রেহানা ও তার গাছ

তখনো একটা মুনিয়া পাখি তেঁতুলগাছের মাথায় বসে একগুঁয়ের মতো আলোর একটা প্রান্ত টেনে ধরে রেখেছিল। নয়তো সন্ধ্যা কবেই নেমেছে। বাড়ির আঙিনায়, গোয়ালঘরে, বাঁশঝাড়ে, সর্বত্রই। শুধু গাঙ্গুলিদের বাড়ির মস্ত তেঁতুলগাছের পেছনে ক্ষেত থেকে তুলে আনা পাকা টমেটোর মতো একফালি আকাশ। মুনিয়া পাখির দাপাদাপি আর অসময়ের গানে বিকেলটা যেন থেমে আছে সেখানে।

সন্ধ্যার শিহরণ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকলে চারদিকে, বনধনিয়ার ঝোপ থেকে চৌকিদারের বাঁশির মতো তীব্র প্রলম্বিত চিৎকারে একটা ঝিঁঝিপোকা দিনের সমাপ্তি ঘোষণা করে। ঝিঁঝির এই চিৎকার গোলপুকুরে সন্ধ্যার আকাশের দিকে মুখ তুলে খাবি-খাওয়া মাছের ঝাঁক ছুঁয়ে আছড়ে পড়ে রেহানাদের বাড়ির দাওয়ায়, কুপির মø­ান আলোতে শুয়ে থাকা রেহানার মুষ্টিবদ্ধ হাতে, উল্টে থাকা চোখের মরা সাদাটে অংশে, এলোমেলো চুলে, চিবুকে আর পায়ের তালুতে।

 সাপের মসৃণ শরীর ঝোপের ভেতরে মানুষের ভয় সরিয়ে সরিয়ে আড়াল-আবডাল অতিক্রম করার সময়ে যেরকম হঠাৎ দৃষ্টিগোচর হয়, রেহানার পা-দুটো সেভাবেই চোখে পড়ে মৌলভি সাহেবের, বৈঠকখানার ছিটের পর্দার দুলে ওঠার ফাঁকে ফাঁকে। ছোট ছেলেটা পান সেজে দিয়ে যাওয়ার পর সেদিকে তাকিয়ে তিনি কিছুক্ষণ কোনো এক দুর্ভাবনার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে গুম হয়ে বসে থাকলেন। তারপর তাঁর প্রাণপণ চেষ্টার ফলেই কি না কে জানে বাতাসে হালকা আতরের গন্ধ ছড়িয়ে মনটাকে এই সন্ধ্যার পরিপার্শ্বে ফিরিয়ে এনে দুই আঙুলের ফাঁকে একটা পান তুলে আনলেন শেষমেশ। সুরমার পোঁচ দেওয়া অন্ধকার চোখ তুলে হারেস মিয়ার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে চমকে ওঠেন মৌলভি মোহাম্মদ উল্লা। নিজের মনের মধ্যে একটা কিছুর অস্বস্তি চাপা দেওয়ার জন্য মৌলভিকে কিছু একটা করতে হয়। কী করবেন ভাবতে ভাবতে শৈশবে মক্তবে পড়া দরুদগুলো পরপর আওড়াতে আওড়াতে এক-একবার প্রায় ভুলই করে বসেন। গ্রীষ্মের এই অসহনীয় গরমে অস্বস্তির একটা প্রবাহ ঘামের মতো তাঁর ঘাড় থেকে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায়। দূরে প্রচ্ছন্ন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা তেঁতুল গাছটার নিচ থেকে ঝিঁঝিটা দ্বিতীয় দফায় তার বাঁশি বাজাবে বলে এলোমেলো দু-একটি চিৎকার দিয়ে পরিবেশটাকে বুঝে নিতে চেষ্টা করে।

দুই

রেহানার রোগটা মাঝে মাঝে আসে। তার শরীর তখন নিজের কব্জায় থাকে না। প্রথম কখন সে নিজের শরীরে এই অদ্ভুত ব্যাধি আবিষ্কার করেছিল তা এখন আর মনে পড়ে না। যদিও প্রথম ঘটা বহু কিছুই এখনো স্পষ্ট মনে আছে তার। মনে আছে প্রথম যেবার মুন্সীবাড়ির মেয়ে কুলসুমের বিয়েতে হিজড়ারা নাচ দেখাতে এসেছিল দূর কোনো মফস্বল এলাকা থেকে। রেহানা এখনো তার খুঁটিনাটি মনে করতে পারে। হ্যাজাকের অপরিচিত তীব্র আলো – তাও তো তার অভিজ্ঞতায় ছিল নতুন। তারপর সেই ঝুপঝুপ নাচ বহুক্ষণ ধরে চলেছে। এমনকি রেহানার ঘুমের মধ্যেও তার বিরতি ছিল না। পরে তার দাদি মেহেরজানের শখ মেটাতে হিজড়ারা এই আঙিনা জুড়েও আসর বসিয়েছে। মেহেরজানকে নিয়ে তাদের গানটিও ভুলবে না রেহানা।

মেহরজা রে মেহেরজা

তোর পা দেখি খালি

পায়ের মল কিন্যা দিমু

আমার লগে গেলি রে মেহেরজা

কাইল তোরে চড়ামু বাইচের নাও।

এখন রেহানার মনে পড়ে না কবে সে প্রথম তাদের বৈঠকখানায়, বাড়ির আঙিনায় তেঁতুলগাছটার জমাট ছায়ার আড়ালে নিজের নিঃসাড় শরীর নিয়ে আছড়ে পড়েছিল। চেষ্টা করলে সে মনে করতে পারে শিরীষের ডালের মতো মেহেরজানের মসৃণ বাহুগুলো। বহু রাতে দাদির বাহু জড়িয়ে শুয়ে শুয়ে অচল মোহরভর্তি কলস আর যক্ষের গল্প শুনেছে সে। নাচতে থাকা মোহরভর্তি কলস সে এখনো পরিষ্কার দেখতে পায়। কিন্তু সে মনে করতে পারে না হিজড়াদের ঘুঙুরের শব্দ তেঁতুল গাছটার ঘন কালো ছায়ার ভেতর কবে প্রথম অচল মোহরভর্তি কলসের নাচের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। কবে হ্যাজাকের আলোয় হিজড়াদের লম্বা ছায়াগুলো বাঁশঝাড়ের আড়ালে ঝুলে থাকতে দেখেছে সে! তারপর সেই ঝুলে থাকার কোনো শেষ হয় না। সুনসান দুপুরে হঠাৎ সেখানে গেলে এখনো সেই রকমভাবে ওই ছায়াদের দেখা যাবে।

তিন

আছরে পাওয়া মেয়ে বলেই রেহানা অন্যদের মতো একরকমভাবে ফুটে ওঠেনি। স্বাভাবিকতার মধ্যেও ওর জীবনটা কোথাও যেন টোল খেয়ে গেছে। হোক না সে কালো আর রোগাটে, কিন্তু শ্রীহীন কখনোই মনে হয় না রেহানাকে। কাছ থেকে দেখলে ঘন কালো মায়াময় বড় ভাসা ভাসা চোখের দিকে বারবার তাকানোর ইচ্ছেটা লুকোতে হবে। তবু লোকজনের চোখে রেহানা কালো আর কুরূপাই। সে-কারণে সম্বন্ধ যা এসেছে তা ধরে রাখতে পারেনি হারেস মিয়া। স্কুলশিক্ষক, রেলওয়ের কেরানি, কন্ট্রাক্টর, সৌদিতে থাকা পাত্র পেলেও তাদের ডিমান্ড অনেক হাই। অথচ স্থাবর সম্পত্তি বলতে গাঙ্গুলিদের রেখে যাওয়া এই বাড়িটা, যার একটা অংশ পোড়ো আর বিঘা কয়েক ধানিজমি। তাই বেচার মতো তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই আর। কেবল হতশ্রী কয়েকটা বাঁশঝাড় আর একটা প্রকাণ্ড তেঁতুলগাছ এখনো রয়ে গেছে।

গাছটা পুরোনো আর মোটা। বিক্রি করলে নগদ কিছু কম পাওয়া যাবে না। অন্তত আইবুড়ো কন্যাকে পার করা যাবে হয়তো। কিন্তু কী একটা অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করে গাছটা বিক্রির কথা উঠলে। সেই খচখচানি দূর করতেই নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয় তাঁকে। আর এভাবেই দরকারি কাজের তালিকা থেকে সে-ভাবনাটা বাদ পড়ে অলক্ষ্যে। বলা যায়, হারেস মিয়া ভুলেই যান একরকম। তবে এসবে রেহানার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। লালচে বেলে দোআঁশ মাটির হাঁটাপথটা দিয়ে হেঁটে হেঁটে অনেকের কৌতূহল, অবজ্ঞা আর অসহিষ্ণুতাকে আনমনে মাড়িয়ে স্কুলের দিকে সে এগিয়ে যায় ধীর-অভ্যস্ত পায়ে। সেই হাঁটার ভঙ্গিতে বোঝা যায় না স্কুলের প্রতি রেহানার বিশেষ কোনো আবেগ আছে কি না। যদিও স্কুলেই রয়েছে তার সেই সহকর্মীরা, অসুস্থতার অজুহাতে যারা তাকে চাকরিচ্যুত করতে চেয়েছে বহুবার। তারপরও রেহানা অতোদূর থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে পড়াতে আসে বলে স্কুল সম্বন্ধে তার আবেগের বিষয়টা সকলে বুঝতে চেষ্টা করে। এবং এও ঠিক, এসব বোঝাবুঝির ওপরই পরবর্তী সময়ে দলে আরো ভারী হয়ে আরো তীব্রভাবে নতুন উদ্যমে রেহানাকে চাকরিচ্যুত করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া অনেকাংশে নির্ভর করে।

কিন্তু রেহানা নির্বিকারভাবে আসে-যায়। মাঝে মাঝে হাঁটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে বাড়ির দিকে, ফিরতি পথের দিকে চেয়ে থাকে একদৃষ্টে। মাঝে মাঝে কালো পিচের সদর রাস্তায় উঠে এসেও সে পেছন ফেরে। তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে একমনে।

চার

রেহানা ঠিক নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে না এটা কবেকার কথা। সেটা হিজড়াদের আসার বছরে কিংবা ম্যাট্রিক পরীক্ষার লম্বা ছুটির সময়টা জুড়ে ঘটে থাকতে পারে। অথবা যে-বার মুন্সীবাড়ির শিমুল গাছটা থেকে উড়ে আসা তুষারকণার মতো শিমুল তুলাতে তাদের বাড়ির চাল, আঙিনা সব ঢেকে গিয়েছিল তার কিছুদিন পর। রেহানা ঠিক মনে করতে পারে না। হয়তো মনে করতে চায় না এখন আর। তবে সেই দিনটার কথা সে কী করে ভোলে। তখনো রেহানা ঢ্যাঙা তালগাছের মতো। তখনো বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে একটা হলদে হয়ে আসা বটের পাতা এসে পড়ছিল পুকুরের জলের ওপর। বহুদূর থেকে। বহু উঁচু থেকে পড়তে পড়তে জলের ওপর পাতাটি নিজের প্রতিবিম্বও তৈরি করছিল। ল্যান্টেনার ঝোপের ধারে ছড়া কাটছিল একদল ছেলেমেয়ে –

ওই গাধাটা গাধা

গলায় দড়ি বাঁধা।

ওই বাঁদরটা বাঁদর

গায়ে সাদা চাদর।

আর সেই মুহূর্তে পাড়া-বেড়ানো, খুনসুটি করা, কালো আর ঢ্যাঙা রেহানা থমকে দাঁড়িয়েছিল তেঁতুলগাছটার গাঢ় ছায়াতে। মহিলাদের স্নানের জন্যই যেন এই স্থানটা এমন নির্জনতা দিয়ে ঠাসা। রেহানা কতবার অবলীলায় পোশাক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, তেঁতুলগাছটার ঘন ছায়া থেকে ঝাঁপ দিয়েছে দুপুরের নির্জন পুকুরে। কেউ দেখেনি। কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায় না কেউ দেখেনি। তাছাড়া দেখলেও-বা কী যায়-আসে! তেঁতুলগাছটার ছায়ায় দাঁড়ালে দূর থেকে তাকে দেখা যাওয়ার কথা নয়। কেমন বেঁকেচুরে ওই ছায়াটা তার শরীরের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। তবু দুপুরের এই নীরব মুহূর্তের কথা হয়তো আরো কেউ জানত। যখন টলটলে গোলপুকুরের জলের ওপর একটা হলুদ পাতা খসে পড়ছিল আর বাচ্চারা ছড়া কাটছিল ল্যান্টেনার ঝোপের পাশে।

প্রথমে তার মনে হয়েছে তেঁতুলগাছটা ফাঁক হয়ে লোকটাকে উগরে দিয়েছে তার সামনে। নবজাতকের মতো আশ্চর্য ভঙ্গিমা ছিল লোকটার। যেন জন্ম হয়েছে ঠিক সেই দুপুরে। বটের হলদে পাতাটি ঝরে পড়ার বিরতিটুকুতে, ল্যান্টেনার ঝোপের ধারে বাচ্চাদের ছড়া কাটার শব্দের মধ্যে।

লোকটা মানে ফিরোজ সম্পর্কে রেহানার ফুপাতো ভাই। এলোমেলো চুল আর কেমন উ™£ান্তের মতো চেহারা। তবে সারাদিন কেবল বইয়ের পাতায় চোখ থাকত তার। বিএ পাশ করে শহরে চাকরির চেষ্টা করে বিফল হয়েছে সে। ঈদের ছুটিতে রেহানাদের বাড়িতে ঠিক কয়দিনের জন্য এসেছিল সে সেটা তখন নিজেও জানত না। তবে বছর গড়িয়ে গেলে সবাই আবিষ্কার করেছিল ফিরোজ রেহানাদের বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা। বাড়িতে থেকে গ্রামের একটা স্কুলে প্রায় বিনা বেতনে চাকরি আর টিউশনিও শুরু করেছিল সে। কিন্তু কী করে এসবের মাঝখানে রেহানা ফিরোজকে একেবারে নতুন করে আবিষ্কার করল। সেদিন বিকেলে তেঁতুলগাছের ঘন ছায়ার ভেতর ফিরোজ তাকে কোনো কিছু ভাবারই সুযোগ দেয়নি। তার ভেজা নগ্ন শরীরটা এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিল যেন এটা বহুকালের অভ্যাস। কোনো জড়তা আর কুণ্ঠার লেশমাত্র ছিল না ফিরোজের আচরণে।

বিকেল পার করে বহুক্ষণ পর রেহানা বাড়ি ফিরেছিল সেদিন। তেঁতুলগাছটার ওপর একটা কুটুম পাখি কয়েকবার গান গেয়ে উঠল তার প্রস্থানপথের দিকে তাকিয়ে। রেহানা শুনছিল কি শুনছিল না বোঝার উপায় নেই। তবু লুটিয়ে পড়া আঁচল ঠিকঠাক করে পেছনে ফিরে দেখার ইচ্ছাটা বিলুপ্ত হয়েছিল। বস্তুত লক্ষ করলে বোঝা যেত তার চলার ভঙ্গিতে, হাত দুটো ডানার মতো করে মাথাটা একপাশে কাত করে হাঁটার ভঙ্গিতে, ভেসে থাকার একটা ইঙ্গিত ছিল। যেন সে তখন দীর্ঘাঙ্গী এক রাজহংসী।

পাঁচ

তুষারকণার মতো হালকা শিমুল তুলাতে ভরে গিয়েছিল তার ম্যাট্রিকের ছুটির দিনগুলোর অবসর। কেবলই এক ভেসে বেড়ানোর মত্ততায় পেয়ে বসেছিল এসব শিমুল তুলাকে। কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখলে রেহানা মনে করতে পারে না আদৌ এসব শিমুল তুলার কোনো অস্তিত্ব ছিল কি না। তাছাড়া মুন্সীবাড়ির শিমুলগাছটা ভেঙে পড়েছিল তারও বহু আগের কোনো এক ঝড়ে। অথচ এখন হালকা তুষারকণার মতো একঝাঁক শিমুল তুলা ঠিকই দেখতে পায় সে। হ্যাঁ, ম্যাট্রিকের ছুটির অবসরের এই সময়টাতে ছবি আঁকতেও শুরু করেছিল সে।

ফিরোজ তাকে বলেছিল অক্ষরের মধ্যে ছবি লুকিয়ে থাকে। পথের পাঁচালি বইটা দেখিয়ে সে বলেছিল, এই বইয়ের ভেতরে গোটা এক গ্রাম আছে। নাম নিশ্চিন্দিপুর। দিগন্তজোড়া মাঠ আর কাশবনের ছবিও আছে সেখানে। অথচ রেহানা বইটা উল্টে প্রথমে কোনো ছবি খুঁজে পায়নি। ফিরোজ বলেছিল, অক্ষরগুলোকে ভেতরে ঢুকতে দিতে হবে। তার মনের ভেতরে। আর তখন চোখ বন্ধ করলে সে ছবিগুলো দেখতে পাবে। আশ্চর্য, সেটা ঘটেও ছিল। আর তখন থেকেই রেহানার ছবি আঁকার শুরু।

কাশবন, মাঠ আর নদী আঁকতে আঁকতে একদিন সে আঁকল একটা পাখি। তারপর তার ডানাতে বেগুনি হলুদ কমলা সবুজ আর নীল রং মিশিয়ে বিচিত্র আর বর্ণিল করে তুলল পাখিটাকে। ফুলস্কেপ সাদা কাগজের ওপর পাখিটা ওভাবেই দিন কয়েক রয়ে গেল পড়ার টেবিলে। তারপর ভূগোল বইয়ের ভেতর অস্ট্রেলিয়ার জীবজন্তুর গা থেকে হালকা কালো কালি নিয়ে ঝুলে রইল চাটাইয়ের গায়ে ক্যালেন্ডারের পাশাপাশি। ওভাবে ওটা থেকে যেত হয়তো আরো বহুদিন দুপুরের রোদে, সন্ধ্যায়, মক্তবের ছাত্রদের আজানে জেগে ওঠা ভোরের আলোয়। কিন্তু একদিন বৈশাখের দুপুরে হঠাৎ শুরু হওয়া দমকা বাতাসে পাখিটা শেষমেশ জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। চাটাইয়ের গা থেকে উড়ে যাওয়ার আগে একবার রেহানার মাথার চারপাশে ভোঁ চক্কর দিয়ে লম্বা উড়ালে বাঁশঝাড়ের মাথা পার হয়ে অদৃশ্য হয়েছিল দুধমুখার বিরান বিলের দিকে। পাখিটা শেষমেশ কালোই ছিল দেখতে।

ম্যাট্রিকের ছুটির অবসরে এমন পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর মত্ততায় পেয়ে বসেছিল রেহানাকে। না পাখির মতো নয়, শিমুল তুলার মতো ভাসছিল সে। মানে কেউ তাকে ভাসিয়ে নিচ্ছিল। অথচ এ-তল্লাটে চার-পাঁচ মাইলের মধ্যে শিমুলগাছ নেই। হয়তো তখনো ছিল না। মুন্সীবাড়ির গাছটাও ভেঙে পড়েছিল বহু আগের কোনো এক ঝড়ে। তবুও ওই তুষারকণার মতো হালকা তুলা মাঝে মাঝে ফেটে পড়ত আর ছড়িয়ে পড়ত দিগি¦দিক। মাঝে মাঝে তুলাগুলো তার মাথার ভেতরে ঢুকে পড়ত। সেখানেই  ফুলে ফুলে একটা বালিশের আকার ধারণ করত। তখন ভীষণ ভারী মনে হতো রেহানার মাথা। হয়তো ভেসে বেড়ানোর ওই সময়টাতে রেহানার অসুখেরও শুরু। তবে এসব কথা সে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে না।

ছয়

গাঙ্গুলিরা পার্টিশনের পর ইন্ডিয়া চলে গেলেও তাদের মৃত স্বজনরা যে এই পোড়ো ভিটার মায়া ছাড়তে পারেনি তা এখন সকলেই জানে। রেহানার ঘনঘন ফিট হওয়া, রাতবিরাতে ঘুমঘোরে হাঁটাচলা করা, এসব চিকিৎসাতীত লক্ষণের মধ্যেই গ্রামবাসী গা-ছমছমে সব গল্পের উপাদান খুঁজে পেয়েছিল। মোহাম্মদ উল্লা মৌলভির জিন হাজিরার পর এসব গল্প গ্রামের বাড়িগুলোর কালো মাটির পুরু দেয়ালের গায়ে গোবরজলের মতো লেপ্টে রইল বহুদিনের জন্য।

সেদিনকার জিন হাজিরার গল্প এরপর বহুদিন বটতলার চা-দোকানগুলোতে ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল। চা-খাওয়া লোকের শখ ছিল না তখন আর। শখ থেকে তা পরিণত হয়েছিল অভ্যাসে, আর অভ্যাস থেকে নেশায়। সে-নেশায় বুঁদ হয়ে তারা তেঁতুলগাছের কালো বাকল ঠিকরে আসা রহস্য আর ভয়ের অর্থ বুঝতে পারে। গল্পের আসরে জিনের শরীরের দৈর্ঘ্যও আশ্চর্য রকমের বড় হতে থাকে। লোকে বলে, রেহানাকে যে জিনে পেয়েছিল তার মাথা বাঁশঝাড় ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মোহাম্মদ উল্লা মৌলভি এই জিনকে ডেকে আনার জন্য রেহানাদের বাড়িতে সেদিন ভোর থেকে জিকির শুরু করেছিলেন। একপর্যায়ে রেহানা বাদে সব মহিলাকে বের করে দেওয়া হয় বাড়ি থেকে। বেলা দশটার পর জিকির করতে করতে মৌলভি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন জায়নামাজ থেকে। এই সময়ে পালঙ্কের চারপাশে ঘুরে ঘুরে রেহানার সংজ্ঞাহীন দেহকে মাঝখানে রেখে তিনি জিকির করেন। বারোটার পর মৌলভির জিকিরের ধ্বনিগুলো বোমার শেলের মতো তীব্র আর ভারী হয়ে উঠেছিল। এই সময়ে উন্মত্তের মতো লাফাতে হয়েছিল তাঁকে। গোলা ছুড়ে দেওয়ার পর কামান যেভাবে নেচে ওঠে, সেভাবে। তাঁর পরনের পোশাক পেঁয়াজের শুকনো মরা খোসার মতো ঝরে পড়েছিল। পুরো বাড়িটা তখন মাটি থেকে এক ইঞ্চি ওপরে উঠে গিয়েছিল ধীরে ধীরে। মৌলভি যেদিকে ঘুরছিলেন বাড়িটাও ঘুরছিল সেদিকে। সকলেই বুঝেছিল, হ্যাঁ এবার জিন এসেছে।

সাত

ল্যান্টেনার ঝোপের ভেতর দিয়ে একটা গিরগিটি গলা বাড়িয়ে বারকয়েক দেখল রেহানাকে। মাথাটাকে ঘোরাল একবার ডানে, একবার বাঁয়ে। ভঙ্গিটা অনেকটা ‘আহা চুক চুক’ সান্ত্বনার মতো; কিন্তু সান্ত্বনা সে চায় না কারো কাছ থেকেই। আর সে তো সান্ত্বনা পাওয়ার জন্যও আসেনি। সে এসেছিল এই ল্যান্টেনার ঝোপের ধারে ছড়াকাটা ছেলেমেয়েগুলির কথা মনে করে। একটি হলদে বটের পাতার কথা মনে করে। তেঁতুলগাছের ঘন জমাট ছায়ার কথা মনে করে। আর হ্যাঁ, সেই দুপুরের কথা মনে করে। কিন্তু সেই দুপুরের কথা এরই মধ্যে রেহানা ভুলে গেছে। অন্তত ভুলে যেতে চায় সে। কিন্তু আশ্চর্য, একটা লোকের জন্ম হলো যেন সেই দুপুরবেলায়! পাটকাঠির মতো সরু হাত। অদ্ভুত মায়াময় চোখ। এলোমেলো চিরুনির স্পর্শ না পাওয়া চুল। কীরকম বিহ্বল দৃষ্টি। নবজাতকের ভঙ্গিতে সে এসে পড়েছিল তেঁতুলগাছটার কাণ্ড ফুঁড়ে। রেহানার স্নানের মুহূর্তে। একটা কুটুম পাখিও ছিল তেঁতুলগাছের ডালে। পাকা তেঁতুলের লোভে রোজ আসত। রেহানা তার জন্যও এসেছে। সেই বিহ্বল লোকটা চলে যাওয়ার পর পাখিরও যেন প্রয়োজন ফুরিয়েছে। নয়তো বহুদিন সে এখানে না এসে থাকতে পারে না।

ফিরোজের চাকরি হয়েছিল কোনো এক চা-বাগানের স্কুলে। পাটকাঠির মতো থরথর করে কাঁপা কাঁপা হাতে মামা হারেস মিয়াকে কদমবুসি করেছিল শেষবার যাওয়ার আগে। কেমন যেন বিনীত বিগলিত ন্যুব্জ দেহ। চাইছিল বুঝি মাটির সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দেয় একেবারে। দূরসম্পর্কের এই ভাগ্নের জন্য হারেস মিয়ারও মায়া পড়ে গিয়েছিল। বিধবা বুবুর এই ছেলেটিকে তালতলার চা-বাগানের স্কুলে মাস্টারি জুটিয়ে দিতে পেরেছিল সে। তাই বুঝি মরমে শ্লাঘায় ফিরোজের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও কেঁদে ফেলেছিল। কান্নাধোয়া মুখে ফিরোজ রেহানার দিকে তাকাতেও যেন ভুলে গিয়েছিল। কৃতজ্ঞতার ভারে নোয়ানো পিঠটা মাটি থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। ফিরোজ ভুলে গিয়েছিল রেহানার কাছ থেকে বিদায় নিতে। তখন তার বাবার সামনে শুধু নয়, এমনকি এর কয়েক দিন আগে থেকে নিভৃতে, তেঁতুলগাছের আড়ালে, বাঁশঝাড়ে সবখানেই রেহানা তার জন্য অপেক্ষা করেছে। কিন্তু বিহ্বল লোকটির প্রয়োজন ফুরিয়েছিল বুঝি। কেবল যাওয়ার সময়ে বৈঠকখানার দেয়ালের ফোকরের মধ্যে অযত্নে বহুদিন পড়ে

থাকা পুতুল দুটির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘যাচ্ছি তাহলে!’

ফিরোজ চলে যাওয়ার পর তার নতমস্তক, ধীর পদক্ষেপ, বাবার পা ধরে কদমবুসি করে হাতটাকে ঠোঁটের কাছে নিয়ে চুমো খাওয়া – এই সমস্ত কিছুই তাকে তুচ্ছ আর মামুলি করে তুলেছিল রেহানার কাছে। লোকটার জন্য কষ্ট হওয়ার বদলে এক ধরনের করুণা কিংবা অনুকম্পা বোধ করেছিল সে।

আট তেঁতুলগাছটা কাটা হয়েছিল নির্বিঘ্নে। মৌলভি মোহাম্মদ উল্লা নগদ টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন গাছটা। হারেস মিয়া কৃতজ্ঞ না হয়ে পারেনি। দীর্ঘ পুরনো গাছটা পড়ার পর যে প্রচণ্ড একটা শব্দ হয়েছিল তা শোনা গিয়েছিল অনেক দূর পর্যন্ত। রেহানারও তা অবশ্যই শুনে থাকবার কথা। কিংবা কে জানে, হয়তো শোনেনি সে। ভোরের আলো ঠিকমতো ফুটতেই প্রতিদিনকার মতো সে রওনা হয়েছিল স্কুলের দিকে, লালচে গ্রামের পথ ধরে যেতে যেতে পেছনে ফিরে দাঁড়িয়েছিল একবার। তারপর হাঁটাপথ ফেলে কালো পিচের তৈরি সদর রাস্তায় উঠে আসার পরও আরো একবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ফিরতি পথের দিকে। আনমনে তার ডানহাতের কড়ে আঙুলটি মুখে পুরে তারপর নিশ্চুপ তাকিয়ে ছিল ধুলা-ওড়া ফেলে আসা পথের দিকে।