মাস্ক-সম্পর্কিত একটি সত্য ঘটনা

থার্মাল স্ক্যানারের সামনে দাঁড়াতেই ধবধবে সাদা স্পেস স্যুট পরিহিত নিরাপত্তা কর্মীটি মাহিদুলের চোখে চোখ রেখে ঈষৎ বিরক্তিযুক্ত কণ্ঠে বললেন – ‘আরে ভাই কী করছেন? হাত নয়, আপনার কপাল আনেন স্ক্যানারের সামনে।’ অনভ্যাসের কারণেই হয়তো হাতটি আগে চলে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে স্ক্যানারের সামনে নিজের মুখাবয়বটি তুলে ধরে মাহিদুল। স্ক্যানারের ডিজিটাল স্ক্রিনে ভেসে ওঠে শরীরের তাপমাত্রা – সাতানব্বই পয়েন্ট সাত। তাপমাত্রা স্বাভাবিক। স্টেশনের  ভেতরে ঢুকতে আর বাধা নেই। প্লাটফর্মে এসে কিছুটা ভড়কে যায় মাহিদুল। রাজশাহী যাওয়ার জন্য যে-ট্রেনটা সামনে অপেক্ষা করছে সেটার বগির ওপর বড় বড় বাংলা হরফে লেখা পদ্মা/ সিল্কসিটি/ ধূমকেতু/ বনলতা। এ কী কাণ্ডরে বাবা! নিজের অজান্তেই কথাগুলো বেরিয়ে আসে মাহিদুলের ঠোঁট গলে। বেশ কবার এদিক-ওদিক তাকায়। একই ট্রেনের গায়ে চার-চারটি নাম। বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করে সে। কমলাপুর রেলস্টেশনের চিরাচরিত রূপ আজ আর চোখে পড়ছে না তার। যে-রেলস্টেশনটি সাধারণত মানুষে গিজগিজ করে সেই স্টেশন যেন মরুভূমির মতো খা খা করছে আজ। ছেষট্টি দিন একটানা লকডাউনের পর আজই প্রথম রেলযোগাযোগ চালু হয়েছে বিভিন্ন জেলার সঙ্গে। সেজন্যই হয়তো স্টেশনটি বেশ ফাঁকা। সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে ট্রেন ও বাস। টেনের টিকিটটি তাকে কিনতে হয়েছে অনলাইন থেকে। মাহিদুলের সামনে দিয়ে মন্থর গতিতে জনৈক ভদ্রলোক হেঁটে যাচ্ছিলেন, তাকে উদ্দেশ করে মাহিদুল বলল – ‘এই যে ভাই, এটাই কি রাজশাহী যাওয়ার বনলতা ট্রেন?’ ভদ্রলোকটি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘আরে ভায়া এ-সময়ে বনলতা ছাড়া অন্য ট্রেন রাজশাহী যায় নাকি?’ মাহিদুল কিছুটা বিরক্ত হলো। লোকটা সরাসরি বললেই তো পারে এটাই বনলতা। এতো ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলার কী মানে হয়। একেবারে টিপিক্যাল বাঙালি। কোনো কথা সোজাসুজি বলতে পারে না। ভেতরের রাগ গোপন করে মাহিদুল ঈষৎ কপট হেসে বলল, ‘ধন্যবাদ।’ ট্রেনে উঠে মাহিদুল নির্দিষ্ট আসনে বসল ঠিকই, কিন্তু সে লক্ষ করল প্রচণ্ড গরমে ঘামে তার শার্টের পেছনটা ভিজে একেবারে জবুথবু অবস্থা। বর্ষা প্রায় শেষের দিকে, কিন্তু উষ্ণতার কোনো কমতি নেই। সূর্যের আলোতে যেন আগুনের ফিনকি ছুটছে। মাহিদুল ইচ্ছে করেই শোভন শ্রেণির টিকিট কেটেছে। এমন নয় যে  শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরার যে-কোনো একটি আসন তার সাধ্যের বাইরে। বরং শৈশব থেকে বাবা-মায়ের কাছ থেকে এই শিক্ষাই পেয়েছে সে, সবকিছুতে কীভাবে সাশ্রয়ী হতে হয়। তাছাড়া ট্রেনের খোলা জানালা দিয়ে যে আলো-বাতাস আসে সেটা মাহিদুলের বেশ পছন্দ।

নির্ধারিত সময়েই ট্রেন কমলাপুর ছেড়ে রওনা হলো রাজশাহীর উদ্দেশে। কু-ঝিকঝিক … কু-ঝিকঝিক। অদ্ভুত এক দুলুনির মধ্যে বেশ রোমাঞ্চিত বোধ হতে লাগল মাহিদুলের। শেষবারে ট্রেন জার্নি হয়েছিল দু-বছর আগে।

চা-বাগানের ওপর একটি ব্লগ তৈরির কাজে বছর দুয়েক আগে তাকে যেতে হয়েছিল সিলেট। যাওয়ার সময় ট্রেনে চেপে গেলেও ফেরাটা হয়েছিল কোচে। সাপের মতো এঁকেবেঁকে ট্রেনটি যখন গাজীপুর ছাড়ল, বাংলাদেশের তখন ভিন্ন চিত্র। বর্ষার অবিরাম বারিপাতে বৃক্ষগুলিকে দেখাচ্ছে প্রগাঢ় সবুজ। বৃক্ষের ছায়াঘন স্নিগ্ধতা ও বনস্পতির সবুজ বিস্তার চোখের ওপর যেন মোলায়েম পরশ বুলিয়ে যায়। চারপাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সুনিবিড় সংস্পর্শে মনের পরিধিটাও প্রসারিত হতে থাকে। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। এক দৃষ্টিতে সারিসারি গাছের দিকে তাকিয়ে মাহিদুলের মনে হলো, ঋজুশীর্ষ প্রতিটি বনস্পতি তার শাখাবল্লরী আন্দোলিত করে বনমর্মরে যেন গান করছে মনের আনন্দে। বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এবার মাহিদুল তাকায় ট্রেনের ভেতর দিকটায়। করোনার কারণে আসন বিন্যাসে বেশ পরিবর্তন আনতে হয়েছে রেল কর্তৃপক্ষকে। সকলকে বসতে হয়েছে পাশের একটি সিট খালি রেখে। এজন্যে ট্রেনের ভেতরটা বেশ ফাঁকা। তবে কাউকে কাউকে দেখা গেল আসন বিন্যাসের পরিবর্তনকে ভ্রুকুটি করে একসঙ্গে জড়াজড়ি করে বসতে। ভাবতেই অবাক লাগে মাহিদুলের, ট্রেনের ভেতরটা এখন কত সুন্দর ও শৌখিন। ছোটবেলায় ট্রেন ভ্রমণের কথা মনে পড়ে তার। মাহিদুলের বাবার ছিল কমলার ব্যবসা। সেজন্য প্রায়ই তাঁকে ছুটতে হতো সিলেট। মাঝেমধ্যে মাহিদুলের বাবা আবুল কাসেম মাহিদুলকেও সঙ্গে নিতেন তাঁর সাহায্যকারী হিসেবে। সে-সময় গেরস্তরা বেড়াতে যেত ট্রেনের সিøপার ক্লাসে। এসির চল এতোটা ছিল না। লোহার সিঁড়ি বেয়ে বাঙ্কে ওঠার সময় মনের ভেতরটায় কেমন শিরশির করে উঠত। সেসব পুরনো ট্রেনের কামরায় থাকত লালচে ডুমের আলো আর লোহার জালে ঘেরা গোলপানা কয়েকখানা কালচে পাখা। রাত্তিরে সবাই যখন ঘুমোত, তখন ট্রেনের প্যাসেজের মাঝখানে কিছু নীলাভ ল্যাম্প পিটপিট করে জ্বলত। ট্রেনের ঘুমন্ত প্যাসেজটার দিকে তাকালে মনে হতো যেন অচেনা কোনো স্পেসশিপে বসে আছে মাহিদুল।

হঠাৎ মাহিদুলের চোখ পড়ল ঈষৎ দূরে জানালার পাশে বসা এক তরুণীর দিকে। মেয়েটির পাশেই বসে আছে প্রৌঢ়মতোন একজন লোক। শুভ্র সফেদ দীর্ঘ শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটির লম্বা সাদা দাড়িগুলো নেমে এসেছে বুক পর্যন্ত। সার্জিক্যাল মাস্কের কারণে সম্পূর্ণ মুখটি দেখা যাচ্ছে না, শুধু চোখ দুটো জ¦লজ¦ল করছে। মেয়েটি দেখতে বেশ সুন্দরী। ঘনকৃষ্ণ দীর্ঘ কুঞ্চিত কেশ। রক্তাভ ধরনের ফর্সা মুখাবয়ব। কালো অঞ্জনে শোভিত নীলকঞ্জপ্রভ চোখ। কালো কাজলের কারণেই হয়তো সমুদ্রনীল চোখ দুটো দারুণ সুন্দর লাগছে দেখতে। মুখে মাস্ক নেই। মেয়েটির চোখ-মুখ বিষাদ ও বিষণ্নতায় ছেয়ে আছে। মাথা নিচু করে চর্বির ঢেলার মতো চুপ করে বসে আছে মেয়েটি। মাহিদুল মনে মনে ভাবে, মেয়েটিকে কি জোর করে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও? কিংবা মতের বিরুদ্ধে ওকে বিয়ে দিচ্ছে? মেয়েটি মাথা উঁচু করতেই মাহিদুলের দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হলো মেয়েটির দিকে। মাহিদুল লক্ষ করল, ওর চোখে কোনো কুণ্ঠা নেই, অধোবদন নয়, নির্বিকার দৃষ্টি। মৃণাল লোলুপ মরালী যেমন পদ্মফুলের পাপড়ির লোভে বারবার ওটার দিকে ছুটে যায়, ঠিক তেমনি মাহিদুলও মেয়েটির দিকে বারবার তাকাতে লাগল। জীবনে মেয়েদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ খুব একটা হয়নি মাহিদুলের। মেয়েদের প্রতি যে তার বৈরাগ্য – এমনটা নয়, বরং পরিবেশ-পরিস্থিতি সব সময়ই তার প্রতিকূলে থেকেছে। মা-বাবা আর চারটি বোনসমেত সংসার। বিগত সাত-আট বছর ধরে মাহিদুলই সংসারের ঘানি টেনে চলেছে। বাবা আবুল কাসেম পক্ষাঘাতে বিছানায় শয্যাশায়ী। চারটি বোনের মধ্যে তিনটি স্কুলে পড়ে। নবীন ইউটিউবার হিসেবে কত টাকাই বা আর আয় হয়। ব্লগিং করার পাশাপাশি তাকে করতে হয় নানারকম উঞ্ছবৃত্তি। অনেক কষ্ট করে বড় হতে হয়েছে মাহিদুলকে।

বুকে-পিঠে বালিশ চেপে ফুরসত করার সময় জীবনে সে কখনোই পায়নি। বাবার ফলের ব্যবসায় সংসার চলে না – এজন্য মা ধনীলোকের বাড়িতে অল্প বেতনে ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে আরবি পড়া শেখাতেন। মাঝে মধ্যে ছোট্ট মাহিদুলকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন মা।

কী আনন্দ ও উল্লাস ধনীবাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানোতে। যা খেতে পায় না, যা চোখে দেখে না – তারই ছিটেফোঁটা পেয়ে যায় ভাগ্যগুণে। ধনীর দুলালীর পরিত্যক্ত খেলনা, বড় মাছের কাঁটাটা, দইয়ের হাঁড়িতে লেগে থাকা শেষদাগটুকু, সন্দেশের ভাঙা অংশটুকু – ওই পেয়েই মাঝে মাঝে ছাগলছানার মতো অহেতুক আনন্দে ঘুরপাক খেত মাহিদুল।

সেসময় মাহিদুলরা থাকতো সায়েদাবাদ এলাকায়। বেশ কিছু গলিঘুঁজি পেরিয়ে ছাপরা মতোন একটি ভাড়াবাড়িতে থাকতো তারা। সেখানে বাস করতো নানা কিসিমের নানা পেশার লোকজন। মুদি-মশলার দোকানদার, লেবার-কারখানার লোক, তেলকলের মজুর, হাঁড়িমিস্ত্রি, ঝি-চাকর। সেখানে ইতর-ভদ্রের পার্থক্য ছিল অনেক বেশি।

মাঝেমধ্যেই মাহিদুল দেখতো রাস্তার মোড়ে মোড়ে কিছু লোক হাত নেড়ে তর্কবিতর্কে চারদিক আলোড়িত করে তুলছে। আলোচনার বিষয়, চুরি কিংবা ডাকাতির সংবাদ। চুরি-ডাকাতি এগুলি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। মাঝেমধ্যে খুন-খারারির খবরও আসতো। বিশাল সেই মহল্লায় নাকি ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকতো অনেক গাঁটকাটা, সন্ধ্যার পর অন্ধকারের মানুষগুলো নেশামত্ত হয়ে আনাচে-কানাচে হানা দিত।

লেখাপড়াটা মাহিদুল ঠিকঠাকমতো করতে পেরেছিল বলে জীবনটা কোনোরকমে বেঁচে গিয়েছিল তার। ছাত্রজীবনে মাহিদুল যে খুব একটা ভালো ছাত্র ছিল তা নয়। তবে এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও পড়ালেখাটা যে সে শেষ করতে পেরেছিল, সেটাই বড়

কথা। মাহিদুলের এখনো স্পষ্ট মনে আছে, বার্ষিক পরীক্ষার সময় মা ঘুমোতেন না। শেষরাতে উঠে কনকনে শীতের মধ্যে কেরোসিনের বাতি জ¦ালিয়ে হাড় জিরজিরে ছেলেটা পড়তে বসত। পেছন দিক থেকে মা সন্তর্পণে ছেঁড়া লেপের একটা অংশ তুলে দিতেন তার গায়ে। চেরাগের তেল ধীরে ধীরে ফুরিয়ে এলে মুখ তুলে উত্তর দিকের নিমগাছের ফাঁক দিয়ে সে দেখত ভোর হয়েছে কিন্তু চারপাশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন। কাকের কর্কশ কণ্ঠ শোনা যেত সেই নতুন পৃথিবীতে। এই বুকচাপা অবরোধের বাইরে, ভূগোল, গণিত কিংবা ইতিহাস থেকে অনেক দূরে একটা স্নিগ্ধ শীতল মুক্তির ইশারা হাতছানি দিয়ে ডাকতো তাকে। উত্তরের হিমেল হাওয়া এসে লাগতো চোখে-মুখে। পিদিমের শুকনো সলতেটা নিভে আসতো আস্তে আস্তে। রাঙা রোদ এসে পড়তো নিমগাছের মগডালে। প্রভাতের পাখিরা তাকে বারবার আহ্বান করতো পরিবার নামক এই গারদ থেকে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু বেরিয়ে আসতে চাইলেই কি বেরিয়ে আসা যায়? যায় না। মা, বাবা আরো চারজন বোনসমেত একটি হতদরিদ্র সংসার থেকে বেরিয়ে আসা সত্যিই কঠিন। সন্ন্যাসজীবন হচ্ছে জমিদার ও রাজরাজড়াদের জন্য, গরিবদের জন্য হচ্ছে সমস্ত জীবন সংসারে কলুর বলদের মতো ঘানি টেনে যাওয়া।

এসব ভাবতে ভাবতে পেটের ভেতর একরকম চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয় মাহিদুলের। বেশ খিদে পেয়েছে। মনে হচ্ছে যেন পেটের ভেতর আস্ত ভিসুভিয়াস জ¦লছে। মাহিদুলের হঠাৎ মনে পড়ল আজ নাস্তা করা হয়নি সকালে। এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট কোনোমতে মুখে তুলে দৌড়াতে হয়েছিল স্টেশনের দিকে। নাস্তা তো অনায়াসেই সারা যেত, কিন্তু ঘুম থেকে উঠতে তার রাজ্যের আলস্য। সে যা হোক ব্যাগের ভেতর থেকে ক্লাব স্যান্ডুইচের প্যাকেটটা বের করে সেখান থেকে একটি চিকেন চিজ স্যান্ডুইচ খেতে খেতে তার মনে পড়ে – আহা!!! ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে ট্রেনজার্নির সাদামাটা খাওয়া, অথচ কী তৃপ্তিময় ও অসাধারণ ছিল সেই দলবদ্ধ ভোজন।

বাঙালির ট্রেন-ভ্রমণের কয়েকটি বাঁধাধরা মেন্যু থাকে। হয় লাল আটার নরম পরোটা এবং জিরজিরে হরিদ্রাভ আলুভাজা আর তা না হলে সাদা আটার ন্যাতন্যাতে রুটি, কালোজিরে আর চেরা কাঁচামরিচ দিয়ে বাঁধাকপি, ফুলকপি আর আলু সবজি। সাদা আটার রুটি সবসময় ফুটন্ত গরম পানিতেই মাখা হতো, ফলে তা পরের দিন সকাল অবধি নরম তুলতুলে থাকত। মনোলোভা খাবার তো বাড়িতে অনেকই খাওয়া হয়, কিন্তু ট্রেনের দুলুনির মধ্যে বসে যে খাওয়া, তার বোধহয় কোনো তুলনা চলে না। সেসব দিনে খাবার পরিবেশন করা হতো বাড়ি থেকে ব্যাগের মধ্যে নিয়ে আসা মেলামাইনের থালায়। মেলামাইন নামক তৈজসপত্রগুলি বোধকরি তখনই বাজারে নতুন উঠেছে। পানি থাকত বড়সড় ওয়াটার বটলে, সবাই সেটা মুখ ওপরের দিকে তুলে আলগোছে খেত। ছোটদের জন্য ছোট মাপের গ্লাস আনা হতো। চা নিয়ে যাওয়া হতো লম্বাটে রঙিন ফ্লাস্কে। খাওয়া শেষে জানালার বাইরে হাত বের করে ধোয়া হতো পানি দিয়ে। তারপর বাড়ি থেকে আনা একটি পরিষ্কার গামছায় হাত মোছার ব্যবস্থা থাকতো। কারণ টিস্যু পেপারের তখনো এতো রমরমা হয়নি।

মাহিদুল গোগ্রাসে যখন স্যান্ডুইচগুলো দিয়ে উদরপূর্তি করছিল ঠিক সেসময় পেছন দিক থেকে একজন তার কাঁধে আলতো স্পর্শ করে বলল  – ‘টিকিট প্লিজ।’ ঘাড় কাত করে মাহিদুল দেখল মাথায় ক্যাপ, সাদা ড্রেস পরা টিকিট চেকার তার পাশে দাঁড়িয়ে টিকিট চাইছে। মাহিদুল বিনীত কণ্ঠে টিকিট চেকারকে উদ্দেশ করে বলল, ‘যদি কিছু মনে না করেন টিকিট আমার প্যান্টের পকেটে। দেখতেই তো পাচ্ছেন আমি এখন খাচ্ছি, হাতে খাবার লেগে আছে। আপনি অন্য সবার টিকিট চেক শেষে না হয় এদিকটায় আসুন। আমি হাত ধুয়ে এসে আপনাকে টিকিট দেখাচ্ছি।’ ট্রেনের ভেতরটা বেশ ফাঁকা বলেই হয়তো আজ মাহিদুল একথা টিটিকে বলতে পারলো। ভিড় বেশি হলে হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। পাঁচ বছর আগের একটি ঘটনা মনে পড়ল মাহিদুলের।

ট্রেনে বাবার সঙ্গে বসে আছে সে। আস্তে আস্তে লোকজনে ভরে যাচ্ছে সমস্ত বগি। এত্তো এত্তো যাত্রী দেখে খুব অবাক হয়েছিল মাহিদুল। আসন শেষ হয়ে আস্তে আস্তে দাঁড়ানো যাত্রীর সংখ্যা বাড়তে আরম্ভ করলো। মাহিদুল প্রমাদ গুনতে শুরু করল। বিভিন্ন পেশা- শ্রেণির সারি সারি যাত্রী দাঁড়ানো। আজকাল এতো লোক যাতায়াত করে ট্রেনে? কমলাপুর স্টেশন ছাড়তে না ছাড়তেই সাদা পোশাকধারী টিটির আবির্ভাব। এত্তো এত্তো লোক দাঁড়ানো কিংবা বসা, কিন্তু বেছে বেছে টিটি মহাশয় অল্প কয়েকজনকে টিকিট দেখাতে বলছেন। বলাই বাহুল্য এদের কারো কাছে টিকিট নেই। এরা টিকিট দেখানোর মতো করে হাতখানা জামা অথবা প্যান্টের পকেটে, লুঙ্গির কোচড়ে ঢুকিয়ে যা বের করে আনছিল সেগুলি টিকেট নয়। নতুন-পুরনো টাকা। দশ, বিশ, পঞ্চাশ, একশ টাকা – যার যার গন্তব্য অনুযায়ী দিয়ে দিলো। টিটিও হাত বাড়িয়ে চুপটি করে টাকাটা মুঠোবন্দি করে আবার নিজ পকেটে চালান করে দিচ্ছিলেন। কিন্তু সবার কাছে তিনি টিকিট চাচ্ছিলেন না। বিষয়টা নিয়ে একটু কৌতূহল হওয়ায় বাবাকে বিষয়টি জানালো মাহিদুল। মাহিদুলের বাবা মাহিদুলের চেয়েও বেশি কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। তিনি ফিসফিস করে কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলেন, এর রহস্য কী? নিয়মিত যাতায়াত করে এমন একজন যাত্রী জানালেন – যারা ট্রেনে ওঠার সময়ই রফাদফা করে পেমেন্ট করে দিয়েছেন তাদের কাছে টিটি টাকা চাইবেন না। যারা বোকার মতো রফা করে ওঠেননি, তারাই প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন।

সে যাক, এখন মনে হয় অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে আর নয়তো করোনাকাল বলে সেই দৃশ্য চোখে পড়ছে না। কিছু সময় পর টিকিট চেকার ফিরে এলেন মাহিদুলের কাছে। লোকটি দীর্ঘকায়, গায়ের রং গৌরবর্ণ, টিকালো নাক, দেখে মনে হয় সম্ভ্রান্ত ঘরের মানুষ। পাকেচক্রে হয়তো টিকিট চেকারের চাকরি নিতে হয়েছে তাঁকে। প্যান্টের পকেট থেকে টিকিটটি বের করে মাহিদুল তুলে দিলেন লোকটির হাতে।

– রাজশাহী যাইতেছেন? বেড়াইতে না কোনো কাজে?

মাহিদুল মৃদু  হেসে বলল, ‘কাজে যাচ্ছি একদিনের জন্য। পরশুই ফিরে আসব ঢাকায়।’

– যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

মাহিদুল হেসে বলল, ‘একটা কেন, যতগুলি ইচ্ছা করুন।’

– আপনি চাকরি করেন, না ব্যবসা?

– দুটোর কোনোটাই না। আমি একজন ফ্রিল্যান্সার। তাছাড়া আমার একটি ইউটিউব চ্যানেল আছে। ডকুমেন্টারি, ব্লগ-টøগ এগুলি তৈরি করি। এবার রাজশাহী যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে পুঠিয়া রাজবাড়ির ওপর একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করবো।

– আইচ্ছা আজকাল অনেকের মুখে এই যে ফ্রিল্যান্সিং কথাটা অনেক শুনি, এইটা আসলে কী? এ-বিষয়ে কাউকে যে জিজ্ঞাস করবো তেমন কাউকে কাছে পাই না। আপনাকে পাইলাম তাই জানতে চাইতেছি।

পাশের আসনটি খালিই পড়ে আছে। সেদিকে চোখ দিয়ে ইশারা করে মাহিদুল টিকিট চেকার মহাশয়কে বসতে ইঙ্গিত করলো। ‘শুনুন, অনলাইনে আয়ের অন্যতম একটি মাধ্যম হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং। আমাদের দেশে এখন অনেকে আছেন যারা পড়ালেখার পাশাপাশি অথবা পড়ালেখার শেষে ফ্রিল্যান্সিং করে প্রতিমাসে ভালো অর্থ উপার্জন করছেন। ফ্রিল্যান্সিং হচ্ছে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে মাল্টিবিলিয়ন ডলারের একটা বিশাল বাজার। বিশ্বের উন্নত দেশগুলি তাদের কাজের মূল্য কমানোর জন্য অনলাইনের মাধ্যমে সেসব কাজ আউটসোর্সিং করে থাকে। আমাদের পাশর্^বর্তী দেশ ভারত এবং পাকিস্তান সেই সুযোগটিকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে। আমরাও যদি ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিশাল বাজারের সামান্য অংশ কাজে লাগাতে পারি, তাহলে এটিই হতে পারে আমাদের অর্থনীতি মজবুত করার শক্ত হাতিয়ার। বর্তমানে এমন অনেকে আছেন যারা তাদের চাকরির পাশাপাশি অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং করে অর্থ উপার্জন করছেন। গতানুগতিক চাকরির বাইরে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করার স্বাধীনতা হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং। যারা অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং করেন তাদের বলা হয় ফ্রিল্যান্সার।’

Ñ আহা টাকা আয়-রোজগারের এখন কত সুযোগ-সুবিধা হইছে। আমাদের সময় তো এগুলি ছিল না। এইসব ফ্রিল্যান্সিং-টেন্সিং তো অনেক দূরের কথা। প্রাইভেট চাকরিই ছিল না বলা চলে। সবাই ঝুঁকতো সরকারি চাকরির দিকে। বিশ-ত্রিশ বছর আগে  তো এমন ছিল যে সরকারি চাকরি নাই তো ভালো বিয়াও নাই। হাহাহা।

Ñ আপনি কি বিয়েশাদি করেছেন, না এখনো ব্যাচেলার?

Ñ না করিনি। এতো বড় সংসার। সংসার চালাতেই তো হিমশিম খাচ্ছি, আবার বিয়ে।

মাহিদুল চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে টিকিট চেকারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। এই যে একই ধরনের কাজ প্রতিদিন আপনাকে করতে হয়, বিরক্ত লাগে না?’

টিকিট চেকার বেচারা ঈষৎ গম্ভীর মুখে বললেন, ‘দেখেন ভাই, ত্রিশ বছর ধইরা এই কাজ করতেছি। বছর দুয়েক বাদে রিটায়ার করবো। এখন জানতে চাইতেছেন এই কাজ বিরক্ত লাগে কি না! চাকরি জীবনে এমন কোনো হেনস্থা নাই যে যার শিকার আমি হই নাই। গালিগালাজ, হাতাহাতি, মারামারি, বাঙালি মানেই তো এক আজব চরিত্র। টিকিট না কেটে ট্রেনে উইঠা বসছে। আপনি জরিমানা করছেন তো গালিগালাজ করে আপনার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবে। বয়স যখন কম ছিল প্রায়ই মারামারি লেগে যেত। বুঝলেন না, অল্প বয়সে সবারই তো মাথা গরম থাকে। ধীরে ধীরে টাকা আদায় করার কৌশল রপ্ত কইরা ফেলছি। বাঙালি পুলিশকে জন্মের মতো ভয় করে। ওই ধরেন হুমকি-ধমকি কোর্ট-কাছারির কথা বলে এদের বাগে আনা যায় না। যখনই কোনো বিনা টিকিটের যাত্রী হম্বিতম্বি শুরু করে ঠিক তখনই আমি আমার সহকর্মীদের বলি পুলিশ ডাকো। ম্যাজিকের মতো কাজ হয় মশাই। অমনি যাত্রীর কণ্ঠ নরম হয়ে আসে। বেশ কয়েকদিন আগে একটা মজার ঘটনা ঘটছে। জীবনে তো বহু গালাগালি শুনছি, তবে এমন অদ্ভুত কথা জীবনে এর আগে কখনো শুনি নাই। কোট-প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোকের কাছে টিকিট চাইলাম। অমøান বদনে সে বলল – সময়ের কারণে সে টিকিট কাটতে পারেনি। আমি বললাম – ঠিক আছে সমস্যা নাই, এখন জরিমানাসহ টিকিট লন। অমনি লোকটা দেশলাইয়ের কাঠির মতো জ¦লে উঠল, কেন জরিমানা দেব? এক কথা, দুই কথা এই ভাবে একসময় ভীষণ ঝগড়া লেগে গেল। উনি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন – বেশ চেনা আছে আপনাদের মতো লোকেদের। আপনারা নর্দমার কীটের চেয়েও নিকৃষ্ট। আপনারা রেলের লোকজন তো বহুগামিতায় ওস্তাদ, আমি জানি না ভেবেছেন।’

টিকিট চেকার মাহিদুলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভদ্রলোকের এই কথা শুনে আমি তো হতবাক। বলে কী লোকটা! আমরা বহুগামী!’ ‘বহুগামী তো বটেই। আপনাদের মতো রেলের শ্রমিকদের কারণেই তো বেশ্যালয়ের যে ইংরেজি নাম ‘রেডলাইট ডিস্ট্রিক্ট’ এটার নামকরণ হয়েছে।’

টিটি তার চোখ দুটি বড় বড় করে বললেন, ‘আমি তো ওই লোকের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারি নাই। শুধু শব্দটা মনে ছিল অল্পবিস্তর। পরে বিভিন্ন মানুষের কাছে খোঁজখবর করে জানা গেল ইংরেজি শব্দ ‘‘রেডলাইট ডিস্ট্রিক্টের’ বাংলা শব্দ নাকি বেশ্যালয়। আমার বুঝে আসতেছে না আমাদের কারণেই এই নাম কেন হবে?’

ঠোঁটে মৃদু রহস্যময় হাসি তুলে মাহিদুল বলল, ‘এটা বলার কারণ আছে ভায়া। সে কথায় পরে আসছি। এই যে আপনি নিজেই বললেন – বাঙালি বড় বিচিত্র প্রাণী। এক্কেবারে সত্য বলেছেন। পৃথিবীতে বাঙালির মতো আর কেউ এমনভাবে একজন অন্যজনের নিন্দামন্দ ও দোষারোপ করায় টেক্কা দিতে পারবে না। এই যেমন ধরুন যাকেই আপনি জিজ্ঞেস করুন, ডাক্তারি পেশাটা কেমন – ভ্রু দুটি কুঞ্চিত করে বলবে – ও ডাক্তার, ওরা তো সব কসাই। আর ইঞ্জিনিয়ার – মহাঘুষখোর। আইনজীবীরা হচ্ছে চামারের চামার। বাবার মামলাতেও নাকি ফি নেয়। আমলারা অহংকারী ও ঘুষখোর, ব্যবসায়ীরা মূর্খ আর সাংবাদিকরা সাংঘাতিক। তাহলে বলুন সমাজে ভালোটা কে? ওই যে, ওই ভদ্রলোক আপনাকে বলেছেন না, রেডলাইট ডিস্ট্রিক্টের নামকরণ আপনাদের কারণে হয়েছে – ওটা একেবারে ফালতু কথা।’

টিকিট চেকার বিস্মিত চোখে বললেন, ‘তাহলে আপনি বলছেন এই নাম আমাদের জন্য হয়নি।’

মাহিদুল কণ্ঠ দৃঢ় করে বললো, ‘আলবাৎ। আমি বলছি, কারণ আমি বিষয়টি জানি। শুনুন। বছর দেড়েক আগে আমি গোয়ালন্দের বেশ্যাপাড়া নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি করেছিলাম। ওদের জীবনযাপন আর আয়-রোজগার এসব নিয়ে আর কী। তখন আমাকে এ-বিষয়ে একটু-আধটু পড়াশোনা করতে হয়েছিল। ওই ভদ্রলোকটি আপনাকে এ-কথা কেন বলেছে সে-কারণ বলছি। কিন্তু আসলে এটি সত্যি নয়। সত্যি ইতিহাসটাও আপনাকে বলবো। উনিশ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকার কানসাস অঞ্চলে যখন রেললাইন পাতা হচ্ছিল তখন নাকি রেলের কর্মচারীরা যৌনকর্ম করার জন্য সন্ধ্যার পরে একটি লালবাতি নিয়ে গণিকা পল্লিতে চলে যেত। লাল রঙের বাতিটি তারা বারাঙ্গনার ঘরে যখন যেত তখন তার দরজার সামনে রেখে দিত। এর  পেছনে হেতু এই যে, যেহেতু বহুসংখ্যক লোকই এই কর্মে বেরিয়ে পড়ত, সেহেতু কখন কার প্রয়োজন পড়ে এবং দ্রুত কাজ সেরে ফেরত আসতে হয় – এজন্য নির্ধারিত সেই গণিকার ঘরের সামনে সেই লালবাতিটি রেখে দিত, যাতে সহজে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথমদিকে রেডলাইট ডিস্ট্রিক্ট সম্পর্কে এই ইতিহাসই লেখা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে অধিকতর গবেষণায় দেখা গেল যে, এই শব্দটির জন্ম আরো বহু বছর পূর্বে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম শহরে।’

হঠাৎ মাহিদুলের মনে হচ্ছিল, টিকিট চেকার মনে হয় তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন না। তার অনুমান সত্যি সত্যি অভেদ্য রূপে ফলে গেল। সে দেখল, টিটির দৃষ্টি একজন মহিলার দিকে। ভারিক্কি গোছের মাঝবয়সী একজন ভদ্রমহিলা ঢোঁড়া সাপের মতো তার কোমরখানা মুচড়ে মুচড়ে আসন থেকে বের হয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছেন আর টিটি সাহেব মহিলাটির ভারি নিতম্বের দিকে তাকিয়ে চোখের উদরপূর্তি করছেন। মাহিদুল মনে মনে হাসল। যৌবনের পড়ন্তবেলায়ও একজন পুরুষ আসলে পুরুষই থাকে। কখনো সাত্ত্বিক হয় না।

মাহিদুল টিটি সাহেবকে কপট ধমকের সুরে বললেন, ‘এই যে ভাই, শুনছেন আমার কথা?’ টিটি ঈষৎ অপরাধ মিশেল কণ্ঠে বললেন, ‘আরে মশাই অবশ্যই শুনছি। আমস্টারডাম পর্যন্ত শুনেছি, তারপর বলুন।’ মাহিদুল বলল, ‘অবশ্যই ইন্টারেস্টিং হিস্টরি, কিন্তু আপনার মনটা তো মনে হয় ইতিহাসে নেই। আপনার মন অন্য কোথাও। তো সেই ১৬৫০ সালের দিকে তখন ইউরোপের অন্যতম বাণিজ্যিক নৌবন্দর হচ্ছে আমস্টারডাম। নিত্যদিন শত শত জাহাজ এসে ভেড়ে বন্দরে। দু-চার-ছয় মাস অভুক্ত মাঝিমাল্লারা সব দিগি¦দিক ছোটে বিভিন্ন বেশ্যাপল্লিতে। আমস্টারডামে সেসময় যৌন ব্যবসায় রমরমা অবস্থা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেসময় স্বাস্থ্যবিধির বালাই ছিল না। নোংরা শরীর, জরাজীর্ণ পোশাক-পরিচ্ছদ, হলুদ দন্ত – এসব দেখলে তো আর কুঠিতে খদ্দের প্রবেশ করবে না। এজন্য গণিকারা এক অভিনব উপায় বের করেছিল। তারা তাদের সেই নোংরা পরিবেশ লুকানোর জন্য ঘরের ভেতর হালকা আলোর লালবাতি জে¦লে রাখতো। এতে আরেকটি সুবিধে হতো। অন্য কোনো খদ্দের যদি জানালা দিয়ে দেখতো ঘরের ভেতর লালবাতি জ¦লছে তখন সে আর ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করতো না।’

ওয়াশরুম থেকে মহিলাটি ফিরছিলেন তাঁর নির্দিষ্ট আসনে। সিন্ধি গাভীর ওলানের মতো ভরাট বুকের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে টিকিট চেকার খানিকটা ঢোক গিলে বললেন, ‘এ তো দেখতেছি খুবই ইন্টারেস্টিং হিস্টরি।’ মাহিদুল ও টিকিট চেকার যখন আলাপচারিতায় মশগুল ঠিক সেসময় ট্রেনের ভেতর হঠাৎ ভীষণ চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা গেল। বেশকিছু মানুষ হইহই করে উঠল। করোনা! করোনা! কেউ একজন বলল – ‘দেখুন দেখুন লোকটার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে।’ নীল চোখ মেয়েটির পাশে মুখে সাদা দাড়িওয়ালা যে প্রৌঢ়মতোন লোকটি বসে ছিলেন, দেখা গেল তাঁর মুখ দিয়েই রক্ত বেরুচ্ছে। যম আতংক করোনার ভয়ে সবাই দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছে। কেউ একজন চিৎকার করে বলল – ‘ট্রেনের চেইন টানো, একে বগি থেকে নামিয়ে দিতে হবে।’ কেউ একজন আবার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলছে – ‘আরে এরকম ফাঁকা জনপদে তাদের নামিয়ে দেওয়া কি মনুষ্যত্বের মধ্যে পড়ে।’ সবাই যখন লোকটাকে একদিকে ফেলে অন্যদিকে সরে এসেছে তখন মাহিদুল ধীরে ধীরে তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘মুরুব্বি কি শ^াস-প্রশ^াস নিতে পারছেন? আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? একটু পানি খাবেন?’ বৃদ্ধমতোন লোকটি এবার প্রথম মুখ খুললেন। বিস্মিত চোখে বললেন, ‘আমার মেয়েটা দৌড়ে কোথায় গেল? আপনারা সবাই ভূত দেখার মতো এমন দৌড় দিতাছেন কেন বুঝলাম না।’ ‘আরে কী বলছেন আপনি? আপনার হুঁশ আছে তো? মুখ দিয়ে আপনার রক্ত বের হচ্ছে অথচ আপনি বলছেন আমরা ভীতসন্ত্রস্ত হচ্ছি কেন?’ লোকটি নির্বাক দৃষ্টিতে বললেন –      ও এই কথা! এইগুলি রক্তটক্ত কিছু না ভাই। মুখে মাস্ক লাগাইয়া পান খাইতেছিলাম। আমার তো আবার একটু পরে পরে পিক ফেলার অভ্যাস। কিন্তু মনে ছিল না মুখে যে মাস্ক পইরা আছি।’ লোকটির কথায় বগির সমস্ত যাত্রীর বাক্বিহ্বলের মতো অবস্থা। আর মাহিদুল অবাকবিস্ময়ে দেখল, বৃদ্ধের মেয়েটি বগির পূর্বপ্রান্তের এক কোণে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।