একটি লাল ফড়িংয়ের গল্প

এক

পুবের আমগাছের ছায়াটা গুটিগুটি পায়ে যেন সেতু মিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে। ছায়াটা ঠিক নিরেট ছায়া নয়, রোদের খানিকটা লুকোচুরি আছে ছায়ার ভেতর।

কিন্তু সেতু মিয়ার প্রয়োজন নির্ভেজাল রোদ। সে নির্ভেজাল রোদের জন্য এরই মধ্যে তিনবার জায়গা বদল করেছে। পিঁড়ি পেতে সে প্রথমে বসেছিল ঘরের দাওয়ায়। রোদটা সেখান থেকে সরে যেতেই সে গিয়ে পুবের খোলা জায়গাটায় বসে। এখন রোদটা সেখান থেকেও সরে যাওয়াতে সে এবার হেঁসেলের পাশে তার মা আমেনা বেগমের কাছাকাছি এসে বসেছে।

উনুনে অবশ্য আগুন জ্বলছে না। খোলা হেঁসেলে বসে আমেনা বেগম হাঁটু ভেঙে ডান পায়ে বঁটিদা চেপে কচুর লতি কাটছে। সিঁদল শুঁটকি দিয়ে সে কচুর লতি রান্না করবে। গতকাল লাল কাজীর বড় বউয়ের কাছ থেকে চারটা বড় লাল মুলো চেয়ে এনেছে। কচুর লতি কাটা শেষ হলে সে মুলোগুলো ফালি ফালি করে কাটবে। ঘরের ভেতর মটকায় জিয়ল টাকি মাছ রেখেছিল। ওখান থেকে চারটা টাকি মাছ তুলে একটা মাটির সানকিতে এনে রেখেছে। জেতা টাকি মাছগুলো এখন গায়ে গা লেগে চুপচাপ পড়ে থেকে কানকো ফোলাচ্ছে।

আমেনা বেগম ঝোল ঝোল করে টাকি মাছ দিয়ে মুলো রান্না করবে। সেতু টাকি মাছ দিয়ে মুলোর ঝোল খুব পছন্দ করে। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পর ছেলে বাড়ি ফিরেছে। ছেলের জন্য একটু ভালোমন্দ রান্না না করলে কী হয়।

চৌদ্দটা বছর! আমেনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার ছেলে মানুষ খুনের আসামি ছিল। কোনো কারণ ছাড়া খুন। ছেলের মাথায় হালকা-পাতলা ছিট আছে, ওটা সবাই জানত। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়া একজন মানুষ খুন করার মতো পাগল তো সে ছিল না? তবে ভাগ্যটা ভালো যে, কাসেম কাজী সেতুর জন্য বড় উকিল ধরেছিলেন। নয়তো জজসাহেব তার ছেলের চৌদ্দ বছরের জেল না দিয়ে ফাঁসির আদেশই দিতেন।

আমেনা বেগম খচখচ করে কচুর লতি কাটতে কাটতে চোখ তুলে ছেলের দিকে তাকাল। তাকানো মাত্রই তার দৃষ্টিটা কী ভেবে ওঠানামা করল। একটা রহস্যও তৎক্ষণাৎ তার মনে এসে ভিড় করল। কাসেম কাজী এখন আর বেঁচে নেই। বছর দুই আগে শরীরে পানি উঠে মারা গেছেন। বয়স হয়েছিল, এছাড়া শরীরে নানা রোগ ভিড় করেছিল। কিন্তু কাসেম কাজীর চেহারার সঙ্গে তার ছেলে সেতু মিয়ার চেহারার কী মিল! শরীরের গড়নটায়ও কেমন মিল আছে।

আমেনা বেগম মাথা ঝাঁকাল। ভাবল, মিল তো হবেই। তার যখন যৌবন। সেই তিন যুগ আগের কথা। তার স্বামী জব্বার মিয়া নৌকায় করে ধানের বাজার ধরতে গিয়ে রামচন্দ্রপুর হয়ে ভৈরব-নারায়ণগঞ্জ যেত। বছরের ছয় মাসই থাকত বাড়ির বাইরে। এদিকে বাড়িটা একেবারে খালি পড়ে থাকত। তখন কাসেম কাজী কী দয়ার শরীর নিয়েই না এগিয়ে আসতেন! সম্মানী লোক, দুই-চার-দশ গ্রামে কাজীবাড়ির কত নামডাক। বাড়িতে এলে সে কখনো না করতে পারত না।

দুই

ছায়াটা সেতু মিয়ার শরীর বেয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ করেই ধূসর হলো। কিন্তু তার নিজস্ব ছায়াটা এবার পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে হেলে পড়ে বেশ স্পষ্ট জানান দিলো।

সূর্যটা এখন আমগাছটার মাথা চেপে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে। রোদের কাঁচা-হলুদ রং উঠোনের সর্বত্র। উঠোনের শরীরে অবশ্য পীতসবুজ রঙের শ্যাওলাপড়া। স্থানে স্থানে শ্যাওলার আস্তর শুকিয়ে কুকুরের জিভ বের করার মতো উঠে এসেছে। চৌদ্দটা বছর সেতু মিয়া শীতের সকালের এরকম কাঁচা-হলুদ রঙের রোদ দেখেনি।

সেতু মিয়া দৃষ্টি তুলে সমস্ত উঠোন ও উঠোনের উত্তরের বিস্তৃত বাঁশঝাড়ের দিকে তাকাল। এলোমেলো বাঁশ। বাঁশের অনেক নতুন কড়ুল। খয়েরি রঙের অসংখ্য বাঁশপাতা ঝাড়ের নিচে এদিক-ওদিক বিছিয়ে আছে। উত্তুরে হিমহিম বাতাস বইছে। বাঁশঝাড়ে শন শন শব্দ তোলে।

বাঁশঝাড়ের ঠিক নিচেই একটা ছাইয়ের টাল। একটা ভাঙা কুলো ছাইয়ের টালের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ছাইয়ের টালের পাশ দিয়েই একটা সরু দিঘল পথ কাজীবাড়ির দিকে চলে গেছে। লাল কাজীর ইশা দিয়ে বিস্তৃত কাজীবাড়ির শুরু।

অনুতপুর গ্রামের উত্তরপাড়া ও পুবপাড়া নিয়ে কাজীবাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। কাজীবাড়ির অতিশিক্ষিত মানুষগুলো যদি শহরমুখো না হতো, তাহলে ওদের বাড়ির বসতি শুধু উত্তর-পূর্ব পাড়াই নয়, পুরো অনুতপুর ছেড়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত গিয়ে ঠেকত।

বাঁশঝাড়ের পর কাজীবাড়ি থেকে নিচু-গৃহস্থ ঘরগুলোকে ভাগ করার জন্য একটা মাঝারি খাল ছিল। খালটার নাম বুইদ্দার খাল। গোমতি নদী থেকে নেমে আসা বুইদ্দার খালে একসময় নৌকা চলত। ধান-পাট বোঝাই নৌকা, মাছ ধরার নৌকা আর নাইওরির নৌকাসহ কত নৌকা। সেই বুইদ্দার খাল শুকিয়ে গেছে সেই কবে, সেতু মিয়া জেলে যাওয়ার আগেই। চৌদ্দ বছর পর জেল থেকে ফিরে এসে খালটার কোনো অস্তিত্বই সে খুঁজে পায়নি।

তবে সেতু মিয়া কাজীবাড়ি ও নিচু-গৃহস্থ ঘরের মধ্যে উঁচু-নিচুর খাদ ভরাটের পাঁয়তারা গতকাল গ্রামে ফিরেই দেখেছে। আগে কাজীবাড়িতেই শুধু দুই-একটা ইটপাথরের দালান ছিল। এখন অনুতপুর ও আবদুল্লাহপুরের প্রতিটা পাড়াতেই দুই-চারটা করে দালান উঠেছে। গ্রামের নিচুঘরের মানুষগুলো এখন শুধু মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর বা মধ্যপ্রাচ্যেই চাকরি করে তা নয়, কেউ কেউ আবার ইউরোপ-আমেরিকাতেও গেছে।

সেতু মিয়া এবার রোদের দিকে পিঠ দিলো। সে বসে আছে একটা জলচৌকির ওপর। তার গায়ে ফুলহাতা শার্ট। শার্টের ওপর একটা ভারি সোয়েটার। কিন্তু রোদে বসে থেকেও তার শীতবোধটা যাচ্ছে না। পৌষ মাসের উত্তুরের হিমহিম বাতাসটা যেন একটু বেশিই বইছে। তার দৃষ্টিটা আবার ওঠানামা করল। আঁখি রঙের একটা মুরগি রোদ ধরে হাঁটছে। সঙ্গে ছয়টা ছানা। মুরগিটা আধার খুঁজছে আর মাথা এদিক-ওদিক করে ডাকছে – কিক কিক, কিক কিক। ছানাগুলো মা-মুরগির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডাকছে – চিঁ চিঁ, চিঁই চিঁই।

সেতু মিয়া এবার তার মায়ের ওপর স্থির দৃষ্টি ফেলল। এই শীতের সকালেও তার মায়ের সাদা শাড়িটাই সম্বল। শাড়ির সাদা গায়ে ময়লা ও কষের অসংখ্য দাগ। তার মা এখন ছাই দিয়ে চেপে ধরে বঁটিতে টাকি মাছগুলো কাটার চেষ্টা করছে। কিন্তু জ্যান্ত টাকি মাছ তার হাত থেকে পিছলে গিয়ে ছটফট করতে করতে দা’টার কাছেই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ছে। মায়ের বয়সী হাত।

সেতু মিয়া ভাবল, তার মা কতকাল আগে বিধবা হয়েছে? – দুই-আড়াই যুগ তো হবেই। তার বাবা জব্বার মিয়া নৌকায় করে রামচন্দ্রপুর, ভৈরব বা নারায়ণগঞ্জ গিয়ে ধান-চালের ব্যবসা করত। বাড়িতে টাকা-পয়সার বেশ পসারই ছিল। কয়েক বিঘা জমিও কিনেছিল। কিন্তু একবার ভৈরব যাওয়ার পথে ডাকাতের কবলে পড়ে বাবা মারা যায়। নৌকার মাঝি কোনোমতে সাঁতরে বেঁচে আসতে পারলেও জব্বার মিয়ার লাশ ও নৌকাটার অস্তিত্ব কেউ খুঁজে পায়নি।

সেতু মিয়ার তার বাবার চেহারা যে খুব মনে আছে, তা নয়। কিন্তু বুঝ হওয়ার পর থেকে সে তার মাকে শুধু বিধবার শাড়ি পরে থাকতেই দেখেছে।

তিন

কাজীবাড়ির বড়পুকুরটার পশ্চিমপাড়ে এখন আর বিস্তৃত মোড়তার জংলা নেই। পাড়ের খানিকটা অংশ নিয়ে একটা বাঁশঝাড়ও ছিল। আর ছিল একটা কাঁচামিঠা আমগাছ। ইলোরা কখনো কাঁচামিঠা আম খেতে চাইলে সেতু মিয়া লাফিয়ে গাছে উঠে মগডাল থেকে সবচেয়ে বড় আমটা পেড়ে আনত।

কাঁচামিঠা আমগাছটা এখনো আছে। তবে বাঁশঝাড় ও মোড়তার জংলা পুরোপুরি উধাও। বুইদ্দার খালটা ভরাট করাতে পুকুরের পশ্চিমপাড়টা বেশ প্রশস্ত হয়েছে।

সেতু মিয়া কাঁচামিঠা আমগাছটার নিচে দাঁড়াল। এখন মধ্যদুপুর। শীতের উত্তুরে বাতাসটা এই ভরদুপুরেও গায়ে এসে বিঁধছে। আকাশ পরিষ্কার নীল। দুপুরের রোদটুকু নরম হয়ে গলে গলে পড়ছে।

সেতু মিয়া দিঘল দৃষ্টি মেলে একপ্রস্থ পুকুরের জল পেরিয়ে পুবপাড়ের কাজীবাড়ির বসতির দিকে তাকাল। কাজীবাড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে সে সমস্ত পুকুরটা দেখল। আগে পুকুরটার পুবপাড়ে মাত্র একটা পাকা ঘাটলা ছিল। কিন্তু এখন পুকুরে পাঁচটা পাকা ঘাটলা হয়েছে। পুবপাড়েই এখন দুটো। মনে হচ্ছে, কাজীবাড়ির লোকজন পাল্লা দিয়ে একেকটা ঘাটলা করেছে। ঘাটলার মতো ওদের প্রতিটা বাড়িতেও বাহারি দালান উঠেছে। কারো বাড়িতে আবার দোতলা দালান।

সুন্দর কাজীর বাড়িতে আগে একটা আটচালা ঘর ছিল। এখন সেখানে একতলা দালান উঠেছে। সবুজ রঙের দালানটা পুকুরের পশ্চিমপাড় থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এমনকি দালানের বারান্দায় দাঁড়ানো মানুষটাকেও। মানুষটা আর কেউ নয়, সুন্দর কাজীর স্ত্রী রাবেয়া খাতুন।

রাবেয়া খাতুনকে দূর থেকে দেখে সেতু মিয়া নড়েচড়ে দাঁড়াল। তার ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। ইলোরার কথা তার মনে পড়ে গেল। সেই ইলোরা। সুন্দর কাজীর মেজো মেয়ে। যাকে সে অদ্ভুত সুন্দর একটা লাল ফড়িং ধরে দিতে চেয়েছিল।

একটা লাল ফড়িং। পুকুরের টলমলে পানির ওপর ফড়িংটা শুধু পাখা মেলে উড়ত আর উড়ত। পাখার অসম্ভব দ্রুত কাঁপুনি। টুপ করে কোথাও বসতে তো পরক্ষণেই আবার উড়তে শুরু করত।

এক সকালে ইলোরা তাকে সেই লাল ফড়িংটা ধরতে বলে। সে উচ্ছ্বাসের গলায় বলে, অ্যাই অ্যাই পাগলা, দেখেছিস, কী সুন্দর ফড়িংটা? লেজটা কী লম্বা, যেন মীনারং করা!

ইলোরা বরাবরই সেতু মিয়াকে ‘পাগলা’ ডাকত। সেতুর মাথায় একটু ছিট ছিল বলে শুধু ইলোরাই নয়, সবাই তাকে পাগলা বলে ডাকত।

তখন দুজনেই সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে। দুজন প্রায় সমবয়সী ছিল। একসঙ্গে মক্তবে যাওয়া, একই ক্লাসে অনুতপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া, তারপর ঘোড়ারশাল স্কুল থেকে একসঙ্গে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া। ইলোরা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বেশ ভালোভাবে পাশ করলেও সেতু মিয়া পারেনি।

ইলোরা পরেত কোম্পানীগঞ্জ কলেজ থেকে আইএ পাশ করে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়। কিন্তু সেতু মিয়া দুই-দুইবার ম্যাট্রিকে ফেল করে লেখাপড়ার ইতি টানে। 

সেদিনের সেই লাল ফড়িং নিয়ে ইলোরার উচ্ছ্বাস দেখে সেতু মিয়াও তাল মিলিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ, ফড়িংটা অনেক সুন্দর। চোখ দুইটা রক্তের মতো লাল।

ইলোরা জিজ্ঞেস করে, পাগলা, তুই কি ফড়িংটা ধরতে পারবি?

সেতু মিয়া বুক চিতিয়ে বলে, কী বলো, এই ফড়িংটা ধরা কী এমন কঠিন? চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই কেমন ধইরা নিয়া আসতাছি।

কিন্তু সেটা ছিল সেতু মিয়ার কথার কথা। সেদিনের সকাল, দুপুর ও বিকেল, এমনকি পরদিন অনেক চেষ্টা করেও সে ফড়িংটা ধরতে পারেনি। তার কত কী চেষ্টা ছিল। পাটখড়ির মাথায় আঠা লাগিয়ে, পানির ভেতর ডুবসাঁতার দিয়ে ও গলাজলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে। তার চেষ্টার শেষ নেই। ইলোরা ফড়িংটা চেয়েছে, আর সে সেটা ধরে দিতে পারবে না! পুরো দুদিনের চেষ্টা বিফলে যাওয়ার পর তৃতীয় দিন সে দেখে ফড়িংটা আর নেই। তার সে কী মন খারাপ হয়েছিল!

চার

আজ হঠাৎ দেওয়ানবাড়ির পুকুরে একটা লাল ফড়িং উড়তে দেখে সেতু মিয়া চমকে উঠল। অথচ জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর গত এক সপ্তাহ ধরে কাজীবাড়ির সেই বড়পুকুরটায় একটাও লাল ফড়িং দেখতে পায়নি। 

কাজীবাড়ির পুকুরটার সঙ্গে দেওয়ানবাড়ির পুকুরটার সাদৃশ্য বেশ। পুকুরটার তিনপাড়ে বসতি। পশ্চিমপাড়ে কীসব গাছগাছালির দীর্ঘ বাগান। আর পুকুরটাতে পাকা ঘাটলাও পাঁচটা। অথচ অনুতপুর কাজীবাড়ি থেকে রতনপুর দেওয়ানবাড়ির দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার।

রতনপুর গ্রামটা উপজেলা লাগোয়া একটা গ্রাম। গোমতি নদীটা যেখানে বাঁক খেয়েছে, এর সামান্য উত্তরে গিয়ে মইজ্যার চকটা পেরোলেই রতনপুর গ্রামের শুরু। উপজেলা ডিগ্রি কলেজের অর্ধেকটা এসে পড়েছে রতনপুরের পুব সীমানায়। দেওয়ানবাড়িটা অবশ্য গ্রামের পশ্চিমে।

 ইলোরার স্বামী উপজেলা ডিগ্রি কলেজের ইতিহাসের প্রভাষক। গত পরশু সেতু মিয়া কলেজে গিয়ে ইলোরার স্বামীকে দেখে এসেছে। একটু শ্যামলাগোছের, কিন্তু বেশ লম্বা। সে ইলোরার স্বামীর নামটাও জেনে এসেছে, প্রভাষক দেওয়ান জয়দুল হাছান।

সেতু মিয়া পুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দাঁড়িয়ে আছে। সে দাঁড়িয়ে আছে ইলোরার স্বামীর বাড়ির খুব কাছাকছি। তার দাঁড়ানোর স্থান থেকে অবশ্য ইলোরার স্বামীর বাড়ির ভেতরটা দেখা না গেলেও তার দৃষ্টি বাড়ির প্রাচীর উজিয়ে দালানটার ছাদে গিয়ে পড়ছে। দালানটা একতলা। তবে ছাদের ওপর মোটা মোটা লোহার রডগুলো এমন হাঁ মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে যে, এতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, দালানটা অচিরেই দোতলা করা হবে।

সেতু মিয়া বেশ কিছুক্ষণ ইলোরার স্বামীর বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সে সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবার লাল ফড়িংটার দিকে তাকাল। ফড়িংটা এখন আর উড়ছে না। পুকুরের সামান্য ভেতরে, পুবদিকের ঘাটলা বরাবর জলে পুঁতে রাখা একটা বাঁশের কঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছে।

সেতু মিয়া কী ভেবে তার দৃষ্টিটা ওঠানামা করল। সে একবার ইলোরার স্বামীর বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছে তো পরক্ষণেই লাল ফড়িংটাকে দেখছে। তার দাঁড়ানোর স্থান থেকে পুকুরের দক্ষিণপাড় ধরে একটা পথ নেমে গেছে মইজ্যার চকের দিকে। পুকুরের পুবপাড় ধরেও একটা সরু পথ ইলোরার স্বামীর বাড়ির ঘাটলায় গিয়ে থেমেছে। ঘাটলা বরাবর বাড়ির গেট।

শীতকাল বলে পুকুরের জল অনেকটাই নেমে গেছে। দক্ষিণের পাড় ধরে ছোট্ট একটা মোড়তার জংলা। আর জলে অনেকটা অংশ জুড়ে ছোটবড় কচুরিপানা। কোথাও কচুরিপানাগুলো একাট্টা হয়ে আছে, কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাসছে। একটা শোল মাছ ভাসছে কচুরিপানার ফাঁকে। কয়েকটা চখকুনি মাছ জলে সরু রেখা করে ছোট্ট লেজটা নাড়ছে। কয়েকটা ব্যাঙ এদিক-ওদিক পানির ওপর মাথা বের করে উঁকি মেরে তাকিয়ে আছে।

লাল ফড়িংটা আবার উড়তে শুরু করেছে। উড়তে উড়তে কখনো দক্ষিণে যাচ্ছে, কখনো উত্তরে। যখন দক্ষিণের পাড়ে তার কাছাকাছি হচ্ছে, তখনই সেতু মিয়ার ভেতরটা মোচড় দিচ্ছে। যৌবনের শুরুতে দেখা সেই ফড়িংটাই যেন! ঠিক একই রকম লম্বা লেজ। লাল টকটকে মীনারং করা শরীর। পাখাগুলো থেকে যেন লাল রেণুগুলো ঠিকরে পড়ছে। মাথাটাও কেমন ফটিকতাজা রক্তের মতো গাঢ় লাল। আর চোখ দুটোও।

সেতু মিয়া তার দাঁড়ানোর স্থান থেকে নড়ে উঠল। ইলোরার সঙ্গে দেখা করবে বলে সে তাদের অনুতপুর বাজারের যোগেশ শীলের কাছ থেকে দাড়িগোঁফ কামিয়ে পরিপাটি হয়ে এসেছে। তার মাথার চুলে সিঁথি করা, গায়ে ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ওপর সবুজ সোয়েটার। একটা শাল কাঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে।

সেতু মিয়া লাল ফড়িংটা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবার ইলোরার স্বামীর বাড়ির দিকে তাকাল। তাকানো মাত্রই তার দৃষ্টিটা কেমন স্থির হয়ে গেল। সেই শিশুকাল, একসঙ্গে বেড়ে ওঠা। খানিকটা যৌবনের অনুভূতি। আর একটা দীর্ঘশ্বাস। তারপর চৌদ্দ বছরের জেলের ঘানি।

চৌদ্দটা বছর! সেতু মিয়া মাথা ঝাঁকাল। লোকজন বলে, সে নাকি পাগলা কিছিমের। কিন্তু সে নিজে জানে, সে এতোটা পাগল ছিল না যে চৌদ্দ বছর আগে কোনো কারণ ছাড়াই রাতের আঁধারে ইলোরার হবু স্বামীকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে খুন করবে!

ইলোরার প্রথম সম্বন্ধটা এসেছিল অনুতপুরের পশ্চিমের গ্রাম আবদুল্লাহপুর থেকে। আবদুল্লাহপুরের মফিজ মেম্বারের ছেলে আলফাজ উদ্দিন। আলফাজ এমএ পাশ ছিল। ইতালিতে থাকত। দেশে বিয়ে করতে এসেছিল। কাজীবাড়ির তুলনায় জাতপাতে একটু নিচু ছিল। তারপরও সুন্দর কাজী সম্বন্ধ করতে রাজি হয়েছিলেন এই ভেবে যে, বিয়ের পর জামাই তার মেয়েকে সঙ্গে করে ইতালি নিয়ে যাবে।

সম্বন্ধটা পুরোপুরি পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের দিন-তারিখও ঠিক। আর তখনই, বিয়ের ঠিক চারদিন আগে রাতের আঁধারে আলফাজ উদ্দিন খুন হয়। খুনিও সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে। খুনি আর কেউ নয়, সেতু মিয়া।

সেতু মিয়া ভাবল, এছাড়া আর উপায় কী ছিল? ইলোরার বিয়ে ঠেকানোর জন্য সে ওটাই একমাত্র পথ খুঁজে পেয়েছিল।

পাঁচ 

একটা অনির্ধারিত ভাবনায় কখন যে সেতু মিয়া ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে ইলোরার স্বামীর বাড়ির ঘাটলায় চলে এসেছে, তা সে খেয়াল করেনি। কী এক অনির্ভরতা তার ভেতর। হঠাৎ একটা মিহি ডাক তাকে চমকে দিলো। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, সাত-আট বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। অদ্ভুত সুন্দর গায়ের রং। চেহারার আদলটা খুব চেনা চেনা লাগছে।

সেতু মিয়ার মুহূর্তমাত্র সময় লাগল। সে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল, এই মেয়ে আর কারো নয়, ইলোরারই মেয়ে।

মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, অ্যাই, তুমি আমাদের ঘাটলায় কী করছো?

সেতু মিয়া একটা বিব্রতের হাসি দিয়ে বলল, একটা লাল ফড়িং দেখতাছি।

– লাল ফড়িং, কোথায়?

– ওই যে, দেখো কেমন উড়তাছে।

– আরে, তাই তো, কী সুন্দর! আমি তো আগে দেখিনি। আম্মুকে গিয়ে বলতে হবে।

– হ হ, তোমার মারে গিয়া বলো। তোমার মা কই?

– আম্মু বাড়ির ভেতরে। আচ্ছা, তুমি কি আমাকে ফড়িংটা ধরে দেবে?

– হ হ, আমি ধরে দিতাছি। এক্ষণই ধরে দিতাছি। – বলেই সেতু মিয়া ফড়িংটার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হতে যাবে ঠিক তখনই গেট পেরিয়ে একজন মানুষ ঘাটলায় উপস্থিত হলো।

সেতু মিয়া দেখল, ইলোরা। 

ইলোরা ঘাটলায় উপস্থিত হয়েই মেয়েকে শাসিয়ে বলল, বলছি, এই জ্বরের শরীর নিয়ে ঘরের বাইরে যাবি না। তবু সে ঘাটলায় চলে এসেছে। আজ তোর আব্বু কলেজ থেকে আসুক। পাজি মেয়ে কোথাকার।

ইলোরা কথাটা শেষ করতে পারল না। সে সেতু মিয়ার দিকে তাকাল। তার চোখ তখনই বড় হয়ে গেল।

সেতু মিয়া দাঁত কেলিয়ে অযথাই হাসল, হে হে, হে হে।

ইলোরা সেতু মিয়ার হাসিটায় তেমন গা করল না। সে এক মুহূর্তের জন্য চুপ থেকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল। মেয়ের হাত ধরে টেনে ঘাটলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল, বাপের বেশি আদর পেয়ে মেয়ে মাথায় উঠে গেছে। আমাকে পাত্তাই দিতে চায় না। শরীরে এতো জ্বর, অথচ না বলে ঘাটলায় চলে এসেছে।

সেতু মিয়া কিছু বলতে গেল। কতদিন পর সে ইলোরাকে দেখছে। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারল না। সে হাঁ করে ইলোরা ও তার মেয়ের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল।

ইলোরা বাড়ির ভেতর ঢুকে খটাস শব্দে গেটটা বন্ধ করে দিলো।

ছয় মাঘ মাসের প্রথম ভোর। ভোরটা ক্রমাগত ভাঙছে। পুবের আকাশে সূর্যের উৎপাত তখনো শুরু হয়নি। সেতু মিয়া দক্ষিণমুখো হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। তার পেছনে মইজ্যার চক। আরো পেছনে রতনপুর গ্রামের দেওয়ানবাড়ি। সে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে গোমতির জলের কাছে থমকে দাঁড়ায়। তার হাতে তখনো রামদাটা ধরা। রামদা থেকে তখনো সরু সরু রেখা করে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। গোমতির জলেও সরু রেখা করা কুয়াশার ধোঁয়া।