অনিঃশেষ ঘুমের ভেতর

জা য়গাটা বেশ ভালোই, দিঘল সরল পত্রময় গাছে ঘেরা, শান্ত আর নির্জন, অনেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপদেশের মতো সুন্দর, নিরুপদ্রব। এখানকার অনন্ত নিরালায় হু হু বাতাস এসে শিশুদের মতো নিশ্চিন্তে দোল খায়। এই অখণ্ড স্তব্ধতায় রৌদ্র এসে ঋষির মতো ধ্যানমগ্ন হয়। গভীর রাতে যখন পৃথিবীর ওপর নক্ষত্রের আলো ঠিকরে পড়ে, এখানকার বাঁশবাগানে তখন শনশন বাতাসের শব্দ হয়। রাতজাগা ঝিঁঝি পোকারা ঘোরলাগা কণ্ঠে একমনে একসুরে ডাকতে থাকে।

এখানে ঢোকার পথে পাকা লম্বা করিডোর পেরিয়ে এলে ঠিক ডানে একটা বিরাট প্রাচীন শেফালি গাছ। যখন এই গাছ থেকে ঝুরঝুর করে তারার মতো কমলা বোঁটার নরম সাদা ফুল ঝরতে থাকে, তখন বুঝি শরৎ এসেছে। কবি শরফুদ্দীন এই প্রাচীরঘেরা জায়গাটাকে বলে অচেনা ঘুমের গ্রাম, ঘুমগাঁও। আমি কিছু বলি না, শুধু চুপচাপ পৌষের শীতল সন্ধ্যা দেখি, পিয়ানোর সুরের মতো টুপটাপ শিশির পতনের শব্দ শুনতে পাই। চৈত্রের খা খা দুপুরে পাতার আড়াল থেকে কোমল সুরে ক্রক ক্রক করে ঘুঘু ডাকে। ঝুটিঅলা কাঠঠোকরা শক্ত ঠোটে খট্খট্ করে গাছের গায়ে ঠোকর দিয়ে পোকা খুঁটে খায়। শ্রাবণ মাস এলে নাকে বৃষ্টির ভেজা গন্ধ  পাই, মেঘের গুরু গুরু ডাক শুনি। পশ্চিম কোনার দিকে একজন গায়িকা থাকেন, তিনি আকাশে মেঘ করলেই গুনগুন করে ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা ,..’ গাইতে থাকেন। ভারি মিষ্টি সুরেলা তার গলা।     

আমাদের এই চৌহদ্দির ভেতর কয়েকটা চঞ্চল কাঠবিড়ালি ছটফটে ভঙ্গিতে গাছে-মাটিতে খেলে বেড়ায়। দুয়েকটা মোটাসোটা শেয়াল আছে, ওরা নিজেদের মতোই থাকে। দুটো চঞ্চল বেজি পরিবারও বাস করে ঝোপঝাড়ে। নিরিবিলি বিকেলগুলোতে গুইসাপ তার লম্বা লেজ নাড়িয়ে ধীরে-সুস্থে চার পা মেলে আমাদের আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে। আর ছোট ছোট লাল-কালো পিঁপড়ে সারাক্ষণই ব্যস্ত। সারিবদ্ধভাবে চলছে তো চলছেই।

রাতের নিস্তব্ধতায় যখন বাউন্ডারির মাথায় সারি সারি ফ্লুরোসেন্ট বাতি জ¦লে ওঠে, তখন উত্তর দিক থেকে অবসরপ্রাপ্ত সচিব জালালউদ্দিন সাহেব হাঁক দেন, ‘জাগো সাকি, গজল শোনাও, শিরাজি দাও, ভোলো তোমার বিষাদ স্মৃতি …’

‘হা হা হা, বুঝতে পারি, পুরনো অভ্যাস! ’

ঢাকা ক্লাবের লাউঞ্জে প্রতি সন্ধ্যায় মৃদু আলোতে কতিপয় আমলা বন্ধুর সঙ্গে এক টেবিলে বসে আনন্দ-আাড্ডা-কোলাহলের স্মৃতিতে এখনো বুঝি আন্দোলিত হৃদয় তার। গ্লাসের ঠোকাঠুকি, প্রশাসনের খুঁটিনাটি, ডার্টি জোকস উতল হাওয়ায় ভেসে ভেসে তার সাদা করোটিতে ধাক্কা দিয়ে যায়। এমন হয়। আসলে একসময় থেকে অন্যসময়ে পারাপার করার, এই অন্তর্বর্তী জলস্রোতে ভাসতে থাকা ধূসর দোদুল্যমান সময়টা একেকজন একেকভাবে আত্মস্থ করে নেয়। সময়ের হিসাব যেহেতু এখানে কোনো অর্থ বহন করে না, তাই অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের কোনো ফারাক এখানে নেই। কত বছর ধরে আমরা আছি আত্মীয়ের মতো, চিরপরিচিতর মতো তা ঠিক বলতে পারবো না, পাঁচ, দশ, পঁচিশও হতে পারে, কিংবা তারো বেশি, অসীম অনন্ত কাল। 

আয়না নেই এখানে। তাই চেহারা কেমন হয়েছে, আগে দেখতে কেমন ছিলাম, তাও মনে পড়ে না। শুধু মাঝেমধ্যে বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ে হাসপাতালের আইসিইউতে নিঃসাড় পড়ে থাকা শেষদিনগুলির কথা। বাইরে ঝকঝকে রোদ আর ভেতরে মৃদু আলোতে হাই পাওয়ার প্যাথেডিন, ক্লোরোফর্ম আর স্যাভলনের গন্ধে ঠাসা এয়ারকন্ডিশনের মৃদু শোঁ শোঁ শব্দের ভেতর অন্ধকার শীতল সময়। এক আশ্চর্য আচ্ছন্নতায় ডুবে আছি, শুনতে পাচ্ছি অনেক দূর থেকে ভেসে আসা ডাক্তার-নার্সদের কথাবার্তা, তাদের সতর্ক পদশব্দ। তারপর ধীরে ধীরে কখন যেন ভেসে গেলাম অস্পষ্ট ছায়ার মতো, ঝাপসা ধে^ায়ার মতো একটা দীর্ঘ অজ্ঞান অবিরাম ঘুমের ভেতর।

জেগে উঠে দেখি এখানে কোনো দাবি নেই, প্রত্যাশা নেই, আকাক্সক্ষা নেই, বাসনা নেই। ভালোবাসা-ঘৃণা বেদনা-অভিশাপ থেকে মুক্ত। আনন্দ-সুখ-ঈর্ষার মতো এখন কিছুই আর বিচলিত করে না, বিষণ্ন করে না, সম্মোহিত করে না। এই মহাকালের বুকে আমরা যে কেউ না, শুধু এক তুচ্ছ ধূলিকণা হয়ে পৃথিবীর রোদ্দুরে ডানা মেলে কয়েক মুহূর্ত উড়েছিলাম, তা খুব টের পাই।

কদিন হলো দেখছি পূর্বদিকের দেয়ালঘেঁষে নতুন বাড়িটার পাশে ছায়াময় অন্ধকারে একটা অল্পবয়সী ছেলে এসে মাটিতে লেপ্টে বসে থাকে। (আহা শোক, সে তো ভয়ানক দহন!) স্বজন হারানোর সদ্য যন্ত্রণায় ছেলেটি ঘন ঘন চোখ মোছে। মাটির ঢিবিটার ওপরে পরম মমতায় হাত বোলায়। যেন বুঝতে চায় না, যিনি ঘুমিয়েছেন তিনি আর জাগবেন না, ‘জাগিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম অবিরাম ভার বহিবে না আর।’ নতুন বাসিন্দারা কেউ এলে প্রথম প্রথম এমনই হয়। আত্মীয়দের মায়ার সীমানা সহজে কাটতে চায় না। (যে প্রিয়জনকে কথা বলতে দেখেছে, স্পর্শ করেছে, হেঁটে বেড়াতে দেখেছে, সে যখন শুয়ে থাকে চুপচাপ, তখন কি তাদের তাকে অচেনা মনে হয়? কে জানে!) আমরা সমবেত কণ্ঠে বলি, ‘শোনো ছেলে, এটা এক অন্য জগৎ। উনি এখন সব পেছনে ফেলে আমাদের জগতে চলে এসেছেন। থমকে গেছে তার পথচলা। তার জন্য আর দুঃখের গান গেয়ো না, তোমার গোলাপের তোড়া তুলে রাখো, তাকে ভুলে যাও অথবা মনে রাখো, সে তোমার ইচ্ছা। আমাদের হৃদয়ে এখন সবুজ ঘাস, ছায়াময় বৃক্ষ, ঝরনা আর শিশিরের শব্দ। চলে যাও ছেলে, কষ্ট পেয়ো না, তোমার জন্য অপেক্ষায় আছি, একদিন দেখা হবেই।’

একদিন নীল রঙের লম্বা রাতের শেষে ভোরের বেগুনি আলো ফুটে এলে দেখি আমাদের নিস্তরঙ্গ নিভৃত সীমানারেখায় অন্যরকম ভাবভঙ্গির অচেনা মানুষের  ভিড়। এরা শোকে ম্রিয়মাণ নয়, এখানে এলে যেমনটা সাধারণত থাকে সবাই, নিঃশব্দ, নত মুহ্যমান নিম্নকণ্ঠ শোকাকুল চোখ-মুখ। মøান চেহারায় যাদের প্রিয়জন হারানোর অস্ফুট ব্যথা। এরা বরং উচ্চকণ্ঠ, জুতার ধাপ্ধুপ শব্দ তুলে নীরবতা ভেঙে দিয়ে শক্ত পা ফেলে তারা এলো। পূর্ব অভিজ্ঞতায় চিনতে পারি, এরা পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, সঙ্গে শাবল-কোদাল হাতে ভাড়াটে গোরখোদকের দল। এলো, তারপর সবে নরম লোমের মতো গজিয়ে ওঠা সবুজ ঘাসগুলিকে দলামোচা করে খুঁড়তে শুরু করলো মাটি। কদিন আগে (দুদিন বা দু-মাসও হতে পারে, আবার এক মাস বা কয়েক সপ্তাহও হতে পারে) দেখেছি একজনকে চুপিসারে ওইখানে কচুঝোপের পাশে শুইয়ে দিয়ে গিয়েছিল একদল মানুষ। সেই নবাগত ছিল আত্মনিমগ্ন, বিষণ্ন ও নির্জন, যেটা প্রত্যেকেই থাকে শুরুতে। তারপর যখন তার বিনাশী অঙ্গখানি পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে সম্পূর্ণ মিশে যায় মাটিতে, তখন সে স্বেচ্ছায় নিজের গল্প বলতে শুরু করে। ছেলেমেয়ের গল্প, মা-বাবা,ভাই-বোন, বন্ধুর গল্প। স্বামী-স্ত্রীর গল্প। খ্যাতি আর অখ্যাতির গল্প। মমতা ও নিষ্ঠুরতার গল্প। সেই গল্প প্রতিধ্বনিত হতে থাকে দীর্ঘ লয়ে বহু বহু বহু দিন ধরে, আকাশে-প্রান্তরে।      

সচিব সাহেব বলেন, মৃত্যুতে ঘাপলা থাকলে এমন হয়। মরদেহ কেটেকুটে খোঁজা হয় মৃত্যুর কারণ।

উপমা খাতুনকে একবার এমন তোলা হইছিল ছয় মাস পরে, মনে নাই?

মনে আছে। উপমার গলায় ফাঁসের দাগ ছিল। উপমার গর্ভে ছিল এক নতুন প্রাণ। চার মাসের ভ্রƒণ। একটা মিষ্টি মেয়ে বাচ্চার অর্ধস্ফুট জীবন। যার তখনো মস্তিষ্কের গঠন সম্পূর্ণ হয়নি, এমনকি পরিপূর্ণভাবে চক্ষু ফোটেনি। মায়ের সঙ্গে সেও এসেছে এখানে, এরকমই এক দফা কবর খোঁড়াখুঁড়ির পর ওরা মা-মেয়েকে কেটে আবার সেলাই করে রেখে গেছে কড়ইগাছের ঘন সবুজ ছায়ার নিচে, যেখানে বেশিরভাগ সময় আধফোটা গোলাপকুঁড়িটিকে সঙ্গে নিয়ে উপমা খাতুন নীরবে ঘুমিয়ে থাকে। শিশুটির অপরিণত মাংসমজ্জাও ঘুমায় মায়ের ভেতরে। ঘুমায় উদ্বেগহীন, ভয়হীন। ঘুম ভাঙলেই মা-মেয়ে ভয়ে-আতংকে শিউরে ওঠে। নিদারুণ এক অশান্তিতে ছটফট করে। তাদের সকরুণ দীর্ঘশ^াস আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। শুনতে পাই, মাটির ওপরে উপমার খুনিরা নাকি আজো সদর্পে ঘুরে বেড়ায়। মানুষের আদালতে তাদের নাকি কোনো বিচার হয়নি।   

‘উত্তোলিত তরুণের দেহে জখমের গাঢ় দাগ ছিল।’ মাটি সাক্ষ্য দেয়। ‘তার হাতের আঙুলের নখ উপড়ানো ছিল। বুকে-পিঠে কালশিটে দাগ ছিল প্রহারের। চোখের নিচে ছিল গভীর ক্ষত। হাঁটুর নিচের হাড় ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছিল।’

‘তবে কি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল? গাড়ি দুর্ঘটনা?’

এমন আঘাতপ্রাপ্ত ভঙ্গুর দেহ আগেও এসেছে এখানে। দেখেছি আমরা রিয়াজ সাহেবের পরিবারকে। তারাও আছেন এখানে। কোনো এক রোজার ঈদের আগের দিন। বিকেলের আলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল তখন, গ্রামের বাড়িতে উৎসবে যোগ দিতে যাওয়ার পথে, হাইওয়েতে, নিজেদের এক্সিও গাড়িটা চালাচ্ছিলেন রিয়াজ সাহেবই। তার পাশে স্ত্রী বসেছিল। পেছনের সিটে সন্তানেরা। হালকা ইলশেগুড়ি বৃষ্টিতে কালো পিচের রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে উঠছিল। তবে রিয়াজ সাহেব স্টিয়ারিং ধরে ছিলেন শক্ত হাতেই। গাড়িতে নিচু স্বরে লতা-মুকেশের গান বাজছিল – ‘এক পেয়ার কা নাগমা হে, মাউজুন কি রাহানি হে …।’ বেশ একটা রোমান্টিক পারিবারিক পরিবেশ। এরই মধ্যে একটা বিপজ্জনক বাঁক ঘুরতেই বাসটা হঠাৎ একটা ভয়ংকর অভিশাপের মতো দানব শরীর নিয়ে হুড়মুড় করে উঠে এসেছিল ওদের রুপালি রঙের গাড়িটার ওপর।

গাড়ির সামনের অংশ ভয়ানকভাবে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল।

একসঙ্গে চারজন এসেছিলেন ওরা কফিনবন্দি হয়ে। এখন পাশাপাশিই থাকেন। নিজেদের মধ্যেই কল-কোলাহলে মগ্ন। মিসেস রিয়াজ অবশ্য সারাক্ষণই দুর্ঘটনার জন্য স্বামীকে দায়ী করতে থাকেন, রিয়াজ সাহেব রাগী গলায় বেপরোয়া বাসের ড্রাইভারকে গালাগাল করেন। সন্তানেরা আছে নিজেদের মতোই অনন্তকাল ধরে গাড়ির ভেতরে একে অন্যের সঙ্গে খুনসুটিরত।

‘সত্যিই যদি দুর্ঘটনা হয়, তাহলে পুলিশ কেন এলো? নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক কিছু আছে।’

নিজের সংসারের নিত্যক্যাচাল একপাশে রেখে রিয়াজ সাহেব প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে যোগ দেন আমাদের আড্ডায়।

আমাদের পাশে এসে নিঃশব্দে বসে থাকেন আমেনা খাতুন, খুব সূক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণ এক নারী, জীবনের প্রতি প্রচণ্ড অভিমান ছিল তার। তার সংবেদনশীল মন চারপাশের অপমানগুলি আর সইতে পারছিল না। যন্ত্রণাগুলি বইতে পারছিল না। সংসারের শত বেদনায় হাঁপিয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত শান্তি পেতে বিষপান করে সে এসেছিল আমাদের প্রতিবেশী হয়ে।       

আমরা জানি, প্রকৃতির কিছু নিয়ম আছে, মানুষ জন্মায়, শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য ও প্রৌঢ়ত্বের মালা গেঁথে  জীবনের চিরায়ত চক্র শেষ করে, বৃদ্ধ হয়ে, অসুস্থ হয়ে। এর বাইরে যেসব মৃত্যু ঘটে সেটাকে তোমরা অপমৃত্যু বলে চালিয়ে দাও। ওই তরুণের কি তবে অপমৃত্যুই ঘটেছিল? কে জানে? আমরা এখন মাটির নিচের সমস্ত কম্পন টের পাই; কিন্তু মাটির ওপরের খবর তেমন পাই না, হয়তো পেতে চাইও না। যে খেলাঘর ভেঙে গেছে, যা ফেলে এসেছি চিরতরে, তার কাছে আর ফেরা যায় না। আমরা বরং অপেক্ষা করি তরুণের আবারো ফিরে আসার, যখন সে নিজে থেকেই জানাবে নিজের কথা। আমাদের হাতে অনন্ত সময়, আমাদের আছে অশেষ ধৈর্য্য।

কাটা-ছেঁড়া শেষে তরুণকে ওরা আবারো ফিরিয়ে দিয়ে যায়। তরুণ নিশ্চুপ। এই অচেনা জায়গায় খাপ খাইয়ে নিতে হয়তো তার সময় লাগে। তা লাগুক। মাটি তাকে জড়িয়ে ধরুক নিবিড় মমতায়। পোকারা খুঁটে খুঁটে খেয়ে নিক তার সমস্ত দুঃখ। পৃথিবী তাকে আশ্রয় দিক নিজের বিশাল বুকে। সময়ের কুয়াশায় ঢেকে যাক তার সমস্ত বঞ্চনা, যেমন আমাদেরও গেছে।

স্মৃতি হারানোর আগে স্মৃতি ফিরে আসে। ক্রোধ-হতাশা-অপ্রাপ্তির স্মৃতি। রক্তমাখা চোখের জল, আগুনজ¦লা চিৎকার, দরজা ছাড়া অন্ধকার ঘর। তরুণ কথা বলে মৃতদের ভাষায়।

‘খুব ভয় পাইছিলাম যখন ওরা আমারে ধরলো। অথচ আমি তখন ফিরতেছিলাম দোকান বন্ধ কইরা। মন্টু ভাই চইল্যা গেছিল ঘণ্টাখানেক আগেই। দুইটা কাস্টমার আসছিল, একজন নিছে চাইর প্যাকেট ওরস্যালাইন আর একপাতা প্যারাসিটামল। আরেকজন এইদিক-ওইদিক তাকায়া ফিস ফিস কইরা কনডম কিনতে চাইল। পাশে মোবাইল সারানোর দোকান বন্ধ কইরা রিপন ভাই বাড়ির পথ ধরার আধা ঘণ্টা পরে আস্তে-ধীরে দোকানের লাইট নিভায়া একটানে শাটার নামাইলাম আমি। তালা লাগায়া টাইনা-টুইনা দেখলাম সব ঠিকই আছে। এইবার দিনের শেষ সিগ্রেটটা টানতে টানতে সোজা হাঁটা দিলাম টেম্পুস্ট্যান্ডের দিকে। মদিনা ফোন করলো সেই সময়, ‘কই? কোন সময় আসবা?’

‘এই তো আসতাছি। আধা ঘণ্টা লাগব।’ বললাম ওরে। হায়! তখন কি আর জানতাম এই আধা ঘণ্টা আর কোনোদিন ফুরাবে না। জাফরান হোটেলটা পার হইয়া একটু সামনে আগাইছি মাত্র, এই জায়গাটা বেশ অন্ধকার। বিকালে বৃষ্টি হইছিল, রাস্তার পাশে কাদাপানি জইমা ছিল। আমি সাবধানে কিন্তু তাড়াতাড়ি পা ফেলতেছিলাম। বাড়ি যাওয়ার জন্য, মদিনার কাছে যাওয়ার জন্য। তখনই কালো রঙের বিশাল জিপ গাড়িটা থামলো, ঘ্যাচ কইরা, আমার পাশেই। কাদাপানি ছিটকায়া আসলো গায়ে। আমি একটু চমকায়া গেলাম। ব্যাপার কি? ছোটবেলায় মা ক্যান জানি না দুষ্টামি করলেই পুলিশের ডর দেখাইত। যখন ঘুমাইতে চাইতাম না, তখনো একই ডর দেখায়া ঘুম পাড়াইতো। কইতো,

‘ওই পুলিশ আহে, তাড়াতাড়ি ঘুমা, নাইলে তরে ধইরা নিয়া যাইব।’

‘ক্যান ধরবো মা?’

‘ঘুমাছ না যে, সেই জন্য।’

আমি ভয়ে কুণ্ডুলী পাকায়া মায়ের বুকের মধ্যে চোখ বন্ধ কইরা ঘুমায়া যাইতাম। স্বপ্নে দেখতাম পুলিশের পোশাক পরা কিছু মানুষ পিস্তল-বন্দুক উঁচায়া আমারে ধরতে আসতাছে। কখনো দেখতাম পুলিশের কাপড় পরা মানুষগুলির ভয়ে ঝোপঝাড় ভাইঙ্গা খাল-বিল পার হইয়া আমি কেবল দৌড়াইতেছি। পুলিশের ভয় আমার আজীবনের। রক্তের মধ্যে সেই ভয় ছিল বইলাই কি আমি দৌড় দিছিলাম? বাঘ দেখলে যেমন ভয়ে পালায় হরিণ, তেমন কইরা? জানি না। কিন্তু  বেশিদূর যাইতে পারলাম না। হইহই কইরা দুই-তিনজন আইসা খপ কইরা আমারে ধইরা ফেললো। যেন এক দুর্বল ভীতসন্ত্রস্ত হরিণ শাবক পড়লো ক্ষুধার্ত বাঘের খপ্পরে।

দুই চারবার কাঁধ ঝাঁকাইলাম আমি, শরীর মুচড়াইলাম, ওদের শক্ত হাত থেকে ছুটতে প্রাণপণে চেষ্টা করলাম। চিঁচিঁ কইরা কইলাম, ‘কী হইছে ভাই? কারা আপনেরা? আমারে ধরলেন ক্যান? … ছাড়েন আমারে …’ 

কিন্তু ওরা কি আর ছাড়ার জন্য ধরছে? ওদের তখন একটা আসামি দরকার। ওদের তখন একটা মুরগি ধরা দরকার।  একজন কইল, ‘ওই হারামজাদা, তুই দৌড় দিলি কেন?’

আরেকজন ঝাড়ি দিলো, ‘চুপ কর ব্যাটা ছিনতাইকারী। চল আমাদের সাথে আজকে তোরে বুঝামু মজা …’  

‘না, না, আমি ছিনতাইকারী না, বিশ^াস করেন।’

একটা বিচ্ছিরি গালি দিয়া উঠল লোকটা। টাইনা-হিঁচড়ায়া আমারে গাড়িতে নিয়া তুলল। পকেট সার্চ কইরা মানিব্যাগটা নিল, তারপর নিল মোবাইলটা।

একটা ভয়ের স্রোত আমার আপাদমস্তক গ্রাস কইরা ফেলছিল। আতংকে নিশ্চয়ই আমি অন্ধ, বধির আর বোবা একটা পাথর হইয়া গেছিলাম। আমার হৃদয় চিৎকার কইরা বলতেছিল, ‘আমি মোহাম্মদ বোরহানউদ্দিন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করছি। সৎভাবে বাঁইচা থাকনের জইন্য সকাল থেইক্যা রাত পর্যন্ত আধুনিক ফার্মেসিতে কর্মচারীর কাজ করি। মা, ছোট ভাই আর বউরে  নিয়া জল্লার পাড়ের ভাড়া বাসায় থাকি। আমি অপরাধী না। আপনেরা ভুল করতেছেন। আমি নির্দোষ।’ কিন্তু আমার মুখ দিয়া কোনো কথাই বের হয় নাই, অথবা বলছি কিন্তু কেউ সেইসব শুনে নাই। ওরা কীভাবে কোথায় নিয়া গেল আমাকে কিছুই বলতে পারি না। একটা দম বন্ধ করা অন্ধকার ঘরে প্রথম আঘাতের সেই তীব্র ব্যথাটা এখনো মনে পড়ে। আর মনে পড়ে বহু দূরের ওপার হতে মদিনার ফোন।

‘কি গো তুমি কই? কখন আইবা? কতক্ষণ ধইরা ফোন করতেছি ধরো না যে …’

ওরা ফোনটা মুখের কাছে ধরার আগে আমাকে শিখায়া দিছিলো কী বলতে হবে। সেইটাই পাখি পড়ার মতো মুখস্থ ভঙ্গিতে বললাম আমি।

‘মদিনা, আম্মারে বলো তাড়াতাড়ি বিশ হাজার টাকা নিয়া আসতে। নাইলে ওরা আমারে ছাড়বে না। টাকা দিয়া আমারে ছাড়ায়া নিয়া যাও।’

আমি এখন জানি, আম্মা এই কথা শুইনা কেমন চিক্কুর দিয়া কাইন্দা উঠছিল। সেই কালো রাতে আম্মা আর মদিনা দিশাহারা হইয়া তাদের একমাত্র সম্বল গলার সোনার চেইন আর হাতের আংটি বিক্রি কইরা টাকা জোগাড় কইরা নিয়া আসছিল। 

আমি কখন জানি গলার মধ্যে মরুভূমির মতো তৃষ্ণা নিয়া একটু পানি খাইতে চাইছিলাম। মাইর খাইতে খাইতে শরীরে আর কোনো ব্যথা টের পাইতেছিলাম না। চেতনাহীন  বেদনাহীন অনুভূতিশূন্য একটা নিথর ঘোলা রঙের জগতে প্রবেশ করছিলাম আমি। সবকিছু শূন্য আর ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। এর মধ্যে কেউ  বোধহয় বলছিল, ‘ভাই থামেন,  পোলাটা মইরা যাইব তো!’

‘মরুক হালার পুত! মরুক!’

সে হয়তো তার জীবনের সমস্ত ঘৃণা, বঞ্চনা আর অপদস্থ হওয়ার ক্রোধ-হিংসা জিহ্বার ডগায় একসঙ্গে জমা কইরা বলছিল।

আমার মুখে তখন রক্তের নোনতা স্বাদ, চোখে ঘোর কালো রাত্রের অন্ধকার, বুকের মধ্যে কলিজাটা টুকরা টুকরা হইয়া ফাইটা পড়তেছিল, মাথার মধ্যে একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাক। শরীর-হাত-পা কিছুই আমার নিয়ন্ত্রণে নাই, যেন আমি একটা কাটা গাছ, একটা ভারি পাথর, যেন একমুঠ হালকা বালি, বাতাস আমাকে উড়ায়া নিতাছে। কেউ একজন বললো,

‘ধর, ধর, এরে হাসপাতালে নিতে হইব।’

‘মনে হয়, খতম হইয়া গেছে।’

হঠাৎ দেখি আমার আর কোনো যন্ত্রণা নাই, যেন জাদুর মতো সমস্ত কষ্টের অবসান হইল, মনে হইল লোহার খাঁচা থেইক্যা মুক্তি পাইছি। আমি একটা দোলায়মান আনন্দে জলের ওপর ভাসতেছি। একটা তীব্র আলোর সুড়ঙ্গ আমারে টাইনা নিয়া গেল আমার মরা আব্বার কাছে, মইরা যাওয়া দাদা-দাদি, নানা-নানির বুকে। হ, মরণ আমারে দিলো এক অপার শান্তি। সত্য এইটাই, আমি বাদে সবকিছু চলতে থাকলো আগের মতোই, খালি আমি চিরতরে থাইমা গেলাম।

‘দুঃখ করো না ভাই। জীবনপুষ্প ঝরার জন্যই ফোটে। কেউ সময়ে কেউ অসময়ে খসে পড়ে।’  আমরা তাকে সুর করে সান্ত্বনা দিই। তারপর আমরা প্রতিদিনের মতো শয়ন করি আবার জাগ্রত হই। আমরা ভাষাহীন হই আবার বাক্য ফিরে পাই। মরে যাই আবার জীবন লাভ করি।