হিটলার ও গোয়েবলসের প্রোপাগান্ডা এবং নাৎসি চলচ্চিত্র

হিটলার কোনো এক রাতে ছদ্মবেশে বার্লিনের সবচেয়ে অভিজাত সিনেমাহলে সিনেমা দেখতে গেলেন। উদ্দেশ্য সিনেমা দেখা নয়। মধ্যবিরতির সময় হিটলারের ছবি পর্দায় ভেসে উঠলে সকলে দাঁড়িয়ে সম্মান করছে কি না, সেটা পরখ করে দেখা। মধ্যবিরতির সময় পর্দায় হিটলারের ছবি ভেসে উঠল। সবাই দাঁড়িয়ে হিটলারের জয়ধ্বনি দিতে শুরু করল। হিটলার দাঁড়ালেন না, তিনি নিজেই তো হিটলার। কিন্তু এটা তাঁর মাথায় ছিল না যে, তিনি ছদ্মবেশে এসেছেন, হিটলার বেশে নয়। চারদিকে হিটলারের জয়ধ্বনি। শুনে হিটলার ভীষণ আনন্দিত হলেন। হিটলারের পাশে থাকা মানুষটি জয়ধ্বনি দেওয়ার ফাঁকে লক্ষ করলেন যে, তাঁর পাশের ব্যক্তিটি নির্বিকার বসে আছেন। তিনি ছদ্মবেশী হিটলারের উদ্দেশে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে যাও ভাই আর হিটলারের জয়ধ্বনি করো। নইলে শুয়োরের বাচ্চা হিটলার আর তার পোষা কুকুরের দল (নাৎসি বাহিনী) তোমাকে বিপদে ফেলে দেবে।’

এই গল্পটি হিটলারকে নিয়ে একটি প্রচলিত কৌতুক। তবে এই কৌতুকের আড়ালে বেশ কয়েকটি সত্য লুকিয়ে আছে। হিটলার গোপনে যাচাই করে দেখতেন মানুষ তাঁর গুণকীর্তন করছে কি না। যাঁরা হিটলারের গুণকীর্তন করতেন না তাঁদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। সিনেমাকেও তাঁর প্রচারমাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সেটা শুধু মধ্যবিরতিতে পর্দায় হিটলারের ছবি দেখানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁর শাসন আমলে গড়ে ওঠা সিনেমা শিল্পের পর্যালোচনা করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। জার্মান সিনেমা শিল্পটাকেই তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর নিজের আর নাৎসি বাহিনীর প্রচারমাধ্যম হিসেবে।

১৯২৭ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মানির সিনেমা দেশের মধ্যে বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক পরিবেশের দ্বারা প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী জার্মানিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ নানা রকম বিধিনিষেধের শিকার হতে হয়েছিল, যার কারণে জার্মানি মারাত্মকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। জার্মানির নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলার ক্ষমতা গ্রহণের পর একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের ঘোষণা দেন। ক্ষুধা-দারিদ্র্য আর ভঙ্গুর অর্থনীতির সেই দুঃসময়ে জনগণ তাঁর ঐক্যের ডাকে সাড়া দেয়। পরবর্তীকালে তিনি একটি একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী সরকার হিসেবে শক্ত হাতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা, শিল্প-সাহিত্য Ñ কোনো কিছুই এই নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল না।

হিটলারের নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আরেকটি নাম – গোয়েবলস। জোসেফ গোয়েবলস ছিলেন হিটলারের প্রচার বা প্রোপাগান্ডা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। হিটলার বিশ্বাস করতেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা প্রচারণায় এগিয়ে ছিল। সেই যুদ্ধে জার্মানরা প্রচারণার অভাবে মার খেয়েছে বারবার। শুধু প্রচারণা দিয়েই ব্রিটিশরা আড়াল করেছিল অনেক কিছু। তাই মিথ্যা প্রচারণা চালাতেই এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গোয়েবলসকে। হিটলারের সময় জনপ্রিয় ছিল রেডিও। বিনামূল্যে জার্মান নাগরিকদের একটি করে রেডিও দেওয়ার ব্যবস্থা করেন মন্ত্রী গোয়েবলস। হিটলার সবসময় বিশ^স্ত এই সহযোগীর কথা শুনতেন। গোয়েবলসের আলোচিত উক্তি ছিল, ‘আপনি যদি একটি মিথ্যা বলেন এবং সেটা বারবার সবার সামনে বলতে থাকেন তাহলে লোকজন একসময় সেটা সত্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করবে।’ জার্মানিতে তেমনটাই হয়েছিল। ইহুদি নিধনের সময় গোয়েবলস প্রচার করতেন, জার্মানিতে হিটলারের মতো শক্তিশালী একজনকে দরকার। তিনিই পারবেন জার্মান জাতিকে তার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দিতে। বেতারে এ-প্রচারণা শুনতে শুনতে মানুষ বিশ^াসও করত। আলোচনায় ইহুদি নিধনের পরিবর্তে সব সময় সামনে থাকত হিটলারের সাফল্যগাথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে প্রচারণা ছিল এক ধাঁচের। যুদ্ধের সময় আরেক। জার্মান রেডিও-টিভিতে শুধুই থাকত হিটলার ও তাঁর বাহিনীর সাফল্যের কথা। বাস্তবে যখন রুশদের হাতে জার্মান সেনারা নাস্তানাবুদ তখন গোয়েবলসের  প্রচারণা ছিল, সোভিয়েত রাশিয়া তাঁদের দখলে। জার্মান সেনারা রাশিয়ান ভদকা পান করছে আর রাশিয়ান মেয়েদের নিয়ে আনন্দফুর্তি করছে। এ-ধরনের প্রচারণা প্রতিদিনই হতো। আমেরিকা আর ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে চলত কুৎসা রটনা।

সেই গোয়েবলসের নেতৃত্বে প্রোপাগান্ডা মন্ত্রকের অধীনে জার্মান চলচ্চিত্র একটি নাৎসি প্রচারমাধ্যম হিসেবে বিকাশ লাভ করে। নাৎসি পার্টির সবচেয়ে প্রভাবশালী এই দুই নেতাই সিনেমা পছন্দ করতেন এবং প্রচারের খুব শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে গুরুত্ব দিতেন। গোয়েবলস সাম্যবাদকে ঘৃণা করতেন; কিন্তু আইজেনস্টাইনের পটেমকিন সিনেমা দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সেই অনুপ্রেরণা সাম্যবাদের প্রতি নয়, সেই অনুপ্রেরণা ছিল শক্তিশালী প্রচারমাধ্যম হিসেবে সিনেমার প্রতি। তিনি নাৎসি ধারণাগুলিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সমান প্রাণবন্ত কিছু সিনেমা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রথমে তিনি কিছু ভালো সিনেমা খুঁজে বের করেন। তারপর সেই সব সিনেমা পরিচালকদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন। ফলে জার্মানির দক্ষ পরিচালকদের হাতে তৈরি হলো অনেকগুলি সিনেমা, যেগুলি ব্যবহার করা হতো নাৎসি বাহিনীর প্রচারের কাজে। এর মাঝে সব থেকে উল্লেখযোগ্য সিনেমা মেট্রোপলিস (Metropolis) এবং ট্রায়াম্ফ দেস উইলেন্স (Triumph des Willens)।

১৯২৭ সালে ফ্রিটজ ল্যাং তৈরি করেন বিজ্ঞান-কল্পকাহিনি ভিত্তিক মেট্রোপলিস আর ১৯৩৫-এ এসে লেনি রিফেনস্টাহল তৈরি করেন প্রোপাগান্ডাভিত্তিক ট্রায়াম্ফ দেস উইলেন্স। প্রায় এক দশকের ব্যবধানে আলাদা দুটো গুরুত্বপূর্ণ জার্মান চলচ্চিত্র। ভিন্ন ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক চাপের ফলে জাতীয়তাবাদ এবং বিপ্লবের খুব ভিন্ন দুটো অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। মেট্রোপলিসে ছিল একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে শ্রেণিবিভাগ ভেঙে সমতা খোঁজার জন্য সমাজের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। সাত বছর পরে, অন্যটি আগের ছবির একই ছকে অস্থির জাতীয়তাবাদের একটি মিথ্যা প্রচারণা।

ল্যাংয়ের মাস্টারপিস মেট্রোপলিস একটি শোষিত-নিপীড়িত শ্রেণির মানুষের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যা একজন ব্যক্তির অনুপ্রেরণার মাধ্যমে বিদ্রোহের দিকে এগিয়ে যায়। ট্রায়াম্ফ দেস উইলেন্সে এসে পরিচালক রিফেনস্টাহল একই ছকে দেখালেন, জার্মান সমাজ আন্তর্জাতিক শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করছে আর তাদের অবিসংবাদিত নেতা অ্যাডলফ হিটলার, যার নেতৃত্বে জার্মানি একটি বিশ^শক্তিতে নিজেকে পুনর্গঠন করে চলেছে। হিটলার মেট্রোপলিসকে একটি নেতিবাচক সিনেমা হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারতেন। যেখানে নিপীড়িত মানুষকে সংগঠিত করে বিপ্লবের জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। অন্যান্য দেশের অগণতান্ত্রিক সরকারপ্রধানরা এই ধরনের বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত করে এমন শিল্পকে সব সময়ই প্রতিরোধ করেন। হিটলার তা করেননি। এখানেই হিটলার কিংবা গোয়েবলসের বিশেষত্ব। এই বিপ্লবী আদর্শকে তাঁরা প্রোপাগান্ডার একটি ছক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যেখানে প্রতিপক্ষ দেশসমূহকে শোষক শ্রেণি এবং জার্মানিকে শোষিতের জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।

মার্কিন চলচ্চিত্র-বিশেষজ্ঞ ডেভিড বোর্ডওয়েল তাঁর চলচ্চিত্রের ইতিহাস (‘Film History : An Introduction’) বিষয়ক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘হিটলার সিনেমার ভক্ত ছিলেন; তিনি অভিনেতা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং রাতের খাবারের পর বিনোদন হিসেবে প্রায়শই সিনেমা দেখতেন। সিনেমার প্রতি আরো বেশি মুগ্ধ ছিলেন তাঁর প্রচারণার শক্তিশালী মন্ত্রী ড. জোসেফ গোয়েবলস, যিনি নাৎসি যুগে শিল্পকলা নিয়ন্ত্রণ করতেন। গোয়েবলস প্রায় প্রতিদিন চলচ্চিত্র দেখতেন এবং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন।’

গোয়েবলস এবং হিটলার উভয়ের অনুপ্রেরণায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় সেই সময়ের চলচ্চিত্রগুলি পুরো জার্মানিতে নিয়ন্ত্রণ অর্জনের জন্য নাৎসি প্রচারণা কৌশলের একটি অংশ হয়ে ওঠে। হিটলার ফ্রিটজ ল্যাংকে নাৎসি চলচ্চিত্র নির্মাণের তত্ত্বাবধানকারী একটি নতুন সংস্থার দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন। যদিও ল্যাং তাতে রাজি হননি। তাঁর মা ইহুদি হওয়ার কারণে জীবনের ভয়ে আমেরিকায় পালিয়ে যান। ল্যাং হিটলারের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন, খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, তবু হয়তো তাঁকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ খুঁজে পাননি।

হিটলারের আরেকজন ভক্ত, চলচ্চিত্র পরিচালক রিফেনস্টাহল। তাঁকে ১৯৩৩ সালে পঞ্চম নুরেমবার্গ র‌্যালির ওপর ভিত্তি করে একটি এক ঘণ্টার প্রচারমূলক চলচ্চিত্র পরিচালনা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সুযোগটা তিনি ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন। তৈরি করলেন ডার সিগ দেস গ্লাউবেনস (Der Sieg des Glaubens) বা ‘বিশ^াসের বিজয়’ নামে একটি প্রচারমূলক চলচ্চিত্র। হিটলার তাঁর কাজ দেখে খুশি হয়েছিলেন। সেই কাজের ভেতর দিয়ে তাঁদের একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ল্যাং জার্মানি ত্যাগ করার পর হিটলার রিফেনস্টাহলকে ফিল্ম কমিশনের দায়িত্ব দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে গোয়েবলস এ-ধরনের দায়িত্ব অন্য কারো হাতে ছাড়ার পক্ষে ছিলেন না। তাছাড়া অন্য একটি কারণ ছিল, গোয়েবলস চাইতেন না তিনি ছাড়া অন্য কেউ প্রোপাগান্ডার জন্য হিটলারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠুক। ফলে রিফেনস্টাহল ফিল্ম কমিশনের দায়িত্ব পাননি।

গোয়েবলস তাঁকে ফিল্ম কমিশনের দায়িত্ব না দিলেও হিটলারের নির্দেশে ১৯৩৪ সালে নুরেমবার্গে নাৎসি পার্টির (NSDAP) সমাবেশের ওপর ভিত্তি করে আরেকটি প্রোপাগান্ডা ফিল্ম তৈরির দায়িত্ব দেন। রিফেনস্টাহল সেই সময়ই তৈরি করেন তাঁর বিখ্যাত সিনেমা ট্রায়াম্ফ দেস উইলেন্স।

রিফেনস্টাহল ১৯৩৫ সালে জার্মান সেনাবাহিনী সম্পর্কে ২৮ মিনিটের ট্যাগ ডের ফ্রেইহাইট : আনসেরে ওয়েহরমাখট (স্বাধীনতার দিন : আমাদের সশস্ত্র বাহিনী) তৈরি করেছিলেন। ডার সিগ দেস গ্লাউবেনস এবং ট্রায়াম্ফ দেস উইলেন্সের মতো, এটিও নুরেমবার্গে বার্ষিক নাৎসি পার্টির সমাবেশে চিত্রায়িত হয়েছিল, যা জার্মান সেনাবাহিনীকে নাৎসি কর্মকাণ্ডের প্রতি অনুপ্রাণিত করার কাজে ব্যবহার করা হতো।

হিটলার রিফেনস্টাহলকে ১৯৩৬ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের ওপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। জার্মান সরকারের অর্থায়নে তৈরি হলো অলিম্পিয়া। ১৯৩৮ সালে হিটলারের ৪৯তম জন্মদিনে অলিম্পিয়ার প্রিমিয়ার শো হয়েছিল। চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রদর্শিত ও প্রচারিত হয়। রিফেনস্টাহল অলিম্পিয়া নিয়ে একটি প্রচারসফরে আমেরিকা যান। সেই সময় ডেট্রয়েট নিউজের একজন প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘আমার কাছে হিটলারই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তিনি সত্যই নির্দোষ, ভালো মানুষ এবং একই সঙ্গে পৌরুষদীপ্ত সাহসী বীর।’ অলিম্পিয়া নিউইয়র্ক সিটি ও শিকাগো সিটিসহ বিভিন্ন সিটিতে প্রদর্শন করা হয়েছিল। এই প্রচারসফরের মূল উদ্দেশ্যই ছিল অলিম্পিয়া প্রদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে হিটলারের পক্ষে প্রচারণা চালানো।

১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে, রিফেনস্টাহলকে যুদ্ধসংবাদদাতা হিসেবে পোল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল। রিফেনস্টাহল ওয়ারশতে হিটলারের বিজয় কুচকাওয়াজের চিত্রগ্রহণ করেন। পরে তিনি নাৎসি কর্মকাণ্ডের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পোল্যান্ড ছেড়ে চলে যান এবং নাৎসি-সম্পর্কিত আর কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত নেন। বিশেষ করে ১৯৪৪ সালে তাঁর ভাই রাশিয়ান ফ্রন্টে মারা যাওয়ার পর হিটলারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন হয়ে যায়। ১৯৪৫ সালের প্রথম দিকে জার্মানির সামরিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে রিফেনস্টাহল জার্মানি ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান।

রিফেনস্টাহল তাঁর নির্মিত সিনেমাগুলিতে হিটলারকে জার্মান সমাজে ঈশ্বরের মতো ব্যক্তিত্ব এবং নাৎসি পার্টিকে শান্তি ও সাম্যের জন্য লড়াইকারী একটি আদর্শবাদী গোষ্ঠী হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন। হিটলারের পৃষ্ঠপোষকতায় রিফেনস্টাহলের সব থেকে বড় প্রোপাগান্ডা ফিল্ম ছিল ট্রায়াম্ফ দেস উইলেন্স। এই সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে একজন নির্বাহী প্রযোজকের মাধ্যমে হিটলারের সতর্ক নির্দেশনা ছিল। ল্যাংয়ের মেট্রোপলিস সিনেমার অনুকরণে এখানে হিটলারকে এক অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি জনসাধারণের থেকে আলাদা, মানুষকে স্বপ্ন দেখান, আশার আলো দেখান এবং সামাজিক সমতার কথা বলেন। মেট্রোপলিসে এই নেতা হলো মারিয়া। আকর্ষণীয় স্বর্ণকেশী ব্রিগেট হেলম অভিনয় করেছেন। দর্শক কেশহীন অন্যান্য কর্মী থেকে যাঁকে সহজেই আলাদা করতে পারেন। মারিয়া সবার সামনে থাকেন। আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং প্রতিটি দৃশ্যে দর্শককে মুগ্ধ করেন। এভাবেই তিনি নিপীড়িত-নির্যাতিত শ্রমিক শ্রেণির নেত্রী হয়ে ওঠেন।

লেনি রিফেনস্টাহল ট্রায়াম্ফ দেস উইলেন্সে নেতা হিসেবে মারিয়ার জায়গায় স্বয়ং হিটলারকে প্রতিস্থাপিত করেন। লো ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল এবং এক্সটেনুয়েটেড লাইটিং ব্যবহার করে রিফেনস্টাহল  দর্শকদের চোখে হিটলারকে মহান নেতা হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। সেখানে হিটলার ছাড়া বিশাল সমাবেশের অন্য কোনো ব্যক্তিকে ঠিক বোঝাই যায় না। সমাবেশের সম্মুখভাগে চলমান একটি ট্রাকের ওপরে হিটলার। চলচ্চিত্রের এক পর্যায়ে একটি জানালার ধারে বিড়ালের একটি শট দেখা যায়। হিটলার বিড়ালটির দিকে তাকাচ্ছেন এবং হাসছেন। যেন তিনি প্রাণীদেরও কত ভালোবাসেন। তিনি মহৎপ্রাণ নেতা। আবার তিনি ভিড়ের সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে আছেন একজন আদর্শ নেতা হিসেবে। তিনি সেখানে ঐক্য ও সাম্যের কথা বলেছেন, দাবি করেছেন যে, বিশ্বের অন্যান্য পরাশক্তির বৈষম্যের ফলে জার্মানি ধংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। এখন তারা জেগে উঠবে এবং সমতাভিত্তিক একটি আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তুলবে। চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে হিটলার বিশাল এক যুবসমাবেশের সামনে বক্তৃতা দিচ্ছেন। সেখানে তিনি স্পষ্টভাবে তার নাৎসি পার্টির সমঅধিকারের সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। যুবসমাজকে নাৎসি চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন, যেখানে কোনো জাতিভেদ বা শ্রেণিবৈষম্য থাকবে না।

সেই সময়ের বাস্তবতায় চলচ্চিত্রের এই বার্তাগুলি ছিল সত্যের অপলাপ মাত্র। হিটলার এবং গোয়েবলসের তত্ত্বাবধানে রিফেনস্টাহল চলচ্চিত্রকে একটি নাৎসি প্রচারমাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। মিথ্যা আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে তাদের পক্ষে টানাই ছিল যার উদ্দেশ্য। বাস্তবে, জার্মান সমাজের মধ্যে নিষ্ঠুর শ্রেণিরেখা টানা হয়েছিল। ইহুদি-বিদ্বেষ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের এই ঘৃণা এতটাই তীব্র ছিল যে, সমগ্র ইহুদি জাতিকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করে দিতে চেয়েছিল। নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সেইসব পৈশাচিক নির্মমতার গল্প আমরা জানি। জার্মান নাৎসি বাহিনীর এই ঘৃণা শুধু ইহুদিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাদের ঘৃণার ক্ষেত্র জিপসি, কমিউনিস্ট, সøাভ, পোল, এমনকি মানসিক প্রতিবন্ধী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তারা একটি ‘মাস্টার রেস’ বা উন্নততর জাতি তৈরির কথা বলে অন্যান্য সকল জাতি-গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে। এটাই ছিল তাদের বৈষম্যহীন ‘এক জাতি’ তৈরির মিশন।

শিল্পের কাজ মানবিকতার বিকাশ ঘটানো। সেখানে চলচ্চিত্রের মতো এমন একটি শিল্পমাধ্যমকে নাৎসি ফ্যাসিবাদী সরকার তাদের অমানবিক কার্যকলাপকে আড়াল করার কাজে ব্যবহার করেছে। মিথ্যা আদর্শ প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফ্যাসিবাদ বা নাৎসিবাদ এভাবেই শিল্পকে গ্রাস করে। গ্রাস করে শিল্পীর স্বাধীন সত্তা। সুযোগসন্ধানী শিল্পীরা তাঁদের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। ফ্যাসিবাদ জাতীয়তাবাদের মুখোশ পরে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। যেখানে জীবন বিপন্ন হয়, শিল্পীর স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয়, সেখানে কোনো শিল্প সৃষ্টি হয় না।

তথ্যসূত্র  

১. 1. Boland, William K., ‘Hitler’s Use of Film in Germany, Leading up to and During World War II’, New York : Inquiries Journal, vol. 2, 2010.

2. Bachmann, Holger, and Michael Minden, Fritz LangÕs Metropolis : Cinematic Visions of Technology and Fear, New York : Camden House, 2000.

3. McGilligan, Patrick. Fritz Lang : The Nature of the Beast, a Biography, New York : St. Martin’s Press, 1997.

4. Bordwell, David and Kristin Thompson, Film History : An Introduction, New York : McGraw – Hill, Inc., 1994.