প্রেম কিংবা প্রকৃতির গল্প

আমার দাঁতের চিকিসৎক গোল্ডিন কিছুটা ভ্রু কুঁচকে আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি নিশ্চয় রাতের বেলা দাঁত কিড়মিড় করো?’ 

গলার স্বরটি একই সঙ্গে প্রশ্ন করা আর বিচারিক রায় পড়ে শোনানোর মতো। তখন পর্যন্ত বাইরের পৃথিবীতে আমি একজন খুব স্বাভাবিক মানুষ। অন্তত এ-পর্যন্ত আমি তাই ভেবে এসেছিলাম। বাইরের পৃথিবী বলতে বোঝাচ্ছি যাদের সঙ্গে সম্পর্কটা পেশাগত। আমার কাছের মানুষেরা ইতোমধ্যে আমার অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে অবগত। আমার স্বামী, অর্ক, বলতে গেলে মেনেই নিয়েছে আমি এমনই। কারণ এমনটি থেকেই আমি সংসার, সন্তান পালন, সামাজিকতা এবং চাকরি-বাকরি সবই করে যাচ্ছি। খুব যে সেটি উচ্চমানের হচ্ছে তা নয়, তবে চলনসই। কিন্তু আমার মেয়ে মেঘা আমার এই অস্বাভাবিকতা মেনে নিতে পারছে না। এই যেমন হঠাৎ হঠাৎ আমার দাঁত কিড়মিড় করা। ঘরের মানুষেরা নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। অপরিহার্য কিন্তু অনুল্লেখ্য। কিন্তু ঘরের বাইরের ভাবমূর্তি নিয়ে আমরা অনেক বেশি সচেতন। এই মুহূর্তে গোল্ডিনের কাছে নিজের স্বরূপ স্বীকার করতে চাইলাম না। বললাম, ‘আমি আসলে কয়েকদিন ধরে বাদাম খাচ্ছিলাম। চিনাবাদাম। জানোই তো দাঁত কিড়মিড় করে বাদাম ভাঙতে হয়।’  

গোল্ডিন এবার গোয়েন্দার ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমার কাছে কিছু লুকাতে পারবে না।’

আমেরিকানরা সাধারণত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে এভাবে কথা বলে না; কিন্তু গোল্ডিন ব্যতিক্রম। মনে হয় আমার মতোই আমেরিকাতে প্রথম প্রজন্মের প্রতিনিধি। চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ বছর আগে পরিবারের সঙ্গে ইসরায়েল থেকে এই দেশে এসেছিলেন। ধর্মে ইহুদি, কর্মে কী তা জানি না। যে-কোনো ধার্মিক মানুষের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটালে বোঝা যায় তার বিশ্বাসের গভীরতা। যেমন আমার আরেক দন্তচিকিৎসক খালিফা। মাউথওয়াশ হারাম না হালাল, তা তাকে ভাবায়। কিন্তু গোল্ডিনের মধ্যে এসব কিছু দেখিনি। বরং বয়স্ক হওয়াতে স্বভাবের মধ্যে একটা দাদু দাদু ভাব আছে। এই যে আমি এখান থেকে দাঁত ঠিক করে অবশ মাঢ়ি নিয়ে বাড়ি যাওয়ার দুই-তিন ঘণ্টা পর গোল্ডিনের ফোন পাব। সব ঠিক আছে কি না জানতে চাইবে। একবার বলেছিলেন, ‘বুঝলে আমি কিন্তু পুরনো দিনের মানুষ। এখনকার চিকিৎসকদের মতো রোগীদের সঙ্গে দূরত্ব রাখি না।’

এজন্যই আমি গোল্ডিনের কাছে বারবার ফিরে আসি – তা খরচটা একটু বেশি হলেও। এখানে আমি দাঁতের চিকিৎসার থেকেও বেশি কিছু পাই। এই যেমন আজ জানতে পারলাম আমার অস্বাভাবিকতাটুকু, আমি চাইলেও তা ঢাকতে পারবো না। মেঘার যখন তেরো তখন থেকে সে প্রায়ই অভিযোগ করে বলে, ‘মা, প্লিজ আমার দিকে তাকিয়ে একটু স্বাভাবিক আচরণ করো।’ 

মেঘার এখন ষোলো বছর। আমিও মধ্যচল্লিশ অতিক্রম করলাম। এই তিন বছরে আমি কতটুকু স্বাভাবিক হয়েছি জানি না, তবে মেঘা কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে। সেই আগের চটপটে, উচ্ছল, পরিপাটি মেয়েটি আর নেই। দিন দিন ঝিমিয়ে যাচ্ছে। জীবন সম্পর্কেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বিষণ্নতার জন্য ওকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েটা আসলেই বিষণ্নতায় ভুগছে। এখন বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের বিষণ্নতা মহামারির মতো গ্রাস করছে। কিন্তু মেঘার ক্ষেত্রে আমি নিজেকেই দোষ দিই। গত তিন বছরে অন্তত তিনশো বার মেঘা আমাকে বলেছে, ‘মা, তুমি কিন্তু অস্বাভাবিক আচরণ করছো। একটু স্বাভাবিক হও।’  

মেঘাকে বারবার কথা দিয়েও আমি স্বাভাবিক হতে পারিনি। আমিও একজন মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিয়মিত যাই। ওরা ওষুধ দেয়। কিন্তু কীভাবে মগজের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ সুনামির মতো অকস্মাৎ চিন্তার ঢলগুলোকে আটকে দেওয়া যায় তা জানবো কী করে? 

দুই

ভার্জিনিয়াতে বর্ষাকাল বলে আলাদা কিছু নেই। বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ – এই তিন ঋতুতেই কমবেশি বৃষ্টি হয়। কখনো ঝিরঝির, কখনো অঝোরধারায়।  আর শীতকালে তুষারপাত, তবে তাপমাত্রা শূন্যের নিচে থাকলে। মাটি উর্বর আর আকাশ প্রায়শ আর্দ্র, প্রয়োজনমতো রোদেলা। চারপাশ গাছগাছালিতে ভরা। তারা আবার একেক ঋতুতে একেক রং গায়ে মাখে। এখন শরৎ চলছে। তাই রেডবাড, পাইন, পপলার, সাইপ্রেস গাছেরা ‘ফল কালারে’ সেজেছে। আমেরিকার ‘ফল কালার হলো বাসন্তি আর হলুদের সঙ্গে সামান্য লাল, কালো আর সবুজের মিশেল। কোমলি রুক্ষির বাড়িটা বলতে গেলে গহন বন-জঙ্গলের  আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক বিশাল দুর্গ। বন-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে তবেই এ-বাড়ির প্রবেশদ্বারে পৌঁছানো যায়। বাড়িটার বাইরের আবরণ দুর্গের মতো বড় বড় পাথরে আচ্ছাদিত। কোমলি আমার সমবয়সী। তবে সে যতটা না বান্ধবী তার থেকেও বেশি দার্শনিক গুরু। ছোটখাটো পেটানো শরীর, দেহে এক বিন্দু মেদ নেই। বেশ কালোও। কিন্তু ওর চোখের দিকে একবার তাকালে কোমলিকে আর কেউ সহজে ভুলতে পারবে না। দুটো কালো মণির মধ্যে প্রশান্তিময় গভীরতা। কীভাবে জানি ওর সঙ্গে আমার সখ্য হয়েছিল। মনের ভেতর যখন একরাশ শূন্যতা বোধ করি তখন ওকে একটা ফোন করে এখানে চলে আসি। ওর সম্পর্কে বলার মতো অনেক কিছুই আছে। অন্য কোনো গল্পে সেসব না হয় বলব। এখন বরং কোমলির সঙ্গে আমার কথোপকথন তুলে ধরি।

কোমলিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা শূন্যতা সম্পর্কে তোমার ধারণা কী?’   

‘এই মহাবিশ্বের এক ধ্রুব সত্য হলো প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। কথাটা গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের।’ 

‘এ তো পদার্থবিজ্ঞানের কথা। মানুষের মন তো অধরা। সে তো আর ইথার বা অণু-পরমাণুতে ঠাসা নয়। মনের ভেতর এতো শূন্যতা কেন?’ 

কোমলি রুক্ষি কোমল স্বরে বলল, ‘তুমি আধ্যাত্মিক শূন্যতার কথা বলছ?’

আমি মাথা নেড়ে সায় দিই। সে তার কথা চালিয়ে যায়।

‘মানুষ কেন অনন্য জানো? তারা নিজেদের মধ্যে একই সঙ্গে স্মৃতি আর কল্পনা তৈরি করতে পেরেছে বলে। এই দুয়ের সমন্বয়ে মানুষের ভেতরে একটা মন তৈরি হয়। যে-মন আসলে আবেগদের জন্য খেলার মাঠ। মগজে জন্মে ভাবনা আর তার রেশ ছড়িয়ে যায় মনে। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ঘৃণা-ভালোবাসা, ক্ষমা-প্রতিহিংসা মনের মধ্যে খেলে যাওয়া নানান আবেগের রূপ। এই ভাবনা আর আবেগকে মিশিয়ে আমরা গড়ে তুলি স্মৃতি আর কল্পনা। স্মৃতি আমাদের অতীতমুখী করে, আর কল্পনা ভবিষ্যতের দিকে টেনে ধরে। প্রত্যেকটা মানুষই এক-একটা টাইম মেশিন। এই টাইম মেশিনে চড়া মানুষের সঙ্গে বর্তমানের সম্পর্ক আলগা হয়ে গেলে তখনই সে নিজের ভেতরে এক শূন্যতা অনুভব করে।’ 

‘এর সমাধান কী?’ আমি ধরেই নিই কোমলি এর উত্তর জানবে।

‘টাইম মেশিনে না চড়ে বর্তমান সময়ের মধ্যে নিজেকে গেঁথে রাখা।’ 

‘সেটি  কীভাবে সম্ভব? পুরনো স্মৃতিরা বারবার ঘুরেফিরে আসে।’ 

কোমলি তার গভীর কালো চোখ দিয়ে আমার দিকে স্থির তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারছি সে চাচ্ছে আমি যেন আরো বিস্তারিতভাবে আমার ভাবনাটা শেষ করি। আমি কথা চালিয়ে গেলাম।

‘কোনো পুরনো স্মৃতি, যেখানে আমি ভিকটিম, সেই স্মৃতি এখনো আমাকে খুব যন্ত্রণা দেয়। আবার সেই স্মৃতিকেই প্রলম্বিত করে কল্পনায় একটা গল্প সাজাই। যে মানুষগুলো আমাকে যন্ত্রণা দেয় তাদের মুখোমুখি দাঁড় করাই। সেখানে চিৎকার করে তাদের বোঝাতে চাই যে, তারা কত খারাপ, তারা আমার সঙ্গে কতটা অবিচার করেছে।’  

‘এভাবে কি তুমি জিতে যাও?’

কোমলির এই প্রশ্নটির পর প্রথম অনুধাবন করলাম, যে কল্পনা আমি তৈরি করছি নিজেকে জেতানোর জন্য, তা আসলে আমাকে পিছিয়ে দিচ্ছে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা যায় না। ক্ষোভ দিয়ে ক্ষোভের স্মৃতি ভোলা যায় না। এই উপলব্ধি আমার খুব দরকার ছিল। কোমলির কাছে এলে প্রতিবারই চিন্তার নতুন খোরাক নিয়ে ফিরে যাই। আমার নীরবতা দেখে কোমলিই আবার কথা বলতে শুরু করে।

‘মানুষ তো আসলে আবেগের সমাহার, আমরা আমাদের আবেগ, অনুভূতি, চিন্তাভাবনা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হই। তাই আমাদের অতীতে জন্ম নেওয়া অপ্রকাশিত আবেগ-অনুভূতির গতিপথ বদলে দিতে না পারলে তা কোনো না কোনভাবে আমাদের জ্বালাবে, কিংবা পরবর্তীকালে তা অন্যভাবে ভয়ংকর রূপেও প্রকাশ পেতে পারে।’

‘আমার মেয়ে, এমনকি আমার দাঁতের ডাক্তারও বুঝতে পারে যে আমি ক্রমাগত  এক অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করছি।’

‘যুদ্ধ নয়, প্রেম দিয়ে সব কল্পনা মুড়ে দিতে হবে।’

আমি হাসলাম। ‘এই মধ্যবয়সে তুমি প্রেমের কথা বলছো? প্রেমের অনুভূতি তো ভুলেই গেছি।’

‘যতদিন পর্যন্ত জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে না মিলছে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের শূন্য হৃদয় প্রেম খুঁজে বেড়াবে। প্রেমসন্ধানীর বয়সের কোনো সীমা নেই। এ-প্রেম তারা খুঁজে বেড়ায় কখনো ধর্মে, কখনো কর্মে, কখনো সমাজসেবায়, কিংবা নিজস্ব কোনো ভালো লাগার জায়গায় অথবা মানবপ্রেমে।’

‘তোমার এ কথাগুলো আমার কাছে খুব দুর্বোধ্য ঠেকে। আর তুমি তো জানো শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠান আমাকে একটু কম আকর্ষণ করে। এতে সমস্যা হচ্ছে নিজের মতো করে নিজস্ব একটি আধ্যাত্মিক পথ খুঁজে নিতে হচ্ছে। সে-কাজটিও সহজ নয়। বই পড়তে ভালো লাগে। কিন্তু এখন আর তেমন ফোকাস করতে পারি না।’

‘স্মৃতি আর কল্পনা তোমাকে সবসময় দোলকের মতো দোলাতে থাকে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি বললে তোমার স্মৃতিগুলোকে প্রলম্বিত করে কল্পনা তৈরি করো। সেখানে এমন কোনো কল্পনা নেই যাতে প্রেম এসে ধরা দেয়?’ 

‘কিন্তু সেসব তো পরমাত্মা ঘরানার প্রেম না। সাধারণ মানবপ্রেম।’

কোমলি একটু হাসলো। তখন দেখা যায় তার দাঁতগুলো কি অসম্ভব সাদা, দ্যুতিময়। একেই কি বলে মুক্তার মতো দাঁত?  

‘প্রেম হচ্ছে আমাদের হৃদয়ের একটি অপার্থিব অনুভূতি। আমরা মনে করি, প্রেম মানুষকেন্দ্রিক। আসলে কিন্তু তা নয়। মানুষ হচ্ছে প্রেমের আধার, কলসির মতো। প্রেম হচ্ছে তার ভেতরের পানি। একবার প্রেমের নদী হৃদয়ের মধ্যে বইতে শুরু করলে আর আধারের দরকার হবে না।’  

চাইলেই সব কথা সবাইকে বলা যায় না। কোমলিকে আমি বলতে পারি না সোপানের কথা। ইদানীং সোপানের সঙ্গে আমার অনেক কথা হচ্ছে। আমাদের মধ্যে তেরো হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব। এগারো ঘণ্টা সময়ের ব্যবধান। নিজেদের সংসার, চাকরি আর সামাজিকতা মিলিয়ে কথা বলার জন্য খুব যে সময় মেলানো যায় তা নয়; কিন্তু যখন কথা হয় তখন কোনো অতীত থাকে না, ভবিষ্যৎ থাকে না – শুধুই বর্তমানের মধ্যে বাস। শুধুই ভালো লাগা। এই কথোপকথনের সম্পর্ককে কী নামে অভিহিত করবো? 

আমাকে ভাবমগ্ন দেখে কোমলিই আবার শব্দ তৈরি করলো, ‘রিমু, তুমি ডায়েরি লেখো?’

‘আগে লিখতাম। এখন আর লেখা হয় না।’

‘আবার লেখা শুরু করতে পারো। আমাদের অনেক ভাব ধ্বনিতে উচ্চারণ করতে পারি না; কিন্তু অক্ষরে লিখতে পারি। এতেও মন পরিষ্কার হয়।’

আমি নিশ্চিত হলাম কোমলি মানুষের মন পড়তে পারে। সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে ঘন বাসন্তি সাজে সজ্জিত

বন-বনানীর মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া উঁচুনিচু পিচঢালা পথ ধরে নিজের বাসায় ফিরে আসি। 

তিন

সোপানের সঙ্গে আমার পরিচয় খুব হঠাৎ করেই। ঠিক পরিচয় নয়, বরং নতুন করে যোগাযোগ স্থাপন। এর পেছনের গল্পটা বেশ মজার। একটা সময় আমি কবিতা পড়তে খুব ভালোবাসতাম। আমেরিকা আসার পর আর কবিতা পড়া হয়নি। সেই বিশ বছর আগে দেশ থেকে আসার সময় একটা কবিতার বই এনেছিলাম। দুই বাংলার প্রেমের কবিতা। শামসুর রাহমান আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত। বইয়ের তাকের দ্বিতীয় সারিতে চুপচাপ সেটি হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেকদিন পর তাকে বের করলাম। এতো পুরনো বই কিন্তু এই প্রথম মলাট খুলে আবিষ্কার করলাম, এই বইটি আমাকে কেউ একজন উপহার দিয়েছিল। কিন্তু উপহারদাতা নিজেকে গোপন রেখেছে। প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা আছে …

কবিতার মতো সুন্দর হোক জীবনের ছন্দ, এলোমেলো শব্দ নতুন সাজে সেজে

জন্ম হোক একটি নতুন কবিতার, জীবনের সব চাওয়া পরিপূর্ণ হোক পাওয়াতে,

… এ অসীম কামনায়,

আমি

২১শে জুলাই, ৯৪ইং

১৯৯৪ সালে লেখা আর আমি সেটি আবিষ্কার করি ২০২০ সালে। এই ব্যাপারটা নিয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিই। ‘সহৃদয় কেউ আছেন কি যিনি হাতের লেখা শনাক্ত করে ছাব্বিশ বছরের পুরনো বন্ধুকে খুঁজে দিতে পারবেন?’ আমার ফেসবুকের বন্ধুতালিকায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পুরনো বন্ধু-বান্ধবী আছে। তবে অধিকাংশই নিষ্ক্রিয় – অন্তত আমার সঙ্গে। এই পোস্টের পর অনেকেই সাড়া দিলো। তবে দুষ্টুমি করলো বেশি। অনেকেই লিখলো, ‘এটি তো আমার হাতের লেখা।’ সে-সময়টাতে অনেকের সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব জমে ওঠে। আলাদা করে ফেসবুকে একটা গ্রুপ তৈরি করে অন্তর্জালে সরব আর সরস আড্ডাখানা গড়ে তুলি আমরা। এখানে সবাই সমবয়সী নারী-পুরুষ। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি। যখন যার সময় হয় তখন সে এই আড্ডাখানায় এসে উঁকি মারে। এর মধ্যে থেকে সোপানের সঙ্গে আমার আবার আলাদা করে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমি দেশে একজন উকিলের খোঁজ চাইছিলাম আর সোপান আমাকে সেই খোঁজ দেয়। আমাদের বন্ধুত্বের শুরু এভাবেই। মধ্যচল্লিশে আমরা মাঝে মাঝে আঠারো বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের মতো প্রগলভ হয়ে উঠি। উপলব্ধি করি বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে বয়সের আসলে নির্দিষ্ট কোনো চরিত্র নেই। আমাদের বয়স কখনো আঠারো, কখনো পঁচিশ, কালেভদ্রে চল্লিশ বা পঁয়তাল্লিশ। একঘেয়েমি জীবনে যখন বৈচিত্র্য শব্দটাকে ভুলতে বসেছি ঠিক তখনই এ এক ঝড়ো বাতাস। নিত্যকার সম্পর্কগুলোতে তখন অনেক মরিচা পড়ে গেছে। বিশের কোঠায় যখন ছিলাম, জীবন ছিল স্বপ্নময়, গতিশীল। তা এখন অনেকটাই মন্থর। দশ বছর আগেও মনে হতো, এমন জীবনই তো চেয়েছিলাম, তবে তা এখন মুখ থুবড়ে পড়লো কেন? হতে পারে নিত্যকার জীবনসঙ্গীর কথায় দিন দিন হীনমন্যতায় ডুবে যায়। কিংবা অফিসের বস মনে করিয়ে দেয় আমি আসলে একজন ক্রীতদাস। ক্রমশ একটি অতল গহ্বরের গহিনে তলিয়ে যেতে যেতে যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় পার করছিলাম, তখনই হঠাৎ খপ করে সোপান আমার হাতটি ধরে ফেললো। অনেকদিন পর আমি একটি সিঁড়ির সন্ধান পাই। আবার আলোর দিকে হাঁটার শক্তি সঞ্চয় করি এবং হ্যাঁ, প্রেমে পড়ি। কোমলি ঠিক কথাই বলে, প্রেম একটি শক্তির মতো। মানুষকে তা আশা দেখায়, জাগিয়ে তোলে। অতীতের সব অসমাপ্ত গল্পকেও একটি প্রেমময় উপসংহারের দিকে গতিশীল করে। আমি আবার আগের মতো হাসতে শিখে যাই। তারপরও সোপানের সঙ্গে প্রেমের সংলাপে প্রগলভ হয়ে যাই না। বন্ধুত্বের দূরত্ব রাখি। আমার বাৎসরিক স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কর্কট রোগের মতো একটি সন্দেহজনক ফল আসে। সোপানকে যখন এই কথা বলি এইভাবে, ‘আমার মনে হয় জীবনে স্বপ্নপূরণ করার মতো আর কোনো স্বপ্ন নেই। বেঁচে থাকার আর কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পাচ্ছি না। এক মেয়েকে নিয়ে চিন্তা ছিল। মেয়েও এখন অনেকটা নিজেকে সামলে নিয়েছে। তাই স্রষ্টা হয় আমাকে সতর্ক করছেন, নয়তো আমার জীবনের যতি টানতে চাইছেন।’

সোপান বলে, ‘তুই বরং একটা প্রেম কর। এতে বেঁচে থাকার একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পাবি।’

‘কার সঙ্গে? এই বয়সে আমার সঙ্গে কে আবার প্রেম করবে?’

‘সেটা আমি দেখবো। তোকে ভাবতে হবে না।’

‘কিন্তু যেনতেন একটা  প্রেম তো আমি করতে পারি না। যার সঙ্গে করব তার সেন্স অব হিউমার খুব উঁচু দরের হতে হবে আর তাকে হতে হবে অনেক সুদর্শন।’  

‘তুই তো দেখি একদম আমার বর্ণনা দিলি। প্রেম করবি আমার সঙ্গে?’

‘বন্ধুত্ব থেকে সহজেই প্রেম হয়। কিন্তু প্রেম থেকে বন্ধুত্বে ফেরা যায় কি?’

‘মনে হয় না।’

‘‘নর-নারীর প্রেমের স্থায়িত্বকাল বড়জোর দুই বছর। দুই বছর পর আমাদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। সেটা কি ঠিক হবে?’

‘আমরা না হয় দু-বছরের জন্য প্রেম করলাম।’

‘কিন্তু আমি তো তোর সঙ্গে সারাজীবন বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখতে চাই।’ 

‘প্রেম আর বন্ধুত্বের পার্থক্য কি?’

‘প্রেম হলো সব বাধ ভেঙে কাছে আসা আর বন্ধুত্ব হলো নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া।’

‘তুই এতো সুন্দর কথা বলিস কী করে?’

খুব সুন্দর করে প্রশংসা করে বলে, আমার ধারণা, সোপানকে আমার এতো ভালো লাগে। একটু প্রেম প্রেম ভাব করে বটে কিন্তু ওই পর্যন্তই। এর নাম দিয়েছি ইটিশ-পিটিশ প্রেম। হলে হলো, না হলেও সমস্যা নেই। অতীতেও যতবার প্রেমে পড়েছিলাম তার সবই ছিল অধরা। সব গল্পই অসমাপ্ত। অশরীরী শক্তির মতো অতৃপ্ত অনুভূতিগুলো একটি সমাপ্তির পথ খুঁজে বেড়ায়। কেমন হয় সোপানের সঙ্গে একটি প্রেম শুরু করে একটি পূর্ণ সমাপ্তির পথ টানলে? অনেকটা সরল অংক মিলিয়ে ফেলার মতো। এই বয়সে? তারপর যখন দুজনেরই সংসার আছে? কিন্তু এটা তো একবিংশ শতাব্দী। আমরা বুঝে গেছি আগের দিনে ছেলেমেয়েদের মেলামেশায় আড়াল আর বাধা এতো বেশি ছিল বলে প্রেমকে অতিরঞ্জিতভাবে মহিমান্বিত করা হতো। তখন প্রেমের মানে করা হতো দুটো মানুষকে সারাজীবন একসঙ্গে সংসার করা, সন্তানের জন্ম দেওয়া। এভাবে শর্তাধীন করে প্রেম বিষয়টিকেই পানসে আর ছিবড়ে করে ফেলা হতো। তাই একসময় বিবাহিত মানুষের মধ্যে প্রেম মরে যায়। তখন মানুষ নতুন প্রেম খুঁজে ফেরে। উদারনৈতিক পশ্চিমা বিশ্বে অর্ধেক সংসারই ভেঙে যাচ্ছে। রক্ষণশীল সৌদি আরবে ভাঙছে এক-তৃতীয়াংশ। সংসার এখন যেন তাসের ঘর। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভাঙা সংসারের সন্তানেরা। বাস্তবতা হলো, সংসার হলো অনেকটা চাকরির মতো। এখানে প্রেমের থেকেও দায়িত্বশীলতা, বিশ্বাস-আস্থা, শ্রদ্ধাবোধ আর নির্ভরতার বাতাবরণ দরকার। সংসার প্রেমনির্ভর নয়, তবে তাহলে ভালো হয়। আগের থেকে এখন অনেক সম্পন্ন, সচ্ছল ও চৌকষ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এখন মানুষের সঙ্গে মানুষের মিথস্ক্রিয়ার ব্যাপ্তি বিস্তৃতিময়। এই নতুন সময়ে চলছে অনেক ভাঙাগড়ার খেলা। অন্তর্জালে পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী-পুরুষের নতুন নতুন বন্ধু-সমাবেশ তৈরি হচ্ছে। মাঝেমধ্যে নিত্যনৈমিত্তিক সংসার আর প্রাত্যহিক কর্মজীবন থেকে ছুটি নিয়ে তারা চলে যাচ্ছে দূরে কোথাও, খুঁজে নিচ্ছে নাটোরের বনলতা সেনের শান্তির পরশ। সামর্থ্যবানরা এখন আর অতো সহজে বুড়ো হতে চাইছে না। এখন পঞ্চাশ বছর মানে ত্রিশের তারুণ্য, সত্তর হচ্ছে নতুন করে পঞ্চাশে ফিরে যাওয়া। মানুষ এখন বাঁচে অনেকদিন। তারা এখন বাঁচার মতো করে বাঁচতে চাইছে। সমবয়সী বন্ধুরা তাদের ভবিষ্যৎ বৃদ্ধনিবাস নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। বন্ধুরা সব একসঙ্গে থাকতে পারলে আর ভয় কী? 

দশ বছর আগে হলেও আমার রক্ষণশীল মানসিকতা সোপানের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বকে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্নের মাথায় ঝুলিয়ে রাখতাম। নতুন সময় বুঝতে শিখিয়েছে পরিবর্তনের ঝাঁকুনিতে অনেক নিয়মকানুনই বদলে যায়। একবার বদলে গেলে তা আর আগের স্থানে ফিরে আসে না।     

চার

গোল্ডিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, এই এক বছরে তোমার দাঁতের এতো উন্নতি করলে কী করে?’  

পাশের রুম থেকে ফ্রান্সিস বলে উঠলেন, ‘আমার পরামর্শে। আমি ওকে পানির ফেঁসো (হাইড্রো ফ্লস) আর বৈদ্যুতিক দন্তধাবন (ইলেকট্রিক টুথব্রাশ) ব্যবহার করতে বলেছিলাম।’  

ফ্রান্সিস এখানকার আরেক দন্ত চিকিৎসক। বয়স ষাটের ওপরে হবে। কিন্তু প্রাণশক্তিতে ভরপুর। রসবোধ তীক্ষè। কাঁচাপাকা চুলগুলো মাথার চূড়ায়  উঠিয়ে একটা বড়সড় খোঁপা করে। দু-হাতের অনামিকা আর মধ্যমায় মোট চারটি আংটি পরা। হীরার আংটিটা নিশ্চিতভাবে বিয়ের আংটি। বেশ বড়সড়। তিন ক্যারেট তো হবেই। নিশ্চয় বিয়ের সময় এতো দামি আংটি পায়নি। এদেশে অনেকেই ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে বিয়ের আংটির ক্যারেট বাড়িয়ে নেয়। তবে যদি বিয়েটা টেকে আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থার উন্নতি হয়। ফ্রান্সিস তার রুমে বেশ কয়েকটি পারিবারিক ছবি টানিয়ে রেখেছে। স্বামী, দুই মেয়ে আর চার নাতি-নাতনি নিয়ে তার বেশ সুখের সংসার। অন্তত ছবির ফ্রেমে। গোল্ডিনের রুমে আছে বেসবল আর আফ্রিকায় তার স্বেচ্ছাসেবক দলের নানান কর্মকাণ্ডের ছবি। বছরে একবার সশরীরে আফ্রিকায় গিয়ে সেখানকার দরিদ্র মানুষদের ওরা বিনে পয়সায় চিকিৎসা দেয়। তবে পারিবারিক ছবি না দেখলেও গোল্ডিনের কথায় বুঝতে পেরেছি, তারও এক হালি নাতি-নাতনি আছে। সে আর ফ্রান্সিস প্রায়ই তাদের নিয়ে গল্প করে। গোল্ডিন একদিন আমাকে মজা করে বলেছিলেন, ‘ফ্রান্সিস আর আমি গত ত্রিশ বছর ধরে একসঙ্গে কাজ করছি।

প্রথমদিকে আমরা আমাদের সন্তানদের নিয়ে গল্প করতাম, এখন করি নাতি-নাতনিদের নিয়ে।’ 

এই দুই সহকর্মীর বন্ধুত্বের সহজতা আর গভীরতা অনেক। একসঙ্গে ওরা ওদের তারুণ্য আর মধ্যবয়সটা অতিক্রম করেছে। এখনো তাদের বন্ধুত্ব অমলিন। অবশ্য আমেরিকায় ছোটবেলা থেকেই তো ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে মিশছে। সোপানের সঙ্গে বন্ধুত্বটা এগিয়ে নিয়ে যাব কি না সেটি নিয়ে যখন দ্বিধায় ছিলাম তখন গোল্ডিন আর ফ্রান্সিসের বন্ধুত্ব আমাকে সাহস জোগায়। মনের গতিপথ বদলে দিতে পেরেছে। যে-সম্পর্কে উপকার বেশি সে-সম্পর্ককে ভয় কেন? 

‘বোকামিটা হচ্ছে নারী-পুরুষের সম্পর্ককে শুধু প্রেম বা বিয়ের আবরণে ভাবা।’

কথা হচ্ছিল নীলার সঙ্গে। গোল্ডিনের দন্ত-কামরা থেকে বের হয়ে কাছেই পট বেলি রেস্তোরাঁয় এসেছি। নীলার কার্যালয় কাছেই। আগে থেকেই কথা ছিল এখানে আমরা দুপুরের খাবার খাব। সদ্যই মেরামত করা দাঁতের ওপর চাপ না দেওয়ার জন্য ব্রকলি-চেডার স্যুপ খাচ্ছি। নীলা নিয়েছে একটা টুনা স্যান্ডুইচ। নীলারও অন্তর্জালে ধ্রুব নামে একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ চলছে। দেশে ওরা একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসক হয়েছে। তবে ধ্রুব নীলার আট বছরের ছোট। সার্টিফিকেট অনুযায়ী। ধ্রুব অবশ্য নীলাকে কামোদ ঘরানার ক্ষুদে বার্তা পাঠায়। আমেরিকার মিনোসোটা স্টেটে থাকে। সে আবার নীলার সঙ্গে দেখা করতে চায়। নীলা বলল, ‘ধ্রুব যখন আমাকে সেক্স-টেক্সট করে তখন তাকে বকে দিই। কিন্তু মনে মনে আবার ভালোও লাগে।’

‘আমার মনে হয় ধ্রুব শুধু তোমাকেই না, ওর আরো অনেকেই আছে যাদের সে এমন টেক্সট পাঠাচ্ছে। তোমার সঙ্গে পরিচয়ের দিন থেকেই যখন এমন করছে, তার মানে এটি তার অভ্যাস।’    

‘আমারো তাই মনে হয়।’

‘দেখা করতে চাইলে দেখা করো না। হয়তো তুমি কিছুই করলে না কিন্তু সে গল্প বানিয়ে ফেলবে। কয়টা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করতে পারছে তার ওপর ভিত্তি করে এখন অনেকেই ক্রেডিট নিতে চায়।’

‘একবার সে হঠাৎ করেই আমাকে টেক্সট করা বন্ধ করে দেয়। তখন আবার আমার সেটাও খারাপ লাগতে থাকে।’

‘আবার শুরু করে কোন ঘটনার পর থেকে?’

‘ফেসবুকে আমি একটা স্কার্ট পরা ছবি দিয়েছিলাম। তখন সে লিখলো – ‘এমন ছবি দেবে আবার ভাজা মাছটি উলটে খাই না এমন ভাব করবে, তা কী করে হয়।’

‘এ তো দেখছি খুব আগ্রাসী মনোভাব। একটা মেয়ে ফ্যাশনেবল পোশাক-আশাক পরে ছবি দিলেই তা অপর লিঙ্গকে মুগ্ধ করার জন্য দিয়েছে এমন মনোভাবের মানুষজনকে আমার খুব সংকীর্ণ লাগে।’

‘আমি কি ভুল করছি?’ নীলা খুব সরলভাবে জিজ্ঞেস করলো।

‘তুমি তো কারো ক্ষতি করছো না, আবার যা করেছো তা নিজের ইচ্ছাতেই করেছো। কেউ প্রশংসা করলে তা নিলে খারাপ হবে কেন? তবে কেউ ফাঁদ তৈরি করলে সেখানে ধরা দেওয়া হবে বোকামি। আমার মনে হয়, এই বোকামি না করার মতো বুদ্ধি তোমার আছে। এখনকার মতো এই সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ আগে কখনো আসেনি। তাই এখনকার সময়কে আগের সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। খুব রক্ষণশীল মনোভাবও সমস্যার সমাধান করে বলে মনে হয় না। আমার বড় বোন মেয়েদের ফ্যাশনেবল কাপড়-চোপড় পরা, ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করাকে খুব খারাপ চোখে দেখে। অথচ ঘুষের টাকায় বড়লোকি, মিথ্যা কথা বলা, এমনকি ভাইবোনদের সম্পত্তি চুরি করার মতো কাজগুলো বোন আর দুলাভাই অনায়াসে করছে। এর খারাপ প্রভাব তাদের মেয়েদের ওপরও পড়ছে। আশপাশের মানুষজনের অবস্থা দেখে সত্যিই আমার বিশ্বাস হচ্ছে যে, পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না।’

‘আমার খালাতো বোনের অবস্থা তো আরো খারাপ। দুজনেই খুব ধার্মিক। ভেবেছিলাম ওদের জীবনে কোনো সমস্যা নেই। পরে শুনলাম গত দশ বছর ধরে তাদের পুরোপুরিই সেক্সলেস জীবন। দুলাভাই পর্নে আসক্ত এবং সেখানেই হাত দিয়ে কাজ চালাচ্ছে আর পাশে দাঁড়িয়ে বোন কাঁদতে থাকে।’

‘দুঃখজনক। একটা মোটামুটি ভালো জীবন কাটানো যে লেখাপড়ায় খুব ভালো করার থেকেও খুব কঠিন তা আমাদের আগে কেউ বলে দেয়নি। আমার কাছে চাকরিও চাকরি আবার বিবাহিত জীবনটাও একটা চাকরি। দুটোকেই ঠিকঠাক রাখতে গেলে অনেক শ্রম দিতে হয়।’

নীলাও এ-ব্যাপারে একমত। নীলাকে আমি আর সোপানের কথা বলিনি। অবশ্য সোপানের কথা আমি আর কাউকে বলিনি। এমনকি কোমলিকেও নয়। কারণ সোপানকে অনেক সময় আমার বাস্তব কোনো চরিত্র বলে মনে হয় না। মনে হয়, হঠাৎ কোনো কল্পলোক থেকে এক দেবদূত এসেছে আমার মনের জখম সারিয়ে দিতে। এই মাঝবয়সে এক ধরনের দমবদ্ধ করা অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে। আমার যে আরো অনেক কিছু করার ছিল তা মনে করিয়ে দিতে। আমাদের মধ্যে যে খুব একটা কথা হয় তা নয়। আবার যখন হয় তখন সেখানে কোনো লালসা থাকে না, কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসাব থাকে না। দুজনই দুজনকে আরো উচ্চতায় তুলে ধরতে চাই। সেখানে প্রেম আছে; কিন্তু এমন প্রেম যেটি আমার অতীতের সব দুঃখময় স্মৃতি থেকে আমাকে বের করে এনেছে। গোল্ডিন তো বটেই আমার মেয়ে মেঘাও বিষয়টি লক্ষ করেছে। আমি আসলেই মেঘার আয়না। মেয়েটা আমার আবার হাসিখুশি হয়ে উঠছে। কোমলি যে আধ্যাত্মিক প্রেমের কথা বলেছিল তার থেকে এর পার্থক্য কোথায়?  অনেকদিন কোমলির সঙ্গে দেখা হয় না। আমার ভেতরে অনেক কথা জমে আছে। কোমলি ছাড়া আর কেউ তা বুঝতে পারবে না। পট বেলি থেকে বেরিয়ে গাড়ি ঘোরালাম কোমলির বাসার দিকে। কোমলির বাড়িতে যেতে হলে অনেকখানি পথ বন-বনানীর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। পথের দুধারের ঘন সন্নিবেশিত গাছগাছালি-সাজসজ্জা দেখলে বোঝা যায় ভার্জিনিয়াতে এখন কোন ঋতু চলছে। বরফের সাদা কার্পেটের ওপর শ্বেতশুভ্র পোশাকে গাছগাছালি দাঁড়িয়ে আছে। এ-দৃশ্য মনকে দ্রবীভূত করে, পবিত্র করে। আমি এখন আরো আলোকিত হওয়ার পথে।