নিঃসঙ্গ কলতান

ফেব্রুয়ারির সকালবেলার হালকা শীত শীত ভাবটা গায়ে যেন মখমল কাপড়ের মতো আরামে জড়িয়ে থাকে। ভোরের দিকে মাখনের মতো নরম কাঁথাটা আরো ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। পুরনো শাড়ি দিয়ে হাতে সেলাই করা নরম কাঁথা। মফস্বল শহরগুলোতে এখনো এসব সহজেই পাওয়া যায়। ছোটবেলায় দেখেছি, মা তার পুরনো শাড়িগুলো জমিয়ে, সেগুলো দিয়ে কাঁথা বানাতে দিয়ে দিত। খুলনায় আমাদের বাড়ির পাশেই থাকতো আমার খেলার সাথি সুভদ্রার মা, যাকে রমা পিসি বলে ডাকতাম। চারটে পুরনো শাড়ি জমলেই তার তলব পড়তো। সে এসে শাড়িগুলো নিয়ে যেতো কাঁথা বসিয়ে দেওয়ার জন্যে। মায়ের সুন্দর সুন্দর একটু পুরনো সুতি শাড়িগুলো দিয়ে কী সুন্দর করেই না রমা পিসি ছোট ছোট ফোঁড়ে নানান সুতো দিয়ে, কয়েকদিনের মধ্যেই এক-একটা কাঁথা বানিয়ে ফেলতো। বিনিময়ে মা তাকে টাকা দিয়ে দিত। কাঁথা দেখতে খুব সুন্দর হলে জুটতো আরো কিছু বখশিশ।

মা আর পিসি মাঝে মাঝে একসঙ্গে বসে পান চিবুতে চিবুতে বন্ধুর মতো গল্প করতো, মাকে বলতে শুনতাম, ‘কাঁথা সেলাই করে তবুও তো কিছু রোজগারপাতি হচ্ছে রে রমা, সংসারে কিছু টাকা-পয়সা দিতে পারছিস! না হলে কী যে হতো! অসীমটার তো আর কোনো হুঁশ হলো না!’

অসীম মানে সুভদ্রার বাবা, যাকে নিয়ে ওদের বাসায় খুব ঝগড়াঝাটি হতো। ছোট ছিলাম, বেশি কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝতাম যে, ওদের বাড়িতে খুব ঝামেলা আছে। প্রায়ই রাতে সুভদ্রার বাবা বাড়ি ফিরে খুব চিৎকার-চেঁচামেচি­ করতো, জিনিসপত্র ভাঙতো; ওদের বাড়ির সেসব শব্দ আমাদের বাড়ি থেকেও শোনা যেত। বাবাকে খুব বিরক্ত হয়ে বলতে শুনতাম, ‘ওদের এসব কী শেষ হবে না নাকি? এ কী অসভ্যতা রাতবিরেতে! একদিন আচ্ছামতো একটু শিক্ষা দিয়ে দিতে হবে ব্যাটাকে।’ মা চাপা গলায় কী যেন বলতো বাবাকে, আমি আর সেসব শুনতে পেতাম না, বন্ধুর জন্য মন খারাপের এক অনুভূতি নিয়ে তলিয়ে যেতাম ঘুমের রাজ্যে।

একদিন হঠাৎ করেই বাক্স-পেঁটরা গুছিয়ে সুভদ্রারা কোথায় যেন চলে গেল! খেলার সাথি চলে যাওয়ার সেই দুঃখ ভুলতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। মা কাঁথা সেলাইয়ের জন্যে অন্য লোক খুঁজে পেলেও মাঝে মাঝেই ‘রমার মতো সেলাইয়ের হাত আর কারো নয়’ বলে খুব দুঃখ করতো।

মায়ের নেশা ছিল এই সেলাই করা কাঁথা জমানো। দুই ট্রাঙ্কভর্তি কাঁথা ছিল সংগ্রহে। মা বলতো, ‘তোদের বিয়ে হলে সবাইকে ভাগ করে দিয়ে দেবো।’ সত্যি সত্যি বিয়ের পরে ভাইবোনেরা বেশ কয়েকটা করে এসব কাঁথার মালিক হয়েছি। একেকজনের বাচ্চা হলেই তার জন্যে একটা-দুটো করে কাঁথা বরাদ্দ হয়ে যেতো। তবে রমা পিসির সেলাই করা কাঁথাগুলো আমার ও মায়ের কাছে খুব বিশেষ কিছু একটা হয়েই আছে সবসময়।

এই অফিসের গেস্টরুমে এমন হাতে-বানানো কাঁথা পাবো তা ভাবিনি। নরম কাঁথার ওমে ছেলেবেলার মতো আরামে এমন বুঁদ হয়ে আছি যে, বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছাই করছে না। ইদানীং মনে হয়, যতই বয়স বাড়ছে ততই যেন ছেলেবেলা যখন-তখন সামনে এসে উঁকি দিয়ে টুকি খেলে যাচ্ছে।

গতকাল আমরা অনেক রাতে এসে পৌঁছেছি এখানে। রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হওয়াতেই এই দেরি, না হলে বিকালের মধ্যেই এখানে পৌঁছে যেতাম। সাধারণত আমি ঢাকা থেকে এমনভাবে ফিল্ড ভিজিটের প্ল্যান করে বের হই যেন সন্ধ্যার মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে, সন্ধ্যার মৃদু আলোয় শহরের অলিতে-গলিতে ঘণ্টাখানেক রিকশায় করে বা হেঁটে ঘুরে বেড়াতে পারি। যে-কদিন ফিল্ড ভিজিটে থাকি, দিনের বেলা শহরের আশেপাশে বা গ্রামের দিকে কাজ শেষ করে এসে, সন্ধ্যার পর শহরে একটু ঘুরে ঘুরে জায়গাগুলো আর এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা অনুভব করার চেষ্টা করি। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর রাজধানী শহরের যাবতীয় ক্লেদ থেকে বের হয়ে মফস্বল শহরগুলোর এখনো টিকে থাকা শ্লথ জীবনের স্বাদ পেতে ভারি ভালো লাগে আমার। রাজধানী শহরে থাকার একঘেয়ে ক্লান্তিকর জীবনের বাইরে অফিসের এই ট্যুরগুলো যেন আমার জন্যে তীব্র খরায় এক ফোঁটা বৃষ্টি।

একটু পরেই উঠে কাজে যেতে হবে, যে-কারণে এখানে এসেছি; কিন্তু এমন আরামের ঘুম ছেড়ে যে উঠতেই পারছি না। ভোর হতে না হতেই বিচিত্র সব পাখির ডাকাডাকিতে ঘুম হালকা হয়ে গেছে। কতদিন পর যে সকালের শান্ত ভাবটা গায়ে মেখে নিচ্ছি! ঢাকায় থাকলে সকাল থেকেই রিকশা, গাড়ির প্যাঁ-পুঁ আর ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক – ‘এই বড় মাছ’; ‘তরকারি তরকারি’ … শুনতে শুনতে কানের পোকা নড়ে যায়! পণ্য বিক্রির তালে বাজার এখন আর তার নির্দিষ্ট জায়গায় নেই, পারলে মানুষের ঘরেই উঠে আসে।

বিছানায় শুয়েই জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই, এখনো একটু একটু কুয়াশা পড়ছে এখানে, যদিও শীত যায় যায় করছে আর গাছে নতুন পাতারাও উঁকি দেওয়া শুরু করেছে। বসন্ত তার আবীর ছড়ানো শুরু করেছে বাতাসে, প্রকৃতিতে এ এক মোহময় সময়। গাছগুলোর পুরনো পাতারা ধুলায় ধূসরিত, যেন বৃষ্টির জন্য গভীরভাবে অপেক্ষমাণ।

বিমানের প্রপেলর ঘোরানোর মতো করে পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে কয়েকটা খয়েরি শালিক মাঠের মধ্যে থেকে গাছের দিকে উড়ে গেল। আবার কেউ কেউ ল্যান্ড করার মতো করে নেমে এলো। বিমানের ওঠানামার সঙ্গে কি অদ্ভুত মিল! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি সেদিকে খানিকক্ষণ। পাখিদের দেখেই না মানুষের উড়ে বেড়ানোর এতো শখ হয়েছে আর তা থেকেই বিমান চালানোর যত কায়দাকানুন বের করে মানুষ সারা দুনিয়া পাখির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে! নিজের কোনো পাখা ছাড়াই মানুষ পক্ষীজীবনের স্বাদ পেয়েছে – ভাবতে ভাবতে সোহেলী আপার দিকে চোখ পড়ে, বেচারী মরার মতো ঘুমোচ্ছে। সারাদিন ঘরে-বাইরে দৌড়ের ওপরে থাকে, একটু সুযোগ পেলেই ঘুম। কাল গাড়িতে আসতে আসতেও যে কত ঘুমালো। আমি আবার গাড়িতে ঘুমাতেই পারি না … পথেঘাটে যা কিছু দেখা যায় সব দেখতে থাকি হাভাতের মতো, যেন একটু চোখ বুজলেই সিন্ডারেলার জাদুর রাতের মতো সব হারিয়ে ফেলবো।

এবারে অফিসের জরুরি কাজে মাত্র দুদিনের ঝটিকা সফরে এসেছি সোহেলী আপাকে সঙ্গে নিয়ে। বয়সে আমি তার একটু ছোটই হই, সেজন্যে ‘আপা’ ডাকি; কিন্তু তার থেকে অফিসের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী একটু ওপরের পজিশনে কাজ করি বলে সে আমাকে ‘দিদি’ বলেই ডাকে।

আমি দাতা সংস্থার প্রতিনিধি হয়ে হেড অফিস থেকে অফিসের গাড়িতে মাসে-দুমাসে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রকল্প পরিদর্শনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাই, যেগুলো সোহেলী আপার মতো কয়েকজন মাঠপর্যায়ের সমন্বয়কারীর আওতাধীন।

সোহেলী আপার এতো আরাম নেই জীবনে। কখনো লোকাল বাসে বা কখনো মোটরসাইকেলে করে তাকে নিত্যই মাঠে দৌড়াতে হয়। পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব বয়সে মোটরসাইকেলে করে দূর-দূরান্তে মাঠ পরিদর্শনে যেতে তার খুব কষ্ট হয়; কিন্তু এনজিও অফিসে তার পজিশনের মানুষদের, যাদের মাঠে-ঘাটেই সবসময় কাজ, তাদের  মোটরসাইকেল ছাড়া উপায় নেই। মোটরসাইকেল না চালানোর জন্য আমাদের সুপারভাইজার, যাকে তার নানাবিধ বিতর্কিত কাজের জন্যে আমরা আড়ালে ‘খচ্চর’ বলে ডাকি, সেই জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক টক্কর লেগেই থাকে। সোহেলী আপার চাকরির শর্ত অনুযায়ী মোটরসাইকেলে করে প্রকল্প পরিদর্শনের কথা বলা থাকলেও সে প্রায়ই সেটাতে তার অনিচ্ছা প্রকাশ করে বাসে যাওয়ার সুবিধা দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করে আর সেটা নিয়েই চলে জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে তার দড়ি-টানাটানি। জাহিদ ভাই বাজেট ও প্রকল্পের খরচ বাঁচানোর দোহাই দিয়ে বাসভাড়া মঞ্জুর করতে চায় না, যদিও সেসব টাকা আরো কত দিকে যে কতভাবে লোপাট হয় সে-খবর কে আর রাখে! শুধু সোহেলী আপার কষ্টটাই কমে না।

আলসেমি ঝেড়ে উঠে পড়লাম বিছানা ছেড়ে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজের জায়গায় পৌঁছাতে হবে। সোহেলী আপাকে ডাকি না, আরেকটু ঘুমাক। আমি যাবো দেখতে আর সে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে দেখাতে, তার ডাবল খাটুনি। যেসব জায়গা দেখতে যাবো, সেসব জায়গার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সে প্রয়োজনীয় গোছগাছ আগেই করে রেখেছে। আমি কিছু বিশেষ ধরনের রিপোর্টিংয়ের প্রয়োজনে এসেছি। বিদেশি দাতাদের তহবিল সংগ্রহের জন্য প্রকল্পের সাফল্যের বিশেষ কিছু কেস স্টাডি করতে হবে। আমার সেই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হয়েছে তাকে। সোহেলী আপা হেড অফিসে আমার সঙ্গেই বসে; কিন্তু আমাদের মতো অধিকাংশ সময় এসি রুমের চেয়ারে বসে অফিস করার ভাগ্য তার নয়, রোদ, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তাকে প্রকল্পের কাজ দেখতে মাঠে-ঘাটে ছুটতে হয় হররোজ। কাজের শেয়ারিংয়ের কারণে অফিসে আমরা কাছাকাছি জায়গায় বসি বলে তার দৈনন্দিন দৌড়ঝাঁপের সাক্ষী আমি, তাই যখনই তাকে একটু আরাম করতে দেখি, ভাবি, আহা! থাক, বেচারী একটু বিশ্রাম নিক।

গোসল সেরে তৈরি হয়ে ঘরে ঢুকতেই সোহেলী আপা চোখ খুললো, আর খুলতেই আমার রেডি হওয়া দেখে ধড়মড় করে উঠে বললো, ‘ইস্স্! কেতকীদি, আমার ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেল।’

খেয়াল করেছি, সবসময় সবকিছুতেই সে সন্ত্রস্ত।

আস্তে করে বললাম, ‘কোনো সমস্যা নেই আপা, আপনি ধীরে-সুস্থে উঠুন, সময় আছে।’

এখানে আমরা আমাদের এক সহযোগী সংস্থার অফিসের গেস্টরুমে উঠেছি। থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা আছে। হেড অফিস থেকে এসেছি বলে অতিরিক্ত খাতিরও পাই। সোহেলী আপা তড়িঘড়ি করে উঠে তৈরি হয়ে নিলে দুজনে মিলে নাস্তা সেরে বের হয়ে ড্রাইভারকে বললাম কোথায় যেতে হবে।

যে-জায়গায় যাচ্ছি সেটা শহর থেকে এক-দেড় ঘণ্টার রাস্তা, বললো ড্রাইভার মনির ভাই। অবশ্য এ-ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা বরাবরই তিক্ত। দূরত্বের ব্যাপারে মানুষের ধারণা খুবই হাস্যকর। ‘দুই কিলো এগোলেই পৌঁছে যাবেন’ শুনে সামনে এগিয়ে কত কত ‘দুই কিলো’ই যে পার হয়ে যেতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। সোহেলী আপা ক্রমাগত ফোনে কথা বলে চলেছে – একবার তার কাজের লোকজনের সঙ্গে, আবার মাঝে মাঝেই তার বাসার কারো সঙ্গে।

গাড়ি খোলা রাস্তায় একশ কিলোমিটার বেগে দৌড়াচ্ছে। ঝড়ের বেগে পেরিয়ে যাচ্ছি মাইলের পর মাইল দিগন্তবিস্তৃত সবুজ-হলুদ শস্যক্ষেত, মাঝে মাঝে তার মধ্যে আছে একটা-দুটো নিঃসঙ্গ তালগাছ। ঢাকার বাইরে যখন আসি এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্য; কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঠ-ঘাট-দিগন্ত আর মাথা-উঁচু-করে দাড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ তালগাছগুলো চোখ দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া।

কবে থেকে যে এভাবে সবকিছু অনিঃশেষ দেখার নেশাখোর হয়েছি আমি কে জানে!

‘আঁকতে হলে তার আগে অনেক অনেক দেখতে হয় রে’, কোন সুদূর থেকে অনিমেষদা’র গলা বেজে ওঠে কানের কাছে। সেই কোন কৈশোরে আমার প্রিয় ছোট্ট শহরে ছবি আঁকা শেখার সেই জায়গাটায় দৌড়ে দৌড়ে যেতাম শিল্পী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে। অনিমেষদা পাতার পর পাতা ছবিভরা বই খুলে দিত চোখের সামনে … ভ্যান গগের ‘তারা ভরা আকাশে’র নীল বেদনা, রেমব্রান্টের আলো-ছায়ার খেলা, পল গগাঁ, মাতিস, সেজান আরো কত কত জগদ্বিখ্যাত শিল্পীর কাজ দেখতে দেখতে চোখে ঘোর লেগে যেত। শিল্পী হওয়া হয়নি, কিন্তু অনিমেষদা সেই যে দেখতে শেখালো, তারপর থেকে একজোড়া যাযাবর চোখ আমার সবকিছু দেখতেই থাকে ক্লান্তিহীন।

যেতে যেতে সৌম্যের কথা মনে হলো। গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত সে একটাও ফোন করেনি। আশ্চর্য! অবশ্য এ আর নতুন কি! এখনো আমি যে ওর এসব আচরণে আশ্চর্য হই সেটাই বরং আশ্চর্যের। মানুষ কোনো সম্পর্কের ব্যাপারে এতো উদাসীন হয় কীভাবে! এতো উদাসীন থাকতে চাইলে এই মানুষগুলো সম্পর্কে কেনইবা জড়ায় আর কেনইবা সংসার করতে ঢোকে! বন্ধুত্ব দিয়ে যে-ভালোবাসার পথে একসঙ্গে চলা শুরু, উদাসীনতা আর শুধু নিজের জীবনের স্বার্থপর হিসাব-নিকাশে সেই ভালোবাসা কফিনবন্দি হয়ে পড়ে। সারাক্ষণ কাজ আর ব্যস্ততার অজুহাত; কিন্তু নিজের অবারিত আড্ডার বেলায় নিযুত কোটি সময় বরাদ্দ। বন্ধু হয়ে থাকতে না পারলে একসঙ্গে জীবন কাটানোর এই যাত্রায় শামিল হওয়ার কোনো অর্থ আর থাকে না, দুজনের জন্যই বড্ড ক্লান্তিকর সে-যাত্রা। অনেক বছর ধরে এগুলো হজম করতে করতে আমি ক্লান্ত। মাঝে মাঝে মনে মনেই এই সম্পর্কের পোস্টমর্টেম করে ফেলি, বাস্তবে যা হয়ে উঠছে না আমার ছেলে রাহুলের জন্য, মাথার ওপর বাবা-মায়ের একসঙ্গের ছাদটা খুব প্রয়োজন হয় বাচ্চাদের, যদি সে-ছাদে ফাটল থাকে তবুও।

রাস্তায় পার হয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সোহেলী আপার অনবরত কথা আমার কানে আসতে থাকে … ‘কীভাবে পড়ে গেল? আমি সবকিছু রেডি করে দিয়ে আসলাম তারপরেও একটু সামলাতে পারিস না? তোরা কি আমাকে একটু শান্তিতে কাজটাও করতে দিবি না?’

ফোন রাখতেই কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করতে বললো, তার পনেরো বছরের শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলে সকালে চেয়ার থেকে পড়ে গেছে।

সোহেলী আপার দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। অনেকদিন ধরেই দেখছি কীভাবে সে একা দুটো বাচ্চার মধ্যে একটা, এই পনেরো বছরের শরীরের অবোধ শিশুকে নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তার স্বামী যথেষ্ট ভালো চাকরি করলেও সংসারে টাকা খরচ করার ব্যাপারে খুবই গড়িমসি ভদ্রলোকের। স্বামী-স্ত্রী হয়েও দুজনের জীবনের হিসাব-নিকাশ যেন আলাদা অ্যাকাউন্টে রাখা। বিশেষ করে এই বাচ্চাটার ব্যাপারে সোহেলী আপাকে কত যে পেরেশান হতে দেখেছি। কতদিন লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছি বাচ্চার চিকিৎসার ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে। তার স্বামী এই প্রতিবন্ধী বাচ্চাকে উটকো যন্ত্রণা মনে করে, একদম সহ্য করতে পারে না, প্রায়ই বলে, ‘ওকে কোনো একটা জায়গায় ভর্তি করে দাও, যেখানে এসব বাচ্চা থাকে।’ সোহেলী আপা সেটা করতে পারে না – এটাই তার দোষ। ডাক্তার বলেছে, ভালো চিকিৎসা ও যত্ন পেলে বাচ্চাটার উন্নতি হতে পারে – সেই আশায় সে হাল ধরে রয়েছে। বাড়িতে একজন সাহায্যকারী রেখে যথাসাধ্য চিকিৎসার চেষ্টা করে যাচ্ছে বাচ্চাটার জন্যে।

আমরা সহকর্মীরা কখনো কখনো আড়ালে তার এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি। কেউ কেউ এটা বলতেও ছাড়ে না যে, ভদ্রলোকটি নিশ্চয়ই অন্য মেয়েতে মজে আছে, না হলে নিজের সংসার, বাচ্চার প্রতি একটা লোক এমন উদাসীন হয় কেমন করে! সোহেলী আপা দুঃখ করে কত সময় আমাদের কাছে এও বলেছে, ‘আমার চেহারা সবসময় ভালো দেখায় না, যে পরিশ্রমের চাকরি করি তাতে আমার পক্ষে অতো সেজেগুজে পরিপাটি থাকাও সম্ভব হয় না, তার ওপর বাসায় ফিরেই এই বাচ্চাটার ফিজিওথেরাপি করতে হয়, খাওয়া-দাওয়া সব করিয়ে দিতে হয়, নিজের জন্য কোনো সময়ই বের করতে পারি না দিদি।’

আমার তাকে বলতে ইচ্ছা হয়, ‘এই বাচ্চার দেখাশোনার দায়িত্ব তো আপনার একার না, দুজনেরই।’ বলি না, বলে ওনাকে আরো কষ্ট দিতে চাই না। দেখছিই তো, লোকটা দায়িত্ব নিতে চায় না, বরং আমার মনে হয়, বেচারী যেন সবসময় ভয়ে থাকে লোকটা তাদের ফেলে চলে যাবে কি না সেটা ভেবে। তাহলে তো আরো ভয়ংকর হবে, যতটুকু আর্থিক সাপোর্ট পাচ্ছে, সেটাও হয়তো পাবে না তখন। জীবনের ভয়ঙ্কর জোয়াল তখন তাকে হয়তো একাই টানতে হবে, সে  তো আরো কঠিন!

এতো কিছুর মধ্যেও তার জীবনীশক্তি দেখে আমি অবাক হই। একটু একটু করে টাকা জমিয়ে গোপনে গ্রামে জমিও কেনে। ‘দিদি সবসময় যে চাকরি করতে পারবো তা তো না, প্রাইভেট চাকরি, এই আছে তো এই নেই, নিজের এটুকু ভবিষ্যৎ চিন্তা তো করতেই হয়, পথে যেন না বসতে হয় তাই নিজের এতোটুকু শখ-আহ্লাদের দিকে না তাকিয়ে এটুকু জমিজমা করে রাখছি।’ স্বামীকে এসব বলে না; কিন্তু আমরা তার এসব খবর জানি, কারণ এসব সময়ে সে প্রায়ই আমাদের কারো কাছ থেকে টাকা ধার করে আবার অনেকদিন লাগিয়ে সেই টাকা শোধও দেয়। কখনো ধার চাওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেলে আমরা একটু বিরক্ত যে হই না তাও নয়, তবে ধার না দিয়েও পারি না। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই যুদ্ধ আছে; কিন্তু তার জীবনের অবিরত যুদ্ধে আমরাও যেন ক্লান্ত বোধ করি মাঝে মাঝে, সে-কারণেই ভাবি, আমাদের সামান্য সহযোগিতা যদি তার যুদ্ধ একটু কমাতে পারে, ক্ষতি কী!

সোহেলী আপার কথা ভাবতে ভাবতে মনে হয়, আমার জীবনই বা কী এমন তার থেকে আলাদা! ভালো থাকার ভান করি শুধু ওপরে ওপরে। সোহেলী আপা যেভাবে তার জীবনের না-পাওয়ার গল্পগুলো বলে যায় আমি সেভাবে বলতে পারি না। আমি কাউকে বলতে পারি না আমার জন্যও কখনোই আমার স্বামীর কোনো শখ, আহ্লাদ, দায়িত্ববোধ, শেয়ারিং, কেয়ারিং কিছুই নেই। আমাদের জীবনে বিশেষ কোনো দিন নেই, কত বিয়েবার্ষিকী কেটে গেছে একা চোখের জলে ভেসে, তার মনেও থাকেনি, একতোড়া ফুলও আসেনি হাতে।

জীবনে কতবার এমন ঘটেছে, বাসা থেকে বের হওয়ার দুদিন পরেও সৌম্যের কাছ থেকে একটা ফোন আসেনি, কোথায় আছি, একবারের জন্য খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেনি। সে তার চাকরি এবং নাটকের দল নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে, যেখানে আমি একেবারেই বহিরাগত। নাটকের লোকজন জানে, সৌম্যের স্ত্রী এসব একদম পছন্দ করে না, তাদের সে তেমনই ধারণা দিয়ে রেখেছে। অথচ বিয়ের আগে দুজনেরই নিয়মিত নাটক দেখার অভ্যাস ছিল। বেইলি রোডে নতুন কোনো নাটক নামলেই দুজনে সময় করে ঠিক চলে যেতাম। বিয়ের পর আমার সেই জীবনের কবর হয়ে গেছে – আমার কাজ শুধু চাকরি করে টাকা কামানো, সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিপুণভাবে সংসার সামলানো আর সৌম্যকে আরামে রাখা, যেন সে চাকরি আর নাটকের জীবন – দুটোই সমানতালে নির্বিঘ্নে চালাতে পারে। মাঝে মাঝে ভাবি, একটা সই, একটা স্বাক্ষর, এতো পার্থক্য গড়ে দেয় জীবনে? সম্পর্কের যত্ন না নিলে ভালোবাসা একসময় শুকিয়ে গিয়ে ধূসর হয়ে যায়, তার থেকে আর কোনো সুঘ্রাণ ছড়ায় না। অধিকাংশ মানুষই মনে হয় সমাজ ও বাস্তবতার চাপে জীবনভর এই সুগন্ধহীন সম্পর্ক টেনে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ইদানীং মনে হচ্ছে, আমি বেশি ছাড় দিয়ে যাচ্ছি, এতোটা দরকার নেই। যে-মানুষের কাছে আমার গুরুত্ব জীবনের দ্বিতীয় অপশন হিসেবে, কেনই-বা জোর করে তার জীবনে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বানাতে হবে! সম্পর্ক তো একটা সমান সমান ব্যাপার। বরং তার জীবনের গুরুত্ব যেখানে বেশি, সে সেটা নিয়েই থাকুক, আমি শুধু সরে যাই তার জীবন থেকে, তাহলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়; কিন্তু সমাধানটা আসলে এতো সহজ নয়।

পনেরো বছরের সংসারজীবনে অনেকবারই ডিভোর্সের কথা ভেবেছি; কিন্তু সেটা  তো মনে হয় জীবনের আরো বড় ঝামেলা। একা একা জীবন কাটানো সহজ কথা নয়। নতুন করে কোনো সম্পর্কে জড়ানো তো আরো অনিশ্চিত। মনে হয়, সবকিছুরই ‘সঠিক সময়’ বলে একটা ব্যাপার থাকে। একসময় যত সহজে কাউকে পছন্দ হয়, পরে সেটাই কত কঠিন হয়ে যায়, হাজারো হিসাব-নিকাশ চলে আসে তখন। যতবার সৌম্যকে জীবন থেকে বহিষ্কার করার কথা ভেবেছি ততবারই আমার সত্তরোর্ধ্ব মায়ের কথা মনে হয়েছে, এই বয়সে মেয়ের বিবাহবিচ্ছেদ কীভাবে সহ্য করবে! ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজনের বিস্মিত চেহারাও মনের ভেতর উঁকি দিয়ে যায়, যারা জানে যে, আমরা কত সুখী দম্পতি। কী নিপুণভাবেই না আমরা সামাজিক অভিনয় চালিয়ে যাই! আমার এগারো বছরের ছেলের কথা মনে হয়, যে তার বাবার আদরের, মা-বাবার সমস্যা পরিষ্কার করে বোঝার মতো বয়স হয়নি। আমার জীবনের জন্য নেওয়া যে-কোনো সিদ্ধান্ত তার জীবনকে প্রভাবিত করবে, তাকে এক অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি ঠেলে দেবে। আমার বন্ধু ইরানীর ডিভোর্সের পর দুই বাচ্চাকে নিয়ে বাবা-মায়ের আইনি লড়াইয়ে বাচ্চাদের নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে গিয়েছিল – সে-কথাও ভুলতে পারি না।

আবার এটাও ভাবি, এসব ভাবনা মনের অজান্তেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্যে আমার এক-একটা অজুহাত কি না। দিন শেষে আমি আসলে এ‌ই সম্পর্ক টিকিয়েই রাখতে চাই, কারণ আমি এতে অভ্যস্ত! পরিবারতন্ত্রের মধ্যে আমাদের মগজ এমনভাবে প্রোথিত যে এর মধ্যে কখনো কখনো আমরা চরম অসহায় বোধ করলেও এর বাইরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারি না।

কখনো মনে হয়, হয়তো ভালোবাসা এখনো একটু অবশিষ্ট আছে, পনেরোটা বছর ধরে নিজের জীবনের যত লগ্নি, সবই তো এই সংসারে … কীভাবে ঝেড়ে ফেলি সবকিছু এক নিমেষে! আবার সব নতুন করে গড়া, সেটা তো আরো ক্লান্তিকর! একজন ডিভোর্সি মেয়ের সামাজিক বাস্তবতা কত কঠিন হতে পারে সেও তো জানি! অন্য পুরুষদের অযাচিত উপদ্রব, নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার ভয়, এসব কিছু বাদ দিলেও একটা বাচ্চার সব দায়িত্ব একা শেয়ার করার শারীরিক আর মানসিক কষ্টই সবচেয়ে কঠিন। এসব ভাবলে আমি যে তিমিরে আছি সেই তিমিরেই পড়ে থাকি। সেই বাড়ি ফিরে রান্না করি, খাওয়ার টেবিলে খাবার সাজাই, শোয়ার বিছানা প্রস্তুত করি, যে-বিছানায় দিনের পর দিন দুজনে জিন্দা লাশ হয়ে দুপাশ ফিরে শুয়ে থাকি।

কাজের জায়গায় পৌঁছে গোটা দিনটাই কেটে গেল খুব ব্যস্ততার মধ্যে। কাজ করতে করতে কয়েকবারই সোহেলী আপার দিকে তাকিয়ে খেয়াল করি, মুখে রাজ্যের অমাবস্যা নিয়ে সে তার কাজ করে চলেছে। নিজের জীবনের নিযুত সমস্যা একপাশে সরিয়ে রেখে গ্রামের কিশোরী মেয়েদের বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, সামাজিক নানা কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব পালন করে চলেছে আমাদের এই প্রকল্পের মাধ্যমে। একটার পর একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলি আর তাদের জীবনের নানা সংগ্রাম আর সেসবের সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ আমাকে ভাবায়। ওদের সঙ্গে নিজের জীবন মিলিয়ে দেখি, খুব বেশি কোনো পার্থক্য করতে পারি না।

কাজ শেষ হতে হতে সন্ধ্যা নামলো। সব গুছিয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠি। সোহেলী আপার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করতেও ভয় হয়। কাজের ফাঁকে বারবার ফোনে কথা বলতে দেখেছি, না জানি কী হয়েছে তার বাসায়! অন্ধকার চিরে গাড়ি ছুটে চলেছে উল্কার বেগে। আমাদের দুজনের হাবুডুবু খাওয়া জীবনও যেন অনির্দিষ্ট কোনো পথের দিকে দৌড়ে চলেছে, যার ওপর আমাদের কোনো হাত নেই।

ফেরার পথে সোহেলী আপাকে তার বাসায় নামিয়ে দিই। সে ইতস্তত করে বলে, ‘দিদি নামেন একটু আমার বাসায়।’ আমি তার বিড়ম্বনা আর বাড়াতে চাই না, কাঁধে হাত রেখে বলি, ‘আরেকদিন হবে আপা, কাল সকালেই তো অফিসে দেখা হচ্ছে, আজকের কাজগুলো নিয়ে কালকে বসবো, কেমন?’ গাড়ি আমার বাসার দিকে এগিয়ে যায়, যাওয়ার পথে আমার ছেলেকে আবার তুলতে হবে মায়ের বাসা থেকে। এ-কাজটুকু অন্তত সৌম্য আজ করতে পারতো। একটু আগে ওর মেসেজ এলো আমার ফোনে, ‘বাসায় ফিরতে রাত হবে, নাটকের রিহার্সাল চলবে অনেক রাত পর্যন্ত।’

আমার মাথার মধ্যে একটার পর একটা কেস স্টাডি সাজানোর প্রস্তুতি চলে … রমা পিসি, সোহেলী আপা, অদম্য কিশোরী মেয়েগুলো … আমি! মাথার মধ্যে সব একাকার হয়ে ঘুরতে থাকে। কাল সকালেই অফিসে গিয়ে সব কেস স্টাডি জরুরি ভিত্তিতে তৈরি করে পাঠাতে হবে হেড অফিসে! সেখানে গল্পগুলি আরো মর্মস্পর্শী করে তুলে ধরা হবে বিভিন্ন জায়গায়, আরো বেশি বেশি তহবিল জোগাড়ের লক্ষ্যে।