সুবর্ণভূমির খোঁজে

নরসিংদী শহর থেকে বারো-চোদ্দো মাইল পুবে একটা গ্রাম আছে, যার মাটি শুকনো আর লাল, পথগুলিতে কাঁকড় বিছানো। মাঝে মধ্যে নিচু টিলা, ঘাস ছাওয়া ঢিবি। কিছুদিন হলো মানুষ জেনেছে, ঢিবিগুলির নিচে আদিযুগের স্থাপনা। আদিযুগ কতটা আদি – তা নির্ধারণ করতে জমি খুঁড়ে কিছু স্থাপনার কংকাল বের করা হয়েছে।  ইটের দেয়ালে-অলিন্দে পরীক্ষা চালিয়ে, মাটির ভাঙা পাত্র, পুতুল-পাতিল আর – অবাক! – অর্ধেক গুঁড়া হয়ে যাওয়া এক নকশাকরা ফুলদানির ওপর অনুসন্ধানী আলো ফেলে এসবের বয়স অনুমান করা হয়েছে হাজার-বারোশো বছর। যাঁরা এই কাজটা করেছেন – যাঁদের প্রত্নতত্ত্ববিদ বলে পরিচয় দিতে গিয়ে বারি সাহেবের দাঁত প্রায় ভেঙেই যায় – তাঁদের যিনি দলনেতা, ড. আজিজুর রহিম, তাঁকে বলেছেন, পণ্ডিত-জ্ঞানী লোকে যা-ই বলুন, এই জায়গাটা ছিল সুবর্ণভূমির প্রধান জনপদ, শহরও বলা যায়, রাজধানীও, যদিও সেটা তর্কসাপেক্ষ। তর্ক ড. রহিম করতে পারেন, বারি সাহেব পারেন না। তিনি প্রত্নতত্ত্ব পড়েননি, খোঁড়াখুঁড়িও করেননি, আদিকালের ধারেকাছেও যাননি কোনোদিন। প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানটিতে তিনি আছেন চিত্রগ্রাহকের ভূমিকায়। একসময় আজাদে কাজ করেছেন, পরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ফটোগ্রাফার ছিলেন। ছবি তোলার হাত ভালো বলে ড. রহিম তাঁকে ডেকে এনেছেন। বলেছেন, সুবর্ণভূমির খোঁজে আপনি আমাদের সহযোগী। সুবর্ণভূমিটা কী – বারি সাহেবের এই প্রশ্নে ড. রহিমের চোখে বিষাদ জমল। কী আবার, আমাদের আদি বাংলা, আদি এবং অকৃত্রিম, তিনি বললেন। হারিয়ে যেতে বসা সুবর্ণভূমির গা থেকে সময়ের ধুলোবালি সরিয়ে তাকে তুলে আনতে আপনি আছেন আমাদের সঙ্গে। একদিন লোকজন আমাদের ভুলে যাবে, কিন্তু আপনাকে মনে রাখবে, আপনার তোলা ছবি আপনার-আমাদের হয়ে কথা বলবে।

ভুলে যাওয়া-মনে রাখার কথায় বারি সাহেবের মনে একটা উদ্বেগ আরেকবার ছায়া ফেলল। বিঘা পাঁচেক জায়গা নিয়ে এই খোঁড়াখুঁড়ি চালানো শুরু করে ড. রহিমরা যত খুশি, তত বিরক্ত এবং রেগেমেগে আগুন গ্রামের লোক, কারণ তাদের ধারণা হয়েছে, একসময় পুরো গ্রাম নিয়ে টান দেওয়া হবে, ভিটেমাটি সব যাবে। যত নিষ্ফলা হোক জমি, জমি তো! বাপ-দাদার বাড়ি তো বাপ-দাদার বাড়ি – এর কোনো বদলা হয়? ড. রহিমের প্রত্নদল মনে স্ফূর্তি নিয়ে আসে, কাজ করে; কিন্তু গ্রামের মানুষের জমতে থাকা রাগ তাদের চোখে পড়ে না। বারি সাহেবের পড়ে, যেহেতু এটিই তাঁর ও তাঁর ক্যামেরার লেন্সের কাজ। জমির নিচে সুবর্ণভূমি না হয় স্বর্গভূমিই থাকুক, জমির ওপরের মানুষগুলি তো আদিকালের সুবর্ণদিনে নেই – যদিও সুবর্ণদিন কোনোকালে ছিল কি না, বারি সাহেবের সন্দেহ। তিনি ভয়ে আছেন, কোনদিন লোকজন এই দলের ওপর পড়ে। দলের মধ্যে যারা তরুণ, তাদের তিনি পছন্দ করেন। তাদের তিনি তাঁর ভয়ের কথা বলেছেন, তবে তারা কানে তোলেনি। সুবর্ণভূমির খোঁজে যারা নেমেছে, তারা এর একটা আদর্শপাঠ মাথায় রেখে এগোচ্ছে, যাতে রাগ-বিরাগ, বিবাদ-সন্ত্রাস এসব কিছুই নেই। যেন, সুবর্ণভূমির আঁচলের এক প্রান্তও যদি সময়ের মরিচা সরিয়ে বের করে আনা যায়, তাহলে গ্রামের মানুষ তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে সব বিরক্তি আর রাগ ভুলে যাবে, তারা সবাই মিলে গাইবে, ‘সার্থক জনম আমার।’ বারি সাহেব নিজেও কেন জানি এই আদর্শ পাঠকদের সঙ্গে থাকলে উদ্বেগটা ভুলে যান, যেমন এই অভিযানের চাকরিটা তাঁকে কিছু কষ্ট ভুলে থাকতে সাহায্য করেছে।

ইদানীং বারি সাহেবের টেনেটুনে দিন চলছিল। এতোদিন স্ত্রী মোমেনা খাতুনের উপার্জনেই সংসারটা চলত, যেহেতু তিনি ছিলেন পেনশনবিহীন অবসরে। কিন্তু ডেঙ্গুজ¦রে ভুগে স্ত্রী মারা গেলে তাঁর টাকা-পয়সার সংকট হলো, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে পুরনো ক্যামেরায় নতুন লেন্স পরিয়ে তিনি বিয়ের ছবি তুলতে শুরু করলেন। মাসে পাঁচ-ছয় রাত কাজ করলেই সংসার চালানোর টাকা উঠে যায়। সংসার বলতে তিনি আর দুলাল – তাঁর এক পা-হারানো কাজের ছেলে, আর কালো বিড়াল ক্লিও। স্ত্রী একে ডাকতেন ক্লিওপেট্রা, তিনি চলে গেলে বিড়ালের নামের অর্ধেকটাও চলে গেল।

বারি সাহেবের ছেলেমেয়ে হয়নি। তাতে তাঁর কোনো দুঃখ ছিল না। এ নিয়ে ভাবতেনও না। কিন্তু মোমেনা আগাগোড়া মর্মাহত ছিলেন। এজন্যে তিনি বিড়াল পুষতেন, টিয়া পুষতেন, এমনকি এক হুলো বিড়াল একটা টিয়াকে মেরে ফেললেও শিকার ও শিকারির সহাবস্থানে তাঁর বিশ^াসে চিড় ধরেনি।

বারি বলতেন মোমেনাকে, ছেলেমেয়ে হয়নি বলে আমার মন খারাপ হয় না, কারণ তোমাকে তাতে ষোলো আনা পেয়েছি। মোমেনা অবশ্য তা বুঝতেন, তারপরও তাঁর মনে হতো, তিনি মা হওয়ার জন্যই তো জন্ম নিয়েছিলেন। তা হলো না বলে ঘরে তাঁর মন বসত না। চাকরির জন্য একসময় মতিঝিল-দিলকুশায় ঘুরলেন দিন সাতেক, তারপর একটা জায়গা পেলেন এক আমদানি-রফতানির কোম্পানিতে, যারা কয়লা থেকে নিয়ে ফার্নেস অয়েল সবই আনে বিদেশ থেকে। সারাদিন ব্যস্ত থেকে মনের আনন্দে ঘর ভুলে থাকেন মোমেনা, তাতে ঘরের মানুষটিও যে দিনের শুরুতেই ঘরছাড়া হন, সন্ধ্যায় ফেরেন দেরি করে, তাঁর নজরে তা আসে না।

সংসার বলতে আমরা যা বুঝি তা মোমেনার ভাবনায় মোটামুটি থাকলেও বারি সাহেবের চিন্তায় তার কোনোই ছাপ ছিল না। বিয়ের বছর পাঁচেক পর থেকেই তিনি দেখেছেন, নিজের ঘরে তিনি থাকেন অতিথির মতো। এ-ঘরে সে-ঘরে যেখানে তাঁর পায়ের শব্দ মোমেনার জন্য নির্ভরতা ছড়ানোর কথা, তাঁর ছায়াটা আদরের মতো, সোহাগের মতো, ভালোবাসার মতো পালং-আলমারি-পর্দা-দেয়ালের সঙ্গে লেপ্টে থাকার কথা, ঘরের বাতাসে মোমেনার কথাগুলি গান হয়ে বেজে যাওয়ার কথা, দিনের শেষে একটা পূর্ণতার তৃষ্ণা নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা বারি সাহেবের এবং সারা সন্ধ্যা-রাত জুড়ে সেই তৃষ্ণা মেটানোর কথা, সেখানে কি না বিছিয়ে থাকে একটা ভদ্র, বিব্রত শূন্যতা; কথা হয়, দীর্ঘশ^াস ঝরে, সান্ত্বনা জানানো হয়, টুকটাক দিনের হিসাব চলে, মুখোমুখি বসে খাওয়া হয়, বিছানায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোও হয়, কিন্তু মাসশেষে হিসাব নিতে গেলে দেখা যায় লাল কালিতে পাতা ঢেকে গেছে।

যেটুকু সংসার ছিল তাঁদের ৫২/ব সেন্ট্রাল রোডের তিনতলার পুবের ফ্ল্যাটটিতে, তাও একদিন মোমেনার সঙ্গে চলে গেল গোপীবাগে তাঁদের পারিবারিক গোরস্তানে। এখন ঘরটাতে গোরস্তানের নীরবতা, সেন্ট্রাল রোড জুড়েই শূন্যতা। ড. রহিম বলেন, সুবর্ণভূমিতে মানুষ গোছানো সংসার করত। তারা মাটির চুলায় রান্না করত, রান্নাঘরে ইটের মেঝে ছিল। তাতে বসে সন্ধ্যাবেলা পিদিমের আলোয় তারা রাতের খাবার খেত। তারপর গল্প করত। দারু খেত, দারু রাখত বাঁশের তৈরি পাত্রে।

সংসার করত? বারি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

ভালোই করত। কিছু প্রমাণ পেয়েছি। বাকিটাও পাব। আপনি ছবি তুলবেন।

সংসারের ছবি তোলা যায়?

ড. রহিম বিব্রত হলেন। না, এ  তো আর জীবন্ত সংসার নয়, মানে মানুষজনই তো নেই – মানুষ না থাকলে সংসারজীবন হয় কীভাবে,

কিন্তু –

বুঝলাম, বারি সাহেব বললেন, আমার কাজ ওই অদৃশ্য, আদিকালে সমাপ্ত অথবা অসমাপ্ত সংসারের ছবি তোলা।

ড. রহিমের বিব্রত ভাব কেটে মুখে হাসি এলো। অসমাপ্ত সংসার – সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি বললেন।

বারি সাহেবের মনে পড়ল, বাড়ি ফেরার পথে বাবুলের জন্য নতুন ক্রাচ কিনতে হবে। আগেরটা সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে রেলিংয়ের ফাঁকে আটকে বেঁকে গেছে।

ড. রহিম বললেন, আমার থিওরিটা এই : অষ্টম শতকে একটা দারুণ সংস্কৃত, পরিশ্রুত, ভদ্রকাল কাটিয়েছে সুবর্ণভূমি। আমার খোঁড়াখুঁড়ি পরিকল্পনামতো এগোলে একসময় দেখাতে পারব, বাড়িগুলির গড়নে-বিন্যাসে, মানুষের জীবনযাপনে, সমাজ থেকে নিয়ে রাজ্যে, সবখানে শৃঙ্খলা ছিল। মানুষ সত্যিকার মানুষ ছিল।

আহা!

হ্যাঁ, সুবর্ণভূমিটা যদি থাকত!

বারি সাহেবের হঠাৎ  মনে পড়ল, মাস তিনেক আগে এক বিয়ের ছবি তুলতে গিয়ে এক বাবার আক্ষেপ শুনেছেন, আহা, মেয়েটা যদি থেকে যেত!

মেয়ে কেন থাকবে, তার তো বিয়ে হচ্ছে?

না, মেয়েটা প্রেম করে বিয়ে করেছে, বছরখানেক থেকে প্রেম। শুরুতে মেয়ের যে উচ্ছ্বাস ছিল ছেলেটাকে নিয়ে তা দিন গেলে মিইয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হলে সে একদিন বাবার সামনে বসে কেঁদেছে। বলেছে, বাবা, দোয়া কোরো।

বারি সাহেব ছবি তোলার সময় মেয়েটির চোখে সেই আলো দেখেননি, যা থাকলে কান্নার ছবিটাও হাসে। তার মনে হলো, সুবর্ণভূমিতে মেয়েদের বিয়ের দিন চোখে নিশ্চয় সেই আলোটা ফুটত। ড. রহিমকে বিশদ জিজ্ঞেস করতে হবে। কিন্তু ড. রহিম হঠাৎ কোন উত্তেজনায় পড়লেন? একটা ঢিবির সামনে দাঁড়িয়ে একজনের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন, কিন্তু আঙুল দিয়ে চুল ছেঁড়ার ভঙ্গি করছেন। বলছেন, এটা তোমার চলে যাওয়ার সময় হলো? এইখানে আসল খোঁড়াখুঁড়িটা শুরু হওয়ার আগে আগেই? তোমার কাজটা কে করবে?

যাকে তিনি কথাগুলি বলছেন, সে তাঁর ছাত্র। খুব উৎসাহ নিয়ে কাজে নেমেছিল। উত্তরে সে কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না, হয়তো একটা কৈফিয়ত। বারি শুধু শুনলেন, ছেলেটার গলা নিচু হয়ে অশ্রুত হওয়ার আগে, এই ঢিবির নিচে সুবর্ণভূমি নেই স্যার, আপনি যাকে সুবর্ণভূমি বলে ভাবছেন।

ঢিবির নিচে তাহলে কী আছে? জানার উৎসাহ হলো বারি সাহেবের। তিনি এগিয়ে গেলেন। তাঁকে দেখে ড. রহিম বিষণ্ন হাসলেন, বললেন, এভাবেই স্বপ্নগুলি মরে যায়। সুশান্ত বলছে এই ঢিবির নিচে কোনো নাটমণ্ডল নেই, যা কথায়, গানে সুবর্ণভূমির বাতাসটা রাঙিয়ে রাখত। সে বলছে, এখানে যা আছে তা একটা কয়েদখানা। কী আশ্চর্য!

কয়েদখানা?

সুশান্ত বলল, কয়েদখানা। যেখানে জমিদারের অপছন্দের মানুষদের ধরে নিয়ে এসে রাখা হতো। আমি তেমন নিশ্চিত নই, আমার  ভুল হতেই পারে। তবে, এই জায়গাটা জুড়ে যা আছে, তা সুবর্ণভূমি নয়, এ ব্যাপারে আমি এখন নিঃসন্দেহ, যা আছে তা এক প্রাচীন জনপদ, কী তার পরিচয়, আরো খুঁড়লে নিশ্চয় পাওয়া যাবে।

ড. রহিম সত্যিই কয়েকটা চুল ছিঁড়েছেন। সেগুলি হাতে নিয়ে অনুপস্থিতভাবে দেখতে দেখতে বললেন, তুমি এখন বলছো, এ-মাটির নিচে সুবর্ণভূমি নেই। অথচ এক সপ্তাহ আগে তুমিই তর্ক করতে সুবর্ণভূমির হয়ে, বাকিদের সঙ্গে।

সুশান্ত চুপ করে থাকল। কিছুক্ষণ পর বলল, আমাকে মাফ করবেন স্যার। সুবর্ণভূমির সত্যটা জানতাম না। স্বপ্নটাই শুধু জানতাম, আপনার থেকে ধার নেওয়া স্বপ্নটা।

ঘণ্টাখানেক পর সুশান্তকে দেখা গেল একটা ব্যাগ কাঁধে ফেলে সুবর্ণভূমি ছেড়ে যেতে। যাওয়ার আগে তার ছিমছাম ফ্লাস্কটা বারি সাহেবকে দিয়েছে। বলেছে, এটা রাখুন স্যার। আপনি চা খেতে যেরকম ভালোবাসেন।

বারি হাসলেন। চা-ই এখন তাঁর প্রধান খাদ্য ও পানীয়। ফ্লাস্কটা দেওয়ার সময় সুশান্ত বলেছে, তার বাবা পরশুদিন জমির মামলায় আদালতে হেরে তাকে বলেছেন, মাঠেঘাটে তাঁবু খাটিয়ে পড়ে না থেকে বাইরে কোথাও যাও।

বারি জানলেন, সুশান্তদের বাপ-দাদার ভিটেমাটিটা শেষ পর্যন্ত বেহাত হলো। সুশান্তর বাবা অবশ্য শহরে থাকেন, কুমিল্লায়। কিন্তু আদি বাড়িটা ছিল তার কাছে এক তীর্থের মতো। কেউ থাকত না, এক আত্মীয় শুধু এর দেখাশোনা করতেন; কিন্তু ভূমিরাক্ষসদের রাজ্যে এরকম অরক্ষিত আয়োজন শুধু এদের লোভ আর বীভৎসতাকেই উসকে দিতে পারে।

সুশান্তর বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপিল করবেন। তাঁকে সবাই বলেছে, তাতে হাত-পা বেঁধে নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার মতো হবে ব্যাপারটা। সুশান্ত জানাল, সে যাচ্ছে তাঁকে নিবৃত্ত করতে। জমি খুঁড়ে সুবর্ণভূমিকে জাগানোর আগে বাবাকে রক্ষা করা দরকার।

ড. রহিম বললেন, একটা বড় কাজে, যুগান্তকারী কাজে নামলে ব্যক্তিগত সমস্যাগুলি একপাশে সরিয়ে রাখতে হয়। সুশান্তের বাবা স্থানীয় রাজনীতির ভিকটিম। আজ জমি হারিয়েছেন, কাল ফিরে পেতেও পারেন। সেজন্য সুবর্ণভূমির স্বপ্ন মিথ্যা হয়ে যাবে?

কোন রাজনীতি করতেন সুশান্তর বাবা? বামের নিশ্চয়, সুশান্তর কথা শুনে যেটুকু বুঝেছি, বারি বললেন। তাহলে শহরে কেন থাকতেন? শহর  তো ডানের দখলে, সেই কবে থেকে?

না, ড. রহিম বললেন। রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে শহরে এসেছিলেন। তা না হলে তাঁর জীবনসংশয় হতো।

বারি সাহেব ড. রহিমের ভুল শুধরে দিলেন। সুশান্তর বাবার মতো মানুষদের জমি হারানোটা হয়ে দাঁড়ায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উল্টো পিঠ। তাঁরা বংশানুক্রমে জমির মালিকানা ফিরে পাওয়ার অধিকার হারান। তাছাড়া মামলায় হারা এক জিনিস, আপিল করা অন্য। সুশান্ত ঠিকই বুঝেছে, বাবাকে বাঁচাতে হলে সামলে রাখতে হবে।

সুশান্ত চলে গেলেও অবশ্য সুবর্ণভূমির স্বপ্ন রং হারালো না। ওর জায়গায় অন্য দুজনকে বরং নিলেন ড. রহিম। এর মধ্যে একটি মেয়ে। সে কাজ করে আর ইয়ার ফোনে গান শোনে। বারি সাহেব বিষয়টা পছন্দ করলেন। একদিন জিজ্ঞেস করলেন, কী গান শোনেন?

এই নানা ধরনের, মেয়েটি বলল। তারপর তাঁকেই জিজ্ঞেস করল, আপনার তো তেমন কাজ নেই, কিন্তু প্রতিদিন কেন আসেন?

ওই কাজ নেই বলেই। বাসায় বসে থাকতে কষ্ট হয়। এখানে এলে মনে হয় কিছু একটা করছি।

যেমন, সুবর্ণভূমিকে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করছেন। না?

বারি সাহেব জানলেন, মেয়েটা এসেছে প্রধানত তার সিভিটা বড় করতে, ড. রহিমের দলে ঢোকা আর বিদেশের জার্নালে একটা স্কোপাস-সমর্থিত নিবন্ধ ছাপা হওয়া একই কথা। তার ওপর আছে একটা বেতন।  সেটিও মন্দ নয়।

বারি সাহেবের মন খারাপ হলো। তার মানে মেয়েটা ড. রহিমের স্বপ্নের ভাগিদার নয়।

না, ঠিক তা নয়। সুবর্ণভূমির স্বপ্ন  কে না দেখে। তবে সুবর্ণভূমিটা এই পাঁচ বিঘা করিডোরে নেই।

মেয়েটা এরপর তিন পণ্ডিতের পরিশ্রমী গবেষণা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে জানাল, এ-জায়গাটাতে একটা ছোটখাটো সেটলমেন্ট ছিল, এর প্যাটার্ন দেখে মনে হয় এক ধরনের ট্রেডিং পোস্ট। হয়তো কাপড় – নরসিংদীর কাপড়ের ঐতিহ্য আদিকালের। মেয়েটি একটু দূরের একটা হাজামাজা খালের দিকে আঙুল তুলে বলল, ওই খালটা একসময় একটা নদী ছিল, এখন জানে না তো কেউ। সেই নদীতে জল ছিল, ঢেউ ছিল, নৌকা চলত। নদীতে নিশ্চয় অবাক সূর্যাস্ত হতো, বসন্তে ফুলের রেণু অথবা শীতে হিম ঝরে পড়ত। কিন্তু সেগুলি অনুভব করার মতো বেশি মানুষ ছিল না। তারা ব্যস্ত ছিল অফিসের কাজে।

কথাগুলি অবশ্য মেয়েটি বলেনি। সে ওই নদীতে নৌকা চলা পর্যন্তই বলেছে। বাকিটা বারি সাহেবের। বিয়ের পর কিছুকাল তিনি মোমেনাকে নিয়ে কালিন্দীতে নৌকায় ভেসেছেন। শীতের হিম মোমেনার ওপর পড়লে মাঝির চোখ বাঁচিয়ে তিনি তাঁকে চাদরের নিচে টেনে নিতেন।

কাজের ফাঁকে চা খেতে খেতে একটি ছেলে তাঁকে বলেছে, আপনার ছবি তোলার মতো বেশ কিছু বিষয় কাল পেয়ে যাবেন। ঘর-গৃহস্থালির জিনিস। টুকটাক প্রত্নসম্পদ। তবে কিছু মুদ্রা বা কড়িও পাওয়া যেতে পারে। মুদ্রা বিনিময়ের জন্য উপযুক্ত জায়গা ছিল এই স্থাপনাটা।

মুদ্রা বিনিময় কথাটাতে সবাই হাসল। সবাই মানে চারজন। তারা চোখাচোখি করল। চোখে চোখে একটা কোনো অর্থ বিনিময়ও। না, এই অর্থ মুদ্রা নয়, এটা মুদ্রার পেছনের রহস্য।

একজন জিজ্ঞেস করল বারিকে, স্যার আপনি কি ডেইলি পেমেন্ট পান, না কন্ট্রাক্ট জবে আছেন?

বারি হাসলেন। এরকম প্রশ্ন তিনি সুবর্ণভূমির ছাদে বসে শুনতে চান না। এসব ভাবনা থেকে মোমেনা তাঁকে দূরে রেখেছেন।

খোঁড়াখুঁড়িতে কদিন থেকে বেশ গতি এসেছিল, এবং ছেলেটার কথামতো বেশ কিছু জিনিস পাওয়াও গেল, যেগুলিকে গান-শোনা মেয়েটি যত্ন করে আলাদা করল। এগুলোর মধ্যে পায়ের মল অথবা হাতের বাজুতে পরার গয়নামতো কিছু পাওয়া গেল, তবে নিম্নমানের কোনো ধাতুতে তৈরি। একটা মাটির হাঁড়িতে রাখা ছিল, জমে অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে। বারি সাহেব ইমিটেশন থেকে আসল সোনা আলাদা করাটাই জানেন না, এসব সামগ্রী কোন ধাতুতে তৈরি তা কী করে বলবেন। তাঁর কাজ ছবি তোলা। এক ফাঁকে তাঁর লেন্সে স্যুট-টাই পরা এক ভদ্রলোক ধরা পড়লেন। তাঁকে এর মধ্যে দু-একবার দেখা গেছে, জিন্স-টিশার্ট পরা, মাথায় বেসবলের ক্যাপ। আজ তাঁকে দেখা গেল বেশ ধোপদুরস্ত কাপড়ে। ভদ্রলোক এগিয়ে এসে তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। হাত মেলানোটা বারি সাহেবের নিতান্ত অপছন্দ, তারপরও সৌজন্য বলে কথা। ভদ্রলোক বললেন, আজ কিছু ইম্পর্টেন্ট গেস্ট আসবেন। তাঁদের ছবিটা যেন ভালো তোলা হয়।

তারা কি প্রত্নসামগ্রী, বারি জিজ্ঞেস করলেন। কারণ তাঁর কাজ প্রত্নসামগ্রীর এবং প্রত্ন-খোঁড়াখুঁড়ির ও নানাবিধ আবিষ্কারের ছবি তোলা। জ্যান্ত মানুষের ছবি তোলা না।

চার-পাঁচ ছেলেমেয়ে জোরে হেসে উঠল। ভদ্রলোক বিব্রত হলেন। নিশ্চয় রাগলেনও। কিন্তু এদের সামনে রাগ দেখানো ঠিক হবে না। তিনি চুপ করে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর জানা গেল, তাঁর নাম ড. আবরার তরফদার। সুবর্ণভূমি প্রকল্পের প্রধান পরামর্শদাতা। সামাজিক নৃতত্ত্বে পড়াশোনা আছে, গালভরা নামের এক বিদেশি ইউনিভার্সিটি থেকে। ড. রহিম বললেন, তরফদার সাহেব না থাকলে সুবর্ণভূমি অধরাই রয়ে যেত।

সুবর্ণভূমি তাহলে প্রকল্পের মলাটে ঢুকল? বারি প্রশ্ন করলেন, যা শুনে ড. রহিমের অস্বস্তি হলো এবং দৃশ্যমানভাবেই। বললেন, খোঁড়াখুঁড়িতে পয়সা লাগে, লজিস্টিকস্ লাগে, পুলিশি সহায়তা লাগে।

বটে। বারি মাঝে মাঝে কিছু পুলিশকে দেখেছেন। অলসভাবে দাঁড়িয়ে-বসে থাকে, হাসাহাসি, গালগল্প করে, মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকে।

মাটির নিচে ঘুমিয়ে থাকা সুবর্ণভূমির সুরক্ষার জন্যও তাহলে পুলিশ লাগে!

বারির ইচ্ছে হলো কেতাদুরস্ত তরফদার লোকটার মনে সুবর্ণভূমি কোন ছবি আঁকে, তা একটা প্রশ্ন করে জেনে নিতে। কিন্তু তার মুখে আঁকা অস্বস্তি সেই ইচ্ছাকে বাড়তে দিলো না।

দুপুরের একটু আগে সুবর্ণভূমির নীরবতা ভেঙে কিছু চকচকে গাড়ি এসে ঢুকল। বারি সাহেব একটা গাছের নিচে বসে ঝিমুচ্ছিলেন। যে-লোকজন আসবে তাদের ছবি তুলতে ড. রহিমও তাঁকে অনুরোধ করেছেন। সে-অনুরোধ বারি ফেলবেন না। কিন্তু যখন দুই ভ্যানে করে বিয়েবাড়ির টেবিলের মতো দুই বড় টেবিল এবং টেবিল ক্লথ এলো, চেয়ার এলো, একটা টেবিল বসিয়ে দুদিনের জড়ো করা প্রত্নসামগ্রী বিছানো হলো সাদা টেবিল ক্লথের ওপর, অন্য টেবিলের দুদিকে চেয়ার পাতা হলো, বোঝা গেল সুবর্ণভূমি প্রকল্প দেখতে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা গণ্যমান্যই বটে। বারি সাহেব দেখলেন, সামনের গাড়ি থেকে দু-তিন সাদা নারী-পুরুষ নামল। বাকিগুলি থেকে কেতাদুরস্ত আরো কয়েকজন। টিভি ক্যামেরা, সাংবাদিক। তবে সব চোখ স্থির হলো যার ওপর, তাঁকে তোয়াজের ভাষায় মধ্যমণি বলা যায়। তাঁর গাড়িতে পতাকা। আবিষ্কারের আশায় থাকা সুবর্ণভূমির আদিকালের বাতাসে নিশ^াস নিয়ে তা যেন তাজা হলো। পতপত উড়তে থাকল।

বারি সাহেব মন্ত্রীকে দেখে চমকে উঠলেন। এই লোক এসেছে সুবর্ণভূমি প্রকল্পের সফলতার সাক্ষী হতে – এবং তরফদার সাহেবের ছোটাছুটিতে যার ইঙ্গিত ছিল – এর সাফাই গাইতে? এ লোক সুবর্ণভূমির আদি-মধ্য-অন্ত সব পতাকার নিচেই তো ঠাঁই পেয়েছে, কিন্তু কোন পতাকাটা তার আবেগটা জাগায়, বারির জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়।

তারা এসে বসলেন একটা টেবিলে লাগানো আটটা চেয়ারে। আটটার তিনটাই সাদাদের জন্য, সুবর্ণভূমির মধ্য-অন্তকালে যাদের হাতে এর মালিকানা ছিল। দুটি চেয়ারে বসার জন্য যারা এগিয়ে এলেন, তাদের গণ্যমান্যতা এমনি যে, চেয়ার দুটিও যেন উঠে দাঁড়ালো। সিংহাসনের মতো চেয়ারে কে বসবেন, তা সুবর্ণভূমির মরে ভূত হয়ে যাওয়া চৌকিদাররাও জানেন। বাকি দুটিতে বসার জন্য একটা ব্যস্ত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। একটাতে চোখের পাতা ফেলার আগেই বসে পড়লেন তরফদার সাহেব, নিশ্চয় মিউজিক্যাল চেয়ার খেলে খেলে শিল্পটা শিখেছেন। তিনি একবারও ড. রহিমকে চেয়ারে বসতে ডাকলেন না, অথচ ড. রহিম এই প্রকল্পে যোগ না দিলে এটি নরসিংদী পৌরসভার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি থেকে বেশি মর্যাদা পেত না। শেষ চেয়ারটাতে একসঙ্গে তিনজন বসতে গিয়ে চেয়ারসহ তিনজনই পড়ে গেলেন।

ভূত হয়ে যাওয়া সুবর্ণভূমির চৌকিদাররা কি এই খেলাটি কখনো দেখেছেন? বারি সাহেবের জানতে ইচ্ছা হলো।

কথা শুরু হলো।

আজ প্রকল্পের সব ছেলেমেয়ে এসেছে। বারি গুনে দেখলেন, বারোজন। তাদের একজন পাশের টেবিলে সাজানো প্রত্নসম্পদ সাদা একটা টেবিল ক্লথে ঢেকে রেখেছে। কথা শেষ হলে মন্ত্রী কাপড়টা টেনে সরিয়ে সেসব উন্মোচন করবেন। কিন্তু কথা কি আর সহজে শেষ হয়। এক সাদা লোকের চোখ বারি সাহেবের দুই ক্যামেরার একটির দিকে। তারিফের সুরে বলল, দারুণ! তা বটে, ক্যামেরাটা ছিল বারি সাহেবের বাবার কেনা, স্বাধীনতার পরপর, ক্যানন-এফ ১। এটি তাঁকে বাবা দিয়েছিলেন ক্লাস এইটে বৃত্তি পাওয়ার পর। তারপর এক বছরও যায়নি, বাবা চলে গেলেন মহাযাত্রায়। ক্যামেরাটা দিয়ে বারি সাহেব আর ছবি তোলেন না – ডিজিটাল যুগ এসে পড়লে এর ফিল্ম খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হলো। কিন্তু সুবর্ণভূমির ছবি তোলার আমন্ত্রণ এলে এটিকেই তিনি বেছে নিলেন। বারি সাহেবের আদিকালের এই ক্যামেরায় এই ভূমির আদিকালের ছবি ফুটবে ভালো।

অনেক কষ্টে এই ক্যামেরার জন্য তিনি ফিল্ম জোগাড় করেছেন। সাহেব লোক ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখল। পাশের সঙ্গিনীর সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে কথা বলল। বারি সাহেবকে সেটি ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল, আমার বাবার এই ক্যামেরাটা ছিল।

বাবা বেঁচে আছেন?

আছেন।

ও।

যোগাযোগ নেই যদিও।

আচ্ছা।

সাদা লোকটার মুখে একটুখানি বিষাদ জমল। কিন্তু মন্ত্রীর গলার আওয়াজটা হঠাৎ ওপরে উঠলে তা মিলিয়েও গেল। সে অবাক চোখে তাকিয়ে বারি সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, যদি কিছু মনে না করেন, ভদ্রলোক কী বললেন?

এখানে একটা জাদুঘর করবেন বলে তিনি প্রতিজ্ঞা করছেন। বিশ^মানের জাদুঘর হবে। দেশ-বিদেশের মানুষ আসবে, তারা দেখবে, আমাদের ইতিহাস কত পুরনো। এই ইতিহাস যাতে হারিয়ে না যায়, সেজন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম।

মন্ত্রীর উত্তেজনার পারদ যুদ্ধে এসে সবচেয়ে ওপরের দাগ ছুঁয়েছে।

সাদা লোক অল্পখানি হাসল। হাসিটাতে কোনো অভিমত নেই, কারণ ক্যানন এফ-১ তাকে তার ছেলেবেলায় নিয়ে গেছে, যাতে তার বাবা বেশিদিন চিহ্ন রাখতে পারেননি, অথবা চাননি। একটা ক্যামেরা কিনে দিয়ে বলেছেন, একদিন আমি মিলিয়ে যাব কিন্তু এই ক্যামেরায় তোলা ছবি হয়ে থেকে যাব।

না, কথাটা সাদা লোকের নয়, কথাটা বারি সাহেবের বাবার। তাঁর আফসোস, বাবার সঙ্গে এই ক্যামেরায় তাঁর কোনো ছবি তোলা হয়নি। সাদা লোকটার নিশ্চয় অনেক ছবি আছে।

লোকটা এখন গেছে তার ছেলেবেলায়। তার মনোযোগ আর মন্ত্রীতে নেই।

একটা কুকুর অলস শুয়ে আছে একটু দূরে। আরো দুই-তিন কুকুর ঘুরঘুর করছে। প্যাকেট লাঞ্চ এসেছে, সেসব খেতে খেতে মাটিতে কিছু ফেলবে লোকজন, সেই আশায়।

কিন্তু প্যাকেট লাঞ্চ খাওয়া হলো না, অন্তত সুবর্ণভূমির প্রত্নমাটিতে। কুকুরগুলিও অভুক্ত থাকল। মন্ত্রী কথা শেষ করে পাশের টেবিলের সাদা কাপড়টা টেনে তুলছেন আর বারির মনে হলো তিনি যেন কোনো লাশের ওপর থেকে কাফনটা সরিয়ে দিচ্ছেন, সবাই যেন একবার শেষ দেখা দেখতে পারে। এই লোকটার কাছে সুবর্ণভূমির আদি ইতিহাসটা মৃত। অন্তের একটা পর্যায়ের ইতিহাসটাও। সে শুধু বোঝে আজকের চলমান ইতিহাসটা, যাতে তার একটা অধিকার সে তৈরি করে নিয়েছে। তা না হলে আটটা চেয়ারের মধ্যে একটিমাত্র কেন থাকবে সিংহাসনের আদলে, এবং তাতে বসার অধিকার শুধু সে-ই কেন পাবে?

কিন্তু বারো ছেলেমেয়ে একটা ছোটখাটো শোরগোল তুলেছে। হেডফোন লাগিয়ে কাজ করা মেয়েটা এগিয়ে এসে বলেছে, এই প্রত্নসামগ্রীর উন্মোচন আপনি করার অধিকার রাখেন না। আপনি শুধু দেখুন, তারপর চলে যান।

এতো স্পষ্ট করে ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে কেউ কথা বলতে পারে, না শুনলে বারি সাহেব বিশ^াস করতেন না।

সাদা লোক বারি সাহেবকে বলল, প্লিজ, মেয়েটা কী বলল?

তিনি কিছু বলার আগে সাদা নারীটি বললেন, লোকটার ইতিহাস মেয়েটি জানে। এরা সবাই জানে। মন্ত্রীকে সে তা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

কেতাদুরস্ত দুজন লোক একসঙ্গে গর্জন করে উঠলেন। ইংরেজিতে বললেন, শাট আপ। পেছন থেকে আরেকজন বললেন, বেয়াদব।

এবার একটি ছেলে এগিয়ে এসে বলল, আপনারাই বরং শাট আপ হয়ে যান।

মন্ত্রীর সঙ্গে পুলিশও ছিল। তারা প্যাকেট লাঞ্চের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এখন দ্রুত এগিয়ে এসে তারা ছেলেটিকে সরিয়ে নিতে চাইল। মন্ত্রী হাত তুলে তাদের নিষেধ করলেন। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে।

তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে তিনি তাঁর গাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। কেতাদুরস্তরাও চোখে বিষ ঢেলে মেয়েটিকে নীল করে দেওয়ার একটা চেষ্টা চালালেন। তারপর মন্ত্রীর পেছন পেছন ছুটে গেলেন। ছুটে গেলেন তরফদার সাহেবও। মন্ত্রী আর কেতাদুরস্তদের গাড়ি সবেগে বেরিয়ে গেল। যত প্যাকেট-লাঞ্চ নিয়ে আসা হয়েছিল সেগুলি ফেরত নিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল। সরকারি মিডিয়ার সাংবাদিকদের নিয়ে শেষ গাড়িটাও ছেড়ে দিলো। বারি বুঝলেন, দু-তিন যে রিপোর্টার এসেছিল, তারা নিশ্চয় কৌতূহলে মরেই যাচ্ছিল জানতে কেন মেয়েটি এই কথাগুলি বলল, বলতে সাহস পেল। কিন্তু তাদের চাকরি বাঁচাতে হবে। আজ হয়তো টিভিতে কোনো খবরই যাবে না সুবর্ণভূমি প্রকল্পের।

ভ্যানওয়ালার লোকজন টেবিল-চেয়ার ভাঁজ করে ভ্যানে তুলতে শুরু করল। ছেলেমেয়েগুলি বড় দুই ট্রাংকে প্রত্নসামগ্রী ঢুকিয়ে ড. রহিমের দিকে তাকিয়ে থাকল। ড. রহিম একটা গাছের নিচে বসে পড়েছেন। তাঁর চোখ বন্ধ।

বারি তাঁর ক্যানন এফ দিয়ে তাঁর একটা ছবি তুললেন। তিনি বুঝলেন, এখন ড. রহিমের হারিয়ে যাওয়ার সময়। হয়তো মেয়েটারও। কিন্তু তাঁকে খুব বিচলিত মনে হচ্ছে না। ছেলেটাও, যে কি না কেতাদুরস্তদের ‘শাট আপ’-এর গোলা তাদের দিকেই ফিরিয়ে দিয়েছে।  শুধু প্রকল্পের সুরক্ষার জন্য যে জনা চার পুলিশ ছিল, যারা প্যাকেট লাঞ্চের আশায় দূরে বসে ঘটনাটা দেখছিল, তারা এগিয়ে এলো। এক পুলিশ বলল মেয়েটাকে, আপা, আপনার কিন্তু খবর আছে। আজ আর বাড়িতে যাইয়েন না।

তরফদার এসে ড. রহিমকে বললেন, সব শেষ। প্রকল্প শেষ। এখন প্যাকআপ করেন।

ড. রহিম হাসলেন। বললেন, আমিও তাই ভাবছি।

তরফদার রেগে আছেন। তিনি বললেন, আমার কত বড় ক্ষতি হলো আপনি কি বুঝেছেন?

ক্ষতি বিশেষ হয়নি, কারণ সুবর্ণভূমি আসলেই এখানে নেই, অন্য কোথাও আছে, ড. রহিম বললেন, তবে চিন্তা করবেন না, একসময় আপনি তার খোঁজ পেয়ে যাবেন। প্রকল্পটা তখন ওই জায়গা ঘিরেই করে নেবেন। সমস্যা নেই।

সমস্যা একটা অবশ্য ড. রহিম ও তাঁর প্রত্নদলের জন্য বড় হয়ে দেখা দিলো। তাদের যে দুই মাইক্রোবাস সকালে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে, সেগুলি আসবে বিকেল চারটায়। তার আগে এখান থেকে যাওয়া যাবে না। দুটো ট্রাংক সিলগালা করে নরসিংদী ডিসি অফিসে রেখে যেতে হবে, ডিসি অফিসের লোকটা বসে আছে।

ততক্ষণ তাঁরা কী করবেন?

তরফদার বললেন, সেটা আপনার চিন্তা। আমার না। আমি যাচ্ছি। যদি চান, ট্রাঙ্ক দুটো আমি নিতে পারি, তাহলে অবশ্য আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।

ড. রহিম মাথা নাড়লেন। গেলে সবাই যাবে। একসঙ্গে। তরফদারকে বললেন, একটা মাইক্রোবাস আনিয়ে নেন না, প্লিজ। ওরা না হয় গাদাগাদি করে বসে যাবে।

ছেলেমেয়েগুলি নিজেদের মতো করে গল্প করছে। যেন গুরুতর কিছুই ঘটেনি। তাদের একজন ড. রহিমকে বলল, ভালোই হলো স্যার, এই সাইটটা সুবর্ণভূমি না, এটা সুলতানপুর, অত আদি না, চৌদ্দ শতকের। মন খারাপ করার কিছু নেই স্যার।

তরফদার একটা ধমক দিলেন। এটাই সুবর্ণভূমি। এ নিয়েই প্রকল্প হয়েছে। যদি বিশ^াস না করেন, দলে থাকবেন না। তারপরই অবশ্য যোগ করলেন, এখন তো দলই থাকবে না।

ড. রহিম কাতর কণ্ঠে ছেলেটিকে বললেন, আমি তো সুবর্ণভূমির খোঁজে আছি বাবা। খুঁজতে খুঁজতে একসময় সুবর্ণভূমিতে পৌঁছে যাব। আজ হোক কাল হোক। তুমি দেখে নিও।

একটা চিৎকারে-গর্জনে তাঁর কথা চাপা পড়ে গেল। একদল লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে এগিয়ে আসছে। তরফদারের চোখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। সর্বনাশ!

কারা এরা? ড. রহিম জিজ্ঞেস করলেন।

মন্ত্রীর দলের মানুষজন। খবর চলে গেছে।

লোকগুলি এগিয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়ালো। কুড়ি-বাইশ জনের মতো। তারা বলল, নেতারে কারা অপমান করছে? ফাজিল মাইয়াটা কোনটা?

পাঁচটি মেয়ে ছিল প্রত্নদলে। প্রত্যেকের দিকে ওদের চোখ গেল। লাঠি ধরা হাতগুলিও যেন এগোলো। পাঁচটি মেয়েই ভয়ে চিৎকার দিলো। ড. রহিম সামনে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে একজন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে।

কিন্তু সিদ্ধান্তটা কাজে প্রমাণের আগেই তাদের থামতে হলো। বন্দুক হাতে চার পুলিশ এসে দাঁড়াল।

তাদের একজন বলল, এক পা সামনে আইলে আমরা গুলি চালামু। একশটা গুলি আছে। তোদের সবগুলারে মাইরা ফেললেও সত্তর-আশিটা থাকব।

মুহূর্তটা দুই পক্ষের জন্যই কঠিন। তবে বন্দুকের একটা শক্তি আছে, এবং তা হচ্ছে এর সামনে সিদ্ধান্তটা হয় সাদার, না হয় কালোর। হ্যাঁ অথবা না। মাঝখানে কোনো ধূসর এলাকা নেই, যে এলাকাটা তর্কের, কথার বাতাবরণের।

লোকগুলি পিঠ দেখাল। এক পুলিশ চেঁচিয়ে বলল, লাঠিগুলা ফেইলা যা।

সব লাঠিসোঁটা মাটিতে পড়ল।

সাদাকালো চুলের এক পুলিশ বলল, দুই মাইলের মধ্যে একটা ফাঁড়ি আছে। আপাতত সেখানেই চলেন।

তরফদারের গাড়িতে ট্রাংক উঠল। ড. রহিমও উঠলেন। মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা মেয়েটি ও ছেলেটিকেও ড. রহিম গাড়িতে তুলতে চাইলেন, তারা রাজি হলো না। বারি সহেবও না। তিনি হাঁটবেন ছেলেমেয়েগুলির সঙ্গে। তরফদারের গাড়ি যাবে ধীরে, সকলের সঙ্গে।

বারি বুঝলেন, পুলিশগুলিকে সুবর্ণভূমি ছুঁয়েছে। তার মানে সুবর্ণভূমি এখানেই আছে। তিনি সন্দিহান ছেলেটিকে বললেন, এটা সুলতানপুরের সাইট না, এটা সুবর্ণভূমির। এতে কোনো সন্দেহ নাই।

এক পুলিশ জিজ্ঞেস করল হেডফোন লাগানো মেয়েটাকে, কী গান শোনেন আপা? মেয়েটি একবার বারি সাহেবের দিকে তাকিয়ে পুলিশটাকে বলল, সুবর্ণভূমির গান।