ধারাবাহিক ধারাভাষ্য

আসার পর থেকে সাবলীল গলায় রেইপ রেইপ শুনতে হচ্ছে নওশিনের। বাংলায় কথাটা যত অর্থময়ই হোক বা ধ্বনিব্যঞ্জনায় তীব্র ইঙ্গিতময়, দেখা যাচ্ছে ধষর্ণের চেয়ে লোকজনের রেইপই পছন্দের। বাংলাটা ইংরেজির চেয়ে কঠিন – এ হতে পারে এক কারণ, অন্য কারণের মধ্যে মনস্তত্ত্ব হয়তো একটা ফ্যাক্টর। কী সেটা ভাবতে গিয়ে নওশিনের মনে হলো, হতে পারে  বর্বরতা আড়াল করার একটা কায়দা। আর সেজন্যই হয়তো শব্দটা কানে বাড়ি মারছে না, আলগোছে এর-ওর মুখ থেকে যেমন বেরোচ্ছে, কানেও তেমনি আলতো টোকা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য যা, গ্রামের অশিক্ষিত মানুষজনও দেদার রেইপ আউড়ে যাচ্ছে। এমন নয় যে, না বুঝে আওড়াচ্ছে, এর-ওর মুখে শুনে মর্মটা দস্তুরমতো রপ্ত করেই করছে।

এই যেমন বরকত নামের লোকটা। দেখতে অতি সাধারণ, বয়স আন্দাজ পঞ্চাশের এদিক-ওদিক। চেহারা, জামাকাপড়ে উলুঝুলু। শার্ট একটা পরেছে, ময়লা বা কলার মুচড়ানো তাতে অবশ্য কিছু যায়-আসে না, তবে শার্টের এক ঘরের বোতাম অন্য ঘরে আটকে পেটের মাঝখানে যে একটা মাঝারি খালুইয়ের হাঁ-মুখ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে তাতে তাকে যথেষ্ট ছন্নছাড়া মনে হলেও মুখ থেকে যখন রেইপ বলতে লেইপ বেরোল, নওশিন তো নওশিন, তার সঙ্গী হাঁটুর বয়সী রূপা, অঞ্জলি ও ওদের চেয়ে খানিকটা বড় কৌশিক, রায়হান হাসি চেপে ধরে নিল এলাকার মানুষের মগজে রেইপ ভর করে আছে – শব্দটার প্রতি টান থেকেই হচ্ছে। নওশিনের মনে হলো, তারা বিকল্প কঠিন বাংলা বা চলতি সø্যাংয়ের চেয়ে এই ইংরেজি শব্দে এক ধরনের স্বস্তিও বোধ করছে। শেষ কথাটা, মানে ‘স্বস্তি’ অনেকটা আচমকাই মাথায় খেলে যেতে নওশিন মনে মনে শব্দটাকে বারকয়েক নাড়াচাড়া  করল। এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে সুতা টানলে একটা অন্যরকম মনস্তত্ত্বের হদিস মিলতে পারে। তবে এটা এখানে এই ফিল্ড রিপোর্ট বানাতে কাজে লাগবে না। স্বস্তির মতো একটা নিরীহ শব্দও যে ভাবনাচিন্তায় মোচড় তোলার শক্তি রাখে তা তাকে কয়েক সেকেন্ড আনমনা করে রাখল।  

গ্রামে যে পরপর ঘটনাগুলি ঘটছে এ নিয়ে বরকতকে জিজ্ঞাসা করতে সে উসখুস করে গলা সাফ করে বলল, লেইপ তো নতুন না, আগেও হইত, গেরামে বদ ছাওয়ালরা কুকাম করত। আগে তেমন জানাজানি হইত না, মাইয়ারা শরমে মুখ খুলত না। এখন তো চাইপা রাখা কঠিন, খবরের কাগজে পর্যন্ত ছাপা হয়, পুলিশে হামলা করে, রাইতবিরাইতে যে করে নাই তারও কোমরে দড়ি বান্দে। গেল সপ্তায় মাইজপাড়ার আকবররে বান্দল, গেরামের ব্যাকতে আকবররে জানে, বাজারের মুদিদোকান নিয়াই থাকে, পাঞ্জেগানা কায়েমে গাফিলতি নাই, পাঁচ কল্লি টুপি ছাড়া খালি মাথায় তারে কে দেখছে! 

পাঁচ কল্লি টুপি কথাটা নওশিন আগে শোনেনি। ব্যাপারটা যেন এমন – পাঁচ বা ছয় কল্লি টুপি মাথায় কারো পক্ষে ধর্ষক হওয়া সম্ভব নয়। নওশিন সেদিকে গেল না। সে জানতে চাইল, ইদানীং এ-গ্রামে বা আশেপাশে ঘটনাগুলি যে বাড়ছে এর কী কারণ? বরকত কী মনে করে? এ-কথায় বরকত থতমত খেয়ে কী বলবে বুঝতে চোখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকাল আর তখনই খেয়াল হতে জিভ কেটে শার্টের বোতামটা তড়িঘড়ি খুলে জায়গামতো আটকে প্রশ্নটা তার জন্য কঠিন, নাকি শহুরে মেয়েমানুষের সামনে উল্টাপাল্টা বোতাম লাগিয়েছে বলে কালো মুখটাকে বেগুনি করে আমতা আমতা করে বলল, ক্যামতে কই?

না, একটা কারণ তো থাকবে, নাকি? এই যে ঘনঘন ঘটনাগুলি ঘটে, কাগজে কত আর ছাপা হয়! আচ্ছা আপনার কি মনে হয় বদলোকেরা দলবেঁধে এসব করছে? 

বরকতকে দেখে যত সোজা-সরলই মনে হোক, সে এ-কথায় সাবধান হলো, এই মহিলা কি তার মুখ থেকে গোপন খবরাখবর বের করার তালে আছে?

সে তার আগের কথায় ফিরে গেল, ক্যামতে কই? বাজারে যে সদাপাতির দাম বাড়ছে, ধানের দর আগন মাস যায় যায় তারপরও যেরম আছিল তেমন, কমার নাম নাই – কারণ কে কইতে পারে?

প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে ঘোরতর অর্থনীতির বিষয়ে চলে যেতে লোকটার উপস্থিত বুদ্ধিতে নওশিন বেশ চমকাল। কদিন ধরে একই অভিজ্ঞতা হচ্ছে নওশিন ও তার দলবলের। কেউই  খোলাসা করে কিছু বলতে চায় না। তারা যে সরকারি লোক না, তদন্দ-টদন্ত করা তাদের কাজ না, এমনকি খবরের কাগজ থেকেও আসেনি – এসব বলে-টলে লোকজনকে আশ্বস্ত করার পাশাপাশি নিজেদের নিরীহ এনজিও পরিচিতি দিতে যত চেষ্টা-চরিত্রই করেছে, মানুষজনের ভাবসাবে মনে হয়েছে, বলার কী আছে! তবে রেইপ বলতে কারো মুখে বাধছে না, এলাকায় রেইপ বেড়েছে, আগে এমন ছিল না, কী দিনকাল পড়েছে – ব্যস, বলার মধ্যে এই দার্শনিকতাটুকু বাদে আর কিছু মিলছে না। ধানে অসময়ে পোকা লেগেছে বা মোবাইল টাওয়ারের কারণে গাছে ডাবের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে, এমনকি গরুর বাঁটে দুধও, বা ইজিবাইক বন্ধ করায় কামাই-রুজির বেহাল অবস্থা – এসবের পাশাপাশি ধর্ষণের কারবার যে দিন দিন বাড়ছে এ নিয়ে দুশ্চিন্তাটা যেন বলেকয়ে মনে করিয়ে দিতে হয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এটা কারো একার দুশ্চিন্তা না, এমন না যে, এর কারণে ধানের দর আরো বাড়বে বা সামনে পৌষের অকাল বৃষ্টিতে বন্যা-টন্যার মতো অঘটন ঘটবে।

খবরের কাগজে আর কিছু থাকুক না থাকুক ধর্ষণের খবরের ছড়াছড়ি। কাগজ খুললে নজরে না পড়ার উপায় থাকে না। কৌতূহলের বিষয় – ইংরেজি কাগজের চেয়ে বাংলা কাগজ খবরগুলো ফলাও করে ছাপে। বাংলা যখন, রেইপ না লিখে ধর্ষণই লিখে, একটা বাক্যে কম করে হলেও তিনবার শব্দটা থাকে। সে যাক। ঘটনা হলো, গত কয়েক মাস ধর্ষণের খবরে পত্রিকার পাতা ছয়লাব। এর মধ্যে যে-খবরটা ঘুরেফিরে এসেছে তা হলো, ফরিদপুরের নোয়াপাড়ায় অপরাধ বলতে এক ধর্ষণ। গত মাস দুয়েকে ডজনখানেক ঘটনা ঘটছে। এর বাইরেও ঘটতে পারে, সব খবর তো পাওয়ার উপায় নেই।

নওশিন জাহানকে যখন তার অফিস থেকে চারজনের দলনেতা করে নোয়াপাড়ায় পাঠানোর কথাবার্তা চলছিল, সে শোনামাত্র রাজি হয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে কারা যাবে তাও ঠিক করতে ঝামেলা হয়নি। শুধু অঞ্জলি বয়সে বেশ ছোট বলে (কুড়ি-একুশ হয় কি না, সবে পাস কোর্সে বিএ দিয়েছে) তাকে এর মধ্যে টানতে ওর বাবা-মায়ের আপত্তি ছিল। তবে নওশিন সঙ্গে থাকবে শুনে অঞ্জলির উৎসাহে বাবা-মায়ের আপত্তি টেকেনি। রওনা হওয়ার আগে নওশিনকে তার ম্যানেজার বলেছিলেন, সাবধানে থেকো, সঙ্গে বাচ্চা মেয়ে দুটো। নওশিন ঠাট্টা করে বলেছিল, পালোয়ান ছেলে দুটো আছে না? ম্যানেজার দিলশাদ খানম তখন চোখমুখ গম্ভীর করে বলেছিলেন, কথাটা হালকাভাবে নিচ্ছ মনে হয়, জায়গাটা কত খারাপ জানোই তো। ওদের একা একা ঘোরাঘুরি করতে দিও না, আর তুমি নিজেও, ভেব না তুমি সেফ। ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো। বছর দুই আগে চল্লিশ পেরোনো, জেল্লাহীন গড়পড়তা চেহারার নওশিনও যে সেফ না, এটা কতটা কমপ্লিমেন্ট, কতটা সতর্কবাণী – এ নিয়ে কয়েক মিনিট দোলাচলে পার করে নওশিন অন্য কথা ভেবেছিল – মেয়েরা কখন সেফ, শুধু বয়স আর শরীরের কারণে আনসেফ?

তিনদিন তারা নোয়াপাড়ায়, লোকমুখে নেয়াপাড়া। গ্রাম থেকে মাইল দুয়েক দূরে সূর্যমুখী নামে একটা নতুন এনজিওর দুই কামরার অফিসে তাদের ঠাঁই হয়েছে। একটা কামরা খালি পড়ে ছিল, সেখানে একটা ঢাউস চৌকি ফেলে নওশিনসহ রূপা, অঞ্জলির থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কৌশিক ও রায়হানের জন্য কাছেই এক বাড়িতে আগে থেকে ব্যবস্থা করা হলেও তারা ওখানে যেতে রাজি হয়নি, ফলে অসুুবিধা হলেও অন্য কামরা, যেখানে একটা ছোট টেবিল, দুটো বাঁশ-বেতের র‌্যাক আর খানচারেক প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে অফিস ঘর, সেখানেই মেঝেতে ডবল চাটাই পেতে তারা রাত কাটাবে বলে ঠিক করল। শুধু চাটাইতে চলবে না বলে কম্বল-তোশকও এলো। জোগাড়যন্ত্র যা করার সূর্যমুখীর করিৎকর্মা ফিল্ড সুপারভাইজার কামরুল হাসান করেছে। খাওয়ার ব্যবস্থা শুধু রাতের জন্য, কামরুলই ব্যবস্থা করে রেখেছিল কাছের এক বাড়িতে। নওশিন কামরুলকে আগাম টাকা দিয়ে রেখেছে যাতে দরকারমতো কেনাকাটা সারতে পারে। 

তিনদিনে কাজ বলতে জনা কুড়ি মানুষের সঙ্গে কথা বলা। বেশিরভাগই পুরুষ, চার-পাঁচজন মহিলা। মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে রায়হান ও কৌশিককে নওশিন সঙ্গে নেয়নি, রূপা ও অঞ্জলিকে নিয়ে এবাড়ি-ওবাড়ি হেঁটেছে। এলাকায় এনজিওকর্মীরা মাঝে মাঝে আসে। পুরুষরা আসে, মহিলারাও। এছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণের জিনিসপত্র দিতে পরিবার পরিকল্পনা অফিসের মহিলারা সবুজ ছাতা মাথায় একসময় ঘনঘন আসত, আজকাল ওদের দেখাসাক্ষাৎ কমে গেছে। মাগনা না বিলিয়ে জিনিসপাতি নাকি দোকানে বেচে দেয়, এমন কথা নওশিনকে বলেছে দু-একজন। গ্রামে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, যে-কারণে ঢাকা থেকে নওশিনদের গ্রামে আসা এ-কথা বলে নিজেদের কাজের গুরুত্ব বোঝাতে নওশিন যতই জানতে চেয়েছে পুরুষগুলো হঠাৎ এমন করছে কেন, মহিলা/ মেয়েদের কেউ কেউ তাকে অবাক করে মুখ টিপে হেসেছে।

হাসছেন যে? বিষয়টা তো সাংঘাতিক।

একজন চট করে জবাব দিলো, আপনের কথায় হাসি পাইলে কী করুম!

আমার কথায়?

এই যে কইলেন হঠাৎ। বেটা মাইনষ্যে দাও পাইলে রেইপ করব জানা কথা। শিয়ালে মুরগি পাইলে …

কী বলেন!

নওশিন অবাক চোখে তাকাল, যেন না বুঝেই সে একটা হাসির কথা বলে ফেলেছে।

কেউ কিছু বলল না। নওশিনও তাৎক্ষণিক বলার মতো কিছু না পেয়ে বলল, এই রেইপ কথাটা কার কাছে শিখলেন?

এ-ওর মুখে তাকাল, যেন অবাক হলো উটকো প্রশ্নে।

নওশিন বলল, একটা কথা বলেন তো, এই যে গ্রামে রেইপ বাড়ছে, এর ফলে কী সমস্যা হচ্ছে, আর রেইপ বন্ধ করার কী উপায়?

উপায় নাই।

এতো চটজলদি জবাব শুনবে নওশিন ভাবেনি।

নাই?

বেটা মাইনষ্যে কইলাম না দাও পাইলে করবই। ঘরে বউ থাকলে করব, না থাকলেও। যে-জাতের যে-খাসলত।

এজন্য সাবধান হওয়া দরকার না?

সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো না কেউ। কিছুক্ষণ পর একজন আনমনে হাই তোলার মতো কী যেন বিড়বিড় করল। নওশিনের মনে হলো তার কথাকে গুরুত্ব না দিতেই। মনে পড়ল, আগের দিন একই কথা একজনকে বলতে সে বিড়বিড় না করে পরিষ্কার গলায় বলেছিল, মাগনা তাবিজ দিতে আইছেন? ঘটনাটা নওশিন ভোলেনি, ঠিক করেছিল এ-ধরনের ফালতু পরামর্শ কাউকে দিতে যাবে না। কিন্তু মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতে সে নিজেই অপ্রস্তুত বোধ করছিল।

মেয়েদের মুখ টিপে হাসি নওশিনকে হতবুদ্ধি করলেও সে এ-কথা না ভেবে পারছে না, ধর্ষণের ঘটনা বাড়লেও তারা একে হঠাৎ উদয় হওয়া কিছু ভাবছে না; অর্থাৎ নওশিন যেমন ভাবছে তারা তেমন ভাবছে না। নওশিন ভাবছে কারণ তাকে রিপোর্ট লিখতে হবে।   

কথাবার্তা যা হচ্ছে তাতে রিপোর্টে লেখার মতো বিশেষ কিছু জুটছে না। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটা ঘটনা, পুলিশি তৎপরতা, ধর্ষিত মেয়েদের বর্তমান সামাজিক অবস্থা – এসব নিয়ে যা লিখবে গরুর রচনা ছাড়া কিছু হবে না। ইউপি চেয়ারম্যান বা স্কুলের দু-একজন পুরুষ বা মহিলা শিক্ষকের জবানি টুকতে পারে। নতুন কিছু কি কেউ বলবে? কী লাভ! লাভের একটা আশা নওশিনের মাথায় ছিল – এমন কোনো একটা অ্যাঙ্গেল যা এলাকায় ধর্ষণকে উসকে দিচ্ছে। কিংবা ধর্ষণের মতো রোমহর্ষক ঘটনা কী করে মানুষের মুখে ভয়ডরহীন, সাবলীল রেইপ হয়ে যাচ্ছে।

নওশিনের দলের রায়হান দেখতে-শুনতে পালোয়ান, বয়স তিরিশের কাছাকাছি, টি-শার্টের হাতা উপচে বাইসেপ ঝলকায়। সে অন্যরকম খবর আনল। রাতে খাওয়ার পর সে দুটো ঘটনার বয়ান দিলো, ঘটনা দুটো ঘটেছে দিন দশেক আগে। সে নাকি এক চালাক-চতুর দোকানদারকে টোপ দিয়ে গেঁথেছে, টোপটা কী বলল না। দোকানদার নাকি তাকে বলেছে, রেইপ নিয়ে এতো কথা, সব নাকি সত্যি না,  কেউ কেউ না করেই রটায়, এতে নিজের বাহাদুরি যেমন রটে, তেমনি যে মেয়েকে নিয়ে ঘটনা, তার পরিবারের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া হয়। কিসের প্রতিশোধ – এ-কথায় লোকটা গলা নামিয়ে বলেছিল, এইটা বোজেন না? রেইপের মতো পরতিশোদ আর কী আছে!

খুন-খারাবিও এর ধারে কিছু না। দিন কয়েক আগের একটা ঘটনার কথা বলতে গিয়ে সে জানিয়েছে, যারা করেছে তারা দুজন আপন ভাই; ধরা পড়বে জানা কথা, পুলিশ বেঁধে নিয়ে কঠিন মামলা দেবে, জামিন হবে না। তারপরও প্রতিশোধ নিতে কাজটা করেছে। লোকটা কানে কানে বলেছে, এর মইদ্যে অন্য কিছু নাই, খালি পরতিশোদ। লোকটা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, যেন প্রতিশোধটা তারও। বলল, জামাল-কামাল, মানে ওই দুই ভাইয়ের বাপ আরফান গাজির লগে দুশমনি আছিল ইসমাইল গোলদারের। কয় বছর আগে গোলদারের ভাড়াইট্টা লোকজন আরফান গাজিরে খুন করল। গেরামের ব্যাকতে জানে। দুই ভাই মামলা করছিল, সাত বচ্ছরেও মামলার নড়চড় নাই। এর মধ্যে গোলদার জাল দলিল বানায়া বাজারে আরফান গাজির এক টুকরা জমির দখল নিছে, শেষমেশ দুই ভাইরে ভিটিছাড়া করার মতলবও পাক্কা কইরা সারা। এমন সময় জামাল-কামাল কামটা করে। গোলদারের আবিয়াতি মাইয়ারে তুইলা নিয়া কী করছে না করছে কে কইতে পারে, তয় মাইনষ্যে তো জানল। মাইয়া চেহারা-সুরতে সুবিদার না, শইল-গতরও কী কমু, আখাম্বা। গোলদারের উপরে খার মিটাইতেই রেইপ।

রায়হান অবশ্য দোকানদার যেভাবে বলেছে সেভাবে না বলে রেখে-ঢেকে নওশিনকে বলেছে। নওশিন তার দুই ধাপ সিনিয়র, এনজিও বলে আপা ডাকে, না হলে তো ম্যাডাম ম্যাডাম করতে হতো। রায়হান আরেকটা ঘটনা শোনাল, সেটাও প্রায় একই রকম – ওই খার মেটানো। যে-কথাটা নওশিনকে সরাসরি বলতে মুখে আটকাচ্ছে তা হলো ধর্ষকের যৌনতাড়নার চেয়ে প্রতিশোধস্পৃহাই ঘটনা দুটোর কারণ। অন্য আরেকটা কথা দোকানদার যেমন বলেছে তা কিছুতেই বলা যায় না, আরে মাইয়া মানুষ অইলেই কি তাওয়া গরম অয়! ইসমাইল গোলদারের মাইয়া তাওয়া গরম করা জিনিস না। তাইলে বোজেন হেরে ক্যান তুইলা নিল?

রায়হানের কাছে যা শুনল নওশিনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হলো। যাদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে তারা এমন ইঙ্গিত করেনি, নাকি রায়হান যে বলেছে দোকানদারকে টোপে গেঁথেছে, এ কি টোপের ফল? রিপোর্র্ট একটা তো লিখতে হবে, সে চাইছে যতটা সম্ভব প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে, সেইসঙ্গে তার নিজের চিন্তাভাবনায় যা বেরোবে। রায়হানের মুখে যা শুনল তাতে  তো অন্য রকম অ্যাঙ্গেল রয়েছে। ভিকটিম বা ভিকটিমের পরিবারের সঙ্গে কথা বললে কি নতুন কিছু পাওয়া যাবে? কাজটা সহজ হবে না জানত, তবে অনেকটা অযাচিতভাবে সুযোগ পেয়ে যেতে সে উত্তেজিত বোধ করল। স্থানীয় জুনিয়র স্কুলে পড়ায় বছর তিরিশের মালতি সাহা, নতুন কিছু না বললেও সে যখন জানাল কারো সঙ্গে কথা বলতে চাইলে চেষ্টা করতে পারে, অন্তত তার কাছের একজনের সঙ্গে চুপেচাপে, নওশিন যেন হাতে আসমান পেল।

সেই ভিকটিম – ধরা যাক নাম ফাতিমা, দেখতে ভালো, বয়স কুড়ি-বাইশ – মালতির পেছন পেছন নওশিন, রূপা, অঞ্জলিকে দেখামাত্র বলে উঠল, আমারে নিয়া বই-পুস্তক লেখবেন? থতমত খেয়ে নওশিন বলল, প্রশ্নই ওঠে না। নামটাও সে ছাড়া কেউ জানবে না। তাইলে কী জানবার চান, ক্যামনে কাপড় খুলছে, একজনে লাগাইছে না বেশি? মালতি সাহা কানে কানে তাকে কী বোঝাতে গেল, লাভ হলো না। ঝটকা মেরে তাকে সরিয়ে চেঁচাতে লাগল, রং দেখতে আইছে, নামটাও কেউ জানব না, ক্যান নাম জানলে কী অইব! এগো ক্যান আনছেন – বলে সে মালতিকে নিয়ে পড়ল।

মালতি নাকি আগেই তার সঙ্গে নওশিনদের আসা নিয়ে কথা বলেছিল, তখন কিছু বলেনি, তবে কথা বলতে রাজি হয়েছে এমনও না। মালতি একসময় তাকে স্কুলে পড়িয়েছে, সেই সুবাদে ভেবেছিল কথাবার্তা বলবে।

নওশিন নিজেকে দুষল। কী শুনবে আশা করেছিল ওর কাছে? মেয়েটা গ্যাং রেইপড হয়েছিল, আটকে রাখা হয়েছিল দুদিন। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল ফেরত যাবে। এখানে থেকে কী করবে! 

রাতে শুয়ে শুয়ে কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভাবতে গিয়ে যা পেল তাতে বুঝল, দলেবলে এভাবে আসার দরকার ছিল না। খবরের কাগজের বাইরে কিছু জুটল না। জানার মধ্যে জানল, গ্রামের লোকজন রেইপ কথাটা রপ্ত করেছে, তবে যারা ভিকটিম তারাও কি রেইপ বলে? তার মন বলল, না। রায়হান যে দুটো ঘটনার কথা শুনিয়েছে, সেসব যদি সত্যি হয়, ঘাঁটাঘাঁটি করলে হয়তো অন্য কিছু বেরোবে? কী যেন বলেছিল – খার। খার মেটাতে রেইপ, প্রতিপক্ষের সামাজিক মান-মর্যাদা তছনছ করতে রেইপ। আরো ভেঙে বললে, ক্ষমতাবানের ক্ষমতা খর্ব করতে রেইপ, যার পেছনে সামাজিক অসাম্য হতে পারে একটা কারণ। তারপরও কথা যা দাঁড়ায় – প্রতিশোধ মেটানোর একটা সিধা পথ মেয়েদের ওপর হামলা। প্রতিশোধটাই বড়, ধর্ষণ না? এ গেল এক দিক। অন্য দিক থেকে দেখলে প্রতিশোধ নিতে বাড়ি-ঘরে আগুন দিতে পারত, খুন-টুনই-বা বাদ যাবে কেন? কিন্তু মেয়েদের ওপর দিয়ে যে যাচ্ছে তাতে ধর্ষণের ব্যাপারই সামনে আসছে, আসার কথাও। খবরের কাগজ ছয়লাব।

নওশিনের মাথায় অন্য কথাও ঘোরে। ব্যাপার যদি হয় প্রতিশোধ, রায়হানের জবানিতে যেমন শুনল, তাহলে মেয়েরা নিমিত্ত মাত্র। তারা প্রতিশোধের সরাসরি টার্গেট না। তবে তারা, মানে তাদের শরীর যেহেতু পুরুষের চিরাচরিত লালসার বস্তু, সম্ভ্রম খোয়ানোর বিষয়ে শরীরটাই আগে আসে। আর সম্ভ্রম খোয়ানো মানে হাত-পা না ভেঙেও চিরদিনের মতো খুঁতো করে দেওয়া – শুধু মেয়েদেরকে না, তাদের পরিবারকেও।

একসময় তার মনে হয়, কীসব ভাবছে? ঘটনাগুলো ধর্ষণ – প্রতিশোধপরায়ন হয়ে হোক বা না হোক। ফলে ধর্ষণই আসল। এ-গ্রামে গত দুই মাসে এক ডজনের ওপর এমন খবর কাগজে এসেছে। কাগজে ফলাও করে আসার কারণ খবর হিসেবে ধর্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিশোধের প্রসঙ্গ টানলে গুরুত্বটা খাটো হয়ে যাবে না? পেছনের কারণ নিয়ে কার মাথাব্যথা! তাহলে নওশিন যে ভাবছিল একটা অন্যরকম অ্যাঙ্গেল যদি পাওয়া যায়! তার রিপোর্টে কী থাকছে যা খবরের কাগজে নেই! নওশিন নতুন কথা ভাবল। কোনো আলোচিত ঘটনার ভিন্ন অ্যাঙ্গেল খোঁজা কাজের কাজ না। সবাই যেভাবে দেখছে সেভাবে দেখাই রীতি। আর কোনো ঘটনাই আনকোরা নয় – একই পরিক্রমার গতানুগতিক ধারাভাষ্য। বরকতের কথাতেই ফেরা – লেইপ তো নতুন না, আগেও হইত …