বরষার দুঃস্বপ্নে পীড়িত প্রাণীদের কথা

ব রষা নিয়ে বাঙালি কবি ও গবেষকদের মধ্যে উৎসাহের শেষ নেই। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কালো মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ; কিন্তু তখন শ্রমজীবী মানুষের মনে গভীর বিষণ্নতা। আসলে কবি ও গীতিকাররা বরষার রিমঝিম বৃষ্টি নিয়ে যেমন ভাবপ্রাণ হয়ে ওঠেন; সচেতন বস্তুবাদী বিশেষ করে কথাসাহিত্যিকরা তেমনটা হন না। তাঁরা বরষার কদম কিংবা কামিনী ফুল নিয়ে গল্প লেখার বদলে বরং বরষার দিনে ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের দুর্দশাকে অবলোকন করেন গভীরভাবে। অবশ্য জনপ্রিয় কল্পনাবাদী কথাকারদের কথা আলাদা। তাঁরা মেঘ-বৃষ্টি-বাদলের দিনে ঝিলের পানিতে পদ্ম-শাপলার রূপ ও নর-নারীর বর্ণনাতেই অভ্যস্ত বেশি। সুতরাং কথাসাহিত্যিকদের মধ্যেও বরষার প্রভাব সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। বিত্তবান যাঁরা বরষার সন্ধ্যায় আপন বাড়ির জলসাঘরে উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর বসান, তাঁদের কেউ কেউ বরষা-বাদলের দিনে রাস্তায় জমে থাকা কাদাপানির বিরূপ পরিবেশে বড় বেশি বিরক্তিবোধ করেন। তবে বরষার জলের ছলছল-কলকল ধারা হয়তো ক্ষণিকের জন্য হলেও মানুষের মনকে উদাসীন করে তোলে। হয়তো মিশ্র অনুভূতি নিয়ে জীবনের এই অভিযাত্রা প্রবহমান। অবশ্য বরষা নিয়ে বাঙালি গীতিকারদের মুগ্ধতা ও ভাবপ্রবণতার শেষ নেই।

বরষার রিমঝিম বৃষ্টি নিয়ে কোনো একটি জীবনের অভিজ্ঞতা বা কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে আমার একটি কাহিনির কথা খুব মনে পড়ে। এর আগে বরষা ছিল আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে – ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’ কী করে ভুলি যে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ একজন মহাকবি ছাড়াও ছিলেন একজন বড় জমিদার। পূর্ববঙ্গের বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল তাঁর জমিদারি। তাই বরষার দিনে দু-মুঠো অন্নের সন্ধানে তাঁর বাইরে বেরোনোর প্রয়োজন হয়নি। জমিদারবাড়িতে কিংবা নদীবক্ষে বরষায় জানালার পাশে বসে তিনি ঝরঝর বৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য কিংবা জলে-ভরা ধানক্ষেত দেখেছেন। আমাদের মতো নুন আনতে পান্তা ফুরোনো মানুষের জন্য সে-সুযোগ বড়ই সীমিত। বরং বরষার একটানা বৃষ্টি ও রাস্তায় জমে থাকা কাদাপানি আমাদের কাছে বড় বিরক্তিকর বলে মনে হয়।

১৯৮৪ সালের আষাঢ় মাসে তেমনই এক বরষার দিন। মেঘের গর্জন ও নিরন্তর জলবর্ষণ উপেক্ষা করে ছাতা মাথায় হেঁটে চলেছি হাতিরপুলের ভূতের গলি থেকে শান্তিনগরে আমার কর্মস্থলে। ঈদের মাত্র চারদিন আগে আমাদের প্রতিষ্ঠানের মালিক খবর পাঠিয়েছেন অফিসে গিয়ে বেতন নিয়ে আসতে। সেদিন আমার নিঃসঙ্গ জীবনে টাকার প্রয়োজন ছিল অতি তীব্র; কিন্তু আমার চেয়েও বেশি প্রয়োজন ছিল আমার সহকর্মী ফিরোজার।

সংসারে তার দুই সন্তান ও পঙ্গু স্বামীর দায়ভার তাকে বহন করতে হয়। কদিন ধরে ফিরোজার স্বামী একধরনের জটিল জ্বরে আক্রান্ত, তার ওপর ঈদ। তখনো পৃথিবীতে বামপন্থী জনকল্যাণের রাজনীতি শেষ হয়ে যায়নি আর আমিও তখন ছিলাম এখনকার চেয়ে অনেক বেশি গরিব-দুঃখী মানুষের পক্ষে। তখনো স্বপ্ন ছিল, দুনিয়াজুড়ে একদিন গরিব-শোষিত মানুষের শাসন কায়েম হবে। পুঁজিবাদের সহযোগী ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের হত্যাযজ্ঞ তখনো শুরু হয়নি। তখনো পল রোবসনের কণ্ঠে জন হেনরির শ্রমের গান দুনিয়ার অনেক মেহনতি মানুষকে ডেকে ফিরছিল।

বরষার দিনে ছাতা মাথায় হাঁটার সময় আমি এসব মজলুম ও মেহনতি মানুষের কথা ভাবছিলাম। হয়তো একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ করে ভিকারুননেসা নূন স্কুলের সামনে বেইলি রোডের পিছল রাস্তায় আছড় খেয়ে পড়ে আমি কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। স্কুলের ছাত্রী দু-তিনটি কিশোরী আমার এ-আছড় খাওয়ার দৃশ্য দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো। নিমিষেই আমার জামা-প্যান্ট কাদাপানিতে ভিজে একাকার। আমি কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে যেতে হবে শান্তিনগর মোড়ের ওপাশে আমার মাসিক বেতন তুলতে। আমার সহকর্মী ফিরোজা হয়তো এতোক্ষণে এসে গেছে। কারণ তার প্রয়োজন আমার চেয়ে বেশি।

শান্তিনগর মোড় পার হয়ে কিছুদূর এগোনোর পর ডানের গলিতে একটু হেঁটে একটি একতলা বাড়ির গায়ে একটি টিনের সাইনবোর্ড তখন অনেকের চোখে পড়তো। সাদা জমিনের ওপর বড় বড় কালো হরফে লেখা ‘সুশিক্ষা সমঅধিকার’। বাংলাদেশের অসংখ্য ছোট ছোট এনজিওর মধ্যে এও একটি আর তখন এদেশকে শাসন করছেন একজন স্বৈরাচারী শাসক। আমি ক্লান্ত শরীরে অফিসের সামনে পৌঁছে দেখি, অফিসে তালা ঝুলছে। ফিরোজা আমারই মতো মøানমুখে দাঁড়িয়ে আছে অফিসঘরের সামনে টিনের চালের নিচে খোলা বারান্দায়। ফিরোজা সকালে নাস্তা করেছে কি না জানি না। তবে তাকে ক্লান্ত, দুর্বল ও হতাশ বলে মনে হলো। সে হতাশার স্বরে বললো, ‘আজ হয়তো আলতাফ ভাই আসবে না। আজ বেতন না পেলে পল্টুর বাবার জন্য ওষুধ কেনা হবে না। বাজারও হবে না। ঈদ তো অনেক পরের কথা।’

ফিরোজাকে সাহস জোগানোর জন্য বললাম, ‘আমারও একই অবস্থা।’

এমন সময় আবার বৃষ্টি শুরু হলো। অসুস্থ শরীরে এই ঝরঝর বৃষ্টিকে বড়ই নির্মম ও নিষ্ঠুর বলে মনে হলো। অফিসের সামনের বারান্দায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, কিছু দূরে মাঠের পাশে একটি কদমগাছে অনেক কদম ফুল বৃষ্টি ও বাতাসের ঝাপটায় দুলছিল, আমাদের বেদনার্ত জীবনের অনিশ্চিত দিনগুলোর মতো। প্রায় আধাঘণ্টা পরে বৃষ্টি একটু ধরে এলে ফিরোজা বলল, ‘চলুন আজিজ ভাই, শান্তিনগর মোড়ে গিয়ে আলতাফ ভাইকে ফোন করি।’

এ-কথা বলা এখন নিষ্প্রয়োজন যে, তখন মোবাইল ফোনের ব্যবহার দুনিয়ার জনজীবনকে এভাবে একসূত্রে গাঁথেনি। শান্তিনগর মোড়ের কাছে ছোট বটতলায় এলাম। সেখানে সিদ্দিকিয়া রেস্টুরেন্ট থেকে আমরা প্রায়ই ফোন করতাম আমাদের বস ‘সুশিক্ষার সমঅধিকার’-এর পরিচালক আলতাফ চৌধুরীকে। হয়তো তিনি মোটরসাইকেলে চড়ে অফিসে আসার পথে রয়েছেন। আমরা রিমঝিম বৃষ্টির মধ্য দিয়ে হেঁটে শান্তিনগরের পীর সাহেবের গলিতে আমাদের অফিসে এলাম এবং যথারীতি অফিস তালাবন্ধ। আমরা অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। কদমফুলের গাছের দিকে তাকিয়ে বরষার কদমফুলের প্রথম স্মৃতি মনে করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ক্ষুধার্ত শরীরে আর কত বরষার কদমফুল দেখবো? এখন সবই বিবর্ণ, বিস্বাদ ও বেদনার্ত। এ-অফিসে আমরা তিনজনই বসি। ফিরোজাকে অবশ্য প্রায়ই মগবাজার রেললাইনের পাশে বস্তির স্কুল প্রকল্পে যেতে হয়। আলতাফ চৌধুরীর ভাষায়, বস্তির গরিব শিশুদের মধ্যে ‘সুশিক্ষা ও সমঅধিকার’ বাস্তবায়নের কাজ করা হয়। প্রকল্পের বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছেন শিক্ষা প্রকল্পের ম্যানেজার ফিরোজা ও তাঁর অধীনস্থ শিক্ষকরা। আমি অবশ্য ফিরোজার সিনিয়র এবং এ-প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ অফিসার। কিন্তু গবেষণার যে কী কাজ তার কিছুই জানি না।

আমরা এ-মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি টিনের চালের নিচে অফিসের খোলা বারান্দায়; চারদিকে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে।  ফিরোজা বলল, ‘ভেবেছিলাম, এতোক্ষণে বেতন পেয়ে বাসায় বাজার নিয়ে যাবো। পল্টু-রীনা আর ওদের বাপকে রান্না করে খাওয়াবো। আজ বোধহয় তা হবে না। বিকেলে বাসায় ফিরে পরিচিত মুদির দোকান থেকে চাল, ডাল, আলু আর ডিম কিনতে হবে।’

আশির দশকের এ-কাহিনি তখনকার

 নিম্নআয়ের প্রায় সব শ্রমজীবীর জীবনে

একই রকম। ফিরোজা আর আমি কেন সেই সমাজকাঠামোর বাইরে থাকবো! আমরা সরল, বোকা ও আবেগপ্রবণ। অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের সামাজিক কৌশল আমরা শিখতে পারিনি। তাই বরষার ঝরঝর বৃষ্টিতে মনের মধ্যে অনেক আশা নিয়ে আলতাফ চৌধুরীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিনি এলেন না। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে বৃষ্টি কমলে আবার এলাম শান্তিনগর মোড়ের কাছে বটতলায় সিদ্দিকিয়া রেস্টুরেন্টে। তখন খিদেয় আমাদের পেট জ্বলছে। ফিরোজাকে দেখে মনে হলো সে আমার চেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত। ওকে বললাম, ‘চলুন আমরা ভাত খাই।’ এই সিদ্দিকিয়া রেস্টুরেন্টে আমি নতুন নই। এখানকার ঝাল তরকারি, ঝরঝরে গরম ভাত আর ঘন ডাল অনেকেরই প্রিয়। ফিরোজা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে আমরা দুজনে একটা টেবিলে মুখোমুখি বসলাম। হোটেলের পরিচিত কর্মী আব্দুল কাছে এসে দাঁড়ালো। বলল, ‘খাবার আছে গরুর ভুনা গোশত, ভাত আর ডাল।’ ঘাড় নেড়ে ইশারায় দিতে বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই টেবিলে খাবার চলে এলো। তখন আমার মনে হলো, এই খাদ্যগ্রহণের আদিম প্রয়োজনে আমাদের বেঁচে থাকা, সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি এই পরিশ্রম। দুজনেই বুভুক্ষের মতো খেলাম এবং অতিরিক্ত আরো দুই প্লেট ভাত নিলাম। এই রেস্টুরেন্টে অতিরিক্ত একটি সুবিধা আছে। তরকারি শেষ হয়ে গেলেও ঝোল চাইলে অতিরিক্ত আরো দু-এক টুকরো গোশত দেয়। পেট ভরে ভাত খেয়ে পরিতৃপ্ত ও শান্ত হলাম দুজনে। খাবার পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে মনে হলো, এখন আমি কত সুখী মানুষ। কিন্তু ফিরোজার চোখে-মুখে উদ্বেগের চিহ্ন দেখতে পেলাম। সে হয়তো ভাবছে তার ক্ষুধার্ত স্বামী ও সন্তানদের কথা। এবার আমার পান খাওয়ার ইচ্ছা হলো। আমি আবদুলকে মিষ্টি জর্দা দিয়ে পান আনতে বললাম।

পান চিবিয়ে মনে হলো, আমাদের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট বসীর আহমেদকে ফোন করি। তিনি কাছেই চামেলিবাগে থাকেন। গত দু-তিন বছরে মানবসেবায় ব্যস্ত থেকে আমাদের বুদ্ধি আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। বেঁচে থাক ‘সুশিক্ষা ও সমঅধিকার’ কার্যক্রম। আমার এখন মফস্বলের সহজ-সরল ক্যাবলাকান্ত নই। অ্যাডভোকেট বসীর আহমদ একজন বিত্তবান ভদ্রলোক। তিনি ফোনে আমাদের পরিচয় জেনে মূল সমস্যাটা জানতে চাইলেন। আমাদের সমস্যা তাঁকে খুলে বললাম। তিনি বললেন, ‘আলতাফ চৌধুরী যে ঢাকায় নেই এ-কথা কি তোমরা জানো না? সে তো গতকাল ব্যাংককে একটি সেমিনারে যোগ দিতে গেছে। পাঁচদিন পরে ফিরবে। অর্থাৎ ঈদের একদিন পরে।’ এবার আমি বললাম, ‘তাহলে আমরা ঈদ করবো কীভাবে?’ বসীর সাহেব বললেন, ‘তোমরা এখনই আমার বাসায় চলে এসো।’

আমি আর ফিরোজা তাঁর বাসায় গেলে তিনি আমাদের সঙ্গে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করলেন। চা খাওয়ালেন এবং দুজনের হাতে দুটি ৫০০ টাকার নোট দিলেন। বললেন, ‘চিন্তার কোনো কারণ নেই। তোমাদের বেতন থেকে কেটে নেওয়া হবে।’ এতোক্ষণ পরে দেখলাম ফিরোজার মুখে হাসি ফুটেছে। অ্যাডভোকেট বসীর আহমদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা যে যার বাসায় রওনা হলাম। নিজেকে মনে হলো পরিপূর্ণ চিন্তামুক্ত। বৃষ্টি থেমে আছে। বাসায় ফেরার পর আবার বৃষ্টি শুরু হলো। কিন্তু এবার বৃষ্টিকে মনে হলো, ঈশ্বরের চোখ থেকে ঝরেপড়া আনন্দের অশ্রুর মতো। ১৯৮৪ সাল সেই কবে বিদায় নিয়েছে। সেই প্রথম বরষার ঝরঝর একটি দিনকে অসংখ্য কল্পনাপ্রবণ কবির বদলে একজন কথাসাহিত্যিকের দৃষ্টিতে দেখতে সমর্থ হয়েছিলাম। সেইসঙ্গে শান্তিনগরে বরষার কদমফুলের চেয়ে সিদ্দিকিয়া রেস্টুরেন্টের ভাত ও গরুর ভুনা গোশত অনেক বেশি কাক্সিক্ষত, সজীব, লোভনীয় ও পবিত্র বলে মনে হয়েছিল।