ওদের সম্পর্কটা এখন বেশ শীতল।

বিবাহিত জীবনের পনেরো বছরের মধ্যেই সম্পর্ক এমন শীতল হয়ে যাবে মাঝে মাঝে ওরা ভাবলেও রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য দুজনের কারো কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। মনে হয় সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে সন্ধ্যায় ক্লান্ত – যেমন হাসান, তেমন লিজা। কেন এতোটা শীতল হলো – তারা খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেও না। খুব স্বাভাবিকভাবে চলছে তাদের যাপিত জীবন। যেন রোবোটিক জীবন। বছর দু-এক আগেও তাদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড় ও উষ্ণ।  

এখন নির্ঝঞ্ঝাট সংসার – বাসায় স্বামী-স্ত্রী, একজন গৃহকর্মী। একমাত্র ছেলে তন্ময় কোনো এক ক্যাডেট কলেজে পড়ে। ছুটির সময় বাসায় আসে। লিজা আর গৃহকর্মী সারাদিন বাসাতেই থাকে। প্রধান কাজের মধ্যে টেলিফোনে বা ট্যাবে কাটানো। ফেসবুক তো আছেই। হাসানের টাকা-পয়সার অভাব নেই। বেতনের বাইরেও কত টাকা আসে তার কোনো হিসাব নেই। লিজার হাত দিয়েই মাসে লাখ টাকা উড়ে যায়। হাসানের হাত দিয়ে কত খরচ হয় তার হিসাব সে নিজেও রাখে না। রাখার প্রয়োজন মনে করে না। নিজেদের তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট আছে, গাড়ি আছে, ব্যাংক ব্যালেন্স আছে। অভাব না থাকলে মানুষ নানা রকম সুখ খুঁজে বেড়ায়। হাসানও সে-পথে, লিজাও দু-এক পা এগিয়েছে। 

ঘড়ির কাঁটায় ওদের জীবন কখনো বাঁধা ছিল না। এখনো নয়। সকাল আটটায় হাসান অফিসের উদ্দেশে বের হয়, ফেরার কোনো সুনির্দিষ্ট সময় আগেও ছিল না, এখনো নেই। রাত এগারোটার আগে যে-কোনো সময় হাসান বাসায়  ফেরে। 

অফিস ছুটির পর হাসান বিকেলে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বের হয়। সন্ধ্যার পর কোনো দিন বিভিন্ন ক্লাবে যায়, কোনো দিন অন্য কোথাও জুনিয়র কলিগ তামান্নাকে নিয়ে ঘুরতে যায়। তামান্নার একাকী জীবন, হাসানের সঙ্গ পেলে সময়টা ভালো কাটে। দুজনের ঘনিষ্ঠতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সেপারেটেড তামান্না মা-বাবার সঙ্গে থাকে।

তন্ময় ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর লিজার সারাদিন একা একা বাসায় থেকে বেশ নীরস লাগে। দু-একদিন হাসানকে বলেছিল, চলো দূরে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি। বান্দরবান, না-হয় সেন্টমার্টিন থেকে।

এখন ছুটি পাওয়া যাবে না। এতো দূরে যাওয়া সম্ভব নয়, হাসানের শর্টকাট জবাব।

দূরে যাওয়ার মতো কথা বলতে লিজা আর কোনো যুক্তি পায় না। তাহলে অন্তত শুক্র বা শনিবারে ঘুরে আসার মতো জায়গায় চলো। একা একা বাসায় থাকতে থাকতে বোরড হয়ে গেছি।

আচ্ছা যাব। তন্ময় বাসায় এলে একসঙ্গে গেলে ভালো হতো না?

তোমার অজুহাতের শেষ নেই, কিছুটা অভিমানে ফেটে পড়লেও লিজার কিছু করার থাকে না। তন্ময়কে নিয়ে বেড়াতে গেলে ভালো হতো, কিন্তু তার নির্ধারিত সময়ে ছুটি। সেই সময়টাতে বাসায় থাকতেই ওর ভালো লাগে। ডিসেম্বরের লম্বা ছুটিতে হয়তো দূরে কোথাও যাওয়া যায়। তখন আবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে শীতের পিঠা খাওয়ার বায়না থাকে তন্ময়ের দাদা-দাদির। একমাত্র নাতির জন্য তাদেরও মন পোড়ে। আবার নানাবাড়িতেও যেতে হয়। সংসারে সবার মন রক্ষা করে চলা মানুষের বড় ধর্ম। লিজা তো সংসারধর্ম করেই কাটিয়েছে এতোদিন। কিন্তু এখন কেন হঠাৎ করেই সংসারের প্রতি মনের টান কমে গেছে? কখনো নিজেকে মনে হয় বন্দি খাঁচার পাখির মতো। এমন রোবটের মতো স্বামীর সংসার করে ছাত্রজীবনে দুরন্ত মেয়েটি ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেছে। প্রতিদিন ফেসবুকের ইনবক্সে মেসেজ আসে। অসভ্য পুরুষের অভাব নেই। কতগুলিকে ব্লক করে দিয়েছে। দু-বছর আগে একজনের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। এই লোকটাকে উদার ও রুচিশীল মনে হয়েছে। প্রতিদিনই ইনবক্সে ফুলেল শুভেচ্ছা দেয়। লিজাও গুগল থেকে নানা রকম ফুলের ইমেজ দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। উত্তরে সাজ্জাদ লেখে, আজকের সকালটা হয়ে গেল কাব্যিক। দিনটি আমার হয়ে গেল কাব্যময়। লিজা কখনো হি হি হি ইমুজি দেয়। কখনো মোহাচ্ছন্ন হয়ে চুপ হয়ে পড়ে থাকে। সাজ্জাদকে ভালো লাগতে শুরু করে ওর কথার জন্য। আবার কখনো সাজ্জাদের প্রোফাইলের ছবিগুলো বের করে নিবদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এমন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব খুব কম পুরুষের চেহারায় ফুটে ওঠে। তারপর সকাল সাড়ে দশটায় সাজ্জাদকে ফোন করে কথা বলে। ভরাট গলার পৌরুষদীপ্ত কণ্ঠে লিজার সঙ্গে কথা বলার সময় লিজার মনে হতো, ওর কাছে উড়ে চলে যায়। এমন সুন্দর করে কথা বলার একটা মানুষ জীবনে খুব প্রয়োজন। তারপর ভরাট হাসি যেন বুকের ভেতরে সবসময়ই বাজতে থাকে। নিজের অজান্তেই বলে ফেলে, কেন যে বিয়ের আগে তোমার সঙ্গে দেখা হলো না? অবশ্যই সাজ্জাদও প্রায় সময়ই ফোনে বলে, কেন যে বিয়ের আগে তোমার সঙ্গে দেখা হলো না কাব্যলতা! লিজাকে সাজ্জাদ কাব্যলতা বলে ডাকে। লিজা অবশ্য সাজ্জাদকে তেমন কোনো বিশেষ শব্দে সম্বোধন করে না। সাজ্জাদ বলেই ডাকে। 

আজ রাত নয়টার দিকে হাসান বাসায় ফেরে। ওই সময় লিজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে মগ্ন হয়ে সাজ্জাদের সঙ্গে কথা বলছিল। হাসানের আগমনের শব্দ টের পেয়ে গেট খোলে। তার চোখে-মুখে এক প্রকার অস্বাভাবিক ত্রস্ততা এবং আভাময় কামার্ত রং ফুটে উঠেছে। বিদুষী লিজা নিজেও বুঝতে পারে তার কিছুটা অস্বাভাবিকতা, তাই একটু স্বাভাবিক হওয়ার জন্য নিজেকে একটু আড়াল করার চেষ্টা করে। হাসান একবার লিজার দিকে তাকিয়ে অন্যদিনের মতোই বসার রুমে জুতো ছেড়ে কাপড় চেঞ্জ করে। লিজা জিজ্ঞেস করে, চা খাবে?

হাসান খুব আন্তরিকভাবে বলে, মন্দ হয় না। তুমি বরং এক কাপ ব্ল্যাক কফি দাও। লাইলি কোথায়?

লাইলি কিচেনে আছে। কিছু বলতে হবে?

না, তেমন কিছু না।

হাসান ফ্রেশ হয়ে চলে যায় বেডরুমে। লিজার বুক কেঁপে ওঠে। বিছানার ওপরই মোবাইল সেটটা। ইনবক্সের কিছুই ডিলিট করা হয়নি। যদি হাসান মোবাইল সেট হাতে নেয় তাহলেই সর্বনাশ। সংসারে শুরু হবে ভাঙন। লিজার শরীরে ঘাম দেখা দেয়। কিন্তু হুট করে মোবাইল সেখান থেকে সরাতে চাইলেই হাসান সন্দেহ করবে। তাড়াতাড়ি কফির কাপ নিয়ে লিজা হাসানের হাতে দেয়।

টিভি অন করে লিজা হাসানের পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, আজ সকাল সকাল ফিরলে যে। কোথাও যাওনি?

না। কালকে ট্যুরে যাব। তাই গোছগাছ করতে হবে ভেবে আগেই চলে এলাম।

কোথায় যাবে? আগে তো বলোনি।

আজকেই অফিস জানালো যাওয়ার জন্য।

কোথায় যাচ্ছ?

যাব রাজশাহীতে।

কয়দিনের ট্যুর?

কাল যাব পরশু কাজ করে পরের দিন ফিরে আসব। একটা মিটিং মাত্র।

হাসান এ-রকম একদিন বা দুদিনের জন্য প্রায়ই ঢাকার বাইরে যায়। ট্রেনিং বা ওয়ার্কশপ থাকলে কয়েক দিন থাকতে হয়। লিজাও মনে মনে হাসানের বাইরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিল। একটা সুযোগ সে খুঁজছিল।

হাসান বলল, লাইলিকে বলো দুই সেট কাপড় আয়রন করে গুছিয়ে দিতে।

লিজা বলল, আয়রন করা আছে। আমিই গুছিয়ে দিতে পারব।

কফি শেষ করে হাসান ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসে একটা ম্যাগাজিন ওল্টায়। শুধু পাতা ওল্টানোই সার। কিছুই পড়ে না। মন পড়ে আছে তামান্নার কাছে। যদিও বিকেলটা তামান্নার সঙ্গে কাটিয়ে এসেছে তথাপি আবার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। লিজার হাতে ধরা খেতে হয় কি না ভেবে নিজেকে সংযত রাখে।

বাথরুমে ঢুকে মোবাইল ফোন সেটের মেসেজ ডিলিট করে দিয়ে বসার ঘরে হাসানের সামনে বসে আন্তরিক হওয়ার ভান করে লিজা। এতোক্ষণ ওর চিন্তা বেশ এলেমেলো ছিল, এখন স্বস্তি ফিরেছে। কিন্তু বলার মতো কোনো কথা পায় না। লিজা ভাবে, বড় আশ্চর্য যে সাজ্জাদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বললেও যেন কথা

শেষ হয় না। আর এতোদিনের ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে কথা বলার জন্য কথা পাই না।

হাসান লিজার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবে লিজা? হাসানও ভাবে, লিজার সঙ্গে একটু আন্তরিকভাবে কথা বলা হয় না অথচ তামান্নার সঙ্গে কথা বলে শেষ করা যায় না। লিজা এখনো আমার প্রিয়, ওকেই তামান্নার চেয়ে বেশি ভালোবাসি। কিন্তু কেন কথা বলতে পারছি না? কেন ইচ্ছে হয় না? বুকের ভেতর থেকে কোনো কথাই যেন মুখে আসে না।

লিজা বলে, না, তেমন কিছু বলব না। এমনিতেই বসলাম তোমার পাশে।

হাসান স্মিত হেসে বলে, আমার পাশে বসার কী আছে? একসঙ্গেই তো থাকি সবসময়।

লিজাও হাসে। তবে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলে, তাই বলে বসতে নেই?

হাসান হাসে, বসো। না তো করিনি।

হাসান বলার মতো আর কোনো কথা পায় না। ট্যারা চোখে লিজাকে দেখে নিরুচ্চারে বলে, চাঁদের মতো তুমি। কিন্তু এরপরও তোমার সঙ্গে আমার একটা দূরত্ব কেন সৃষ্টি হলো? তামান্নাও কি কম সুন্দর! তাকেও ভুলে থাকা যায় না। এ কীসের কেমিস্ট্রি? তামান্নাই আমাদের দুজনের মাঝখানে একটি অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে। 

লিজাও মাঝে মাঝে ট্যারা চোখে দেখে হাসানকে। মনে মনে বলে, এতো মায়াবী আকর্ষণ তোমার চোখে, মুখে, হাসি ও কথায় … কিন্তু এরপরও কেন সাজ্জাদকে ভালো লাগে। এ কীসের আকর্ষণ?

কিচেনে ব্লেন্ডারে মসলা গুঁড়ো করছে লাইলি। একটা তীক্ষè শব্দ এসে কানে বিঁধছে। হাসান লিজার দিকে তাকিয়ে বলে, লাইলিকে বলো তো ব্লেন্ডার বন্ধ করতে। আমার কোনো শব্দ ভালো লাগছে না। মাথাটা কেমন যেন কনকন করছে।

লিজা নিঃশব্দে উঠে যায় কিচেনের দিকে। হাসানের মনে তামান্নার জন্য একটা আবেশ তৈরি হয় এবং চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে বিভিন্ন বিষয়। এবারই প্রথম তামান্নাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। আজকাল এখানে-সেখানে সিসি ক্যামেরা। নানাভাবে ফোনের কথাও রেকর্ড হয়ে যায়। কোনো বিপদ হয় কি না কে জানে।

ব্লেন্ডারের তীক্ষè ও ঝিম ধরা শব্দটা বন্ধ হলে হাসান চোখ বন্ধ করেই সোফায় কাত হয়ে শুয়ে থাকে। এই রাত বড় দীর্ঘ। ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল দেখা শুরু করে লিজা। বাসায় থেকে তার কাজের মধ্যে সিরিয়াল দেখাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মাঝে মাঝে শপিংয়ে যায়, খেয়ালবশত যা ভালো লাগে তা-ই কেনে।

সকালে হাসান বের হয়ে যায়। আজকে নিজের গাড়ি নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। লিজাকে বলেছে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত উবারের ভাড়া দেবে অফিস। তাই নিজের গাড়ি নেবে না। বাসা থেকে বের হয়ে নির্ধারিত ভাড়া করা গাড়িটি পেয়ে উঠে তামান্নাকে বনানী থেকে তুলে গাজীপুরের সুইট হ্যাভেন রিসোর্টের দিকে যাত্রা শুরু করে। টঙ্গী থেকে গাজীপুর রাস্তাটি প্রায় এক যুগ ধরে ভাঙা, রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে। এখনো ঠিক হয়নি। রাস্তায় ভয়ানক জ্যামে ওরা প্রায় তিন ঘণ্টা আটকা পড়ে থেকে দুপুরের দিকে বুকিং অনুযায়ী নির্ধারিত রুমে গিয়ে ওঠে। তামান্না রুমে কোনো রকম ঢুকেই ওয়াশরুমে ঢোকে বিদ্যুৎগতিতে। বের হয়ে হাঁফ ছেড়ে বলে, এমন ভয়ানক বিপদে পড়েছিলাম যা বলার মতো নয়। এই সকালেই এমন জ্যাম থাকবে কে জানতো?

ভিআইপি স্যুইট, কিং সাইজ কাপল বেড, একপাশে দুটি সোফা। টি-টেবিলে একটা ছোট বাঁশবেতের ঝুড়িতে কয়েক রকম ফল র‌্যাপিং কাগজে লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা। বিশাল ড্রেসিং টেবিল। পর্দাগুলো হালকা নীল। দেয়ালের সঙ্গে একটা লম্বা টেবিল। ওখানে চা-কফি খাওয়ার যাবতীয় সরঞ্জাম। একটা মিনি ফ্রিজ। কয়েকটি পানির বোতল, কাপ, প্লেট, কয়েক প্রকার বাদাম ও চিপসের প্যাকেট। বাদাম ও চিপসের প্যাকেটের গায়ে মূল্য লেখা রয়েছে, যা শপিংমলের দামের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি।

তামান্না হাসানের দিকে তাকিয়ে বলে, যাও, ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি কফি বানাচ্ছি।

হাসান সুবোধ বালকের মতো ফ্রেশ হয়ে এসে তামান্নার পাশে বসে।

অনেকদিন পর স্বপ্ন পূরণ হলো। এখনো মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। বিশ^াসই হচ্ছে না যে তোমাকে নিয়ে আমি এক রুমে আছি, বলে হাসান।

তামান্না বলে, আমারও এমন মনে হচ্ছে। আসলেই অনেকদিন পর।

তুমি সহজে ধরা দাওনি।

হুম। তুমি এতোটা নাছোড়বান্দা না হলে আজো দিতাম না।

তোমার কি ইচ্ছে হতো না এমন নিরিবিলি …

থাক এসব কথা। কফি খাও। তারপর দেখা যাবে। এই রুম থেকে বের হওয়া যাবে না। রুমেই খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। 

কেন?

কে না কে দেখে ফেলে। এখানে কেউ চিনেও ফেলতে পারে। এখানে কত লোকের যাওয়া-আসা।  

রুম থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন কী? রুমেই থাকব। তুমি আর আমি, দুজন একাকার হয়ে যাব।

দুপুরে বনানীর হান্ডি রেস্টুরেন্টে এক কোণে একটি টেবিলে মুখোমুখি বসে সাজ্জাদ আর লিজা। দীর্ঘদিন দুজনের ফোনে প্রেমালাপ, ফেসবুকের ইনবক্সে চ্যাটিংয়ের পর দেখা হওয়ায় প্রথমে সলাজ অনুভূতি থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যে তারা সপ্রতিভ হয়ে ওঠে। তাদের চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ে সুখানুভূতির উজ্জ্বল প্রভা।

তাহলে আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলো? সাজ্জাদ বলে লিজার চোখের দিকে তাকিয়ে। লিজা কোনো জবাব না দিয়ে স্মিত হাসে। কিছুক্ষণ তাদের অনুভূতি বিভিন্ন কথায় প্রকাশ করে। একসময় লিজা বলে, আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। আমি কখনো ভাবিনি তোমার সঙ্গে সরাসরি দেখা হবে। লিজা ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে একটি টাইটান ঘড়ির প্যাকেট বের করে সাজ্জাদের হাতে দিয়ে বলে, তোমার জন্য আনলাম।

এই সময় ওয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, স্যার, কী দেব? তার হাতে ছোট একটি নোটবুক আর বলপয়েন্ট। অপেক্ষা করছে লেখার জন্য। ওদের দুজনের সামনেই মেন্যু বুক।

লিজা মেন্যু বুকটি সাজ্জাদের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, আজকে তোমার চয়েসে খাব।

সাজ্জাদ বলে, আমার একার চয়েসে কেন? দুজনের চয়েসেই খাব। সাজ্জাদ দুই আইটেম অর্ডার দিয়ে মেন্যু বুকটি লিজার দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, এবার তুমি কিছু বলো।

লিজা আরো কয়েক আইটেম অর্ডার দেয়। ওয়েটার চলে যাওয়ার পর সাজ্জাদ বলে, চমৎকার উপহারের জন্য ধন্যবাদ। ল্যাপটপের ব্যাগ থেকে একটি সোনার চেইন বের করে লিজার হাতে দিয়ে সাজ্জাদ বলে, এটি তোমার জন্য। লিজা সোনার চেইনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, তোমাকেও ধন্যবাদ। কিন্তু …

সাজ্জাদ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু কী?

লিজা বলতে চেয়েছিল এতো দামি চেইন কী প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সাজ্জাদ আবার কিছু মনে করে কি না ভেবে চুপ থাকে। সে বলে, থাক। অন্য কোনো দিন বলব।

সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করে, আবার কবে দেখা হবে?

হবে। তুমি যখন চাইবে। আমার সাহেব তো প্রায়ই ট্যুরে যায় তখন নির্বিঘ্নে দেখা করা যাবে।

সাজ্জাদ সন্দিহান কিন্তু এরপরও মনের কথা লুকিয়ে রাখতে পারে না। সে জিজ্ঞেস করে, দীর্ঘক্ষণের জন্য কোনো দিন দেখা হবে না?

লিজার মুখে দুষ্ট হাসি। অস্ফুট উচ্চারণে বলে, দুষ্ট, বদমাশ।

সাজ্জাদ হাসে। সাজ্জাদের হাত দুটি টেবিলের ওপর। লিজা এক হাতে চিমটি দিয়ে বলে, হবে কোনোদিন। অস্থির হওয়ার কিছু নেই।

এখানে যতক্ষণ থাকব ততক্ষণ তোমার হুকুমেই সব হবে, বলে হাসান। 

আমার হুকুমে, হাসে তামান্না। এমন কর্তৃত্বপরায়ণ গৃহিণীর মতো দায়িত্ব নিতে পারব না। আজ আমরা দুজন মিলে একজন। আমি আর তুমি বলবে না। বলবে আমরা।

তামান্নার কথা ভালো লাগে হাসানের। হাসানের পরনে শর্টস, গায়ে মোটা একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। এসির হালকা বাতাসে হিম ছড়ায়। সোফায় কাত হয়ে বসে ভদকা খায় আস্তে আস্তে। তামান্নাও দু-এক চুমুক দিয়ে বিছানায় শুয়ে ঝিমুচ্ছে। ওর গায়ে ফিনফিনে পাতলা কাপড়ের গোলাপি রঙের নাইটি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে তামান্না। চমৎকার রোদ বাইরে। রিসোর্টটি একটি জঙ্গলের মধ্যে। জঙ্গলের গাঢ় সবুজ বনানী ওর দৃষ্টিতে এক প্রকার মাদকতা সৃষ্টি করে। বিশাল জানালা দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। তাকিয়ে থাকে নিসর্গের অপরূপ সৌন্দর্যের দিকে। অনেক পাখি ওড়াউড়ি করছে। হয়তো ওরা কিচিরমিচির শব্দে গানও করছে কিন্তু জানালার কাচ ভেদ করে পাখিদের শব্দ শোনা যায় না। কেবল সৌন্দর্যেই চোখ জুড়িয়ে যায়।

খেয়ে খেয়ে তো কেবল ওজনই বাড়াচ্ছি। মোটা হওয়ার অনেক যন্ত্রণা, খেতে খেতে আনমনা হয়ে বলে লিজা।

সাজ্জাদ বলে, তোমার ওজন বেড়ে চলেছে বলে মনে হয় না। ফিট বডি।

হুম। ফিট কি আর সহজে থাকে। ডায়েট করি, এক্সারসাইজ করি, মাঝে মাঝে জিমেও যাই।

তাহলে এতো ভাবছো কেন? মনের খুশিমতো খাও। আমরা তো আর প্রতিদিন রেস্টুরেন্টে খেতে আসছি না।

আসতেও তো পারি। লিজা হাসে।

তুমি এলে আমার অবশ্য বাধা নেই। আমি টাইম ম্যানেজ করতে পারব। বৈরাগী হতেও দ্বিধা নেই লিজা। কসম, আমি সত্যি তোমার প্রেমে দেউলিয়া। 

লিজা বলে, দুষ্ট।

সত্যি বলছি, তোমার প্রোফাইল পিক তেমন আকর্ষণ করত না। কিন্তু এখন ভাবছি, এতো সুন্দর মানুষ হয় কী করে?

বিকেলটায় একবার বের হতে পারলে ভালো হতো। নিসর্গের এই রূপ যদি না উপভোগ করতে পারি তাহলে এখানে আসাটাই অর্থহীন হয়ে যাবে। দেখো হাসান, পাতায় পাতায় রোদের কেমন অপূর্ব নাচানাচি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রহস্য মনে হয় আলো-ছায়ার খেলা।   

হাসান হাসে। হুম। আলো-ছায়া। সত্যিই বলেছো। আমরা কি নিসর্গের রূপ দেখতে এসেছি। আমরা এসেছি জীবকে উপভোগ করতে। আমি এসেছি তোমার রূপ দেখতে। জীবনের এই সময়টা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। কিন্তু নিসর্গের এই রূপ চির অমøান। আমরা অন্যদিন এসে চোখ জুড়িয়ে দেখব।

চলো না একবার বাইরে যাই। দুদিন থাকা হবে। সময় তো কম নয়। 

কেউ যদি আমাদের দেখে চিনে ফেলে সেই ভয় তো কিছুটা আছে।

হুম। তা আছে।

আমাদের দেখাটা ক্ষণকালের জন্য হলেও বড় প্রশান্তি অনুভব করলাম, বলে সাজ্জাদ।

আজকের মুহূর্তটা আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি, সেরা মুহূর্ত। এমন ভালো লাগার সময় আর এই জীবনে অনুভব করিনি। সত্যিই … ভাষায় বোঝাতে পারব না সাজ্জাদ।

একটা দিনক্ষণ ঠিক করো লিজা। দীর্ঘ সময়ের জন্য। খুব ভালো হতো যদি …

যদি কী? শেষ করো।

যদি দু-একদিন একসঙ্গে থাকা যেত দূরে কোথাও যেখানে শহরের কোলাহল ছেড়ে একেবারে দূরের কোথাও বনবনানী ঘেরা কোনো রিসোর্টে।

তুমি খোঁজ নিয়ে রাখো। আমার সাহেব পরের বার ট্যুরে গেলে দেখা যাবে।

হাসান ফিরে আসার পর ওদের আগের মতোই রোবোটিক শীতল জীবনযাপন শুরু হয়। দুজন দুজনের মতোই একই নিয়মে একই রুটিনে স্রোতহীন নদীর মতো নিরানন্দে দিন চলে। তবে দুজন যখনই ফুরসত পায়, সাজ্জাদ ও তামান্নার সঙ্গে কথা বলে তখন মুহূর্তেই প্রবল স্রোতধারা শ্রাবণের নদীর মতো হয়ে ওঠে। তামান্না আর সাজ্জাদ যেন মৃত নদীকে জাগিয়ে তোলে কথার তরঙ্গে। কিছুদিন আগে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে তন্ময় বাসায় বেড়াতে এলে বাসায় কিছুটা প্রাণ ফিরে এসেছিল। কিন্তু তাও মাত্র এক সপ্তাহের জন্য। তন্ময়কে নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে চাইলে তন্ময় যেতে চায়নি। মা আমি শুধু ঘুমাব, একটিই বায়না তন্ময়ের। ক্যাডেট কলেজের কঠোর নিয়মের মধ্যে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে তন্ময়।

তন্ময় চলে যাওয়ার পর আবার বাসাটি ঝিমিয়ে পড়ে। লিজা আর হাসানের মধ্যকার সম্পর্কটা আরো দূর মনে হয়। দুজনের কেউ দূরত্ব ঘুচিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ নেয়নি বা তৎপর হয়নি। কারো প্রতি কেউ বীতশ্রদ্ধও নয়। কোনো ঝগড়াও নেই। কোনো অনুযোগ-অভিযোগ বা বিরোধ নেই। নদীর পাড়ের বালির মতো কেবল নিঃশব্দে আলগা হয়ে যাওয়া, নিবিড় বন্ধনমুক্ত হয়ে একজনকে অন্যজনের ছেড়ে যাওয়া।

এমনই এক নিরুত্তাপ সময়ে একদিন হাসান লিজাকে জানায়, তিনদিনের জন্য ট্যুরে যাবে চট্টগ্রাম। লিজাও সাজ্জাদকে হাসানের চট্টগ্রাম যাওয়ার তারিখ জানিয়ে দিয়ে বলে এবার সে বের হতে পারবে। গৃহকর্মীও গ্রামের বাড়িতে গেছে। বাসায় তালা মেরে দু-একদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে কোনো বাধা নেই।

নির্ধারিত তারিখে হাসানের লাগেজে সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মেই গোছগাছ করে দেয় লিজা। হাসান সকালেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট থেকে ডমেস্টিক ফ্লাইটে চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

দুপুরের আগেই লিজা বাসায় তালা লাগিয়ে সাজ্জাদের সঙ্গে গাজীপুরের শালবনের অনেক ভেতরে ‘রিসোর্ট হ্যাভেনে’ গিয়ে হাজির হয়। সাজ্জাদ আগেই রুম বুকিং দিয়ে রেখেছিল। রিসোর্টের ভিআইপি স্যুইট, কিং সাইজ কাপল বেডের রুমে গিয়ে ঢোকে দুজন। রুমের উত্তর পাশের জানালা দিয়ে শালবনের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। দু-একটি মহুয়া গাছও আছে।

আবার ফাঁকে ফাঁকে হিজল জারুল চালতা কদম অশ^ত্থ গজারি দেখা যায়। লিজা উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছে। গাছগাছালি দেখে মনের ভেতরে ছাত্রজীবনের ভালো লাগার দোলা লাগে। সে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে শালবনের গাছগাছালির দিকে। রুমের ভেতরে দুজনের লাগেজ ঠিকঠাক করে রেখে দু-কাপ কফি বানিয়ে এক কাপ লিজার হাতে দিয়ে অন্যটি নিজে নিয়ে বারান্দার সোফায় বসে সাজ্জাদ। লিজাও বসে কফির মগ হাতে নিয়ে। লিজার দৃষ্টি এখন শালবনের দিকে। বনের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না লিজা। সাজ্জাদ বলে, তুমি কি শুধু বনই দেখবে? আমাকে দেখবে না?

লিজা স্মিত হেসে বলে, তোমাকে দেখার জন্যই তো এলাম। কী অপূর্ব এই শালবন দেখো।

সাজ্জাদ হাসে। আসলে প্রকৃতি আমাকেও মুগ্ধ করে। আমি প্রতি মাসেই গ্রামে যাই। আমাদের গ্রামের বাড়ির কাছে একটি বাগানবাড়ি আছে। শহরের কোলাহল, বিশেষ করে ঢাকার মতো উচ্চ শব্দের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লে গ্রামের বাড়িতে যাই, তারপর পরিবার নিয়ে বাগানবাড়িতে থাকি। এতো নিরিবিলি, এতো প্রশান্তি আর কোথাও নেই।

ইস, শুনেই ভালো লাগছে। কিন্তু তোমাদের বাগানবাড়িতে কি যাওয়ার উপায় আছে?

মাথা খারাপ! ধরা খাওয়ার ইচ্ছে থাকলে চলো। তারপর দুজনে বাকি জীবন জেলে কাটাব। হো হো করে হাসে সাজ্জাদ।

লিজাও হাসে। জেলে থাকার ইচ্ছে নেই। আমরা মাঝে মাঝে এখানে আসতে পারি, তাই না সাজ্জাদ?

হুম। যদি তোমার সম্মতি থাকে। তুমি যখনই হুকুম করবে আমি তোমার পদসেবায় লেগে যাব। তোমার পদ্মপদযুগলে দেবো বকুলের মালা।

যাহ্, বজ্জাত। দুষ্ট। লিজা হাসে।

সাজ্জাদ লিজার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে, তোমার হাসিতে কেমন যে এক স্বর্গীয় দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। আমি বিমোহিত হয়ে যাই।

থাক মোসাহেবি। আমি তো তোমার জালে ধরাই পড়েছি। এখন কাটো, বাটো, ভাজো … যা ইচ্ছে তাই করো।

এভাবে এতো নির্দয় কথা বলবে না লিজা।

নির্দয় কথা কীভাবে হলো? হাসে তামান্না। হাসান তামান্নার দিকে তাকিয়ে থাকে গভীর ও গাঢ় দৃষ্টিতে।

হাসান বলে, তাহলে কেন বললে আর কখনো এখানে আসবে না।

তামান্না বলে, এখানে আসব না তাই বলে অন্য কোথাও যাব না সে-কথা তো বলিনি। এক জায়গায় বারবার আসতে কি ভালো লাগে? ঢাকার বাইরেই যখন যাব তখন দূরে কোথাও যাব। গাজীপুরেই শতাধিক রিসোর্ট আছে। তাহলে এখানেই আসতে হবে কেন?

ও আচ্ছা! সে-কথা বলো। আমি ভাবছিলাম তুমি আর আমার সঙ্গে আসবে না।

তামান্না আনমনা হয়। তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ে। একসময় নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অস্ফুট উচ্চারণে বলে, যেভাবে জড়িয়েছি তাতে কি তোমাকে ছাড়া থাকা যাবে? তোমার মধ্যেই বিলীন হয়ে গেছি। জানি না এই প্রেমের পরিণতি কী?

হাসান বলে, আসলে জানো তামান্না, আমিও তোমার মধ্যে বিলীন হয়ে গেছি। তোমার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর আমাদের দাম্পত্য জীবন এতো শীতল যে বলতে গেলে মনে হয় আমরা দুজনই রোবট।

তোমার ওয়াইফ তোমাকে জ¦ালায় না?

ও কেমন যেন নিরুত্তাপ নিস্পৃহ হয়ে গেছে। আসলে আমার মনে হয় আমার নিস্পৃহতায় ও ক্ষুব্ধ এবং আমি কত দিন এভাবে থাকতে পারি তা দেখছে। হয়তো সে এভাবেই রিভেঞ্জ নিতে চায়। কোনো বিরোধ নেই, কোনো নির্যাতন নেই, কোনো কথাকাটাকাটি নেই অথচ আমরা দুজন একই বিছানায় পুতুলের মতো থাকছি … তাও প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেল।

আশ্চর্য! অস্ফুট উচ্চারণে বলে তামান্না। তারপর ধীরে ধীরে বলে, আসলে মনকে মানিয়ে নিলে শরীর তো আর কিছু না। আমার সেপারেশনের পর তিন বছর আমি ভালোই ছিলাম। শরীরের কোনো পীড়ন ছিল না। এখন তুমিই মরা নদী জাগিয়ে তুললে। হয়তো তোমার স্ত্রীও মরা নদীর মতোই পড়ে আছে। তুমি জাগিয়ে তুললেই আবার জেগে উঠবে।

হুম। কিন্তু তোমার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর ও আমাকে কেন যেন টানতে পারে না। কোনো আকর্ষণ বোধ করি না।

এই ভালো লাগার অনুভূতি ব্যাখ্যা করা যাবে না সাজ্জাদ। মনে হয় স্বর্গীয় অনুভূতি। লিজার নিমীলিত চোখ। নিরাভরণ দেহ। পাশে শুয়ে আছে সাজ্জাদ। লিজা আবার বলে, কয়েকটা দিন থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু …

বেশি দিন থাকলে ভালো লাগবে না লিজা। তবে আমরা মাঝে মাঝে ঢাকার বাইরে কিংবা তোমার বাসাতেও প্রোগ্রাম করতে পারি। যেহেতু তোমার বাসা খালিই থাকে।

দেখা যাক। মিয়া বিবি রাজি থাকলে কত জায়গাই পাওয়া যাবে।

চোখের পলকে কেটে গেল একটি রাত। এক রাতের বেশি থাকা লিজার পক্ষে অসম্ভব। রিসোর্টের নিয়ম অনুসারে পরদিন দুপুর বারোটা পর্যন্ত রুমের বুকিং আছে। দশটায় ওদের ঘুম ভাঙে। বেশ ফুরফুরে লাগে দুজনকে। ফ্রেশ হয়ে রুমেই নাশতা করে দুজন। ওদের তৈরি হতে হতে এগারোটা বেজে যায়।

হাসান আর তামান্না আজকেও রিসোর্টে থাকবে। ওদের ঢাকায় ফেরার তাড়া নেই। তামান্না বলে, চলো আজকে এই মিষ্টি রোদের মধ্যে একটু শালবনে ঘুরে বেড়াই। পাখি দেখি। কত রকমের পাখি এই শালবনে তাই না?

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তামান্না শালবনের গাছগাছালি, পাখি, বানর ও কাঠবিড়ালি দেখে আনমনা হয়ে। বড় ভালো লাগে গাছের পাতায় পাতায় সকালের উজ্জ্বল রোদের নাচানাচি। কত রকমের পাখি দেখেছো হাসান।

হ্যাঁ। অনেক রকমের পাখি।

চলো তাহলে লাঞ্চের আগ পর্যন্ত শালবনে ঘুরে বেড়াই। শরীরটাও চাঙ্গা হবে, খিদেও লাগবে আর ঘুমও ভালো হবে।

রাখো, ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখি এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে কি না?

তামান্না বুঝতে পারছে না হাসান মজা করছে নাকি সত্যি সত্যি বলছে। সে বলে, শালবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার! বলো কী?

দাঁড়াও না দেখি। থাকতেও তো পারে।

হুম। এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার নেই। তবে উল্লুক আছে।

উল্লুক? হুম।

কোথায়?

এখন আমার রুমেই আছে।

হাসান হো হো করে হাসে। বুঝেছি তুমি রেগে গেছো। চলো তাহলে বের হই। সাজ্জাদ স্যুইটের দরজা খুলে ট্রলিব্যাগের লাগেজ নিয়ে বের হয়ে দরজা লক করে। পেছনে বড় একটি ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে লিজা দাঁড়িয়ে। ঠিক সেই মুহূর্তেই সাজ্জাদের সামনের স্যুইট থেকে নীল রঙের টি-শার্ট ও থ্রি কোয়ার্টার পরা হাসান আর তার  পেছনে তামান্না বাইরে এসে দাঁড়ায়। লিজার চোখে হাসানের চোখ পড়ে। ওরা ফ্রিজ হয়ে যায়। সাজ্জাদ ডাকে, লিজা এসো। তামান্না ডাকে, হাসান এসো। ওরা দুজন নড়তে পারে না। মোমের পুতুলের মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।