চোস্ত পায়জামা

শিঙ্গারদানির  তলার সবুজ পেটমোটা পোটমেন্টের ভেতরটা ঘাঁটাঘাঁটি করতাম জারের কাপড়ের বাস নাকে পাওয়ার লালচিতে।

তেলাপোকায় কাটার ভয়ে শীতের কাপড়গুলোর ভাঁজে ভাঁজে মার্বেলের মতো সাদা গোল গোল ন্যাপথলিনের গুলি ঢুকানো থাকতো। পোটমেন্টের ডালা তুললে কিছুটা গন্ধ নাকে ঢুকে সুড়সুড়ি দিত, বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগতো। ন্যাপথলিনকে তেলাপোকার ভয় পাওয়ার রহস্যটা কী? কোনো নেশাদ্রব্য ঘুম পাড়িয়ে দেয়?

শীতের কাপড় বলতে বড়দের শাল, চাদর। ফ্লানেলের কাপড়ের ছোটদের শার্ট, পায়জামা, কোনটা যে কার বলার উপায় নাই। পাঁচ ভাই যার যেটা গায়ে লাগে। বাচ্চাদের শরীর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তো বাড়েই, কমে তো আর না। বড় ভাইয়েরটা ছোট ভাই পায়। বোনেরা তখনো আমাদের সংসারে আসেনি, আরো কয় ভাই ও বোন সামনে জন্মাবে। আমরা হবো মোট দশ ভাই-বোন। সাত ভাই তিন চম্পা বোন। ততোদিনে আমি আরো বড় হয়ে যাব। দয়াগঞ্জ রেললাইনের ঢালে মারোয়াড়ি নাপিত তার দুই হাঁটুর মধ্যে  আমার মাথা ঠেসে ধরে মাথার চুল কেটে দিতে পারবে না। আমি পরে কবিদের মতো ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল রাখতে শুরু করবো।

পোটমেন্ট ঘাঁটতে ঘাঁটতে চোস্ত  পায়জামাটা হাতে উঠে আসে। অনেক লম্বা আর চিপা পায়জামা। এতো লম্বা যে মনে হয় তিনটা বড় মানুষ ভেতরে ঢুকে যাবে। আর চিপা হচ্ছে বকের লম্বা ঠ্যাঙের মতো। জানতে পারি যে, এটাতে কষ্ট করে হলেও আমার বাবা আলী আক্কাস তার দুই পা ঢুকাতে পারে। পরে হাতির মতো শুঁড় তোলা একজোড়া নাগরাও পাই কাপড়ে পেঁচানো। তখন তখনই না, আরো কিছু পরে খোঁজখবর করে জানতে পারি, আমার বাবার নাটকের পোশাক, বাবা নাটকে পার্ট করত। নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জ মুড়াপাড়া জমিদারবাড়ির নাটমন্দিরে পূজা-পার্বণে নাটক হতো। আলী আক্কাস সে-নাটকে চোস্ত পায়জামা, নাগরা পরে অভিনয় করেছে। এই খবরে আমার মনে চমক লাগে। আমি ততোদিনে লায়ন, নাগরমহল, মুকুলে সিনেমা দেখেছি, বাপ-মায়ের সঙ্গেই। একবার মনে হয় লতু চাচা নিয়ে গিয়েছিল ইংলিশ বই দেখতে, সেটাতে বেশি ফাইটিং আমার ভালো লাগেনি। ওইটা বাদে অন্য সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের গোলগাল সুন্দর মুখ আমি চোখ বুজে মনে করতে পারি, সবার চেহারা চিনি, নাম জানি। ওদের কাউকে মনে হয় না এই দুনিয়ায় থাকে। আর আমার বাবা যেহেতু আমাদের সঙ্গে থাকে, তার সব জানি, বুঝি, বেশি খাটো, দেখতে কালো, গোঁফঅলা, শুঁটকা-পটকা একটা মানুষ, মাথার চুল শুধু ঢেউ খেলানো, ওইরকম একটা কিছু-না-লোককে নাটকে পার্ট দিতে যাবে কেন? আমি বুঝতাম না। তবে আমার বুঝ হওয়ার পর, বাবা নাটকে গেছে আমি দেখিনি, শুনিওনি।

তবে মুড়াপাড়ার কথা পরে আরো শুনেছি। আমার বাবা আলী আক্কাস যে রোকনপুর করিম ড্রাগ হাউসে চাকরি করে তারা মুড়াপাড়া এলাকার মুসলমানদের মধ্যে নামিদামি লোক, প্রায় জমিদার মাপের। মুড়াপাড়া রাজবাড়ি তৈরি করেন রাম রতন ব্যানার্জি। এরপর তাঁর কয়েকজন বংশধর কর্তৃক রাজবাড়ি সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্তিতে মুড়াপাড়া রাজবাড়ি ছেড়ে দিয়ে বংশধরেরা কলকাতা গমন করেন। হিন্দু জমিদারদের আমলে পূজা-পার্বণে রাজবাড়ির নাটমন্দিরে নাটক বা অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। বাবা মনে হয় করিম ড্রাগ হাউস পরিবারের সূত্রে কোনো কোনো নাটকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়।

আমি করিম ড্রাগ হাউসে গেছি। ওই বাড়ির মেয়ে রওশন আরা। নাচের মেয়ে। সিনেমায় তো দেখেছি, নায়িকাদের নাচতে হয়, গান গাইতে হয়। রওশন আরাও কি অভিনয় করতেন, আলী আক্কাস যে-নাটকগুলোতে থাকতেন! আমার ইচ্ছে হতো বাবার কাছ ঘেঁষে বাবার চোস্ত পায়জামা, তার  নাটকের খুঁটিনাটি জানি। জল-জঙ্গলের ঝুপড়ির ভেতরকার পুতিগন্ধময় পরিবেশ থেকে আমার পলায়নের বাহন ছিল ন্যাপলিনের গন্ধমাখা চোস্ত পায়জামা। বাবা আমাদের চড়-চাপড়ের ওপর রাখতো, ধমকাধমকি, বউকে মেরে ঝিকে শিক্ষা, আমার মা প্রায় রোজই স্বামীর হাতের মার খেতো, তা দেখে আমরা সোজা হয়ে থাকতাম। অহেতুক দুর্বিনীত, অসভ্য, বর্বর মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া যায় না, তা পিতা, স্বামী হলেও। তাও আমার জেনে রাখা দরকার ছিল, আলী আক্কাসের চরিত্রের বৈপরীত্যের কথা, তার নাটকে অভিনয়, শিল্পীচরিত্রের কথা। তার চরিত্রের কোনটুকু আমি নেব বা নেব না।

এখন আমি দেখি যে, আমি কিছু কিছু কাজ করি যেগুলো আমার করার কথা নয়; সেগুলো আমার  জ্ঞান, আমার চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে যায় না। কিন্তু সেগুলো আমি করতে বাধ্য হই। তখন কেন যেন মনে হয় আলী আক্কাস ওগুলো আমাকে দিয়ে গেছে। দশ ছেলেমেয়ের মধ্যে যে-কোনো কারণে আমাকেই যেন বেশি পরিমাণে দিয়েছে। আমি কলেজে পড়তে যাওয়ার সময় হাটখোলা হরদেও ফ্যাক্টরির সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করি। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার সেটা বাসের রাস্তা। ছোটখাটো তখনকার মুড়ির টিনের বাস। ওই বাসগুলো কি মুড়াপাড়া ছুঁয়ে যায়? হঠাৎ করে আমার হাঁটার ভঙ্গি নায়কোচিত হয়ে যায়, কপালের ওপর এসে পড়া রেশমের মতো আমার ঝাঁকড়া চুলগুলো ‌ হাতের আঙুলে তুলে নিয়ে মাথার ওপর পাটপাট করে দিই। সেটা আমার দিবাস্বপ্ন দেখার সময়। মনে হয়, আমার পশ্চার, ভঙ্গি, চেহারা, ছিপছিপে ফিগার দেখে দুই পাকিস্তানের নামী সিনেমা পরিচালক ব্রেক করে তাঁর গাড়ি প্রায় আমার গায়ের ওপর থামিয়ে তাঁর সিনেমার নায়ক হওয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি নাকি দেখেই বুঝেছেন আমার রক্তের মধ্যে অভিনয় আছে। রেললাইনে কমলাপুরগামী ট্রেনের আচমকা হুইসেলে আমার স্বপ্নের ঘোর কেটে যায়। আরেকটু বিলম্বে এই ট্রেনের চাকায়ই আমি কাটা পড়তাম। তখন আমার যুক্তি-বুদ্ধি কাজ শুরু করে। ষোলো বছরের ছেলেকে কে নায়ক বানায়? তাহলে নায়িকার বয়স হবে কত?

জানি না আমার বাবার মনে কী ইচ্ছা ছিল, মাঝেমধ্যে আমাকে তার সিনেমা দেখার সঙ্গী বানাতো। ১৯৭০ সালের এপ্রিলে গুলিস্তান সিনেমা হলে বাবা আমাকে জীবন থেকে নেয়া দেখায়। সিনেমা চলার সময় আমার হাতটা উঠিয়ে নিয়ে পর্দার দিকে দেখিয়ে বলে, ওইটা রওশন জামিল, করিম সাহেবের মেয়ে।  নাচ ছাড়া এখন সিনেমাও করে। মুখটা আমি মেলাতে পারি। আমি কয়েকবারই তাকে করিম হাউসে দেখেছি। একবার বড় করে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। একটা বড় হলরুমে মেঝেতে কার্পেট বিছিয়ে দিয়ে আত্মীয়স্বজন, কর্মচারীদের মোরগ-পোলাও খাওয়ানো হয়। ওই প্রথম আমি মোরগ-পোলাওয়ের নাম শুনি ও খাই। খাওয়ার সঙ্গে আরো বড় ব্যাপার ছিল, বাবার সঙ্গে নাচের বা জন্মদিনের বিশেষ ড্রেস পরে নাচের মতো ঘুরে ঘুরে রাজকন্যা জিজ্ঞেস করেছিল, খাবার কেমন হয়েছে, আরো একটু নেব কি না? আমাকেও জিজ্ঞেস করেছিল। ছোট ছেলেমেয়ে সেখানে বেশি ছিল না। আমার সামনে কি একটু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল সারাদেশে নাম কুড়ানো নাচের মেয়েটি?

জীবন থেকে নেয়া দেখার সময় কেন জানি আমার চোস্ত পায়জামার কথা মনে পড়েনি, তাহলে বাবাকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, মুড়াপাড়া রাজবাড়ির অনুষ্ঠানে রওশন করিম কেবলই কি নাচতো, নাকি বাবাদের সঙ্গে অভিনয়ও করতো? বাবার কী পার্ট ছিল? নিশ্চয়ই কোনো ঐতিহাসিক নাটক?

মুড়াপাড়া না তবে রোকনপুর স্কুলের মাঠে করিম ড্রাগ হাউসের  আয়োজনে নাটক দেখেছিলাম। সেখানেও আর কোনো ভাইবোন না বাবা কেবল আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। নাটকের নাম জুতা আবিষ্কার। অনুষ্ঠান শুরুর আগে ছাপানো কাগজ বিলি করেছিল। তখন পড়ে দেখি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জুতা আবিষ্কার। মজার কাণ্ড-কারখানা। তখন জানি যে, রবীন্দ্রনাথ মজার লেখক। জুতা আবিষ্কারের আগে অনেকক্ষণ ধরে হয় রওশন করিমের নাচ। একেবারে সামনের লাইনে আমরা বসতে পেরেছিলাম। শীতের সময় ছিল। মাথার ওপর কাপড় টানানো, তাও কুয়াশা ভিজিয়ে দিচ্ছিল মনে হয়। কিন্তু শীত বোধ আমার তখন মোটেও ছিল না।

তখন মনে হয়নি, এখন মনে হয়, আমরা এতো ভাইবোন, এক ভাই আবার আমার বড়, বাবা আমাকেই কেন তার সঙ্গে নাটক-সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতো?

আলী আক্কাসের মা, আমার দাদিও, কেন যেন আফিমের সঙ্গে যে দুধ খেতো, পিতলের বড় গ্লাস থেকে আমাকে দুই চুমুক দুধ খেতে দিত। বলতো, ‘আর কেউরো তো অইবো না, তুই বান্দর পড়স-লেখস, তরে একটু দুধ দেওন দরকার।’ তবে দুই চুমুক দুধই খেতে দিতো, আমার আরো খেতে ইচ্ছে হতো, কিন্তু পিতলের গ্লাসটা হাত থেকে টেনে নিতো দাদি। সন্ধের পরে আফিম ঢুলুঢুলু দাদি। নবাবপুরের রথখোলার মোড় থেকে আলী আক্কাস তার মায়ের জন্য আফিম কিনে আনতো। ঘরে আফিম নাই, আলী আক্কাস আফিম আনতে ভুলে গেছে, তখন আমার দাদি চিৎকার করে চিল-শকুন সব এক করতো। একমাত্র পুত্রের বাবা-মা তুলে গালি দিতো, পুত্র ও তার পরিবারের সবার মৃত্যু কামনা করতো। ঘুমাতে পারতো না। ভূতের মতো করতো। দাঁড়ায়, লাফায়, পাখির মতো পলকা শরীর নিয়ে উড়ে যায়। ভয়ে তখন আমরা কেউ কাছে ভিড়তাম না। আফিমের দোকান বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যায়। পরের দিন ছাড়া আর হবে না। আমার দুই চুমুক দুধ সে-রাতে মিস হয়ে যেতো।

আলী আক্কাস ১৯৪৭ সাল দেখে, ১৯৭১ সাল দেখে, তারপর ১৯৭৫। ১৯৪৭-এর পরে মুড়াপাড়া জমিদারবাড়ির বাবুরা দেশ ছেড়ে চলে যান। তখন থেকে মুড়াপাড়ায় করিম সাহেবদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৭১ সালে কে কোথায়? করিম ড্রাগ হাউস বন্ধ। আলী আক্কাসের চাকরি নেই, কামাই বন্ধ। কিন্তু পাখিদের মতো ঝড়ঝাপটায় উড়ে গিয়েও ঘরের ভেতরকার চিল-শকুনের বাচ্চাদের জন্য খাবার জোগাড় করার কাজ বন্ধ করা যায় না। গোপীবাগের গলির ভেতর গিয়ে একটা মুদির টং দোকান দেয়। যতদিন যায় আলী আক্কাসের কথা আমি কম জানতে ও মানতে শুরু করি।

আমাদের মহল্লায় লেখাপড়া, স্কুলে যাওয়া – এসবের কোনো বালাই নেই। এই মহল্লা থেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও বেরোতে পারব – শুধু এই সুযোগটা নেওয়ার জন্য আমি লক্ষ্মীবাজার, সদরঘাট এসব এলাকার স্কুল-কলেজে যেতে শুরু করি। কুকুরের বাচ্চার মতো আমাকে মুখে করে নিয়ে আমার বাবা মাঝে মাঝে রোকনপুর করিম হাউজে আমাকে নিয়ে যেতে পছন্দ করতো। মূল সাহেব, বড়, মেজো, সেজো আরো সাহেব ছিল সেখানে। কাকে কখন পাওয়া যেতো, আশেপাশে ঘুরঘুর করে বাবা বুঝে নিতো কার কাছে পাত্তা পাওয়া যাবে। বাকল্যান্ড বাঁধে, বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে শহরবাসীরা বেড়াতে আসতো, তাদের মনোরঞ্জনের জন্য নদীর ঘাটে অনেক আয়োজন। বেশি জমতো আর লোক ভিড় করতো বানর খেলা দেখার জন্য। আমাকে বাবা বড় বা মেজো বা সেজো সাহেবের সামনে ঠেলে দিতো বানরের খেলা দেখাতে, দাঁত কেলানো, পাছা দেখানো, লাফালাফি – যেটা যেটাতে বেশি দৃষ্টি টানা যায়। আমার নিয়মিত স্কুলে যাওয়া, পরীক্ষায় কোনো বিষয়ে ফেল না করা, মহল্লার ছেলেপেলেদের সঙ্গে না ঘোরা, মারপিট না করা, মুখ খারাপ না করা, আমার সব রকমের ভীরুতাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাবা তার সাহেবদের কাছে হাজির করতো। আলী আক্কাস তার ছেলের অতি প্রতিভা বুঝে উঠতে পারতো না। সে সাহেবদের দিয়ে আমার প্রতিভা বুঝতে চাইতো। আমার প্রতিভা বিকাশের পথ নিজে নিজে মাথা ঘামিয়ে বের করতে পারতো না, তাই সাহেবি পরামর্শ শোনার জন্য আমাকে হাজির করতো। পরিহাস করেই কি না, সাহেবরা আমাকে বলতেন, বুদ্ধিসুদ্ধি তো ভালো, গণিতের নম্বর তো ভালোই, সায়েন্স পড়ো, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়া যাবা মিয়া। গাড়িতে উঠবা, নিজের গাড়ি। কিন্তু আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম, আমি বাবার কোনো কথা শুনবো না, তার সাহেবদের কথাও না। আমি আর্টস নিয়ে পড়লাম। আর যে আমি ঢাকা শহরের বাইরে কখনো পা রাখিনি, কোথাও যাওয়ার কথা শুনলে গায়ে জ্বর আসে, চোখের ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টির কারণে আকাশে চাঁদ ভিন্ন অন্য কোনো গ্রহ, নক্ষত্র দেখা হয়নি, ভাবি যে সাগর, মহাসাগর, পর্র্বতমালা নিয়ে মানুষ মাতামাতি করে কেন, সেই আমি কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই ভূগোল নিয়ে পড়ে ফেললাম।

জিয়াউর রহমানের আমলে জগন্নাথ কলেজে চাকরিও পেয়ে গেলাম একটা, ভূগোলের লেকচারার। দেশ বদলাতো, করিম হাউজ দেশের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকতোই তাদের নিজেদের জায়গা ঠিক রাখতে। ছোটবেলায় দেখতাম করিম হাউজে গিয়ে, বাবা সেখানে ওষুধের শিশি-বোতল লেবেল লাগানোর দায়িত্বে। ছোট একটা ছাপার মেশিন, পা দিয়ে চেপে চালাতে হয়। বাবা সেই মেশিন চালায়, কাঁচি দিয়ে লেবেল কাটে, বোতলের গায়ে লেই দিয়ে লেবেল লাগায়। বাবার সেটা কোন মাপের কাজ বুঝতাম না, স্কুলের ছাত্র হাফপ্যান্ট পরা আমি যখন কোনো কিছুর জন্য সেখানে যেতাম, মনে হতো, আমি করিম হাউজের কোনো চাকর-বাকর, দারোয়ান-বরকন্দাজের ব্যাটা। বাংলাদেশ হলো, বাবা আবার কাজে গিয়ে ঢুকলো করিম হাউজে। কত বছর ধরে বাবা করিম হাউজের লোক? বাংলাদেশ হওয়ার পর জানি, নতুন ছাপাখানা এসেছে, বাবার কাজের ধরন বদলে গেছে। ১৯৮০ সালে হলো কী, একদিন পুলিশ এলো আমার খোঁজে, আমি তখন তাঁতীবাজারে এক মেসে থাকি। আমাকে যেতে হবে তাদের সঙ্গে। ভুল করে ধরা। আমি কোনো রাজনীতি করা লোক না। পুলিশের জিপে বসিয়ে আমাকে প্রথম নিয়ে গেল দয়াগঞ্জে। পুলিশ করিৎকর্মা, দুই বাড়ি খুঁজে বের করে ফেলল আমার মা কোন বাড়িতে। মা ও ছেলেকে নিয়ে এলো হাসপাতালে, মর্গে। লাশপচা গন্ধ, একটা লাশের মুখের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে আমাকে ও মাকে দেখালো। আমাকে একজন ধমকের গলায় জিজ্ঞেস করলো, দেখেন এটা আপনার বাবা কি না। গন্ধে আমার পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসছিল। বমি ঠেকাতেই বললাম, হ্যাঁ, এটা আলী আক্কাসের লাশ। চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই তাও আমার মা বলল, এটা তার স্বামীর লাশ। চিনে বলল নাকি আন্দাজের ওপর। যাক লাশ গোসল, জানাজা, কবর দেওয়ার সময় নিশ্চিত হওয়া যাবে কার লাশ।

পুলিশ আমাদের বলে, বাড়ি যান। লাশ আমরা নিয়ে আসছি। বাড়ি ফিরে আমরা পুলিশের জিপ বা লাশবাহী গাড়ির জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু কোনোটাই কোনোদিন আর আসে না। তাতে আমাদের লাভ হয় কী, আমরা  আলী আক্কাসের মৃত্যু দিবস ও গোরের জায়গার খবর জানি না। ফলে আমরা তাকে নির্বিকারে ভুলে যেতে পারি।

এ-সময়েই আবার আমার জুলফিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। জগন্নাথ কলেজের চাকরিটা যার জোরে পেয়েছিলাম সে রাজনীতি করা লোক। সে হঠাৎ একদিন বলে, তোমার চাকরি জোগাড় করে দিলাম, এর বদলে আমার বোনকে বিয়ে করে ফেলো। জুলফিয়াকে বিয়ে করে ফেললাম। তার আগে জুলফিয়ার সঙ্গে ঘুরতে-ফিরতে, একসঙ্গে সিনেমা দেখতে কিছু সুযোগ দিলো। হয়তো তার বোনের আমাকে পছন্দ হয় কি না সেটা দেখা। নবাবপুরের গলির ভেতর একটি পুরনো বাড়ির তিনতলার দুটো ঘরও ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলো জুলফিকার ভাই, আমার সম্বন্ধী। মেসে ছিলাম, বারোয়ারি ব্যবস্থা, খাওয়া-শোয়া, কোনোটাই ঠিকমতো হতো না। আমার বেশি অসুবিধা হতো, আমাকে তখন লেখায় পেয়েছে। অনেক কথারা আমার মাথায় চাপ সৃষ্টি করছে। সেগুলো সাদা কাগজের পাতায় বের করে দেওয়া দরকার। জুলফিয়াকে নিয়ে আলাদা ঘর পেয়ে আমার লেখার সুবিধা বেড়ে গেল। রাতভর লিখি। আর সকালবেলা দেখি সে-সব কিছু হয় না, ফেলে দিই। জুলফিয়া দেখি ফেলে দেওয়া কাগজগুলো কুড়িয়ে জমা করে।

আমি জুলফিয়াকে বলি, আমি যা লিখতে চাই, তা এগুলো না।

জুলফিয়া বলে, আমি পড়েছি, ভালো লাগে।

তার ভালো লাগায় আমার কিছু আসে-যায় না। আমি তার জন্য প্রায় কিছুই করি না। রাতে একসঙ্গে শোয়াটাও তেমন হয় না। আমি ছোট টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে সারারাত ধরে লিখি।

ভাড়াবাড়িতে শুধু আমি ও জুলফিয়া না, আরো অনেক ভাড়াটে। সেটা ছিল এককালের বাইজিবাড়ি। নবাবপুরে নবাবি হালচাল। বিকেল পড়ে আসতে রইস আদমিরা একে একে এসে টপাটপ বাইজি বাড়িতে ঢুকে পড়তো। রাতভর চলতো ঘুঙুরবাঁধা পায়ে নাচ, কালোয়াতি গান, শরাব, তামাক, নেশার আগুন ধরাতে যা যা লাগে।

আমার ছাত্র পড়ানোর জায়গা জগন্নাথ কলেজ নবাবপুরে আমার

থাকার জায়গা থেকে কাছে। আর আমি ঘুরে বেড়াই লক্ষ্মীবাজার, পাটুয়াটুলী, বানিয়ানগর, আরমানিটোলা, নয়াবাজার, চকবাজার, বাবুবাজার। কী জানি খুঁজে বেড়াই? কে যেন আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে অলিগলির ধাঁধায় ফেলে। আমি কোন দূরে হারিয়ে যাই। শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরি। জুলফিয়াকে দেখে অবাক লাগে। সে আমার ঘরে এলো কীভাবে?

আমার মা বাচ্চা বিয়াতো, এতো বাচ্চা পালতো‌। কারোই তেমন অবশ্য যত্নআত্তি করতে হতো না। তাও এতো বাচ্চার খাওয়া-পরার ব্যবস্থা, রাঁধো-বাড়ো, কাপড় ধোও, ঘর মোছো। ছোট বাচ্চার গু-মুত পরিষ্কার করো। স্বামীর হাতের ঠ্যাঙানি খাও। পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া করো। আমাদের বাড়িতে সব সময় দু-ঘর ভাড়াটে থাকতো। এক ভাড়াটের সঙ্গে মায়ের মধুর সম্পর্ক হতো, আরেকজনের সঙ্গে দা-বঁটি সম্পর্ক, কোপাতে যাওয়া। একজন কাউকে লাগে, যাতে বাকি দুজন একমত হয়ে তার গিবত করতে পারে। একটু ফুরসত মিললে, পান চিবুতে চিবুতে এটাই মায়ের বিনোদন। পানের ডাব্বা, পান, সুপারি, খয়ের মায়ের। তাতে মা বাড়িউলির কর্তৃত্বটা প্রকাশ করতে পারে। বেশি হলে আরেকজনের  শুধু চুনের কৌটাটা বের করা। আমার বয়স তখন অতো বেশি হয়ে যায়নি যে মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করা যাবে না। তাছাড়া আমি রোগা-পাতলা, বয়স লুকিয়ে ফেলতে পারি। আমার ভাইয়েরা সকালে মুড়ি, ছাতু খেয়ে বেরিয়ে পড়তো, দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় হওয়া পর্যন্ত। বাড়িতে কয়েকটা বিচ্ছু,  কোনোটা হামাগুড়ি দেয়, কোনোটা হাঁটতে শিখছে। আমার সঙ্গে ছোটদেরই বনে বেশি, আমার কথা তারা বোঝে, আমি তাদের ভাষা বুঝি।

কবিরের মা দুই মাস এসেছে, নতুন ভাড়াটে, তার সঙ্গে মায়ের দহরম-মহরম। বাবুলের মা হচ্ছে অন্য দল, যাকে ছিলা হবে। মা কবিরের মায়ের ঘরে গেলে, আমি কাছাকাছি থাকি বা ঘরে ঢুকে পড়ি। কথার মজায়, পানে মুখ লাল করে দুজন যুবতী কন্যা হয়ে তখন মশগুল। আমার থাকা-না-থাকায় পাত্তা দেয় না। যতটুকুই  বুঝতে পারি বড়দের ওইসব কথা, আমার শুনতে ভালো লাগে‌। অন্য রস। একদিন শুনি মা কবিরের মাকে শোনাচ্ছে, আজিজের (আমার বড় ভাই) বাপ তো বাবুবাজার পট্টিতে যায়।

– বলেন কী, আটকান না?

– কেলা, আপনারটা যায় না!

– পোলাপান ঘুমায়া পড়লে আমি নিজেই তার উপরে উইঠা পড়ি। সে আমার কাছে ধরা।

– বাবুবাজারের ঢলঢলা হেগো মতোন আমরা কি পারি! হে অইলো আবার রইস ঘরের। আপনেরা ঢাকাইয়াগো ভাবচক্কর বুঝবেন না ভাবি।

বাবুবাজার পট্টির আর কী খবর জানে মা, কান পেতে রাখি। কিন্তু মায়েদের গল্প তখন অন্যদিকে ঘুরে গেছে। আমি একদিন টিফিন ক্লাসের পরে হেডস্যারকে বলি, আমার নানি মারা গেছে, আমাকে নিতে আসছে। আমি স্কুল পালাই, আর হাঁটতে হাঁটতে বাবুবাজার পট্টি খুঁজে বের করে ফেলি। গলির মুখে লেখা ‘আউট অফ বাউন্ড’। আমি পড়তে পারি, অর্থ পুরোটা বুঝতে পারি না। ওরকম গলি, নবাবপুর পুলের ঢালেও খুঁজে পাই। আমার স্কুলের কাছাকাছি, তাই বেশি সময় ধরে জায়গাটায় ঘোরাঘুরি করতে পারি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে গলির ভেতর উঁকিঝুঁকি মারি। সায়া, ব্লাউজ পরা মেয়েরা লাইন ধরে গলির ভেতর দাঁড়িয়ে। আমার কল্লা ধরে আমাকে কেউ গলির মুখ থেকে সরিয়ে দেয়।

একদিন দেখি বাবা আমাদের মহল্লার গনিকে নিয়ে আসছে বাড়িতে আর মায়ের সঙ্গে কাইজা, গনিকে ভালো করে খাওয়াতে হবে। মা খাওয়াবে না, পোলাপান সব তখনো খায়নি, ওদের খাওয়া কম পড়ে যাবে। বাবা মাকে মারতে যায়। রাতে ঘুম ভাঙতে পেশাব করতে বারান্দা দিয়ে পায়খানায় যাই। বারান্দায় মশারির তলায় দেখি খসখস, নড়াচড়া, গনি মিয়া আলী আক্কাসের গায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে ঘুমাচ্ছে।

নবাবপুরে পুরনো বাইজি বাড়িতে মনে হয় আমার ওঠা ঠিক হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয়, রাতে টেবিলে বসে আমি লিখছি, জুলফিয়া বিছানায় উঠে বসেছে, দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। ঘুঙুরের শব্দে আমার লেখার জগতে ঢুকতে কষ্ট হয়। আমি জোর করে চেপে জুলফিয়াকে শোয়ানোর চেষ্টা করি। জুলফিয়া আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি এতো ঠান্ডা কেন মিয়া!

কিছুদিন যাওয়ার পর বুঝতে পারি, জুলফিয়ার ঘরে লোক আসে, আমি যখন ভূগোল পড়াই, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, দেখি যে বাবুবাজারের পট্টি উঠিয়ে দিয়েছে, গলির ভেতর দিয়ে রিকশা মানুষ যে কেউ আসা-যাওয়া করতে পারে। নবাবপুরের পাড়াও নাই।

 আমার মাও তার বাকি নয়  ছেলেমেয়ের ভেতর কার কাছে এখন জানি না। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় তার খোঁজ নিতে বেরোই। মনে হয়, খুঁজে পাবো না। দুয়েক জায়গায় খোঁজ না পেলে ধৈর্য হারিয়ে ফেলবো। আমার গায়ে লেগে থাকা মায়ের দুধের গন্ধে মা হয়তো আমাকে চিনে নেবে। কিন্তু আমি তো আমার ভেতর পুরনো কোনো চিহ্ন রাখতে চাই না।

তাও আমি সন্ধেবেলা আমার ভাড়া করা ঘরে ঢুকে আফিমের গন্ধ পাই। সিগারেটের গন্ধ পাই। তামাকের গন্ধ পাই। মদের গন্ধ পাই।

জুলফিয়াকে জিজ্ঞেস করি, তোমার কাছে কারা আসে গো? কাদের নিয়ে বসো?

জুলফিয়া বলে, কী পাগলের মতো কথা বলো!

এটা এড়িয়ে যাওয়া।

হাঁটতে হাঁটতে আমি একবার বেখেয়ালে বাবুবাজার চলে গেছি। তখন আমার গোঁফের রেখা উঠেছে। দুপুরের অবেলা, খদ্দের কম, তাই হয়তো আমাকে গলি থেকে বের করে দেয় না। আমি একটা ঘরে গিয়ে বসি। আমাকে নিয়ে একটা কিছু হয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারি, সেটা আমি না।

জুলফিয়া যতই অস্বীকার করুক, আমি ঘরে ফিরলেই ঘরের ভেতর অন্য পুরুষের গন্ধ পাই। আমি জুলফিয়ার চোখ-মুখ তল্লাশ করি। আমার ঘরে ফেরার সময়টায় জুলফিয়া একটু সেজেগুজে থাকে, পরিষ্কার কাপড়-চোপড়, ধোয়া মুখ, মাথার চুল খোঁপা করে বাঁধা। আমি জুলফিয়ার ভেতর দোমড়ানো-মোচড়ানোর চিহ্ন খুঁজি।

জুলফিয়া আমাকে বলে, এতো মুগ্ধ হয়ে আমার কী দেখো? অন্ধকারে তো দেখো না।

বুঝি যে সবই চালাকি। জুলফিয়ার, আমারও।

একদিন বাড়ি ফিরে পুরুষ মানুষের গন্ধ আরো তীব্রভাবে নাকে লাগে। জুলফিয়া গেছে বাথরুম। বারোয়ারি বাথরুম, সে আমার জন্য একটু পরিষ্কার করে রেখে আসবে। আজ রাস্তায় রাস্তায় অনেক ঘুরেছি। সূত্রাপুর, বানিয়ানগর, ফরাসগঞ্জ, পাটুয়াটুলী, আরমানিটোলা, নয়াবাজার। আমাকে কে যেন কোথায় যেতে বলেছে? বুঝে উঠতে পারছি না। চিনে উঠতে পারছি না। গরমের দিন। আমি এখানে ঘুরি, সেখানে যাই।

জুলফিয়াকে বলেছিলাম, গোসল করব।

জুলফিয়া ঘরে নেই। এ-সুযোগে জুলফিয়ার সবকিছু হাতড়াই। বিছানার তলা, জানালায় লাগানো পর্দার পিছনটা, খাটের তলা, কাঠের আলমারির ভেতরটা।

তখনই চোখে পড়ে পাশাপাশি রাখা আমাদের দুজনের বালিশের তলায় দুমড়ানো-মুচড়ানো চোস্ত পায়জামা। আলী আক্কাসের চোস্ত পায়জামা। বুঝি যে আমার পলায়নের সব পথ বন্ধ।