শ্রদ্ধান্জলি
-
এক দ্রোণাচার্যের কথা (তর্পণ : শ্রী শঙ্খ ঘোষ)
এক যুবক কবি ভিড়ের আড়ালে দূর থেকে বুদ্ধদেব বসুকে দেখছেন। মাঝখানে তাঁর দৃষ্টি ঢেকে কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় ঘণ্টি বাজিয়ে ট্রাম চলে যায়, কত হাজাররকম ব্যস্ততা ফুলেফেঁপে ওঠে। যুবক শুধু দূর থেকে দেখে যান স্বনামধন্য কবি ও সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুকে – নিজের পরিচয় দিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াতে কোথাও যেন সংকোচ হয় তাঁর। … এই একই ঘটনার…
-
শঙ্খ ঘোষ : কিছুটা ব্যক্তিগত অনুষঙ্গে
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। মফস্বলের শহর থেকে সোজা রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে। কলাভবনে ছবি আঁকার পাঠ নিতে এসেছি। আমার কাছে এ একেবারে অন্যভুবন, বড় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে সময়। প্রথম বর্ষের পাঠশেষে কখন যে দ্বিতীয় ধাপে উঠে পড়েছি কে জানে! তাহলে আমরা একটু সিনিয়র, এবারে আরেক রকমের অপেক্ষা। নতুন ছেলেমেয়েরা ভর্তি হবে – এই ভেবে মনের মধ্যে প্রবল…
-
শঙ্খ ঘোষের কবিতা : একটি অলীক সংলাপ
(আধুনিক বাংলা কবিতার অলোকসামান্য ব্যক্তিত্ব শঙ্খ ঘোষ করোনাকবলিত হয়ে বিদায় নিলেন। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে। তাঁর কবিপ্রতিভার আলোচনা, বিশ্লেষণ বহু হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আমরা এখন শোকের ভার লাঘব করতে পরলোকে বিশ্বাস স্থাপন করে ফিরে যাব স্বর্গোদ্যানে, যেখানে তিনি তাঁর সতীর্থ, গুণমুগ্ধ কয়েকজনের দেখা পেয়ে সংলাপে মগ্ন হয়েছেন। চলুন, আমরা চুপ থেকে ওনাদের…
-
কবি অলোকরঞ্জন ও তাঁর কাব্যপরিসর
এই তো সেদিনের কথা। ১৭ই নভেম্বর। একটু রাত করেই ঘুমোই। হঠাৎই ফেসবুকে ভেসে উঠল অলোকদার প্রয়াণসংবাদ। চমকে উঠলাম। সুশীলদা মানে আমাদের সুশীল সাহাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম। ফোন বন্ধ। সারারাত জেগেই কাটল। ঘুমবো কী করে? মনে পড়ে এরকমই অবস্থা হয়েছিল সমালোচক অধ্যাপক উজ্জ্বলকুমার মজুমদারের প্রয়াণসংবাদে। যে কয়েকজন প্রথিতযশা মানুষের কাছে এসেছি, ভালোবাসা পেয়েছি তাঁদের মধ্যে…
-
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত : অধিবিদ্যার কবি
এক বেশ্যা অনায়াসে ভিতরমন্দিরে ঢুকে যায় বুদ্ধ মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল এক বেশ্যা ঢুকে যায় পেছন-দুয়ার ঠেলে দাঁড়ায় বৃদ্ধের ঠিক পাশে; দুটি দেবদারু দেয় দ্বারপ্রান্তে সযত্নে পাহারা কেউ যেন বুঝতে না পায়, কবিতা কি শুধু আবেগ আর প্রেমের, শুধুই কি বৃক্ষ, অরণ্য আর নীরবতার? প্রেম-প্রণয়ের বিপরীতে কবিতা যে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ হয়ে উঠতে…
-
সুধীরদা : স্মৃতির টুকরো
সুধীর চক্রবর্তী। বাংলা সাহিত্যের আসরে সোনার জলে খোদাই করা একটি নাম। কৃতী লেখক ও গবেষক। তাঁর কলমের ডগায় শব্দেরা অনায়াসে হাজির হয় বাধ্য অনুগামীর মতো। সারাজীবনে তিনি অজস্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। লেখার হিসাব নিতে বসলে তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠবে। এইসব গ্রন্থ কোনো নির্দিষ্ট পথে একই মুখে এগিয়ে চলতে…
-
অপরাজিত সৌমিত্র: রেখে গেলেন এক অমর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
সদা কর্মচঞ্চল মানুষটিকে ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত করছিল টানা লকডাউন? কিন্তু ক্লান্ত হওয়ার মানুষ নন তো তিনি। তাই গৃহবন্দি থেকেও ক্রমে আরো আরো মনের দরজা খুলে দিতে চাইছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর নিজের পড়ার ঘর থেকে পাওয়া গেল এক ডায়েরি, যেখানে রয়েছে ছোট ছোট গদ্য, কবিতা এবং আঁকা ছবি। বোঝা যায় লকডাউন তাঁকে মনের দিক থেকে…
-
‘সেই অনিঃশেষ চিত্রকল্পের কাছে’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রের একঝাঁক চরিত্রের মুখচ্ছবি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে বাঙালিমাত্রেরই। চলচ্চিত্রের অভিনয়ের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন অসামান্য কৃত্যে প্রায় ষাট বছরেরও বেশি। স্বনামধন্য স্মরণীয়-বরণীয় পরিচালকদের সঙ্গে তাঁর অভিনয় বাঙালি দর্শকের হৃদয় জয় করে নিয়েছে দু-তিন প্রজন্ম ধরে। চলচ্চিত্র-নাটক ছাড়া এক নিভৃতচারী মগ্ন চিন্তাশীল অন্তরের সুপ্ত অনুভবে নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন কবি সৌমিত্র…
-
পাঠপরিক্রমণ থেকে লেখালেখির মিলিত ঐকতান
হেমন্তবালা দেবীকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমার জীবনটা তিন ভাগে বিভক্ত – কাজে, বাজে কাজে এবং অকাজে।’ বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘কাজের দিকে আছে ইস্কুলমাস্টারি, লেখা, বিশ্বভারতী ইত্যাদি, এইটে হলো কর্তব্য বিভাগ। তার পরে আছে অনাবশ্যক বিভাগ। এইখানে যতকিছু নেশার সরঞ্জাম। কাব্য, গান এবং ছবি।’ (১৪ জুন, ১৯৩১) অনেকটা একই সূত্র ধরে…
-
অনন্য রাবেয়া খাতুন
আশফাক খান রাবেয়া খাতুন – শক্তিশালী ও সাহসী কথাসাহিত্যিক, শুধু এ-পরিচয়ই যথেষ্ট তাঁর জন্য, আর কোনো বিশেষণের বিশেষ প্রয়োজন নেই। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও তৎপরবর্তী দশকসমূহে বাংলা সাহিত্যকে পরম নিষ্ঠা ও সাধনায় যাঁরা সমৃদ্ধ করে তুলেছেন তাঁদের অন্যতম তিনি। লিখেছেন দু-হাত খুলে – উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথা – সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় রয়েছে…
-
মকবুলা মনজুরের জীবনকালের মন্দিরা
মকবুলা মনজুর (১৯৩৮-২০২০) আমাদের কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক। শক্তিশালী লেখক হয়েও তিনি এ-সময়ে তেমন পাদপ্রদীপের আলোয় আসেননি। কোনোদিন প্রচারও চাননি। প্রচারবিমুখ এ-লেখক গল্প-উপন্যাস মিলে একটা সময়ধারায় নিছক কম লেখেননি। তাঁর লেখালেখির কিছু উদাহরণ : আর এক জীবন (১৯৬৮), জলরং ছবি (১৯৮৪), অবসন্ন গান (১৯৮২), বৈশাখে শীর্ণ নদী (১৯৮৩), আত্মজ ও আমরা (১৯৮৮), অচেনা নক্ষত্র (১৯৯০), পতিতা…
-
মাটি হারে না!
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমার শ্রদ্ধেয় কবি অসীম সাহা বাংলা একাডেমির পাশেই একটা কলোনিতে সাবলেট নিয়ে থাকতেন। আজ চাকরি আছে তো কাল নেই। আমরা দুয়েকজন, আরশাদ আজিজ, আমি বা আর কেউ সেই ছোট ঘরে আড্ডা দিতে যাই। অঞ্জনা বউদি ছোট ছোট কাপে চা দেন, সঙ্গে মুড়ি, পেঁয়াজ, মরিচ, তেল দিয়ে মাখা। এ সময়টায় অসীমদা ভীষণ…