বিয়ের কিছুদিন পর আমি আবিষ্কার করি যে, আমার আমার বর সাধারণ মানুষ নয়, সে বেশ সৃজনশীল, সে কবি কি না আমি বিয়ের আগে জানতাম না, তার সম্পর্কে কোনো তথ্য বাবা আমাকে বলেনি; আমি বাধ্য কন্যার মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসলাম কোনো কিছু না ভেবেই। তো একদিন দেখি সে ব্রার নতুন নামকরণ করছে, সে বলছে, তোমার দুধপট্টির রংটা বেশ ভালো, সাঁঝ আকাশের মতো। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম কিছুক্ষণ, কেন তাকালাম সে বুঝতে পারল কি না তা বুঝতে পারলাম না, তবে সে বেশ সন্ধিগ্ধভাবে আমার দিকে দৃষ্টি নামিয়ে আনল। আমি আলুপট্টি, বেনিয়াপট্টি, চুড়িপট্টি, সোনাপট্টি ইত্যাদি শব্দ জানি বা শুনেছি, তবে দুধপট্টির নাম কখনো শুনিনি। আমি এর মধ্যে একধরনের সৃজনকলা আবিষ্কার করতে পারার আনন্দ পেলেও আমার যুক্তিবোধ আমাকে একটু দ্বিধায় ফেলল। আমি বললাম, তোমার শব্দচয়ন ভালো, তবে অর্থটা তো যথোপযুক্ত মনে হচ্ছে না আমার কাছে। সে কম কথা বলে সাধারণত, তবে কখনো কখনো অনেক কথা বলে। এখন সে কথাটা বলে চুপচাপ বসে আছে টেবিলের পেছনে। আমার কথার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে না। খাটের পাশে ছোট একটা  টেবিল; সেখানে বসে সে পড়াশোনা করে, লেখে; বিশেষত আমি ঘুমিয়ে পড়লে। তবে তার মূল লেখাপড়ার ঘরে আমি ঢুকতে ভয় পাই, এতো অগোছাল মানুষের পড়ার ঘর হতে পারে, তা আমি ভাবতে পারিনি। এমনিতে বাড়িটার কোনো শ্রী নেই, পুরনো আমলের বাড়ি, রং তো নেই-ই, দেয়ালের প্লাস্টারও ঠিকমতো নেই, বর্ষার সময় আরো অবস্থা খারাপ হয়, সারা দেয়ালে ভেজা স্যাঁতসেঁতে ভাব হয়; সেদিকে দেখলে আমার গা ঘিনঘিন করে, তবে ওকে বলে কোনো লাভ হয় না বলে আর বলি না, এসব বিষয়ে ওর কোনো নজর নেই। সামনে-পেছনে অনেক গাছপালা আর অযত্নে বেড়ে ওঠা কিছু ফুলের গাছ, পেয়ারা, আম, লেবু, সজনে, জামরুল আর আমড়া গাছ মিলে একটা জঙ্গল। নিচে কেউ থাকে না। বাড়িওয়ালার গ্যারেজ আছে। দুটো রুম তালা মারা থাকে, মাঝে মধ্যে রাতবিরেতে এসে তিনি হাজির হন। আমরা একবেলা দুবলো খেতে দিই, তিনি আবার হাঁটা শুরু করেন। তো তার পড়ার টেবিলে, মেঝেতে, ভাঙা তিনটে আলমারি মিলে রাজ্যের বই-পত্রিকা স্তূপ হয়ে থাকে, ওখানে যে বাথরুম তার জানালার নিচে বই, ছোট যে একটা চৌকি আছে যেখানে সে মাঝে মধ্যে ঘুমাত, তার ওপরে বইয়ের দঙ্গল, তারই একপাশে জামাকাপড় দলাপাকানো। আমি আগে ঢুকতাম, এখন আর ঢুকি না। তার কোনো বিকার নেই। এসব নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। মাথাব্যথা কী নিয়ে ভেবেছি অনেকবার, হদিস পাই না। আমি একবার তার অগোছালো স্বভাব নিয়ে কথা বলেছিলাম। সে দার্শনিকের মতো জবাব দিয়েছিল। সে তার প্রিয় এক কবির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিল, যার মাথার ভেতরটা গোছালো সে বাইরের পৃথিবীর এলোমেলো বিষয়ে ভাবে না। আমি রাগ করতে পারতাম, তবে করিনি। সে তার ঘরে আরশোলা, টিকটিকি, বিড়ালের বাচ্চা আর একটা তক্ষককে নিয়ে খুব ভাবে, তক্ষক টরেটক্কা টরেটক্কা করে ডাক দিলে সে সেদিকে তাকিয়ে থাকে, আরশোলার পেছনে অন্য আরশোলা ছুটলে সে তাকিয়ে থাকে। লেবু গাছে ফড়িং বা দোয়েল বসলে সে এমন করে তাকায় যেন জীবনে এসব দেখেনি। যদি বিমান শব্দ করে সে সোজা বারান্দায় এসে দাঁড়াবে, যতক্ষণ দেখা যায় ঘাড় কাত করে দেখবে, কোনোদিন মিস করবে না। আমি জানি না সে কখন লেখে, বই পড়তে দেখেছি, তবে আমার সামনে কখনো লেখে না; এমনকি কী লেখে তা কখনো বলে না আর লুকিয়ে রাখতে চায়। তার লুকোচুরি ভাব দেখে মনে হবে, সে কোনো গোপন কাজ করছে তাই ধরা পড়ার ভয়ে এরকম করে। বেশ ঠান্ডা পড়ার কারণে সে একটা পাতলা কম্বল গায়ে জড়িয়ে খাটে বসে আছে, বালিশটাকে দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে পিঠে ঠেস দিয়েছে, পা দুটি সামনে ছড়িয়ে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের সেই মেয়েটার মতো, যার সখীরা কী কথা বলে যা সে বুঝতে পারে না। চোখের চশমাটা খুলে লেপের পাতলা কাপড় টেনে নিয়ে মুছতে থাকে। জানালা খোলা বলে দোতলা থেকে আকাশ দেখা যাচ্ছে। মেঘ-কুয়াশা আর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির সমবায়ে যে-আবহ তৈরি হয়েছে তাতে কেউ মনে করতে পারে, সে লন্ডনের বাড়িতে বসে আছে। আমি জানালার কাছে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে তাকে কাছে আসার জন্য বললাম, সে ওঠার জন্য কোনো তাড়া দেখাল না। আমি পরে বুঝতে পারলাম তার আরাম ভঙ্গ করার দরকার নেই। আমি বললাম, তুমি উত্তর দিলে না যে। আমি মনে করেছিলাম সে বুঝি প্রসঙ্গ ভুলে গেছে। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে আমি দেখেছি তার ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা অসাধারণ, আমি অবাক হয়েছি, কখনো বিরক্ত হয়েছি, কখনো মনে হয়েছে, সে বুঝি একটা কবি-কবি ভাব নেওয়ার জন্য এসব করে। বাস্তবতা হলো, সে ইচ্ছা করে এটা করে না, তার স্বভাবের মধ্যেই এটা আছে, হয়তো বাল্যকাল থেকে। চোখে চশমা নিয়ে সে সারাবাড়ি চশমা খুঁজে বেড়াচ্ছে, আর জোরে জোরে বলছে – রমা, রমা, আমার চশমাটা কোথায় দেখেছো? আমি হয়তো রান্নাঘরে চা করছি, ডাকের উত্তর দিতে পারছি না, সে আরো জোরে বলে, তাহলে গেল কোথায় চশমাটা? ছোটবেলা থেকে ওর গ্লুকোমা আছে, এখন তো বিচ্ছিরি অবস্থা। চশমার লেন্স দেখলে বোঝা যায় কত বড় সমস্যা। সে চশমা ছাড়া তেমন কিছু দেখে না, পড়তে পারে না, হাঁটাচলা করতে পারে আস্তে আস্তে। আমি বিরক্ত হই না ওর চেঁচামেচিতে, ধীরেসুস্থে এসে দেখি চশমা ওর নাকের ওপর। আমি নাক থেকে চশমা তুলে নিয়ে বলি, এটা তাহলে কী? সে হেসে ওঠে, অনুচ্চস্বরে, আস্তে বলে, স্যরি। আমি  দেখতে পাই এক বালক দুষ্টুমি করতে গিয়ে ধরা পড়ে হাসছে। সে আমাকে জাপটে ধরে, আমি বলি, করো কী, আমার সারা গায়ে নোংরা। সে বলে, নোংরা তো নোংরা, তাতে কী হলো?  এরকম আরো অনেক ফর্দ আমি দিতে পারি যা সে প্রায়শ করে, সবটা স্মৃতির ব্যাপার নয়, কিছুটা স্বভাব, কিছুটা খেয়ালিপনা। খেয়ালের মধ্যে থাকে সব সময়, তাই সবকিছু টের পায় না হয়তো, মনে রাখতে পারে না। সমস্যা গভীর হয় সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে ভুলে যাওয়ার সময়। আমি তাকে তোতা পাখির মতো মুখস্থ করিয়ে দিলাম যে, জয়ত্রি ফল আনবে, খুব জরুরি। বাবা আসবে, পোলাও রান্না হবে, জয়ত্রি সব শেষ। সে সুবোধ বালকের মতো মাথা নাড়ে, মুখে বলে, আচ্ছা। রাতে ফিরল খালি হাতে, তবে তার ঝোলার মধ্যে গোটাপাঁচেক বই-ম্যাগাজিন ঠিকই আছে। আমি অগ্নিশর্মা হই, আমার জ্ঞান থাকে না, একপর্যায়ে বলি, এরকম হলে আমি তোমার সংসার করব না। সে চুপচাপ থাকে। আমি আবারো বলি, সারাদিন কোন কাজটা সংসারের করো, যেটা বলব সেটাই পারো না। ভাগ্য ভালো, বাবা এসে আমাকে থামাল। আমার মা-বাবা আবার ওর কোনো দোষ দেখতে পায় না। তবে কিছু বিষয়ে সে কথা বলে মাঝে মাঝে যা তীক্ষè-স্মৃতির মানুষেরই কেবল থাকে, আমি মেলাতে পারি না। সে বলে, দেখো, শব্দ নিয়ে তর্ক করে লাভ কী? শব্দ তো আমরাই তৈরি করি, আমরাই হারিয়ে ফেলি, কেউ একজন বলে, অন্যরা তা মেনে নেয়, মানতে মানতে তা মান্যতা পায়, আর সবাই না মানলেই কী এসে-যায়? যারা ব্যবহার করে তারা মানলেই তো হলো। তুমি যদি মানো এটা দুধপট্টি তাহলেই তুমি আমি বলব, অন্যরা না মানলেই কী? এটা আলুপট্টি রেশমপট্টির মতো না হোক আমাদের বলতে তো কোনো অসুবিধা নেই। আমাদের এই চার দেয়ালে নতুন একটা শব্দ তৈরি হলো, আমাদের নিজস্ব শব্দ, কোনো সমস্যা তো নেই। আর ব্যাখ্যাই যদি বলো, তাহলে আমার মতো একটা ব্যাখ্যা আছে, মানুষের যখন জ্বর হয় তখন মাথায় জলপট্টি দেয় তো, দেখেছো না? তো সোনাপট্টির অর্থ না হোক উত্তপ্ত কপালে জ্বর থামাতে জলপট্টি হলে তোমার বুকের জ্বর থামাতে পট্টি দিতে সমস্যা কোথায়? সে হাস্যকৌতুক মিশিয়ে রাখে ঠোঁটে। আমি বলি, বাহ! কবি তোমার তো দেখি খুব বুদ্ধি হয়েছে। আচ্ছা, পট্টি আর পট্ট কি এক জিনিস? সে বলে পাট থেকেই তো সব এসেছে বোধ হয়। গলিটলিও হতে পারে একটা অর্থ। আমি বলি, বিয়ের পর তো বেশ সেয়ানা হয়ে উঠেছো। সে বলে, সেয়ানা মানে কী? আগে কি বালক ছিলাম?

ছেলেটা পাশের ঘরে ঘুমিয়ে ছিল, সে তখন চিৎকার করে জানান দিলো, আমি উঠে গেছি, তোমরা এসো, রাজা জেগে উঠবে আর প্রজারা তো দূরে দূরে থাকতে পারে না। আমি দৌড়ে যাই, দেখি তিনি বিছানা থেকে নেমে গড়াগড়ি দিচ্ছেন, উঠে বসার চেষ্টা করছেন, যেটা সে সামান্য শিখেছে কয়েকদিন হলো। ও পেছনে পেছনে এলো। সে আসার পর দেখল, সে বসে আছে, ফোকলা দাঁতে বাবার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বাবাকে সে চেনে, কীভাবে চেনে বলতে পারব না, তবে চেনে। আমার ভ্রম হলো কি না জানি না, দেখি, ছেলের জায়গায় ওর বাবা বসে আছে। যেন কবির ছোটবেলার চেহারা, জামা-কাপড় ছাড়া। আমি থাতস্থ হয়ে বললাম, তোমার চেহারা এরকম ছিল, তাই না? তোমার ফটোকপি মনে হচ্ছে তো। সে ঘন করে তাকায় ছেলের দিকে, সে ডান হাতের বুড়ো আঙুল মুখের মধ্যে পুড়ে দিয়ে চুষছে। আমি কবির দিকে তাকাতে দেখি সেও বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল গালে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমার মাথা ঘুরে যায়, একবার ছেলের দিকে আর একবার কবির দিকে তাকাই। তারপর সামলে বলি, তোমার আবার কী হলো, বুড়ো খোকা? সে বলল, না তেমন কিছু না, খোকা, পুরনো অভ্যেসটা মনে করিয়ে দিলো, আমি আঙুল চুষে দেখলাম, মজা লাগে কি না? কোনো মজা পাচ্ছি না, তবে একটা আরাম পাচ্ছি।

কী আরাম? কিসের আরাম?

একটা শিরশির ভাব।

কেমন শিরশির?

কোমল পিচ্ছিল জলের মতো।

পুকুরের জল?

না, মুখের ভেতরে ঘন স্যাঁতসেঁতে জল।

তোমার বংশে কি কেউ পাগল ছিল?

সে আর কোনো জবাব দেয় না, মুখটা কেমন ঘোলাটে করে একটা গম্ভীর ভাব করে তাকায় জানালার দিকে, আমার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নেয়। তার পাগলামি নিয়ে আগেও বলেছি, সে মন খারাপ করেনি, আজ বোধহয় করল। ছেলেকে বগলদাবা করে আমি অন্য ঘরে যাচ্ছি, সে এদিকে তাকায় না, সে লন্ডনের আকাশ দেখে, তখনো শিশিরের মতো বৃষ্টি, ঝাপটা বাতাস, পাখিদের ভীতবিহ্বল চোখ আর অস্পষ্ট আলোর মাখামাখিতে বিকেলের কোনো আলাদা চেহারা আছে কি না সে দেখতে চেষ্টা করবে, আমাকে এখন আর কিচ্ছু বলবে না।

ছেলেকে থামাতে গিয়ে বিপদে পড়ি, সে থামে না। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। আমি মনে করি ওর বোধহয় খুব খিদে পেয়েছে, সে বুকের দুধ পেলে অনেক সময় চুপ করে থাকে। হয়তো এটা তার কাছে অমৃত মনে হয়। আমি ব্লাউজ আলগা করে বাঁ স্তনে ছেলের মুখ গুঁজে দিই, সে খেতে থাকে তবে মাঝে মাঝে মুখ বের করে ফোঁপায়, আমার মুখের দিকে তাকায়, আবার খায়। কবি ফিরে আসে। সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে আমাদের দেখে। আমি বলি, হাঁ করে কী দেখো? যাও এখান থেকে। সে বলে, ভাবছি, মা মেরির মতো তুমি খোকাকে দুধ দিচ্ছো, মিকেলেঞ্জেলো হলে একটা সুন্দর ছবি আঁকতে পারত, সে হয়তো পরিবেশ বদলে দিত। ধরো, তুমি আকাশের বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে আছো, তোমার খোকা একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুধ খাচ্ছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বলি, অনেক হয়েছে এবার থামো। তখন সে বলে, এই ফিরোজা রঙের শাড়িতে আর কমলা জামায় তোমাকে রাজকন্যার মতো লাগছে। তোমার কি মনে আছে যেদিন খোকা হলো তোমার কি রঙের জামা গায়ে ছিল? আমি বলি, জানি না। সে বলল, বিয়ের আগের একটা সালোয়ার-কামিজ তোমার পরনে ছিলে, ময়ূরের রং, বেশ ঢিলেঢালা জামাটা, মাঝে মাঝে তারার মতো সাদা সাদা ফুটকি, তোমার মনে আছে? তোমার বাবা দেশের বাইরে থেকে তোমার জন্যে কিনে এনেছিল। আমার মনে পড়ে, তবে বলি, না মনে নেই। আমার আসলে জামার কথা খুব মনে নেই তবে সেই রাত বারোটার কথা মনে আছে। অ্যাম্বুলেন্সে করে আমাকে ও হাসপাতালে নিয়ে গেল, আমাদের লেডি ডাক্তার ফাহিমা আগেই সেখানে ছিল অন্য রোগী নিয়ে, তাকে কবি ফোন করেছিল যাওয়ার আগে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম সবার কথা শুনে। অ্যাটেনডেন্ট, নার্স সবাই মিলে বলল, অপারেশন করতে হবে। ও বলল, আপনারা আগে ভালো করে দেখুন। তারপর না অপারেশন। টাকা-পয়সা নেই সত্য, তবে টাকা-পয়সা নিয়ে সে কখনো ভাবে না, কাল কি হবে তাই নিয়েও তো ভাবে না কখনো। বিস্তর ধার-দেনা করে বন্ধু-বান্ধবের কাছে, ওডি করে, নানাভাবে সংসার চালায়। সে সবার মতামতের বিরোধিতা করলেও শেষে ডাক্তারের কথা শুনে সম্মতিপত্রে সই করে দিলো। তাকে আমার এই প্রথম খুব সাহসী মনে হলো। আমি তার ঘাড় ধরে, গায়ে ঠেস দিয়ে আস্তে আস্তে ওটির দিকে হেঁটে যাচ্ছি, সমস্ত ভার ওর ঘাড়ে। ওটিতে ঢুকে ডাক্তার ওকে বের হয়ে যেতে বলল, আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, না, তুমি যাবে না। আমি কেন কাঁদলাম আর ওর ওপর কেন এতো ভরসা করতে থাকলাম বুঝতে পারি না। ডাক্তার খুব বিপদে পড়লেন আমার কান্না দেখে। কবি বলল, দেখুন তো কিছু করা যায় কি না। অগত্যা তিনি বললেন, থাকুন আপনি। আমি ওর ডান হাত ধরে শুয়ে থাকলাম, আমার অপারেশন হলো, জ্ঞান ফিরল, সে তখনো দাঁড়িয়ে আর আমি তার হাত ধরে। খোকাকে কোলে নিয়ে সে বাইরে বাবা-মাকে দেখাতে গেল, আবার ফিরে এলো। এসব কথা কী করে ভুলি। সে বলে জামার কথা, ফুটকি দেওয়া জামা, হবে হয়তো, তবে অপারেশনের কথা না বলে সে জামার কথা বলে কেন? আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, সে বোধহয় কোনো কিছুকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চায়। আবার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গুরুত্বহীন করতে চায়। কেন চায় আমি বলতে পারব না। তার মনে কোনটা উঁকি দেয়, কোনটাকে সে বেছে নেয়, তুলে রাখে পঙ্ক্তির জন্য – আমি জানি না। সবটা সে বলে না।

ওর বাবা-মা মারা গেল পরপর। আগে মা, পরে বাবা। মা মারা যাওয়ার পর আমরা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কবর দিয়ে এলাম, যা যা করার সব করা হলো। বাড়ি ফিরে এসে সে কদিন ছুটি নিল। সারাদিন বাড়ি বসে থাকে; বই পড়া যার প্রধান নেশা সেই মানুষ বই খুলেও দেখে না, স্নান-খাবার সব অনিয়মিত হয়ে গেল। আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। একদিন দেখি সে কাগজে কী লিখছে আর কাটছে; খানিক পরে কাগজটা ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে ফেলে দিচ্ছে। আমি যত কথাই বলি সে শোনে না। মনে পড়ে একদিন সে বলেছিল, মা মারা গেলে আমি আর বাঁচব না, যদি বাঁচিও তাহলে এরকম থাকব না, অন্য রকম হয়ে যাব, সব লুপ্ত হয়ে যাবে। সব লুপ্ত হয়ে যাবে – এই কথার অর্থ আমি বুঝতে পারিনি, জিজ্ঞেসও করিনি, শুধু নিজের মতো করে ভেবেছি। দু-একটা কাগজ আমি খুলে দেখার চেষ্টা করি ওর আড়ালে, সে লিখছে, যাবার সময় হলো বিহঙ্গের, সব কাগজে একই কথা লেখা। আমি কী করব ভেবে পাই না। বাবা-মাকে ডাকব কি না বুঝতে পারি না, জানি তাতে তো কোনো লাভ নেই। আমার পড়াশোনা-বিদ্যাবুদ্ধি কোনো কাজে আসে না। আমি ওকে হাত ধরে তুলি, বুকের কাছে জাপটে ধরি, আস্তে আস্তে বলি, আর কারো মা মারা যায় না? সবাই তো এই কষ্ট পায়, তুমি এভাবে নিচ্ছো কেন? তাকে টানতে টানতে খাটের ওপর বসাই, বলি, তুমি যদি এরকম করো, তাহলে আমার কী হবে? সে এতোদিন পরে আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো, লাল চোখ, নির্ঘুম চোখ। সে বলতে থাকে, জানো, খুব ছোটবেলায় আমার খুব অসুখ করত, প্রতিবছর একটা বড় বড় অসুখ, ডাক্তার নয়, মা-ই আমাকে বাঁচিয়ে তুলত। আমার অসুখে মা পাগল হয়ে যেত, কোথা থেকে কীসব এনে খাওয়াতো, আর দোয়াদরুদ পড়ত। একবার তো আমি মারাই গিয়েছিলাম। সবাই জানত আমি আর ফিরব না। মা হা-হা করে বুক চাপড়ে কাঁদত, আমি বুঝতে পারতাম না, মা কেন কাঁদে। সেবারও মা আমাকে বাঁচিয়ে তুলল। তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না, সেই যে গল্পে পড়েছো না রাক্ষসের  প্রাণ থাকে একটা কৌটার মধ্যে, সেই প্রাণ নষ্ট করলেই রাক্ষস মারা যায়, আমার প্রাণ ছিল মায়ের বুকের ভেতর, আমি যেখানে থাকি না কেন, প্রাণ থাকে মায়ের কাছে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, সে বোধহয় আরো গভীরে চলে যাচ্ছে, আমার ভয় হয়। আমি বলি, তুমি মাকে নিয়ে লেখো, দেখবে, তোমার মা ফিরে আসবে তোমার লেখার মধ্যে। সে আমাকে আশ্চর্য করে বলে, না, মাকে নিয়ে লিখব না, মাকে নিয়ে কী লেখা যায়? লেখা তো তৈরি করা জিনিস, অনেক মিথ্যা-সত্যের কারসাজি, সেখানে মাকে রাখা যায় না, মা তো বুকের মধ্যে থাকে, তাকে বের করে বর্ণনা করা যায় না। সে বলতে থাকে, এখানে নক্ষত্রভরা রাতে আমি মায়ের চোখের তারা দেখতে পাচ্ছি, রাতের ক্রন্দনের সঙ্গে তার ব্যথার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, অবিরাম প্রসন্ন আলোয় তার মুখ ধুয়ে নিয়ে নিচ্ছি। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, আমি তাকে বিছানায় শুইয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি। সে মুখ বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে, আমার ভয় হয়, আমি জানি বিস্মরণ কবিদের মজ্জাগত। বাবা শিক্ষক ছিলেন বলে আমাকে এসব নিয়েও কথা বলেছিলেন একবার, নানা কথার মধ্যে এই কথাগুলোও মনে আছে। তাহলে কি ও আমাকেও একসময় ভুলে যাবে? আমার বিয়ে দাম্পত্য ভালোবাসা সব হারিয়ে যাবে? তাকে যতটুকু চিনেছি, তার মধ্যে কোনো ফাঁকি নেই, তবে ভয় সেখানে যেখানে তার আয়ত্তের বাইরেও অনেক কিছু রয়েছে। মানুষ পৃথিবী নিসর্গ আর সব খুঁটিনাটিকে ভালোবাসার কারণে তার ভেতরে সংবেদ তৈরি হয় অনরবত। তাই তাকে ভাবায়। আমি মাঝে মাঝে তুচ্ছ হয়ে যাই, তবে যতটুকু তাকে পাই সেটা নিখুঁত, তার তুলনা নেই, তার অর্থ এইটুকু নিয়েই আমাকে থাকতে হবে? আমি পারব? নাকি এই খোকা আমাকে ভুলিয়ে রাখবে? ও আমাকে সব দিতে পারে? আমি ইতিহাস লিখতে চাই না বরং বুঝতে চাই মাঝে পাঁচ বছরের যাপিত জীবনে তার সঙ্গে সম্পর্ক কি কৃত্রিম? সে কি একটা রঙের অচলায়তন তৈরি করেছে আমার জন্য, আমাকে ভুলিয়ে রাখার জন্য কিছু কারসাজি? সংসার সম্পর্ক বাৎসল্য প্রেম সংরাগ সব মিলিয়ে সে কতটুকু আমার? কোনো দেয়াল কি তৈরি হয়েছে কখনো এর মধ্যে?  মাঝে মাঝে সে ফোনে কথা বলে, কার সঙ্গে বলে জানার কোনো ইচ্ছে  হয় না সাধারণত, তবে তার তো বন্ধুবান্ধবের অভাব নেই, হাজার হাজার বন্ধু, একদিন এক রাতে সে কার সঙ্গে কথা বলছে নিচু স্বরে, আমার সন্দেহ হয়, সন্দেহ হতো বিয়ের পরপর বেশি বেশি, তখন তাকে অনেক ভুল বুঝেছি। আমি কাছে গিয়ে বললাম, কার সঙ্গে কথা বলো? সে ইশারা করে বলে পরে বলছি। আমার খুব রাগ হলো, আমি ফোনটা কেড়ে নিলাম, দেখলাম  লাইনটা ডিসকানেক্টেড হয়ে গেছে। বললাম, তুমি লাইনটা কেটে দিলে কেন? সে বলল, কাটব কেন, এমনিই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারপর বললাম, রাতদুপুরবেলা মেয়েদের সঙ্গে তোমার এতো কী কথা? সে বলল, কেন কথার আবার রাতদুপুর কী, ওর প্রয়োজন হয়েছে তাই ফোন করেছে, কী একটা বই বের করবে, প্রকাশনী ও ছাপা বিষয়ে কথা বললো। আমি বললাম, আমাকে কি গরু-ছাগল মনে করো, কিছুই বুঝি না ভাবো। অনেক সহ্য করেছি, আর না, আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। সে বলল, তুমি বরং আবার ফোন করো, দেখবে সুনন্দা তোমার সঙ্গে কথা বলবে, ও তো আমার সহপাঠী। আমি মুখ ভেংচি দিলাম ওর দিকেই, অন্ধকারে ও হয়তো বুঝতে পারল না। তবে লাইন দিয়ে আমার কাছে ফোন দিলো, সত্যি আমি ওকে চিনতে পারলাম, একবার দেখা হয়েছিল ঢাকায়। আমি একটু লজ্জা পেলাম। সে বলল,  হেমন্তের একটা গান আছে না? তুমি দেখো নারী পুরুষ, আমি দেখি শুধু মানুষ। আমি বললাম, ও তুমি সন্ন্যাসী হয়ে গেছো নাকি? সে উত্তর দেয় না, মিটিমিটি হাসে।  আমি খানিকটা বিভ্রমে পড়ি।

ঝড়জলের একরাতে আমাদের বিয়ে হয় পারিবারিক এক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে, আমি তাকে ঠিক পছন্দ করিনি, আবার অপছন্দও করিনি, বেশ হ্যান্ডস্যাম যুবক, লেখাপড়ায় ভালো, ভালো চাকরি করে,আর কেমন ভীরুতা চোখে-মুখে। বিয়ে শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক পর ঝড়বৃষ্টি থামল, তবে রওনা দেওয়ার পর ওর বাসায় পৌঁছানোর ঘণ্টাখানেক আগে আবার প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো, সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি। ভীষণ বজ্রপাতের শব্দে ভয় পেয়ে আমি না বুঝেই অতর্কিতে ওকে জড়িয়ে ধরলাম, চারিদিকে অন্ধকার, পেছনের সিটে আরো দুজন নিকটাত্মীয় ছিলেন। আমি ভয় থেকে মুক্তি পেলাম, সে আমাকে বাঁ হাত দিয়ে ধরে যেন অভয় দিলো, বুঝিয়ে দিলো, যেন কিছুই হয়নি। আমি স্বস্তি পেলাম, এই স্বস্তির কোনো নাম নেই, অন্য কোনো নাম হতে পারে তার। বাধ্য হয়ে আমরা রাস্তার একপাশে চল্লিশ মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। কবি কি ভেবেছিল আমাদের প্রথম শারীরিক স্পর্শে আমি জানি না, আমি তাকে জিজ্ঞেস করিনি, তবে ভীতবিহ্বল হলেও সেই ঘন অন্ধকারে বজ্রপাতের ভয়ার্ত পরিবেশের মধ্যেও আমি তার উষ্ণতা পেয়েছিলাম, যা জীবনের প্রথম উত্তেজনা, স্পর্শের আনন্দ।  সেই থেকে এই স্পর্শ আমি চিনি, অনুভব করি, উপলব্ধি করি কবিকে। তার বেলায় ব্যাখ্যাটা কেমন আমি জানি না, জানতে চাইলে কী বলবে আমি হয়তো বুঝবো না, তার সব ব্যাখ্যা আমি বুঝি না, তবে না বুঝলেও একধরনের বোধের জন্ম হয় তার কথার জাদুতে। আমি তার অনেক কবিতা পড়েছি, তাকে বোঝার জন্য, আমি জানতে চাই, সে কেন লুকাতে চায় – সেটাও জানতে চাই। একদিন হয়তো বলবে নিজের থেকে। খোকা থামলে তাকে বালিশে শুইয়ে দিই, সে আবার ঘুমিয়ে পড়বে। বারান্দার দিকে এগোতেই দেখি ও গান ধরেছে; কাছে গেলাম। গাইছে – তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা, মম শূন্য গগনবিহারী, আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা, তুমি আমারি, তুমি আমারি, মম অসীম গগনবিহারী, তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াই, সে বুঝতে পারে কি না জানি না, গান থামায় না – মম হৃদয় রক্তরাগে তব চরণ দিয়েছি রাঙিয়া, অয়ি সন্ধ্যা স্বপনবিহারী, তব অধর এঁকেছি সুধাবিষে মিশে মম সুখদুখ ভাঙিয়া; তুমি আমারি, তুুমি আমারি, মম বিজন জীবনবিহারী, তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা। সে থামে। অন্ধকারে তার চোখ চিকচিক করছে। এই গানে অশ্রুর সংযোগ কোথায় আমি জানি না। তবে সে যখন গভীরভাবে গান গায়  তখন তার চোখে জল আসে, সেটা আবেগের প্রাবল্যে হওয়ার কথা। আমি মাঝে মাঝে বিস্মিত হয়ে যাই গান না শিখেও সে কীভাবে এতো ভালো গান গায়, যদিও আমি গান তেমন বুঝি না, তবে ভালো শ্রোতা হিসেবে যেটুকু অভিজ্ঞতা আছে তাতে মনে হয়, সে খুব ভালো গায়। আমি একদিন তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, সে বিয়ের কয়েকদিন পরে আমাকে রবি ঠাকুরের একটা গান শুনিয়েছিল, আমি, সন্দেহ নেই, মোহিত হয়েছিলাম, বলেছিলাম, তুমি তো গানের চর্চা করতে পারো, ভালো শিল্পী হওয়ার সমস্ত লক্ষণ তোমার মধ্যে আছে। সে একটু হেসে বলেছিল, না, না, তুমি ভুল বলছো, আমি গান শুনি, আর মাঝে মাঝে ভুলভাল গাই, আর সব করতে গেলে হয়? আমি তো একটু-আধটু লিখি জানো, সেই জায়গাটা ভালো করে ধরবার জন্য গান শুনি আর গাই। আমার ঘোর লাগে, কথা বুঝতে পারি না। আমি বলি, একটু গুছিয়ে বলো। সে বলে, তোমাকে একটা বিদ্যে শিখিয়ে দিয়েছিলাম না, সেটা প্রয়োগ করো, তারপর বলি। আমি ওর দিকে ফিরে অনুচ্চস্বরে হাসি, বলি, ও অন্যদিকে মোড় ঘোরাতে চাও। সে বলে, না তো, দেখো এখানেও প্রসঙ্গ আছে। আমি সত্যি সত্যি ওর পায়ের পাতার ওপর দাঁড়িয়ে ওর ঠোঁটে চুমু খাই। সে আমার দুই হাতের ডানা উঁচু করে ধরে আমাকে সামান্য সাহায্য করে। সে আমাকে বুকে টেনে নেয়, তারপর বলে, শোনো, সব কাজের কিছু অনুষঙ্গ লাগে, অনুপান লাগে বলতে পারো। ধরো, এই গানটা, দুয়ার মোর পথপাশে, সদাই তারে খুলে রাখি, কখন তার রথ আসে, ব্যাকুল হয়ে জাগে আঁখি – এই গানটা শোনার বা বিশেষত গাওয়ার সময় আমি নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারি, আমার ভেতরের অনুভবসজ্জা পাখা মেলতে থাকে, আমি সেই সংবেদনায় ডুবে নতুন ভুবনের সন্ধান পাই, হলো? ব্যাখ্যা বিশ্বাস হলো? আমি বললাম, আমার বোঝার দরকার নেই। আমি বললাম বটে, তবে গান যে এভাবে শোনা যায়, এর যে এরকম চরিত্র আছে  ভেবে  একটু বিচলিত হই।  সে সত্যি আমাকে তার ভুবনের দিকে টানতে থাকে একটু একটু করে। আমি বলি, তুমি কাকে কাকে রচনা করেছো, কে কে ছিল, ঘন অন্ধকারে মুগ্ধ নয়নবিহারীকে কীভাবে পেলে? সে হাসে, দেখো রমা, রবিঠাকুর যে-কথা বলতে চান তা তো আমরা বুঝতে চাই না, বা সেই নির্মাণ বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তবে গানে যে অনবদ্য হৃদয়াবেগের জন্ম হয় তা তো মিথ্যে নয়। এরাই আমাদের পথ দেখায়, রঞ্জিত করে, নতুন নতুন চোখ তৈরি করে। প্রকৃতি জীবনের রহস্য আর প্রাক্তন কবিদের হাতছানি মিলে আমরা একটু সচকিত হই আর নিজের আত্মার ধ্বনি প্রতিধ্বনির মিলিত উত্তেজনায় লিখে ফেলি পদ। চলো, অনেক হয়েছে। একটু চা খাই চলো।

বাড়িতে মাঝে মধ্যে কেউ কেউ থাকে, অনেকদিন হলো কেউ নেই, বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সামনে গাছপালা আর সবজিবাগান, পাখি, পোকামাকড় আমাদের সখা এখন। ছেলেটা তো কিছু বলতেই শিখল না। চায়ের সঙ্গে হাতে-ভাজা আমন ধানের মুড়ি সরিষার তেল সহযোগে আমরা খেতে থাকি, সেসব খাবারের সঙ্গে মায়ের খাবারের তুলনা করে প্রায়শ। সে মায়ের রান্নার প্রতিটি পদের বর্ণনা  দেয় সবিস্তারে। কোন তরকারির সঙ্গে কোন মাছ, কীভাবে চিতই পিঠা খেতে হবে, কোন সময় কাঁটাখুড়ো শাক চিংড়ি সহযোগে মা রান্না করত, সে রেসিপিসহ বর্ণনা করে। নয়না মাছ রান্না করতে হবে বেগুন অথবা চালকুমড়ো দিয়ে, মাটির নিচে বড় আলু রান্না করতে হবে বড় কাতলা মাছ দিয়ে আর তার সঙ্গে থাকবে মাষকলাইয়ের বড়ি, ঝিঙে-পটোল আর নতুন আলুর সঙ্গে কই বা টেংরা মাছ ঝোল হবে, তবে খেতে হবে ভোরবেলা লাল চালের ভাত দিয়ে। সব প্রসঙ্গ, তার প্রকরণ ওর মুখস্থ। আমি বলি, ধরো, মানুষের নাম তোমার মনে থাকে না, আমার খালাত বোন শানু যে তিন মাস প্রায় থাকল এখানে, তার নাম তুমি মনে রাখতে পারো না, আর এসব মাছের নাম, সবজির নাম কীভাবে মনে রাখো, ব্যাখ্যা করো। সে বলে, পরীক্ষার প্রশ্নের মতো বলছো দেখি। দেখো, স্মৃতি বহু রকমের হয়, লং বা শর্ট হতে পারে। স্মৃতিশক্তি নির্ভর করে সম্ভবত তোমার আগ্রহের ওপর। যে-বিষয়ে তোমার আগ্রহ বেশি সেটাই তোমার মনে থাকবে, বাকিটা তোমার ব্রেন অটো ডিলিট করে দেবে, ব্রেনের সেই অপশন আছে, কম্পিউটারেরও তা নেই। আমি বলি, তার মানে তুমি যা ইচ্ছা তাই মনে রাখবে, বাকিটা ছেঁটে ফেলবে। সে বলে, না, তাও না। ব্যাপারটা এতো সোজা নয়, একটু গোলমেলে। এমন হয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আমার দরকার তা হারিয়ে যায়, আমি হয়তো কাজের জন্য জোড়াতালি দিয়ে চালাই কখনো, ফিকশনে এই সমস্যা আরো বেশি। আমি আগেই ওর কাছ থেকে মুক্ত হয়েছিলাম, বলি, তাহলে তো আমার অবস্থা খুবই খারাপ, পাঁচ বছরেও আমি তো তোমার মেমরিতে নেই, তুমি তো আমাকে ডিগবাজি দিয়ে যখন-তখন ফেলে দিতে পারো, আমার ওজন কতটুকু তোমার কাছে? সে জবাব দেয় না, সে বলে, সব ফাঁকি হে, রঙের খেলা, নিজেকে মশগুল রাখার কৌশল বলতে পারো, আর তোমাকে আমি ভুলতে পারব না বোধহয়। আমি বলি, বোধহয়? তাই না?

কতটুকু জানি তোমাকে?

আমি তো মনে করি সব।

না, সামান্যই।

কেন?

মানুষকে জানা সহজ নয়।

আমি মানুষ?

বিশেষ মানুষ।

তাকে নির্বিশেষ করতে চাও?

হ্যাঁ, তাকে জানতে চাই গভীরভাবে, ভালোবাসায়, ভালোবাসাহীনতায়।

এটা কী রকম কথা।

খুব ভালো কথা। আমি আলো জ্বেলে দিই ঘরে। খোকা ঘুমাচ্ছে। পৃথিবী ঠান্ডায় কাঁপছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কী ভাবছে আমি জানি না, চোখে দেখে তা বোঝার কোনো উপায় তো রাখেনি সে।