টিয়া পাখির অভিমান

ওয়াশরুমে ঢোকার আগে মোবাইল দুটো আমি বিছানার ওপর রেখেছিলাম। একটা ফোনে চিটাগাংয়ে কথা বলছিলাম, আরেকটা ফোন ছিল হাতে। কথা শেষ করে দুটোই বিছানায় ছুড়ে ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে গিয়েছিলাম। ফোন দুটো সাইড টেবিলে রাখল কে? একদম গুছিয়ে পাশাপাশি সুন্দর করে রাখা!

এই ফ্ল্যাটে তো আমি ছাড়া কেউ নেই। তিনদিন হলো উত্তরার এই ফ্ল্যাটটায় আমি উঠেছি। লেকের ধারে সুন্দর ছয়তলা বিল্ডিংয়ের তিনতলায় ফ্ল্যাট। ফুল ফার্নিশড। ফার্নিশড বলেই বলতে গেলে অনেকটা জোর করে ভাড়া নিয়েছি। মালিক ভদ্রলোক ভাড়া দিতে চাননি। এভাবেই ফেলে রাখতে চেয়েছিলেন। নিজেরা হয়তো মাঝে মাঝে এসে   থাকবেন, এরকম প্ল্যান হয়তো ছিল। পুরনো বাসস্থানের প্রতি মায়া থেকে যায় না মানুষের!

তিন বেডরুমের পনেরোশো স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। আমার একার জন্য চমৎকার। মালিক ভদ্রলোক খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন ফ্ল্যাটটি। আসবাবপত্র এবং সাজানো-গোছানোতে সুরুচির ছাপ। তিনি বাড়ি করেছেন নিকুঞ্জে। তিনতলা ছবির মতো ছোট্ট বাড়ি। স্বামী-স্ত্রী আর কাজের লোকজন থাকে। ভদ্রলোকের নাম মুনিরুজ্জামান। তাঁর একটাই ছেলে। ছেলে থাকে আমেরিকায়।

মুনিরুজ্জামান সাহেব মাঝারি সাইজের ব্যবসায়ী। ডেভেলপার। ঢাকার বিভিন্ন লোকেশনে তিন-চারটা কাজ তাঁর সবসময়ই চলে। পরিচ্ছন্ন স্বভাবের মানুষ। ব্যবসাটাও করেন পরিচ্ছন্নভাবে। তাঁর এই ব্যবসায় ফাঁকি-ঝুঁকির প্রচুর অবকাশ থাকে। তিনি ওসবের মধ্যে থাকেন না। আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল চিটাগাংয়ে। আমার সব কিছুই চিটাগাংনির্ভর। চিটাগাং পোর্টে ঠিকাদারির ব্যবসা করি। সেই ব্যবসার কাজে প্রায়ই ঢাকায় আসতে হয়। এসে হোটেলে উঠতাম। পাঁচ-সাতদিন, দশদিন একটানা থাকতে হলে বেশ ভালো একটা খরচ হয় হোটেলে। তার চেয়ে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকা ভালো। চিটাগাং থেকে আমার বহুদিনের পুরনো লোক এনায়েতকে নিয়ে এলেই হবে। সে আমার দেখাশোনা করবে। ঢাকায়ও ব্যবসা করার কথা ভাবছি। ঘন ঘন আসতে হবে। সুতরাং এনায়েতকে ফ্ল্যাটেই রেখে দেব।

এসব ভাবনা থেকেই ফ্ল্যাটটা নেওয়া। আমার স্ত্রী ডাক্তার। চিটাগাং মেডিক্যালে গাইনি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। তার নাম আফরিন। আমার পাঁচ বছরের মেয়েটির নাম রুম্পা। সে কিন্ডারগার্টেনে পড়ে। আমাদের যৌথ পরিবার। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আন্দরকিল্লায় পুরনো আমলের বড় বাড়ি। সেখানে মা-বাবার সঙ্গেই আমি থাকি। একমাত্র ছেলের মা-বাবাকে ছেড়ে অন্যত্র থাকা ঠিক না। আমার মা-বাবা আফরিনকে আপন মেয়ের মতো ভালোবাসেন। আর রুম্পা হচ্ছে তাঁদের চোখের মণি। নাতনি বলতে অজ্ঞান দুজনে।

কিন্তু মোবাইল সেট দুটো সাইড টেবিলে গেল কী করে? কে রাখল ওখানে?

এখন রাত সোয়া দশটা বাজে। ওয়েস্টিনে আমার একটা মিটিং ছিল সন্ধ্যাবেলা। সেখানে ডিনার করে এসেছি। যেহেতু এনায়েতকে এখনো আনা হয়নি, ফ্ল্যাটে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা নেই। শুধু ব্রেকফাস্টের জিনিসপত্র আমি কিছু কিনে রেখেছি। লাঞ্চ-ডিনার বাইরেই করি। আরো কয়েক দিন থাকতে হবে ঢাকায়। তারপর ফিরে যাব চিটাগাংয়ে। এ-মাসে আবার আসব। তখন এনায়েতকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব।

একা একা থাকতে আমার অবশ্য কোনো অসুবিধা হয় না। ফ্ল্যাটটাকে হোটেলের মতোই মনে হয়। দিনের বেশির ভাগ সময় তো বাইরেই থাকি। শুধু রাতের বেলা এসে ফ্ল্যাটে ঘুমাই। ফার্নিশড ফ্ল্যাট পাওয়ায় সুবিধা হয়েছে। কিছুই কিনতে হয়নি। ভাড়াও রিজনেবল। ব্যবস্থা একেবারে হোটেলের মতো।

কিন্তু মোবাইল সেটের ব্যাপারটা তো বুঝতে পারছি না! বাইরে থেকে এসে জামা-কাপড় বদলে মোবাইলে কথা শেষ করে দুটো সেটই তো বিছানায় ছুড়ে ফেললাম। সেই জিনিস সাইড টেবিলে গেল কী করে?

আসলেই কি আমি ফোন দুটো বিছানায় ছুড়ে ফেলেছিলাম, নাকি নিজেই ওভাবে সাইড টেবিলে রেখেছি!

তা-ই হবে। আমারই ভুল। আমিই সাইড টেবিলে রেখেছি। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মনে হচ্ছে বিছানায় ছুড়ে ফেলেছিলাম। এই নিয়ে ভাবার কিছু নেই। সারাদিন এতো রকম কাজে ব্যস্ত থাকি, এতো কথা বলতে হয় লোকের সঙ্গে, এসব কারণে ভুলভাল হতেই পারে। ফোনের ব্যাপারটা নিশ্চয় আমার ভুল। বিছানায় না, আমিই আসলে সাইড টেবিলে রেখেছি।

ভাবনাটা মন থেকে ফেলে শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। তারপর টিভি অফ করে ম্যাটম্যাটে জ্যোৎস্না রঙের ডিমলাইট জ্বেলে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার ঘুম বেশ গাঢ়। শোয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে যাই। রাতে একবার হয়তো ওয়াশরুমের জন্য উঠি। তারপর আবার ঘুম। একটানা সকাল আটটা পর্যন্ত ঘুমাই। ভালো ঘুমের কারণ হলো, বিছানায় যাওয়ার পর মাথা থেকে যাবতীয় চিন্তা-টেনশন সবকিছু আমি ফেলে দিই। মনোভাবটা এ-রকম, যা হওয়ার হবে। ফোন দুটো মিউট করে দিই, যাতে কেউ ফোন করলেও ধরতে না হয়। এজন্য অবশ্য মাঝে মাঝে আফরিন একটু বিরক্ত হয়। কারণ সে দু-একবার রাত বারোটার পর ফোন করে কোনো জরুরি কথা বলতে চেয়েছে। আমি তো আমার মতো ঘুমাচ্ছি, ওর ফোন রিসিভই করিনি! তবে ভালো ঘুমের কারণে আমার শরীর ঠিক আছে। সকালবেলা উঠে ফ্রেশ হওয়ার পর নিজেকে নতুন মানুষ মনে হয়।

পরদিন সকালেও নিজেকে খুব ফ্রেশ লাগছিল। নিজ হাতে এক মগ কফি বানালাম। পাউরুটি টোস্ট করলাম। তারপর বাটার জেলি মাখিয়ে বেশ তৃপ্তি করে নাশতাটা করলাম। ডাইনিং টেবিলটা সুন্দর। মোটা গ্লাসের চারজন বসার টেবিল। কফি খেতে খেতে আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকটা দেখছিলাম। ওদিককার সাদা দেয়ালে সুন্দর একটা পেইন্টিং। গাছের ডালে দুটো পাখি বসে আছে। কী পাখি বোঝা যায় না। তবে যে শিল্পী এঁকেছেন তাঁর আঁকার হাত চমৎকার। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখতে লাগলাম।

আরে, ছবিটা তো একটু বাঁকা হয়ে আছে। উঠে গিয়ে সোজা করে দেব নাকি।

না থাক। সকালবেলা কিছুক্ষণ আমার কোনো কাজ করতে ভালোই লাগে না। বিছানাটাও এলোমেলো হয়ে আছে। থাক, অসুবিধা কী। রাতের বেলা ফিরে আমিই তো ব্যবহার করব! বিছানার ওপর পড়ে আছে রাতে পরা ট্রাউজার আর টি-শার্ট। আজ রাতও ও-দুটো পরেই কাটিয়ে  দেব। কাল অন্য ট্রাউজার আর টি-শার্ট বের করব। যেহেতু আরো কয়েক দিন থাকতে হবে, সেহেতু দু-তিনদিন পর বাড়ির সিকিউরিটির লোকদের দিয়ে কাপড়চোপড় সব লন্ড্রিতে পাঠিয়ে দেব।

ঢাকায় এলে আমার বন্ধু নিয়াজ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটা গাড়ি দিয়ে রাখে। রাতের বেলা ড্রাইভারকে ছেড়ে দেওয়ার সময় বলে দিই সকালে কটায় আসতে হবে। আজ বলেছি নটায় আসতে।

ড্রাইভারের নাম শাজাহান। খুবই সময় মেনে চলা লোক। ঠিক নটায় এসে  ঢুকল। সিকিউরিটির লোক ইন্টারকমে জানাল, স্যার, আপনার গাড়ি এসেছে। রেডি আমি হয়েই ছিলাম। ফ্ল্যাট লক করে বেরিয়ে যেতে দু-তিন মিনিটও লাগল না।

ধাক্কাটা খেলাম রাতে ফ্ল্যাটে ফিরে। বেডরুমে ঢুকে দেখি বিছানাটা পরিপাটি করে গোছানো। আমার স্বভাব একটা চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমানো। সেই চাদরটা যত্নে পায়ের কাছে ভাঁজ করা। ট্রাউজার আর টি-শার্টটাও ভাঁজ করে একপাশে রাখা।

এ কী করে সম্ভব! ফ্ল্যাটে কি কেউ ঢুকেছিল? সেই সম্ভাবনা তো নেই। দুই সেট চাবির এক সেট থাকে আমার পকেটে আরেক সেট হ্যান্ডব্যাগে। অন্য কারো পক্ষে ফ্ল্যাট খোলা সম্ভবই না। নাকি তৃতীয় কারো কাছে এক সেট চাবি আছে? সে এসে খুলে সব পরিপাটি করে রেখে গেছে! কিন্তু কোন স্বার্থে সে তা করবে? আমি তো এমন কোনো কাউকে রাখিনি!

বেশ একটা চিন্তায় পড়ে গেলাম। ইন্টারকমে নিচে সিকিউরিটির লোকদের সঙ্গে কথা বললাম। বাড়িটায় তিনজন সিকিউরিটির লোক। একেকজন আট ঘণ্টা করে ডিউটি করে। গেটের সঙ্গেই তাদের থাকার রুম। আজ রাতে যে ডিউটি করছে তার নাম সামসু। সামসুকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার ফ্ল্যাটের আরেক সেট চাবি কি কারো কাছে আছে?

লোকটা আকাশ থেকে পড়ল। না তো স্যার। আপনার ফ্ল্যাটের চাবি অন্য কারো কাছে থাকবে কেন? কেন, কী হয়েছে স্যার?

ব্যাপারটা আমি চেপে গেলাম। না, এমনি জানতে চাইলাম। ঠিক আছে সামসু।

চিন্তিত ভঙ্গিতে বেডরুমে এলাম। প্রায় এগারোটা বাজে। রাতের কাজগুলো শেষ করে শুয়ে পড়লাম। আজ আর টেলিভিশন দেখতে ভালো লাগল না। বিছানায় শুয়ে ব্যাপারটা নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবলাম। ঘটনাটা আসলে কী? নিশ্চয়ই কেউ এসে এই ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল। ঢুকে আমার বিছানা গুছিয়ে রেখে গেছে। কিন্তু কে আসবে? এলে তো সিকিউরিটির লোকেরা দেখত? তারা কেউ কাউকে দেখিনি। আর কার এমন কী স্বার্থ থাকতে পারে যে আমার ফ্ল্যাটে ঢুকে বিছানা গুছিয়ে রেখে যাবে? এই বাড়িতে বা বাড়ির কোনো ফ্ল্যাটে চোর ঢোকা সম্ভব না। আর যদি চোর ঢুকেও থাকে তাহলে সে চুরি না করে বিছানা গুছিয়ে রেখে যাবে কেন?

ভৌতিক ব্যাপার-স্যাপারে আমার বিশ্বাস নেই। ভূত আছে কী নেই ওসব নিয়ে কখনো ভাবিইনি। অনেক রকমের অনেক ভূতের গল্প বিভিন্নজনের মুখে শুনেছি। শুনে বিশ্বাস করিনি, মনেও রাখিনি। ভয় তো পাইইনি। নিজের জীবনে ওরকম কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু আজকের এই ব্যাপারটার অর্থ কী?

যা ইচ্ছা হোক গিয়ে, এতো কিছু ভাবতে পারব না। মাথা থেকে চিন্তাটা ফেলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে নিজের কাজগুলো করার ফাঁকে ফাঁকে বিছানা গোছানোর ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভাবলাম। কোনো কূলকিনারা পেলাম না। ব্যাপারটা আসলে কী? ওরকম কি সত্যিই ঘটেছে? নাকি সবই আমার কল্পনা? আসলে বিছানা গোছানোই ছিল না। আমার দৃষ্টি বিভ্রম ঘটেছিল। হোটেলে থাকলে যা হয়, সকালবেলা বেরিয়ে যাওয়ার পর হাউসকিপিংয়ের লোক এসে রুম গুছিয়ে দিয়ে যায়। আমি এই ফ্ল্যাটে থাকছি ঠিকই, আমার অবচেতন মন হয়তো ভাবছে আমি কোনো হোটেলেই আছি। এই কারণে হয়তো দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছে। এছাড়া তো আর কোনো কারণ দেখি না। ঠিক আছে। আজ ব্যাপারটা আবার পরীক্ষা করব। আজো যদি একই কাণ্ড ঘটে তাহলে বুঝব কোথাও কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে।

শাজাহান গাড়ি নিয়ে এলো দশটার দিকে। আমি আমার কাজে বেরিয়ে গেলাম। রাতে ফিরলাম একটু আগে আগেই। তখন নটা বিশ। ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে ভেবেছি, আজো ওরকম পরিপাটি বিছানা দেখব নাকি?

না। আজ বিছানা যেভাবে রেখে গেছি, সেভাবেই পড়ে আছে। তার মানে গত রাতের ব্যাপারটা আমার দৃষ্টিবিভ্রম। ওসব নিয়ে আর ভাবলাম না। বাইরের জামাকাপড় বদলে রাতের ট্রাউজার্স আর টি-শার্ট পরলাম। তারপর ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। প্রথমে গেলাম কিচেনের দিকটায়। কিচেনের সঙ্গে তৃতীয় রুমটা। এই রুমে নিশ্চয়ই মনিরুজ্জামান সাহেবের কাজের মহিলারা থাকত। তারপরও বিছানা-টিছানা খারাপ না। নিশ্চয়ই দুজন বুয়া থাকত। মুখোমুখি দুটো সিঙ্গেল খাট। বিছানার চাদর-বালিশ সবই সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন। একটা ওয়াল কেবিনেট আছে। একটা বাইশ ইঞ্চি টেলিভিশনও আছে। তার মানে মনিরুজ্জামান সাহেব এই ফ্ল্যাটের একটি কুটোও নাড়েননি।

কিচেন আর বুয়াদের রুমের লাইট অফ করে আমি মাঝের রুমটায় এলাম। এই রুমটা মাস্টারবেডের চেয়েও সুন্দর করে সাজানো। শিশুদের রুম। রুমের সবকিছু বেগুনি রঙের। পর্দা, বিছানার চাদর, ওয়ালপেপার, কেবিনেট সব বেগুনি রঙের। পড়ার টেবিল, চেয়ার, একটা ডেস্কটপ অত্যন্ত গুছিয়ে নিখুঁতভাবে সাজানো। এই রুমের ওয়ালেও ঝুলছে টেলিভিশন। পড়ার টেবিলের সঙ্গে সুন্দর বুকশেলফ। সেখানে কিছু ছোটদের ইংরেজি বই। দুটো পুতুল এমন করে সাজানো যেন আজই রাখা হয়েছে।

কে থাকত এই রুমে? মনিরুজ্জামান সাহেবের ছেলে? কিন্তু রুমটা তো মনে হচ্ছে মেয়ের রুম! মনিরুজ্জামান সাহেবের তো মেয়ে নেই! একমাত্র ছেলেও বিয়েশাদি করে বউবাচ্চা নিয়ে আমেরিকায় আছে। তাহলে?

মনিরুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে দেখা হলে জেনে নেব।

নিজের রুমে ফিরে অনেকক্ষণ টেলিভিশন দেখলাম। ঘুমাতে ঘুমাতে সাড়ে এগারোটা।

মাঝরাতে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। হঠাৎ আমার কানের কাছে শুনি মিহি সুরে বিড়ালছানা ডাকছে। ঘুমের ভেতর থেকেই শব্দটা পেয়েছিলাম। ঘুম ভাঙার পর দেখি সাইড টেবিলে আমার দিকে মুখ করে ছোট্ট একটা বিড়ালছানা বসে আছে। সাদা ধবধবে। ম্যাটম্যাটে জ্যোৎস্নার মতো আলোয় নীল চোখ ঝিলিক দিচ্ছে। আমি চোখ খোলার পরও ছানাটি কয়েকবার মিউমিউ করল। তারপর লাফ দিয়ে নেমে কোথায় উধাও হয়ে গেল।

ধড়ফড় করে বিছানা থেকে নামলাম। লাইট জ্বেলে সারাঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। না, বিড়ালছানা নেই। তখন মনে হলো, বেডরুমের দরজা বন্ধ। বন্ধ দরজায় এমন কোনো ফাঁকফোকর নেই যে বিড়ালছানা ঢুকতে পারে। তেলাপোকা বা টিকটিকি ছানারও ঢুকতে কষ্ট হবে এমন অবস্থা। তাহলে বিড়ালছানাটি ঢুকল কী করে? বেরিয়েই বা গেল কী করে?

দরজা খুলে ডাইনিংস্পেসে এলাম। লাইট জ্বেলে পনেরো-বিশ মিনিট ধরে পুরো ফ্ল্যাট খুঁজলাম। বিড়ালছানার কোনো চিহ্নই নেই। মিহি সুরের ডাকটাও আর ডাকছে না।

তার মানে কী? আমি কি স্বপ্ন দেখলাম? স্বপ্নের ঘোরেই কি চোখ মেলে তাকিয়ে স্বপ্নের দৃশ্যটাই দেখেছি? ঘুমানোর আগে এরকম বিড়ালছানার কল্পনা কি করেছিলাম? ডাকটা তো স্পষ্ট শুনলাম!

এসব কী হচ্ছে ফ্ল্যাটে? জীবনে কখনো তো এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়িনি।

এই প্রথম ভয়ে আমার একটু গা কাঁটা দিলো। টেলিফোন সেট সাইড টেবিলে রাখা, দেয়ালে বাঁকা হয়ে যাওয়া পেইন্টিং সোজা করে রাখা, আমার বিছানা গোছানো আর আজ গভীর রাতে বিড়ালছানার স্পষ্ট ডাকে ঘুম ভাঙল। নীল চোখের সাদা বিড়ালছানাটা দেখতেও পেলাম পরিষ্কার। পরপর চারটা ঘটনা। একটা হলে না হয় বুঝতাম চোখের ভুল, না হয় মনের ভুল।

চার-চারটা ঘটনা ভুল হয় কী করে?

পরের রাতে ঘটল পঞ্চম ঘটনা।

ভোররাতে ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। একদম আমার কানের কাছে দুটো পাখি সমানে ডাকছে। ঘুম ভাঙার পর পাখি দেখতে পাই না, ডাক শুনতে পাচ্ছি। প্রথমে যেমন কানের কাছে ডাকছিল, এখন আর অতো কাছে ডাকছে না। মনে হচ্ছে, পাশের রুমে ডাকছে পাখি দুটো। নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামলাম। দরজাও খুললাম নিঃশব্দে। পা টিপে টিপে পাশের রুমে এলাম। পাখি দুটো এই ঘরেই ডাকছে। ঘরভর্তি অন্ধকার বলে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নিঃশব্দে সুইচ টিপলাম। আলোয় ভরে গেল ঘর। আর সেই আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেলাম একটি কিশোরী মেয়ে দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার এক কাঁধে সবুজ রঙের একটি বার্জিকা পাখি আর এক হাতের তালুতে হলুদ রঙের ওই একই পাখি। লাইট জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাখির ডাক বন্ধ হলো। সেকেন্ডখানেক সময়ের জন্য মেয়েটি আমার দিকে তাকাল। তারপর পাখি দুটো ও সে ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল।

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম মনে নেই। একসময় বাইরে কাকপাখি ডাকতে শুরু করল। ধীরে ধীরে ফুটতে লাগল সকালবেলার আলো। আমার পা যেন পাথর হয়ে গেছে। নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। ভাবতেও যেন ভুলে গেছি।

দুই

ঘোর কাটার পর আমি সকালবেলার কাজগুলো সারলাম। মাথাটা গরম হয়ে ছিল। শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে পাঁচটি ব্যাপার নিয়ে খুব ভাবলাম। কোনো কূলকিনারাই পেলাম না। ঘটনাগুলো নিয়ে কথা বলা দরকার।

কার সঙ্গে বলব?

ব্রেকফাস্ট শেষ করে ইন্টারকমে সিকিউরিটির সামসুকে ডাকলাম। সামসু অত্যন্ত বিনয়ী লোক। আমার সামনে বসবেই না। দু-তিনবার বলার পরও দাঁড়িয়ে রইল। আমি ডাইনিং টেবিলে বসেই ঘটনাগুলো অতি সংক্ষেপে তাকে বললাম। সব শুনে সে চুপ করে রইল।

সামসু, কথা বলছ না কেন?

কী বলব স্যার!

বাড়ির অন্য কোনো ফ্ল্যাটেও কি এ-ধরনের ঘটনা ঘটে? বা কেউ কখনো তোমাদেরকে কিছু জানিয়েছে?

না স্যার।

মনিরুজ্জামান সাহেবের ফ্ল্যাট নিয়ে কি তুমি কখনো কিছু শুনেছ?

এই বিষয়ে আমি স্যার কথা বলব না।

কেন?

আপনার কেন-র জবাবও আমি দিতে পারব না। আপনি স্যার মনিরুজ্জামান স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। ফোনে না বলাই ভালো। আপনি স্যার তাঁর বাড়িতে যান। সব কথা তাঁকে খুলে বলুন। আমি যাই স্যার। গেট ভেতর থেকে বন্ধ করে রেখে এসেছি। আমার এখন ডিউটি টাইম। যাই স্যার?

ঠিক আছে, যাও।

আমি তারপর মনিরুজ্জামান সাহেবকে ফোন করলাম। সø­ামালিকুম ভাই। কেমন আছেন?

মনিরুজ্জামান সাহেবের কণ্ঠ একটু মø­ান। ওয়ালাইকুম আসসালাম। মোটামুটি আছি ভাই। আপনি কেমন আছেন?

এই চলছে আর কি। ভাই, একটা দরকারে ফোন করেছিলাম।

বলুন না, বলুন।

ফোনে বলতে চাইছি না। সামনাসামনি বসে বলতে পারলে ভালো হয়। সন্ধ্যাবেলা আপনি কি ফ্রি আছেন?

কটার দিকে আসতে চাচ্ছেন?

এই ধরুন সাতটা।

আমি ও-সময় বাড়িতেই থাকব। চলে আসুন। আমার এখানে ডিনারও করবেন।

না না, তার দরকার নেই।

দরকার নেই কেন? আমি যতদূর জানি আপনি তো বাইরেই লাঞ্চ-ডিনার করেন। আজকে ডিনারটা না হয় আমার সঙ্গেই করলেন।

ঠিক আছে ভাই। আমি সাতটায় আসব।

সাতটা দশে গিয়ে মনিরুজ্জামান সাহেবের বাসায় পৌঁছালাম। দুজন মাত্র মানুষ। থাকেন তিনতলা বাড়ির পুরোটা নিয়েই। কয়েকজন কাজের লোক আছে। সিকিউরিটির লোক আছে। অল্পবয়সী একটা ছেলে আমাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে বসাল। কিছুক্ষণ পর এলেন মনিরুজ্জামান সাহেব। নিপাট ভদ্রলোক মানুষ। আমি আসব বলেই হয়তো প্যান্টের সঙ্গে হালকা আকাশি রঙের সুন্দর একটা টি-শার্ট পরেছেন। ষাটের ওপর বয়স। তারপরও শরীর বেশ মজবুত। মাথায় চুল কম। মুখের দিকে তাকালে বয়স বোঝা যায় না। একটু ভাবুক ধরনের মানুষ। হাসেন কম।

মুখোমুখি সোফায় বসে বললেন, আমি বুঝেছি আপনি কী বলতে চান।

আমি হাসলাম। তার মানে ওই ফ্ল্যাটে আপনার অভিজ্ঞতাও নিশ্চয়ই আমার মতো কিছুটা।

এ-কথার জবাব না দিয়ে তিনি বললেন, কী কী ঘটেছে, বলুন শুনি।

আমি একে একে পাঁচটি ঘটনাই খুলে বললাম। শুনে তিনি উদাস হয়ে রইলেন। কাজের ছেলেটা ট্রলিতে করে চা-নাশতা নিয়ে এলো। তিনি নিজ হাতে কোয়ার্টার প্লেটে আমাকে খাবার তুলে দিলেন। নিজেও নিলেন। নিন ভাই, নাশতা করুন।

থ্যাংকস।

প্লেট নিয়ে আমি একটা সমুচায় কামড় দিলাম। মনিরুজ্জামান সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি আগের মতোই উদাস। উদাস ভঙ্গিতেই সমুচা চিবুচ্ছেন। কয়েক সেকেন্ড পর আমার দিকে তাকালেন। কাহিনিটা বেশ লম্বা ভাই। কখনো সেভাবে কাউকে বলা হয়নি। টিয়ার কথাটা সবাই জানে। কিন্তু সে চলে যাওয়ার পর যা যা ঘটেছে সেসব আমি আর আমার স্ত্রী অনেকটা জানি। আমাদের বাড়ির পুরনো যে বুয়াটা আছে সে কিছুটা জানে। মানে তারও দু-একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার কথা সে শুধু আমাকে আর আমার স্ত্রীকেই বলেছে। অন্য কাউকে বলতে আমরা তাকে মানা করেছিলাম। তারপরও সামসুকে সে বোধহয় কিছু একটা বলেছে। কারণ সামসুকে সে-ই ওই বাড়িতে সিকিউরিটির কাজে এনেছিল। বুয়ার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। একই এলাকার লোক। তবে বুয়ার মুখে আমি শুনেছি, সামসু নাকি একদিন নির্জন দুপুরে হঠাৎ করে ছাদে গিয়েছে। গিয়ে টিয়াকে দেখতে পেয়েছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। সামসু বোধহয় শুকাতে দেওয়া কাপড় তুলতে গিয়েছিল। চিলেকোঠা পেরিয়ে মাত্র ছাদে পা দেবে, দেখে টিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। দু-হাত অঞ্জলি করে বৃষ্টির পানি ধরছে আর বৃষ্টিতে ভিজছে। মুহূর্তের জন্যই দেখা। হয়তো সে সামসুর উপস্থিতি টের পেয়েছিল। এক পলকের জন্য সামসুর দিকে তাকিয়েই হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল।

একটা সমুচা খেয়ে আমি চায়ে চুমুক দিয়েছি। বললাম, টিয়া কি আপনার মেয়ে?

ঠিক আমার ঔরসজাত না। মেয়ের মতোই ছিল।

মনিরুজ্জামান সাহেব আবার উদাস হলেন। এক ঢোক পানি খেয়ে চায়ে চুমুক দিলেন। মানে আমি এবং আমার স্ত্রী ওকে আমাদের মেয়েই মনে করতাম। অনেকবার চেয়েছি সে আমাদের মা-বাবা বলে ডাকুক। ডাকত না। মামা-মামি বলে ডাকত। ঘটনা আপনাকে খুলেই বলি। আমরা হচ্ছি বিক্রমপুর অঞ্চলের মানুষ। বিক্রমপুরের সচ্ছল পরিবারগুলোর প্রায় সবাই ঢাকায় থাকে। গ্রামে সুন্দর সুন্দর ঘরওয়ালা বড় বাড়ি পড়ে থাকে। সেসব বাড়ি দেখাশোনার জন্য কোনো কোনো পরিবারকে রাখা হয়। এই পরিবারগুলো পদ্মার ওপার থেকে আসে। চরের দরিদ্র মানুষ। বছরের পর বছর তারা ওইসব বাড়িতে কেয়ারটেকার হিসেবে থাকে। একটা সময় একেবারে বাড়ির মানুষ হয়ে যায়। বদরু ছিল আমাদের বাড়ির সেরকম কেয়ারটেকার। তাগড়া জোয়ান একজন মানুষ। অত্যন্ত পরিশ্রমী ও হাসিমুখের সৎ মানুষ। বদরুর বউয়ের নাম ছিল জুলেখা। ছোটখাটো ফুটফুটে চেহারার মহিলা। মানে যে-সময় আমাদের বাড়িতে ওরা এলো তখন বদরুর বয়স হবে পঁচিশ-ছাব্বিশ, জুলেখার কুড়ি-একুশের বেশি হবে না। বদরুর গায়ের রং কালো। কিন্তু চেহারাটা সুন্দর। জুলেখা ছিল টকটকে ফর্সা গায়ের রঙের। চোখ দুটো কটা। ওই ধরনের চোখের মানুষকে লোকে বলে ‘বিড়ালচোখো’। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারত। আমাদের বাড়িটা অনেক বড়। বাগান, পুকুর সবকিছু মিলিয়ে তিরিশ বিঘার মতো জায়গা। আমার বাবা মারা গেলেন যখন আমি বিয়েশাদি করে মাত্র ব্যবসা শুরু করেছি। তিনিও ব্যবসায়ী ছিলেন। লৌহজং বাজারে আমাদের ধান-চালের আড়ত ছিল। আর মাল টানার নৌকা ছিল চল্লিশটার মতো। সেসব বিশাল বিশাল নৌকা। বাবা কলকাতা থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে এসেছিলেন। আড়ত আর নৌকার ব্যবসা আমার দাদার আমলের। দাদার একমাত্র ছেলে হিসেবে বাবাকে ওই ব্যবসার হাল ধরতে হয়েছিল। কিন্তু আমরা দুই ভাই বাবার ব্যবসাটা দেখিনি। ভাই-বোনদের মধ্যে আমি সবার ছোট। বড় ভাই ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। পাঁচ বছর হলো মারা গেছেন। ভাবি তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে ধানমণ্ডিতে থাকেন। দুই ছেলে গার্মেন্টের ব্যবসা করে। একমাত্র মেয়েও বাপের বাড়িতেই থাকে। তাকে বড় একটা ফ্ল্যাট দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়ের বর ইঞ্জিনিয়ার। বড় ভাইয়ের পর আমার বোন। সে পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আমেরিকায়। দুলাভাই মারা গেছেন। আপার দুই মেয়ে। ছেলে নেই। তারপর আমি। আমার একমাত্র ছেলেটিও আমেরিকায় থাকে। বাবা মারা যাওয়ার পরও অনেকদিন বেঁচেছিলেন আমার মা।

মনিরুজ্জামান সাহেব একটু থামলেন। চায়ে শেষ চুমুক দিলেন। আপনার মনে হতে পারে আমাদের পারিবারিক ইতিহাস এভাবে কেন আপনাকে বলছি। বলছি টিয়ার ব্যাপারটা ক্লিয়ার করার জন্য।

আমারও চা প্রায় শেষ। টিপট থেকে আরেকটু চা ঢালতে ঢালতে বললাম, কোনো অসুবিধা নেই। আপনি বলুন।

মনিরুজ্জামান সাহেবও চা নিলেন। নিয়ে বললেন, টিয়া আসলে বদরু আর জুলেখার একমাত্র মেয়ে।

শুনে আমি একটু অবাকই হলাম। তাই নাকি?

হ্যাঁ। বাবা কালো, মা কটা চোখের ফর্সা মেয়ে। বাবার কিছুই পায়নি টিয়া। পেয়েছিল মায়ের রূপ আর তাঁর ডাগর কটা চোখ। কিন্তু মায়ের স্বভাবটা সে পায়নি। জুলেখা ছিল চঞ্চল স্বভাবের। টিয়া একদম তার উল্টো। ধীর, গম্ভীর।

আমার দিকে তাকালেন মনিরুজ্জামান সাহেব। আপনি স্মোক করেন?

জি না। আগে করতাম। চার-পাঁচ বছর আগে ছেড়ে দিয়েছি।

আমিও তেমন করি না। দিনে তিন-চারটা বা পাঁচটা। তা-ও মাইল্ড মার্লবোরো। এখন একটা সিগ্রেট খেতে ইচ্ছা করছে। আপনার অসুবিধা হবে না তো?

কিচ্ছু অসুবিধা হবে না। আপনি খান, প্লিজ।

মনিরুজ্জামান সাহেব তাঁর কাজের ছেলেটিকে ডাকলেন। কালাম, আমার সিগ্রেট দে।

কালাম ছেলেটা কাছাকাছিই ছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সিগ্রেটের প্যাকেট আর লাইটার নিয়ে এলো। কাচের সুন্দর একটা অ্যাশট্রে সোফার পাশে টিপয়ের ওপর রাখা আছে, এই প্রথম আমি তা খেয়াল করলাম। তার মানে, মনিরুজ্জামান সাহেব সবসময় সোফার ওই পাশটাতেই বসেন।

সিগ্রেট ধরিয়ে তিনি আবার অতীত জীবনে ফিরে গেলেন। মানুষের মৃত্যু যে কত অদ্ভুতভাবে আসে, মানুষ তা ভাবতেই পারে না। জুলেখার যে অমন মৃত্যু হবে আমরা কেউ তা কল্পনাই করিনি। পঁচিশ-ছাব্বিশ হয়তো তখন তার বয়স। টিয়ার বয়স দেড় বছর। যথারীতি স্বামী-স্ত্রী সারাদিন বাড়ির কাজ করেছে। মেয়ের গোসল-খাওয়ানোর কাজও করেছে জুলেখা। মা ছিলেন বাড়িতে। মা বাড়িতে থাকলে ওইটুকু টিয়া ঝাঁপিয়ে তার কোলে চলে আসত। কোল থেকে আর নামতেই চাইত না। মাও খুব ভালোবাসতেন বাচ্চাটিকে। টিয়া জšে§র পর থেকেই তার টানে এক-দুই মাস পরপর মা বাড়িতে যেতেন। থাকতেন আমার সঙ্গে। কখনো কখনো বড় ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েও থাকতেন। কিন্তু ঢাকায় ওই বড়জোর দেড়-দুই মাস। বলতেন, টিয়ার জন্য মন খারাপ লাগছে। গ্রামের বাড়িতে চলে যেতেন।

সেই রাতে মায়ের কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল টিয়া। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে জুলেখা তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে শুয়ে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটি। সকালবেলা বাপ-মেয়ের ঘুম ভাঙল, মায়ের ঘুমটা আর ভাঙল না। রাতে কোন ফাঁকে কেমন করে জুলেখা মারা গেল, দুই হাত দূরে শুয়ে থাকা বদরু তা টেরই পেল না। ওই বয়সী একটি মেয়ের কী এমন ঘটতে পারে যে ওইভাবে ঘুমের ভেতর সে মারা যাবে? জুলেখার কোনো অসুখবিসুখ ছিল না। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর তরুণী মা। হাসছে, ছোটাছুুটি করছে, কাজ করছে, আনন্দ করছে। সেই মানুষের এমন মৃত্যু!

মনিরুজ্জামান সাহেব পরপর দুবার সিগ্রেটে টান দিলেন। ধোঁয়া ছেড়ে একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ঠিক যেন জুলেখার মতো করেই নিঃশব্দে চলে গেল টিয়া। আমার স্ত্রীর নাম রেশমা। পাশের রুমে শুয়ে আমি আর রেশমা কিছুই টের পেলাম না। ওপাশের রুমে শুয়ে কাজের বুয়া দুজনও টের পেল না কিছুই।

মনিরুজ্জামান সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জুলেখা মারা যাওয়ার পর বদরু কী রকম যেন এলোমেলো হয়ে গেল। চুপচাপ এক জায়গায় বসে আছে তো বসেই আছে। বাড়ির কাজে মন নেই। নিঃশব্দে শুধু কাঁদে। মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না। তাকানোর অবশ্য দরকারও ছিল না। জুলেখা মারা যাওয়ার পরের সকাল থেকেই আমার মায়ের কোলে টিয়া। দেড় বছরের শিশুটি তার নিজের মাকে খোঁজেই না। সারাক্ষণ আমার মায়ের কাছে। মায়ের বয়স হয়েছে। তবু তিনি মেয়েটিকে খাওয়ান, গোসল করান। নিজের বুকের কাছে নিয়ে ঘুম পাড়ান। নিজের মা যে চিরতরে চলে গেছে টিয়া তা টেরই পায় না।

এসময় বদরু একদিন উধাও হয়ে গেল। উধাও তো উধাওই। কোথাও তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। পদ্মাচরের যে এলাকার মানুষ সে, সেখানে লোক পাঠিয়ে খোঁজখবর করা হলো, বদরুর পরিচিত-আধাপরিচিত যত লোকজন আমরা চিনতাম সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। কেউ কিছুই বলতে পারল না। সেই যে উধাও হলো মানুষটি এই জীবনে তার আর কোনো হদিস পাওয়া গেল না। বেঁচে আছে, না মারা গেছে, কেনই বা ওইভাবে মাহারা শিশুসন্তানটিকে ফেলে উধাও হয়ে গেল, এই রহস্যও আর জানা হলো না। স্ত্রীর শোকে ফুলের মতো একমাত্র সন্তানটিকে ফেলে কেউ এমন করে? মানুষের চরিত্রে যে কত রকমের রহস্য! বদরু চরিত্রের রহস্য অনেক ভেবেও আমি উšে§াচন করতে পারিনি।

মনিরুজ্জামান সাহেব আবার সিগ্রেট টান দিলেন। আবার উদাস হলেন। টিয়াকে কোলে নিয়ে মা তারপর ঢাকায় আমার কাছে চলে এলেন। টিয়া তার সারাক্ষণের সঙ্গী। ভাইয়ের বাসায় গেলেও টিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যান। ওর দেখাশোনার জন্য হালিমা নামে বারো-তেরো বছরের একটি মেয়েকে রেখেছেন। একদিকে টিয়া বড় হচ্ছে, আরেকদিকে আমার মা বৃদ্ধ হচ্ছেন। আমি আর রেশমাও টিয়াকে খুব ভালোবাসি। আমাদের ছেলেটির নাম ফারহান। সে বড় হয়ে গেছে। তার নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়েছে। বন্ধুবান্ধবের সার্কেল তৈরি হয়েছে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেই আমেরিকার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করছে। বেশ ভালো ছাত্র। ইউনিভার্সিটি অব অস্টিনে চান্স পেয়ে গেল। সেও টিয়াকে খুব ভালোবাসতো।

একটু দম নিলেন মনিরুজ্জামান সাহেব। এরপর বললেন, নিজের দিন যে ফুরিয়ে আসছে কোনো কোনো মানুষ বোধহয় তা টের পায়। আমার মাও টের পেয়েছিলেন। টিয়ার বয়স তখন চার-সাড়ে চার বছর। এক বিকেলে আমি আর রেশমা বসে চা খাচ্ছি। টিয়ার হাত ধরে মা আমাদের কাছে এলেন। হালকা-পাতলা শরীরের মানুষ ছিলেন। ওই বয়সেও ভালোই হাঁটাচলা করতে পারতেন। সেই বিকেলে মা এসে সরাসরি টিয়াকে ঠেলে দিলেন রেশমার কোলের দিকে। গভীর আবেগ এবং অনুনয়ের গলায় বললেন, মাগো, আমি তো আর বেশিদিন বাঁচব না। টিয়ার দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে গেলাম। ওকে তুমি আপন মেয়ের মতো করে দেখো। রেশমাও খুব আবেগী মানুষ। মায়ের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দুই হাতে টিয়াকে সে বুকে জড়িয়ে ধরল। ওকে নিয়ে আপনি ভাববেন না মা। আজ থেকে ও আমারই মেয়ে। মা তারপর আমাকে বললেন, বাবা মুনির, আজ থেকে এই মেয়েটির বাবা তুই। হাত ধরে মাকে আমি পাশের সোফায় বসালাম। মা, জীবনে কোনোদিন তোমার কথার অবাধ্য হইনি। তুমি যা বলেছ তাই হবে। কিন্তু তুমি এতো ভেঙে পড়েছ কেন? এতো মৃত্যুর কথা কেন বলছ? তোমার শরীর তো ভালোই আছে। মা মন খারাপ করা গলায় বললেন, কদিন ধরে খুব মরণের কথা মনে হয় বাবা। আবোল-তাবোল স্বপ্ন দেখি। আশ্চর্য ব্যাপার, এ-ঘটনার ঠিক সতেরো দিনের মাথায় ভোররাতে বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গেলেন মা। পড়লেন তো পড়লেনই। আর উঠলেন না। বাড়িতে ডাক্তার এলো। মাকে দেখে বলল, পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক।

কোন ফাঁকে সিগ্রেট শেষ করে অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়েছেন মনিরুজ্জামান সাহেব আমি খেয়ালই করিনি। আমার একটু ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। কথাটা বললাম তাঁকে। তিনি কালামকে ডেকে বললেন, স্যারকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দে।

ফিরে এসে দেখি তিনি পায়চারি করছেন। আমাকে দেখেই বললেন, চলুন আরেকটু চা খাই। আপত্তি নেই তো?

না না, চায়ে আমার আপত্তি নেই।

কালাম চা নিয়ে আসার পর মনিরুজ্জামান সাহেব আবার ফিরে গেলেন টিয়ার স্মৃতিতে। আমরা খুব চাচ্ছিলাম টিয়া আমাদেরকে মা-বাবা ডাকুক। সে কিছুতেই ডাকল না। সে ডাকে মামা-মামি। তাও দু-চারদিনে একবার-দুবার। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলে না। এমনিতেই চুপচাপ উদাস ধরনের শিশু ছিল। একা একা নির্জনে থাকতে পছন্দ করত। মা চলে যাওয়ার পর আরো চুপচাপ হয়ে গেল মেয়েটি। হালিমা নামের কাজের মেয়েটির সঙ্গেও তেমন মেশে না। ভালো একটা স্কুলে দিয়েছি। স্কুলে একদিন যায় তো তিনদিন যায় না। বলে, স্কুলের টিচারদের তার ভালো লাগে না, ছাত্রছাত্রীদের ভালো লাগে না। বাড়িতে টিচার রেখে দেওয়া হয়েছে। সেই টিচারের কাছেও ঠিকমতো পড়ালেখা করে না। প্রায়ই হালিমাকে দিয়ে টিচারকে বলিয়ে দেয়, সে আজ পড়বে না, ভালো লাগছে না। আমি আর রেশমা নানাভাবে বোঝাই।

এদিক-ওদিক বেড়াতে নিয়ে যাই। খেলনার দোকানে নিয়ে যাই। ঘুরে ঘুরে খেলনা দেখে ঠিকই। কেনে খুব কম। বড় রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাই। খেতেও চায় না ঠিকমতো। ফারহান প্রায়ই ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করে। একটা-দুটো কথা বলেই ফোন রেখে দেয়। একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালাম। সব শুনে ভদ্রলোক বললেন, একেবারেই অন্যরকম বাচ্চা। ওর যেভাবে ভালো লাগে সেভাবেই চলবে। কোনো কিছু নিয়ে চাপাচাপি করবেন না। আমরা চাপাচাপি আর করতাম না।

ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল টিয়া। সেই ফাঁকে অদ্ভুত এক অভিমান পেয়ে বসছিল তাকে। নিজের জীবনের কথা সে জেনে গিয়েছিল। বাবা-মায়ের কথা জেনে গিয়েছিল। প্রকৃত অর্থে আমরা যে তার কেউ নই, এসব বুঝে গিয়েছিল। সবমিলিয়ে তার হয়তো নিজের জীবনের ওপর অভিমান হয়েছিল। এই পৃথিবী বা প্রকৃতির ওপর অভিমান হয়েছিল। কেন তার জীবন এমন হলো, এই নিয়ে অভিমান হয়েছিল। তার কিন্তু হাসি-কান্না তেমন ছিলই না। বড় হয়ে ওঠার পর ওকে আর আমি হাসতে দেখিনি, কাঁদতেও দেখিনি।

রাগ-অভিমান তীব্র হলে আমরা বুঝতে পারতাম। কারণ সে খাওয়া-দাওয়া একদম ছেড়ে দিত। কোনোভাবেই তার মুখে কিছু তোলা যেত না। অন্য ছেলেমেয়ের যখন ক্লাস সেভেনে পড়ার কথা তখন সে পড়ে ক্লাস ফাইভে। তেরো-চৌদ্দ বছর বয়স হয়েছে। কিন্তু একটা বড় অদ্ভুত স্বভাব ছিল। অগোছালো কোনো কিছু দেখতে পারত না। নিজের বিছানা নিজে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখত। ফ্ল্যাটের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াত। এক জায়গার জিনিস অন্য জায়গায় থাকলেই নিঃশব্দে জায়গামতো রেখে দিত। দেয়ালের পেইন্টিংটা বাঁকা হয়ে থাকলে সেটাকে সোজা করে রাখত। এসব দেখে রেশমা একদিন মায়াভরা গলায় বলল, এই ফ্ল্যাটটা আমরা তোকে দিয়ে দেব মা। বিয়ের পর বর নিয়ে তুই এই ফ্ল্যাটে থাকবি। বোঝা যায় ফ্ল্যাটের সবকিছুর প্রতি তোর একটা মায়া আছে। এ-কথা শুনে টিয়া একেবারে অন্যরকম একটা কথা বলল। আমি বিড়ালছানা পুষব। আমাকে একটা সাদা বিড়ালছানা এনে দাও।

এই প্রথম মেয়ে মুখ ফুটে একটা কিছু চেয়েছে। সাদা বিড়ালছানা জোগাড়ের জন্য পাগল হয়ে গেল রেশমা। পরিচিত লোকজনকে বলে বলে ঠিকই সাদা একটা বিড়ালছানা কোত্থেকে যেন নিয়ে এলো। সাত-আটদিন হবে ছানাটির বয়স। সেই বিড়ালছানা নিয়ে মগ্ন হয়ে গেল টিয়া। একজন পশু ডাক্তার ডাকা হলো। এইটুকু বিড়ালছানার পরিচর্যা কীভাবে করা যায় সেসব জেনে নিল। সে আর হালিমা মিলে এতো যত্ন নিতে শুরু করল, ভাবাই যায় না। তবে ওই ডাক্তার বলে গিয়েছিলেন এইটুকু বিড়ালছানা বাঁচানো খুব মুশকিল। তার কথাই ঠিক হলো। দিন সাতেক পর বিড়ালছানাটি মারা গেল। মৃত বিড়ালছানা কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ পাথরের মতো বসে রইল টিয়া। কাঁদল না। কিন্তু তারপর দুদিন কিচ্ছু মুখে দিলো না। রেশমা খাওয়ানোর চেষ্টা করে। হালিমা আর বুয়ারা চেষ্টা করে, আমি নানা রকমভাবে আদর করে বোঝালাম, ফারহান আমেরিকা থেকে ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করল। কিছুতেই মুখে খাবার তুলল না সে। সামান্য একটু খেল দুদিন পর দুপুরের দিকে।

কী করব এই মেয়েকে নিয়ে?

সকালবেলা আমি বাড়ি থেকে বেরোব, হঠাৎ আমার সামনে এসে টিয়া বলল, তুমি কাঁটাবন চেনো, মামা?

চিনব না কেন? ওই তো এলিফ্যান্ট রোডের কাছে।

আমাকে একটু নিয়ে যেতে পারবে?

নিশ্চয়ই। কবে যাবে মা বলো?

এখন যদি যেতে চাই?

কোনো অসুবিধা নেই। চলো। তার আগে বলো তো মা কাঁটাবনে তোমার কী কাজ?

আমি একজোড়া বার্জিকা পাখি কিনব।

মেয়ে পাখি কিনতে চাইছে এর চেয়ে আনন্দের ঘটনা আমার জন্য আর হতে পারে না। অফিসের কথা মাথায়ই রাখলাম না। কাঁটাবনে পাখির দোকানে গিয়ে একটা সবুজ আরেকটা হলুদ রঙের বার্জিকা পাখি কিনল টিয়া। সুন্দর খাঁচায় ভরে পাখি ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো। পাখির খাবার কিনে আনলো। কীভাবে প্রতিদিন সকালে খাবার দিতে হবে, খাঁচার তলার ট্রে কীভাবে টেনে বের করে ময়লা পরিষ্কার করতে হবে, সব জেনে নিল দোকানির কাছ থেকে। খাঁচার ভেতর এক কোনায় মাটির হাঁড়ি বাঁধা। হাঁড়ির বুকের কাছে অনেকখানি জায়গা গোল সুন্দর করে কাটা। ডিম দেওয়ার সময় হলে ওই হাঁড়িতে ঢুকবে পাখি। দোকানির কাছ থেকে এসবও আমরা জেনে এলাম।

এই পাখি দুটোই হয়ে উঠল টিয়ার প্রিয়সঙ্গী। কিছুদিন পর জানা গেল পাখি দুটোর জোড়া মেলেনি। দুটোই পুরুষ পাখি। তাতেও টিয়া মন খারাপ করল না। গভীর মমতায় পাখি প্রতিপালন করতে লাগল। একটা সময় এমন হলো, খাঁচার মুখ খুলে দিলে পাখি দুটো এসে তার কাঁধে-হাতে বসে। গভীর বন্ধুত্ব পাখি দুটোর সঙ্গে।

একটু যেন ক্ষুব্ধ হলেন মনিরুজ্জামান সাহেব। মানে, কী বলব ভাই আপনাকে! কোনো কোনো মানুষের জীবন থেকে সব শুধু হারাতেই থাকে। টিয়ার জীবনে

শুধুই হারানোর ঘটনা। মা-বাবাকে হারাল। মায়ের পর যে মানুষটি তাকে সবচাইতে ভালোবাসত, আমার মা, তাকে সে নানু ডাকত, সেই মানুষটিও চলে গেল। আমি আর রেশমা প্রাণপণ চেষ্টা করলাম তাকে আপন করার। আমাদের আপন সে হলো না। আমাদের মাঝখানে থেকেও সে থাকল একা হয়ে। বিড়ালছানাটিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসল। সেই ছানা মরে গেল সাতদিনের মাথায়। বার্জিকা পাখি দুটোর ক্ষেত্রেও ঘটল এরকম ঘটনা। এক সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে টিয়া। খাঁচার মুখ খোলা। একটা পাখি এসে বসল তার হাতে, আরেকটা কাঁধে। হঠাৎ কী মতি হলো সবুজ পাখিটার, গ্রিলের ফাঁক দিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল। তার দেখাদেখি হলুদটাও গেল। চোখের পলকে কোথায় যে উধাও হয়ে গেল পাখি দুটো, টিয়া কিছু বুঝতেই পারল না। ফ্যালফ্যাল করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সারাটা দিন একঠায় ওখানটায় দাঁড়িয়ে রইল। এই বুঝি তার পাখি দুটো ফেরে।

পাখি ফিরল না।

সন্ধ্যা হলো।

রাত হলো।

পাখি ফিরল না।

আমি আর রেশমা অনেক বোঝালাম। এই ধরনের পাখি চলে গেলে আর ফিরে আসে না। খাঁচায় জš§ এবং খাঁচায়ই বড় হওয়া পাখি। বেরিয়ে গেলে তারা ফেরার পথ ভুলে যায়। অনেক সময় কাকে ধরে খেয়ে ফেলে।

সবই শুনল টিয়া। একটাও কথা বলল না। রাতে কিছু মুখেও দিলো না। পরে হালিমার মুখে শুনলাম, রাতে সে এক মিনিটও ঘুমায়নি। সারারাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকেছে। কখনো কখনো রুমে ঢুকেছে, আবার গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। পরের দিনও সে সারাদিন বারান্দায় কাটাল। মুখে দিলো না কিছুই। কত বোঝালাম আমরা, কোনো কথাই কানে তুলল না। সন্ধ্যাবেলা আমার মনে হলো, এরকম না খেয়ে থাকলে মেয়ে আমার বাঁচবে না। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম। ডাক্তার বললেন জোর করে হলেও খাওয়াতে হবে, আর না হয় স্যালাইন দিতে হবে। ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হবে।

আগেও দুয়েকবার স্যালাইন তাকে দেওয়া হয়েছে। ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। রেশমা আর আমি দুজন গিয়ে তার পাশে দাঁড়ালাম। রেশমা কাঁদছিল। টিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই কি চাস আমি তোর জন্য মরে যাই? কেন নিজেকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস? আমি তোকে তিনটা সাদা বিড়ালছানা এনে দেব। অনেকগুলো বার্জিকা পাখি এনে দেব। তুই আমার কথা শোন মা। তুই স্বাভাবিক হ। তুই যা চাস সব আমি তোকে এনে দেব।

এই প্রথম অদ্ভুত একটা কাণ্ড করল টিয়া। চট করে রেশমার মুখের দিকে তাকাল, আমার মুখের দিকে তাকাল। যেন বুকের ভেতর অনেক দিন ধরে আটকা পড়ে আছে কথাগুলো। হঠাৎই আগ্নেয়গিরির মতো বেরিয়ে আসছে এমন তীক্ষè কণ্ঠে বলল, কী এনে দেবে আমাকে তোমরা? বিড়ালছানা আর পাখি তো আনতেই পারবে। আমার মাকে কি আনতে পারবে? পারলে এনে দাও আমার মাকে। আমার বাবাকে এনে দিতে পারবে? পারলে এনে দাও আমার বাবাকে। আর আমার নানু? নানুকে এনে দাও।

টিয়া এভাবে কথা বলতে পারে আমাদের ধারণাই ছিল না। আমরা দুজন পাথর হয়ে গেছি। টিয়ার এরকম গলা শুনে বুয়ারা এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে, হালিমা এসে দাঁড়িয়েছে। টিয়ার এই কণ্ঠ তারা কোনোদিন শোনেনি। এই চেহারা কোনোদিন দেখেনি। সবাই স্তম্ভিত।

টিয়া আবার আগের মতো করেই বলল, তোমরা জানো, কোন কষ্ট নিয়ে আমি বেঁচে আছি? কোন কষ্ট নিয়ে আমি বড় হচ্ছি? হ্যাঁ, আমি জানি তোমরা আমাকে মেয়ে মনে করো। মনে করা এক, আর আসল মা-বাবা হওয়া আরেক। চাইলেই আসল মা-বাবা তোমরা আমার হতে পারবে না। আমি তো তোমাদের ঘরে জš§াইনি। আমার মা জুলেখা, বাবা বদরু। বাবার নিশ্চয়ই একটা পুরো নাম ছিল। সেই নাম আমাকে কেউ কখনো বলেনি।

তারপর কেমন যেন ভেঙে গেল টিয়া। কাতর অভিমানী কণ্ঠে বলল, আমার সঙ্গে এমন হলো কেন? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি? গরিব মানুষের ঘরে জšে§ছিলাম। তাদের ঘরেই না হয় বড় হতাম! সেই জীবনই তো ছিল আমার আসল জীবন। সেই জীবনে দুঃখ-বেদনা থাকলেও আমি তো আমার আসল মা-বাবার কাছেই থাকতাম। আমার জীবন এমন হলো কেন?

তারপর এই প্রথম আমরা সবাই হতবাক হয়ে দেখলাম দু-হাতে বারান্দার রেলিং ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল টিয়া। তার কান্না দেখে রেশমা কাঁদছে। হালিমা কাঁদছে। বুয়ারা চোখ মুছছে। আমারও চোখ ভেসে যাচ্ছে নিঃশব্দ কান্নায়। আর সেই ফাঁকে মনে হচ্ছে, কোন ফাঁকে টিয়া এমন ম্যাচিউরড হয়ে উঠেছে? যেভাবে কথাগুলো সে বলল, এভাবে তো অনেক বয়স্ক মানুষও গুছিয়ে কথা বলতে পারে না!

বেশ অনেকক্ষণ কাঁদল টিয়া। কোন ফাঁকে রেশমা তাকে জড়িয়ে ধরেছে। একসময় তার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, এতোদিন পর এসব কথা তুই আমাদের বললি মা? আমরা কি তোর এতোই পর? নিজের মা-বাবা তোর জন্য যা করতেন, আমরা কি সেই চেষ্টা তোর জন্য করিনি?

নিজেকে সামলে খুব স্বাভাবিক মানুষের মতো টিয়া বলল, আমি জানি আমার কথায় তোমরা খুব কষ্ট পেয়েছ। তারপরও বুকে আটকে থাকা সব কথা বের করে ফেললাম। তোমরা যাও, আমি এখন ঘুমাব। কাল সকালে তোমাদের সঙ্গে নাশতা করব। ডাক্তার, স্যালাইন ওসবের দরকার নেই। আমি ঠিক আছি। যাও তোমরা।

এসব আট মাস আগের কথা। সেই রাত ভোর হলো কিন্তু টিয়া আর জেগে উঠল না। ঠিক ওর মায়ের মতোই রাতের কোন প্রহরে যে নিঃশব্দে চলে গেল, আমরা কেউ টেরই পেলাম না। সব দেখেশুনে ডাক্তার বললেন, মৃত্যুর কারণ দুর্বলতা। না খেয়ে থাকার ফল।

বাড়িতে কান্নাকাটি চলছে। সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়েছিল, চার-সাড়ে চার বছর বয়সেও মন খারাপ হলে কিংবা অভিমান হলে টিয়া খেত না। জোর করেও খাওয়ানো যেত না। মা বলতেন, এই মেয়েটা হচ্ছে ওর নামের মতো। শুনেছি টিয়া পাখি অভিমান করে না খেয়ে থাকে। না খেয়ে থাকতে থাকতে মরে যায়।

আমাদের টিয়াও টিয়া পাখির মতো অভিমান করে না খেয়ে মরে গেল। ওর অভিমান ছিল নিজের জীবনের ওপর, পৃথিবীর ওপর। ওই যে বলেছিল, ‘আমার জীবন এমন হলো কেন?’ এই অভিমানেই সে না খেয়ে থাকত।

মনিরুজ্জামান সাহেবের কথা শুনতে শুনতে টিয়া মেয়েটির জন্য আমার মন খুব খারাপ হলো। নিজের মেয়েটির কথা মনে হলো। মেয়েটির মুখ দেখার জন্য ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে গেলাম আমি। কিন্তু মনিরুজ্জামান সাহেবকে কিছুই বুঝতে দিলাম না।

মনিরুজ্জামান সাহেব বললেন, টিয়া চলে যাওয়ার পর আমার স্ত্রী রেশমা অসুস্থ হয়ে পড়ল। এখনো সে স্বাভাবিক হয়নি। ওই ফ্ল্যাটটায় মাস দুয়েক তারপর আমরা ছিলাম। সেই দুই মাসে এই আপনার যেমন অভিজ্ঞতা, তেমন অভিজ্ঞতা আমাদেরও হলো। আমার ফোনসেট জায়গামতো রাখা, এলোমেলো বিছানা গুছিয়ে রাখা, বাঁকা পেইন্টিং সোজা করা, কানের কাছে বিড়ালছানার ডাক, ভোররাতে বার্জিকা পাখির ডাক আর ছায়ার মতো মাঝে মাঝে টিয়াকে দেখতে পাওয়া – সবই ঘটেছে। বুয়া একদিন শুনল, খুব কাছে দাঁড়িয়ে টিয়া তাকে বুয়া বুয়া বলে ডাকল। আর বৃষ্টির দিনে সামসুর ঘটনা তো আগেই বললাম। রেশমা আমাকে একদিন বলল, চলে গিয়েও টিয়া আসলে যায়নি। সে এই ফ্ল্যাটেই আছে। ওই যে আমি বলেছিলাম, এই ফ্ল্যাট আমি তোকে দিয়ে দেব। বিয়ের পর বর নিয়ে তুই এখানে থাকবি। সেদিন থেকেই এই ফ্ল্যাট তার। চলো আমরা এই ফ্ল্যাট যেমন আছে তেমন রেখেই নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠি। টিয়া থাকুক এখানে।

আমার এই বাড়ি তখন তৈরি হয়ে গেছে। টুকটাক কাজ বাকি ছিল। সেই অবস্থায় এসে উঠলাম। উত্তরার ফ্ল্যাটবাড়ির সামসু ছাড়া টিয়ার ব্যাপারটা কেউ জানে না। জানলে বাড়ির অন্য ফ্ল্যাট মালিকরা বা ভাড়াটিয়ারা ভয় পাবে। এই কারণে কঠোরভাবে সামসুকে আমরা কথা বলতে নিষেধ করেছি। সামসু সেটা মেনে চলছে। ফ্ল্যাটে আমরা তারপর সামান্য সময়ের জন্য দুয়েকবার গিয়েছি। গেলেই টিয়ার জন্য রেশমা কান্নাকাটি করে। ইদানীং আর যাওয়া হয় না। মাঝে মাঝে কালামরা দু-তিনজন গিয়ে সব গোছগাছ করে রেখে আসে। আপনি জোরজার করে ভাড়া নিলেন। প্রথমে ভাড়া আমি দিতে চাইনি। পরে একটা কথা ভেবে দিলাম। দেখতে চাইলাম টিয়া চলে যাওয়ার পর আমাদের সঙ্গে যা ঘটেছে, আপনার সঙ্গেও তেমন কিছু ঘটে কি না। ঘটল তো। সুতরাং ওই ফ্ল্যাট আর ভাড়া দেওয়া যাবে না। আপনিও ওখানে আর থাকবেন না। আজকের রাতটা আমার এই বাড়িতেই থাকুন। কাল সকালে কালামদের নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে যাবেন। আপনার ব্যাগ, স্যুটকেস গুছিয়ে নেবেন। ওরা ফ্ল্যাট লক করে আসবে।

আমি বললাম, না না, আপনার এখানে থাকবার দরকার নেই। এমনিতেই আমি ভেবেছি কাল সকালে চিটাগাং যাব। রাতটা ফ্ল্যাটেই থাকি। সকাল নয়টার দিকে কালামদের পাঠাবেন। ওরা লক করে আসবে। আমার ফ্লাইট দশটা চল্লিশে।

চলুন তাহলে খেয়ে নিই।

মনিরুজ্জামান সাহেব কালামকে ডাকলেন। কালাম, খাবার রেডি কর।

চলে আসার সময় মনিরুজ্জামান সাহেব আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন। আপনি দু-মাসের অ্যাডভান্স দিয়েছিলেন। টাকাটা ফেরত নিন।

সেই রাতে কিছুই ঘটল না। আমার অবশ্য ঘুম এলো একটু দেরিতে। বিছানায় শুয়ে টিয়ার কথা খুব মনে পড়ছিল। কী অদ্ভুত জীবন মেয়েটির! আশ্চর্য এক অভিমান নিয়ে পৃথিবী থেকে চলে গেল। আহা রে! পরদিন সকালবেলা কাঁটায় কাঁটায় নয়টায় কালাম আর হাফিজ এলো। ব্রেকফাস্ট সেরে আমি রেডি হয়েই ছিলাম। ওরা আসতেই স্যুটকেস টানতে টানতে বেরিয়ে এলাম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চাবিটা মাত্র কালামের হাতে দেব ঠিক তখনই আমার পাশে দাঁড়িয়ে কে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যেন গভীর বেদনার দীর্ঘশ্বাস। আমি আপাদমস্তক কেঁপে উঠলাম। কে ফেলল দীর্ঘশ্বাস? টিয়া?