ধ্বংসপ্রাপ্ত পত্রসাহিত্য ও টিকে থাকা তিন লেখকের চিঠি

গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটকের মতো চিঠিপত্রও যে সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা বা ধরন হতে পারে, সেটাও বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। ব্যক্তিবিশেষকে উদ্দেশ করে লেখা তাঁর ছিন্নপত্রাবলী ও রাশিয়ার চিঠি নিছক খবর কিংবা তথ্যের বাহন নয়, সাহিত্যগুণে গুণান্বিত হয়ে তা আজো পাঠকহৃদয় ও মননে সাড়া জাগায়। পত্রে পত্রলেখকের ব্যক্তিজীবনের খুঁটিনাটি নানারকম তথ্য যেমন তাঁর বাস্তব জীবনকে জানার সুযোগ দেয়, অন্যদিকে লেখকের ভাব ও ভাষা, জীবনবোধ ও সাহিত্যবোধের মিলনে, কিংবা বলা যায় তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ত বিচ্ছুরণে যে-আনন্দরস সৃষ্টি হয়, তা পাঠকের জন্য বাড়তি প্রাপ্তি হয়ে ওঠে।

মনে পড়ে, তরুণ বয়সেই ‘রঙ্গপুর সাহিত্য সংসদ’ পাঠাগারে সংরক্ষিত পুুরনো প্রবাসী, ভারতবর্ষ, সাপ্তাহিক দেশ কিংবা অন্য কোনো সাহিত্য ম্যাগাজিনে বিখ্যাত লেখকের চিঠিপত্র ছাপা হয়েছে দেখলে তা সবার আগে পড়তাম। মনের ভাব এমন হতো যে, নিজেই যেন দারুণ চিঠি পেলাম একটা। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরও দেশ পত্রিকায় বিভিন্নজনকে লেখা তাঁর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র অনেক বছর ধরে সংকলিত ও প্রকাশিত হতে দেখেছি এবং সবার আগে তা সাগ্রহে পড়েছিও। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও বিখ্যাত লেখকদের ব্যক্তিগত চিঠিপত্র গবেষকদের কাজে যেমন সহায়ক-সূত্র হয়েছে, তেমনি সেগুলি লেখকের সামগ্রিক রচনাসংগ্রহেরও অংশ হয়েছে।

পত্রসাহিত্য সাহিত্যের অন্য শাখার মতো বিবেচিত হলেও কোনো লেখকই সাধারণত পত্র-পত্রিকায় নিজের লেখা চিঠি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেন না। এর বড় কারণ চিঠিখানা লেখার পর তা প্রাপকের সম্পদ হয়ে ওঠে। হাতে-কলমে লেখার যুগে সম্ভবত নিজের লেখা চিঠির কপি রাখার প্রয়োজন বোধ করতেন না কোনো পত্রলেখক। এ-কারণে লেখকের জীবদ্দশায় তাঁর রচিত চিঠিপত্র প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ হয় কম। তবে বিখ্যাত ব্যক্তির চিঠিপত্রের প্রাপকরা তা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করে নিজেরাও কিছুটা বিখ্যাত হয়েছেন, এমন নজির বিরল নয়।

বিখ্যাত লেখকদের সঙ্গে চিঠিপত্রের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কটি নিবিড় করতে চান সাধারণত সেই লেখকের অনুরাগী ভক্ত-পাঠক। চিঠি লিখতে ভক্তদের মধ্যে অগ্রগামী ভূমিকায় থাকতেন প্রধানত সাহিত্য-যশঃপ্রার্থী নবীন লেখক অথবা কোনো সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। আমার জানা উদাহরণ হিসেবে এখানে কবি কায়সুল হকের উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। পাকিস্তান আমলে রংপুরে থেকে তিনি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন, কবিতাও লিখতেন। সেই সময়ে আজকের প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সুফল ই-যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকের কল্পনাতেও ছিল অনুপস্থিত। টেলিফোন-টেলিগ্রাম যোগাযোগ ছিল নাগালের বাইরে। ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য হাতে-কলমে কাগজে লেখা চিঠি এবং সে-চিঠি পাঠাতে ডাক বিভাগই ছিল প্রধান ভরসা। কবি-সম্পাদক কায়সুল হক কলকাতার ও ঢাকারও অনেক বিখ্যাত কবি-লেখককে চিঠি লিখতেন, জবাবও পেতেন। প্রাপ্ত চিঠিগুলি বেশ যত্নসহকারে সংরক্ষণ করেছিলেন। কলকাতার অন্নদাশঙ্কর রায়, বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, আবু সয়ীদ আইয়ুব, ঢাকার কবি শামসুর রাহমানসহ অনেক বিখ্যাত কবি-লেখকের সঙ্গে পত্র-যোগাযোগ ছিল তাঁর। জীবদ্দশায় এসব চিঠিপত্র পত্রপত্রিকায় প্রকাশও করেছিলেন। তাঁকে লেখা শিবরাম চক্রবর্তীর একটি ছোট্ট চিঠি মনে পড়ে। পত্রিকার জন্য লেখা প্রার্থনার চিঠির জবাবে সম্মানী দাবি করে লিখেছিলেন Ñ লিখি বলে টিকি, টিকি বলে লিখি।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে একদা বিখ্যাত লেখদের রচিত চিঠিপত্র যেমন পত্রসাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে, তেমনি পত্রসাহিত্য প্রভাবিত করেছে সাহিত্যের অন্য শাখাকেও। চিঠির আদল বা ভঙ্গিতে রচিত হয়েছে বহু গল্প-কবিতা ও উপন্যাস। কিন্তু সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা হিসেবে গল্প, কবিতা, নাটক ইত্যাদি এখনো টিকে থাকলেও তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবোত্তর যুগে পত্রসাহিত্য রচিত ও তার টিকে থাকাটা আজ বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। কারণ দুর্গম ও অসীম দূরত্ব ঘুচিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা আজকাল এতই সুলভ ও গতিময় হয়েছে যে, এখন আর একান্তে বসে কোনো প্রিয়জনকে ভেবে ভেবে হাতে-কলমে পত্র লেখার প্রয়োজন বোধ করেন না কেউ। হাতে-কলমে লিখলেও তা খামে মুড়ে ডাক বিভাগের বাক্সে ছোড়ার কষ্টটুকু কেউ করতে চাইবেন না এ-যুগে? শহরের নানা স্থানে বসানো ডাক বিভাগের গোলাকার লাল বাক্সগুলি এখনো টিকে থাকলেও সেগুলি আদৌ কখনো খোলা হয় কি না, তা নিয়েও সন্দেহ জাগে। পত্রসাহিত্য যেহেতু দুটি ব্যক্তিহৃদয়ের পরস্পরের কাছে একান্ত গোপন উন্মোচন, বদ্ধ খামের ভেতরে নগ্নমনের সেই গোপনীয়তাকে মর্যাদা দিত পুরনো ডাক বিভাগ ও ব্যক্তিবাহকরা। কিন্তু ইন্টারনেট-যুগে ব্যক্তির সেই গোপনীয়তা ধ্বংস হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ই-মেইল, এমনকি রাষ্ট্রীয় গোপন নথিপত্রও ফাঁস বা হ্যাকড হওয়ার ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ তুলেছেন অনেকে, তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব আসলে ধ্বংস করেছে ব্যক্তির একান্ত গোপনীয়তাটুকুও। ব্যক্তি-শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন, তেমনি তার মস্তিষ্কের ক্রিয়াকাণ্ড জানাটা এ-যুগের বিজ্ঞানীর জন্য কঠিন কর্ম নয়।

দুজন ব্যক্তির একান্ত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পত্রসাহিত্যের অতীত ও ধারাবাহিকতা ধ্বংসের জন্য তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব ও ইন্টারনেটে ই-যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে দায়ী সন্দেহ নেই। এ-যুগের বড় লেখকদের ব্যক্তিগত ই-যোগাযোগে ব্যবহৃত টেক্সট কিংবা এআই নির্ধারিত ভাষা-ভঙ্গি-ইঙ্গিত ইত্যাদি ভবিষ্যতে তাঁদের রচিত সাহিত্যের মতো পত্রসাহিত্যের মর্যাদা পাবে কি না জানি না। তবে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবপূর্ব অনেক মহান লেখকের রচিত কালজয়ী সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি তাঁদের রচিত এবং প্রাপ্ত চিঠিপত্রও সাহিত্যগুণে কিংবা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গ্রন্থাবদ্ধ হয়ে সর্বজনীন হয়েছে এবং টিকেও আছে এখনো।

পত্রসাহিত্য নিয়ে এটুকু গৌরচন্দ্রিকা করতে হলো, নিজের সামান্য লেখক-জীবনে পত্রসাহিত্যের বিপুল-বিশাল ভূমিকা খতিয়ে দেখার গরজে। আপন সাহিত্যপ্রতিভার প্রকাশ ও প্রমাণের জন্য পত্রসাহিত্যের ওপর নির্ভর করে কতশত যে চিঠি লিখেছি! সেসব পণ্ডশ্রম ও পাগলামির কথা স্মরণ করলে এখন অবাক হই, নিজেকে সত্যই পাগল মনে হয় কখনো-বা।

কৈশোরে লেখক হওয়ার সংকল্পে স্থির হলে যখন দিনেরাতে রঙিন স্বপ্ন দেখি, হৃদয় নানারকম ভাবাবেগে টইটুম্বর হয়, প্রকাশের জন্য বেশ কিছু মোটা বাঁধানো খাতা কিনেছিলাম। বড় মহাজন ও আড়তদারদের গদিতে যেমন মোটা খাতা থাকত, আমারও তেমনি ‘কবিতা’, ‘গল্প’, ‘উপন্যাস’, ‘গান’ ইত্যাদি শিরোনামে আলাদা সব খাতা। পত্র লেখার জন্য দামি কাগজের খাতাও কিনেছিলাম একটা। রবীন্দ্র, নজরুল, মাইকেল মধুসূদন প্রমুখ মহাপ্রতিভাধরের মতো যখন যে-লেখা আসত, লিখে খাতা ভরাতে থাকি। কিন্তু প্রকাশ করব কোথায়? হাইস্কুলে নাইন-টেনে পড়ার সময় ছাপার অক্ষরে প্রকাশের একটা সুযোগ এসেছিল। স্কুলে কিশোর নামে একটা ম্যাগাজিন বেরুবে বিমলেন্দু ভট্টাচার্য পণ্ডিত স্যারের সম্পাদনায়। ছাত্রদের কাছে লেখা আহ্বান করেছিলেন তিনি। নিজের নামটি দু-তিনভাবে লিখে দুটি কবিতা আর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্মৃতি নিয়ে একটা গদ্য লেখা তৈরি করে দ্বিধা-লজ্জা নিয়ে পণ্ডিত স্যারের হাতে দিয়েছিলাম। মাস তিনেক পর পত্রিকাটি বেরুলে দেখি, তিনি সব লেখা ছেপে দিয়ে আমাকে লেখক হওয়ার রাজপথে নামিয়ে দিয়েছিলেন যেন। উৎসাহে সব খাতায় লেখার পরিমাণ বাড়তে থাকে। কিন্তু প্রকাশের আর কোনো সুযোগ পাই না। কিছু কিছু ডাকযোগে ঢাকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সেসব পত্রিকার সম্পাদকগণ মফস্বলের কিশোর কবি-লেখককে পণ্ডিত স্যারের মতো উদারতা দেখাননি। এ অবস্থায় আপন প্রতিভা প্রকাশের জন্য চিঠি লেখাই হয়ে ওঠে বড় ভরসা।

পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ও শহরে থাকতাম একা। চিঠি লেখার খাতা টেনে নিলাম। মাকে লেখা চিঠিতেও নিজের স্বপ্ন ও সাহিত্যপ্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটত। মা যেহেতু নিয়মিত  কোরান শরিফ পড়া ছাড়াও গল্প-উপন্যাস ও পুঁথি পড়তেন, আমার দীর্ঘ চিঠি পেয়ে খুশি হতেন খুব। মা ছাড়াও ছোট ভাই সঞ্জুকে ছন্দে চিঠি লিখে নিজের কাব্যপ্রতিভা জাহির করতাম। ভাইটি স্কুল ম্যাগাজিনে আমার ছাপানো নাম ও কবিতা দেখেছিল। তার ওপর নিজেও আমার লেখা কবিতাপত্র পেয়ে খুশি হয়ে বলেছিল, ‘ভাই, তুইও মনে হয় নজরুলের মতো বড় কবি হবি।’ উৎসাহিত হয়ে ওই সময় ঝাঁকড়া বাবড়ি চুলও রেখেছিলাম কিছুদিন। পত্রপত্রিকাগুলি পাত্তা না দেওয়ায় রেডিওতে অনুরোধের আসরে প্রিয় শিল্পীর গান শোনার জন্য অনুরোধপত্র লিখেছি। তারপর একদিন অনুরোধের আসর শুনতে গিয়ে ঘোষকের মিষ্টিকণ্ঠে নিজের নাম-ঠিকানা উচ্চারিত হতে শুনে কী যে রোমাঞ্চ জেগেছিল। গানেও নিজের প্রতিভা প্রতিষ্ঠার জন্য খালি গলায় চর্চা ছাড়াও স্বরচিত ২৫টি গান রংপুর রেডিও সেন্টারে পাঠিয়েছিলাম। প্রাপ্তিসংবাদ পেয়েছিলাম। কিন্তু তারপর কোনো সুরকার কি গায়ক মেরে দিয়েছে, নাকি সেসব ডাস্টবিনে জায়গা পেয়েছে, ঠিক জানি না।

পত্রসাহিত্যের গতিপ্রকৃতি এ-পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু চিঠি লিখে আপন সাহিত্যপ্রতিভার বিস্তর অপচয় ও পণ্ডশ্রম ঘটেছে নবীন যৌবনে, লেখক হওয়ার জন্য ঢাকায় আসার পর। চিঠি লেখার জন্য উপযুক্ত বন্ধু তেমন ছিল না। কল্পনার জগতে যেসব বান্ধবী উদয় হতো, তাদের ঠিকানা নিজেও জানতাম না। এমন সময় একদিন আমার অফিসের সমবয়সী ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বন্ধু বলল, তাকে প্রেমপত্র লিখে দিতে হবে। পছন্দের একটি মেয়ে আছে তার, কিন্তু কোনোভাবে তার হৃদয় হরণ করতে পারছে না সে। এখন আমার প্রেমপত্র যদি অব্যর্থ ধন্বন্তরীর কাজ দেয়, পুরস্কার দেবে সে। আমি মেয়েটির সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য জেনে বন্ধুটির সঙ্গে নিজেরও অন্তরের প্রেম উজাড় করে ঢেলে লেখা শুরু করলাম। আমার লেখা পড়ে প্রেমিক বন্ধু মহাখুশি। নিজ হাতের লেখায় কপি করার পরও আমাকে দেখিয়েও নিত। দেখতাম কিছু বানান ভুল ছাড়া আমার একটি শব্দও এদিক-সেদিক করত না সে।

প্রথম চিঠিতেই কাবু হয়েছিল বন্ধুর প্রেমিকা। ইতিবাচক জবাবে আরো চিঠি পাওয়ার তৃষ্ণাও প্রকাশ করেছিল। বন্ধুটি খুশিতে আমাকে দেখাল তার প্রেমিকার চিঠি। প্রেমে পড়লে মানুষ বড় উদার হয়। বন্ধুটি খুশির ভাগ দিতে আমাকে চা-নাস্তা ঘুষ খাওয়াত, টাকা ধার দিত, মোটরসাইকেলে করে নিজবাড়িতে নিয়ে গিয়েও খাওয়াত অনেক সময়। যেহেতু তার প্রেমিকার প্রেমতৃষ্ণা নিবারণে প্রতি সপ্তাহেই আমাকে লিখে দিতে হবে, আমার উৎসাহ বাড়াতে তার বাড়ির এক ভাড়াটিয়া মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো, যাতে আমিও নিজের জন্য চিঠি লিখে তার হৃদয় হরণ করতে পারি। ডাকপিয়নের কাজ বন্ধু নিজেই করবে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল এক হাতে দুই প্রেমিকার হৃদয়হরণের সাধনা। দুটোতেই বেশ অগ্রগতি হচ্ছিল। বন্ধুটি তার প্রেমিকাকে আমাকে দেখায়নি কোনোদিন। তবে আমারটিকে দু-তিনবার দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল নিজবাড়িতে। একান্তে প্রেম করার জন্য তাকে বেশিক্ষণ কাছে পাবো না ভেবে, একটা দীর্ঘ চিঠি লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম তার জন্য। আমার সামনেই হাতে নিয়ে সে চিঠিখানা যেভাবে জামার ভেতরে বুকের ফাঁকে লুকিয়েছিল, স্বচক্ষে দেখা নিজ চিঠির সে গন্তব্যস্থান ও গতি ভোলার মতো নয়।

যা হোক শতাধিক প্রেমপত্র বাস্তবে কী ফল প্রসব করেছে, সংক্ষেপে সেটা বলি এবার। বছরখানেকের মধ্যে বন্ধুটির সঙ্গে তার প্রেমিকার শুভ-বিবাহ সম্পন্ন হয়। এ-বিয়েতে আমার প্রেমপত্র, ঢাকায় বন্ধুটির পৈতৃক বাড়ি, ছোট চাকরি হলেও মোটরসাইকেল হাঁকানো সচ্ছল অবস্থা Ñ কোনটা কি পরিমাণে কী ভূমিকা রেখেছে বলতে পারব না। তবে বাসররাতেই নাকি তার স্ত্রী বন্ধুটিকে কবি হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছিল। অন্যদিকে আমার প্রেমিকার পরিবার ঢাকা থেকে বদলি হয়ে যাওয়ার পর পত্রযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন পর অন্যত্র তার বিয়ে হওয়ার খবর শুনেছিলাম বন্ধুটির কাছে। ফলে মেয়েটির কাছে পাওয়া ছবি ও চিঠিগুলি রাগে-অভিমানে আগুনে পুড়ে ভস্ম করে দিয়েছি। কিন্তু ভেতরে যার এত প্রেম ও প্রেমপত্র লেখার মতো বিপুল সাহিত্যপ্রতিভা, একটি প্রেমিকা ও কিছু প্রেমপত্র আগুনে ভস্ম হলেই বা কী এমন ক্ষতি!

এরপর যাকে-তাকে নয়, বিয়ের পর যে আমার জীবনসাথি হয়ে ঘরে আসবে, নিজের মনের মতো করে গড়ে তোলার জন্য তাকে উদ্দেশ করে চিঠি লিখতে শুরু করেছিলাম। আমার সাহিত্যপ্রতিভা বা প্রেমপত্রের টানে সে আমার ঘরে আসেনি বটে, কিন্তু ঘরে আসার পর আগাম লেখা চিঠিগুলি একা একা একাধিকবার পড়েছে। যেহেতু বিয়ের পূর্বে আমাদের পারস্পরিক জানাশোনা ছিল না, চিঠিগুলি আমাকে বুঝতে তাকে খুব সাহায্য করেছে এবং বেশ যত্নসহকারে রেখেও দিয়েছিল। পরে তার বাপের বাড়ি কি শ^শুরবাড়িতে যাওয়ার কারণে আমাদের মধ্যে যখন সাময়িক বিচ্ছেদ-বিরহের সময় আসত, সেই সময়েও প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখতাম তাকে। তার কলমে জোর আমার মতো ছিল না, তারপরও চিঠির যে-জবাব দিত তাতেও খাঁটি ভালোবাসার স্পর্শ পেতাম। আমাদের প্রথম সন্তান যখন স্ত্রীর পিত্রালয়ে ভূমিষ্ঠ হলো, অনিবার্য কারণে আমি তার পাশে থাকতে পারিনি। জন্মের পরও বেশ কিছুদিন সন্তানের মুখ দেখতে না পাওয়ার বেদনা নিয়ে, সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানকেও তার ডাকনামে (যা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম দুজন মিলে) দীর্ঘ এক পত্র লিখেছিলাম। সে-চিঠি পিতৃত্ব অর্জনের গর্বিত আবেগ-উদ্বেগ-স্বপ্ন-প্রেরণায় ভরপুর এবং বেশ দীর্ঘ ছিল। স্ত্রী আমার লেখা সমস্ত চিঠির সঙ্গে পুত্রকে লেখা চিঠিখানাও সযত্নে রেখে দিয়েছিল।

স্ত্রীর রংপুরে অবস্থান ছাড়াও ঢাকাতেও প্রতিদিন দুজনের মধ্যে টানা কয়েক ঘণ্টার বিচ্ছেদ ছিল বাধ্যতামূলক, যখন অফিসে বা আড্ডা-অনুষ্ঠানে যেতাম। এটুকু বিচ্ছেদের মধ্যেও স্ত্রীকে চিঠি লিখেছি এবং কী জাদুবলে সে-চিঠি তার হাতে পৌঁছেছে, সেই স্মৃতিটাও বেশ মজার।

স্বাধীনতার পরের দু-এক দশক দেশটা সার্বিক অর্থে গরিবের দেশ ছিল। বাজারে গেলে বা রাস্তায় হাঁটলেও টের পাওয়া যেত। দুটো পয়সা ধরার ধান্ধায় কত ধরনের মজুর, মিন্তি আর টোকাই! বাজারে ভদ্রলোকদের বাজার টানার কাজে যেসব মিন্তি ঘুরঘুর করত, এরাই আবার ভদ্রলোক অফিসযাত্রীদের দুপুরের খাবার টিফিন ক্যারিয়ারে করে তাদের অফিসে পৌঁছে দেওয়ারও কাজ করত। বিভিন্ন মহল্লা থেকে মাথার ডালায় অনেকগুলি টিফিনবাটি নিয়ে মতিঝিল-পল্টন এলাকার বিভিন্ন অফিসের সাহেবদের টেবিলে পৌঁছে দিত তাদের বাসার গরম খাবার। আবার খালি টিফিনবাটি বাসাতেও পৌঁছে দিত। আমাকেও দুপুরে নিজের হাতের রান্না খাওয়াবে বলে খিলগাঁও-শাহজাহানপুর এলাকার এক বালক মিন্তিকে মাসচুক্তিতে ঠিক করেছিল স্ত্রী। অফিসে বসে বাসার রান্না খাওয়ার তৃপ্তির আবেগে ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা জানাতে, কখনো-বা জরুরি কোনো মেসেজ দিতেও চিঠি লিখে খালি টিফিনবক্সে রেখে দিতাম। মিন্তি ছেলেটা সেই চিঠির ওজনের তোয়াক্কা না করে ঠিক পৌঁছে দিত বাসায়। আর টিফিনবাটি খুলে আমার চিঠি আবিষ্কার করে স্ত্রী বেশ মজা পেত। আমার লেখা সমস্ত চিঠির সঙ্গে এভাবে লেখা দু-একটি চিরকুটও চিঠির বান্ডিলে ঢুকিয়ে প্রাপ্ত প্রেমের বোঝা ভারী করেছিল সে। অনেক বছর পর, একদিন তার কাছে নিজের লেখা ওসব চিঠি দেখে অবাক হয়ে বলেছিলাম, এগুলি রেখে দিয়েছ কেন? সে জবাব দিয়েছিল, ‘যখন নাতি-নাতনি হবে, ওগুলো দেখিয়ে বলব, তোদের দাদা কি নানা আমাকে কীরকম ভালোবাসত আর কেমন পাগল ছিল, এসব পড়লে টের পাবি।’

পাগলামি স্ত্রীর অজান্তে অন্যদের সঙ্গেও কম করিনি। বিয়ের পরও একাধিক সাহিত্যমনা এবং সুন্দরী বান্ধবী জুটেছিল। গোপনে চিঠি আদান-প্রদানের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল দু-একজনের সঙ্গে। সেসব চিঠিতে দুজনের বন্ধুত্বের সীমা ডিঙানো ভাবাবেগ গভীরতর প্রেমে রূপান্তরিত হওয়ার বাসনায় শরীরেও আশ্রয় পেতে চেয়েছিল কখনো-বা। এরকম একটি চিঠি স্ত্রী আবিষ্কার করার পর টের পেলাম, বান্ধবীর সেই চিঠিতে আমার জন্য শুধু গোপন ভালোবাসা নয়, আমাদের সুখের সংসারে অশান্তির আগুন ধরানোর জন্য হিংসার বিষ এবং দাহ্য পদার্থও মেশানো ছিল, আমি টের পাইনি। আমার সংগ্রামী জীবনে স্ত্রীর যে ভূমিকা এবং ত্যাগ-তিতিক্ষা, অন্য পাল্লায় কয়েক গণ্ডা প্রেমিকা-বান্ধবীর সহস্র প্রেমপত্রের ওজন মাপলেও কি তার সমান হবে? এ-প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে একদিন প্রাপ্ত সমস্ত প্রেমপত্র ধ্বংস করে দিয়েছি। অনুরূপভাবে আমার কাছ থেকে পাওয়া চিঠিগুলিও তারা আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে বলেই বিশ^াস। প্রমাণ হিসেবে এখন কেউ যদি হাজিরও করে, স্রেফ অস্বীকার করব। কারণ আমি তো আর সেই আমি নেই, দুই যুগ হাতে-কলমে না লেখার কারণে আমার হাতের লেখাও আর নেই আগের মতো।

এবারে নবীন লেখক হিসেবে বিখ্যাত ও প্রিয় লেখকদের সঙ্গে পত্র-যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতা ও ফলাফলের বয়ান দিই কিছুটা।

লেখক হওয়ার জন্য ঢাকায় আসার পর, বিশেষ করে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে চাকরি করে খ্যাত-অখ্যাত সব লেখক-বুদ্ধিজীবীকে চেনাজানার সুযোগ ঘটায় কাউকে চিঠি লেখার প্রয়োজন হয়নি কখনো। হাসান আজিজুল হক যেহেতু ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে থাকতেন, পরিচয় ও সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর তাঁকে গোটা চারেক চিঠি লিখেছিলাম। জবাবও পেয়েছিলম। এছাড়া আমার ব্যতিক্রমী দার্শনিক-গ্রন্থকার বন্ধু, আরজ আলী মাতুব্বর বরিশালের লামচারি গ্রাম থেকে ডাকে চিঠি দিতেন। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সত্যের সন্ধানে ও সৃষ্টির রহস্য নামে বই দুটি গ্রন্থকেন্দ্রের বিক্রয় বিভাগে জমা দিতে এসেছিলেন তিনি। সেই বই পড়ে ও আলাপ করে বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছিলাম। অ্যাকাডেমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, পেশায় কৃষির সঙ্গে সামান্য একজন কানুনগো বা ভূমি পরিমাপকারী আমিন হিসেবে গ্রামে থাকেন। তাঁকে নিয়ে গ্রন্থকেন্দ্রের মাসিক বই পত্রিকায় সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখাটার শিরোনাম ছিল ‘সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত’। ছবিসহ নিজের বিষয়ে সেই লেখা দেখে খুশি হয়েছিলেন বৃদ্ধ মাতুব্বর। ঢাকায় ডিআইটিতে চাকরিরত ছেলের বাসায় এলে আমার অফিসেও আসতেন। একদিন আমার বাসায় খাওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলে, পল্টনের অফিস থেকে খিলগাঁওয়ের বাসা পর্যন্ত গল্প করতে করতে হেঁটে গিয়েছিলাম দুই বন্ধু। আমি যেমন হেঁটে অফিস করতাম, তিনিও ঢাকা এলে হেঁটেই চলাচল করতেন। আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বরিশালের গ্রাম থেকে অনেকগুলি চিঠি লিখেছিলেন আমাকে। রাজশাহীর হাসানভাই ও বরিশালের মাতুব্বরভাই ছাড়া আর কোনো লেখকের সঙ্গে পত্রযোগাযোগ ছিল বলে মনে পড়ে না।

প্রিয় লেখকদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই বাস করতেন কলকাতায়। তাঁরা ঢাকায় এলে বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত ১৯৭৪-এর সাহিত্য-সম্মেলনে এবং গ্রন্থকেন্দ্রের ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও অনেককে দেখেছি, কথাবার্তাও শুনেছি। অন্নদাশঙ্কর রায়, গোপাল হালদার, শিবনারায়ণ রায়, মনোজ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ কয়েকজনকে কাছে থেকে দেখার কথা মনে পড়ে। সুনীল-শক্তি-সমরেশ-শীর্ষেন্দু প্রমুখ জনপ্রিয় লেখক ঢাকায় এলে ভক্ত-অনুরাগীর দল তাঁদের সান্নিধ্য পেতে বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিবিড় করতে যেভাবে ভিড় জমাতেন, আমি তেমনটি পারতাম না। তবে অনুরাগী পাঠক হিসেবে কলকাতার দুই প্রিয় লেখক, দেবেশ রায় ও মহাশে^তা দেবীকে বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছিলাম। দেবেশ রায়ের উত্তরবঙ্গের পটভূমিতে রচিত মফস্বলী বৃত্তান্ত, তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, মানুষ খুন করে কেন, আপাতত শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে ইত্যাদি উপন্যাস পড়ে বেশ মুগ্ধ ও আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম।

সত্তর-আশির দশকে কলকাতার উল্লেখযোগ্য সব পত্র-পত্রিকা ঢাকায় আসত। স্টেডিয়ামের দোতলায় ‘ম্যারিয়েটা’ ছিল কলকাতার বই-পত্রিকার দোকান। দেবেশ রায়-সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকাটি পড়তাম নিয়মিত। পরিচয়ের ঠিকানায় তাঁকে চিঠি দিতাম, জবাবও পেতাম। তবে আমার দীর্ঘ চিঠির তুলনায় দেবেশ রায়ের চিঠি ছিল সংক্ষিপ্ত। পরিচয় পত্রিকায় আমার গল্প ছাপা হওয়ার পর তিনি প্রতিক্ষণ পত্রিকার জন্য গল্প চেয়েও চিঠি লিখেছিলেন।

মহাশে^তা দেবীর অগ্নিগর্ভ পড়ে নিজের লেখক-সত্তাও অগ্নিময় হয়ে উঠেছিল যেন। এই লেখক সম্পর্কে তখন তেমন কিছুই জানতাম না। বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক এখলাস উদ্দিন আহমেদ আমাদের অফিসে আসতেন প্রায়ই। তাঁর সঙ্গে কলকাতার বহু লেখক-বুদ্ধিজীবীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক। মহাশে^তা দেবীর সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। প্রমাণ দিতে মহাশে^তার কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহার বেশ কয়েকটি উপন্যাস আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। অরণ্যের অধিকার ও বসাই টুডু, ফেরা উপন্যাস, ‘স্তন্যদায়িনী’ ও অন্যান্য গল্প পড়ে মনে হয়েছিল, আমাকেও বঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হয়ে এমন অগ্নিময় শাণিত লেখাই লিখতে হবে। এখলাসভাইয়ের কাছে ঠিকানা পেয়ে মহাশে^তা দেবীকে বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছিলাম। তিনি সব চিঠিরই জবাব দিয়েছিলেন, সংখ্যায় কমপক্ষে ছয়-সাতটি তো হবে। এই দুজন প্রিয় লেখক ছাড়াও, লেখক হিসেবে নিজেরও কিছুটা নামখ্যাতি হওয়ার পর লেখা চেয়ে কলকাতা থেকে কিছু পত্রিকা সম্পাদকের চিঠি পেতাম। মনে আছে কথাশিল্পী সাধন চট্টোপাধ্যায় প্রমা পত্রিকার জন্য, চতুরঙ্গ পত্রিকার জন্য আব্দুর রউফ এবং অনুস্টুপ ও অন্যান্য কিছু পত্রিকার হয়ে সুশীল সাহা বেশ কিছু চিঠি লিখেছিলেন। প্রতিক্ষণ প্রকাশক প্রিয়ব্রত দেব চিঠি লিখেছিলেন আমার তমস উপন্যাসটি তাঁদের একটি সংকলনগ্রন্থে অন্তর্ভুক্তির অনুমতি চেয়ে। কলকাতা থেকে দাউদ হায়দারও বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন আমাকে। আর একটি পত্রিকা সম্ভবত চোখ নাম, আমার অপারেশন জয়বাংলা গল্পগ্রন্থের জন্য সাহিত্য পুরস্কার দেওয়ার জন্য মনোনীত করে এবং আমাকে কলকাতা যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে মুদ্রিত চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উপস্থিত থাকবেন জেনেছিলাম। কিন্তু আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ২০০০ সালে দিল্লিতে প্রথম প্রথম সার্ক রাইটারস কনফারেন্সে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের লেখক প্রতিনিধিদলে কবীর চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, বেলাল চৌধুরী, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, নির্মলেন্দু গুণ, সেলিনা হোসেনের সঙ্গে আমি ছিলাম কনিষ্ঠ সদস্য। সার্ক রাইটার্স ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা পাঞ্জাবি লেখক অজিত কাউর, পশ্চিমবঙ্গের নবনীতা দেবসেন, পাকিস্তানের বিখ্যাত কবি আহামদ ফারাজ এবং সার্ক-দেশের বেশ কিছু কবি-লেখকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু একমাত্র অজিত কাউরের সঙ্গেই পত্র-যোগাযোগ ছিল বেশ কিছুদিন। তাঁর লেখা ছোটগল্পের বইসহ আত্মজৈবনিক বই উপহার দিয়েছিলেন। সেগুলি পাঠের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ‘অজিত আপা’ সম্বোধন করে ইংরেজিতেই লিখেছিলাম তাঁকে, তিনিও ইংরেজিতেই লিখেছিলেন বেশ কয়েকটি চিঠি। লেখালেখি সংক্রান্ত বিষয় ছাড়াও সাংগঠনিক কাজের কথা ছিল সেসব চিঠিতে। এছাড়া দিল্লিতে আন্তর্জাতিক ছোটগল্প লেখকদের সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলাম একটি। আমন্ত্রণকারী সংস্থা ও ব্যক্তির নাম মনে নেই।

ওপরে লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ ও চিঠি লেনদেনের স্মৃতি স্মরণ করে দীর্ঘ বয়ানটুকু দিতে হলো নিজের সামান্য লেখক-জীবনের গুরুত্ব বাড়াতে নয়, বরং গভীর একটি দুঃসংবাদ জানানোর উদ্দেশ্যে। সেটা বলে শেষ করছি লেখাটা।

অগোছালো স্বভাবের মানুষ বলে টাকাপয়সা থেকে শুরু করে নিজের তাবত মূল্যবান কাগজপত্র স্ত্রীকে দিতাম। সে গুছিয়ে রাখত সবকিছু। তাকে লেখা আমার চিঠিপত্রের সঙ্গে বিখ্যাত লেখক-সম্পাদকের কাছ থেকে প্রাপ্ত চিঠিপত্র, আমার সম্পর্কে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখার কাটিং অতি যত্নে মোটা একটা খামে ভরে রেখে দিয়েছিল সে সেলফের নিচের দেরাজে। ২০০১ সালে আমার শহরতলির বাড়ি কোমর-সমান পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিপর্যস্ত ঘর-সংসার ছেড়ে পালানোর ঘটনাটি ‘আবাসভূমির তিক্তমধুর দিনগুলি’তে সবিস্তারে বলেছি। নতুন করে যোগ করার কথাটি হলো, সেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় অনেক মূল্যবান বইপত্রের সঙ্গে আমার লেখা ও প্রাপ্ত পত্রসাহিত্যও ধ্বংস করেছে। কাজেই বর্তমানে পত্রসাহিত্য ধ্বংসের জন্য তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব দায়ী হলেও, আমার পত্রসাহিত্য ধ্বংসের জন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং প্রেমের পাগলামিও দায়ী অনেকটা।

স্মৃতিকথার এ-বইটি লেখার সময় কিছুদিন আগে সেই হারানো চিঠিগুলির জন্য যখন দুঃখ করছিলাম, স্ত্রী সেই বন্যাতেও রক্ষাপ্রাপ্ত একটি মোটা খামে জমির কাগজপত্র ও ইলেকট্রিক বিলের কাগজ হাতড়ে চারটি চিঠি উদ্ধার করে আমাকে দিয়েছে। চিঠিগুলি যাতে আর কোনো বিপর্যয়েই হারিয়ে যেতে না পারে, নিচে সংক্ষিপ্ত ভূমিকাসহ তা হুবহু ছেপে দিচ্ছি।

১। মহাশে^তা দেবীর দুটি চিঠি প্রসঙ্গে

আমার লেখা চিঠিতে তাঁর প্রতি ভক্তি-ভালবাসার কারণ, লেখক হিসেবে তাঁকে জানার কৌতূহল ও নিজের লেখক হওয়ার সদিচ্ছাটিও প্রকাশ করেছিলাম সম্ভবত। ঢাকায় আসার আমন্ত্রণও জানিয়েছিলাম। জবাব পেতে দেরি হওয়ায় অভিমান প্রকাশ করেও চিঠি লিখেছিলাম হয়তো-বা। চিঠিতে তিনি পিতার মৃত্যুর কথা লিখেছেন। তাঁর পিতা মণীশ ঘটকের পটল ডাঙার পাঁচালি ও মান্ধাতার বাবার আমল নামে দুটি বই পড়েছিলাম মনে পড়ছে। চিঠিতে তিনি সাক্ষাৎ হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যখন ক্যান্সারাক্রান্ত হয়ে এক পা হারিয়ে কলকাতা থেকে ফিরে আজিমপুরে সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার থাকতেন, একবার মহাশে^তা দেবী এসেছিলেন তাঁকে দেখতে। তখন তাঁর বয়স আশির ওপরে। আরো অনেকেই উপস্থিত ছিলেন অসুস্থ ইলিয়াসভাইয়ের বাসায়। সেই ভিড়ের মধ্যে তাঁকে প্রথম দেখি। আত্মপরিচয় দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি প্রায় দুই যুগ আগের চিঠির লেখককে চিনতে পেরেছিলেন কি না জানি না। কারণ ব্যক্তিগত চিঠি বা লেখার প্রসঙ্গ ওঠার মতো পরিবেশ ছিল না ইলিয়াসভাইকে ঘিরে সমবেত ভিড়ের মধ্যে। এরপরও বাংলাদেশে এসে একবার একুশের বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মহাশে^তা দেবী, আমার সঙ্গে দেখা হয়নি আর।

প্রথম চিঠি

                                                                                কলকাতা

                                                                                ২/২/৮০

প্রিয় মনজু,

আমি তোমার প্রতি চিঠির উত্তর দিই, সকলের সব চিঠিরই। তুমি চিঠি পাও না কেন?

আমার এ চিঠি খুব সংক্ষিপ্ত ও বিস্রস্ত। বাবার মৃত্যুতে ঝড় বয়ে চলেছে, স্থির হতে পারিনি। মা অন্ধ ও পঙ্গু। বহু দায়-দায়িত্ব। বাবার সৎকার থেকে সবই আমাকে করতে হয়। ভাইরা দিল্লী ও পাটনা থেকে এসে পৌঁছতে পারে নি সময়মত।

যাবার প্রবল তৃষ্ণা Ñ কবে হবে?

                                                 স্নেহ জেনো।

                                                                মহাশে^তাদি।।

দ্বিতীয় চিঠি

মহাশে^তাদি।

                                                                                কলকাতা

                                                                                ২২.৫.৮০

কল্যাণীয় মঞ্জু,

তোমার দুখানি আন্তরিকতা ও ভালবাসাপূর্ণ চিঠির উত্তর দিতে আমি কত দেরি করলাম। বাবার মৃত্যুর পর থেকে তাঁর কাজে যে কি ভাবে জড়িয়ে পড়েছি। বাবা ২৪ বছর ধরে যে ছোট কাগজ চালাতেন, তার ভার আমার ওপর। এই জুনে বেরুবে প্রথম সংখ্যা। সে জন্য বিজ্ঞাপন জোগাড়, প্রেস ঠিক করা, লেখা জোগাড় করা Ñ এক কাজ। তারপর, বাবার বই বের করছি। ফলে তাঁর লেখাগুলি কপি করা, ওহফবী ও ষরংঃ করা, সব একা করতে হচ্ছে। আজ পাঁচ মাস দিন ১৬/১৮ ঘণ্টা খেটেও কাজ শেষ হচ্ছে না। শুধু কি তোমাকে? শ খানেক চিঠির জবাব দেওয়া বাকি।

না, আমি রাগ করিনি। তোমার হৃদয় আছে, অনুভূতি আছে, তোমার কাছে আছে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের মহান ও রক্তাক্ত ঐতিহ্য। লেখার কত প্রেরণা। লেখো, লেখো, লেখা হোক। আমি কে বল? অতি সামান্য। কিন্তু আমরা সবাই চেষ্টা করলে সাহিত্যে হাওয়াবদল ঘটাতে পারি হয়তো।

আজ এই রইল। তুমি চিঠি লিখো, যা মন চায়, আমি সময় মত উত্তর দেব Ñ আর যত কথা জানতে চেয়েছ সে তো  সামনাসামনি হতে পারে। আশা রাখি তাও হবে কোনদিন।

স্নেহ ও শুভেচ্ছা নাও। লেখো, খুব লেখো।

মহাশে^তাদি

২। জহুরুল হকের লেখা একটি চিঠি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক জহুরুল হক বেশ কিছু বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থের লেখক ছিলেন। সাঁত সাতার নামে তাঁর বিলাত ভ্রমণের এক বই ছিল। আমি তাঁকে চিঠি লিখিনি। আমার প্রথম গল্পগ্রন্থটি পড়ে আমার ঠিকানা জেনে চিঠিখানা লিখেছিলেন। এরপর তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ বেশ নিবিড় হয়েছিল। একাধিকবার গিয়েছিলাম তাঁর বাসায়। তিনিও গ্রন্থকেন্দ্র অফিসে অনেকবার এসেছেন। কবি কায়সুল হকের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল তাঁর। সজ্জন, সংস্কৃতিবান ও এমন সর্বগ্রাসী বইপ্রেমিক পাঠক আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। আমাকে তাঁর সংগ্রহ থেকে অনেক প্রিয় বই পড়িয়েছেন। আমার মৃত্যুবাণ নামের গল্পগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলাম তাঁকে। তাঁর লেখা আগুনের কী গুণ নামে বিজ্ঞানবিষয়ক একটি বই আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘শেষ বেলায় কাছে ডেকে নেওয়া বন্ধু’র স্বীকৃতি দিয়ে। আবাসভূমি পড়ে খুব ইচ্ছে ছিল তাঁর আমার শহরতলির বাড়িতে যাওয়ার, কিন্তু বৃদ্ধ মানুষটি বন্ধুর পথে বেশ কষ্ট পাবেন ভেবে নেওয়ার সাহস হয়নি।

টাইপরাইটারে লেখা চিঠিখানা অবিকল এরকম :

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়                          

১/বি, প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়

আবাসিক ভবন

                                                 ঢাকা-২। তাং ১৮/১০/৮২

প্রিয় মঞ্জু সরকার প্রিয়বরেষু,

       প্রথমেই আপনার নাম ধরে সম্বোধন করার জন্যে মার্জনা ভিক্ষা করছি। আপনার বয়স যতোই হোক, আমার চেয়ে তো বেশি হবে না, ষাট কয়েকমাস আগে পেরিয়েছি। এবং অনুমান করি আপনি এখনো বিশের কোঠায়।

                যাই হোক, আপনাকে হয়তো বিরক্ত করছি, রাগ করবেন না। আপনার লেখা ছোটোগল্পের বই ‘অবিনাশী আয়োজন’ সম্প্রতি আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে। তার আগে আপনার লেখা গল্প পড়ার সুযোগ আমার হয়নি, যদিও এখন দেখতে পেলাম বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আপনার গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। আপনার গল্পের বইটির মধ্যে সব ক’টা গল্পই আমার এতো শক্তিশালী, হৃদয়স্পর্শী, রসোত্তীর্ণ, সর্বোপরি কঠিন বাস্তব অবস্থার পটভূমিতে রচিত, মনে হয়েছে যে আমি আনন্দে অভিভূত হয়েছি। এত ভালো লেগেছে যে, আমাদেরই কোনো লেখক এই সব রচনা করছেন, বিশ^াসই করতে পারিনি। তার ফলে কয়েকবার করে গল্পগুলি পড়েছি। ভাষার মধ্যে অতি সূক্ষ্ম ইংগিত দিয়ে কোনো দিকে নির্দেশ করা ও সুন্দর রসচৈতন্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। হাসান আজিজুল হক-এর গল্পগুলিও ভালো লাগে, লেখার শৈলী, এবং বাস্তবতাবোধ খুব প্রশংসনীয়, কিন্তু আপনার গল্পগুলি অনেক ভাল, ধারালো ও ‘তাজা’ মনে হলো। আশা রাখি আপনার এই সচেতনতা এবং শিল্পবোধ বেঁচে থেকে আরো অগ্রসর ও প্রখর হবে। আমার আনন্দ, অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনার মেধার উৎকর্ষ ও কলমের তীক্ষèতা যেন দিন দিন বৃদ্ধি পায়, সেই শুভেচ্ছা রইল।

   আপনি আমাকে চিনবেন না, প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি অনেক দিন থেকে। আমি বৃদ্ধ হলেও দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্বন্ধে কিছু খোঁজখবর রেখে আনন্দিত বোধ করি। ভালো কাজ দেখলে গর্ব বোধ করি। সংক্ষেপে, আমি একজন আদি ‘ভেতো’ বাঙালী, যার আর কিছু না  থাকলেও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, মানিক, আলাউদ্দিন খাঁ, সত্যজিত রায়, জয়নুল, রবিশংকর এবং আরো অনেকেই আছেন, এবং আপনাদের কাজ দেখে মনে হয়, সব কিছু শেষ হয়নি। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার সময় বা সুযোগ আপনার হবে কি? বাসা-১/বি, প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় আবাসিক ভবন। টেলিফোন ২৫৪৭০৫ ঊীঃ ৭৫। অথবা ২৩৪০০০। দেখা হলে খুবই খুশি হবো বলা বাহুল্য। আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা রইল।

                                                                                ইতি

                                                                                বিনীত

                                                                স্বা/ জহুরুল হক

পুঃ আমার হাতের লেখা অতিশয় বাজে হওয়ার কারণে টাইপ করে এই চিঠি দিলাম। মার্জনা করবেন।

৩। হাসান আজিজুল হকের লেখা চিঠি প্রসঙ্গে

হাসান ভাই এ-চিঠি যখন লেখেন, তখন তিনি ‘বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সভাপতি।’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন সহসভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আনু মুহাম্মদ এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আমি। সংগঠনটির নেপথ্যে ছিলেন আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমর, মূলত তাঁর রাজনীতি ও সংস্কৃতিবিষয়ক তত্ত্ব-নীতির দ্বারাই পরিচালিত হতো সংগঠনটি। সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কিছু কর্মী ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক সংগঠনেরও সক্রিয় সদস্য। তবে ইলিয়াসভাই, আনু মুহাম্মদ ও আমি বেশ তৎপর হওয়ায়, মূলত আমাদের উদ্যোগে ওই সময়টা লেখক শিবির বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে সাহিত্য-

সংস্কৃতিমূলক নানা কর্মসূচির আয়োজনে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রেও বেশ কয়েকটি আলোচনা, মিটিং, সেমিনার হয়েছে। টিএসসির বড় মিলনায়তনেও অনুষ্ঠিত হয়েছিল বেশ বড় একটি সেমিনার।

হাসান ভাইকে লেখা চিঠিতে লেখক শিবিরের কর্মসূচি জানানো ছাড়াও তাঁর লেখালেখি প্রসঙ্গেও অভিযোগমূলক কিছু লিখেছিলাম সম্ভবত। তখন পর্যন্ত তাঁর কাছে উপন্যাস না পাওয়া ও আরো বেশি গল্প না লেখার অভিযোগ সাক্ষাতেও করেছি অনেক সময়। ইলিয়াস ভাইকেও যেমন একদিন গ্রিন রোডের মিউজিক কলেজ থেকে দুজনে রিকশাযোগে তাঁর বাসায় যাওয়ার সময় বলেছিলাম, ‘আড্ডা আর লেখক শিবির বাদ দিয়ে আপনি লেখালেখিতে আরো সিরিয়াস হন তো।’ জবাব দিয়েছিলেন, ‘আরে, আমি তো বেশি সিরিয়াস। সে জন্যই বেশি লেখা হয় না।’ পরে ভেবে দেখেছি, কথাটা তিনি সত্য বলেছিলেন। ঠিক সেরকম আমার বোকামি-মন্তব্যের জবাবেই হাসানভাইও এ-চিঠিতে নিজের সম্পর্কে সত্য ও উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন :

হাসান আজিজুল হক                               পশ্চিম/৭৬ সি

আবাসিক এলাকা

রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়

বাংলাদেশ

২৪.১১.৮৬

প্রিয় মঞ্জু,

যেদিন তোমার চিঠি পাই, ঠিক তার পরের দিনই জরুরি কাজে খুলনা গিয়েছিলাম, ফিরেছি গত পরশু। কাজের কথাটা আগে সেরে নিই। লেখক শিবিরের সেমিনার নিয়ে পড়েছি বড়ো বেকায়দায়। ২৩শে ডিসেম্বর বিশ^বিদ্যালয়ের ডিন, সিন্ডিকেট ইত্যাদি নির্বাচনের তারিখ। কারো পক্ষেই এখান থেকে যাওয়া সম্ভব হবে না। অনুরোধপত্রগুলি আমি মতিন, শহিদুল,  হারুন ইত্যাদি সবাইকে দিয়ে দিয়েছি। নিজেরগুলিও ঠিকমতো দিয়েছি। কিন্তু কথা হচ্ছে সেমিনার জানুয়ারির দিকে না নিয়ে গেলে রাজশাহী থেকে বড় কেউ অংশ নিতে পারবে না। আমার নিজের শরীর আজকাল প্রায়ই ভালো থাকে না, হাইপার এসিডিটি গ্যাস্ট্রাইটিক ইত্যাদি তো আছেই, যোগ হয়েছে নার্ভ সংক্রান্ত অসুস্থতা। উত্তেজনা, আবেগ, তাড়াহুড়ো, ভিড়, পথভ্রমণ একেবারেই সইতে পারছি না। চাপের মূলে কিছু লিখাও আজকাল অসম্ভব হচ্ছে। ঢাকা যেতে পারলে সেমিনারে সর্বতোভাবে অংশগ্রহণ করবো। কিন্তু প্রবন্ধ লিখে উঠতে পারবো এমন ভরসা পাচ্ছি না। সেমিনারের জন্য তোমরা যে পরিকল্পনা করেছো তা আমার পছন্দ হয়েছে। আরো কিছু বলার থাকলে পরে জানাচ্ছি।

`যে ভিতরে আসে’ নামের লেখাটি সম্ভবত সাত আট বছরের পুরনো, প্রথমে ‘বিচিত্রা’য় বেরিয়েছিল, পরে নানা জায়গায় পুনর্মুদ্রিত হয়েছে, সর্বশেষ মুদ্রণ লিটল ম্যাগাজিনে। ‘চালচিত্রের খুঁটিনাটি’ নামে আমার যে একটি নানা লেখার বই বের হয়েছে, তাতে লেখাটি সংকলিত হয়েছে। বুঝতে পারছি, লেখাটি তোমাদের চোখে পড়েনি। ইলিয়াসের যে লেখাটি ভালো লেগেছে, তাতে আমি ভীষণ খুশি। তুমিও যে পছন্দ করেছো – তাতেও আনন্দ পাচ্ছি, কিন্তু আমার কাছে ওই লেখার তেমন কোনো ভূত-ভবিষ্যৎ নেই। ‘রোববারে’ যে ‘প্রবাস’ নামে লেখাটি দেখেছ, সে-ও ঐ প্রবাসকালেই লেখা, পড়ে ছিল ৭/৮ বছর, অনুরোধেই পাঠাতে হয়েছে। কাজেই ঐ লেখাটি নিয়েও আমি কিছুই ভাবি না। আসল কথাটা হচ্ছে, অনেকদিন কিছু লিখি না। কেন লিখি না তা আমি নিজেই সবচেয়ে ভালো জানি। সে কি ফুরিয়ে যাবার কারণে, নাকি নতুন লেখকজীবন শুরুর উদগ্র আনন্দ-প্রস্তুতিতে, নাকি অন্য কোনো দায়ে, তা আমিই সবচেয়ে ভালো জানি – কিন্তু সেটা নিয়ে আলোচনার সত্যিই কিছু নেই। কারণ লেখা নিয়ে হাজির হতে না পারলে কোনো কথাতেই চিড়ে ভিজবে না। অবস্থাটা যখন এই, তখন ব্যর্থতা বা সীমাবদ্ধতা আড়াল করার কথাটা উঠবে কেন? যতোক্ষণ লিখছি না, ব্যর্থতা তো স্ব-প্রকাশ, অতি স্পষ্ট, সেটাকে আড়াল করার কোনো প্রশ্ন নেই। সেজন্য সাক্ষাৎকারের সাহায্য নেব কেন? মফস্বলে যে লেখক জীবন আমি কাটিয়েছি, তা থেকে কি এটা স্পষ্ট হয়নি যে লেখক থাকাটাকেই আমি আমার জীবনের চরম ও শেষ লক্ষ্য হিসেবে আঁকড়ে ধরি নাই? এটা কি এখনো স্পষ্ট নয় যে সৃজনশীলতা জীবনের সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন একটা আলাদা চর্চার বিষয় নয়? আসলে যেদিক থেকে তুমি প্রশ্নগুলো করেছো, সেদিক থেকে বিষয়টিকে আমি কখনো দেখি না। লেখা একরকমের কাজ, আর পাঁচটা কাজের মতোই; এটা দুর্ভাগ্যই যে যশ, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি, ক্ষেত্রবিশেষে ঐশ^র্য এবং অমরতার মোহ ইত্যাদি লেখা-কাজের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। এগুলো থেকে লেখাকে আলাদা করা মুশকিল হয়ে ওঠে। অমরত্বের সাধনা বা পণ্য ফিরি করে বেড়ানো কোনোটাই লেখকের কাজের মধ্যে পড়ে না। জানি না আমার কথা তোমাকে বোঝাতে পারলাম কিনা। অন্তত ভুল বুঝো না। শেষ করি। সুমন রহমানকে জিগগেস করতে পারো রফিকের কাছ থেকে গুন্টের গ্রাস সম্পর্কে আমার একটুখানিও লিখা হয়েছে কিনা।

প্রীতি – হা আজি হক