ধূসর বরন চিল

আ  মার ঘর বারোতলার ওপর। তেরোতলায়। আনলাকি থার্টিন। আকাশের কাছাকাছি। এখানে থেকে ‘মনে হয়’ জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিলেই আকাশ ছুঁতে পারবো। কখনো কখনো নীলচে আকাশই ঢুকে পড়ে জানালা দিয়ে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে। মেঝেতে পানি-রঙা নীল আকাশের রং লেগে থাকে। গড়াগড়ি যায়। আমি তাকালেই সেই রং দৌড়ে পালায়। গিয়ে বসে মেঘ পার হয়ে। আকাশের সীমানায়। ক্লান্তিময় নীল। মাঝে মাঝে থান পরা মেঘেরা ওঠে সেখানে। তাদের পাহারা দেয় একটি চিল। চিল নাকি ভুবনচিল জানি না। জীবনানন্দ বলতে পারবেন। হায় চিল, ধূসর বরন চিল!

নায়লা এ-মুহূর্তে অফিসে। আজ আমার ছুটি। কিন্তু ওর অফিস। ভালো। বেচারী খাটছে। চেয়ারের পর চেয়ার বদলাচ্ছে। আমি থিতু হয়ে বসে আছি রং-তুলিতে। ছন্নছাড়া, ছন্দছাড়া জীবন আমার। বেঁধে যেতে পারিনি। যোগ্যতাই নেই। নায়লা বাসায় থাকলে এখন টিভি চালিয়ে বসে থাকতো। এমটিভি ওর খুব প্রিয় চ্যানেল। আর প্রিয় রেসলিং। এমটিভির নিতম্ব দোলানো মেয়েদের প্রশংসা করে ও। নাম-ধাম সব বলে দেয় অনায়াসে। গড়গড় করে বলে। আমি তাকিয়ে থাকি। এ-ব্যাপারে আমার অযোগ্যতার শেষ নেই। বোকার মতো তাকিয়ে থাকি। আক্ষরিক অর্থেই এ-ব্যাপারে প্রথম শ্রেণির মূর্খ আমি। নায়লা ভারি বিরক্ত হয়। শোনার মতো একজন ভালো লোক দরকার। যে ওকে ওসব বিষয়ে সঙ্গ দিতে পারবে। একজন কথা বলার উপযুক্ত লোক। আমি কখনোই হতে পারিনি। সেদিন বললো, … কী যেন? … জেনিফার লোপেজ, আগুইলিরা … আমি বোকার মতো তাকিয়ে থেকেছি।

চিল আজো উড়ছে। এখন দুপুরবেলা। ভরদুপুর বলা যায়। আচ্ছা, এবার নায়লাকে একটি ফোন করা যেতে পারে। ও কি চিলের নাম বলতে পারবে? ওর জানাশোনা তো প্রচুর। অবশ্য চিল যদি বাঙালি হয়, তবে ওর না জানারই কথা। এমনকি জানতেও আনস্মার্ট বোধ করতে পারে। আবার আমি এ-বিষয়ে ফোন করছি, হেঁয়ালি ভাববে না তো? কিন্তু ফোন করতে গিয়ে যার কথা আমার প্রথম মনে হলো, সে নায়লা নয়। মনে পড়লো অমিয়র কথা। নম্বর টিপতেই ওপাশ থেকে, ‘হ্যালো।’

– অমিয়, আমি সেজান।

– সেজান, এমন অসময়ে? বল।

– আমি একটা সমস্যায় পড়েছি।

– বল না। কী নিয়ে সমস্যা?

–  চিল নিয়ে।

– চিল নিয়ে? মানে তুই চিল পালছিস?

– না। তা পালবো কেমন করে? আচ্ছা, তুই কি শঙ্খচিল কিংবা ভুবনচিল চিনিস? মানে কোনটার কোন রং?

– না রে। একটা চিল চিনি, গাঙচিল। সিগাল। সাদা রঙের।

– সে চিল তো আকাশের বহুদূরে উড়তে পারে না। আবার আমার এ-চিল সাদাও নয়।

– তাহলে আমায় ছেড়ে দে।

– অমিয় ফোন রেখে দিলো। আকাশে উড়তে থাকা চিলটিকে আমার কালো বলেই মনে হয়। কিন্তু গ্রামে আমি যে-চিল দেখেছিলাম তা কালো ছিল না। এর রংও কালো না হতে পারে। দূরত্বের জন্য এমন। আচ্ছা, এ-চিলটি মেয়ে না ছেলে? একাকী ওড়ার কারণটি আমার জানা দরকার। সেটি জানা সম্ভবত সহজ হবে না। একবার নায়লার অফিসে ফোন করলে কেমন হয়? করা যেতে পারে। এমটিভি চ্যানেলের যাবতীয় নারীর খবর যে রাখে তার পক্ষে তুচ্ছ এক চিলের খবর রাখা খুবই সম্ভব। নাকি উল্টো? চিল উড়তে থাকা দৃশ্যের বদলে তার চোখের সামনে হয়তো রয়েছে কোনো মহিলার ভারী নিতম্ব। অথবা তার বুকের অর্ধেকটাও হতে পারে। হৃদপিণ্ডের মতো নড়ছে সে বুক। তবে চিলের নামটি ওর জানা থাকার সম্ভাবনাই বেশি। নায়লা জানে না এমন বিষয় কি পৃথিবীতে খুব বেশি আছে। নেই সম্ভবত। আর না জানলেও ভালো। বরং সেটিই বেশি ভালো। খুব কাবু করা যাবে তাহলে। সামান্য চিলও ওর চেনা নেই, এই বিষয়টিই ওকে ভাবিয়ে তুলবে। আমি অনেকটা জব্দ করতে পারবো ওকে। জীবনে ওরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে, বোঝাতে পারবো।

নায়লার অফিসের ফোন নম্বর আমার মনে থাকে না। আমাকে ওর কার্ড দেখতে হয়, অথবা ফোনের পাশেই রাখা ডায়েরি দেখতে হয়। আমি অবশ্য খুব বেশি

 ফোন করি না। ফোন করার দরকারও হয় না। তবু মনে রাখা দরকার নম্বরটি। কিন্তু মনেই থাকে না। যে-কোনো একটি ডিজিট ভুল হয়ে যায়। ও আমার ফোন পেয়ে খুবই বিস্মিত হয়। আজ হবে কি না বুঝতে পারছি না। আমি ডায়েরি খুলে নম্বর দেখে দেখে টিপলাম, ‘হ্যালো, নায়লা।’

– তুমি কোত্থেকে?

– বাসা থেকে বলছি। আমি একটা সমস্যায় পড়েছি।

– পড়েছো তো সময় নিচ্ছো কেন?

– সমস্যাটা জটিল।

– কথা বাড়াও কেন? সমস্যা বলো। কী সমস্যা?

– চিল নিয়ে সমস্যা।

– কী নিয়ে?

– চিল নিয়ে। আমি ভুলে গেছি ভুবনচিলের রং কী, শঙ্খচিলের…

– আবার তোমার পাগলামি শুরু হয়ে গেল। আমি এখানে অফিসের কাজ নিয়ে মরে যাচ্ছি। যত্তসব!

নায়লা ফোন রেখে দিলো। ওর চেহারা যদি এখন দেখা যেত! কী জানি, এসব ক্ষেত্রে তো বসরা অধস্তনদের ওপর এক হাত দেখে নেয়। ঈশ^র, ক্ষমা করো, যদি ওর অফিসের কেউ আমার কারণে কষ্ট পায়। তবে নায়লা কিন্তু চালাকিই করলো। ও চিল চেনে কিনা তা আমার জানা হলো না। রাগ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলো, এসব নিয়ে হেঁয়ালি করার সময় ওর নেই। আমার জানা হলো না, ও জব্দ হলো কি না। হায় চিল, ধূসররঙা চিল! সোনালি ডানার চিল।

দেখার অভিজ্ঞতা খুবই বড় অভিজ্ঞতা। তার চেয়েও বড় অভিজ্ঞতা হলো কল্পনা। এখানে যে-কোনো বস্তুতে যে-কোনো রং বসানো সম্ভব। আকাশ নীল, কালো, সাদা, হলুদ, বেগুনি রঙের হতে পারে। মানুষেরও এমন রং হয়। যা কিছু চাও, যে-কোনো রঙে, পাবে।

পাওয়া অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু ওই রংটির সঙ্গে তোমার দেওয়া রঙের মিল যে পাবে না, তার কাছে মনে হবে হাস্যকর। কিন্তু আবার যে হাসলো, সে মানুষই রয়ে গেল, শিল্পী হতে পারলো না। একজন শিল্পী মানুষের চেয়ে অনেক ওপরে। ঈশ^র সমঝে চলেন।

কে আমায় শুনিয়েছিল এ-কথা? কোনো স্যার? মনে নেই। তবে তেমনি কেউ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। চিলকে আমি ভেবে নিতে পারি, একাকী নয়। তার সঙ্গে রয়েছে থান-পরা মেঘ। তারাও উড়ছে চিলের সঙ্গে। আকাশের রং কেমন হবে? সাগর-নীল? নাকি আকাশ-নীল?

আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। আকাশের দিকে। আজ আকাশ আমার দিকে অমন চোখে তাকিয়ে আছে কেন? আমার জানা নেই। আমি রীতিমতো হতবাক। করুণ চেহারায় তাকিয়ে আছে সে। ধ্যানীর মতো? তাও হতে পারে। আকাশ আমার প্রেমে পড়েছে। তার জলে-ভেজা চেহারা তাই বলে।

ছবিটি আমার জমা দিতে হবে আগামী সপ্তাহে। এই নিয়ে দুবার সময় বাড়ালাম। প্রেমের চিল আমায় নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। আমি তার নাগাল পাই না। কোম্পানির লোকেরা আমার অভ্যাস জানে। আমার কাছ থেকে সময়মতো জিনিসটি পাওয়া যেতে পারে, আবার না-ও পাওয়া যেতে পারে। আমি অলস নই বোধহয়। পুরোপুরি পছন্দ না হলে আমি ছবি কিছুতেই হাতছাড়া করি না। আমি জানালা দিয়ে আবার তাকালাম বাইরে। আকাশের মুখ দেখে আমার ভেতরে যেন চিনচিনে ব্যথা। তাহলে আকাশটি নিশ্চয়ই কোনো এক মেয়ে। তাই হবে। নীলিমা তার নাম।

কিন্তু সে-আকাশ জুড়ে আজ মেঘ নেই। নেই কোনো চিল। আমার মন খারাপ হয়ে যায়। সেখানে লাল-নীল রঙেরা কমতে থাকে। চিলটির জন্য আমার বুকের কোথায় একটু কষ্ট হয়। এক ধরনের অস্থিরতা বাড়ে। চিলের নাম জানা হলো না। নাম আর রং জানা জরুরি। সোমা! সোমা বলতে পারবে। ওর পড়াশোনা অনেক। কিন্তু সোমার সঙ্গে কথা বলা নিষেধ করে দিয়েছে নায়লা। তার ধারণা, এ-মহিলা যথেষ্টই আনস্মার্ট। নায়লাদের পাশে বসার উপযুক্ত নয় কোনোক্রমেই। সোমাও অবশ্য ওদের পাশে বসে না। বসার চেষ্টাও করে না। সে বাংলা বইয়ের ভক্ত। বাংলা গান শোনে। কবিতা পড়ে, ছবির সমালোচনা পড়ে। আলাপ করে। পত্র-পত্রিকায় লেখাও বের হয়। খুব বেশি নয়। এক্ষেত্রে তাকে একেবারেই অ্যামেচার বলা যায়। মহিলা একাকী থাকে। ছেলেমেয়েরা কোথায় থাকে জানি না। তারা আদৌ কেউ আছে কি না তা একবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। তারপর আর করা হয়নি। কী জানি, উনি বিব্রতবোধ করতে পারেন। আর একটি বিষয়। মহিলা ছবির প্রদর্শনীতে যান। আমার ছবির খবর রাখেন। সম্ভবত ওনার কোনো আত্মীয়কে দিয়ে আমার একটি ছবি কিনিয়েছেন। এই ফ্ল্যাটবাড়িতে সোমার একটু বদনামও আছে। একজন মহিলা একাকী থাকলে যে বদনাম হয়, এরও তাই। আমার সঙ্গে কথা হয় কদাচিৎ। বাসায় ডাকে আমায়। আমি যাই না ভয়ে। ভয় পাই নায়লাকে। বিষয়টি কোনোভাবে জেনে থাকবে সোমা। আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, আমার বাসায় আসতে ভয় পান? খুব ভালো। স্ত্রীর বাধ্যগত স্বামী। বাইরে বেরোলেই কেউ ধরে নিয়ে যাবে। তা নাক দিয়ে দুধ বেরোলেও কি বউ মুছে দেয়?

আমি কোনো কথা খুঁজে পাইনি। আমতা-আমতা করেছি। সোমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হা-হা করে হেসে উঠেছে। রহস্যময় হাসি। সে-হাসি আজো আমার চোখে ভাসে। তার হাসি, তার সেই চেহারা। আমি ভীত, পরাজিত, পলাতক এক পুরুষ। পালিয়ে নায়লার ভয়ে, নায়লার আয়ত্তে চলে আসি। একেবারে ঘরে। আচ্ছা, সোমাকে ফোন করা যায় না? আকাশ নিয়ে চিল নিয়ে কথা হবে। সোমা বলবে, সোমা বলতে পারবে। আমি ডায়েরি খুলে দেখলাম। বহু লোকের ফোন নম্বর তাতে। এ-ফ্ল্যাটবাড়ির অনেকেরই। ডায়েরি ভরাই নম্বর। কিন্তু সোমার নম্বরটি নেই। হয়তো নম্বরটি দরকারি নয়। কিংবা ডায়েরিতে থাকার যোগ্য হয়নি ওই নম্বর।

আমি সাহস নিয়ে নিচে নামলাম। তার ফ্ল্যাট আবার চারতলায়। আমাকে অনেকখানিই নিচে নামতে হলো। কলিংবেলে হাত রাখলাম। আমি সাধারণত একবার বেল টিপি। এখানে ব্যতিক্রম হলো। দুবার টিপলাম। টিপে দাঁড়ালাম। খুট করে একটি শব্দ হবে। কেউ খুলে দেবে। কিন্তু তেমন কোনো আলামত পাওয়া গেল না। আমি আবার বেলে হাত দেবো, তখনই দেখি কপাটে তালা। সোমা বাসায় নেই। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। তালা খেয়াল করলাম না। ক্লান্তি নিয়ে ওপরে উঠলাম। আসলে আমার এখন দরকার ধূসরবরন চিল। সোনালি ডানার চিল। সাগর-নীল আকাশ। আকাশরঙা আকাশ। কিংবা তারচেয়েও বেশি কিছু, যা হয়তো সোমা দিতে পারে। সোমাই পারে। মানব প্রকৃতির রং, যেখানে সব রং আছে। যা চাওয়া যায় সব। কেবল মিলিয়ে নিতে হবে।

ফ্ল্যাটে এসে আমি থম মেরে রইলাম। সাগরের নোনা জলের স¦াদ মনে পড়ছে। ভেতরে আমার সাগর-জল। ক্যানভাসের ওপর সে-জল গন্ধ ঢালছে না। উজাড় করে দেওয়ার গন্ধই যেন তার নেই। সাগর শূন্য হয়ে গেছে। মাছ ছটফট করছে। জলশূন্য, গন্ধশূন্য। একবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। একবার একেবারে নিচে। মানুষেরা হাঁটছে। যেন পাতালপুরী। কত ছোট মনে হচ্ছে তাদের। আকাশে আবার তাকালাম। এখানে শোঁ-শোঁ বাতাস। সিলিং ফ্যান আছে ঘরে। দরকার পড়ে না চালানোর। মনে হলো, আমি যেন চিরকাল এখানে ছিলাম। বদ্ধ ঘর। বেরোনোর পথ নেই। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমার দরকার আকাশরঙা রং, সাগররঙা আকাশ।

কলিংবেল বাজার শব্দ। একবার, দুবার। খুব বিরক্ত লাগলো। কে হতে পারে? ঘড়ির দিকে তাকালাম। নায়লা হবে। অফিস থেকে ওর ফেরার সময় এখন। কিন্তু দুবার তো বেল বাজাবে না নায়লা। ওর পরিমিতিবোধ অসম্ভব রকমের তীক্ষè। তাহলে কে হতে পারে?

দরজা খুলে আমি অবাক। নায়লা। ঢুকলো। কোনো কথা বললো না। স্বাভাবিক নিয়ম। আমিও কিছু বললাম না। এ-পাশের রুমে আসতে লাগলাম। তক্ষুনি ও বলল, কী করছিলে ঘরে বসে?

– কিছুই না।

– আমাকে তিনবার বেল বাজাতে হলো।

আমি অবাক। তিনবার বাজালো নাকি? হতে পারে। প্রথমবার সাড়া পায়নি বলে, পরে পরপর দুবার। আমি শুনতেই পাইনি। আকাশ আর সাগরজল আমায় বধির করে দিয়েছে। ক্যানভাসে কোনো রং নেই, শূন্য। আকাশে কোনো রং নেই, শূন্য। একাকী আকাশে রঙের খোঁজে উড়তে থাকে এক চিল। সোনালি ডানার চিল, কিংবা ধূসররঙা চিল। নায়লা সরে যায়। এবার সোজা ওই রুমে। এখন ও বাথরুমে যাবে। ফ্রেশ হবে। তারপর ধীরেসুস্থে একটু কফি খাবে। আমিও খাবো। দুজনেই। তবে খেতে ও ডাকবে না। আমাকে গিয়ে বসতে হবে। বসলেই অবশ্য ও ঢেলে দেবে। রোজকার নিয়ম। আর সব নিয়ম বদলে যাচ্ছে। এটি রয়ে গেছে এখনো। কেমন করে থাকলো আমার জানা নেই।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো কফির টেবিলে বসলাম। নায়লা বসেছে আগেই। আমার কাপে কফি ঢাললো। আমি নিলাম না। নায়লা আমার দিকে তাকালো একটু। কিছু বললো না। আমিই তাকিয়ে আছি ওর দিকে। মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। নায়লা বললো, ‘কী হলো? নাও।’

আমি সে কথায় যেন পাত্তা দিলাম না। অনেকটা মরিয়া হয়ে বললাম, ‘নায়লা!’

ও অবাক হয়ে তাকালো। বললাম, ‘তোমাকে আজ ভারি সুন্দর লাগছে।’

– তোমাকে না বলেছি, আমার সঙ্গে হ্যাংলামো করবে না! ওসব আমার একেবারে পছন্দ নয়।

– আমার একটু রং দরকার। আকাশরঙা নীল। সে-রং না হলে ক্যানভাস শূন্য শূন্য মনে হয় আমার। ছবি হয় না। রংতুলির রং কুৎসিত হয়ে যায়। আমি ভিক্ষা করি রঙের। ফিরে আসি বারবার। রং নেই। চিল ওড়ে আকাশে। একাকী।

নায়লা উঠে পড়লো। কফি শেষ করলো না।

ইভ পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় আদমকে। সে পৃথিবী চেনে না। সাগরজল চেনে না। জলের নীল দেখেনি কখনো। ইভ তাকে শেখায়। সব শেখায়। একের পর এক। আকাশে চিল দেখে বিস্মিত হয় সে। আকাশ দিগন্ত পর্যন্ত বড় হয়। ইভ মুগ্ধ। সে ঢুকে পড়ে আদমের মধ্যে। ইভ তৃপ্ত হয়। তারপর ইভ বড় হতে হতে একেবারে শূন্যে মিলিয়ে গিয়ে কীভাবে যেন তার মন দখল করে ফেলে। পুরোপুরি। ইভ আদমকে খোঁজে। তার মনের রং ক্যানভাসের ওপর প্রলেপ দেয়। ক্যানভাস হেসে ওঠে। গাঢ় সবুজ রঙে ঢেকে যায় ইভের শরীর, স্পর্শের চূড়ান্ত বিন্দু, যার ওপর আদম তার ঠোঁট রাখে। নাক ঘষে। ইভের মনে হয়, তার মধ্যে প্রোথিত হচ্ছে সাগরজল। লোনা, মিঠা, তেতো … সব স্বাদ রয়েছে তাতে। পৃথিবী বেড়ে ওঠে আদমের মধ্যে। আদম সে পৃথিবী প্রোথিত করে ইভের হৃদপিণ্ডে। ইভ অনন্য। আদম ধন্য। ইভের শরীরে সে দেখে রঙের ছড়াছড়ি। ইভ তার প্রকৃতি, নারী। নারী মানেই প্রকৃতি। প্রকৃতি মানেই ইভ। তার রস নিংড়ে নেওয়া চাই। প্রকৃতির অপরিসীম দান হাত পেতে নিতে হবে। ইভ যে আদমের কাছে দায়বদ্ধ। সে এক বিশাল পৃথিবী। রহস্যময়। তার মধ্যে রং ঢুকিয়ে দেবে আদম। তেমনই তো অঙ্গীকার। তা না হলে এ-পৃথিবী কেমন করে ভরে উঠবে সবুজ-শ্যামলিমায়! আকাশ কেমন করে হবে নীল? বিশ্বজোড়া ক্যানভাসে তার রং ছড়াতে ইভের স্পর্শ দরকার।

নিষ্ফলা জমির কী মূল্য? বিশুদ্ধ কোনো মূর্তিও হবে না এমনকি সে-মাটিতে।

কেবলই হাতুড়ির ঠুংঠাং। বৃথা

হা-হুতাশ। একাকী ইভ চিরন্তন হয় আদমের ছোঁয়ায়। নিষিদ্ধ গন্ধমের টান সেখানে। আমার মনের ভেতর কু ডেকে ওঠে। হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, ধূসররঙা চিল! কালো কুৎসিত চিল। আমি বিছানা ছেড়ে উঠি। উঠে একটু তাকাই নায়লার দিকে। তৃপ্ত এক রমণী। ঘুমুচ্ছে। আমি উঠে চলে আসি এ-পাশে। আবার জানালা। বাতাসের বেগ খুব বেশি। রাত হলেই বোধহয় বাতাস বাড়ে। আকাশকে প্রশান্তি দেয়। আমি তাকালাম আকাশের দিকে। নিষ্ফলা জমির মতো কর্কশ। ভয়াবহ শূন্য। করুণা প্রার্থনা করছে রাতের তারা। ধ্যানে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি কী দিতে পারবো তাদের? কিছু না। আমার এ-অনুভূতিতে তারাদের চোখ ঘোলাটে হয়ে ওঠে।

কাকুতি-মিনতির শেষ পর্যায়ে ভিখিরির চোখ যেমন ঘোলাটে হয়, কিছুই না পেয়ে। বেত ফলের মতো ঘোলাটে? কী জানি! এসব তো জীবনানন্দ বলতে পারবে। তারাদের জাগিয়ে দিয়ে আকাশ লুকিয়ে আছে এখন। ইভকে খুঁজছে আকাশ। বাতাস তাড়া করছে আকাশকে। চিলের ডানায় ভর দিয়ে বাতাস ধেয়ে চলে। 

আমি আবার তাকাই আকাশের দিকে। আসলেই নেই। আকাশের চিহ্ন নেই। অসহায় তারারা জেগে আছে। আমি জানালা ছেড়ে ভেতরের ঘরে ঢুকলাম। নায়লার ওপাশে শুয়ে পড়লাম। ঘুম নেই। আমার বিস্ময় লাগে। এতো বয়সেও নায়লার শরীর ভাঙেনি। অটুট বাঁধন। দেখে মনে হয় খুব বেশি অভিজ্ঞ নন তোমার গৃহস্বামী। কার কবিতা মনে নেই। লাইন ঠিক বলেছি Ñ তেমন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু অর্থ ঠিক এমনই। নায়লা বাংলা কবিতা পড়ে না। ও রবীন্দ্রনাথকে বলে ট্যাগোর। কিন্তু তাঁর কবিতা ও পড়েনি। কবিতা পড়ার অভ্যাস থাকলে ওকে জিজ্ঞেস করা যেত। এক্ষুনি হয়তো করাও যেতো  না। বাংলা ভাষাই ওর খুব  একটা পছন্দ নয়। তবু আমার সঙ্গে ওর যোগাযোগ হলো কেন? যোগাযোগ এবং বিয়ে। দুই বিপরীত মেরু কখনো কখনো জোড়া লেগে যায়। আমাদেরও তাই। দেশি শিল্পী নয়, বিদেশি শিল্পীদের আঁকাই ওর পছন্দ। তাদের ওপর পড়াশোনাও ওর আছে। কিন্তু এসব বিষয়ে বাংলা কোনো বই ওর পড়া নেই। ওর ধারণা, বাংলা ভাষায় কিছুই লেখা হয়নি। বাংলা খুবই অপয়া একটি ভাষা। অচ্ছুতও বলা যেতে পারে। বাংলা ব্যবহার না করে পারলে, ও করে না। এ-ভাষায় হেঁয়ালি খুব বেশি। সিরিয়াস ভাষা নয়। এখানকার মানুষেরাও তাই সিরিয়াস নয়।

ইভ জেগে ওঠো। প্রকৃতি প্রোথিত তোমার মধ্যে। জাগিয়ে তোলা। আমি ভিখিরি এখন। করুণাপ্রার্থী। তোমার দান চায় পৃথিবী। ইভ, ওঠো। হাত বাড়িয়ে দাও। কিন্তু আমারই হাত চলে যায় ইভের দিকে। তার সযত্নে রক্ষিত স্তনযুগলের দিকে। ধীরে, ধীরে। বোঁটার স্পর্শ পায়। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে যায়। আমার মধ্যে এবং হয়তো নায়লার মধ্যেও। বলে ওঠে, ‘একেবারে নোংরামি করবে না। ভারি অসভ্যতা!’

কিন্তু আমি মরিয়া। আমার ক্যানভাসে রং নেই। রং চাই। তারার আকাশ শূন্য করে দিয়ে ঘোলা চোখে তাকিয়ে আছে। আকাশ নেই। চিল নেই।

সাগর-রং নীল নেই। আমার দরকার। সব দরকার। আমি ঝাঁপিয়েই পড়লাম অনেকটা। ইভ, তোমার দান আমার চাই-ই চাই।

নায়লা উঠে বসলো। বললো, ‘ব্যাপার কী? এমন শুরু করলে কেন? একেবারে বাড়াবাড়ি করবে না। পাগল কোথাকার!’

ডানা ঝাপটে যায় চিল। আকাশের নীল গলে গলে পড়ে। কালো কুৎসিত রং ধরে। তাকানো যায় না এমন রং। তারারা তাকাতে পারে না। অন্ধ। আমি বিড়বিড় করে কী যেন বলছিলাম। হয়তো জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়াতে যাচ্ছিলাম। ইভের কাছে আশ্রয় দরকার আমার। নায়লা ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলো। ও চলে গেল ওপাশের ঘরে। শব্দ করে রুম বন্ধ করলো। আমার ঘোর কাটেনি। ইভ, আকাশ আর চিল উড়ছে। আকাশের রং কুৎসিত কালো।

তিতির পাখি জল খোঁজে। মাটি শুকিয়ে চৌচির। সে ঠোঁট ফুটিয়ে দেয় মাটির ভেতর। শুকনো খড়খড়ে। আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ ধরে রেখেছে জল। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে। তিতির পাখির বুক ফাটে তৃষ্ণায়। তার জল চাই। জলের ধারায় তিতির পাখির প্রশান্তি আসে। আকাশের কাছে কৃতজ্ঞ। তিতির পাখির দিকে তাকিয়ে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। সে জল পায় না। দিনের পর দিন। ইভের বংশ টিকবে কেমন করে? আদমের হাতে রং নেই। বিচ্ছিরি সবকিছু। আকাশের নীল রং কেমন করে ঢুকবে ঘরের ভেতর? চুঁইয়ে চুঁইয়ে সে নীল আবদ্ধ করে নেবে আদমের হৃদয়। কিন্তু আদম তৃষ্ণার্ত। ইভের ভাবনায় বিভোর সে। রংতুলি পড়ে থাকে। শুকনো খড়খড়ে মাঠের মতো সব। তিতির পাখি ডেকে যায় আমার মনের মধ্যে। মাথা কুটে মরে। কার জন্য নায়লা ধরে রাখে শরীর, তার বুক? ওর কথা, বুকে হাত দিলে ভেঙে যাবে তা। ওর আকর্ষণ হারিয়ে যাবে। সংগমও সীমাবদ্ধ তাই। একই কারণ। আমি ঘৃণা করি তোমার আকর্ষণে। তোমার যাবতীয় আকর্ষণ আমার জন্য। আর কারো জন্য হতে পারে না। ইভ কখনোই আদমের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারে না। ইভকে আমার চাই। যে ইভে আদমের অধিকার নেই, তাকে ঘৃণা করি আমি। ঘৃণার কুৎসিত অচ্ছুত রং মেখে দেবো তার সারা অঙ্গে। ভেতরে নায়লা ঘুমুচ্ছে। ইভ। দরজায় টোকা পড়লো। কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি বের হয়ে পড়লাম। ইভ-শূন্য ঘর হা হয়ে আছে সাগর-নীল জলের অপেক্ষায়।

থাকুক। অপব্যবহারে চৌচির হোক সব। তিতির ডাকুক।

ঘরের বাইরে পা দিতেই মনে পড়লো সোমার কথা। অমিয় সেদিন বলেছিল, ‘একটু শ্যাম্পেইন আর একজন নারী’ পাশে থাকলে আর কিছুরই দরকার নেই তার। সারারাত এঁকে যেতে পারে ছবি। সে ছবি, ছবি নয়; কবিতার মতোই হয় তার রং। নানান রং তার। কী মনে করে সোমার দরজায় টোকা দিলাম। একবার, দুবার। খুট করে শব্দ হলো। সোমা একটু বিস্মিত। বললাম, ‘কিছু কথা ছিল।’

সোমা একটু টলতে টলতে বললো, ‘আজ নয়। বাসায় গেস্ট।’

আমি অপেক্ষা করলাম না। নামতে লাগলাম সিঁড়ি বেয়ে। ইভের পথে হাঁটছি আমি। আকাশরঙা সাগরের অভিশপ্ত তিতির। ব্রহ্মচারী চিল।