পারাপার : একই চেহারার ভেতর শিল্পী ও শকুন

শিল্পী অভিধা সহজেই গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে। কিন্তু শিল্পীর আড়ালে যে পশু লুকিয়ে থাকে তা সমাজের অনেকেই টের পায় না। অনেক মানুষরূপী শকুন শিল্পী পরিচয়ের আড়ালে ঘুরে বেড়ায়। শিল্পের ঝলমলে আলোর পেছনে যে কুৎসিৎ বাস্তবতা তার ইঙ্গিতধর্মী বিষয়বস্তু নিয়ে দেশ নাটক সম্প্রতি প্রযোজনা করেছে পারাপার নাটক। গত ১০ নভেম্বর শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল মঞ্চে নাটকটির উদ্বোধনী শো অনুষ্ঠিত হয়। নাটকটি রচনার করেছেন মাসুম রেজা এবং নির্দেশনা দিয়েছেন ফাহিম মালেক ইভান। এটি দেশ নাটকের ৩৪তম প্রযোজনা।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নাট্যচর্চায় এই বিষয়টি একটু ব্যতিক্রম। এই নাটক নানা প্রশ্ন উত্থাপন করে। শিল্পের আড়ালে কী সত্যি নারী ব্যবসার মতো জঘন্য প্রবণতা বিদ্যমান? কীভাবে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার মুখোশ পরে থাকে শকুনরা? ব্যবসায়ীই কী শিল্পী সাজে? অথবা, একজন শিল্পীর জীবিকা অর্জনের উপায় কী? নাটকের শেষে নাট্যকার প্রশ্ন তোলেন Ñ শিল্পী কি শিল্পকে ভালোবাসবে? নাকি ভালোবাসবে তাঁর প্রেমিকাকে কিংবা বাঁচার জন্য করবে নারী পাচারের ব্যবসা? দর্শকের জন্য প্রশ্নগুলি ছুড়ে দেয় নাটকটি।

বিষয়বস্তু ও সহজ-সরল নান্দনিক উপস্থাপনার কারণে উদ্বোধনের দিনই দর্শকদের মধ্যে আলোচনার ঝড় তোলে। দেশ নাটক বরাবরই তাদের নাট্য প্রযোজনায় সমাজ-মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছে। এই নাটকও তার ব্যতিক্রম নয়। উনিশশো সাতাশি সালের জুলাইয়ে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশ নাটক অসংখ্য জনপ্রিয় নাটক উপহার দিয়েছে। দেশ নাটকের নিত্যপুরাণ বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মহাভারতের বহুল প্রচলিত একটি কাহিনিকে নতুন এক দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরে যে-জনপ্রিয়তা পেয়েছে নাটকটি, বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে আর কারো ভাগ্যে তেমনটি জোটেনি। নিত্যপুরাণ বাংলা নাট্যেতিহাসের মাইলফলক। দেশ নাটকের অরক্ষিতা নাটকেও হাজার বছরের বঙ্গদেশের জ্ঞানতত্ত্বের যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে তা দুর্লভ। দলটি তাদের ৩৫ বছরের নাট্যচর্চায় ২৩টি নাট্য প্রযোজনার পাঁচ শতাধিক প্রদর্শনী করেছে দেশে-বিদেশে। দেশ নাটকের নাট্যচর্চায় মানুষের জীবন ও সমাজই প্রধান হয়ে ওঠে। তাদের আরো উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা হলো, বিরসা কাব্য, দর্পণে শরৎশশী, ঘর লোপাট, লোহা, জনমে জন্মান্তর, প্রাকৃত পুরাঙ্গনা ইত্যাদি।  

দেশ নাটকের ২৪তম প্রযোজনা পারাপার। সীমান্তে পাচারের ব্যঞ্জনায় নাটকের এই নামকরণ। জনপ্রিয় নাট্যকার মাসুম রেজার রচনায় নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন ফাহিম মালিক ইভান। নির্দেশক ইভান জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের একজন শিক্ষক। নাটকের আখ্যানভাগে দেখা যায়, ভাবোখালী গ্রামের জনগণ চিনু গায়েনের পালা দেখে মুগ্ধ হয়। চিনু গায়েন বংশ-পরম্পরায় শিল্পী বলে বিশেষ সমাদর পায়। কিন্তু চিনু গায়েন শিল্পী পরিচয়ের আড়ালে যে একজন ঘৃণ্য নারী ব্যবসায়ী তা গ্রামের কেউ জানে না। চিনু গায়েন ভালোবাসে গ্রামের সরল মেয়ে মাঞ্জেলাকে। মাঞ্জেলাও চিনু গায়েনের সুর-কণ্ঠ ও শিল্পের অনুরাগে ভালোবাসে তাকে। কিন্তু গায়েনের কাছে মাঞ্জেলা কখনো কখনো অরূপ প্রেমের সুরের মতোই ধ্বনিত হয়। মাঞ্জেলা জীবনের যে পথে চিনু গায়েনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে সে পথে যেন তাকে পায় না। চিনু গায়েন শিল্পের আড়ালে নারী পাচারের ব্যবসা করে। বিয়ের নামে সে সীমান্তের ওপারে নারী পাচার করে। একসময় চিনু গায়েন জোসনা নামে এক সরলমতী নারীকে কলকাতায় উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে বিয়ে করতে চায়। গায়েনের কণ্ঠ ও সহজাত আকর্ষণে জোসনা আকৃষ্ট হয়। কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতায় আশ্চর্য জীবনের সন্ধানে চোরাই পথে যেতে গিয়ে অনাকাক্সিক্ষতভাবে বেনাপোলে আটকা পড়ে। নারী পাচার চক্রের রশিদ কোম্পানির হোটেলে ওঠে সে। সেখানে চিনু গায়েন তার পুরনো প্রেমিকা মাঞ্জেলাকে দেখে আত্মদহনে ফেটে পড়ে। চুড়িবুড়ি নামে এক নারী মাঞ্জেলাকে পাচারের উদ্দেশ্যে সেখানে নিয়ে এসেছে। সে কী পারে মাঞ্জেলাকে বাঁচাতে? কিংবা মাঞ্জেলার মতো নিষ্পাপ জোসনাকে অর্থের লোভে বিক্রি করতে? চিনু গায়েন তখন দাঁড়ায় জীবনসত্যের মুখোমুখি।

নাটকটি প্রসেনিয়াম মঞ্চে ঐতিহ্যবাহী উপস্থাপনারীতিতে বাস্তববাদী ধারার সঙ্গে সাজেস্টিকতার মিশ্রণে উপস্থাপিত। এ নাটকে নৃত্য-গীত-সংলাপ-অভিনয়ে গল্পের গাঁথুনির গীতল ঢঙে নাটকীয় দ্বন্দ্বটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। নাটকটি শুরু হয় পালাগান আয়োজনের মধ্য দিয়ে। গ্রামীণ সংস্কৃতির নানা হাসি-ঠাট্টা-কৌতুকের ভেতর লাল রঙের পাঞ্জাবি গায়ে উজ্জ্বল আলোয় চিনু গায়েনের প্রবেশ। চিনু গায়েন চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাঈন হাসান। সুদর্শন যুবক, স্মিতহাস্য ও গম্ভীর কণ্ঠস্বর। মঞ্চে তখনো যেন হ্যাজাক জ্বালানোর ছোটাছুটি। ধীরে ধীরে নৃত্য-গীতের মধ্য দিয়ে পালার বন্দনা শুরু হয়। পালা চলতে থাকলে কে যেন চিনুর গায়ে প্লাস্টিকের সাপ ছুড়ে দেয়। ভয় পেয়ে যায় চিনু গায়েন। নির্দেশক গ্রামীণ জীবনের হাসি-ঠাট্টা কিংবা বিনোদনের সারল্য নির্দেশ করেছেন এর মধ্য দিয়ে। পালাকার আধুনিক Ñ আরবি, হিন্দি, ফরাসিও জানে।

‘আমি এই বাংলারই মানুষ … গেলো সাত বছর হলো কলকাতায় বসবাস করি … কিছুদিন আগে কলকাতা এসপ্লানেডে বন্ধু ডালিমের সাথে পরিচয় … তারই নিমন্ত্রণে এখানে আসা এবং তারই অনুরোধে একটি পালার কিয়দংশ উপস্থাপন করবো … আজকের পালা এক পরমা সুন্দরী কন্যার কাহিনি। পালার নাম কমলারাণীর সাগরদীঘি … এই পালায় আপনাদের শোনাবো কমলা সুন্দরী আর সুসং দুর্গাপুরের রাজা ধর্মরাজের কথা। মায়ের মনোবাসনা পূরণ করবে বলে ধর্মরাজ একবার বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে তার উজিরকে ডেকে বলে, উজির, মায়ের মনের বাসনাকে অপূর্ণ রাখতে চাই না।’

সংলাপগুলি অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ। রং-আলোয় কালারফুল উপস্থাপন। পালা পরিবেশনা বা পালার বর্ণনার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা বা আড়ষ্টতা নেই। মনে হয়, এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন। পালাকার বিয়ের পাত্রীর সন্ধানে উজির ধর্মরাজ চরিত্রে অভিনয়ে ঘোড়ায় উঠে গান শুরু করেন Ñ ‘আমার পাগলা ঘোড়ারে তুই কোন মানুষ কই লইয়া যাও’ নৃত্য-গীতে মঞ্চ তখন আলোড়িত হয়ে ওঠে। মঞ্চদৃশ্যে অভিনেতারা তখন গ্রামের দর্শক হিসেবে বসা।

দৃশ্য পরিবর্তনে সংগীতের নিনাদ বাজতে থাকে। দেখা যায় মাঞ্জেলাকে। মাঞ্জেলা চরিত্রে সোমা ফেরদৌস। সে ভাবোখালী গ্রামের এক কিশোরী। চিনু গায়েন মাঞ্জেলার প্রেমে পাগল। পালায় কমলার কষ্ট দেখে মাঞ্জেলা অনেক কেঁদেছিল। 

চিনু : আপনে খুব সুন্দর করে কানতে পারেন … আপনার চোখের জল বিন্দু বিন্দু ফোঁটা হয়ে ঝুলে থাকে আপনার কপোলের ওপর … আপনার কপোলের সেই অশ্রুবিন্দুতে হ্যাজাক লণ্ঠনের আলো পড়ে কি যে চমৎকার চিকচিক করে, মনে হচ্ছিল জলবিন্দু না, মূল্যবান হীরা পাথরের দানা … একটা যদি তুলে নেওয়া যায় সারাজীবনের সঞ্চয় হয়ে যাবে তাতে …’মাঞ্জেলা সায় দেবে কী তাতে?

কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু তার বান্ধবী জোসনা চিনু গায়েনের হৃদয়ের অতলকে যেন বুঝতে পারে। অপরদিকে চুড়িবুড়ি নামে এক ফেরিওয়ালা মাঞ্জেলাকে দেখায় স্বপ্নের হাতছানি। কলকাতার উন্নত জীবনের কল্পনায় বিভোর করে তোলে মাঞ্জেলাকে। নির্দেশক তখন মাঞ্জেলার স্বপ্ন হিসেবে অভিনেতাদের কোরিওগ্রাাফিতে, বায়োস্কোপ দেখার প্রতীকে নৃত্য-গীত ও সার্কাসীয় ঢঙে কলকাতার জীবনের প্রতীকী রূপ তুলে ধরেন। আলো প্রক্ষেপণের নানা ক্যারিশমা, কোরিওগ্রাফির নৃত্য ও সংগীতের নিনাদে দর্শক যেন বিমোহিত হয়ে পড়েন। দৃশ্যে বস্তুগত কলকাতার চেয়ে রঙিন স্বাপ্নিক রূপ বড় হয়ে ওঠে। 

ড্যাডম মালিথার বাড়িতে আতিথ্য নিয়েছে চিনু গায়েন। ঘুড়ি কাটাকাটির আনন্দ। নির্দেশক কোনো বিষয়কে সার্বিক থেকে বিশেষে নিয়ে এসেছেন, কখনো বিশেষ থেকে সার্বিকে নিয়ে গেছেন। স্যাটায়ারে গ্রামীণ শিক্ষা, ছাগল বিক্রি, মিষ্টি খাওয়ানো ইত্যাদি প্রসঙ্গ হাস্যরসের সৃষ্টি করে। সংলাপে গ্রাম্য কিছু অশিষ্ট শব্দ ও বাক্যের ব্যবহার দেখা যায়। অভিনয়, নৃত্য, নাটাই, ঘুড়ি আর গানে গানে ফুটে ওঠে পালানির্ভর সংস্কৃতি। একসময়ের আসমান বয়াতি এখন বাবা আসমান। ছোট ছোট দৃশ্যের মধ্য দিয়ে পিরপ্রথা, নানা আচার, মুরগি দান প্রভৃতি অনুষঙ্গ বিধৃত হয়। শরবতের সঙ্গে জামাল গুঁড়ার মিশ্রণ মানে ডায়রিয়ার গাছন্ত ওষুধ খাওয়া নিয়ে নানা কৌতুকে মেতে ওঠে।

চিনু গায়েন : আমি আপনেরে গগনকাকা বলে ডাকতাম? আপনের নাম আসমান, আসমান মানে গগন, মনে নেই …

আসমান : সবুর করো … ভালো করে দেখতে দাও … এখনি বুকে আসার চেষ্টা করো না … না … আপনারা তারে চিনু গায়েন চিনু গায়েন বলছেন … চিনু কোনোদিন গায়েন ছিল না … গলাতে তার সুর ছিল; কিন্তু সে কোনোদিনও গানে মনোযোগ দেয়নি …

চিনু : আমি আসলে ভবখালির লোকদের কমলারানীর সাগরদীঘি পালাটা শুনিয়েছি … বাপজানের কাছে শিখেছিলাম … সিডাই শুনিয়েছি … তার থেকে সবাই চিনু গায়েন ডাকছে আমারে …

পরের দৃশ্যেই ভাবোখালী গ্রামে মানুষ বিয়ের আনন্দে নেচে ওঠে – ‘এই রাস্তা দি কারো পুত্র যায়/ ফুল বিয়াস্তি পুত্র যেন বিয়া কর্ইত যায়।’ সাজ-সজ্জা, গান ও নৃত্য। জোসনাকে বিয়ে করে চিনু গায়েন। রওনা হয় কলকাতার উদ্দেশে। রাস্তায় নদী পার হতে গিয়ে সুরেন মাঝি কী জানি ইঙ্গিত দেয়, জোসনা তা বোঝে না। কাশ্মিরে যুদ্ধের কারণে সীমান্তে পারাপার বন্ধ। হোটেল মালিক শিল্পভক্ত রশিদ কোম্পানি গায়েন চিনুকে খুব সম্মান করে। রশিদ কোম্পানি মদ-যাত্রায় মেতে থাকলেও সে অপ্রকৃতিস্থ নয়; ধূর্ত, প্রতারক ও নারী ব্যবসায়ী। ওপরের তলার রুম নেয় চিনু গায়েন। কিন্তু একই হোটেলে তার ভালোবাসার মাঞ্জেলা। কলকাতায় পাচারের জন্য চুড়িবুড়ি মিথ্যা প্রলোভনে মাঞ্জেলাকে নিয়ে এসেছে। পাচারে নারীর প্রতীকী শব্দ লাগেজ। মাঞ্জেলাকে দেখে চিনু গায়েন অনুতাপে ভেঙে পড়ে। চিনু গায়েন চায় না মাঞ্জেলা পতিতালয়ে বিক্রি হোক। কিন্তু চিনুও তো জোসনাকে পাচারের উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছে। একসময় চিনু গায়েন ও মাঞ্জেলা মুখোমুখি দাঁড়ায় –

চিনু : রাতের আন্ধারে তোমারে নিয়ে আমি পালাবো মাঞ্জেলা।

মাঞ্জেলা : চুড়িবুড়ির হাত ধরে রাতির আন্ধারে পালায়েই আমি এখানে এসেছি।

চিনু : তুমি ভুল জায়গায় এসে পড়েছো মাঞ্জেলা।

মাঞ্জেলা : না … বেনাপোল দিয়ে হরিদাসপুর।

তারপর বনগাঁ রেলস্টেশন সেখান থেকে ট্রেনে চড়ে পাঁচ স্টেশন আমার গন্তব্য … তারপর ফ্যাক্টরিতে চাকরি হবে আমার বিয়েও হবে সেখানে।

চিনু : সব মিথ্যে, সব ভুল … চুড়িবুড়ি তোমারে মিছে কথা বলেছে সব।

মাঞ্জেলা : চুড়িবুড়ি মিথ্যে বলতি পারে না সে আমারে মেয়ের মতো সেনেহ করে।

চিনু : চুড়িবুড়ি কই তবে? সে তো উধাও।

মাঞ্জেলা : তার সঙ্গে আমার বনগাঁও রেলস্টেশনে দেখা হবে … সে মতোই কথা হয়েছে।

চিনু : আর কোনোদিন তার সাথে তোমার দেখা হবে না, সে তোমারে বিশ হাজার টাকায় বেচে দিয়ে গিয়েছে কোম্পানির কাছে …

রশীদ ফ্যাক্টরির হোটেলে টিপু সুলতান যাত্রাপালার আড়ালে যে মানুষ কেনাবেচা, জীবনের খেলা চলে তার দৃশ্যরূপে অনবদ্য তখন মঞ্চ। একটি উচু সিঁড়ি ও কয়েকটা বাক্স দিয়ে সে হোটেল আবহ। কী করবে চিনু গায়েন? মাঞ্জেলা চাইলেও পালাতে পারে না। সেখানে রশীদ ফ্যাক্টরির চালাঘরের অন্ধকারে মাঞ্জেলার দেহ শুয়োরের দংশনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। কোরিওগ্রাফির চলন-ছন্দে সংবেদনশীলতায় এ নৃশংস দৃশ্য ফুটিয়ে তোলেন। নাটকে প্রতিটি মুহূর্ত, আবেগ ও দ্বন্দ্বে সংগীতের নিনাদ হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে। জোসনাও যেন ভেসে যায় ভাসা পানিতে। চিনু গায়েন দাঁড়ায় নির্মম সত্যের কাছাকাছি।

‘এ কোন জগৎ … বন্ধুত্ব … সম্পর্ক … ভালোবাসা … সবই টাকার পায়ে গড়াগড়ি খায় … একই চেহারার ভিতর শিল্পী ও শকুন দেখা যায় … মুক্তি চাই আমি মুক্তি চাই।’ চিনু গায়েনের লাশও ফেলানির লাশের মতো সীমান্তে ঝুলে থাকার সংবাদ পাওয়া যায়। আর কোর্টের দলিল হাতে খজিবুর মেয়ে জোসনাকে নিয়ে নৌকায় ফিরে আসার দৃশ্য দেখা যায়।

নাট্যকার মাসুম রেজা বলেন, ‘চিনু গায়েন তার জীবন বাস্তবতায় জীবিকার নিরিখে যে-জীবন যাপন করে সে-জীবন চিনুর বিপরীত আরেক চিনু। যে-চিনুকে চিনু নিজেও চেনে না; কিন্তু বয়ে বেড়ায়, ধারণ করে। শিল্পের আড়ালে সে তার অন্তরজাত শকুন লুকায়। শিল্প ভাঙিয়ে সে বাণিজ্য করে। সে বাণিজ্যের পণ্য নারী। বিবাহের আবরণে সীমান্তের এপার-ওপার। পারাপার নাটকে চিনুর লক্ষ্যে পরিণত হয় এক গ্রাম্য বালিকা জোসনা। … পারাপার নাটকে এই চতুর্ভুজ সংকট তৈরি করে আমি জীবনের কিছু মৌলিক প্রশ্নকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি, উত্তর দিইনি। পারাপারে বাস করা মানুষগুলোর যাপিত জীবন থেকেই সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে বলে আমার বিশ^াস।’

নাটকে চিনু গায়েন চরিত্রটি নাট্যলক্ষ্যকে বিকশিত করেছে। মাঈন হাসান অভিনয়ে যেন অনবদ্য চিনু গায়েন। কখনো কখনো মনে হয়েছে, নির্দেশক দেখাতে চেয়েছেন সেও বাস্তবতার ক্রীড়নক। জীবিকার প্রয়োজনে হয়তো তার এমন নীচুতা।  বাস্তববাদী প্রাণবন্ত ভাবপ্রকাশী অভিনয়। সত্যিকার পালাকারের মতোই তার নাচের স্টেপিং। সে প্রথমে ফন্দি আঁটে মাঞ্জেলাকে পাচারের। কিন্তু মাঞ্জেলার প্রতি তার ভালোবাসার দুর্বলতাই সমস্ত নাটকজুড়ে লক্ষ করা যায়। নানা কারণে মাঞ্জেলাকে কব্জা করতে ব্যর্থ হয়ে সে জোসনাকে ধরে। কিন্তু চিনু গায়েনের মধ্যে দ্বৈতসত্তা। সে নারী পাচারের ব্যবসা করলেও ভালোবাসার প্রতি তার রয়েছে শ্রদ্ধাবোধ। নাট্যকার বর্তমান সময়ে শিল্পী পরিচয়ের আড়ালে যে নারীকেন্দ্রিক জঘন্য বাণিজ্য বা শিল্পচর্চার আড়ালে নানা ইতর প্রবণতা বিদ্যমান তারই ইঙ্গিত করেছেন। নাট্যকার নাটকের শেষে শিল্পীরূপী শকুনকে কাঁটাতারের ওপর ঝুলিয়ে শিল্পকে কলুষতা থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন।

জোসনা চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইসমেত জেরিন বিনতে নিজাম Ñ দেখতে সুদর্শনা, লাজুক ও প্রেমময়ী। চিনু গায়েনের পৌরুষ – গায়েনের কারণে সে তার প্রতি দুর্বল। অভিনয়ে গ্রামের সহজ-সরল কিশোরীর স্বাতন্ত্রিক রূপ। সে প্রেমিকা তাই কলকাতার যাত্রাপথের কোনো কষ্টই স্বামী চিনু গায়েনকে বুঝতে দেয়নি। এমনকি হোটেলে অবস্থানকালে যখন জানতে পারে তাকে পাচারের উদ্দেশ্যে এখানে নিয়ে এসেছে, তখনো সে বিশ^াস করেনি। স্বামীর প্রতি অবিচল ভালোবাসা তার চরিত্রকে উজ্জ্বল করেছে। আর চুড়িবুড়ি নারী পাচারকারী এক ফেরিওয়ালা। অভিনয়ে কাজী লায়লা বিলকিস। লেইস ফিতা ও নারীপণ্য বিক্রির নামে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মেয়েদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে লোভ দেখিয়ে কলকাতায় নিয়ে পতিতালয়ে বিক্রি করে। নাটকে যেন চুড়িবুড়ি, চিনু গায়েন কিংবা রশীদ কোম্পানি একই সূত্রে গাঁথা। শুধু তাদের অবস্থান ভিন্ন।

মাঞ্জেলা এ-নাটকের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র। এই চরিত্রে সোমা ফেরদৌস সহজ-সরল স্বপ্নচারী কিশোরী। সে শাড়ি পরে সারাক্ষণই মুখ ঢেকে রাখতে চায়। মাঞ্জেলা চিনু গায়েনের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করেছে। জীবনসংগ্রামের শেষ পর্যায়ে একটি চাকরি, বিয়ে আর একটু সুখী জীবনের জন্য সে ফেরিওয়ালা চুড়িবুড়ির কাছে সমর্পণ করে। সে অন্যায়, অসৎ ও প্রতারণার কাছে কখনো নতি স্বীকার করেনি। যখন জানতে পেরেছে চুড়িবুড়ি হোটেলে তাকে বিক্রি করে চলে গেছে, তখন সে জীবন রক্ষা করতে সর্বস্ব খুইয়ে মৃত্যুর পথে হেঁটেছে, তবু সে কখনো সমাজের নোংরামির কাছে আত্মসমর্পণ করেনি।

আসমান বাবা চরিত্রে অভিনয় করেছেন সজীব বিশ^াস। আসমান বাবা একসময় ছিলেন আসমান গায়েন। আজ সে পিরবাবা। কৌতুকপূর্ণভাবে গ্রামীণ পেশা ও জীবন-সংস্কৃতি পরিবর্তনের নানা রূপরেখা এ-চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হয়ে ওঠে।

রশীদ কোম্পানি যেন এখনকার শিল্পজগতের প্রডিওসার। রশীদ কোম্পানি চরিত্রে অভিনয় করেছেন কাজী রাজু। অত্যন্ত ভরালো কণ্ঠ। সুস্পষ্ট উচ্চরণ ও সুনিয়ন্ত্রিত বাচনভঙ্গি। অভিনয়ের  সাত্তিকতা বিশ্বাসের গভীরে প্রোথিত। নারী পাচারের মতো নানা জঘন্য কর্মকাণ্ডে সে বিনিয়োগ করে থাকে। শিল্প-সমঝদারের আড়ালে সে একজন লোভী, ভোগী ও নরপশু। নাটকটিতে অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন – আশরাফুল আশীষ, ইব্রাহীম হোসাইন, গোলাম মাহমুদ, আরিফ হক, অসীম কুমার নট্ট, কামার আহমেদ, লেতুনজেরা, তাওহীদা ইসলাম তানহা, নাজমুল আলম লিমন, মাসুদ রানা সবুজ, বাদশাহ আলমগীর কবির, সালাম শামীম, ব্রততি বিথু, মায়াবী, দিনা চৌধুরী, মো. নাঈম হাসান, শেখ নাইমুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসাইন, গোলাম রাসুল নাবিদ, মো. শুভ খান, শাহেদ নাজির হেডিস, লরেন্স উজ্জ্বল গমেজ, ফাহিম মালেক ইভান। 

নির্দেশক ফাহিম মালেক ইভান বলেন, ‘এক জীবনে নিজেকে নানা রঙে প্রকাশ করে মানুষ। একের মধ্যে রূপ আর অরূপের সন্ধান মেলে। জীবনের হাজার বাঁকে অসংখ্য ঘটনার প্রেক্ষিতে ঘটে এই রূপান্তর। সবকিছু রঙিন করে দেখা ভাবোখালী গ্রামের সরল মানুষগুলোও এই রূপান্তরের বাইরে নয়। জীবন ও জীবিকার তাগিদে তারাও খোলস পাল্টায়। সবকিছু নিয়েই ভাবোখালী নানা বর্ণে বর্ণিত রঙিন এক গ্রাম। নাট্যকার মাসুম রেজার লেখনীতে এই চিত্র যেন আরো রঙিন হয়ে উঠেছে। পারাপারে লোকসমাজের কথাই যেন ব্যক্ত হয়েছে, তাই লোক ঐতিহ্যের নানাদিক তুলে ধরা হয়েছে। ভাবোখালীর নানা রং দৃশ্যকাব্য হয়ে পাদপ্রদীপের নিচে উদ্ভাসিত হবে – এই প্রত্যাশায় নাট্যকার মাসুম রেজা তাঁর এই সৃষ্টি পরম মমতায় যেন আমার হাতে অর্পণ করেছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। দেশ নাটকের সঙ্গে প্রায় দুই যুগ ধরে সম্পৃক্ত থাকলেও নির্দেশনার পথে এটি প্রথম যাত্রা। আমার প্রতি আস্থা রাখার জন্য দেশ নাটকের প্রতি কৃতজ্ঞতা। … পারাপার যেন সুরের সাগরে ভেসে যাওয়া এক তরী। এই তরীর হাল ধরার কাজটি সহজ হয়েছে দেশ নাটকের সংগীতের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিভাধর গুণী শিল্পীদের জন্য।’ 

ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যে আলাদা কোনো উপকরণ দ্বারা দৃশ্য নির্মাণের প্রচলন নেই। এ-নাটকেও নিরাভরণভাবে নির্দেশক মঞ্চ সাজিয়েছেন। ছোট্ট ছোট্ট সাজেস্টিক উপকরণে বিভিন্ন স্থান-কাল ও পরিবেশকে তুলে ধরতে সচেষ্ট ছিলেন। নির্দেশক দর্শকের মনোযোগকে মঞ্চে কেন্দ্রীভূত করে রাখতে নানা ক্যারিশমা প্রয়োগ করেছেন। উপস্থাপনে জটিলতার বিপরীতে অত্যন্ত সরলীকরণ হলেও একধরনের ভালো লাগাই তৈরি করে। মঞ্চ-উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে গোল কাঠের বাক্স, চাকতি, পাটাতন, টুল, চেয়ার, সিঁড়ি ইত্যাদি। প্রপস হিসেবে হ্যাজাক, ঘুড়ি-লাটাই, মুরগি, যাত্রার তলোয়ার, ট্রাংক, গামছা, টাকার বান্ডিল ইত্যাদি। নদীর দৃশ্য নির্মাণে পেছনে কালো সায়াক্লোমার কিছু অংশ সাদা। যেখানে আলোর প্রক্ষেপণ, মিউজিক ও চরিত্রাভিনয়ের নৈপুণ্য অনবদ্য নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করে। অন্যান্য প্রচলিত নদীর দৃশ্যের চেয়ে একটু ভিন্ন রকমের আবেগ কাজ করে। পুকুরের ঘাটে জোসনার কলসি ভরে আনার সময়ের দৃশ্যটি মৈমনসিং গীতিকার মহুয়া পালার নদীর ঘাটের দৃশ্যকেই মনে করিয়ে দেয়। কাহিনির সঙ্গে কিছুক্ষণ পরপরই নৃত্য-গীতে অনবদ্য হয়ে ওঠে মঞ্চ। নাটকের শেষ কয়েকটি দৃশ্যের নির্মিত সেট নান্দনিক। এক্সপেরিমেন্টাল মঞ্চের ওপরের রেলিং থেকে একটি বৃহদাকার সিঁড়ি লাগিয়ে হোটেলের দৃশ্য তৈরি করা হয়েছে। এই ছোট সিম্বল যেমন পুরো রূপকে প্রতিভাত করে, তেমনি ভালোলাগাও তৈরি করে। নির্দেশক নাট্যদৃশ্য নির্মাণে চরিত্রের বহুমুখী চলনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এমনকি চুড়িবুড়ি ফেরিওয়ালাকে দর্শকের প্রায় চারপাশ দিয়ে ঘুরিয়ে নৃত্য করতে করতে মঞ্চে এনেছেন। এর মধ্য দিয়ে ফেরিওয়ালার পরিভ্রমণকে যেমন স্পষ্ট করে, তেমনি দর্শকও নাটকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠেন। ভিন্নমাত্রায় দর্শককে উদ্বোধিত করে।

মঞ্চ পরিকল্পনায় ছিলেন কাজী কোয়েল। পোশাকে সাজিয়া আফরিন গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে পোশাকের ধরন নির্ধারণ করলেও রংকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। চুড়িবুড়ি কেমন উদ্ভট। মাঞ্জেলার সাধারণ গ্রামীণ শাড়ি পরিধান সরল গ্রাম্যবালিকার চরিত্রকেই প্রতিভাত করে। অপরদিকে গায়েনের গায়ে অধিকাংশ সময় লাল-ম্যাজেন্টা রঙের পোশাক। সর্বত্র যেন রঙের ছড়াছড়ি। পাজামাটা ছিল পালাকারীয় ঢঙে। গলায় বড় লম্বা উত্তরীয়। শেষের দৃশ্যে চিনু গায়েনের গায়ে নীল পাঞ্জাবি। আর জোসনা গ্রামীণ সরল বালিকাদের মতো ফুলওয়ালা ব্লাউজে লাল রঙের শাড়ি পরিধান করেছে। গ্রামীণ নারী চরিত্রদের শাড়ি এবং পুরুষদের শার্ট, লুঙ্গি, গামছা এবং কখনো প্যান্ট লক্ষ করা গেছে। পোশাকের রংগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্য তৈরি করা হয়েছে। নির্দেশক গ্রামকে দৃশ্যে এনেছেন কিন্তু সুনির্দিষ্ট সময়কালকে বাঁধেননি। আলোক পরিকল্পনায় ফারুক হোসেন টিটু অত্যন্ত মুনশিয়ানায় নাট্যমুহূর্তগুলি নির্মাণ করেছেন। দৃশ্যের আবেগের ওপর আলোয় নানা অনুভূতির ইমেজ তৈরি করেছেন। পালার দৃশ্যে আলোর ঔজ্জ্বল্য, বায়োস্কোপের দৃশ্যে আলোর পরিভ্রমণ, নদীর দৃশ্যে আলোয় নাট্যমুহূর্ত সৃষ্টি সত্যি দর্শককে ভাবাবেগে আপ্লুত করেছে। দৃশ্যকে কেন্দ্রীভূত করা ছাড়াও আলোর গতির উত্থান-পতন দর্শকদের নাড়া দিয়েছে।

শুভাশিস তন্ময়ের মেকআপ চরিত্রবৈশিষ্ট্য প্রকাশে ছিল যথেষ্ট সহায়ক। বিশেষত চুড়িবুড়ি চরিত্রের মুখাবয়বে খাঁজকাটা রেখাগুলি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে সুনির্দিষ্ট করেছে। আবার চিনু গায়েনের স্বচ্ছ শুভ্র রূপাবয়ব তাকে প্রচলিত নায়কোচিত রূপেই প্রতিভাত করেছে। একইভাবে আসমান বাবা চরিত্রের গেটআপেও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনবদ্য রূপে ফুটে উঠেছে। এত ভোল্টেজের আলোর মধ্যেও মেকআপের আস্তরণগুলি কখনো ফ্যাকাশে কিংবা বিবর্ণ মনে হয়নি। বরং বয়স, আবেগ ও বৈশিষ্ট্য সৃষ্টিতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। আর সংগীত তো অনবদ্য। এ নাটকের ভালোলাগা সৃষ্টির পেছনে সংগীতের অবদান সবচেয়ে বেশি। নাটকের শুরু থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত সংগীত দর্শক-হৃদয়কে নানাভাবে আবিষ্ট করেছে। সংগীতে ছিলেন অসীম কুমার নট্ট, লরেন্স উজ্জ্বল গমেজ, ইমামুর রশিদ, ফাহিম মালেক ইভান। কোরিওগ্রাফিতে ছিলেন ফেরদৌস হাসান, মৃন্ময়ী  ও পূজা।