সুলুকসন্ধান

ওই যে ওই বছর – যে-বছর যুইদ্ধ বান্ধিল, পাকিস্তানিদের খপ্পর থাইকে বাঁচনের জইন্য ধুন্ধুমার এক যুইদ্ধ, ওই বছরই তো আতাহার মিয়ার বয়স হইছিল সবে ষুল! আলেকজান বিবি নিজের হাড্ডি আর মাংসরে মণ্ড কইরে দিয়ে মানুষ করতেছিল একমাত্র ছাওয়াল আতাহার মিয়ারে। আতাহার মিয়ার গতরে তহন শাওন-মাইস্যা বিলের লাহান বিস্তর-ঢেউ! জলের আধিক্য খলবলিয়ে ছুটে গেছে বিস্তীর্ণ সীমানার দিকে। হাওয়ার আকুলিবিকুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওই সীমানা দিগন্তরেখাকে যেন বিদীর্ণ করে দিতে চাইছে! আতাহারের এমন বাড়বাড়ন্ত গতর থেকে আলেকজান বিবি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকত – মায়ের নজর বেজায় বদনজর! একবার লেগে গেলে সন্তানের কিছু না কিছু অনিষ্ট ঘটিয়েই ছাড়ে। ফলত তাগড়া-জোয়ান হয়ে উঠতে থাকা আতাহার মিয়ার দিকে সে তাকাতোই না। চোখের কোনা দিয়ে ছাওয়ালডারে সে দেখত কি দেখত না! কিন্তু নিজের বাড়বাড়ন্ত চারাগাছটির দিকে আপনাআপনিই নজর চলে যেতো আলেকজান বিবির। এজন্য সে নিজের ওপরই বেজায় বিরক্ত হতো। মার্বেলের মতো ছোটমোটো গর্তে ঢুকে যাওয়া দুই গালে ডান হাতের তিন আঙুল দিতে মৃদু চাপড় মারতে মারতে  আপন মনেই বলত –

তওবা, তওবা, আলেকজান বিবি – নিজের ছাওয়ালডারে চক্ষের মইদ্যে হান্দায়া রাখন ছাড়া তুমার কী আর কুনু কাইজকাইম নাই?

আদতে কথা কিন্তু মিথ্যা না। আলেকজান বিবির বুকের ভেতর দিনরাইত ধুকপুকানি – কিমুন ফনাফনাইয়া ডাঙ্গর হইয়া উঠতাছে আতাহার মিয়া, আর তো হেয় আঞ্চলের তলায় থাইকব না। আর তো হেরে ধইরাবাইন্ধা আগলাইয়া রাহন যাইব না।

হেয় অহন বাইস্যা মাসে ছাইড়া দেওয়া হাঁসাগুলার লাহান খালেবিলে যাইব। গুগলি-শামুকের তালাশে তালাশে ধানক্ষেতের কোনাকাঞ্চি ঠুকরাইয়া খাইব। নইলে মাছের ফালফুল দেইখেলেই পুষ্করিণীর জল ঘোলা কইরে ফেলাইব। আইচ্ছা, হেইডা খাওক, খাওক নইলে ফেলাক – হেইসবে আমার দরকার কী? আমি তো হেরে আর গলায় দড়ি পিন্দাইয়া রাইখবার পারুম না – মনকে এইভাবেই দমিয়ে রাখতে চায় আলেকজান বিবি। মনকে না-হয় থাপথুপ করে রাখতে পারে, কিন্তু মনের ভেতর উজিয়ে ওঠা আকথা-কুকথাকে তো দমিয়ে রাখতে পারে না সে।

আলেকজান বিবির মনের ভেতর নিত্যই উজিয়ে ওঠে –

এক কৌটা তেল/ কাইত  অইলেই গেল!

অর্থাৎ তেল আছেই মাত্র এক কৌটা, সেটুকুও কাত হয়ে পড়ে গেলে তো সব্বোনাশ! বংশের প্রদীপ জ্বালানো যাবে না আর কিছুতেই। তখন ঘুটঘুটে আন্ধার ছাড়া এই জীবনের বুকেপিঠে আর কিছুই থাকার উপায় নাই।

একমাত্র ছাওয়াল আতাহার মিয়াকে নিয়ে এরকম ভাবনা তাকে দিবানিশি তটস্থ করে রাখে। আলেকজান বিবি নিজের মার্বেলের মতো বসে যাওয়া গাল দুটিতে ফের মৃদু চাপড় মেরে এই কুচিন্তাকে উড়িয়ে দিতে চায়।  ধুর-অ ধুর-অ এইসব ছাতামাথা কীসব ভাবে সে? কেনই-বা এমন ভাবে?

দিবারাত্র শতেকবার তওবা কেটেও মনের ভেতর উজিয়ে ওঠা নাকি গজিয়ে থাকা কুচিন্তাকে তাড়াতে পারে না আলেকজান বিবি। তখন কী রকম এক বেদিশাভাব তাকে আক্রান্ত করে। কী করবে, কই যাবে, কাকেই-বা বলবে সে এসব বেত্তান্ত? এসব কুচিন্তার কথা তো কাউকেই বলা যায় না। বলতে গেলেই একেবারে ঝাঁটা হাতে তেড়েমেরে আসবে লোকজন। আর তার দিকে ঘেন্নার চোখে তাকিয়ে, মুখ কুঞ্চিত করে বলবে –

খাইয়া-দাইয়া আর কুনু কাইমকাজ নাই তুমার? ও গো ও আলেকজান বিবি, নিজের ছাওয়ালের দিকে চোখ দিওন ছাড়া আর কুনু কামই কি তুমার জইন্য বরাদ্দ নাই গো?

আবাগীর বেডি আবাগী, সোয়ামিডারে খাইছে, অহন বুঝি ছাওয়ালডারেও খাইব।

ছিঃক্ক ছিঃক্ক। এমুন দুরমুইশ্যা বেডিরে পিছা দিয়া পিডিলেও তো কম কিছুই অয়।

ফলত নিজের মনের ভেতর ভেসে ওঠা আজগুবি দুশ্চিন্তা নাকি কুচিন্তার কিছুই আলেকজান বিবি কাউকে খুলে বলতে পারে না। ফের একা একা এসব ভয়ানক কুচিন্তা হজম করাও তার জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে ওঠে। সে ফের তওবা কাটে। ফের মার্বেলের মতো গর্ত হয়ে যাওয়া দুই গালে ডান হাতের আঙুলগুলি তুলে ঘন ঘন চাপড় মারে। তওবা,  তওবা …

আর মনে মনে ভাবে, আমি কুন আবাগীর বেডি আবাগী? আমি কুন বেত্তমিজ মাইয়ানুক – নিজের ছাওয়ালের দিকে চাইয়া থাকন ছাড়া আর কুনু কাইম নাই এমুন মরার শুকি?

ধুর, অহন থিক্যা বেবাকতাই বাদ। মইরা গেলেও কিছুতেই আর চাইমু না ছাওয়ালের পানে।

মনে মনে শক্ত কসম কেটে সংসারের কাজেকামে ঢুকে পড়তে চায় আলেকজান বিবি। সংসারে তো আর কাজের অভাব নাই। যত কাজ – সবই তো সে একলা হাতেই সামলায়।

ঘরে রাখা খোরাকির চাউল নামতে নামতে মটকার তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এই হপ্তার মাঝে কিছু ধান ঢেঁকিঘরে না নিলেই নয়। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আর ধান থেকে চাউল বানানো যাবে না। চাউল বানানোর আগে ধানের আছে বিস্তর ক্যারিকেচার। ধান সেদ্ধ করো, সেই সেদ্ধ-ধান রোদ্দুরের তলায় ফেলে রেখে শুকাও, চিটাধান ওড়াও – তারপরেই না ঢেঁকির তলার কারবার।

আলেকজান বিবি এত ভাবনা নিয়েই দুয়ারে এসে দাঁড়ায়।  কিছু ধান আজ ওড়াতেই হবে। ইস্ রে, কত কাজই না বাকি পড়ে আছে! আলেকজান ত্রস্ত হাতে কুলা টেনে নিয়ে শুকনা-ধানের কোল ঘেঁষে বসে পড়ে। গত দুইদিন ধরেই কিছু ধান সে রোদের বুকে ফেলে রাখছিল। ধান রোদ্দুরে দেওয়ার আগে সমস্ত উঠান গোবর-লেপা করে দিয়েছে আলেকজান। এতে করে সূর্যের আলো খাড়া হয়ে ঢুকে পড়েছে মাটির গহিনে। গোবর-মাটির মিশ্রণে তাপ লেগে উঠানটা একেবারে চটচটা হয়ে উঠেছে। টান ধরা মাটিতে শুকাতে দেওয়া সেদ্ধ-ধানের জল দ্রুত টেনে গিয়ে গিয়ে হয়ে উঠেছে  একেবারে ঝনঝনা। এই শুকনা-ধান হাতের তালুতে নিলে সত্যি সত্যিই ঝনঝনিয়ে বেজে ওঠে। ঝনঝনা ধান থেকে চিটাধান এখন সহজেই উড়িয়ে দেওয়া যাবে। অবশ্য ধান ওড়ানোর আগে বাতাসের ভাও বুঝে নিতে চায় আলেকজান। বাতাস যেদিকে বইছে তার উলটা দিকে কুলা ধরে দাঁড়ালে চিটাধান আপসেই উড়ে চলে যাবে বাতাসের আগে আগে। উড়তে উড়তে কোন মুলুকে যে চলে যাবে

কে জানে?

ধানের কুলা মাথার ওপর তুলে নেওয়ার আগে শাড়িটা গোছগাছ করে পরে নেয় আলেকজান। কারণ পরনের কাপড় আঁটসাঁট করে না-নিলে কাজে জুত পাওয়া যায় না। কাপড় বলতে তো রোদ-জলে নেতিয়ে যাওয়া বহু পুরাতন একটা শাড়ি – তাও কি না পেটিকোট ছাড়াই পরতে হয় তাকে। নিচে পেটিকোট নেই বলে আলেকজান বিবি খানিক কায়দা করে দুই-পল্লা প্যাঁচ দিয়ে সামনের দিকে ঘুরিয়ে আনে শাড়িটা। তারপর অভ্যস্ত হাতে আঁচল তুলে দেয় বাম কাঁধের ওপর। পিঠের ওপর থেকে আঁচল গুছিয়ে সরু করে নামিয়ে এনে শাড়িটা পেঁচিয়ে দেয় প্রায়-হাড্ডিসার কোমরে। আর আঁচলের খুঁটটা গুঁজে দেয় কোমরে বাঁধা কালো তাগার ভেতরে।

 তাগাতে আঁচলের খুঁট গুঁজে দেওয়ার আগে কী যেন হাতাপাতা করে খোঁজে সে – আলেকজান বিবির কোমরের তাগার সঙ্গে লটকে দেওয়া আছে একটা কড়ি আর ছোট্ট একটা লোহার টুকরা। আতাহার গর্ভে আসতে না আসতেই মসজিদের ইমামের কাছ থেকে এই কড়ি আর লোহার টুকরাটা এনে দিয়েছিল সোয়ামি মোতাহার মিয়া। ঘামে-স্পর্শে মলিন হয়ে যাওয়া সাদা-কাগজের ভাঁজ ধীরে ধীরে খুলে একটা ফুটো করা কড়ি আর লোহার টুকরা  আলেকজানের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল –

কুমরের তাগার লগে লটকাইয়া থুইও এই দুইডা। প্যাটের ছাওয়ালের তাইলে ছুত্মুত্ লাগব না। আর তুমিও বদনজরের খপ্পর থিইকে দূরে থাকতে পারবা।

সেইদিন থেকে আলেকজান বিবির কোমরের সঙ্গে লেপ্টে আছে এই দুই জিনিস। গত ষোলো বছরে তাগা বদলাতে হয়েছে বহুবার, কিন্তু এই দুই জিনিস বড় যত্ন করে সঙ্গে রেখেছে আলেকজান।

প্রতিদিনই  হাড্ডি-চামড়া লেগে থাকা কোমর হাতড়িয়ে ওই দুইটার অস্তিত্ব পরখ করে নেয় সে। নিশ্চিন্ত হয়ে শাড়ি দুই-পল্লা প্যাঁচ দিয়ে ঘুরিয়ে আনে। আজো শাড়ির খুঁট গুঁজে দেওয়ার সময় পরখ করে নিল, ওই দুই জিনিসের অস্তিত্ব তাগার সুতাতে ঝুলে আছে কি নাই?

মোতাহার মিয়া গত হয়েছে তাও তো বছর পাঁচেক হয়ে গেল। যেইবার পাক-ভারত যুদ্ধ বান্ধিল – সেই বছর, বা দুই-এক বছর এদিক-ওদিক করে –  চন্দ্রবোড়ার হিংস্র-ফণার নিচে পড়েছিল বেচারা মোতাহার মিয়া। অমাবস্যার রাইতে ধানক্ষেতের আইল ধরে একা একাই হনহনিয়ে আসছিল সে। আর আইল বরাবর শুয়ে থাকা বড়সড় এক চন্দ্রবোড়ার পেটের ওপর পড়েছিল তার পা।  একেবারে তক্ষুনি বিষে কালো হয়ে গিয়েছিল মোতাহার মিয়ার সারাদেহ।

আতাহার আর আলেকজান বিবি বিস্ফারিত চক্ষে দেখেছিল – তরতাজা একটা মানুষ কেমন করে বিষে বিষে নিস্তেজ হয়ে যায়!

কোমরে বাঁধা কালো-তাগার কড়ি আর লোহার টুকরাটাতে হাত রেখে প্রায়ই বিচলিত বোধ করে আলেকজান বিবি -বদনজরের খপ্পর থিইকে আমারে রক্ষা কইরে সে-ই কি না কোন আলাইবালাইয়ে বিষজর্জর হইয়ে জেবনডারে হারাইলো!

আহারে নসিব! মাইনষের নসিব বুঝি এরেই কয়?

দুই

ধান-উড়ানির কুলা মাথার ওপর তুলে ধরতেই আলেকজান বিবি টের পায় –

হাওয়ার ভাও আইজ বড় বেগতিক – এই বেগতিক হাওয়ার লাগ পাওয়া আইজ বড়ই মুশকিল। কইথন কই যে ভাইসি যাইতিছে এই হাওয়া? কইথন যে ভাইসি আইতিছে এই হাওয়া? নাকি আলেকজান বিবিই ভাইসি যাইতিছে এই বেসামাল হাওয়ার টানে? আলেকজান বিবি না-ভাইসিলেও মাতার উপ্রের কুলাডা য্যান ভাইসি যাইতিছে! কুলাডা য্যান পঙ্খি অইয়া গেছে গো! বড়সড়-পাখনাওয়ালা পঙ্খি! যে পঙ্খি উড়তে উড়তে দক্ষিণে যায়। দক্ষিণ থাইকে যায় পুবে আর পুব থাইকে পশ্চিমে। পশ্চিম থাইকে যায় উত্তুরে। উত্তুরে গিয়া সে কি না জোরে পাখনা নাড়ায়। ফলে উত্তরের হাওয়া বেগে বইতে থাকে। সেই দুদ্দাড় হাওয়ায় ধানের চিটাগুলান তো উড়বই উড়ব, লগে পুরুষ্টু ধানও কিছু উইড়ে যাইতে পারে। এমুনও অইতে পারে, আলেকজান বিবিও উইড়ে যাইতে পারে এমুন বেদিশা হাওয়ার টানে! তা আলেকজান বিবি উইড়ে আর যাইবে কই? কতদূরে যাইতে পারব হেয় আর?

উইড়ে উইড়ে মোতাহার আলির কাছেপিঠে গিয়া ঠেকতে পারলেও তো শান্তি কিছু পাওয়া যাইতে পারে!

আলেকজান বিবির দেহ থেইকে যৌবন তো এখনো এইকেবারে হারায়ে যায় নাই। তাই তার চক্ষের জ্যোতিও এখনো কিছু বেশ-কম হয় নাই। উত্তুরের হাওয়ার খপ্পড়ে পড়ে কয়েকটা উড়োজাহাজ আথালিপাতালি চক্কর দিইতেছে তা সে স্পষ্টই দেখতে পায়।

চিলের মতো ঘুরে ঘুরে সারা আসমান জুড়েই চক্কর দিচ্ছে তারা। আলেকজান বিবির বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে! ধানের চিটা ওড়ানো একেবারে মাথায় ওঠে। কুলাটা একপাশে নামিয়ে রেখে সে উড়োজাহাজের চক্কর-খাওয়া খেয়াল করার চেষ্টা করে।

এতোক্ষণ বাদে সে বুঝতে পারে – হাওয়ার ভাও আইজ ক্যান সে ধরতে পারে নাই।

দুদ্দাড়-বেতাল হাওয়ার লগে তো ওই উড়োজাহাজগুলার পাঙ্খার হাওয়াও আইসে মিশ খাইয়েছিল!

আলেকজান বিবি বিষম ভাবনায় পড়ে যায়। ভাবনায় পড়ে ধামাভরা ধান ঢেঁকির তলায় নেওয়ার কথাও বেমালুম ভুলে যায় সে!!

গ্রাম কুমকুমারির আসমানে তো এতোদিন কাক, চিল, বাজ আর ঈগলের ওড়াউড়িই ছিল, এক্ষণে কি না উড়োজাহাজও চক্কর খেতে শুরু করেছে!

উত্তুরের হাওয়া বেগে দক্ষিণের দিকে ধেয়ে যায়। আলেকজান বিবি সেদিকে তাকিয়ে থেকে স্পষ্ট দেখতে পায় দক্ষিণের দিক থেকে কালো-কালো ধূম্রকুণ্ডলী আসমানের সব রং গিলে ফেলছে! ধোঁয়া, নাকি মেঘ? মেঘ, নাকি ধোঁয়া? এমতো বিভ্রমে থেকেও আলেকজান বিবি স্পষ্ট স্মরণ করতে পারে – খানিক আগেই তো আসমান তেজদীপ্ত রোদ্দুরে নেয়ে উঠেছিল! উজ্জ্বল  আলো চারদিকে আধুলির রং ছড়িয়ে এই পৃথিবীকে রুপার মতো ঝকঝকে করে তুলেছিল। এক্ষণে কী হলো? এই কালো-কালো মেঘ নাকি ধোঁয়া, ধোঁয়া নাকি মেঘের বিভ্রমে সে কি না এমনতর  কাতর হয়ে পড়লো?

উত্তুরে দাপুটে হাওয়া, নাকি ওইসব কালো মেঘের কুণ্ডলী, নাকি ধূম্রজাল ফুঁড়ে দিয়ে যে তার সামনে অবিকল ছায়ার মতো এসে দাঁড়াল, আলেকজান বিবি তাকে এই মুহূর্তে, এই গোবর-লেপা উঠানে দেখবে – মনের ভুলেও  এমনটা আশা করে নাই। তার এখন থাকার কথা আউশ ধানের জমিতে। মাত্র দিন-কয়েক আগেও যে জমিন চৈত্রের দাবদাহে ফুটিফাটা হয়ে দেহের কালো কংকাল বের করে মরণদশায় পৌঁছেছিল। আতাহারই তাকে বহু যত্নে বাঁচিয়ে তুলেছে! রাতদিন জল-সিঞ্চন করেছে।  বাঁশ আর দড়ি বেঁধে দোলনা-সেচনি দিয়ে পাশের ডোবার জল তুলে মৃতপ্রায় ভূমিকে কোমল করে তুলেছে। প্রচণ্ড রুখুমাটি ক্রমে কোমল হয়ে উঠলে তাতে তৈরি করেছে বীজতলা। আর ছিটিয়ে দিয়েছে আউশ ধানের বীজ। আরো দিন কয়েক বাদে এই বীজ ফেলতে পারতো আতাহার। কিন্তু এইবার যেন তার আর কিছুতেই তর সইলো না। দিন-ক্ষণের তোয়াক্কা না-করে কঠিন মাটিকে বহু পরিশ্রমে মোলায়েম করে তুললো সে। আতাহার জানে – এ-জগতের সকলে নিরাশ করলেও মাটি কোনোদিন কাউকে নিরাশ করবে না। আতাহার জানে, মাটির বুকে আশ্রয় পেতে রাখা আছে সকলের জন্যই। ফলত প্যাঁচপ্যাঁচে জল আর কাদার মাঝে আউশের বীজ সবুজ হাসির উদ্ভাস ছড়াল আর আতাহারের মুখেও হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু লাঙল দেওয়া জমিতে জালার সারির নিশানা ঠিক না করে আতাহার এই মুহূর্তে আলেকজানের সম্মুখে কেন?

উড়ন্ত উড়োজাহাজের সারি, মিশকালো মেঘ নাকি ধোঁয়া এবং উত্তুরে হাওয়ার প্যাঁচগোছের মাঝে এক্ষণে আতাহারও যুক্ত হয়েছে! আলেকজান বিবির মাথার ভেতর চিটাধানের ওড়াউড়ি শুরু হলে সে-ও খানিকটা তব্দা মেরে যায়। থতমত খেয়ে চক্ষের সামনে থেকে কোনটা আগে সরাবে সহসা বুঝে উঠতে পারে না! কিন্তু আতাহার – জলজ্যান্ত – যুবকটি সমস্ত কিছু আড়ালে ঠেলে দিয়ে কি না একেবারে আদুল-গায়ে মায়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল!

আতাহারের হাতে তখনো ভেজা-কাদা লেপ্টে আছে। উঁচু করে পরা লুঙ্গির তলায় লোমশ দুইখানা কালোকোলো পা জলকাদায় মাখামাখি – একটা পায়ে কালো জোঁক রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে আর নড়তেই পারছে না – সেদিকে আতাহারের কি না বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নাই! আউশের দুই-একটা জালার কোমল সবুজ ডগা ঘনচুলের ভেতরে লুকোবার চেষ্টা করে বিফল হয়েছে – আলেকজান বিবি ছেলের এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে কী বলবে কিছুই যখন ভেবে পায় না – তখুনি কি না আতাহারই কথা বলে ওঠে –

মা যুদ্ধ বান্ধিছে, যুদ্ধ! দ্যাশ স্বাধীনের লাইগে যুদ্ধ!

আলেকজান বিবি ছেলের কথায় এইবার আরো খানিকটা তব্দা খায়। সবকিছুই তার মাথার ভেতর আরো খানিকটা তালগোল পাকায় – তার আট ক্লাস পাশ-দেওয়া ছেলে – রাত হলেই যে দোস্ত রজবালির বাড়িতে গিয়ে রেডিও শুনে আসে – তার কথা বোঝার সাধ্যি তো আলেকজান বিবির নাই!

কীসের যুদ্ধ আর কেনই-বা যুদ্ধ সে-কথা হয়তো আতাহার মিয়াই জানে। আতাহার মিয়া তো কতকিছুই জানে! আলেকজান বিবির  সেসবের বিন্দুবিসর্গও জানার কথা নয়।

রোদের বুকে ফেলা রাখা সেদ্ধ ধানের স্তূপে শালিক আর চড়াইয়ের দল হুটোপুটি খেতে খেতে হল্লা শুরু করেছে, মাথার ওপর কয়েকটা কাক উড়ে উড়ে কা-কা ডেকে গেলেও আলেকজান বিবির তব্দা কাটতে চায় না। সে কি না তাকিয়ে তাকিয়ে আতাহারকে দেখে! আদুল-গায়ের আতাহারের বুক জুড়ে আউশ ধানের জালার মতো ঘন হয়ে লোম গজিয়েছে। কালো জোঁকটা রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে হাঁটুর নিচে লটকে আছে তো আছেই – অথচ আতাহারের চোখমুখে কি না শ্রমের স্বেদ, যুদ্ধের উদ্বেগ-আতঙ্ক ছাড়া আর কিছুই নাই?

আলেকজান বিবির ডান হাতটা নিজের অজান্তেই কোমরের সেই

কালো-তাগা খুঁজে বেড়ায়। কড়ি আর লোহার মাঝে হাতটা স্থির হলে বুকে যেন বল ফিরে পায় সে –

তাগার এই কড়ি আর লোহা আমার ছাওয়ালডারে বদনজর থাইকে বাঁইচে দিবে। তার জন্মের সমুয় থেইকেই তো এই জিনিস আমি লগে লইয়ে ঘুরতে আছি!

তার বাপই তো আমারে পেন্দিয়ে দেছিল।

আতাহার মিয়া মাকে ঘরে যাওয়ার কথা বললে তাগায় বাঁধা  কড়ি আর লোহার বেড়াজাল থেকে আলেকজান বিবিও বের হয়ে আসে।

তার মানে ব্যাপার গুরুতর!

আতাহার মিয়া ঘরের চৌকির ওপর আলেকজান বিবিকে বসিয়ে দিয়ে

বলে –

মা, যুদ্ধ বান্ধিছে। দ্যাশ স্বাধীন করার লাইগে যুদ্ধ! আমি এই যুদ্ধ করবের চাই।

আলেকজান বিবি ফ্যালফ্যাল করে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে।

কীসের যুদ্ধ, কখন বান্ধিল এই যুদ্ধ?

আতহার মুখ নিচু করে ঘরের মেঝেতে তাকিয়ে রয়েছে। আলেকজান দেখে ছেলের নাকের নিচে গোঁফের রেখা কীরকম ঘন হয়ে উঠেছে।  ধানের জালার দুটা কচি সবুজ ডগা আতাহারের কপালের ওপর ঝুলে আছে। এতে আতাহারের চেহারা যেন আরো কঠিন হয়ে উঠেছে!

আলেকজান বিবির মায়ের মন – সে তো আগেভাগেই সবকিছু বুঝে যায়!

ফলত আতাহারকে যে কিছুতেই আটকানো যাবে না সেটা সে টের পেয়ে যায়।

গলার স্বর যতটা সম্ভব কোমল করে ছেলেকে বলে –

পায়ের জোঁকটা ফেলাইয়া দেও। রক্ত খাইয়া তো পেট ফুলাইয়ে রইছে।

আতাহার চমকে উঠে নিজের কাদা-জলে একাকার হয়ে থাকা পায়ের দিকে তাকায়।

এক ঝটকায় চৌকি ছেড়ে উঠে গিয়ে উঠানে নামতে নামতে বিড়বিড় করে বলে –

হ, মা জোঁক তো ফেলাইতেই হইব। খামাখাই এতো রক্ত খাইলে হেইগুলারে মারণ ছাড়া আর গতিক কী?

আলেকজান বিবি ছেলের কথার

মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না।

সেও ধীর পায়ে উঠানে গিয়ে দাঁড়ায়। ঝাঁকে-ঝাঁকে শালিক আর চড়াই পুচ্ছ নাচিয়ে নাচিয়ে আলেকজান বিবির শুকাতে দেওয়া ধান সাবাড় করে চলেছে! কিন্তু এখন আর আলেকজান বিবির তাদের তাড়ানোর সময় নাই।

ক্ষেতের সমস্ত কাজ ফেলে চৈত্রমাসের উত্তাপ মাথায় ঢেলে ছেলেটা ঘরে ফিরে এসেছে। এক্ষুনি তাকে ভাতের হাঁড়ি চুলার ওপর না-চড়ালেই নয়! এক মুঠো চাউল আর দুইটা আলু অন্তত তড়িঘড়ি সেদ্ধ করে ছেলেটার পাতে তুলে দিতে হবে।

তিন

শাওন মাসের ঘোর-বাদলায় আউশের ক্ষেত যখন জলে টলোমলো করছে, পাকা ধানের পুরুষ্টু ছড়া বারবার ঝুঁকে পড়ছে সেই জল অভিমুখে – যেন সে এক্ষুনি তলিয়ে যেতে চায়! যেন সে আর জীবনের এতো ভার আর বইতে পারছে না! যেন সে চায়, এ-জীবনের সমস্ত কিছুই আজ অকাতরে বিসর্জন দিতে।

ঘোলা জলের দিঘল চাদরের তলায় বুক অবধি ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আতাহার মিয়ার আউশ ধানের ক্ষেত। হাওয়া বেগে বইলে নড়ে উঠছে জল। ছোট-ছোট ঢেউ এসে নাড়িয়ে দিচ্ছে গুচ্ছ-গুচ্ছ ধানের ছড়ার অবনত হয়ে থাকা মাথা। আলেকজান বিবি ধানকাটার মুনিষ ঠিক করে রেখেছে –

দুই-একদিনের ভেতরেই এই সোনালি শস্য উঠে যাবে আলেকজান বিবির গোলায়। ধান শুকিয়ে সেদ্ধ হবে, সেদ্ধ ধান ফের পাবে রোদের উত্তাপ। যাবে ঢেঁকিঘরের ঢেক্কুর ঢেক্কুর শব্দের তলায়। লালচালের ভাত রাঁধতে রাঁধতে আলেকজান বিবি ভাববে –

হাঁড়িতে আইজ কিছুডা চাউল বাড়তি দিইয়ে দিমু। আতাহার মিয়া আউশের পান্তা খেইতে বড় ভালোবাসে।

সত্যি সত্যিই আউশের ধান কাটা সারা হয়। সেসব ধান উঠে যায় আলেকজান বিবির গোলাঘরে। লাল লাল পুরুষ্টু চাল; কিন্তু এক মুঠো চাল বাড়িয়ে রাঁধার উপায় নাই আলেকজান বিবির। কার জন্য রাঁধবে সে? চাল রেঁধে খেতে গেলেও তার গলা দিয়ে সে-ভাত আর নামতে চায় না। আতাহার মিয়া নিজ হাতে ক্ষেতের এই ধানগাছ রোপণ করে গেছে। নিজের ছাওয়ালের পরিশ্রমের ফসল –

কীভাবেই-বা এই ভাত গোগ্রাসে খেতে পারে আলেকজান?

তার ঘরবাড়ি আজ শূন্য! খা খা করছে উঠান। অস্থিরমতি চড়াই আর শালিকের দল লুকিয়ে পড়েছে কোন গাছ নাকি পাতার আড়ালে। কিংবা যুদ্ধের গন্ধ পেয়ে উড়ে গেছে নিরাপদ আশ্রয়ে। শুধু দুরমুইশ্যা কাকের দল তারস্বরে

কা-কা-কা করে অবিশ্রাম ডেকে যাচ্ছে মাথার ওপরে!

আলেকজান বিবির মনে কু ডাকতে থাকে –

ইস্! মরারশুকা কাউয়ার কাউয়া – তগো কী আর যাওনের জায়গাজুয়গা নাই?

আলেকজান বিবি দুই ঠোঁট সরু করে হুশ-হুশ শব্দ করে কাক তাড়াতে চায়; কিন্তু বজ্জাত কাকের  দল একচুলও নড়ে বসে না!

আপদ আর কী!

আতাহার মিয়া কোনো সংবাদ পাঠায় নাই বহুদিন হলো। তা পাক্কা মাস তিনেক তো হবেই। আলেকজান বিবি ভুলোমন হলেও ছেলের সংবাদের দিন-তারিখ একেবারে মুখস্থ করে রাখে। ছেলেটা তার ভারি সুবোধ। পাক-ভারত যুদ্ধের আগে না পিছে – যখন বাপটা মারা গেল – তখন থেকেই আলেকজানকে ফেলে কোথাও আর যায় নাই আতাহার। মাকে ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছে; কিন্তু এখন  কি না যুদ্ধ করতে গেল। নিজের দেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধ। আলেকজান বিবি প্রথমে মানতে চায় নাই। কান্নাকাটি করে নাক-চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে! ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছে –

বাজান, তুমি চইলে গেইলে আমি তুমারে পাইমু কই? কই পাইমু কও? আমার তো আর কেউ-ই নাই।

আতাহার চোয়াল শক্ত করে বলেছে –

আমি কি এলকাই যাইমু মা? দেখ গিয়া কতশত মায়ের পুত যাইতেছে। আমাগো রজবালিও তো যাইতেছে।

মা, মা গো – একবার ভেইবে দেইখো, এই দ্যাশডা ওরা নিয়া নিলে আমাগোর অবস্থা কী হইতে পারে?

বলেই চুপ হয়ে গিয়েছে আতাহার।  অতঃপর গভীর কোনো চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়েছে।

দিন কয়েক চুপ করেই রইলো সে। আলেকজান ভাবলো – যুদ্ধে যাওনের বাই মাথা থেইকে নেইমে গেইছে বুঝি?

কিন্তু মিলিটারিরা কুমকুমারির বাজারের দোকানপাট যেদিন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলো, আতাহার একেবারে ক্ষেপে উঠলো। এক দৌড়ে চলে গেল রজবালির ঘরে। আলেকজান এতোদিনে জানে যে, যুদ্ধের সব খবরাখবর রেডিও খুললেই পাওয়া যায়। রজবালির বাপ ঘরে একটা ফিলিপস তিন ব্যান্ডের রেডিও কিনে রেখেছে। আতাহার শুধু নয়, কুমকুমারির জোয়ান-বুড়া বেবাকেই যুদ্ধের খবর শোনার জন্য কান খাড়া করে রাখে! রেডিওর আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করে।

বাজারে আগুন দেওয়ার পরদিনই গ্রামের সুকানিকে মেরে ফেললো পাকিস্তানি মিলিটারিরা। সুকানিকে সকলে বলতো পাগল। শরীরে ছালা জড়িয়ে ঘুরে বেড়াতো সে! হয়তো সে পাগল কিংবা পাগল নয়!

সুকানির দোষ কী সেটাও শুনলো আলেকজান বিবি।

গায়ে ছালা-জড়ানো সুকানিকে হানাদাররা ছদ্মবেশী মুক্তিফৌজ ভেবেছিল। ভেবেছিল, পাগল সেজে ভড়ং করতে এসেছে!

 এদিকে সুকানিও তো কম নয়! সে নাকি সব কথার জবাবে শুধু একটা কথাই বলেছে –

জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা!

সুকানির ল্যাগব্যাগে-কংকালসার দেহটা নিষ্প্রাণ করার জন্য মেশিনগান কেন দরকার হয়েছিল আতাহার তা জানে না। আলেকজান বিবিও জানে না। কুমকুমারি গ্রামের কেউ-ই তা জানে না।

সুকানিকে হত্যার পরদিনই আতাহার মিয়াও নিখোঁজ হলো। গ্রামের বেবাকে জানলো যে, আতকা আতাহার মিয়ার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না; কিন্তু আলেকজান বিবি জানে সত্য ঘটনাটা – ছাওয়াল আমার যুদ্ধ কইরবের গেইছে! দ্যাশ স্বাধীন কইরবের গেইছে।

কিছু শুকনা চিড়া, গুড়, দুইটা লুঙ্গি, একটা গামছা আর দুইটা শার্ট ঝোলায় ফেলে আতাহার প্রায় নিঃশব্দে চলে গেল। আলেকজান বিবিকে এক  ফোঁটা কাঁদার সুযোগও দিলো না সে!

আলেকজান বিবির একবার মনে হয়েছিল – কোমরের কালো-তাগাটা খুলে আতাহারের কোমরে বেঁধে দেয় – কিন্তু সেরকম কোনো সুযোগ আতাহার তাকে দিলোই না।

যতদিন কাঁটাতার পেরিয়ে ভারতে পৌঁছাতে পারে নাই, ততদিন মায়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল আতাহারের। ভারতে পা দেওয়া মাত্রই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আলেকজান বিবি এখন নিয়ম করে রজবালির ঘরে যায়। কিন্তু রজবালিও তো নিরুদ্দেশ। আলেকজান বিবি রেডিওতে কান লাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর শোনে। রজবালি বা আতাহারের কোনো সংবাদ তারা কেউ-ই পায় না।

দিন গেল, মাস গেল – আলেকজান বিবির শিমের বড় মাচানটা এন্তার বেগুনি-বেগুনি ফুলে ছেয়ে গেল। কার্তিক মাসের ঠিক এই মাঝামাঝি সময়ে আসমানের-কপাট খুলে ঝিরঝির করে হিম নামতে শুরু করে। আর তক্ষুনি কিনা ছাওয়ালের সংবাদ পেল আলেকজান বিবি। ভারতের বর্ডার পার হয়ে তারা যশোর অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে। আর বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে হানাদারদের বক্ষ! আলেকজান বিবি পেল আরেকটি সুসংবাদ – মুক্তিবাহিনীরা যশোর জেলা থেকে পাকিস্তানি মিলিটারিদের দ্রুত হটিয়ে দিচ্ছে।

এখন বোরো ধানের মরশুম।

কাদা-জলে বীজতলা তৈরি করে তাতে ধানের বিছন ছড়িয়ে দিতে হবে।  আলেকজান বিবি আতাহারের পথের দিকে তাকিয়ে থাকে – এই বুঝি তার ছাওয়ালডা এইসে পড়লো। এইসেই তো আইল বেঁধে দিইয়ে জল আটকে ফেইলেবেনে।  তারপরে সেই কাদা থকথকে জলে বোরো-বিছন ছিটিয়ে দিবে। কিন্তু আলেকজান বিবির মনের আশা পূর্ণ হয় না। আতাহার ফিরে আসা দূরে থাক, আতাহারের কোনো সংবাদও তার কাছ আর আসে না।

ঘরে দোর দিয়ে আলেকজান বিবি হু-হু করে কাঁদে। রাতভর কেঁদেকেটে ভোরবেলায় চোখ মুছে ফের ক্ষেতের আইলের মাথায় গিয়ে দাঁড়ায় – আতাহার ফিরে এলে এই পথ দিয়েই আসবে। যতদূর দৃষ্টি যায় আলেকজান বিবি তাকিয়েই থাকে। তাকিয়েই থাকে। যদি আতাহারকে দেখা যায়! আতাহারকে দেখা না গেলেও বহুদূর থেকে তার ছায়াটাও একবার যদি দেখতে পায় সে!

আশপাশের সমস্ত জমিতে বোরোর জালা রোপণ করা হয়ে গেছে। শুধু আলেকজান বিবির জমিনে ঘাস-জংলা-বিচালি ফনফনিয়ে বেড়ে চলেছে। কবে ফিরবে আতাহার?  পথপানে চেয়ে চেয়ে আর কাউকে বর্গা দিতেও ভরসা পায় না আলেকজান বিবি।

জল-কাদা-জোঁকে দুই-পা ডুবিয়ে নিজের জমিতে গোছা-গোছা জালা রোপণ করবে তার জোয়ান ছাওয়াল আতাহার। রোদ-মেঘের তলায় প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে করতে কুলকুল ঘেমে-নেয়ে উঠবে। আর ঘরে ফিরে আউশের চালের এক থালা বাসি পান্তা সাবাড় করবে লবণ, শুকনা মরিচ ভাজা আর কাঁচা পেঁয়াজ ডলে।

চার

ধানি জমিটা এইবার পতিত পড়ে রইলো। বোরো ধানের ছোট-ছোট কোমল জালা বাড়বাড়ন্ত হয়ে ঢেকে দিলো না এই মাটির উদোম-শরীর! চারপাশের থইথই সবুজের মাঝে  বড় বেখাপ্পাভাবে নিস্তেজ শুয়ে রইলো সে। যেন-বা আলেকজান বিবির মতোই নিঃসঙ্গ কোনো নারী! যার বুকের ভেতর তীব্র হাহাকার, ধুধু শূন্যতা – নিজের গর্ভে ফসল বুনে দেওয়ার জন্য গোপন আর্তনাদ, আর যন্ত্রণায় নুইয়ে পড়া; কিন্তু কাউকে সে-কথা বলার উপায় তার নাই! বলার মতো ভাষা তার মুখে নাই! এই বোবা-মাটির ভাষা বুঝতে পেরে একবিন্দু সবুজ বুনে দেওয়ার মতো কেউ নাই! এমনকি রুখুমাটির ওষ্ঠে এক আঁজলা জল তুলে দেওয়ার মতোও কেউ নাই!

আদতেই দশা বড় করুণ! বর্গা দেওয়ার মতো এইবার কাউকেই পেল না আলেকজান বিবি। বর্গাদার পাবে সে  কীভাবে? কুমকুমারির প্রায় জোয়ান-মরদই তো যুদ্ধ করতে চলে গেছে। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। নিজের জাতির আলাদা পরিচয়ের জন্য যুদ্ধ। নিজেদের গেরিলা বানিয়ে ভয়ংকর এক যুদ্ধ।

রুখু-ক্ষেতের বুকে লাঙলের ফলা বসিয়ে দেওয়ার মতো তাগড়া-পুরুষ গ্রামে এখন নেই বললেই চলে।

বোরো ধানক্ষেতে সবুজ রং গাঢ় হলো, ধানের ক্ষেতে দামাল হাওয়া দুদ্দাড় হামলে পড়তে না পড়তেই যুদ্ধ থেমে গেল। দেশ স্বাধীন হলো। নতুন এক রাষ্ট্র – বাংলাদেশ!

যুদ্ধের ক্লান্তি আর বিজয়-উল্লাস নিয়ে একে একে ঘরে ফিরতে শুরু করলো তাগড়া জোয়ানেরা। তারা যখন ফিরে এলো কাউকে ঠিকঠাক যেন চেনাই যায় না। তামাটে গায়ের বরণ রোদে জ্বলে, বৃষ্টিতে ভিজে কালো  কেশরের পাতার মতো হয়ে উঠেছে! কারো কারো মুখাবয়বে দাড়িগোঁফের ঘন জঙ্গল। ওই জঙ্গল ভেদ করে আসল মানুষটিকে চিনতে পারা বড় কঠিন কম্ম! কিন্তু আলেকজান বিবি ফিরে আসা প্রায় প্রত্যেকটি মানুষকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো – আতাহার মিয়া? তার আতাহার মিয়া কই? ফেরে নাই সে? ও আতাহার মিয়া, কই তুমি গো?

আতাহারের ফিরে আসতে এতো বিলম্ব কেইনে? কেইনে ফেরে নাই? এই দেশে তো এখন আর কুনু যুদ্ধ নাই, আর গোলাগুলি নাই, বাতাসে বারুদের গন্ধ নাই – তবে কেইনে ফেরে নাই আতাহার মিয়া?

মাকে একা ফেলে একদণ্ড দূরে থাকার মতো ছাওয়াল আতাহার মিয়া নয়! তাহলে তার ফিরে আসতে এতো বিলম্ব কেন?

আতাহারের সঠিক খবর কেউ-ই দিতে পারলো না আলেকজান বিবিকে।

কে একজন বলল, যশোর জেলা স্বাধীন হওয়ার পরপরই ভৈরব নদ পাড়ি দিয়ে আতাহার কোথায় যেন চলে গেছে। মাগুরা নাকি খুলনা? খুলনা থেকে নদীপথে ভারতের সীমান্তের দিকেও যেতে পারে সে!

এতসব আগুরিবিগুরি নাকি আজবগজব কথাবার্তার মাঝে কিছুই বুঝতে পারলো না আলেকজান বিবি। শুধু আনমনা হয়ে শুনে যেতে লাগল। না শুনেই বা উপায় কী তার?  আতাহারের সন্ধান তো তাকে করতেই হবে।

কিন্তু রজবালি ফিরে এসে বলল অন্যকথা – ঘোরতর যুদ্ধ চলার সময়

 নাকি সংবাদ এসেছিল – আতাহার যুদ্ধ করতে করতে মারা গেছে! কিন্তু কোথায় মারা গেছে? কীভাবে মারা গেছে – রজবালি এসবের কিছুই আর জানতে পারে নাই। যদিও তারা একই সেক্টরে ছিল। ঘোরতর গোলাগুলির সময় কে কোথায় ছিটকে গিয়েছে তার হদিস পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য ছিল। কিন্তু রজবালি এ-খবর নিশ্চিত জানে – আতাহারের বুকে গুলি লেগেছিল – তবুও সে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে –

মারা যাওয়ার সময়েও মায়ের কথা বারংবার বলেছে – আমার বিধবা-দুখিনী মা! ফায়জুলের সম্মুখেই মারা যায় আতাহার। কিন্তু ওই ফায়জুলের সঙ্গে রজবালির দেখা হয় নাই। আতাহার মারা যাওয়ার পরপরই মাথায় গুলি লেগে ফায়জুলও মারা গেছে!

আলেকজান বিবি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো রজবালির দিকে। এমন মারাত্মক-নিষ্ঠুর কথাটা কীভাবে বলতে পারল এই রজবালি? সে ইয়াজিদ, নাকি সিমারের বংশধর?

দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে ঢাকা রজবালিকে সত্যিই তার অচেনা মনে হতে লাগল!

আলেকজান বিবি এরপরও বহু চেষ্টা করে গেল, কিন্তু আতাহারের সংবাদ কেউই তাকে সঠিকভাবে দিতে পারলো না!

আলেকজান বিবির কোমরের হাড্ডি-মাংস এখন একেবারে চিমসে আছে, আর আছে সেই কালো তাগায় বাঁধা কড়ি আর লোহার টুকরা – বিপদ তবুও আতাহারকে গিলে ফেললো? তামশার কথা নাকি এইগুলান?

স্বাধীন দেশে লাল-সবুজ রঙের পতাকা পতপত করে উড়তে লাগল আর শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা খুঁজে দেখা আলেকজান বিবির একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়াল। নিজে সে আনপড় – কিন্তু একে-তাকে ধরে ঠিকই সে জেনে নেয় নিহতদের নাম। তবে আলেকজান বিবির মনে এখনো ক্ষীণ আশা – ছাওয়ালডা ফিইরে আইসতেও পারে। রজবালি কী শুনতে কী না কী শুইনে ফেলাইছে, কী দেইখিতে কী না কী দেইখে ফেলাইছে – এতো কথা বিশ্বাস যাইতেও অয় নাকি?

পাঁচ

আউশ-বোরো-আমন কত ধানের কত মরশুম যে পেরিয়ে গেল – কত আষাঢ় আর শাওন, চৈত্র আর বৈশাখ – কিন্তু আলেকজান বিবি আতাহারকে খোঁজাখুঁজি ক্ষান্ত দিলো না।

তার চক্ষের আলো প্রায় নিভু-নিভু – মোষের গলার চামড়া হয়ে ঝুলঝুলে হয়ে গেছে দেহের ত্বক! সেই ঝুলঝুলে ত্বকের ওপর চিতাবাঘের শরীরের মতন কালো কালো ফুটকি পড়েছে! আহা! একদা কত মসৃণ ছিল এই দেহ!

ধান-উড়ানির হাত দুইটাতে কতই না শক্তি ছিল – আর এখন?  হাতে ধরা বাঁশের লাঠিটা এখন তার নিত্যসঙ্গী। লাঠিতে ভর দেওয়া ছাড়া আলেকজান বিবি এখন আর হাঁটতেও পারে না। কিন্তু তার কান দুটি ভারি সজাগ! কান দুটি সদা উৎকর্ণ! 

আলেকজান বিবি শুধু নয়,  মুক্তিযোদ্ধা আতাহার মিয়ার নামটা শহিদের তালিকায় অনেকেই খুঁজে ফেরে। তাদের ইচ্ছা – মরার পূর্বে যদি এই বুড়িকে সামান্য শান্তিও দেওয়া যায়!

বহু বছর বাদে আতকা একদিন খবর আসে – খবর জানায় আরেক মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ আলি – মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়সও ছিল ষোলো। আতাহার মিয়ার বন্ধু ছিল সে। ইউনুছ আলি জানায়, রক্তাক্ত ৭১ নামে এক বইতে নাকি শহিদদের তালিকায় আতাহার মিয়ার নাম উঠেছে। বইয়ের লেখক তাদের  আরেক সহযোদ্ধা বজলুর মজিদ।

দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক অর্ধশতক পর ছেলে আতাহারের সন্ধান পেল আলেকজান বিবি! মেহেরপুরের ভৈরব নদের ধারে চিরঘুমে ঘুমিয়ে আছে আলেকজান বিবির ছাওয়াল আতাহার।

বেদনার পথ বড় দীর্ঘ, বড় সর্পিল, শ্লথ – এই পথ যেন কিছুতেই ফুরাতে চায় না! তবুও আলেকজান বিবি লাঠিতে ভর করে কুঁজো হয়ে হেঁটে চলে। চক্ষের আলো নিভু নিভু। কিন্তু কানে আাজো সব স্পষ্টই শুনতে পায় – আলেকজান বিবি শোনে জলের শব্দ! ঝুমুত ঝুমুত শব্দে অগণন ঢেউ হারিয়ে যাচ্ছে আরেক ঢেউয়ের তলায়। ফের তলা থেকে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে নতুন  ঢেউ! রজবালিকে বাম হাতে ধরে আছে আলেকজান। তার আরেক হাত লাঠির মাথায় চেপে ধরা।

সারি সারি কবরের মাঝ থেকে আতাহার মিয়াকে আলাদা করে আজ আর চেনা যাবে না। কারণ কারো সমাধিতেই নামফলক লাগানো হয় নাই।

পথভ্রমণের শ্রান্তিতে ঘাসের ওপর ধপাস করে বসে পড়ে আলেকজান বিবি। প্রায়ান্ধ-দৃষ্টিতে কী যেন ইতিউতি খুঁজে ফেরে। আতাহারের কবর? নাকি আতাহারকেই? কই ঘুমিয়ে আছে তার সেই তাগড়া ছাওয়াল আতাহার?

ক্লান্ত-শ্রান্ত নব্বই বছরের বৃদ্ধা আলেকজান বিবি আলগোছে নিজের পা থেকে দুই ফিতার মলিন স্যান্ডেল জোড়া খুলে ফেলে। অদূরেই খরস্রোতা ভৈরবের জলস্রোত – ঘূর্ণি তুলে ভাসিয়ে নিচ্ছে এই পৃথিবীর সমস্ত বেদনা, নাকি সমস্ত জড়-জঞ্জালকে? কাঁপা কাঁপা হাতে আলেকজান বিবি পায়ের জীর্ণ স্যান্ডেল জোড়া নিক্ষেপ করে সেই বেগবান জলরাশিতে। মুহূর্তে ভেসে যায় আলেকজান বিবির পায়ের স্যান্ডেল দুইখানি।

যে-মাটিতে শহিদেরা ঘুমিয়ে আছে, সে- মাটির ওপরে আলেকজান বিবি আর কোনোদিন স্যান্ডেল পায়ে হাঁটতে পারবে না।

রজবালির কাঁধে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরতে শুরু করে আলেকজান বিবি। আহ! কোমল ঘাসের ওপর খালি পায়ে হেঁটে যেতে যেতে কিরকম যে নির্ভার লাগছে।

আলেকজান বিবির কোমরে বাঁধা তাগাতে হালকা করে টান দিতেই সেটা পলকেই ছিঁড়ে আসে। পুরাতন হয়ে যাওয়া ফ্যাসফ্যাসে সুতা – বহুদিন হলো নতুন তাগা কিনে এনে কড়ি আর লোহাটা গেঁথে নেওয়া হয় নাই। আর কীসের বদনজর থেকে বাঁচার আশায়  কোমর ঘিরে তাগার পাহারা রাখবে আলেকজান বিবি?

ভৈরবের জলস্রোতে আলেকজান বিবি আলগোছে ফেলে দেয় বহু বছর ধরে আগলে রাখা লোহার টুকরা আর সেই কড়িটিও। নিজের দেহে এতসবকিছুর ভার বহন করে আলেকজান বিবি আর এক কদমও হাঁটতে চায় না …!