জলকুসুমের আখ্যান

আমরা মেয়েটির নাম জানতাম। জরিনা খালা মেয়েটির নাম রেখেছিল কুসুম। কুসুমফুলের মতো লাল-হলুদ মিশ্রিত গায়ের রং – নাম তাই কুসুম। কিন্তু একসময় আমরা মেয়েটির নাম ভুলে যাই …।

দেখো কাণ্ড! আমাদের চোখের সামনেই বেতসলতার মতো বাড়তে বাড়তে মেয়েটি যুবতী হয়ে গেল, যাকে বলে ষোড়শী কন্যা। গাঁয়ে কত কথা মেয়েটিকে নিয়ে, কিছু আমাদের কানে আসে, কিছু আসে না; আমি মেয়েটিকে, মনে পড়ে, একদা কুসুমফুল বা কুসুমপরি নামেও ডেকেছি; এই নামে ডাকলে মেয়েটি গালে টোল তুলে মুচকি মুচকি হাসতো – তাও মনে পড়ে; কিন্তু এখন আমার আর মেয়েটির নাম মনে পড়ে না। গাঁয়ের ছেলে-বুড়ো সবাই তার নাম ভুলে গেছে, কেউ আর তাকে কুসুম নামে ডাকে না …।

কুসুম! আহারে! শালুক নদের জলে মেয়েটির নাম কবে যে ভেসে গেছে, আমরা কেউ তা খেয়াল করি নাই …।

এখন শুনি, যত ব্যস্তই থাকি না কেন, হয়তো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম বলেই, গাঁয়ে খুব গোপনেও যদি কিছু ঘটে, আমার কানে আসবেই; কুসুমকে কেউ কেউ বেশ্যামাগি, কেউ কেউ খানকি-ছিনাল বলে …।

কুসুম, মেয়েটিকে নিয়ে ভাবার; কুসুমফুলের মতোই দেখতে সুন্দর মেয়েটিকে কেন গাঁয়ের লোকে বেশ্যামাগি বলে – এসব ভাবাভাবির সময় আমার এখন নাই, তা ঠিক; কিন্তু এ-কথা আমাকে কবুল করতেই হবে, মেয়েটি হঠাৎ হঠাৎ, মধ্যরাতে, আমার মনের ভেতরে শালুক নদের দক্ষিণ কাটালের বড়ো বড়ো বোয়ালমাছের মতো ঘাই মারে। কেন যে মেয়েটি মধ্যরাতে এসে ঘাই মারে – তাও তো জানি। কুসুম তখন ক্লাস এইটে পড়ে, আমি তিনবার এসএসসি ফেল করে দলের খাতায় নাম লিখিয়েছি, সরকারি দল করি। সাঙ্গপাঙ্গও জুটেছে; কুসুমের পেছনে বেশ কিছুদিন ঘুরঘুর করেছি। একদিন জোর করে ওর হাতে প্রেমপত্র গুঁজে দিয়েছিলাম। মেয়েটি আমাকে পাত্তা তো দিলোই না, জরিনা খালার কাছে সব ফাঁস করে দিলো। খালা একদিন আমাকে সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরলো …।

মিঞাবাড়ির দক্ষিণ পাশে জরিনা খালার বাড়ি। একটু ফাঁকামতো জায়গায় বাড়িটা। বাড়ির সামনে এলজিইডির পাকা সড়ক। হাইস্কুলের পেছনের বড়ো সড়ক থেকে নেমেছে। জরিনা খালাদের বাড়ির সামনে মোড় নিয়ে গালার দিকে গেছে। মোড়ে বেশ বড়োসড়ো একটা বকুলগাছ। ছাতার মতো ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা মাঝে-মধ্যে এই বকুলতলায় বসে আড্ডা দিই। আমি, কাদের, সবুর, ময়না, নয়ন …। সেদিনও আড্ডা দিচ্ছিলাম। অবশ্য, সেদিন বকুলতলায় আড্ডা দেওয়ার কারণও ছিল। সেই যে কুসুমের হাতে প্রেমপত্র গুঁজে দিয়েছিলাম, তারপর থেকেই কুসুমকে কোথাও আর দেখি না। স্কুল খোলা, কিন্তু কুসুম স্কুলে যায় না। কোনো অসুখ-বিসুখে পড়লো কি না, তাই বা কে জানে! ক্লাস এইটে পড়ে, মেয়েলি অসুখেও পড়তে পারে। নাকি আমার প্রেমপত্রের জের! যা হোক, কিছু একটা যে হয়েছে, তা নিশ্চিত। আমরা বকুলতলায় আড্ডা দিচ্ছি। সবাই মিলে খই ভাজছি। কিন্তু আমার চোখ জরিনা খালার পুকুরঘাটে। কুসুম যদি কোনো কারণে ঘাটে আসে! একবার চোখের দেখা তো মেলে …।

পুকুরে গোটা-পঞ্চাশেক মর্দা আর মাগি হাঁস। প্যাঁকপ্যাঁক করছে। মর্দা হাঁসগুলো লাফিয়ে উঠছে মাদি হাঁসের পিঠের ওপর। তারপর মাদিটার ঝুঁটি চেপে ধরে ডুব দিচ্ছে। পুকুরের পানিতে তুমুল কলরব। এটা নাকি হাঁসের জলক্রীড়া। তা, ওরা মনের সুখে জলক্রীড়া করুক, পুকুরের পানিতে শব্দ তুলে সাঁতার কাটুক, আমার কোনো অসুবিধা নাই; আমি একবার শুধু কুসুমের মুখটা দেখতে চাই …।

কুসুমের মুখ কুসুমফুলের মতোই সুন্দর …!

আমি হলফ করে বলতে পারি – চৌদ্দ বছরের কুসুমপরিকে দেখলে, আমি মনে মনে কুসুমকে কুসুমপরি বলে ডাকি, শুধু এই নাদের আলীরই বুক কাঁপে না, শুধু নাদেরের গলাই শুকিয়ে কাঠ হয় না, গাঁয়ের আমাদের বয়সী সব ছেলে-ছোকরার বুকই কাঁপে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়। আমি যেমন কুসুমের পেছনে ঘুরঘুর করি, সিকদারবাড়ির টোকন, মোল্লাবাড়ির কালু, সরকারবাড়ির জুয়েল; কজনের নাম বলবো, মেলাজনে ঘুরঘুর করে। এই যে আমার সাঙাত কাদের, সবুর, ময়না, নয়ন – ওরাও জিহ্বা চাটে; কিন্তু আমার ভয়ে না সিকদার-মোল্লা-সরকার বাড়ির ছেলেরা, না আমার সাঙাতদের কেউ, কেউই মুখ খোলার সাহস করে না …।

সকাল এগারোটায় বকুলতলায় এসেছি। সাপ-লুডু খেলছি। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। গাঁজার স্টিক নিয়ে এসেছিলাম গোটা-সাতেক। তাও ছাই হয়েছে সেই কখন। কুসুমের দেখা নাই। কুসুম তো পুকুরেই গোসল করে। হাঁসের মতো সাঁতার কাটে। হাঁস নিয়ে খেলে। স্কুলে না-হয় না যায়, বাড়ির বাইরেও কি বের হয় না …?

গাঁজার নেশা কেটে গেলে নয়ন হাঁসফাঁস করে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট চাটে। ঠোঁট চাটতে-চাটতেই নয়ন বললো – ‘নাদের ভাই, লও উইঠা পড়ি, মাগি আইজ আর বাইরোবো না …।’

‘চোপ শালা …।’

নয়ন কুসুমকে ‘মাগি’ বলায় আমার মাথায় খুন চেপে গেল। আমি ওর গলা চেপে ধরলাম – ‘মাদারচোদ, ক, আর কোনোদিন কুসুমকে গালি দিবি …?’

আমি দুই হাতে নয়নের গলা চেপে ধরেছি, ও গো গো করছে – ‘ভুল অইয়া গেছে গুরু, মাফ কইরা দেও, মাফ কইরা দেও …।’

দুপুর থেকেই রাস্তায় লোক চলাচল কম। একটার কিছু আগ-নাগাদ বাজারের লোকের চলাচল ছিল। এখন কদাচিৎ দু-একজন মোটরসাইকেলে যাচ্ছে।

পায়ে-হাঁটা পথচারীও নগণ্য। আমরা সাপ-লুডু খেলছি। গাঁজার ধোঁয়ার আচ্ছন্নতা লেপ্টে আছে আমাদের চারপাশে। পথচারীদের নাকেও ঘাই মারছে ধোঁয়ার গন্ধ। তবে পথচারীরা কেউ আমাদের কাছে দাঁড়াচ্ছে না। কেউ যে আমাদের কাছে দাঁড়াবে না, কোনোকিছু জিজ্ঞেসও করবে না, তা আমরাও জানি …।

কিন্তু নূর হোসেন তালুকদারের কথা আলাদা। লোকটি বকুলতলায় এসে মোটরসাইকেলের ব্রেক কষে দাঁড়ালেন …।

নূর হোসেন তালুকদার তিনবার চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন বাড়িতে বসে নামাজ-কালাম পড়েন। নাতি-নাতকুরের সঙ্গে সাপ-লুডু খেলেন। মন চাইলে কোনো-কোনোদিন বাজারের গদিতে গিয়ে বসেন। বয়স সত্তরের বেশি। কিন্তু শরীর এখনো বেশ শক্তপোক্ত। নিজেই মোটরসাইকেল ড্রাইভ করেন …।

বারোটার কিছু পরে তালুকদারকে বাজারে যেতে দেখেছি। তখন তিনি মোটরসাইকেল ব্রেক করে আমাদের কিছু বলেননি। এখন বললেন – ‘নাদের যে …।’

‘সাপ-লুডু খেলতাছি চেয়ারম্যান সাব…।’

‘ভালো, খুব ভালো। সুবাস ছড়াইয়া বইছো। চালাইয়া যাও। তবে দেইখো, সাপের মুখে পইড়ো না আবার …।’

মোটরসাইকেল স্টার্ট করে চলে গেলেন নূর হোসেন তালুকদার। কিন্তু লোকটি কী বললো? সাপের মুখে! হঠাৎ তালুকদারের মুখে একথা কেন?

আমি একটু আতান্তরে পড়ে গেলাম। রাজনীতি করি। এই লাইনে শত্রুর অভাব নাই। নিজের দলের লোকদের মধ্যেও শত্রু আছে। কখন কী ঘটে বলা যায় না। আবার কুসুমের হাতে প্রেমপত্র গুঁজে দিয়েছি …!

ঝিমধরা দুপুরের মতো ঝিম মেরে গেলাম তালুকদারের কথা শুনে। আমার মুখে কোনো রা-শব্দ নাই। চোখ আটকে আছে লুডুর ছককাটা ঘরে অজগরের মুখের ওপর। কাদের আমার কোমরের কাছে গুঁতো মেরে বললো – ‘নাদের, ওই যে দ্যাখ …।’

কাদেরের হাতের গুঁতো খেয়ে সম্বিত ফিরে পেলাম। বললাম – ‘কী …?’

‘জরিনা খালা আইতাছে …।’

‘জরিনা খালা …!’

‘খালাই তো …।’

‘তা, হাতে ওইডা কী …?’

কাদের তখন বইয়ের ভাষার মতো শুদ্ধ করে বললো, ‘খালার হাতে ওটা সাঁড়াশি …।’

জরিনা খালা সাঁড়াশি হাতে পুকুরপাড় ধরে আসছে। আমাদের দিকেই …।

আমরা গা-ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম সবাই …।

জরিনা খালা জাঁদরেল মেয়েমানুষ তা শুধু আমরা নই, শুধু আমাদের গাঁয়ের লোকেরা নয়, আশপাশের গাঁয়ের লোকেরাও তা জানে। বারো-তেরো বছর আগের ঘটনা, জোড়কুমের চকে খুন হলো খালার স্বামী নিয়ত আলী তালুকদার। আরফান সিকদারের সঙ্গে জমি নিয়ে বিবাদ ছিল। মামলাও ছিল কোর্টে। ওই বিবাদযুক্ত জমিতে ভোরবেলা হাল বাইতে গেছিল নিয়ত তালুকদার। ক্ষেতে তিন হাল। সবার সামনে নিয়ত তালুকদার। পেছনে দুই কামলা। সিকদারবাড়ির লোকেরা নিয়ত আলী তালুকদারের ওপর আক্রমণ করে। মাছ-মারার জুতি দিয়ে তালুকদারকে গেঁথে ফেলেছিল।

খালা কিন্তু সিকদারবাড়ির লোকেদের ছেড়ে দেওয়ার লোক ছিল না। প্রচণ্ড সাহসী, জেদী মানুষ সে। আরফান সিকদারদের তিন ভাইকে জেল খাটিয়ে ছেড়েছে, জমির দখল অটুট রেখেছে, এখনো তার ভরবাড়ন্ত গেরস্থালি। চকের জমি বর্গা দিয়েছে; কিন্তু পুকুরে মাছচাষ করে, হাঁসচাষ করে। নিজের দুটো মেয়ে বন্যা-পপি, লেখাপড়া শিখিয়ে তাদের ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছে। কুসুম হয়তো জানেই না – সে জরিনা খালার পালিতা মেয়ে …।

আমরা স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে আছি। খালা আমাদের দিকেই হেঁটে আসছে। হাতে লোহার সাঁড়াশি। কাদের, সবুর, ময়না, নয়ন – ওরা কেউ ঘামছে কি না জানি না, কিন্তু আমার শরীর দিয়ে ঘাম ছুটছে। বকুলগাছের ঘন ছায়া, ঝিরঝিরে বাতাস – তবুও আমি ঘামছি …।

জরিনা খালা আমাদের কাছে এসে, আমাকে লক্ষ করে বললো – ‘তুই রমজান ব্যাপারীর পোলা নাদের না?’

‘জে খালা।’

‘ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনবার ফেল করছস?’

‘জে খালা।’

‘সরকারি দলের বান্দর?’

‘জে খালা।’

‘তুই আমার ম্যায়ারে প্রেমপত্র দিছস?’

‘জে খালা।’

‘তর প্যান্টটা খোল।’

‘জে খালা…।’

‘কী-ছাগলের মতো জে খালা, জে খালা শুরু করছস? ব্যাপারীর পুত, তর এতো বড়ো সাহস! তুই আমার না-বুঝ ম্যায়ারে প্রেমপত্র দিছস? তর সোনাটা আমি এই সাঁড়াশি দিয়া টাইনা ছিঁড়া ফালামু…।’

জরিনা খালার বয়স কতো – আমার কোনো ধারণা নাই। বারো-তেরো বছর আগে বিধবা হয়েছে, কিন্তু এখনো তার শরীরের বাঁধন যে খুব শক্ত তা বোঝা যায়। কোথাও একটুও টাল-খাওয়া নাই। আর খালার চোখে যেন সর্বদাই আঙরার মতো আগুন জ্বলে। আমাকে যখন প্রশ্নগুলো করলো – চোখের আগুন যেন ঠিকরে পড়ছিল। আমি যেন পুড়ে ছাইভস্ম হচ্ছিলাম। যখন প্যান্টটা খুলতে বললো – আমার পেচ্ছাব বেরিয়ে আসার জো হয়েছিল।

আমরা রাতে বাজারের বটতলায় বসলাম। পাহারাদার নওশের আর গনি ব্যতিরেকে বাজারে জনমনুষ্যি কেউ নাই। বাজারের কুকুরগুলো গনিকে ঘিরে ধরে ঘেউ ঘেউ করছে। গনি পাউরুটি ছিঁড়ে খাওয়াচ্ছে ওর ইয়ার-বন্ধুদের। কুকুরগুলোর সঙ্গে গনির খুব খাতির …।

রাত বাড়ছে। গাঁজার বিড়ির স্টিক ফুরিয়ে আসছে। কাদের, সবুর, ময়না, নয়নের চোখ বিড়ালের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে, দেখছি। আমার চোখেও হয়তো আগুন, কিন্তু নিজের চোখ নিজে দেখতে পাচ্ছি না।

সবুর বললো – ‘কী ব্যাপার নাদের? কিছু কস না তো …?’

কী বলবো? জরিনা খালা যতোই জাঁদরেল মহিলা হোক, মহিলা তো? আমাকে এভাবে অপমান করলো? আমার সোনা সাঁড়াশি দিয়ে টেনে ছিঁড়তে চাইলো! এর প্রতিশোধ নিতে হবে। আমি কুসুমকে ভালোবাসি, ভালোবাসার কথা বলতেই তো প্রেমপত্র দিয়েছি। কিন্তু এখন ভালোবাসার চিন্তা বাদ। সুবোধ বালকেরা প্রেম-ভালোবাসা করুক। আমি কুসুমকে কিডন্যাপ করবো। রেপ করবো।

‘কী বলিস এটা?’ বললো সবুর।

আমার পরিকল্পনা খুলে বললাম …।

কিডন্যাপ! রেপ! ওরা গাঁইগুঁই করছিল। বললাম – ‘তরাও ভাগ পাবি।’

অতঃপর আমার সাঙাতকুল রাজি হয়ে গেল।

কুসুম আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। আমরা সুযোগ খুঁজছি। কোত্থেকে ওকে ধরে কুশাল ক্ষেতে নিয়ে যাবো। শালুক-নদের পাড় ঘেঁষে ম্যালা কুশালের ক্ষেত। বড়ো বড়ো কুশাল। ক্ষেতের ভেতরে একবার ঢুকে পড়লে বাইরে থেকে কেউ কিছুই টের পাবে না। এই সময়, একদিন আনোয়ার ভাই এলেন গাঁয়ে। আলহাজ আনোয়ার হোসেন, আমাদের এমপি।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি – কুসুমকে রেপ করবো; কিন্তু কিছুদিন আগে থেকেই দেশে রেপের মহামারি শুরু হয়ে গেছে। টিভির স্ক্রলে-পর্দায়, পত্রিকার পাতায় প্রতিদিন অসংখ্য রেপের খবর। কোথাও কোথাও রেপের পর খুন। স্তন কেটে নেওয়ার খবরও বেরোয়। এসব খবর আমিও দেখি, পড়ি। আহারে! রেপিস্টদের অধিকাংশই আমাদের দলের লোক। কেউ ছাত্রসংগঠন করে। কেউ যুবসংগঠন করে। কদিন পর রেপিস্টদের দলে আমার নামও যোগ হবে। হোক। সমস্যা নাই। সরকারি দল করি। আনোয়ার ভাইয়ের সুনজর আছে আমার ওপর। পুলিশের বাবার সাধ্য কী আমাকে ধরে।

হাইস্কুলে নতুন ভবন হবে। তারই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠান। আনোয়ার ভাই বক্তৃতা শেষ করে, আমরা যারা ছাত্র ও যুব সংগঠন করি, তাদের নিয়ে স্কুলের একটা রুমে বসলেন। বললেন – ‘তোমাদের সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে। তাই নিরিবিলি বসলাম।’

আমি বললাম – ‘বলেন আনোয়ার ভাই, কী জরুরি কথা, বলেন।’

‘শোনো নাদের, তোমরা অনেকেই টুকটাক চাঁদাবাজি করো, তোমার নামে চাঁদাবাজির একটা মামলাও আছে; আমি রাস্তাঘাট, মসজিদ-মন্দিরের জন্য যেসব প্রজেক্ট দিই, তোমরা সেখান থেকে কমিশন খাও, বয়স্ক ভাতা-বিধবা ভাতা কার্ড কিংবা ঘরহীনদের ঘর ম্যানেজ করে দেওয়ার নামেও কিছু আয়-রোজগার করো – সবই আমার কানে আসে, কিন্তু এসবে আমি কিছু মনে করি না। তোমাদেরও তো কিছু টাকা-পয়সার দরকার …।’

‘ঠিক আনোয়ার ভাই, আপনের কথা ঠিক।’

‘তোমরা তো জানো সবাই, দেশে একটা মানবিক-সংকট শুরু হয়েছে, রেপ মহামারির আকার ধারণ করেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে দুঃখ ও লজ্জার কথা – অনেক রেপিস্ট আমাদের দলের লোক। এতে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।’

আমরা তো জানি, টিভি-খবরের কাগজে দেখছি, রেপিস্টরা অধিকাংশই আমাদের মতো ছাত্র ও যুবসংগঠনের সদস্য; কিন্তু আনোয়ার ভাই হঠাৎ এসব কথা তুলছেন কেন!

‘তোমাদের সবাইকে আমি সাবধান করছি – চাঁদাবাজি করো, কমিশন খাও, আপাতত কোনো সমস্যা নাই, কিন্তু কেউ রেপের মতো অপকর্মে লিপ্ত হবে না। কেউ আমার নির্দেশ অমান্য করবে তো সারাজীবন জেলের ঘানি টেনে মরতে হবে।’

আনোয়ার ভাইয়ের কথা শুনে আমার শরীরে জ্বর এসে গেল। তার কানে কিছু গেছে কি না কে জানে! জরিনা খালার হাত তো কম লম্বা না।

আমি আমার সিদ্ধান্ত বদলে ফেললাম। জরিনা খালা আমাকে যতোই অপমান করুক – কুসুমকে রেপ করা যাবে না। আনোয়ার ভাইয়ের ভাষণের কথা তো কানে বাজছেই – ‘সারাজীবন জেলের ঘানি টেনে মরতে হবে’ – নাদিরার মুখটাও মনে পড়লো। নাদিরা আমার ছোট বোন। কুসুমের সঙ্গেই পড়ে। তাহলে কুসুম তো আমার বোনের মতোই।

আমি সিদ্ধান্ত পাল্টালাম, কিন্তু জেল আমাকে ছাড়লো না। চাঁদাবাজির যে-মামলাটা ছিল আমার নামে, ওই মামলায় পাঁচ বছরের জেল হয়ে গেল!

দুই

জেলখানায় থাকতেই আমি জরিনা খালা খুন ও কুসুম রেপ হওয়ার খবর শুনেছিলাম। রাতের ঘটনা, পরদিন দুপুরেই খবর পাই। নূরুল্লাহ জেলগেটের এক সেন্ট্রির মাধ্যমে খবরটা পাঠিয়েছিল। নূরুল্লাহ আমাদের গাঁয়ের লোক। জেলগেটের সামনে, নদীর পাড়ে পান-বিড়ি, চা-সিগারেটের দোকান করে। নদীর পশ্চিম পাশে বস্তি। বউ-বাচ্চা নিয়ে বস্তিতে থাকে। মায়ের অসুখের খবর শুনে সেদিন সকালে বাড়িতে গেছিল। জরিনা খালার লাশ দেখে এসেছে। দুর্বৃত্তরা তাকে গলাকেটে খুন করেছে। ধড়-মুণ্ডু আলাদা আলাদা ভাসছিল পুকুরে। কুসুম মৃতবৎ পুকুরপাড়ে পড়ে ছিল। কিশোরী-কুসুমের বাজিলা মাছের মতো পাতলা ঠোঁট, কোমল স্তন আর অপরিপূর্ণ যোনিতে লেগে ছিল ফোঁটা ফোঁটা কালচে রক্তের দাগ। শূকরের মতো দাঁত বসানোর দাগ! কী যে বীভৎস! সেন্ট্রির মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনে আমার মাথা ঘুরছিল।

জরিনা খালাকে কারা খুন করতে পারে? কোনো ভাবনা-চিন্তা না-করেও বলে দেওয়া যায় – সিকদারবাড়ির লোকেরা খালাকে খুন করতে পারে। জমিজমা নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে শত্রুতা ছিল, হয়তো এখনো আছে, জরিনা খালা তো সিকদারবাড়ির তিন ভাইকে জেলের ভাত খাইয়েছে। সুতরাং, সিকদারবাড়ির লোকেদের পক্ষে এই খুন সংঘটন অসম্ভব নয়। কিন্তু কিশোরী-মেয়েটাকে পশুর মতো রেপ…!

এটা নিশ্চয়ই, আমি দিব্যি করে বলতে পারি, টোকনের কাজ। সিকদারবাড়ির ছেলে টোকন কুসুমের পেছনে ঘুরঘুর করতো। এমনও হতে পারে, সিকদারবাড়ির বড়োরা এই খুনের ঘটনার কিছুই জানে না, জমিজমার বিরোধ এখানে অনুঘটকের কাজ করে নাই, টোকন কুসুমকে রেপ করতেই এসেছিল, জরিনা খালা হয়তো তাকে বাধা দিয়েছিল; সাপ বাধা পেলে যা করে, সম্মুখে দণ্ডায়মান বস্তুকেই দংশন করে, টোকনও তাই করেছে। হয়তো খালাকেই খুন করেছে আগে।

আমি কুসুমকে রেপ করতে চেয়েছিলাম, কর্মকৌশলও ঠিক করেছিলাম, কিন্তু এটা তো মূলত খালার ওপর রাগ ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ছিল। খালা আমাকে যারপরনাই অপমান করেছিল – আমি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম, মোদ্দাকথা, আমি কুসুমকে ভালোবাসতাম। কিন্তু মেয়েটিকে এভাবে কেউ রেপ করবে, এটা তো আমি কল্পনাও করতে পারছি না!

পাঁচ বছর জেল খেটে গাঁয়ে ফিরে এসেছি, এসে যা শুনছি, তা না-শোনাই ভালো ছিল, কুসুম কেন খানকি-বেশ্যা হবে, গাঁয়ের লোকেরা কেন মেয়েটিকে আড়ালে এই নামে ডাকবে?

আমি পাঁচ বছর জেলে ছিলাম, এই পাঁচ বছরে, সত্যি বলতে কী, কুসুমকে, এমনকি ওর নামটিও ভুলে গেছিলাম। গাঁয়ে ফিরে এসে শুনলাম – গাঁয়ের মানুষেরাও কুসুমের নাম ভুলে গেছে। আমি এতে একধরনের স্বস্তিও অনুভব করেছিলাম। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগলো – মেয়েটি এখন একা, অসহায়, জরিনা খালা নিহত হওয়ার পর মেয়েটি বাড়িতে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছে, সবই ঠিক; কিন্তু বেশ্যাজীবন বেছে নেবে কেন? স্বাভাবিকভাবে জীবনধারণের নিমিত্তে যা কিছু প্রয়োজন, টাকা-পয়সা, কাজের লোক সফুরা, প্রতিবেশী – সব তো তার আছে; তবে কেন সে ঘৃণ্য পথে পা দেবে? মেয়েটি কি সত্যি-সত্যিই বারবনিতার খাতায় নাম লিখিয়েছে,

গাঁয়ে-ঘরে কি এটা সম্ভব, নাকি এখানে কোনো রহস্য আছে?

রহস্য থাকতে পারে। হয়তো একদিন এই রহস্যের জট খুলে যাবে।

কুসুম মেয়েটিকে, তখন সে নবজাতক, বয়স হয়তো ২৪ ঘণ্টাও হয় নাই, আনছের আর মঙ্গল কাকতালীয়ভাবে কুড়িয়ে পেয়েছিল।

আনছের-মঙ্গল দুজনে হরিহর আত্মা বন্ধু। দুজনেই শহরে রিকশা চালায়। দুজনেই মদ্যপায়ী। গাঁজাখোর। রাত দশটা কি সাড়ে দশটায় রিকশা মালিকের গ্যারেজে জমা দিয়ে ওরা দুজনে কান্দাপাড়া ঋষিবাড়ি ঢোকে। ঋষিবাড়ির ঘরে ঘরে বানুটি বিক্রি হয়। দুই বন্ধুতে সতীর ঘরে বসে গলা পর্যন্ত বানুটি গেলে। তারপর দুজনে কান্দাপাড়া রাস্তার ধারের দোকান থেকে গাঁজার বিড়ি কিনে বাড়ির পথ ধরে। বাস টার্মিনালে কোনো-কোনোদিন বঙ্গবন্ধু সেতু কি খায়েরপাড়া কিংবা বল্লার বাস মেলে। লেগুনাই মূল ভরসা।

যা-হোক, গাঁয়ের স্টপেজে বাস কি লেগুনা থেকে নেমে গাঁজার বিড়ি ধরিয়ে টানে আর বেসুরো-গলায় গান ধরে – ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায় …।’

যে-রাতে ওরা কুসুমকে পেল, ওই রাতেও ওরা ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গাইতে গাইতে ফিরছিল।

বাস কি লেগুনা থেকে নামলেই হাইস্কুলের মাঠ। মাঠ পার করে স্কুলের দুই ভবনের মাঝখান দিয়ে পশ্চিম দিকে বাড়ির পথ। স্কুলের পেছনে, রাস্তার ডান পাশে মহিলা সংস্থার পরিত্যক্ত ঘর। আমরা জন্ম থেকেই দেখছি – ঘরটি উপুর হয়ে পড়ে আছে। হয়তো ঝড়ে ভেঙে পড়েছিল। চালের টিন-কাঠ, দেয়ালের ইট, কে কবে খুলে নিয়েছে জানা নাই। ঝোপজঙ্গলে ভরা ঘরটির চৌহদ্দি। ওই ঘরের কাছ থেকেই কুসুমের কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল।

মঙ্গলের কানেই প্রথমে কান্নার শব্দ আসে। জোর শব্দ না, মিহি কান্নার সুর। তবুও মঙ্গলের কানে বাজে। মঙ্গল দাঁড়িয়ে পড়ে।

‘কী ব্যাপার, খাড়াইলি ক্যা? মোতা ধরছে নাকি?’ বলে আনছের।

‘না। কান খাড়া কইরা দ্যাখ, পোড়োবাড়ি থিকা বাচ্চালোকের কান্দনের শব্দ আইতাছে না?’

‘কী আবোল-তাবোল কস? আমার কানে তো কিছু বাজে না। তর মালে কি উজানি ধরছে?’

‘নারে আনছের, আমি হুনতাছি। ঠিক বাচ্চালোকের কান্দনের শব্দ।’

‘বাড়িতে তর বউ বুঝি কানতাছে।’

‘দূর ব্যাটা! আমি বউ পামু কই?’

‘তাইলে অনিল ব্যাহারার বউ। তার লগে তো তর রোশনাই আছে।’

‘যা-তা কইস না তো আনছের। ল, আগাইয়া দেহি।’

‘তর কি মাথা খারাপ অইছে মঙ্গল? ওনে তো সাপখোপের আড্ডা …।’

‘টর্চলাইট আছে না? না দেইখা যামু নাকি?’

কুসুমের কান্নার জোর তখন কিছুটা বেড়েছে। এটা যে মানুষের বাচ্চারই, মানে নবজাতকের কান্না, তাও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আনছেরের কানেও তখন বাজছে ওই কান্নার শব্দ। বাচ্চাটির যেন খুব খিদে পেয়েছে। দুধ খাওয়ার জন্য ‘মা-মা’ করে কাঁদছে।

আনছের বললো – ‘তাই তো রে মঙ্গল! বাচ্চালোকের কান্দনই তো।’

টর্চের আলো জ্বেলে হাঁটে ওরা। আগে মঙ্গল, পেছনে আনছের। পরিত্যক্ত ঘরটির সামনে বিষকাঁটালি আর বেতঝোপের কাছাকাছি যেতেই একটা কুকুর ঘেউ  ঘেউ করে উঠলো। অচেনা কুকুর। আগে কখনো পথে-ঘাটে চোখে পড়ে নাই।

কুকুর বুদ্ধিমান প্রাণী। বাচ্চাটির কান্না দেখেই বুঝে ফেলেছে, সে জীবিত। তাকে পাহারা দিতে হবে। সকালে লোকজনকে খবর দিতে হবে। কিন্তু হঠাৎ আনছের ও মঙ্গলকে দেখে খুশিতে চকচক করে উঠলো কুকুরটির চোখ-মুখ। যাক, বাঁচা গেল। দুজন মানুষ যখন এসে পড়েছে, বাচ্চাটির একটা হিল্লে এখন হবেই।

কুকুরটি একটু সরে বসে লেজ নাড়াতে লাগলো।

নবজাতকটির পুরো শরীর একটা ফিনফিনে পাতলা কাঁথা দিয়ে মোড়ানো। মুখমণ্ডল খোলা। কী সুন্দর যে দেখতে! যেন একটুকরো চাঁদ খসে পড়েছে ভূতলে!

মঙ্গল বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিল। বললো – ‘দ্যাখ, দ্যাখ আনছের, এটি যেন মাইনষের বাচ্চা না, আকাশের চাঁদ। এতো সুন্দর বাচ্চালোক আমি জীবনে দেহি নাই।’

আনছের বললো – ‘দ্যাখ্ছে – বাচ্চাটা ছেলে না মেয়ে?’

‘আরে! এহনই দেখার দরকার কী? আগে বাড়িতে নিয়া যাই।’

‘দরকার আছে।’

‘কী দরকার?’

‘মেয়ে অইলে অনুমান করি, কারো দুই মেয়ে বা তিন মেয়ের পর আবার মেয়ে অইছে, তাই রাগের চোটে ফালাইয়া দিয়া গেছে।’

‘আর ছেলে অইলে?’

‘অনুমান করি, অবৈধ সন্তান অইতে পারে।’

মঙ্গল দার্শনিকের মতো বললো – ‘অবৈধ সন্তান বইলা জগতে কিছু নাইরে আনছের। নারী-পুরুষের মিলন ছাড়া কি সন্তান জন্মে!’

আনছেরও তখন দ্রব্যগুণে দার্শনিক হয়ে উঠেছে। সে উদাসভাবে বললো – ‘তাই তো রে মঙ্গল। ঠিক কথাই কইছস। নর-নারীর মিলন ছাড়া সন্তানের জন্ম অসম্ভব। কিন্তু সন্তানের জন্ম দিয়া যারা তারে এই সাপখোপেভরা জঙ্গলের কাছে ফালাইয়া রাইখা গেল, তারা কি মানুষ? তারা অমানুষ। জানোয়ার। দোজখের কীট।’

নবজাতকটিকে এখন দ্রুত বাড়িতে নিয়ে দুধ খাওয়ানো দরকার। শুশ্রুষা করা দরকার। মঙ্গল তো বলেওছে – ‘আগে বাড়িতে নিয়া যাই’ – কিন্তু বললেই তো তা হয় না। কাকতালীয়ভাবে কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চাটিকে মঙ্গল বাড়িতে নিয়ে গেলে প্রথমেই নবজাতকের জাতপাতের প্রশ্ন উঠবে। কার না কার বাচ্চা। হিন্দুঘরের না মুসলমানের বাচ্চা, কে জানে! এবং এই প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক। হিন্দু পরিবারে জাতপাতের বিচার খুব কড়া। মঙ্গল বাচ্চাটিকে আবেগের বশে বাড়িতে নিয়ে গেলেও তাকে বাড়িতে রাখার স্পর্ধা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। সমস্যা আরো আছে। মঙ্গল অবিবাহিত। মা বেঁচে নাই। বড়ো দুই ভাবির চার-পাঁচটা করে বাচ্চা আছে। গরিব মানুষ। বাড়িতে একটি বাচ্চা, তাও নবজাতক, তার ভার নেওয়া তাদের জন্য খুবই কঠিন।

বাচ্চা কোলে মঙ্গল নিজেই নিজেকে, মনে মনে প্রশ্ন করলো – এখন কী করবে সে? বাচ্চাটিকে তো নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই।

আনছের মঙ্গলের মন পড়ে ফেলেছে। মঙ্গল বাচ্চাটিকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে না, তাও সে জানে। কিন্তু আনছের নিজেও যে নিরুপায়। তার বউটা দেড় মাস হয়ে এলো রাগ করে বাবার বাড়ি চলে গেছে। ছেলেমেয়ে দুটোকেও সঙ্গে নিয়ে গেছে। আনছের এখন একলা মানুষ।

কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। বললো – ‘তোমরা দেরি করছ কেন? দেখছ না বাচ্চাটি খুব ক্ষুধার্ত!’

আনছের বললো – ‘মঙ্গল, এক কাম করি।’

‘কী?’

‘বাচ্চাটারে জরিনা খালার কাছে নিয়া যাই। সে ব্যবস্থা একটা কিছু করবোই।’

মঙ্গল ক্রমেই দিশেহারা হয়ে উঠছিল। বাচ্চাটাকে নিয়ে কী করা যায় – কিছুই ভাবতে পারছিল না। আনছেরের কথা শুনে তার দিশেহারা ভাব কেটে গেল। বললো – ‘তাই তো! খালার কথা মনেই আছিল না। সে তো দাইমা। তার কাছেই বাচ্চাটা নিরাপদ।’

দশ মিনিটের পায়ে-হাঁটা পথ – তারপরই রাস্তার ডানপাশে জরিনা খালার পুকুরওয়ালা বাড়ি। খালার বাড়িতে বিদ্যুৎসংযোগ আছে। পাঁচ-সাতটা বড়ো বাতি জ্বলে বাড়িতে। ঝাড়বাতির আলোয় ভরা ঝলমলে বাড়ি। তালুকদারবাড়ি, সিকদারবাড়ি, মণ্ডলবাড়ি ছাড়া গাঁয়ে আর কারো বাড়িতে এরকম জরিনা খালার বাড়ির মতো ঝলমলে আলো জ্বলে না। রাত তখন কতো, কে জানে! হয়তো বারোটা ছাড়িয়ে গেছে। জরিনা খালার বাড়িতে বিদ্যুতের আলো ছাড়া আর কোনো শব্দ নাই। নিঝুম বাড়ি। আনছের খা খা গলায় ডাক শুরু করলো – ‘খালা, ও জরিনা খালা …।’

জরিনা খালার পাতলা ঘুম। বাড়িতে চারটে মানুষ, সবাই মহিলা, দুটো মেয়ে – বন্যা-পপি, কাজের লোক সফুরা, ওরা কেউ জেগে উঠলো কি না কে জানে, খালার ঘুম ভেঙে গেল, সে গলা খাঁকারি দিয়ে প্রশ্ন করলো – ‘ক্যারারে, এতো রাইতে ডাকাডাকি করস?’

‘খালা, আমি আনছের, সাথে মঙ্গল আছে।’

‘দুই মদখোর, গাঁজাখোর …?’

‘হ খালা। দরজাটা খোল।’

‘এতো রাইতে, কেন?’

‘আগে দরজা খোল। কইতাছি। খুব জরুরি ব্যাপার।’

জরিনা খালা ঘরের দরজা খুলে বাইরে এলো। বন্যা-পপিও সঙ্গে এসেছে।

‘কী ব্যাপার আনছের?’

বাচ্চা কোলে মঙ্গল। কুকুরটাও সঙ্গে এসেছে। লেজ নাড়ছে। ও এখন খুব খুশি। বাচ্চাটার একটা হিল্লে হবে। বেঁচে থাকবে। খালার চোখ পড়লো বাচ্চার ওপর। ‘তর কোলে কী রে মঙ্গল?’

‘খালা, বাচ্চা। স্বর্গশিশু।’

বাচ্চাটিকে জরিনা খালা নিজের কোলে নিল। ‘এতো সুন্দর বাচ্চা! দেখতে যে একেবারে চান্দের মতো। কোনে পাইলি তরা?’

আনছের বললো – ‘মহিলা সংস্থার জঙ্গলের কাছে। কেউ রাইখা গেছিল।’

হায় আল্লাহ! এতো খারাপও হতে পারে মানুষ! এ যে জান্নাতের ফুল! কারা করলো এই জঘন্য কাজ? মা-বাবার বুক একবারও কাঁপলো না? তখন জবাই-করা মুরগির মতো কাঁপছে জরিনা খালার গলা। কাঁপা কণ্ঠেই খালা বন্যাকে বললো – ‘বন্যা মা, তর সফুরা খালারে ডাক দে তো।’

তারপর উঠোনে বসেই খালা নিজের স্তন তুলে দিলো বাচ্চাটির মুখে।

ভোর হতে না হতেই গাঁয়ে রাষ্ট্র হয়ে গেল – রাতে আনছের আর মঙ্গল মহিলা সংস্থার জঙ্গলের সন্নিকট থেকে একটি মেয়েশিশু কুড়িয়ে পেয়েছে। নবজাতক। মেয়েটি নাকি পরির বাচ্চার মতো দেখতে। এখন জরিনা খালার কাছে আছে। গাঁয়ের মানুষ বাচ্চাটিকে দেখতে ভেঙে পড়েছে খালার বাড়িতে।

জরিনা খালার বাড়ি বাজারের মতো গমগম করছে। অবশ্য মেয়েমানুষের কলরবই বেশি। ‘এইডা মানুষের কাম? কে মেয়েটির মা, আর কে বাবা – কে জানে! আহারে, পরির মতো মেয়ে!’

আমি তখন সদ্য-কিশোর। মনে পড়ে – আমিও কুসুমকে দেখতে গেছিলাম। জরিনা খালা ততক্ষণে বাচ্চাটির নাম রেখে ফেলেছে – কুসুম। আমার ‘কুসুম’, আমার ‘কুসুম’ বলে কবুতরের মতো বাকবাকুম করে ডাকছে।

খবর পেয়ে চেয়ারম্যান এসেছেন। মেম্বার তো গাঁয়ের লোকই। সে খুব সকালেই এসেছে। চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই নাকি থানায় ফোন করে এসেছেন। পুলিশ এলো বলে! এরকম অজ্ঞাতপরিচয় নবজাতক কেউ ইচ্ছা করলেই নিজের কাছে রাখতে পারে না। পোষ্য হিসেবে নিতে পারে না। সবকিছুর জন্যই আইনকানুন আছে তো।

সকাল ১০টার দিকে, রোদ তখন চড়ে গেছে, উৎসুক মানুষের সমাগম কিছুটা কমেছে, উঠোনের বাম-কোনার কামরাঙা গাছের ছায়ায় বসে খালা কুসুমকে চামচ দিয়ে কুসুম কুসুম গরম দুধ খাওয়াচ্ছে; চেয়ারম্যান-মেম্বার উসখুস করছে, পুলিশ আসতে এতো দেরি করছে কেন?

কিছুক্ষণ পর থানার ওসি নিজাম উদ্দিন নিজেই এলেন। সঙ্গে একজন এএসআই, কামাল ও একজন কনস্টেবল।

‘বাচ্চাটি তো দেখতে খুবই সুন্দর, চেয়ারম্যান সাহেব।’ বললেন ওসি।

‘হ্যাঁ। খুবই সুন্দর। দেখুন না, খালার কোলে যেন চাঁদ উঠেছে।’ চেয়ারম্যান বললেন।

‘বাচ্চাটিকে যারা পেয়েছে, ওরা কই? ওদের স্টেটমেন্ট দরকার।’

আনছের-মঙ্গল কাছাকাছিই ছিল। ওরা সামনে এলো। আনছের আদ্যোপান্ত খুলে বললো। সব লিখে নিল এএসআই কামাল।

সেই কুকুরটি দাঁড়িয়ে ছিল আনছেরের গা ঘেঁষে। লেজ নাড়ছিল। ওসি বললেন, ‘আরে! কুকুর কেন এখানে?’

আনছের বললো – ‘স্যার, এই কুত্তাই বাচ্চাডার পাহারায় আছিল।’

‘বাচ্চাটিকে তো এখন থানায় নিয়ে যেতে হবে।’

ওসির কথা শুনে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো জরিনা খালা। ‘থানায়! থানায় ক্যান?’

‘বাচ্চাটি আপনি পোষ্য নিতে চাইলে ডিএম-স্যারের অনুমতি লাগবে।’

চেয়ারম্যান বললেন – ‘খালা, তোমার তো দুই-দুইটা মেয়ে আছে। আরো একটা মেয়ের দরকার কী?’

খালা কুসুমের কপালে চুমু খেয়ে বললো – ‘বন্যা-পপি তো বিয়ার যোগ্য হইয়া উঠছে। দুই ম্যায়া শ্বশুরবাড়ি গেলে আমার বাড়ি খালি। আমি একলা। কুসুম আমার ছোট ম্যায়া। ও আমার বুড়াকালের সঙ্গী।’

আইনকানুন মেনেই কুসুম জরিনা খালার ছোট মেয়ে হয়ে বাড়িতে আসে।

এই আখ্যান সৃজিত হয় নিয়ত আলী তালুকদার খুন হওয়ার দু-বছর পর।

আমাদের চোখের সামনেই কুসুম বড়ো হয়েছে। কুসুমফুলের মতোই লাল-হলুদ আলো ছড়িয়ে মেয়েটিকে পথে হাঁটতে দেখেছি। আমাদের বাড়িতে নাদিরার সঙ্গে ‘পুতুল-বিয়ে’ খেলতে দেখেছি। আর কতো যে দেখেছি খালার পুকুরে কিংবা বাড়ির অদূর দিয়ে বয়ে চলা শালুক নদে সাঁতার কাটতে। সাঁতারও জানে কুসুম! ওর সঙ্গী-সাথি মেয়ের দল তো দূরে থাক, দেখেছি, ওর বয়সী কিংবা ওর চেয়ে বয়সে কি গায়ে-গতরে বড়োরাও কখনো ওর সঙ্গে সাঁতার কেটে পারতো না। কুসুম সবার আগে সাঁতরে পুকুর কিংবা নদের ওপার যেতো। তাই তো কুসুমের সঙ্গী-সাথিরা ওর নাম দিয়েছিল জলকন্যা।

জলকন্যারা তো নদের জলের মতোই পবিত্র। একটা পবিত্র মেয়ের শেষ পর্যন্ত এই পরিণতি! গাঁয়ের লোকেরা ফিসফাস করে – ‘কুসুম বেশ্যা হইয়া গেল!’

আমার একবার ভীমরতি ধরেছিল, আমি কুসুমকে রেপ করতে চেয়েছিলাম, তা তো এই আখ্যানেরই অংশ। আনোয়ার ভাইয়ের প্রচণ্ড ভীতিপ্রদর্শন আর আল্লাহর রহমতে আমি বেঁচে গেছিলাম। আমি রেপিস্ট হই নাই। আমি জেলে যাওয়ার পর কুসুম রেপড হয়। কিন্তু রেপড হওয়া আর বেশ্যা বনে যাওয়া তো এক না।

জেল থেকে বেরিয়ে রাজনীতির পাট চুকিয়ে ফেলেছি। বুঝতে বাকি নাই – রাজনীতি এখন কতোটা কলুষিত। কী রকম বদগন্ধযুক্ত। চাঁদাবাজির মামলায় আমি জেল খাটলাম। অথচ রঘুনাথ সাহার গদি থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছিল দলের ইউনিয়ন সেক্রেটারি নূরে আলম। আমি কিছুই জানতাম না। এক লাখ টাকার কানাকড়িও আমার কপালে জোটে নাই। এখন আমি বাবার ব্যবসা দেখছি।

বাজারের ‘ব্যাপারী-হাউজে’ বসি। আমার মতি ফেরায় বাবাও খুব খুশি। ম্যাট্রিক পাশ করি নাই, তাতে কী? ব্যাপারীবাড়ির ছেলে, ব্যবসার মাথাটা খুলে গেলেই চলবে।

ব্যবসায় নেমেছি, হাউজেও বসি, কিন্তু আমি ঠিক সুস্থির নই। নিজেই বুঝি – নাদের আলীর মাথাটা বর্ষার শালুক নদের মতোই উত্তাল। মাথার ভেতরে, নিজের কানে শুনি, নদের পাড় ভাঙার শব্দ। সবকিছুর মূলে কুসুম। কেন গাঁয়ের লোকেরা কুসুমকে বেশ্যা বলে, কিংবা সত্যি সত্যিই, আমি যেহেতু মনে করি মেয়েটি জলের মতো পবিত্র, এই মেয়েটা বেশ্যা বনে গেছে কি না, যেভাবেই হোক, এই রহস্য উন্মোচন করা দরকার।

আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেললাম – আমি কুসুমদের বাড়িতে যাবো, আজ রাতেই, মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবো, ওর সঙ্গে কথা বলতে না-পারলে তো রহস্য উন্মোচন করা যাবে না।

কিন্তু রাতে যে যাবো, যা শুনছি, যা কানে আসে, কুসুমের ঘরে রাতে লোক আসে, থাকে; আমি ওর ঘরে গেলে একটা বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। ওর ঘরে লোক থাকলে থাকুক। যা ঘটে ঘটুক। আমি আজ রাতেই ওর ঘরে যাবো। কোনো লোক যদি থাকে ওর ঘরে, তাহলে, আমি যা চাইছি, কুসুম আসলে বেশ্যা বনে গেছে কি না, আর বেশ্যা বনে গেলে তা কেন, এই রহস্যের জট খুব সহজেই খুলে যাবে।

সন্ধ্যায় ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল। এখনো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বাজারের রাস্তাঘাটে কাদাপানি। বৃষ্টি ধরে আসতেই বাবা বাড়িতে চলে গেছে। আমাকেও নয়টার আগেই বাড়ি ফিরতে বলেছে। দুর্যোগপূর্ণ রাত। আবার বৃষ্টি নামতে পারে। কিন্তু আজ আমার বাড়ি ফিরতে রাত কটা বাজবে জানি না।

পিয়ার আলী হাউজেই ছিল। ও আমাদের কর্মচারী। নাটোর কি নওগাঁ – কোথায় যেন বাড়ি। অনেকদিন ধরেই ব্যাপারী হাউজে আছে। থাকা-খাওয়া আমাদের বাড়িতেই। আগে হাউজ বন্ধ করে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরতো, এখন আমার সঙ্গে ফেরে। পিয়ার আলী বললো – ‘মুচিবাড়ি যাবো ভাইজান?’

জেল থেকে এসে গাঁজা ছেড়ে দিয়েছি। মাঝে মধ্যে বানুটি খাই। বাজারের উত্তর পাশে নদঘেঁষে মুচিবাড়ি। মুচিবউরা বানুটি তৈরি করে। পিয়ার আলী বানুটি এনে দেয়। কিন্তু আজ খাবো না। পিয়ার আলীকে বললাম – ‘না, থাইক। দরকার নাই।’

রাত তখন এগারোটার মতো বাজে। ইলশেগুঁড়ি বন্ধ হয় নাই। আমি বৃষ্টি মাথায় নিয়েই কুসুমদের বাড়িতে গেলাম। ঘরে আলো জ্বলছে। আমার বুকটা ছ্যাত্ করে উঠলো! কুসুম কি তাহলে জেগেই আছে? ঘরে কেউ আছে, নাকি কেউ আসবে, তার জন্য অপেক্ষা করছে কুসুম।

আমি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিলাম – ‘কুসুম।’

কুসুম তো জানে, এখন টোকন আসবে, সে বললো – ‘দরজা খোলাই আছে।’

দরজা খোলা! মানে, দরজার পাল্লা ভেজানো? খিল আঁটা নাই। আমি পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। কুসুম বিছানায় শুয়ে কী একটা বই পড়ছিল। আমাকে দেখে চমকে উঠলো। হাতের বই পড়ে গেল বিছানায়। দুই হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলো কুসুম। ‘আপনি! শেষ পর্যন্ত আপনিও …?’

‘বিশ্বাস করো কুসুম। আমার মনে কোনো পাপ নাই। আমি তোমার কাছে মাফ চাবার আইছি।’

‘মাফ! কেন? আমার কাছে মাফ চাইতে আসছেন কেন?’

‘আমি একদিন জোর কইরা তোমার হাতে প্রেমপত্র গুঁইজা দিছিলাম …।’

‘সেটা খুব অন্যায় ছিল না আপনার। অন্যায় করেছিলাম আমি। আমার বয়স কম ছিল। বুঝি নাই। মাকে সব বলে দিলাম। মা আপনাকে কী অপমানটাই না করলো!’

‘কুসুম …!’

‘কিন্তু নাদের ভাই, সেই কুসুম আর এই কুসুম এক না।’

‘তুমি রেপড হইছিলা, তা ঠিক। কিন্তু রেপড হওয়া, আর তোমার নামে এখন যে বদনাম, তা তো এক না। কেন এই বদনাম উঠেছে?’

‘বদনাম চারদিকে রটে গেছে, ছিঃ ছিঃ পড়ে গেছে, তা বলা যাবে না। কেউ কেউ গোপনে ফিসফাস করে। সেই ফিসফাসই হয়তো আপনার কানেও গেছে। কুসুম মেয়েটা বেশ্যা …।’

‘কিন্তু এই ফিসফিসানিটাই বা কেন কুসুম?’

‘দেখলেন তো দরজা খোলা। আমার কোনো উপায় ছিল না।’

‘দেশে কী আইনকানুন-বিচারআচার কিছুই নাই?’

‘যার কাছে বিচার চাইতে যাবো, সেও আসে নাদের ভাই।’

‘বন্যা-পপি – কারো কাছে চইলা যাইতা।’

‘রেপড মেয়েদের কোথাও মুখ দেখানোর জায়গা থাকে না।’

উঠোনে টর্চের আলো। টোকন এসেছে। কুসুম দরজায় দাঁড়ালো। বললো – ‘আমার শরীর খারাপ টোকন ভাই। আজ চইলা যান।’

‘ঘরে কে তাই বল্ মাগি।’

নাদের আলীর আর ঘরের ভেতরে চুপচাপ বসে থাকার মতো পরিস্থিতি নাই। তার মাথায় আগুন ধরে গেছে। করোটির ভেতর আগুন দপদপ করছে। টোকনের মুখোমুখি না-হলে এ-আগুন নিভবে না। নাদের দরজায় দাঁড়ানো কুসুমকে ঠেলে উঠোনে নামলো। দাঁড়ালো টোকনের সামনে। ‘দ্যাখ। ভালো কইরা দ্যাখ, ঘরে কে আছিল?’

‘আরে, নাদের‌্যা তুই! বাইনচোত, তুই আমার মালে ভাগ বসাবার আইছস? তর কল্লাটা আমি কাইটা ফালামু না?’

‘চুপ হারামির পুত!  তুই জরিনা খালারে খুন করছস। কুসুমরে রক্ষিতা বানাইয়া রাখছস। তর কল্লা কাটমু আমি।’

তখন আর বৃষ্টি নাই। দুই প্রবল প্রতিপক্ষ মুখোমুখি। দুজনের মাঝখানে কুসুম। সেই কুকুরটিও এসে কুসুমের পাশে দাঁড়িয়েছে। কুকুর কতদিন বাঁচে! হঠাৎ উঠোনে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো। অদূরেই পুকুর …।

পাদটীকা

পরদিন সকালে গাঁয়ের লোক দেখলো – এ কী মর্মান্তিক কাণ্ড! জরিনা খালার পুকুরে ভাসছে তিনটি লাশ। নাদের আলী আর কুসুমের লাশ পাশাপাশি, দূর থেকে দেখার ভুল হতে পারে – যেন দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে; অনতিদূরে টোকনের লাশ। লাশগুলো গাঁয়ের কার চোখে যে আগে পড়েছে, কে জানে! নাদের ও টোকনের লাশ রক্তাক্ত। দুজনেরই শ্বাসনালি কাটা। কে জানে – নাদের নাকি টোকন, কে আগে কার গলা কেটেছে! কুসুমের শরীরের কোথাও ক্ষতচিহ্ন নাই…!