একটি চিরকুট ও একজন আতিকউল্লাহ

নেতা, পাতিনেতা, সাংবাদিক, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, সুহৃদ, শত্রু সবার সময়-অসময়ের উৎপাতে বাড়িটা যেন বাজার হয়ে উঠেছে। এমন ঘটনা পরিচিত পরিবেশে এর আগে আর ঘটতে দেখেনি কেউ, শোনেওনি। অপার কৌতূহল যেন হঠাৎ তেড়ে আসা সুনামির মতো নানা প্রশ্ন নিয়ে নানা সম্ভাবনায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে।

হাট-বাজার, চায়ের স্টল, বৈঠকখানা, পার্টি অফিস, গলির মোড়ের আড্ডা – সর্বত্র সব কথার মাঝে প্রসঙ্গটি কৌতূহল, ঈর্ষা, অহংকার, আগ্রহের অপরিচিত ঘ্রাণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হয়ে ঠিক দাঁড়িয়ে যায়। কেউ কোথাও উপেক্ষা করতে পারে না।

 প্রায়ান্ধ চোখে তিনি ছবিটার গায়ে হাত বুলান। আজকাল অনেক কিছুই স্পষ্ট দেখতে পান না, চোখে ছানি, যতটা বয়সের কারণে পড়েছে, তার তারচেয়ে বেশি পড়েছে অসহায় হতাশায় আর অপেক্ষার অসহায়ত্বে। দুই-ই বড়ো নাচার। সহ্যও হয় না, বিপরীতে লড়াও যায় না। দাঁতে দাঁত চেপে মেনে নিতে নিতে একসময় গা-সওয়া হয়ে যায়, তীব্র গ্রীষ্ম কিংবা তীব্র শীতের মতো।

দিনের পর দিন তিনি অপেক্ষা করেছেন। সব আবেগ, ক্ষোভ আর অসহায়ত্ব ঝুলিতে পুরে নিয়ে অপেক্ষা করেছেন। নিশ্চয়ই একদিন সেইদিন আসবে। তিনি যেদিনের অপেক্ষা করছেন। বুঝি অপেক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে, ছানিপড়া ঝাপসা চোখেও আজ তিনি স্পষ্ট দেখছেন বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টার থেকে মাটিতে পা রাখছেন। স্পষ্ট দেখছেন বত্রিশ নম্বর বাসায় ট্রে হাতে করে চা এনেছিল যে-মেয়েটি, সেই মেয়েটির মায়াবী মুখ, পলিমাটির মতো মায়াবী মুখ। মেয়েটি এখন দেশের পিএম (প্রধানমন্ত্রী)। তাঁকে ডেকেছেন।

তাঁর সারাদিনের কাজে যেন উৎসাহের প্রাবল্যে আনন্দ ঝলমল করে, নৈমিত্তিক কাজগুলো করতে করতে তিনি আপনমনে হাসেন। মিনু টিপ্পনী কাটে, কী হাসো ক্যান, শেলির কথা মনে পড়ছে? তিনি হ্যাঁ-না কিছু বলার বাহুল্যে যান না। চুপ করে থেকে নিজেকে এক অনির্বচনীয় স্বস্তির ভেতরে মুড়ে রাখেন। শেলি তাঁর জীবন থেকে আড়াল হয়েছে পঞ্চাশ বছর, শেলির স্মৃতি অস্পষ্ট না হলেও, তার দহনের আঁচ আজ আর নেই। আজ এই হাসির কারণটা মিনু বুঝবে না। মিনু বুঝবে না তিনি হাসেন তাঁর বিশ্বাসের জয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন, এমন দিন আসবে। আসতেই হবে। প্রকৃতি কোনো হিসাব বাকি রাখে না। সব ফিরিয়ে দেয়। 

বিয়ের পরপর এ নিয়ে মিনুর সঙ্গে বিস্তর ঝগড়াঝাটি হয়েছে – ততোদিনে ব্যবসাপাতি গুটিয়ে নিশ্চিত রোজগারের একটা চাকরিতে ঢুকে গেছেন তিনি। ফটোগ্রাফির নেশাটা প্রয়োজনের দুনিয়ায় নেহাত অকেজো হয়ে গেছে দুঃস্বপ্নের মতো। পুরো দেশটাই ঢুকে গেছে একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর। যেখানে কোথাও বঙ্গবন্ধু নেই, আছে কতগুলি বিশ্বাসঘাতক, বঙ্গবন্ধুর নাম ঘষে মুছে ফেলা বিশ্বাসঘাতক। বিশ্বাসঘাতক সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা তিনি একজন আতিকউল্লাহ, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা ছাড়া যাঁর আর কোনো দোষ ছিল না, অনেক মাশুল দিয়ে তিনিও আপস করে নিয়েছেন বেঁচে থাকার দরকারে – চাকরি, বিয়ে। অন্যজীবন। স্টুডিওতে যুদ্ধফেরত বন্ধুদের আড্ডা তখন বিভীষিকা, থিয়েটারের নেশা লক্ষ্যহীন পাগলামি। একদিন পুলিশ এসে ভেঙে-গুঁড়িয়ে দিলো স্টুডিওটা। ভাঙা ক্যামেরা, স্ট্যান্ড, পেছনে ফুলের বাগান আঁকা পর্দা, সিঁড়ি আঁকা পর্দা সব তিনি কুড়িয়ে এনে তালাবদ্ধ করেছেন একটা আলমিরায়। এগুলি কেবল কিছু ভাঙাচোরা, ছেঁড়া-ফাঁড়া বস্তু নয়। এর পরতে পরতে লেগে আছে ইতিহাস। কত স্মৃতি এই স্টুডিওর। শেলির সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করার স্মৃতি, গভীর রাতে বন্ধুদের যুদ্ধে যাওয়ার পরামর্শ সভার স্মৃতি। ফিরে এসে অস্ত্র লুকিয়ে রাখার স্মৃতি …। যৌবনই তো মানুষের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি। স্মৃতিহতের মতো তিনি সব কুড়িয়ে এনে আলমিরায় তালাবদ্ধ করে আগলে রেখেছেন যক্ষের ধনের মতো। পরিবারের সবাই একে এখন অহেতুক পাগলামির মতো মেনে নিয়েছে। কদিনই বা বাঁচবে লোকটা। আতিকউল্লাহ, গড় আয়ু সত্তরের দেশে পঁচাত্তর ছুঁইছুঁই বোনাস জীবন যাঁর!

একবার তো এসব নিয়ে মিনুর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির উপক্রম। কী লুকায় আতিকউল্লাহ? কাঠের পুরনো আলমারি, যা খুললেই প্রাগৈতিহাসিক ঘ্রাণ ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে, শান্ত ছেলের মতো ঘরের ভেতর স্থির হয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ। ঘরের অন্যান্য আসবাব ড্রেসিং টেবিল, খাট, আলনা, চেয়ার, টেবিল সব যেন জাপটে ধরে রাখে সেই প্রাগৈতিহাসিক ঘ্রাণ। ঘরে ঢুকে দমবন্ধ লাগে মিনুর। কৌতূহল বেসামাল হয়ে পড়ে তার।

সেই আলমিরাতে কী আছে জানে না মিনু – ঠাসা জিনিসপত্র। প্রতিদিন নিয়ম করে একবার খোলেন আতিকউল্লাহ। কী যেন করেন, তারপর আবার বন্ধ করে রাখেন। এই রোজ আলমিরা খোলা, লাগানো এতে কারো কোনো সমস্যা হয় না; কিন্তু সমস্যাটা হলো এই আলমিরাটা খোলার সময় তিনি দরজায় খিল আটকে নেন আর চাবিটা কিছুতেই হাতছাড়া করেন না!

নববিবাহিত মিনু কয়েকদিন লক্ষ করার পরই ভাবিদের জানিয়েছে ঘটনাটা। ভাবিদের মুচকি হাসির আগামাথা কিছু বুঝতে না পেরে আতিক সাহেবের পেছনেই পড়েছে। প্রতিদিন দরজা লাগাইয়া আলমিরা খুলে কী দেখেন আপনি? এইটার ভিত্রে কী? আতিকউল্লাহ হালকা চালে এড়িয়ে যান, আরে আমার স্টুডিওর পুরানা জিনিসপত্র। আতিক সাহেবের হেঁয়ালি উত্তর নির্বিবাদে মেনে নেওয়ার মতো বোকা মেয়ে নয় মিনু। দরজা বন্ধ কইরা খুলেন ক্যান, পুরানা জিনিসপত্র ফালাই দিলেই পারেন, জমাইয়া রাখছেন ক্যান ইত্যাদি নানাবিধ প্রশ্ন শেষে চাবিটাই চেয়ে বসে আতিকউল্লাহর কাছে। দেন  তো আমারে, দেখি ভিত্রে কী! বলেই ছিনতাইকারীর মতো একটানে চাবিটা হাতে নিয়ে নেয় মিনু। যেন হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন আতিকউল্লাহ। চাবিটা নেওয়ার জন্য তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন মিনুর ওপর। ধাক্কাধাক্কিতে মিনুর হাত চিরে যায় খাটের কোনায় লেগে – একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড। হতভম্ব মিনু সেদিন ভাবিদের স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, আতিকউল্লাহের সঙ্গে আর সংসার করবে না সে।

তখনই ভাবিরা শেলির কথা ফাঁস করে মিনুর কাছে। ছোট্ট মফস্বল শহরটাতে চেনা গলির মতোই সবাই সবাইকে চেনে – গুটিকয়েক সরকারি কর্মকর্তা, যারা শহরে পরিবার-পরিজন সমেত আসে তাদের হাঁড়ির খবরও সবার জানা থাকে। স্থবির জনপদে হঠাৎ ঢিলপড়া তরঙ্গের মতো শেলির গল্প তখন শহরের মানুষের মুখে মুখে। ঘরে ঘরে, উঠানে উঠানে। আড্ডায় আড্ডায়। ভাবিরা সান্ত্বনা দেয়, হয়তো শেলির চিঠিপত্র হবে। তুমি কিছু মনে করো না। শেলি বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নি – এখন কোথায় আছে কে জানে।  ওর কি আর আতিকউল্লাহকে মনে আছে? বাদ দাও ওর পাগলামি। মন দিয়া সংসার করো। 

আসলেই এক অখ্যাত শহরের অখ্যাত মানুষ আতিকউল্লাহ। গলির মোড়ে একটা স্টুডিওর ফটোগ্রাফার। স্টুডিও বলাকা। সারাদিন ছবি তোলা পেশা যাঁর, শেলির তাঁকে মনে আছে কি না কে জানে! 

থাকার কারণও নেই। তবে তিনি শেলিকে ভুলতে পারেননি এটা ঠিক। হয়তো একতরফা, তবু প্রথম প্রেম জীবনে জড়িয়ে থাকে দুর্ঘটনার দাগের মতো। সুসময়ের ফুলের ঘ্রাণ মানুষ ভুলে যায়। জীবনের কোনো বাঁকে পুনরায়

আবার ঘ্রাণ নাকে এলেই কেবল মনে পড়ে, দুর্ঘটনার ক্ষত প্রাথমিক যন্ত্রণা কাটিয়ে গায়ে লেগে থাকে আজীবন, চাইলেও ভোলা যায় না। শেলি জীবনের সেই অমোচনীয় দাগ।

ঘরে মুরগি মুসাল্লাম আর পোলাও রান্না হয়েছে। বড় ছেলে ফয়সাল নিজে বাজার করেছে। তাকেই ডেকে নিয়ে খবরটা জানিয়েছেন স্থানীয় এমপি। প্রাইম মিনিস্টার আতিকউল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে চান। মিনু অনেকদিন পর হাত খুলে রান্না করেছে। বাসাময় চাপা আনন্দ। কেউ আনন্দে লাফাচ্ছে না, কিন্তু আনন্দের উত্তাল স্রোত চেপেও রাখা যাচ্ছে না। কেউ মানে সে মিনু, ছেলে ফয়সাল, ফয়সালের বউ-ছেলে আর ছোট ছেলে নেহাল। মানুষই সাকল্যে ছয়জন। এই মুরগি মুসাল্লাম রান্নাটা মিনু শিখেছে শাশুড়ি অর্থাৎ আতিকউল্লাহর আম্মার কাছে। আর আম্মা শিখেছে শেলির আম্মার কাছে। বিটিভিতে বঙ্গবন্ধুর বিরল সব ভিডিও ক্লিপস দেখানো হচ্ছে। তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। কোথাও কোনো কোণে কি শেলিকে দেখা যাচ্ছে? শেলি কোথায় আছে? কেমন আছে? শেলি কি বেঁচে আছে? মিনু টেবিলে খাবার দিয়ে তাড়া দেয় অন্যমনস্ক বসে থাকা আতিকউল্লাহকে, তাগদা কইরা খান ফয়সালের বাপ। মুরগির রানটা মিনু তার পাতে দেয়। তিনি অনেকদিন পর অসাধারণ মুসাল্লামের স্বাদ পান।  আতিকউল্লাহ ভালোবাসেন বলে শেলির মা মুরগি মুসাল্লাম রান্না করেই তাঁকে ডাকতেন। আতিকউল্লাহ অপেক্ষায় থাকতেন, কখন চাচি আম্মা ডাকেন – এই একটুখানি সময় শেলিকে পাওয়া যেত বাঁধাহীন। চাচা-চাচি ছিলেন অসাধারণ মানুষ। খাওয়ার অজুহাতে আতিকউল্লাহ গল্প জমাতেন শেলির সঙ্গে বারান্দায়। চাচা-চাচির ঘরে রেডিওতে গান বাজতো – ‘যব পিয়ার কিয়াতো ডরনা কিয়া…’। পঞ্চাশ বছর আগে মফস্বলের দুই যুবক-যুবতী খোলা বারান্দায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কী রাজ আলাপ করত এখন আর কিছুতেই মনে করতে পারেন না আতিকউল্লাহ, তবে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে না বোঝার ভানে দুজন দুজনের হাত ছুঁয়ে দিতেন একটু। শেলির জোড়া ভ্রু আর ঘন পল্লবের আকর্ষণ ছিল বড় বেশি, ভেতরের সব শিহরণ যেন জমা হয়ে থাকতো সেখানে। ধীরে সন্ধ্যা নামলে বাধ্য হয়ে উঠে আসতে আসতে প্রতিদিন আতিকউল্লাহর মনে হতো, এমন মধুর সন্ধ্যা বুঝি কখনোই তাঁর হবে না, এমন সন্ধ্যায় তিনি কেবলই অতিথি হয়ে থাকবেন শেলির কাছে।

প্রাইম মিনিস্টার আতিকউল্লাহকে ডেকে পাঠিয়েছেন – খবরটা শহরে চাউর হতে ঘণ্টা কয়েক লাগে। শহরের দুয়েকটা স্থানীয় পত্রিকা লিড নিউজ করে দেয়। মুখে মুখে রটে যায় খবরটা। নানা জল্পনা-কল্পনা মুখে মুখে। কী দেবেন পিএম আতিকউল্লাহকে, কয় লাখ টাকা? নাকি জমি? নাকি অন্যকিছু? কেন ডেকেছেন পিএম আতিকউল্লাহকে? লোকের কল্পনা-ভাবনা কিছুই বাস্তবতাকে নাগালে ধরতে পারে না। উৎসুক কৌতূহল কেমন থইহীন নানা সম্ভাবনায় হারিয়ে যায়।

থিয়েটারের নেশা ছিল আতিকউল্লাহর। সেবার সিরাজউদদৌলা নাটকে আলেয়া চরিত্রের জন্য নারী খোঁজা হচ্ছিল। প্রতিবছর বাইরের যাত্রাদল থেকে মেয়েদের উচ্চ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এনে অভিনয় করাতে হয়। নির্দেশক হিসেবে বড় অতৃপ্তি থেকে যায়। মুখস্থ ডায়লগ থ্রো করে তারা চলে যায় – না এক্সপ্রেশন, না আবেগ, না চরিত্রের ভেতরে ঢোকা – কোনো দায় নেই তাদের। নির্দেশক হিসেবে খুব অস্বস্তি হতো আতিকউল্লাহর। এতো পরিশ্রম, সময় – এরপরও স্বস্তি পেতেন না এই একটা কারণে। তাদের ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়াটা মুশকিল হয়ে পড়ে। তারা ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায়।

অনেক ভেবেচিন্তে মেয়েদের স্কুল-কলেজগুলিতে একটা উদ্যোগ নিলেন তিনি। হেঁটে হেঁটে মেয়েদের স্কুল আর কলেজে দুটি হাতে লেখা আবেদনপত্র দিয়ে এলেন আতিকউল্লাহ। এক্সিবিশনে প্রদর্শনীর জন্য নতুন নাটকে অভিনয়ে ইচ্ছুক মহিলা অভিনেত্রী প্রয়োজন। আগ্রহীরা যোগাযোগ করতে পারেন। শহরের মেয়েদের কমবেশি চেনেন তিনি। জানতেন কেউ আসবে না। অপ্রত্যাশিতভাবে সেবার বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাঁকে ডেকে সুখবরটি দিলেন। শহরে নতুন আসা মেয়েটি অভিনয় করতে ইচ্ছুক। শেলির সঙ্গে তখনই পরিচয়। পরে বাসা খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, শেলিরা আতিকউল্লাহদের একদম পাশের বাসার বাসিন্দা। একসঙ্গে রিহার্সালে আসা এবং যাওয়া। আতিকউল্লাহর আম্মার সঙ্গে দ্রুতই খাতির হয়ে যায় শেলির আম্মার। জানালা দিয়ে বাটি-চালাচালি। বিকেল বিকেল দুজনের গল্প। ম্যাটিনি শোতে সিনেমাও দেখতে যেতেন দুজন। শেলির আম্মা আতিকউল্লাহর আম্মাকে শেখাতেন মোগলাই রান্না আর আতিকউল্লাহর আম্মা শেখাতেন সাতকড়া দিয়ে রাজহাঁসের মাংস, কুমড়োর মোরব্বা। দু-বাড়ির মাঝে একটা পলকা বাঁশের বেড়ায় মোটেই আটকাতো না তাদের গভীর সখ্য। 

তবু মফস্বলের পরিবেশে কোনো যুবকের যখন-তখন সে-বাড়িতে অবাধে ঢোকা যায় না, যে-বাড়িতে যুবতী মেয়ে আছে। শুধু মুরগি মুসাল্লাম হলেই আর কোনো কথা নেই – আতিকউল্লাহর বাঁধা দাওয়াত শেলিদের বাড়ি। টাউন হলে সিরাজ আর আলেয়ার অভিনয় করতে করতে শেলির আঞ্চলিক টানহীন কথা বলার ভঙ্গি, জড়তা-সংকোচহীন স্মার্টনেস তাঁকে দুর্বল করে দিয়েছিল শুরুতেই। আসলে শেলি তেমন নারী, যার প্রতি দুর্বল না হয়ে পারে না কোনো পুরুষ। জানালা খুলেই দু-বাড়ি থেকে দুজনার চোখাচোখি। তারপর দিনমান বিকালে রিহার্সালের অপেক্ষা। অনেক যত্নে মুখে ক্রিম আর চুলে সুগন্ধি তেল মাখতে দেখে বড় ভাবি টিপ্পনী কাটতো, ঘটনা কী আতিক, ইদানীং তেল-মশলা বেশি মাখতেছ!

শেলির বাবা সেই ছোট্ট শহরটির কী যেন এক অফিসার ছিলেন, যেদিন তাঁর বদলির অর্ডার এলো স্টুডিওর পেছনে বসে চেইন সিগারেট টেনেছে আতিকউল্লাহ। এক শহরের দুই প্রান্তে দুজন, আতিকউল্লাহর সেদিন মনে হচ্ছিল, শেলি আর তিনি দুই সমান্তরালে রেললাইন, কোনোদিন এক হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। শেলিরা চলে যাওয়ার পর বেশ কদিন দু-তরফেরই চিঠি-চালাচালি ছিল। তারপর একসময় এশিরিয়া ব্যাবিলনের মতো তাও হারিয়ে গেছে। বারকয়েক একতরফা লিখে গেছেন আতিকউল্লাহ, উত্তর না পেয়ে ক্ষান্ত দিয়েছেন। কে জানে শেলি কোথায় কী অবস্থায় আছে! হয়তো বিয়েশাদি হয়ে গেছে। যদি ওর বরের হাতে পড়ে কোনো চিঠি! কত ভাবনা তাঁকে শেষ পর্যন্ত বিরত করেছে!   

রানের মাংসটায় দাঁত বসিয়ে তিনি ভাবেন, শেষ পর্যন্ত শেখের বেটি ক্ষমতায় এলেন। তিনি ভাবেননি জীবদ্দশায় এটা দেখতে পাবেন, ঘোরগ্রস্তের মতো তিনি বলতে থাকেন, শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ডাকলো মিনু! মিনু আজ আর রাগে না, ভুল ভাঙিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু নয় গো, বঙ্গবন্ধুর মাইয়া। কী অসীম রহমত আল্লাহর! আতিকউল্লাহ জানে, মিনু যে ভুল শুধরে দিয়েছে সেটা তিনি ইচ্ছা করেই বলেন। তাঁকে বঙ্গবন্ধুই ডেকেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, তিনি তাঁকে ডাকবেন। অপেক্ষায় অপেক্ষায় জীবন সেই সন্ধ্যাটির মতো দাঁড়িয়েছে, যে-সন্ধ্যা পঞ্চাশ বছর আগে শেলিদের বাসার বারান্দায় নেমে আতিকউল্লাহকে জানিয়ে যেত, এখন চলে যেতে হবে। অপেক্ষার বুঝি শেষ হতে চললো।

খাওয়ায় মনোযোগ দেন আতিকউল্লাহ। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হয়ে বঙ্গবন্ধু যেদিন এই মফস্বল শহরটিতে এসেছিলেন, তার আগের রাতে সারারাত তিনি বসেছিলেন জালাল স্টেডিয়ামের মূল মঞ্চের পাশে। কোনো কারণ ছিল না। বঙ্গবন্ধু আসবেন, এই মঞ্চে বসবেন। যাঁর জন্য দেশ আজ স্বাধীন – তিনি শেলির মামা বঙ্গবন্ধু। তাঁর কোনো অ্যাঙ্গেলের ছবিই বাদ দেওয়া যাবে না।  কী ভাগ্য আতিকউল্লাহর। হেলিকপ্টার থেকে যখন তিনি নামলেন, সেই মুহূর্তেই পরপর ক্লিক করলেন আতিকউল্লাহ। তারপর মানুষের ঠেলাঠেলি-ধাক্কায় আর একটাও ছবি নিতে পারলেন না তাঁর।

স্টুডিওর ব্যবসা উঠে গেলে তিনি চাকরিতে ঢুকলেন। শহরের বাকি স্টুডিওগুলিও তখন জাদুঘরে যাওয়ার আয়োজন করছে। স্টুডিও ব্যবসা নিয়ে দুঃখ নেই তাঁর; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ছবি না তুলতে পারার আক্ষেপ যায়নি আতিকউল্লাহর।

অবশ্য নিজেকে সান্ত্বনা দেন, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত কর্মী হিসেবে কী ভোগান্তিটাই না তাঁর পোহাতে হয়েছে – ’৭৫-এর পর কতবার পুলিশ তাঁর বাড়িতে ঢুকে তছনছ করেছে, তাঁকে বেঁধে নিয়ে গেছে। জেল খেটেছেন। কত বছর মনের গভীরে অমূল্য রত্নের মতো লুকিয়ে রাখা বঙ্গবন্ধুর নাম তিনি মুখে নিতে পারেননি ভয়ে। আর ছবি! সেটা তিনি রাখতেন কোথায়? বেইমানেরা সন্ধান পেলে সব জ্বালিয়ে দিত।

জেল-জুলুম সহ্য করলেও এই দহন তিনি সহ্য করতে পারতেন না।

সেদিন স্টেডিয়ামে ভিড় ঠেলেঠুলে বঙ্গবন্ধুর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছিলেন আতিকউল্লাহ। নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন শেলির বন্ধু হিসেবে। বঙ্গবন্ধু পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, যাইস ব্যাটা ৩২ নম্বরে। তুই শেলির বন্ধু। আমারও ভাইগ্না।

গিয়েওছিলেন আতিকউল্লাহ। কী আশ্চর্য মানুষটা! চেহারা দেখেই বললেন, তুই আতিকউল্লাহ! আমার ভাইগ্না। শেলির সঙ্গে দেখা করার প্রবল ইচ্ছা সেদিন তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল এই বিশাল মানুষটার অসাধারণ স্মরণশক্তি দেখে – নেহাত মফস্বলের এক স্টেডিয়ামের জনসভায় এক মিনিটের কথা! অথচ কিচ্ছু ভোলেননি মানুষটা! কী আশ্চর্য!  একটা গোটা রাষ্ট্র চালান যে মানুষ, তিনি সামান্য একজনকেও এভাবে মনে রাখেন! 

হয়তো সেবারই দেখা হতো শেলির সঙ্গে; কিন্তু আতিকউল্লাহর আর ইচ্ছে করলো না। বিশাল মানুষটার এই আপন সম্ভাষণ তাঁকে ঘোরগ্রস্ত করে দিয়েছিল। একে সঙ্গী করেই ফিরে এসেছিলেন  তিনি। ভেবেছিলেন পরে আবার যাবেন। কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। তার আগেই ১৫ই আগস্ট এসে স্তব্ধ করে দিলো বাংলাদেশকে।

সেই দিনটির কথাও স্পষ্ট মনে পড়ে তাঁর। সকালবেলায় বাজারে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন তিনি। শহরের বিহারিপট্টির হইহুল্লোড় শুনে তিনি প্রথমটায় তেমন পাত্তা দেননি, যেমন পাত্তা দিলে কোনো ঘটনা অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে; কিন্তু সেখানকার একটা লোক সেদিন সদর রাস্তায় পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছিল আর বলছিল, শেখ মুজিবুর রে মাইরা ফালাইছেরে, দেশ আবার পাকিস্তান হইয়া গেছে –

ধপ করে বিছানার ওপর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন আতিকউল্লাহ। এমন মানুষটারে তারা মেরে ফেললো! এটা কীভাবে সম্ভব, এটা কী করে হয়! সেদিন থেকে অপেক্ষা তাঁর, নিশ্চয়ই একদিন সময় কথা বলবে। আজ বলছে …

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি পিএমের দফতরে। ঢোকার পথে বারকয়েক তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা চেক করা হয়েছে, সে-ঝক্কি অবশ্য তাঁর পোহাতে হয়নি। ছেলে ফয়সালই সামলে নিয়েছে সব নিরাপত্তার ব্যারিকেড। সে এসেছে আতিকউল্লাহর সঙ্গে।

সদ্য পৃথিবী তছনছ করে দেওয়া প্যান্ডামিকের কারণে নিরাপদ দূরত্বে বসে পিএম একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে একবার চোখ বুলালেন, আপনি আতিকউল্লাহ ভাই? মেয়েটাও বাপের মতো। মানুষকে খুব ভালোবাসেন। কী সুন্দর করে ভাই বললেন, যেন তাঁর সত্যিই ভাই হন তিনি। আতিকউল্লাহ মাথা নেড়ে জবাব দেন, জি, আমি। পিএম বলতে থাকেন, আব্বার ডায়েরির ভেতরে এই চিরকুটটি পেয়েছি, যেখানে আপনার নাম লেখা, আপনি শেলি আপার বন্ধু। আব্বার সব লিখে রাখার অভ্যাস ছিল। ডায়েরিতে, কাগজে। পিএমের চোখে অশ্রু টলমল করে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেন দায়িত্বশীল নেতার মতোই। বলেন, শেলি আপা আমার ফুফাতো বোন … আমি ঠিক করেছি আব্বার শততম জন্মবার্ষিকীতে …।

আতিকউল্লাহ পিএমকে কথা শেষ করতে না দেওয়ার স্পর্ধা দেখান। মাঝপথে থামিয়ে দেন, সঙ্গে আনা বঙ্গবন্ধুর কয়েকটা অমূল্য ফটোগ্রাফ বের করেন হাতের ব্যাগ থেকে। এক পা হেলিকপ্টারে আরেক পা মাটিতে। হবিগঞ্জের মাটিতে নামছেন বঙ্গবন্ধু। ছবিগুলি পিএমের হাতে দেন। বলেন, অনেক কাল ভয়ে এই ছবিটি বের করতে পারিনি, অনেক কাল অভিমানে বের করিনি, ক্ষোভে বের করিনি, অপেক্ষায় বের করিনি। এই দিনের অপেক্ষায়। আমি শেলির সঙ্গে দেখা করতে চাই না। ও পৃথিবীতে বেঁচে আছে নাকি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে – তাও জানতে চাই না – আমার কাছে সে ষোলো বছরের শেলি হয়েই আছে; কিন্তু এই যে এতো বিশাল মানুষটা, পুরা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল যাঁর হৃদয়, তাঁরে আপনার হাতে তুলে দিতে পেরে বড় শান্তি লাগছে। আমি ভাবিনি এই সুযোগ জীবনে আসবে। আমি আর কিচ্ছু চাই না। পিএম ছবিটির দিকে অপলক তাকিয়ে ভাবেন, সত্যি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে কতজন কতভাবেই না বঙ্গবন্ধুকে আঁকড়ে রেখেছেন, তাঁর চোখ বেয়ে অশ্রু নামে – আতিকউল্লাহ ঠিক দেখতে পান না। চোখে ছানি পড়েছে।