পোষা প্রাণ

মিনির বিড়ালের সঙ্গে ভুলুর কুকুরের বিসম্বাদটা শুরুই হলো নাম দিয়ে। নামের প্রসঙ্গটা হাতে বানানো বড় কাগজের পাখি হয়ে ফরফর করে চারপাশে উড়লো। 

তা ওরা ওদের পছন্দের নাম রাখতেই পারে, তাতে কী সমস্যা! কিন্তু কথা ঘন হয়ে ওঠে নিজেদের নামধাম দেওয়া-নেওয়ার সময়।

– তুমার নাম কী? 

– ভুলু।

– ভুলু তো কুকুরের নাম!

মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা, রোদে পুড়ে যাওয়া তামা রং ঢ্যাঙা ছেলেটার।

‘কে কইছে?’ – প্রশ্ন ছুড়ে হাতের লাঠি দিয়ে রাস্তার পাশের শিশু তুতগাছে

বাড়ি মেরে পাতা ঝরিয়ে দেয়। যেন পাতাদের ওপর শোধ তুললেও একরকম জবাব

দেওয়া হবে।

– ক্যান ইস্কুলের বইতে গল্প আছিল না?

ছাপা শাড়ির আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে টরটর করে কথা বলা মেয়েটা ফাজিলের ফাজিল। ইস্কুলে গেছে কি না কে জানে? সেটা আর জানতে চায় না ভুলু। বরং সে তক্কে তক্কে ছিল। 

একদিন বাজারের মাছপট্টির কাছে বিড়ালছানা কোলে পথ আটকে ছিল, ‘নাম কী?’ 

– ‘অর নাম কাজল।’ বিড়ালের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে লাজুক জবাব আসে।

মেয়েটিকে বোকা বানানোর খুশিতে হেসে ফেলেছিল ভুলু, ‘বিলাইয়ের নাম তো জিগাই নাই, তুমার নাম কও।’

– আমার নাম মিনি।

এবার ঠাঠা করে হাসে ভুলু – ‘মিনি তো সিধা বিলাইয়ের নাম।’

এবার মিনি ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়ায়, ‘কে কইলো?’

‘ক্যান ইস্কুলের বইতে আছে না?’ ভুলু উদাত্ত গলায় বলে।

– ইস্ কত য্যান ইস্কুলে যায়!

তুতগাছের সবুজ পাতার রং

যে-সময়টায় কালচে দেখায় তেমন সময়ের সন্ধ্যাবেলা ছিল, পাতাগুলো হাওয়া দিচ্ছিল যেন হাত নেড়ে কোরাস গাওয়া কোনো গানের দল। মানুষের শান্ত মনের মতো। মিনি-ভুলু দুজনে কিছু সময় দাঁড়িয়েছিল রাস্তার পাশে। ধুলো-ময়লার জটপাকানো রাস্তার ঢাল। সেদিকে অভ্যাসবশে দেখেছিল, নিজেদের মনে হচ্ছিল এসব থেকে দূরের। তাদের ভেতরের উদ্বেগ সুরুৎ করে বেরিয়ে এসে হাত ধরেছিল পরস্পরের। ওই একদিনই। 

ভুলুর মনে হলো মিনিই সই। মিনির মনে হলো ভুলুই ঠিক।

তারপর পাড়া-প্রতিবেশী উল্টাপাল্টা কিছু বলার আগেই এক মধ্যরাতে মিনির মা তাকে কাঁথার ওম থেকে ঘুম ভাঙিয়ে ভুলুর সঙ্গে কলেমা পড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দিলো। ভুলু সামান্য গা-মোচড় দিলেও শেষমেশ বাধ্য ছেলের মতো রুমাল নাকে চেপে কবুল বললো। গা-মোচড়ের সময় তার মনে পড়ছিল নিজের বাপ, নদীভাঙা ভিটার ওপরে ডুবে যাওয়া সূর্যের গাঢ় লাল আলো, মায়ের মরা মুখটা। তবে ভাই-বোন না থাকার সুবিধার কথা ভেবে শরীরের ভেতর আরেক শরীর সটান হয়েছিল।   

আড়মোড়া ভেঙে ঘুম ঘুম চোখে মাটির কলসিতে রাখা পানি দিয়ে গোসল সেরে বেগুনি রঙের শাড়ি পরে বিয়ে হওয়া নিয়ে দীর্ঘ একটা আক্ষেপ আছে মিনির। 

তাদের বিয়ের বয়স ছয় বছর।

এখন অবশ্য তার লাল জরিপাড় শাড়ি হয়েছে, মাঝে মাঝে নতুন করে বউ সাজার মহড়াও দেয়। লিপস্টিকটা, টিপটা দেয়। ভুলু তাকে রাত্রিকালে হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের সঙ্গে তুলনা দিয়ে ভালোবাসে। কিন্তু সকালে কোনো উদ্ভট কারণে তার মেজাজ খিচড়ে গেলে চড়-থাপ্পড় মারে। মিনির তখন রাতের আদর ফেরত দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কী কারণে ভুলুর মেজাজের এই উত্থান-পতন – এই ভাবনায় কাতর হয়।  

এসব সময় শারুক খান এসে সামনের দু-পা তুলে আহ্লাদপনা করে, রাগে মিনির গা জ্বলে যায়; কিন্তু পরক্ষণেই কাছে ডাকে, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। ভাবে, কে-ই বা আছে তার শারুক ছাড়া!

খোলতাই মেজাজ থাকলে যেমন করে ভুলুও বলে – ‘আমি কত বনবাদাড়ে  ঘুরাঘুরি করি। তোরে পাহারা দিতে শারুক খান আছে।’

শারুক খানের ইতিহাস সোজাসাপটা।

তখনো বাড়ি মানে উপজেলা গেস্ট হাউসের পেছনে কর্মচারীদের থাকার একটা আটফুটি ঘর, মেঝে-দেয়াল পাকা, ওপরে টিন – এই বাড়ি না। ততোদিনেও ভুলু এই গেস্ট হাউসের দারোয়ান কাম বাবুর্চি হয়নি। সে তখনো সিক্স কেলাসের পড়া বাদ দিয়ে ঘোড়াজান গেরামের নদীভাঙনে ভিটা বিলীন হয়ে যাওয়া বাপের ছেলে হয়নি।

বাপ তার ক্লাস এইট ফেইল করে আর না পড়া ছেলেকে শ্যালো নৌকায় তুলে দেওয়ার সময় সিরাজগঞ্জে গিয়ে রিকশা বা ভ্যান চালানোর বদলে আর কী করা যায় তার তত্ত্বতালাশ করতে বলেছিল।

প্রবল বন্যায় ঢোঁড়া সাপের লেজ আঁকড়ে ধরার মতো বাপের দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই সরকারি অফিসের কেরানীকে আঁকড়ে ধরায় সে শ্বাস নিতে পেরেছিল। এক হিসেবে শারুক খানকেও পয়মন্ত মানে ভুলু।

যেদিন সে চাচার বাসা খুঁজতে এসে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে বাজারে গিয়ে কাজ খুঁজবে, নাকি ভিক্ষে করা শুরু করবে – এমন দোটানার সঙ্গে লড়ছিল, তখন বাজারের অবিন্যস্ত কুকুরদের একটি, ভুলু যে মুদিদোকানের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে বিস্কুটের প্যাকেট মুখে করে এক দৌড়ে ভুলুর পায়ের কাছে রেখে দিয়ে জিভ বের করে হ্যাহ্ হ্যাহ্ করতে থাকলো। ভুলুর তখন স্থাণু দশা। মুদিদোকান থেকে কাউকে লাঠিসোটা হাতে বের হতে না দেখে সে নিশ্চিত হতে চাইলো যে, বিস্কুটের প্যাকেট কেউ স্বেচ্ছায় কুকুরটিকে দিয়েছে।

বিস্কুট খেয়ে সুস্থির হয়ে চাচার বাসা খুঁজেছে ভুলু। তার পিছে পিছে নেড়ি কুকুরটা। বুদ্ধিমান প্রাণী, বাড়ির ভেতরে ঢোকেনি। ভুলু কস্মিনকালেও ভাবেনি যে, পরদিন সকালে তাকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে এবং তার পরদিন, তারও পরদিন। এর জন্যই সে না খেয়ে মরে যায়নি এবং পরে ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসের বাগান নিড়ানির কাজ জুটেছে।

তার মতো কাগজে-কলমে মালি আরো তিনজন। ভুলু এদিক-সেদিক এডিসি, ম্যাজিস্ট্রেটদের বাগানে দিন পার করতে করতে একদিন দুই নম্বর অতিথিশালার বাবুর্চি কাম দারোয়ান বনে গেল।

কারণ ছিল। আসন্ন নির্বাচনি প্রচারণায় সার্কিট হাউস ছাড়াও থাকার জায়গা লাগে। কে আর মফস্বলী আধময়লা আবাসিক হোটেলে থাকে, সে থাকায় মান-সম্মান কই? এডিসি সাহেব কামেল লোক। অব্যবহৃত এই বাড়িটা সরকারি বয়েজ হাইস্কুলের পেছনে, দেয়ালের গায়ে সবুজ শ্যাওলার আস্তর, সামনে বিরাট পুকুর। পুকুরের মজা শ্যাওলার ছাঁট এসে দেয়ালের গায়ে জায়গা করে নিয়েছে। তখন তখন পুকুরে হাত দেওয়া যায়নি, কিন্তু ভেতরে ঘর চারটার হালসুরত ফিরিয়ে, নতুন তোশক পেতে সাদা চাদর বিছিয়ে আরামদায়ক বিছানা বানিয়ে দিলে, সেই সঙ্গে ওয়ারড্রোব, চেয়ার-টেবিল বসিয়ে নিলে দেখতে আবাসিক হোটেলের চেয়ে  খারাপ হলো না। তা ভুলু খাটাখাটনি কম করেনি। চাচার মোক্ষম বাণী মন দিয়ে শুনে কাজে দিয়েছে – ‘পয়লা পরথম খাটবি। নিজের জাগা পোক্ত করা দিয়া কথা।’

পোক্ত হয়েছে বলেই তো মনে হয় ভুলুর। সরকারি খাতায় বাবুর্চি হিসেবে নাম ওঠা কি সোজা কথা!

এখন তার খায়েশ হলো সার্কিট হাউসের বাবুর্চি হওয়া।

ভুলু রান্না করে নাম-কা-ওয়াস্তে। বরং বলা যায়, সে যখন রান্নাঘরে, তখন মিনির ভেতর থেকে আসল বাবুর্চি বেরিয়ে আসে। তবু সে অলস দুপুরে সুখের পিঠখোটা খাওয়ার সময় মিনিকেও স্বপ্ন দেখায় – ‘আমি সার্কিট হাউজে কুক হয়া গেলে তোরে এইখানে কুক বানায়া দিমু, দেখিস।’

মিনি ঠোঁট উল্টায় – ‘এইখানে আসল কুক কিডা? হ্যাঁ, কিডা?’  

‘তুই, তুই! আমাগের গেন্দাবাচ্চার মা’ – বলে মিনিকে দলাইমলাই করে ভুলু, আর মিনির ভেতরটা কেরোসিন কমে আসা কুপির মতো দপদপ করতে থাকে। 

মিনির সাধ ছিল ছেলে হলে নাম দেবে শারুক খান আর মেয়ে হলে কাজল। তা ওনারা সব শাহেন শাহ, আল্লাহর বানানো রুহর দুনিয়া থেকে মানুষের শরীরী দুনিয়ায় আসতেই চায় না। কত যে কান্নাকাটি করে মিনি! ভুলু যখন পছন্দের নায়কের নাম নেড়িটাকে দিয়ে দিলো, মিনির ইচ্ছে হয়েছিল বলে – পাল্টায়া দেও। ভুলু যেভাবে জোগালি থেকে বাবুর্চি হলো, একদিনে না। ওই রকম, নামটাও আস্তে আস্তে দিলো। পাল্টানোর প্রসঙ্গ তোলা যায়নি।

একদিন গল্পে গল্পে তারা বলাবলি করছিল – ‘দেখছস অর পশমগুলা একদম শারুকের চুলের মতোন, পিছলা আর কালা।’

মিনি কটাক্ষ করেছে – ‘হ, আইছে আমাগো শারুক খান।’

তখন তার কাজলের কথাও মনে হয়। খুব মায়াবতী ছিল। দিলওয়ালে দুলহানিয়ার মতো হালকা গম্ভীর চালে হাঁটতো। ভুলু উড়িয়ে দেয় – ‘যাহ, বিলাই একটা পালনের জিনিস অইলো?’

মিনি মনের কষ্ট মুখে ফুটে উঠতে না দিয়ে দ্রুত একমত হয়, ‘হ, বিলাই খালি বিছানায় উঠতে চায়। আর মাছে, দুধে মুখ দেয়।’

ভুলু তখন দুষ্টুমি করে, ‘বিলাইয়ের বদলে তো আমি আছি’ – বলে মিনির উপুড় হওয়া শরীর উল্টিয়ে দিলে তাকে কাজলের প্রসঙ্গ ভুলে যেতে হয়। 

তারপর থেকে তারা নিজেদের মধ্যে, মানে শারুকের প্রসঙ্গে কথোপকথনে এই নামটা চালু রাখে। তবে মানুষজনের সামনে উঁচু গলায় নাম ধরে ধমক-ধামক দিতে মিনি লজ্জা পায়। কী ভাববে সবাই! হাজার হলেও কত বড় নায়ক! কিন্তু নাম কি আর গোপন থাকে? 

কিন্তু এই হারামজাদাও তেমন, এখন আর নামে না ডাকলে কথা শোনে না। এই যে কখন থেকে মিনি বাঁ হাত উঁচিয়ে – ‘ছেই ছেই, যা ভাগ’, করছে, শারুক খান কি শুনছে? কপাটের কাছ থেকে নড়ছে একটুও? গ্যাট হয়ে দু-পা তুলে বসে আছে। এটুকু বুঝবি না, এতো বছরে শারুক খানের মতো ঝিলিক তোলা রোয়াগুলো উঠে গিয়ে ‘তোর অবস্থা জানস না, মাইনসের সামনে আর ওই নামে ডাকা যায়? নবাবজাদা – হোমর দেয় না, কতা শুনে না’, মনে মনে গজরায় মিনি, মুখে যদিও তার লাজুক হাসি, সে-হাসি ধরে রাখতে মাছ শিকারির সতর্কতা লাগে।

এই হাসি ভুলুর ভাইয়ের বউ আর চাচাতো বোনেদের জন্য। যারা এখন তার ঘরের নীল-কালো ছাপা চাদর দুমড়ে বিছানায় বসে আছে।  

অতো কেউ তাদের  বাড়ি বেড়াতে আসে না। যেদিন আসে, সেদিনও তারা মিনি বা ভুলুকে দেখতে আসে না। অন্য কাউকে দেখার ছুতোয় মিনির ফ্যাকাশে ফর্সা রং, সামান্য বোঁচা নাক আর পাতলা ঠোঁটের দিকে আলগোছে তাকিয়ে, মেপে যায়। হুহ্, মিনি এসব বোঝে। হোক না তার বুদ্ধি কম বলে ভুলু মাঝে মাঝে দাপিয়ে রাখে, কিন্তু সেও যে এসব বোঝে আর এটা যে ভুলু বুঝতে পারে না – এতে সময় সময় মিনিও আমোদ পায়। ভাঁপ-ওঠা গরমের দুপুরে যখন ঘরে টেকা কঠিন তখন গেস্ট হাউসের পেছনে আমগাছের গুঁড়িতে মাথার চুল দু-ভাগ করে গিঁট দিয়ে বেঁধে আঁচলে বাতাস খেতে খেতে এসব ভেবে মিনির মুখও সুখে চকচক করে।

 আজকে ভুলুর চাচাতো ভাইয়ের বউ-শালি এরা বেড়াতে এসে বেশ অনেকক্ষণ বসে আছে। একে কি বেড়ানো বলে? না চা-বিস্কুট, না পান। গেস্ট হাউসের চা অবশ্য সে চাইলেই বানিয়ে দিতে পারে, কিন্তু এরা সব স্বামীর দিকের আত্মীয়, ওদের সম্পর্কে নানাবিধ জটিলতা আছে, নদীতে বিলীন হওয়া ক্ষেতখোলা নিয়ে আগে থেকে ঝগড়াবিবাদ আছে। তাই কাকে কী রকম সমাদর করতে হবে, সেসব ভুলু শিখিয়ে-পড়িয়ে দেয়। কিন্তু এখন মিনির ইচ্ছে করছে তাকের ওপর ঝকঝকে করে মেজে রাখা পাতিল নামিয়ে একটু সুজি রান্না করে দেয়। কিন্তু  তা না করে কপাট ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আঁচলের কোনা দাঁতে খুটে শারুক খানকে ছেই ছেই করে খেদায়। গাধাটা জিভ বের করে অকারণে হাপায়।

তার জা-ননদাই নিজেরা কী এক আলাপে মশগুল হয়ে গেলে যে সুযোগ মিনি খুঁজছিল, হিসহিসিয়ে – ‘ছেই ছেই, যা ভাগ’ বললে শারুক একলাফে উঠানের আমগাছের নিচে গিয়ে বসে পড়ে। 

এতো ফিসফিসিয়ে বললো, তবু ভুলুর ভাবি বা চাচাতো বোনদের কেউ শুনে ফেললো – ‘কি বইলা ডাক দিলা পশম ছাড়া কুত্তাক?’ ওরা একে অন্যের গায়ে ঠেস দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে আরো হাসলো। এদের কৌতূহলী চোখ তার ঘরের কোনায় তাকে রাখা বয়াম আর হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে আলনা, মিটসেফ ঘুরে মিনির কান্না ফোলা চোখমুখে ফিরে আসে।

শারুকের গমনপথে সস্নেহ চাউনি দিয়ে মিনি বলে, ‘ওর খাইছলত খারাপ হয়া গেছে, আমি কিছু কইলে শোনে না বদের বদ, আপনেগেরে ভাই তু তু কইরা ডাকলে পিছে দৌড়ায়।’

একটু আগে ভুলু যে বাঁশের বাতার বাড়ি দিয়ে তার হাতের ছাল উঠিয়ে বেরিয়ে গেছে, সেটা তো আর এরা জানে না। দরজায় শব্দ হওয়ার আগেই অবশ্য মিনির ভেতর থেকে আরেক মিনি বেরিয়ে চোখ-মুখ মুছে সুস্থির হয়ে বসেছিল, তবু ফুলে-ওঠা চোখে জোর করে তো আর ফুর্তি আনা যায় না, অন্তত মনের ভেতরের মেঘ বাইরে ছায়া ফেলে। 

একসময় মিনির মনে হয়, দীর্ঘক্ষণ হয়ে গেল এখন ভদ্রতা করা দরকার। সে চা বানাতে চায়, ওরা না না করে থামায়। যে জন্য আসা, সেই মেহমানই তো ফেরে নাই।  

গেস্ট হাউসে মেহমান সেই সকালে নাস্তা খেয়ে কাজীপুর এনজিওর প্রজেক্ট দেখতে গেছে। ফুলে-ওঠা চোখে মিনি তার জানা সব রান্না মনে মনে ঝালিয়ে নিতে নিতে আরেকবার ডুকরে কেঁদে উঠেছিল, সেও প্রায় ঘণ্টাদুই আগে। এমন গালি আর মারধর তো সে নতুন খায় না। তবু কেন চোখে এতো নহর নেমে আসে বুঝে উঠতে পারে না সে। বিয়ের এতো বছর পরেও যদি কোলজুড়ে বাচ্চা না আসে, মানুষ তো বাঁজা বলবেই। কানাকে কানা, ল্যাংড়াকে ল্যাংড়া যদি বলা যায়, তাইলে তাকে কেন ‘বাঁজা মেয়্যামানুষ’ বলবে না। কিন্তু যে-দুঃখ তার গায়ে গুটিবসন্তের মতো ফুটে আছে তা নিয়ে খোঁটা দেওয়া যে ঠিক না, তার ঘরের মানুষ বুঝবে না?

ভুলুর চাচাতো বোন, ভাইয়ের বউ আর শালি যে তাকে হিংসা করতে করতে করুণা করে ফেলে তা তো শুধু এ-কারণেই। হোক না ছোট্ট, গুমটি ঘরের মতো ঘর, তাও তো সিরাজগঞ্জ শহরে সে দালান ঘরে থাকে, এই নদীভাঙানি মাতারিদের তাকে করুণা করার কোনো কারণ নাই। কিন্তু নিজেদের কোলে-কাঁখে বাচ্চা নিয়ে মিনির দিকে তারা যে-চোখে তাকায় সে-দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে থাকে মিনি।

– ভুলু ভাইর মোবাইলে একটা ফুন দেও, আমরা এট্টু মেম দেইহা

যাই …

মিনি দোনামোনা করে – ‘আমার মোবাইলে ট্যাকা ভরা নাই।’

স্বামীকে এখন কোনোক্রমে ফোন করবে না সে। ঘেন্নাপিত্তি কি খুলে খুলে দেখাতে হবে? আর তাছাড়া ভুলু তো গেছে বাজার করতে। যদি বাজার করতে না-ও যেত, তাহলেও কি ফোন করে তাকে ফিরিয়ে আনা যেত!

ওরা চলে গেলে মিনি আমগাছের গুঁড়িতে গিয়ে বসে। শারুক খান কাছে এসে ন্যাওটামি করে, গলা চড়িয়ে দূর করলেও সে যায় না, নাম ধরে ছেই ছেই বললেও নড়ে না, অল্প দূরে গিয়ে আবারো দু-পা তুলে মনোযোগ চায়, জানে যে, মিনি এখন একলা আছে। ভুলু বাজার করে  ফিরে আসার আগে তার পা ছড়িয়ে কাঁদার সময় আছে।

আমগাছে একটা পাখি তীব্র শিস দিয়ে ডাকে, কান্না ভুলে পাখিটা খুঁজলে হয়, কী রঙের পাখি অন্তত এটা দেখলে হয়, কিন্তু মিনি নড়ে না। বেশিক্ষণ চোখের পানি ফেললে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠার সামান্য সম্ভাবনাকে আমল দিতে ভালো লাগে তার।

একসময় রিকশার ঘণ্টা শুনে হুড়মুড়িয়ে উঠে আসে মিনি। 

অভিমান শব্দটা ভুলুর অপাঠ্য। সে বাজার গুছিয়ে রাখতে দাঁত খিঁচিয়ে তাড়া দেয় মিনিকে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের জন্য অপেক্ষা করতে করতে এমনিতেই তার দেরি হয়ে গেছে। ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের ডাক পেয়ে কিছুমাত্র দেরি না করে হাজির হতে চাইলে কী হয়, ভুলু তো যাওয়া মাত্রই সাক্ষাৎ পেতে পারে না। স্যারের মিটিং থাকে, দুপুরে বাসায় খেয়ে আসতে হয়। পিয়নের পাশে বেঞ্চিতে বসে ঝিমুনির সঙ্গে ভুলুর যখন বিদেশি মেহমানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হয়, ওরা ফিরে আসার আগে কী বাজারসদাই নিয়ে ফিরতে পারবে? 

মিনি একলা সামাল দিতে পারবে না। ‘মেয়্যামানুষ কোনহানকার’, ইত্যকার ভাবনায় তার ঝিমুনি উড়ে গিয়ে ক্ষুধাবোধ আর কপালে ঘাম দেখা দিলে যখন চোখ খুলে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার ডাক পড়ে।

– নাম কী তোমার?

– স্যার ভুলু।

– ভুলু কী?

ভুলু থতমত খায় একটু।

– ভুলু-ই স্যার।

টেবিলের উল্টোদিকে চেয়ারে বসে থাকা দুজন লোকের কাছে নিজের শৈশবে পালা কুকুরের নাম বিষয়ে বলে কৌতুক করেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব।

– ভুলু মিয়া! গেস্ট হাউসে যারা আসছে তাদের কোনোরকম অযত্ন হইলে তোমার নাম ভুলু থেকে ভোলা মিয়া বানায়া দিবো, এরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ লোক, বুঝিছো?

তারপর ভুলুর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনের দুজনকে বলতে থাকেন – ‘সুইডিশ সরকারের লোক, এখানে নদীভাঙন নিয়া কীসব রিসার্চ-মিসার্চ কইরবে।’ 

ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের মেন্দি রাঙানো দাড়ি। ভুলুর কাছে তার গায়ের রংটাও কমলা রঙের ঠেকে। বিদেশি মেহমানদের ঠিকমতো যত্ন নেওয়া হচ্ছে কি না জানতে চেয়ে, শুক্রবারে তাদের চায়ের দাওয়াত দিয়ে খসখস করে কাগজে চিঠি লিখে দেন। আর যে-কোনো প্রয়োজনে একপায়ে সেবা দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে সে-কথা ভুলুকে জানাতে ভোলেন না।

সরকারি অফিসারের প্রশংসা পেল নাকি ধমক খেল বুঝতে পারেনি, তার শেষ বাক্যে কপালের দুটো ভাঁজ স্বাভাবিকের চেয়ে গভীর ছিল কি?

ভাঁজ করা পত্র বুকপকেটে ভরে বুক উঁচিয়ে ইলেকট্রিক পার্টসের জেনারেল স্টোরের সামনে দিয়ে হনহন করে হেঁটে বজলুর সার ও কীটনাশকের দোকানের কাছে থমকে গিয়েছিল ভুলু। গেস্ট হাউসে ইঁদুর দেখেছে গত পরশু। জরুরি ভিত্তিতে ইঁদুর মারা কল এবং ওষুধ দুইই কেনা দরকার। বজলু ভাই ঝটপট চার প্যাকেট র‌্যাটকিলার দিয়ে দেয়। ভুলু আর দাঁড়ায় না। কাঁচাবাজারে ঢুকে তাজা শাক-সবজি নিয়ে যেতে হবে।

মিনি-ভুলু দুজনেই খাবার-দাবার সাজায়। ডাইনিং টেবিলে বসেই ল্যাপটপ খুলে কাজ করে লিন্ডা। ভালো বাংলা জানে সে। টাঙ্গাইলের গ্রামে দশ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা গুরুত্বসহকারে ভুলু-মিনির কাছে পেশ করে। সকালের নাস্তা শেষ করে তারা কাজীপাড়া যাবে। সেখানে তাদের কী কাজ ভুলু তার কিছু কি বোঝে? মিনি তাও জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে। 

Ñ আগেরদিন না তোমাক ছাড়াই গেল! আইজ সঙ্গে নিবার চায় ক্যান? তুমি ওগলার কী বুইজবা?

মর জ্বালা! ভুলু তার কী জানে?  ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের হুকুম, ওরা যা বলবে করতে হবে। সকালের নাস্তা খাওয়া হলে ভুলু দুটো রিকশা নিয়ে আসে। ফিলিপ আর ক্রিস্টিনা দুজন এক রিকশায়। লিন্ডা উঠে পাশের খালি জায়গায় থাবড়া মেরে ভুলুকে ডাক দেয়। ভুলু আজকে এদের গ্রামযাত্রার সঙ্গী। লিন্ডার বাংলার সঙ্গে ভুলু মিশেল দেয়, দুপক্ষই বেশ ভালো যোগাযোগের কাজ চালায়।

তাদের রিকশায় বসা দেখতেই বাড়ির সামনের মাঠে ভিড় জমে গেল! খবর পেয়ে ভুলুর চাচাতো ভাইয়ের বউ আর শালি সেই বাঁধের ওপর থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে  হাজির।

এ-অবসরে মিনির কাজ রান্নার জোগাড়যন্ত্র – এ তার উদ্বেগেরও সময়। দেশের গেস্টরা তার বান্না খেয়ে ভালো-টালো বলে; কিন্তু বিদেশিগুলি কেমন যেন, যত স্বাদই হোক, দু-একজন ছাড়া বাকি সবাই, মিনি লক্ষ করেছে, কেমন পিতপিতা স্বভাব করে খায়। তারপর অবশ্য – ভেরি টেস্টি, ভেরি টেস্টি বলে, কিন্তু তার মনে হয় যে, সেটা কেবল মুখের কথা।

ফিরে এসে মিনির কাছে ভুলু টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোর মতো মনোযোগ পায়।

‘অরা সবাই আম্রিকা থেইকা আইছে, এহন ট্রাম্প পাওয়ারে আসার বাদে বাংলাদেশে অরা আইসা ভইরা যাইতেছে’ – ভুলু বলে।

‘বাংলাদেশ ভইরা ওগোর কী লাভ, অগো দ্যাশে কি জাগাজমিন নাই?’ ভুলুর কথা বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নাই, তবু মিনি জানতে চাইলে মুখভর্তি ধমক আসে – ‘তুই এতো কিছু দিয়া কি করবি?’

এই লোক জন্মেও শুধরাবে না। মিনি মনে মনে ভুলুকে বেজন্মা বলে গালি দিয়ে লিন্ডার সালোয়ার-কামিজ দেখায় মন দেয়। লাল-হলুদ জামদানির ওপরে সুতোর এমব্রয়ডারি করা জামায় তাকে বেপরোয়া সিঁদুরে আমের মতো দেখতে লাগছে। রান্নাঘরে এসেছে বরফের খোঁজে। তারপর কী ভেবে পেছনের বাগান দেখতে নেমে এলো। ভুলু পেছন পেছন যেতে যেতে বলে – ‘কিছু চায় কি না দেখি।’

মিনির জা-ননদের একজন যাওয়ার সময় যে ‘স্বামীরে চোহে চোহে রাহিস’ – বলে চোখ টিপে  ইঙ্গিত করে গেল, সে-কথা মনে করে অস্থির হয়ে পড়ে মিনি। বাচ্চাকাচ্চা হয় না বলে তার আতঙ্কের শেষ নাই। এই বুঝি স্বামী বলে ওঠে – ‘আরেকটা বিয়া করা লাগে।’ বাপ না হওয়া পুরুষের বিশ্বাস কি? সব রাগ গিয়ে ভুলুর ওপরে পরে। কোনো চিকিৎসাও করাতে চায় না উজবুক লোকটা। উঠোনে লাকড়ি শুকাতে দেওয়া রোদে নিজের লম্বমান ছায়ার দিকে চেয়ে ভেতরটা খালি খালি লাগে মিনির, যেন এক নিঃসীম শূন্যতার ভেতরে দুলছে সে।

গেস্ট হাউসের পেছন দিকে সদ্য গজানো কিন্ডারগার্টেনের শিশুদের কলতান আর তারের ওপরে বসা একমনে ডেকে যাওয়া কাকের ডাক তাকে আরো বিষণ্ন করে তোলে। কী হবে ভুলু যদি আরেকটা বিয়ে করে বসে! অজুহাত তো তার কব্জিতে বাঁধা সস্তা ঘড়িটার মতো লটকে আছে, যে-কোনো সময় বলে দিতে পারে। হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদার জন্য সময়টা উপযুক্ত না।

শারুক খানকে আশপাশে না দেখে তার কাজলের কথা মনে পড়ে। বাপের বাড়িতে কতগুলি বিড়ালছানার মধ্যে থেকে সে কাজলকে পছন্দ করে নিয়ে এসেছিল। ওইদিন কি হাটবার ছিল?  হাটের দিন বাপের সঙ্গে তেলের শিশি নিয়ে ঘুরতো কি মিনি? আহা কাজলটা কেমন পেটের ব্যথায় মরে গেল। ওর মিউমিউ থেকে একটা মা মা ডাক উঠে আসতো, সেটা যদি এখন শুনতে পেতো! যেটা শারুকের ঘেউ ঘেউ বা ব্যথা-বেদনার সময় কুঁইকুঁই থেকে পাওয়ার আশা একেবারে দুরাশা।

ফিলিপ এসে ডাইনিং টেবিলে ল্যাপটপ খুলে বসে। তার মুখ থমথমে।

ডাইনিং টেবিল গোছাতে এসে মিনি কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে বেরিয়ে এসে পেছনের উঠানে ঘাসের ওপরে বসে থাকে। এসব সাহেব-মেমদের মেজাজের মতিগতির হদিস করা তার কাজ না।

একটু পরে ঘরের ভেতর থেকে ঠান্ডাস্বরের কথাবার্তা শোনা গেল। ঠান্ডা কণ্ঠদুটো ক্রমে উত্তেজিত হতে থাকলো। তারপর আবার চুপ। নারীকণ্ঠ যখন চেয়ার ধাক্কা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো মিনি দেখলো লিন্ডার কান্নাভেজা মুখ।

আকাশের কোনায় বিরাট ভারী চাঁদ উঠছে। গরমে ঘরে থাকা কঠিন। মিনিও উঠানেই বসে থাকে। লিন্ডা কখন

পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি মিনি।

‘আপনি কি আমাদের ঝগড়াঝাটি শুনেছেন?’- দীর্ঘদিন রপ্ত করা বাংলা লিন্ডার।

মিনি বিগলিত হয়, ‘না না, আমি কিছু শুনি নাই।’

– আপনি শুনেছেন, কিন্তু বুঝতে পারেন নাই। ঝগড়ার তো আসলে কোনো ভাষা নেই, শব্দের ছোড়াছুড়ির আওয়াজ শুনেই বোঝা যায়।

মিনির তো বলার কিছু নাই।

লিন্ডাই কথা বলে, ‘হ্যাঁ, আমরা ভীষণ ঝগড়া করছিলাম। ফিলিপের সঙ্গে আছি প্রায় এক যুগ। কিন্তু যখন একসঙ্গে থাকি, কথায় কথায় মতবিরোধ হয়। কাজের জন্য ফিলিপকে কিংবা আমাকে প্রায়ই দীর্ঘসময়ের জন্য দূরে থাকতে হয়। তখন আমরা পরস্পরের কাছে আসার জন্য অস্থির হই।’ লিন্ডা হঠাৎই চুপ করে যায়। যেন এতোক্ষণ যেসব কথা বললো তা কাউকে শোনানোর জন্য না। নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন।

মিনির কাছে নিজের সঙ্গে নিজের কথাবার্তা খুব চেনা। মাথার ভেতরে বলে, তো শব্দ করেও বলে। বাড়িতে যখন কেউ থাকে না তখন নিজের বলে ওঠা কথায় নিজেই চমকে যায়।

– আবার কিছুদিন একসঙ্গে থাকলে নিজেদের চিনতে পারি না। সে কারণে দূরত্ব তৈরির পথ খুঁজে বের করি। একবার আমার পোষা কুকুরের অসুখ হলো – ফিলিপ কোনো ডাক্তার দেখালো না। সেই দুঃখে আমি প্রায় বছরখানেক ওর মুখ দেখিনি। এখন আবার আরেক ইস্যু তৈরি হয়েছে। ফিলিপ বেবি নিতে চায়। আমি এখনি মা হওয়ার জন্য তৈরি না। সম্ভবত কোনোদিনই হবো না। আমি আরেকটি শিশুকে পৃথিবীতে এনে নিজের বোঝা বাড়াতে চাই না। কত শিশু পিতামাতাহীন। তাদের জন্য কাজ করতে পারলেই আমি খুশি। অথচ ফিলিপ আমার আবেগ বুঝতে চাইছে না। ও বাচ্চা চায়।

‘আমিও বাচ্চা চাই, কিন্তু আল্লায় দেয় না’ – মিনি চট করে একথা বলে কেঁদে ফেলে।

কান্না সংক্রামক, লিন্ডা অশ্রুসজল হয়।

মিনির নিজের কথা বলার লোক কই? দুজনের সংসারে ভুলুই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

একটি সন্তানের জন্য তার আকুলতা আরেকজন মেয়েই বুঝবে বলে হঠাৎ করেই মিনি মুখর হয়ে ওঠে।

লিন্ডা তখন তাকে চিকিৎসার কথা বলে। তার পরিচিত খুব ভালো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছে।

মিনির মনে হয়, এই বিদেশি আপা আসলে ফেরেশতার ছদ্মবেশে হাজির হয়েছে।

কিন্তু এমন ভালো খবরে ভুলুর খিঁচড়ে থাকা মেজাজ কেন?

পরের দিন লিন্ডারা সবাই মিলে যখন ম্যাজিস্ট্রেটের বাসভবনে ডিনার খেতে গেল তখন অবশ্য অলস একটা ঘুম দিয়েছিল দুজনে মিলে।

তারও পরের দিন ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের অফিসের সামনে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর আবারো শান্ত-ঠান্ডা টেবিলের উল্টোদিকে দাঁড়িয়েছিল ভুলু।

‘ভুলু মিয়া, সরকারি গেস্ট হাউসের মান-ইজ্জত রাখতে পারলা না! বিদেশি মেহমানরা বলছে তোমার ওখানে অযত্নে রাখা কুকুর দেখে তাদের মনে কষ্ট লাগে। তুমি তো দুইটা অন্যায় করিছো। এক. সরকারি জাগায় কুকুর ঢুকাইছো। দুই. সে-কুকুরের অযত্ন করিছো, তার ছাল-বাকল উঠায়া রাখছো। এর প্রতিকার কীভাবে করবা, চাকরি  রাখতে চাও?’

ম্যাজিস্ট্রেট স্যার সামনে রাখা ফাইলের ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই কথা বলে যান। ভুলুর মনে হয় এই ফাইলে তার নামধাম লেখা আছে।

বাড়ি এসে বেশ অনেকক্ষণ থম ধরে বারান্দায় বসে থাকে ভুলু। তার সামনে রোয়া-ওঠা শারুক খান। ভুলু চেয়ে থাকলে শারুক খানের বয়সী শরীরে ঠিকরে পড়া আমোদ দেখা যায়। অনেকদিন পর ভুলু তাকে নিয়ে বসে থাকলো। সামনের পুকুরের শ্যাওলা সরিয়ে ডলে ডলে গোসল করালো। মাংস দিয়ে ভাত মেখে দলা-দলা করে খাইয়ে দিলো।

তারপর নিজে না খেয়ে ঘরের কোনায় দাঁড় করিয়ে রাখা তুতগাছের লাঠি আর র‌্যাট কিলারের খালি প্যাকেটটা নিয়ে বাসা থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল।

এর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মিনির চোখের সামনে মুখে রক্তের গ্যাজলা উঠে মরে গেল শারুক খান।

সার্কিট হাউসের বাগানে লাগানো জবাফুলের মতো লাল রক্ত।

ঝিম ধরা বিকেলে গ্রিল ঘেরা গেস্ট হাউসের বারান্দায় বসে ফিলিপ ল্যাপটপে কিছু লিখছে। মিনি ডাক ছেড়ে কাঁদতে গিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে।

বছর দেড়েক পরের কথা।

মিনির ঘরের সিলিংয়ে দড়িতে ঝোলানো একটা দোলনা, সেখানে ঘুমন্ত শিশুটির বয়স মাসদুই।

ঢাকায় ছোট্ট একটা অপারেশন লেগেছিল মিনির। ডাক্তার বলেছিল, ‘কান্নাকাটি না করে বাচ্চার নাম ঠিক করেন!’

ভুলু আর মিনি দুজনে মিলে লিন্ডাকে একটা চিঠি লিখেছিল, পুত্রের নাম চেয়ে।

লিন্ডা উত্তর পাঠিয়েছে – ‘টম রাখা যেতে পারে, আদর করে টমিও ডাকা যাবে তাদের আদরের শিশুকে।’

চিঠি পড়তে পড়তে হো-হো করে হেসে ওঠে ভুলু – ‘আমাগের কপালে কি খালি কুত্তা-বিলাইয়ের নাম থাকবো?’

মিনি ততোক্ষণে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়েছে। বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে অকারণে হাসে। ছেলের দিক থেকে চোখ সরিয়ে প্রশ্নবোধক চোখে তাকায়। ভুলু বলে – ‘কখনো শুনস নাই? টমি তো বড়লোকের কুত্তার নাম।’