একটু আগেই ড্রাইভারকে ছুটি দিয়েছিল সোহানা। সে জানত না আকরাম এতো তাড়াতাড়ি অফিস শেষ করে এসেই বলবে, ‘চলো, তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। অনেক কষ্টে সিরিয়াল পেয়েছি এখানে অনেক রোগীর ভিড়ে। এক মাস আগেই নাকি সিরিয়াল নিতে হয়। তোমার নয় নম্বর। অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছি। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।’ একটানে কথাগুলি বলে যায় আকরাম। যদিও এই কথাগুলিই আরো অনেকবার আকরামের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে একইভাবে। অফিস থেকে তাড়াহুড়ো করে এসে উদভ্রান্তের মতো।

‘তুমি তো আমায় আগে বলোনি। আমি ড্রাইভার ছেড়ে দিয়েছি।’

‘অসুবিধা নেই। একটুখানি পথ। আমরা রিকশায় যাব! তাছাড়া অনেকদিন তোমায় নিয়ে রিকশায় ঘোরা হয় না।’

আকরামের দিকে তাকিয়ে সোনিয়া ভাবল, গত তিন বছরে আকরাম ঢাকা শহরের খ্যাতিমান সব গাইনোকোলজিস্টের কাছে তাকে নিয়ে গেছে। সোনিয়া জানে এবারো কোনো ভালো খবর কিছুতেই আসবে না। তবু আকরাম কিছুতেই অস্থির হয় না। খুব ধৈর্যের সঙ্গে লাইনে বসে থাকে, কখনো কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেমন ইনোসেন্ট ভাব ওর মধ্যে। সংসারে যখন আর ভালো লাগার কিছুই নেই, তখনো কেমন নিজ থেকেই মনে করে নিল রিকশায় চড়ার কথা। সোনিয়া জানে, আকরামের ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। তবু এক অপার নিঃসঙ্গতার ব্যথায় সোনিয়া নিজে নিজেই ঢলে পড়ে।

সত্যিই ওরা অনেকদিন ধরে রিকশা করে ঘোরে না। রিকশায় ঘুরে বেড়ানোটা একসময় নিয়মিত ছিল। আংটি পরানোর পর বিয়ের আগে ওরা তিন মাস প্রেম করেছিল। হ্যাঁ, ঠিক ঠিক তিন মাসেরই প্রেম। সেই প্রেমের সময়টায় রোদে-বৃষ্টিতে-ছায়ায় অনেক ঘুরেছে ওরা রিকশায় চড়ে। আকরামের সান্নিধ্যেই হঠাৎ করে বসন্ত এসেছিল, যখন সোনিয়া ভাবত, চারদিকে কেবলই দিশাহীন কুয়াশা। আলো-অন্ধকারের দ্বন্দ্বে এক বিরাট খাদে পড়ে গিয়েছিল জীবনের প্রথমদিকেই। প্রথম যেদিন সে আকরামের সঙ্গে রিকশায় করে ঘুরেছিল, সেই দিনটি ছিল শুক্রবারের বিকেল। ওরা চন্দ্রিমা উদ্যানের দিকে গিয়েছিল। লোকজনের খুব ভিড় ছিল উদ্যানজুড়ে। তবু সন্ধ্যার একটু আগে আগে একটা নিরিবিলি জায়গা ওরা পেয়ে গিয়েছিল। ওমন রোমান্টিক সময়েও সোনিয়া তার নিজের অতীতের কিছুই লুকাতে চায়নি। আকরামকে সবই খুলে বলেছিল সে।

বাবার বদলির চাকরির কারণে সোনিয়ার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছিল খুলনায়। খুলনায় থাকা অবস্থায়ই হঠাৎ বাবা চলে গেলেন নরওয়েতে, এক বছরের ট্রেনিংয়ে। সোনিয়ার ভাই ছিল না। বড় বোন তখন চট্টগ্রাম মেডিক্যালে পড়ত। সোনিয়ার বয়স তখন আঠারো। আবেগে ভেসে যাওয়ার বয়স। এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়টায় সে কোচিংয়ে  যেত। তখনই একটা প্রেম হয়েছিল তার সহপাঠী দিলারার বড়ভাই সজলের সঙ্গে। সম্পর্কটার মধ্যে এতোটাই সে ডুবে গিয়েছিল যে, পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছিল খুব খারাপ। সজল লেদার টেকনোলজির শেষ বর্ষের ছাত্র ছিল। শ্যামলা রং, নীল জিনস আর কালো টি-শার্ট, চোখে হাই পাওয়ার চশমা, ভেতরে চোখদুটো ভাসা আর তীক্ষè-কোমল। সজলের সঙ্গে একটা দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক হতেই পারত। সোনিয়ার বাবা-মাও হয়তো আপত্তি করতেন না। তখন মোবাইল ফোনের এতোটা চল ছিল না। সজলের এক বন্ধু চিঠি-চালাচালি করত। তখন বয়সটা ছিল ভারি আবেগের। চারদিকে কেবলই গোলাপগন্ধ। জীবনের সহজ আর সুন্দর দিকগুলিই নিবিড়ভাবে স্বপ্নিল হয়ে থাকতো চোখেমুখে। কখনো ভাবেনি এক বিপদসীমার মাঝে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছিল সে। সহপাঠী দিলারা একটুও টের পায়নি বিষয়টা। কিছু না জেনেই সে একদিন সোনিয়ার ভুলটা ভাঙিয়ে দিয়েছিল; কিন্তু ততোদিনে সোনিয়ার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। কোচিং থেকে সে দুদিন সজলের মেসে গিয়েছিল। আর বয়সের আবেগে ডুবেও গিয়েছিল অনভিজ্ঞ শরীরী অন্ধকারে। তার একবারও মনে হয়নি সজল ড্রাগ অ্যাডিক্টেড। সজলের সান্নিধ্যে এতোটাই আনন্দে আত্মহারা ছিল যে, কোনো নোনতা অবিশ্বাস তাকে আতঙ্কিত করেনি। বরং সজলের মধ্যে এতোটাই বুদ্ধিদীপ্ততা ছিল যে, সোনিয়ার কখনো মনেই হয়নি কোনো আশঙ্কার কথা। তাই নিজের দিক থেকে সতর্ক ছিল না খুব একটা। তার নিজের দিক থেকে স্বপ্নগুলো ছিল রঙিন।

দিলারাই একদিন দুঃখ করে বলেছিল, ‘জানিস, এই মাসে আমার কোচিংয়ের টাকাটা আলমারি থেকে চুরি হয়ে গেছে। আমি তো জানিই যে সজল ভাইয়া ছাড়া কেউ এ-কাজ করেনি। সে ড্রাগ নেয় বলে বাসা থেকে সবসময় টাকা চুরি হয়ে যায়। আমার ভাইটা খুব অল্পদিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে গেল রে। আমরা এতো চেষ্টা করেও ফেরাতে পারলাম না।’ দিলারার এসব কথা শুনে সোনিয়ার মাথা ভোঁ-ভোঁ করল কিছুক্ষণ। তবু সে বিশ্বাস করতে পারলো না। সোনিয়া ছুটে গিয়েছিল সজলের মেসে। এভাবে হুট করে ছেলেদের মেসে যাওয়া ঠিক না – তা জেনেও সে দৌড়ে গিয়েছিল আর প্রচণ্ড ঝগড়া করেছিল এসব কথার রেশ ধরে। সজল অস্বীকার করেনি। বাজপোড়া গাছের মতো বিধ্বস্ত হয়ে ছিল। সোনিয়ার মনে হয়েছিল, তার নিজের ভেতর থেকে বের হওয়া বীভৎস চিৎকারে ফেটে পড়বে পৃথিবী।

এইচএসসি পরীক্ষার মাত্র পনেরো দিন বাকি। এই সময় সজল আত্মহত্যা করল। সজলের চরিত্রের অধঃপতন যেমন তাকে রাগিয়ে দিয়েছিল তার আত্মহত্যার খবরে সোনিয়া ভীষণভাবে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হলো। তার চোখ দিয়ে অনর্গল জল পড়ত। সজল ড্রাগ নেয় জানার পর সোনিয়া কোনো সম্পর্কই রাখেনি, তবু সজলের ভাবনা তাকে নিয়মিত গ্রাস করে ফেলত। ভাবনা তো আর যুক্তি মেনে আসে না। সোনিয়ার বাবা নরওয়ের ট্রেনিং থেকে ফিরে এসে দেখলেন মেয়ে খুবই অসুস্থ। সিক বেডে পরীক্ষা দিয়েছিল সোনিয়া। যাকে নিয়ে পরিবারের সবার আশা ছিল, সে কোনোরকমে টেনেটুনে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করল। ইউনিভার্সিটিতে সুযোগ পেল না। শেষ পর্যন্ত নীলক্ষেতে আইসিএমএতে পড়ল। সেখানে খুব মনোযোগের সঙ্গে খেটেখুটে পড়েছিল সোনিয়া, চেয়েছিল জীবনের ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে। ততোদিনে পরিবারের অনেকেই তার ওপর বিরক্ত। তার ওপর তাদের ভরসাও ছিল না। সোনিয়াও তাদের এসব ভাবভঙ্গিকে সহজভাবেই নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আইসিএমএতে খুব ভালো ফল করায় পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে সোনিয়ার চাকরি হয়ে গিয়েছিল ঢাকার এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। বেতনও বেশ ভালো। আকরাম ওর সিনিয়র সহকর্মী ছিল। নিজের ঘোরে ডুবে থাকা সোনিয়াকে কখন কীভাবে আকরাম পছন্দ করে ফেলেছিল, সোনিয়ার জানা নেই। বিয়ের সম্বন্ধটা আসে আকরামের পরিবারের পক্ষ থেকে। দুই পরিবারের মিলিত সিদ্ধান্তেই বিয়েটা হয়।

যেদিন আকরামের সঙ্গে সোনিয়া প্রথম বেড়াতে যায়, তার ভেতর প্রবল কুণ্ঠা ছিল। স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন সে ছিল শামুকের মতো, নিজের খোলের ভেতর। তাছাড়া নিজের জীবনের ঘায়ের যন্ত্রণাটা তাকে কুরে কুরে খেত। সজলের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা তাকে আর তেমনভাবে স্বাভাবিক হতে দেয়নি। মুখের সম্পর্ক ছিল সবার সঙ্গেই, কিন্তু মনের সম্পর্ক আর কারো সঙ্গেই গড়ে ওঠেনি। সেখানে আকরাম ওকে নিজেই পছন্দ করে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। আর তাই সোনিয়া তার সুশ্রী-সুন্দর মুখের আড়ালে থাকা সত্যগুলিকে একেবারেই আড়াল করতে চায়নি। প্রকৃত ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায় আকরাম ছিল একেবারেই তাই। সেই প্রথমদিন থেকেই আকরাম হয়ে উঠল সোনিয়ার আজীবনের বন্ধু। তার বার্নিশ করা আলকাতরার মতো গায়ের রং, খাড়া নাক, দীর্ঘ দেহ, পাজামা-পাঞ্জাবি, চমৎকার করে কথা বলার পারদর্শিতা – সব মিলিয়ে সোনিয়াকে দিয়েছিল স্বস্তি, সান্ত্বনা আর আশ্রয়।

সোনিয়ার ভীষণ ভয় ছিল নিজেকে নিয়ে। তার সবসময়ই মনে হয়েছিল, আকরামকে সে সুখী করতে পারবে না। কিন্তু বিয়ের পর তিনটি বছর অত্যন্ত সুখী ছিল তারা। সোনিয়ার শাশুড়িও বেশির ভাগ সময় সোনিয়ার সঙ্গেই থাকতেন। তবু কখনো মনোমালিন্য হয়নি। সোনিয়ার স্বাধীনতায় কোনোদিন বাধা হয়ে দাঁড়াননি তার শাশুড়ি। এমনকি আকরাম ভুলেও কখনো সোনিয়ার অতীতের প্রসঙ্গ নিয়ে কোনো অশান্তি করেনি। যখন-তখন রিকশায় সোনিয়াকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করত আকরাম। গাড়ি কেনার পর প্রায়ই ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে নিজেই গাড়িটা চালাত। রাতের দিকে লং ড্রাইভে শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেত তারা। তখন সোনিয়ার মনে হতো, সত্যিকারের ভালোবাসার স্বাদ সে পেয়েছে আকরামের কাছ থেকেই। যদিও অতীতের ভালোবাসার রক্তাক্ত দিকটা তার পাঁজরের হাড়গোড়কে খেয়ে নিত অনেক সময়।

আকরামের দিকে অপলক তাকিয়ে তন্ময় হয়ে এসবই ভাবছিল সোনিয়া।

‘আরে! দেখছ কী! তৈরি হয়ে নাও! বললাম না, তোমার নয় নম্বর সিরিয়াল!’

চমকে ওঠে সোনিয়া। ‘এই তো এখনই হয়ে যাব।’

আকরামের কথার পর চট করেই শাড়িটা বদলে নেয় সোনিয়া। বাসা থেকে বের হয়ে রিকশায় উঠেই দেখতে পেল মেঘলা আকাশটাকে। আর দেখতে দেখতেই হঠাৎ নামল বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি হওয়ার কোনো আভাসই ছিল না। দুদিন ধরে গরম পড়ছে বেশ। রাস্তার লোকজন হঠাৎ বৃষ্টির চমকে যার যার মতো ছোটাছুটি করতে লাগল নিরাপদ জায়গায় গা বাঁচানোর জন্য। রিকশাওয়ালার কাছে কোনো পর্দা ছিল না, তাই একটু একটু ভিজে যাচ্ছিল ওরা দুজনে। সোনিয়ার বেশ ভালো লাগছিল এই বৃষ্টি। দীর্ঘ বিষণ্ন দিনের ক্লান্তির পর এই বৃষ্টি।

আকরাম রিকশাচালককে তাড়া দিচ্ছিল আর বৃষ্টির ওপর খুব বিরক্ত হচ্ছিল, যেন এই অসময়ে বৃষ্টি নামল তার যাওয়ার তাড়া আছে বলেই।

সোনিয়া মুখটিপে হাসছিল। তারপর বলল, ‘আজ তো আমি ভেবেই নিয়েছি ডাক্তারের কাছে যাব না। আমার ভীষণ ভয় করছে। জানোই  তো ডাক্তারের বিষয়ে কী রকম তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে আমার! সত্যিই আমার খুব ভয় করছে।’

বৃষ্টির তোড়ে এক দমকা হাওয়া এসে আরেকটু ভিজিয়ে দিলো তাদের দুজনকে। অনেকদিন পর আকরামেরও ভালো লাগছিল এই সান্নিধ্য, এই বৃষ্টি, অনেক পুরনোকে নতুন করে দেখা।

‘তবু একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত সোনিয়া, আমার তাই মনে হয়।’ একটু থেমে থেমে বলল আকরাম।

‘কিচ্ছু লাভ হবে না আকরাম। আমার শরীরে যে-সমস্যাটা আছে তা থেকে সত্যিই মুক্তি নেই আমার। আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখেছি, যাদের এই রকম সমস্যা আছে তাদের মা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি কিছুতেই ক্ষমা করতে পারি না সেই ডাক্তারকে যে আমার প্রথম সন্তানটিকে আমার চোখের সামনে মরতে দিলো। বিশ্বাস করো আকরাম, আমি তখন বেডে, নার্সরা আমাকে টাটকা রক্তের ভেতর থেকে পরিষ্কার করছে আর আমি দেখতে পাচ্ছি আমার পাঁচ মাসের শিশুটি ট্রে-র মধ্যে অক্সিজেনের অভাবে নীল হয়ে যাচ্ছে। আমি কতবার বললাম, আপনারা ম্যাডামকে বলুন, ওকে এখনি ইনকিউবিটরে রাখতে হবে! ওকে বাঁচাতে হবে! আমি কত অনুনয় করলাম। নার্সদের শুধু একই কথা, আমরা ওনার অর্ডার ছাড়া কিচ্ছু করতে পারব না। ম্যাডাম এখন অপারেশনের রুমে আছে। আমি অসহায়ভাবে দেখতে থাকলাম এক ঘণ্টার মধ্যে আমার বাচ্চা আমার চোখের সামনে মরে গেল। কীসের থেকে কী হয়ে গেল! যখন আমি চেকআপে ছিলাম, অনেকবার বলতে চেয়েছি আমার সমস্যাগুলো। কিন্তু তিনি কিচ্ছু না শুনেই প্রেসক্রাইব করে ফেলতেন। যদি প্রথম থেকেই আমি বেডরেস্টে থাকতাম, যদি প্রথম থেকেই ইউটেরাসের এই সমস্যাটির জন্য ব্যবস্থা নেয়া হতো, তাহলে কখনো এমন হতো না আকরাম! কী সুন্দর একটা ফুটফুটে শিশু থাকত আমার! মনে পড়ে, একদিন ফজরের নামাজের পর তুমি বলেছিলে, সোনিয়া, আমাদের মেয়ে হবে। আমিও যেন জেনেই নিয়েছিলাম আমার মেয়েই হবে। আমি ওর নাম রেখেছিলাম নওশিন। আর সত্যি সত্যিই মেয়ে হলো। কী করে আমি ভুলব? তুমি ভুলতে পার আকরাম? ট্রে-র ভেতরে নীল হতে হতে আমার মেয়েটা চোখের সামনে মরে গেল! তারপর ওর জানাজা হলো। খুব সুন্দর জায়গা দেখে আমরা তাকে কবর দিলাম। এই দুঃসময়গুলো আমি কী করে ভুলব আকরাম! জানো আমি ঘুমের মধ্যেও ঝুমঝুমির শব্দ শুনি! কতদিন ভালো করে অফিস করতে পারছি না। নিজের ভেতরে এক অপরাধবোধ আমাকে বিকলাঙ্গ করে দিচ্ছে। উহ্, এতো শূন্যতা! তুমি আমায় ভালোবেসে সব দিয়েছ, আমি তোমায় কিছুই দিতে পারলাম না আকরাম!’

কাঁদতে কাঁদতে সোনিয়ার স্বরটা বন্ধ হয়ে আসতে চায়। বৃষ্টি-বাতাসে ওরা প্রায় ভিজেই গেছে। দুজনের চোখেই জল। বৃষ্টি জলটুকু আড়াল করে দিয়েছে।

দুই

এরপর গত কয়েক বছরে সোনিয়া আকরামের অনুরোধে আরো অনেকবার ডাক্তারের কাছে গেছে। কোনো লাভ হয়নি। মাঝে মাঝে আকরামের গলা জড়িয়ে ধরে সোনিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, ‘বলতে পারো আমার পাপটা কী? আমার কেন এমন হলো?’ কেঁদে কেঁদে বুকের পাথরটাকে ক্ষয়ে ফেলতে চেয়েছে। আকরামের গভীর ভালোবাসার মাঝেও সোনিয়ার জীবনের একটি অংশে মরুভূমি রয়েই গেছে। একটা গভীর দুঃখ অন্তরে পুষে রাখতে রাখতে চারদিকের সবকিছুর ওপরই সোনিয়ার আজকাল ভারী অভিমান হয়। মাঝে মাঝে শরীরটা কেমন হঠাৎ হঠাৎ ঘেমে ওঠে। জোরে কথা বললে কাঁপতে থাকে সারা শরীর। সোনিয়ার বড় বোন নিউরো সার্জন। আজকাল সে-ই তাকে দেখাশোনা করে, নার্ভের ওষুধপত্রও দেয়।

এক বিকেলে সোনিয়ার জন্মদিনের এক সপ্তাহ আগে, তার বড় বোন হঠাৎ করেই আকরামকে প্রস্তাব দিলো, ‘আকরাম, সোনিয়ার শরীরটা ভালো থাকছে না। চলো, আমরা সবাই মিলে কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি। এতে সবারই একটু ভালো লাগবে। এখন অফ সিজন। ভিড়ও কম।’ আকরাম খুশিমনেই যাওয়ার আয়োজন করল। ঢাকা থেকে পরিবারের অনেকে মিলে বেশ মজা করতে করতেই গেল ওরা।

সমুদ্রের নীলের দিকে তাকিয়ে কেমন তন্ময় হয়ে থাকল সোনিয়া। অনেকে এদিক-ওদিক বেড়াতে গেল। শপিং করল। আকরামও গেল ওদের সঙ্গে। সোনিয়া গেল না। কীসের টানে ভূতগ্রস্তের মতো পড়ে থাকল সমুদ্রের পাড়ে দু-তিনদিন। সমুদ্রের নীল আর ঝাউয়ের বাতাস মিলে এক তুমুল শূন্যতার জালে আটকে পড়ল সোনিয়া। প্রতিদিন ভোরেই সূর্য ওঠার দৃশ্যটা দেখার জন্য একাই চলে যেত সমুদ্রের কাছে। আকরাম বলেছিল, ‘যাওয়ার সময় আমায় নিয়ে যেও। একা যেও না।’ কী জানি কেমন করে সে একটু একটু করে এগিয়ে গিয়েছিল সমুদ্রের দিকে। কাউকে না জানিয়ে। একদিন ভোরে সূর্য ওঠার কিছুক্ষণ পরে লোকজনের তুমুল হইচই। ছুটে এলো অনেকে। আকরাম চেয়ে দেখল, অবিরাম স্রোতের পাশে একটা শরীর। সোনিয়ার! হ্যাঁ, এটা সোনিয়ারই! মৃতদেহ! না, এখনো বেঁচে আছে! সবুজ সালোয়ার, সবুজ কামিজ, গোলাপি ওড়না। সমুদ্র তাকে নিয়ে নিল। কী করে! তবে কী আত্মহত্যা! আত্মহত্যা নয়! কী জানি! আপনমনে বিড়বিড় করে আকরাম। তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। সমুদ্রের স্রোত তখনো দূর থেকে ভেসে আসা তীব্র হুইসেলের মতো সোনিয়ার মাথার মধ্যে ঝমঝম করছিল। সেই স্রোত নিঃশব্দে আঁচড়ে তৈরি করে নিয়েছিল অন্য এক মৃত্যুর রূপ। অতল জলের ভেতর পাক খেয়ে খেয়ে ধেয়ে আসছিল মৃত্যু। নার্সিং হোমের বেডে চোখ মেলে তাকিয়ে সোনিয়া দেখল সব প্রিয়জনের মুখ। তখনো এই প্রিয় দৃশ্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকছে তার জীবনের অতলে পড়ে থাকা সব মৃত্যুদৃশ্য। মাথার মধ্যে বারবার হানা দেওয়া সেই দৃশ্যকে সোনিয়া আর দেখতে চায় না। জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে সকালের মিষ্টি আলো। তার জন্মদিনের ফুলগুলো টেবিলের ওপর সাজানো। ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে সোনিয়ার মনে হলো তার যেটুকু আনন্দময় জীবন আছে তা নিয়েই সে ঢুকে যাচ্ছে বর্ণময় পৃথিবীর মধ্যে। রঙের পিপাসায় ভরে উঠেছে তার বুক।