। এতদিন সে ওগুলো তোরঙ্গে তুলে রেখেছিল। 

উনায় কুপিটা শাঁই শাঁই করে জ্বলছে। সাধারণত এ-বাড়িতে কুপির সলতে এতটা বাড়িয়ে রাখে না। তেল খরচ বাঁচায়। কিন্তু আজ সেতারা বেগমের বিয়ে। কাজিবাড়ির কল্যাণে তাদের গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে ঠিকই, কিন্তু আজকাল সাতদিনে একদিন বিদ্যুৎ আসে না। যখন বিদ্যুৎ আসে, তখন কালা মিয়ার দুই ঘরে দুটি বাল্ব কেমন পার্বণী ঢঙে জ্বলে।

আজ বিদ্যুৎ নেই বলে কিছুক্ষণ আগে কালা মিয়ার ছেলে কাওসার নিজে নিজেই গালিগালাজ করে বিদ্যুৎ অফিসের একদফা উদ্ধার করে গেছে। কিন্তু সিতারা বেগমের মনে এ-ব্যাপারে তেমন কোনো বিকার নেই। সে অন্যমনস্কভাবে উনার কুপিটার দিকে তাকিয়ে আছে। পাঁচ বছর আগে তার আরেকটা বিয়ে হয়েছিল। সাতগাঁও দক্ষিণে, করিমপুরে। তার স্বামীর নাম ছিল রহমত আলী। দেখতে-শুনতেও বেশ ছিল। তাকে বেশ সোহাগ করত। কিন্তু বিয়ের ছয়মাস যেতে না যেতেই মাঘমাসের এক শীতের মধ্যরাতে সে শ^শুরের দুই হালের বলদ চুরি করে সেই যে পালায়, এরপর আর ফিরে আসেনি। এমনকি তার টানেও নয়। সে এখন কোথায় আছে ও কী করছে, কেউ জানে না। বছর দুই আগে তার বাপ কালা মিয়া তাকে দিয়ে রহমত আলীর বাড়িতে তালাকনামা পাঠিয়ে দেয়।

কিন্তু গত দুই বছরে সিতারা বেগমের তেমন কোনো বিয়ের কাজ আসেনি। একদিন কালা মিয়া হতাশ ও বিরক্ত হয়ে মনসুর পাগলার মা রমিজা খাতুনের কাছে মেয়ের বিয়ের কথা তোলে। একই জ্ঞাতিগোষ্ঠী, পুকুরের এপার আর ওপার। না হয় মনসুর আলী পাগলা টাইপের। এরা আগে তার দুটো বউ গোমতীতে ডুবে মরেছে। কিন্তু সেটা তো দশ বছর আগের ঘটনা।

উনায় কুপির আলোটা তিরতির করে কাঁপছে। সলতের মাথায় তিনটা-চারটা ফুট পড়েছে। কয়েকটা উলুপোকা আলোকে কেন্দ্র করে ওড়ছে। একটা টিকটিকি কুপির ঠিক কাছাকাছি শোলার বেড়ায় চুপ করে বসে আছে। সলতের মাথার ফুটগুলোকে সিতারা বেগমের টোকা মেরে ফেলতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সে ইচ্ছেটা দমন করে নিল। সে বসা থেকে নড়ছে না। কী একটা স্তব্ধতা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। এ-মুহূর্তে তার আগের স্বামী রহমত আলীর কথা মনে পড়ছে। চোর হলেও রহমত আলীর ভেতর একটা প্রাণ ছিল। সারাক্ষণ হাসত, প্রেম-ভালোবাসার কথা বলত। একবার তার সঙ্গে সে পুনোয়ারার মেলায় আনারকলির পালা দেখতে গিয়েছিল। স্বামীর পাশে বসে সে আনারকলির  পালা দেখতে দেখতে নিজেই কেমন আনারকলি হয়ে উঠেছিল।

সিতারা বেগম ভাবল, আজ আবার তার বিয়ে। যার সঙ্গে তার বিয়ে, সে তার চাচাত ভাই। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে, সে পাগল। মাঘমাসের শীতেও সে শুধুমাত্র লুঙ্গি পরে খালি গায়ে গ্রামের এপাড়া-ওপাড়া করে, মধ্যরাতে দুই বাড়ির মাঝখানের পুকুরটায় সাঁতরায়, অসংখ্যবার ডুব দেয়। সুযোগ পেলে লাঠি নিয়ে মানুষ দৌড়ায়। যদিও গরমকালে তার মাথায় কোনো ছিট ওঠে না।

তিন

উত্তর ঘরের খোলা দরজা গলে কুপির আলো উঠোন বেয়ে দক্ষিণ ঘরের কুপিতে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণের ঘরে হোগলার চাটাইর ওপর আজ ফুলতোলা চাদর বিছানো হয়েছে। মনসুর পাগলা সেই ফুলতোলা চাদরের ঠিক মাঝ বরাবর বসেছে। তার পরনে পলেস্টারের পাঞ্জাবি আর নীল পাড় দেওয়া শাদা লুঙ্গি। মাথায় একটা টুপি। তাকে একজোড়া নাগড়াও কিনে দেওয়া হয়েছে। কালা মিয়া গত পরশুদিন এসব ধনিরামপুর হাট থেকে কিনে এনেছে।

মনসুর পাগলা তার বিয়ে উপলক্ষে যৌতুক হিসেবে কালা মিয়ার কাছে একটা মোবাইল ফোনও চেয়েছিল। চ্যাপ্টা মোবাইল ফোন। তাদের গ্রামের সবাই মোবাইল হাতে হ্যালো-হ্যালো করে কথা বলে আর কীসব দেখে। তারও শখ, সে হ্যালো-হ্যালো করবে আর চ্যাপ্টা মোবাইলটায় ওই সব ভিডিও-টিডিও দেখবে। 

কালা মিয়া অবশ্য মনসুর পাগলাকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিবে বলে আশ^াস দিয়েছে। আগামীবার রামচন্দ্রপুরের বড়বাজারে গেলেই সে কিনে দিবে। কিন্তু সে আশ্বাস দিলেও মনে মনে তাকে কয়েক দফা গালিও দিয়েছে, ‘লওয়ের পুত, বাদাইম্যা, ভাত খাইতে ভাত পায় না, অর হাউস হইছে মোবাইল ফোনে হ্যালো হ্যালো করনের। ভিডিও দেখবে নে …। লওয়ের পুত …।’

কুপিটা মনসুর পাগলার ঠিক সামনে।

কুপির ডানপাশে দক্ষিণপাড়ার সিদ্দিক মেম্বার বসেছে। সে অনবরত পান চিবাচ্ছে। পানের কষ ঠোঁটের কোণ বেয়ে দাড়িতে এসে পড়েছে। দক্ষিণপাড়া মসজিদের আসকর আলী মৌলবিও এসেছেন। তিনি বসেছেন মনসুর পাগলার ঠিক উল্টোপাশে। আসকর আলী মৌলবির পাশে মসজিদের মোয়াজ্জিন জব্বার আলী বসেছে। কুপির বাঁ-পাশে কালা মিয়া আর কাওসার বসেছে। বিয়েতে বাইরের মানুষ বলতে কাওসারের এক দোস্ত এসেছে। সে বসেছে কাওসারের ঠিক পেছনে।

ওদের খাওয়াদাওয়া বেশ খানিকক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে। মুরগির গোশত, শোলমাছের ঝুল ও মাসকলাইর ডাল। সঙ্গে লালচালের ভাত। ভাত খাওয়ার পর পায়েসের ব্যবস্থাও ছিল। খেজুরের গুড়ের পায়েস।

গরমকালে মনসুর পাগলার মাথায় এমনিতেই ছিট থাকে না, কিন্তু আজ যেন সে আরো বিকারহীন। সে আজ চোখে সুরমা দিয়েছে। তার ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি কুপি হয়ে থেমে থেমে সবার চেহারায় ওঠানামা করছে। খাবার বেশ ভালো ছিল। ভালো খাবার পেটে পড়লে এমনিতেই তার দৃষ্টি ঘুমে নিস্তেজ হয়ে আসে।

সিদ্দিক মেম্বার পিকদানিতে পিক ফেলে গম্ভীর গলায় বলল, হুজুর, বিয়াডা পড়ায়ে ফেলেন।

আসকর আলী মৌলবি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে বললেন, জি, মেম্বারসাব।

কালা মিয়া, কাওসার ও জব্বার আলী সামান্য এগিয়ে মনসুর পাগলাকে কেন্দ্র করে খুব কাছাকাছি গিয়ে বসল। আসকর আলী মৌলবি দুরুদ পড়তে শুরু করলেন। তার দুরুদ পড়ার পাশাপাশি পরিবেশটায় একধরণের নিস্তব্ধতা নেমে এল।

ঠিক তখনই মনসুর পাগলা দাঁত বের করে হেসে ফুঁ দিয়ে কুপিটা নিভিয়ে ফেলল।

চার

কালা মিয়ার বাড়ির উত্তরের বাঁশঝাড় ও পুবের কচুর জংলা এগিয়ে গিয়ে যেখানে কোনাকুনি সন্ধি করেছে, ঠিক সেখান থেকে খানিকটা এগিয়ে গেলে অনুতপুরের উত্তরপাড়ার শেষ। তারপর বিস্তীর্ণ বৈদ্যনাথের বিল। এবারের শ্রাবণ মাসে বৈদ্যনাথের বিলে উত্তরের জোয়ারের জল বাড়তে বাড়তে গলা অবধি উঠে গেছে।

বৈদ্যনাথের বিলে জোয়ারের জল বাড়তে শুরু করলেই কালা মিয়া ও কাওসারের ব্যস্ত দিন শুরু হয়। এমনিতে সারাবছর কাজিদের জমিতে খেতমজুরের কাজ করলেও জোয়ারের এ-সময়টায় ওরা মাছ ধরায় বেশি সময় দেয়। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অব্দি ওরা বিভিন্ন ধানিজমির ধারে গিয়ে খাড়াজাল পাতে। রাত পোহানোর আগে আবার সেই খাড়াজাল তুলে মাছ নিয়ে আড়ংয়ে যায়। মাঝেমধ্যে বড়সড় মাছ পেলে রামচন্দ্রপুর বড়বাজারে চলে যায়।

কালা মিয়ার বড় সম্পদ বলতে একটা দুধের গাই, একটা বলদ ও একটা মাছ ধরার ছোট্ট নৌকা। নৌকাটা সবসময় বাঁশঝাড়ের পাশে একটা খুঁটিতে বাঁধা থাকে।

আজ কালা মিয়া ছেলেকে নিয়ে খাড়াজাল পেতে সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরতেই মনসুর পাগলা ও সিতারা বেগম চুপিসারে খুঁটি থেকে রশিটা খুলে নৌকাটা নিয়ে বের হলো। ওদের আগেরই পরিকল্পনা ছিল যে, ওরা আজ নৌকাটায় করে পুনোয়ারায় যাবে।

আজ রাতে পশ্চিমের পুনোয়ারায় রব্বান মস্তানের ওরস হবে। কিবরিয়া বয়াতির গানের আসর। সঙ্গে মেলা ও যথারীতি পালাগান। আজ আনারকলি পালা হবে।

বৈদ্যনাথের বিল ধরে ছোট ছোট দুই গাঁও পেরিয়ে যেতেই গোমতী নদী। গোমতী নদীর ওপারে তিন-চারটা বসতবাড়ির সমান উঁচু জায়গা নিয়ে পুনোয়ারার ওই স্থানটায় মেলা বসে। রব্বান মস্তানের ওরস হয়। রাতভর পালাগান, বয়াতির গানের আসর, মেলায় কত কি জিনিসপত্র কেনাবেচা হয়! ভোরবেলায় সারি বেঁধে বসিয়ে কলাপাতায় ওরসের খিচুড়ি আর গরুর গোশত। প্রতিবছর নতুন নতুন পালাগান হয়। কোনো বছর সিরাজদৌলা পালা, কোনো বছর গুনাইবিবি, কখনো রহিম বাদশা-রূপবান কন্যা, কখনো বেহুলা সুন্দরী। প্রায় পাঁচ বছর আগে আনারকলির পালা হয়েছিল। এ-বছর আবার আনারকলির পালা হবে।

আনারকলির পালা! সিতারা বেগম ভাবল, একেই বলে সময়ের ফের। পাঁচবছর আগে সে এমনই এক রাতে পুনোয়ারার মেলায় তার আগের স্বামী রহমত আলীর সঙ্গে আনারকলির পালা দেখতে গিয়েছিল। আজ আবার সে তার নতুন স্বামী মনসুর পাগলার সঙ্গে একই পালা দেখতে যাচ্ছে।

মনসুর পাগলা লগি ঠেলছে। জলের শব্দ হচ্ছে – ছলাৎ ছলাৎ ছলাৎ। লগি ঠেলার শব্দ – ক্যায়াত-ক্যায়াত। নৌকাটা তির তির করে চলছে।

দুই-একটা বড়মাছের লেজের ঝাপটার শব্দ। ব্যাঙগুলো অনবরত ডাকছে – ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, কটর কট, কট কট।

সিতারা বেগম নৌকার মাথায়, গলুইতে বসে আছে। তার মাথায় আধাঘোমটা। সে বসে আছে হাঁটু ভেঙে, কুঁজো হয়ে। সে খানিকক্ষণ পর পর মনসুর পাগলাকে দেখছে। ভরাট জ্যোৎস্নার নিস্তব্ধতা যেন তার ওপর থমকে রয়েছে।

ওদের বিয়ের প্রায় একমাস হয়ে গেছে। এরই মধ্যে মনসুর পাগলার প্রতি সিতারা বেগমের ভিন্ন একটা অনুভূতি গড়ে উঠেছে। যাকে সে আগে একজন পাগল হিসেবে জানত, হোক সে জ্ঞাতিগোষ্ঠীর কেউ, তার চাচাতো ভাই। পাগলামির ছাট উঠলে হয় সে মানুষ তাড়াত, নাতো রাতভর পুকুরের এপার-ওপার করত। ভয়েও সে কোনোদিন তার কাছে ভিড়েনি। কিন্তু আজ সে-ই তার স্বামী। বিয়ের একমাসে সে সত্যি তাকে অন্যভাবে পেয়েছে। বিয়ের প্রথম রাতেই বলির পাঁঠার মতো ভয়টা কেটে গেছে।

নৌকাটা জ্যোৎস্নার ভেতর কেমন জলের সিঁথি কেটে চলছে। মনসুর পাগলা লগি ফেলে মাঝেমধ্যে বৈঠা বাইছে। অনুতপুরের পর মুকিমপুর। বৈদ্যনাথ বিলের পুবে ধনিরামপুর। মুকিমপুরের ওপাশটায় তারাকান্দি। গ্রামগুলোর মাঝখানে বৈদ্যনাথের বিলটাকে যেন হাতের তালুর মতো দেখাচ্ছে।

বিলের জল প্রায় গলা অবধি। নৌকার দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত বোরো ধান কেমন সিঁথি কেটে কেটে এগিয়ে গেছে। ধানগাছের ওপর দক্ষিণের বাতাস বইছে- শন শন, শন শন। কাছে কোথাও একটা ডাহুক ডাকছে।

অনুতপুর, মুকিমপুর, তারাকান্দি, রসুলপুর আর ধনিরামপুর নিয়েই গোমতীর ভাটি অঞ্চলটা দাঁড়িয়ে আছে। আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টির জল ও উত্তরের জোয়ারের জল যখন বিলে নেমে আসে, তখন গোমতীর বান আর বৈদ্যনাথ বিলের জোয়ারের জল একাকার হয়ে প্রতিটা গ্রামের প্রত্যেকটা পাড়া যেন দ্বীপের মতো ভাসে। রাতের বেলায় আলো দিয়ে বাড়িগুলোকে নিশানা করা হয়।

মুকিমপুর গ্রাম পেরিয়ে তারাকান্দি গ্রামের পাশ দিয়ে বৈদ্যনাথ বিলের ধানিজমির সিঁথিকাটা জলের সরুপথটা পেরিয়ে নৌকাটা গোমতী নদীতে এসে পড়ল। মনসুর পাগলা এবার বেশ শক্ত করে লগি ঠেলতে শুরু করল। গোমতী নদী ধরে খানিকটা পশ্চিমে যেতেই ওপারে পুনোয়ারার মেলার স্থান। একটা বড় বটগাছের নিচে মেলাটা বসে।

গোমতী ধরে সামান্য যেতেই সিতারা বেগম দূর থেকে পুনোয়ারার মেলার অসংখ্য আলোর ঝিলিক দেখল। ধূসর জ্যোৎস্না ছাপিয়ে আলোগুলো বেশ স্পষ্ট।

ঠিক তখনই মনসুর পাগলার মাথায় পাগলামি চাপল।

গোমতী নদীতে বর্ষা আর জোয়ারের বানে স্রোত খুব বেশি। স্রোতগুলো মোচড় দিয়ে জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাওয়া ঘোলাজলকে আরও ঘোলা করছে। জলের শব্দ হচ্ছে – কল কল, কল কল। দক্ষিণের বাতাস ছাপিয়ে স্রোতের শব্দ – শোঁ-শোঁ, শোঁ-শোঁ। স্রোতের ভেতর অসংখ্য বিচ্ছিন্ন স্রোত। নৌকাটাকে কোনোমতেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

নৌকাটা বিচ্ছিন্ন স্রোতের মোচড়ের সঙ্গে তাল হারিয়ে ঘুরতে শুরু করল।

মনসুর পাগলা লগি ছেড়ে দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে গেল।

সিতারা বেগম ব্যস্ত গলায় বলল, বৈঠা ধরেন। নাইলে নাওডা উল্টায়া যাইবে কিন্তু। তাড়াতাড়ি বৈঠা ধরেন। 

মনসুর পাগলা বৈঠা ধরার বদলে নৌকাটাকে দুই পা দিয়ে নাচাতে শুরু করল।

সিতারা বেগম ভয়ার্ত গলায় বলল, আহা এমন কইরেন না-তো। এমন কইরেন না।

মনসুর পাগলা এবার বিজাতীয় শব্দ করে উঠল, ইঁ ইঁ ইঁ, ইঁ ইঁ ইঁ! সে দুই পা দিয়ে নৌকাটা আরো জোরে নাচাতে শুরু করল।

সিতারা বেগম এবার আর্তনাদ করে উঠল, আহা, আহা, করাতছেন কী, করতাছেন কী, নাওডা তো ডুইবা যাইবো, করতাছেন কী!

সিতারা বেগমের কথা শেষ না হতেই জল আর স্রোতের শব্দ ছাপিয়ে আরেকটা শব্দ হলো – ধপাস।

নৌকাটা উল্টে গেল।

সিতারা বেগম শাড়িটাতে প্যাঁচিয়ে গিয়ে ডুবতে ডুবতে একবার ভেসে উঠল। একবার সে সাঁতার কাটারও চেষ্টা করল। কিন্তু নদীর বড় একটা স্রোতের পাঁকে পড়ে সে আর কুলিয়ে উঠতে পারল না। ডুবে যাওয়ার আগে সে গোমতীর ঘোলাজল আর বানের চাঁদে মনসুর পাগলাকে শেষবারের  মতো আরেকবার দেখল।

এদিকে মনসুর পাগলা উল্টে যাওয়া নৌকাটা ধরে ভাসতে ভাসতে জোরে জোরে আর্তনাদ করে উঠল, অ, কেডা আছো গো, আমার বউরে বাঁচাও। আমার বউ ডুইবা গেছে গো। অ, কেডা আছো গো…।