মশা ওড়ে ঘরের ভেতর। উড়তে উড়তে গান গাইতে গাইতে হঠাৎ তার নাকের ডগায় এসে বসে পড়ে। চোখের মণিদুটোকে নাকের কাছাকাছি এনে মশাটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে লোকটাকে ট্যারা মনে হয়। মশাটা এখন তার রক্ত চুষে নেবে। প্রচণ্ড জোরে নিজের নাকের ওপর থাপ্পড় মারেন, হাতের তালু দেখেন খুব ভালো করে, হ্যাঁ, মশাটা মরেছে ঠিকই; কিন্তু নাকের ওপর ব্যথা করছে খুব। বিদ্যুৎ চলে গেছে আধঘণ্টা আগে, এখনো আসার নামগন্ধ নেই। গরমে কষ্ট পাচ্ছে তার স্ত্রী আর কন্যা। দক্ষিণ দিকের জানালাটা খুলে দিলে এই দুঃসহ অবস্থা থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া যায়, কিন্তু খোলা যাবে না। জানালা খুললে মশার দল ঢুকে পড়বে দলে দলে। ঢুকেই তারা গান গাইবে আর চুষে নেবে শরীরের রক্ত। আরো বিড়ম্বনা আছে, জানালার পাশেই ড্রেন, ওটা খুললে বাতাসের সঙ্গে দুর্গন্ধ ঢুকে পড়বে ঘরের ভেতর। রিকশাওয়ালাদের বেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজ, ঠেলাগাড়িওয়ালাদের মুখখিস্তিতে ঝালাপালা হবে কান।

লোকটা সবকিছুই দেখছেন শুনছেন বুঝতেও পারছেন; কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না। সকালে খাবারের হটপটটা ব্যাগে পুরে যখন বাস স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ান তখন তার আর কিছুই ভালো লাগে না। অফিসে যেতে-আসতে তিন ঘণ্টা সময় চলে যায় রাস্তায়। তাও যদি বেতনটা সংসার চালানোর মতো হতো তাহলেও চলতো। কোম্পানির ভাবখানা এমন – তার বেতন বাড়ালে কোম্পানি চলবে না, বন্ধ হয়ে যাবে। বেতন যা পায় তার সিংহভাগ নিয়ে যায় নিষ্ঠুর বাড়িওয়ালা। কতবার লোকটাকে বলেছেন, জানালাগুলোতে নেট লাগিয়ে দিতে, মশামাছির অত্যাচারে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। শোনে না। লোকটার গায়ের চামড়া ভীষণ পুরু। যা-ই বলা হোক তার গায়ে লাগে না। 

বিকালে অফিস থেকে ফিরে এলেন। বাস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে দেখলেন পুবদিকে বড় একটা চাঁদ উঠছে।  বিলবোর্ডে ঢাকা পড়ছে চাঁদটা। আজ একটু দেরিতে বাসায় ফিরবেন। হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা থেকে পশ্চিম দিকের লেকের পাড়ে চলে গেলেন। একটা পার্ক আছে ওখানে। মাঝে মাঝে এই পার্কে এসে বসেন। লেকের পাড়ে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে চারপাশে তাকালেন। বিশাল গাছগুলোর পাতা নড়ছে ঝিরঝির বাতাসে। এখান থেকে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে। এমন একটা সুন্দর নির্ঝঞ্ঝাট সময়কে উপভোগ করার যে মন থাকতে হয়, সেটা এই মুহূর্তে নেই তার। সবসময় কেমন যেন ভারি কিছু একটা চেপে থাকে মাথার ওপর! মেয়েটা পড়ছে কলেজে, তার চাহিদা অনেক; কিন্তু কখনো সেসব কথা বলে না সে, দিতে না পারলেও মাঝে মাঝে মেয়েটা এট-ওটা চাইতে তো পারে; কিন্তু কিছুই চায় না, অভাবের সংসার বলে এই না চাওয়ার পেছনে এক ধরনের অপমানবোধ কাজ করে লোকটার অন্তর্জগতে, যা তাকে ক্রমশ একটা বামনে পরিণত করে ফেলছে! কলেজে উঠে মেয়েটা একবার তার মাকে বলেছিল, তার সহপাঠীরা সুন্দর সুন্দর মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। হঠাৎ কেউ একজন সালাম দিলো লোকটাকে! সামনে এসে বলল, বসতে পারি?  ভালো করে দেখলেন লোকটা, সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। কেমন অদ্ভুত চেহারা, মাথার চুল উস্কোখুস্কো, রঙিন পাঞ্জাবির সঙ্গে ফেইড জিন্স পরেছে। পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। লোকটা ভাবলেন, যুবক কবিতা-টবিতা লেখে মনে হয়। আজকালকার কবিরা এমনই হয়, কেয়ারফুল্লি কেয়ারলেস। হয়তো পার্কের সান্ধ্যকালীন সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছে। কয়েক সেকেন্ড চলে গেল, কিন্তু যুবক অথবা লোকটা কেউ কোনো কথা বলল না। যুবক হঠাৎ বলল, লেকের পানিতে চাঁদের আলো পড়েছে দেখেছেন স্যার, এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে কত মানুষ অথচ কারো খেয়ালই নেই সেদিকে, গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে বলবে, চাঁদ! না তো, দেখি নাই। এমনই হচ্ছে আজকাল, মানুষের সুন্দর মনটা মরে যাচ্ছে দিনদিন। অথচ কেমন একটা নিরিবিলি সুন্দর এদিকটাতে, তাই না?

লোকটা কোনো কথা না বলাতে যুবক বলল, স্যার কি এখানে প্রথম এলেন আজ?

পাশের মেহগিনি গাছটার ডালে একটা পাখি ডাকছিল কুউব কুউব শব্দে। এই পাখিগুলো সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এভাবেই ডাকে, কিন্তু ওদের দেখা যায় না। যুবক আবার বলল, স্যার কি এখানে প্রথম এলেন আজ?

না, প্রথম নয়, মাঝে মাঝে আসি।

লোকটা ভাবলেন, কী উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে তার পাশে এসে বসল যুবক! ধোঁকাবাজ বা ছিনতাইকারী নয়তো! আজকাল কোনোভাবেই কাউকে বিশ^াস করা ঠিক নয়, সময় খুব খারাপ।

ভাইয়া কফি খাইবেন? ছোট্ট একটা ছেলে কফির ফ্ল্যাস্ক নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গেল, দুই কাপ দিই ভাইয়া? যুবক লোকটাকে বলল, স্যার, কফি খান এক কাপ, দিতে বলি? লোকটা মনে মনে বললেন, হ্যাঁ আমি কফি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই আর তোমরা আমার ঘড়ি আর মানিব্যাগ নিয়ে পালাও, কী মজা তাই না। না না আমি কফি খাব না, সরি, আপনি খান, সেটাই ভালো হয়, দাও ওকে এক কাপ কফি দাও, লোকটা বললেন।

আমি বসে আছি, আপনার খুব খারাপ লাগছে, তাই না স্যার?

না না তা হবে কেন, আপনি বসে আছেন আপনার মতো, কোনো ডিসটার্ব তো করছেন না, তাই না?

আমার সৌভাগ্য স্যার, আজকের সন্ধ্যাটা আপনার মতো এমন একজন সুন্দর সৌম্য মানুষের পাশে বসে কাটাচ্ছি, জীবনটা এমনই, সবকিছুই অনিশ্চিত, কে কখন কোথায় কার সঙ্গে পরিচিত হবে, কার পাশে বসে কথা বলবে কেউ বলতে পারে না, পারবেও না, তাই না স্যার?

যুবক থেকে থেকে হঠাৎ প্রশ্ন করছে লোকটাকে। এখন আবার তার চেহারা নিয়ে মন্তব্য করে বসলো, প্রতিদিন স্টিলের আলমারির আয়নায় নিজের চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পান না লোকটা, কারণ সেটা অপরিষ্কার, অস্বচ্ছ। কিন্তু তিনি জানেন চেহারাটা তার খারাপ না, বেশ ভালোই, এটা তিনি পেয়েছেন মায়ের কাছ থেকে, মা ছিলেন অসম্ভব সুন্দর। লোকটা বললেন, একটা বিষয় আমি একদম বুঝতে পারছি না, আমরা দুজন কেউ কারো পূর্বপরিচিত নই, কেউ কাউকে চিনি না, জানি না, তাহলে আপনি কেন এভাবে আমার কাছে বসে এসব বলছেন, প্রশ্ন করছেন, আপনি আসলে কে? কী করেন, কোথায় থাকেন?

স্যার, আমার ভেতরে গোপন কিছু নাই, কোনো রাখঢাক নাই, যে-কোনো জায়গায় যে-কোনো সময় আমি কনফেস করতে পারি যে, আমি আসলাম শেখ, জন্ম খুলনার দৌলতপুরে, পিতা জুলমত শেখ এখন বেকার অসুস্থ, আর আমি তার পুত্র একজন কন্ট্রাক্টর বা দালাল, পনেরো বছর হলো এই শহরে ঘুরছি ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে, ভালো একটা কিছু করার জন্যে ঘুরে ঘুরে ব্যর্থ হয়ে এখন দালালি করি। এই যে আমার পকেটে সবসময় দুটো মোবাইল ফোন থাকে এ-দুটো দিয়ে আমি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করি।

ঠিক আছে করেন, কিন্তু আমার কাছে কেন? আমি তো ওসব মানুষের দলে নই। আমার বাসা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, চালের দাম বেড়েছে, অভাবের সংসারে এসব বাড়তি খরচ চালানো আমার পক্ষে কঠিন হয়ে যাচ্ছে, এসব ভাবতে ভাবতে আমি এই পার্ক পর্যন্ত চলে এসেছি।

স্যার, আপনি বাড্ডার পোস্টঅফিস গলিতে থাকেন, আপনাকে ফলো করে আমি আপনার বাসা এবং চারপাশের পরিবেশ সবকিছু দেখে এসেছি, বাস থেকে নেমে একদিন রেস্টুরেন্টে চা খাচ্ছিলেন আপনি, তখন আপনার সামনে বসে আপনার একটা ছবিও তুলেছি আমি। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে ছবিটা দেখাল যুবক, ছবি দেখে লোকটা যুগপৎ বিস্মিত এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গেলেন। যুবক লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, এতে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই, আজকাল ফেসবুক থেকে যে-কোনো পুরুষ বা মেয়ের ছবি নেওয়া যায় যে-কোনো সময়, ছবির বিষয়টা কিচ্ছু নয়।

যা-ই হোক না কেন, আপনি আমার ছবি নেবেন কেন, এটা খুব গর্হিত কাজ, ওটা আপনি ডিলিট করে দিন এখনই।

হ্যাঁ স্যার ছবিটা ডিলিট করতে পারি, কোনো সমস্যা নাই আমার, ওটা যার জন্যে নিয়েছিলাম সে-ছবিটা দেখে আপনাকে নির্বাচন করেছে, এখন আপনি রাজি হলেই মঙ্গল।

এসব কী বলছেন আপনি, কে ছবি দেখে আমাকে নির্বাচন করেছে, আমি রাজি হলে কিসের মঙ্গল! এমন উদ্ভট কথাবার্তা বলছেন কেন? আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাচ্ছেন আপনি?

প্লিজ স্যার, রেগে যাবেন না, এখানে রাগারাগির কিছু নেই, আমি দরিদ্র ঘরের ছেলে, দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্যে পরিণত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, ওসব মিথ্যা ধোঁকাবাজি বা ব্ল্যাকমেইল আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়, যা করবো বা বলবো সব সোজাসুজি – স্পষ্ট, একদম সহজ-সরল, আপনি আমাকে ট্রাস্ট করতে পারেন, বিপদে পড়বেন না।

আমার ছবি দেখে নির্বাচন করেছে, কে কীভাবে কিসের জন্যে নির্বাচন করেছে, স্পষ্ট করে বলেন, বিষয়টা আমার কছে খুব অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে।

স্যার, প্রথম কথা হলো আমি আপনার অস্বস্তির কারণ এই ছবিটা ডিলিট করে দিচ্ছি (যুবক মোবাইল ফোন বের করে লোকটার সামনেই তার ছবিটা ডিলিট করে দিলো), হ্যাঁ, এবার সবকিছু খুলে বলি, আসলে স্যার, আমরা আমাদের পেট চালানোর জন্যে কেউ চাকরি করি কেউ ব্যবসা করি তাই না স্যার? আপনার ছবির আগে আমি আরো পাঁচজন মানুষের ছবি তুলে আমার ম্যাডামকে দেখিয়েছি, ম্যাডাম সব ছবি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, এই ছবিটা চলবে, একদম বাবার মতোই চেহারা, ভদ্র-সৌম্য, ইনি বাবা হলে আমাদের ব্যবসাটা ভালো চলবে।

বাবা! সেটা কিসের ব্যবসা?

স্যার, আমার ম্যাডামের একটা ব্যবসা আছে, ফ্যাশন হাউজ, বড় বড় ধনী লোকের সঙ্গে কারবার, ওসব বড়লোকের বাড়িতে গিয়ে তার প্রোডাক্ট দেখাতে হয়, প্রোডাক্টের গুণাগুণ তুলে ধরতে হয়, ওই যেমন ধরুন বড় বড় ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভরা তাদের প্রোডাক্ট বাজারজাত করার জন্যে যেভাবে বড় বড় ডাক্তারের চেম্বারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর প্রোডাক্ট দেখিয়ে চলে আসে, আমাদের ব্যবসাটাও তেমন।

এতে আমার ভূমিকাটা কোথায়, কী?

আপনাকে কিছুই করতে হবে না, আপনি শুধু আগামীকাল এইখানে চলে আসবেন, ম্যাডাম আপনাকে সবকিছুই বুঝিয়ে দেবেন, এখানে দুর্বোধ্য কিছুই নেই, ম্যাডাম খুবই ভালো। ও আরেকটা কথা, কাজটা কিন্তু আপনার অফিস আওয়ারের পর, আর এর জন্যে আপনাকে টাকা দেবেন ম্যাডাম।

আহা! আমাকে কী করতে হবে সেটা জানতে পারলাম না, সেটা আসলে কী?

কিছুই না, শুধু আমাদের সঙ্গে গিয়ে কিছুক্ষণ সময় দিতে হবে, ফেরার সময় ম্যাডাম আপনার যাতায়াত খরচ ছাড়া আরো কিছু টাকা দেবেন, তাহলে স্যার, আগামীকাল এই সময়ে এইখানে আসবেন।

হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরছিলেন লোকটা। আজ এই প্রথম অদ্ভুত একটা অনুভূতির স্বাদ পেলেন মনের গভীরে, এর আগে কখনো এমনটা হয়নি। যুবকের কথাগুলো নতুন ধরনের। সরাসরি কথা বলে। কিন্তু যা কিছু বলে তার কতটা সত্যি! আগামীকাল আসতে হবে পার্কে, কোথাও নিয়ে যাবে তাকে, টাকা দেবে! এই ধরনের কথা কেউ তাকে বলেনি কখনো। তবে সবকিছু ছাপিয়ে একটা কথা সত্য, টাকা দরকার!

পরদিন সকালে অফিসে গিয়েও নিজের ভেতরে কেমন একটা পরিবর্তন টের পেলেন লোকটা। দু-একজনের সঙ্গে কথাও বললেন হেসে হেসে। আসলে লোকটা হাসতেই ভুলে গিয়েছিলেন! বাসা থেকে বের হওয়ার সময় স্ত্রীকে বললেন, কিছু একটা করা দরকার, এভাবে আর চলে না। হঠাৎ মুখ ফসকে বের হয়ে গেল, ভালো একটা মোবাইল ফোনের দাম কত? তার স্ত্রীও বোকার মতো একবার তাকালেন স্বামীর দিকে।

অফিস থেকে ফিরে একটা ভালো শার্ট-প্যান্ট পরলেন লোকটা। পার্কের দিকে হাঁটতে লাগলেন। ঘড়ি দেখলেন। পৌনে আটটা এখন। একটা সিএনজি অটোরিকশা দাঁড়িয়ে আছে পার্কের পাশের রাস্তায়। যুবক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। চারপাশে তাকালেন লোকটা, কিছু একটা বা কাউকে খুঁজছেন তিনি। যুবক সালাম দিয়ে বলল, ভেতরে বসেন স্যার, ম্যাডামকে তুলে নেব। লোকটা ভেতরে বসলে যুবক নিজেই চালকের আসনে বসে বলল, আজ আমরা যাবো গুলশান দুই। লোকটা ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু মুখে কিছু বলছেন না। ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যায় দেখতে চান তিনি, সারাজীবন ভয় পেয়ে ঝুঁকি না নিয়ে আজ এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছেন। অটোরিকশা এগিয়ে গেল সামনে। বিশ পঁচিশ মিনিট চলার পর একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। লোকটা দেখলেন অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ে এসে দাঁড়ালো তাদের পাশে। মাথার ছোট চুলে ব্রাউন কালার করা, মুখে কালচে-লাল লিপস্টিক, পায়ে উঁচু হিল জুতো। হাসতে হাসতে বললো, বাবা কই সুমন? লোকটা নেমে এলে মেয়েটি আবার হেসে বললো, না না বাবা, আপনি ভেতরেই থাকেন, নামতে হবে না। মেয়েটা ভেতরে বসে বললো, আপনার শরীর ভালো? 

– হ্যাঁ, আমি ভালো আছি।

আবার চলা শুরু করলো স্কুটার। গুলশানের বাড়িগুলোর শান-শওকতই আলাদা। প্রতিটি বাড়ির সামনে পরিষ্কার পোশাকে সুসজ্জিত নিরাপত্তাকর্মী। এখানকার রাস্তায় বিদেশিদের চলাফেরা বেশি। বাড়ির সামনের ফুলের বাগানে ফুল ফুটেছে। গলিঘিঞ্জি নেই। এসব দেখছিলেন লোকটা আর নিজের পোস্টঅফিস গলির কথা ভাবছিলেন। বিশাল একটা বাড়ির সামনে গিয়ে অটোরিকশা দাঁড় করালো যুবক। দ্রুত নিচে নেমে মেয়েটা বললো, আসেন বাবা। ভবনের ভেতরে ঢুকতেই লম্বা একটা সালাম দিলো সিকিউরিটি। মেয়েটা বলল, ফাইভ বি, চৌধুরী স্যারকে বলেন শায়লা আসছে বাবাকে নিয়ে। সিকিউরিটি কথা বললো ইন্টারকমে, আবার সালাম দিয়ে বললো, লিফটের পাঁচ ম্যাডাম।

ডোরবেল টিপতেই পঞ্চাশোর্ধ্ব সুন্দর এক ভদ্রলোক দরজা খুলে স্বাগত জানালেন ওদের দুজনকে। সোফার ওপর বসতেই লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী খাবেন, চা না কফি?

– না না স্যার, আমরা চা খেয়ে এসেছি, মেয়েটা বললো। ভদ্রলোক ভেতরে চলে গেলেন। মিনিট দুয়েক পর মেয়েটাকে ডেকে নিলেন ভেতরে।

এতোক্ষণ খেয়াল করেননি লোকটা, পাশেই অল্প ভলিউমে টিভি চলছে, চঞ্চল চৌধুরীর নাটক হচ্ছে। নাটক দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে গেলেন লোকটা। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ঘড়ি দেখলেন। এখানে এসেছেন চল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে। তখনই মেয়েটা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, চলেন বাবা। এখন মেয়েটার শরীরে অন্য পারফিউমের গন্ধ পেলেন লোকটা, আসার সময় এই সুগন্ধিটা ছিল না। লিফটের ভেতরেই লোকটার মনের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিলো, আচ্ছা,  মেয়েটার ব্যাগের ভেতর কোনো প্রোডাক্টের নমুনা দেখলাম না তো!

ফেরার সময় অটোরিকশা থেকে নেমে মেয়েটা বললো, বাবা, এই টাকাটা রাখেন, এখানে তিনশো টাকা আছে, আপনার যাতায়াত খরচ। আর আগামীকাল ওখানেই চলে আসবেন। মেয়েটা চলে গেল তার বাসায়। যুবক লোকটাকে পোস্টঅফিস গলির কাছে নামিয়ে দিয়ে বলল, স্যার আপনি সত্যিই একজন ভালো বাবা, কাল চলে আসবেন ঠিক একই সময়ে, একই জায়গাতে, আসি স্যার, সালাম। লোকটা ধীরে ধীরে তার বাসার দিকে যাওয়ার সময় ভাবলেন, প্রতিদিন রাতে এরকম টাকা পেলে এক মাসের মধ্যেই মেয়েকে একটা ভালো মোবাইল ফোন কিনে দিতে পারবেন।

পরদিন লোকটা আবার লেকের পাশের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালেন। যুবক এলো সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে। মেয়েটার সঙ্গে আজ তারা বারিধারার একটা বাড়িতে গেলেন। সিকিউরিটিকে বলে মেয়েটা তাকে নিয়ে ছয়তলার একটা ফ্ল্যাটে গিয়ে ডোরবেল টিপতেই চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের এক ভদ্রলোক দরজা খুলে স্বাগত জানালেন তাদের। ড্রইংরুমে বসে থাকলেন লোকটা। মেয়েটা চলে গেল ভেতরে।

আজো মেয়েটা তিরিশ-চল্লিশ মিনিট ভেতরে থেকে বেরিয়ে এলো। আজো মেয়েটার শরীরে অন্য সুগন্ধি পেলেন লোকটা। লোকটা আবার ভাবলেন, কই মেয়েটার ব্যাগে তো কোনো প্রোডাক্ট নেই, তাহলে কী দেখালো সে?

নিচে নামার সময় লিফটের ভেতর লোকটা বললেন, আচ্ছা আপনার ব্যাগের মধ্যে কোনো প্রোডাক্টের নমুনা দেখলাম না  তো? মেয়েটা একটু হেসে বলল, বাবা, আমাদের তো অনলাইনের ব্যবসা, উনি কম্পিউটার খুলে সব দেখেছেন, পছন্দও করেছেন। লোকটা কিছুতেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, আগামীকাল তার আসা উচিত হবে কি না!