সুর ও সম্পর্ক

এতোগুলো শীত-বসন্ত অবলীলায় পেরিয়ে এসে ষাট বছর বয়সে বিয়ে করার প্রয়োজন পড়ল কেন – এ-প্রশ্ন আপনাদের মনে আসতে পারে; কিন্তু এতোকাল আমার বিয়ে করার সময়-সুযোগ হয়নি, বা তেমন প্রেরণা-প্ররোচনাও ছিল না, এটুকু বলে আপনাদের আপাতত নিরস্ত করতে পারি। কখনোই না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়া ভালো। সেদিক থেকে পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ বছরের একজন মহিলা, দেখতে যিনি যথেষ্ট সুন্দরী, তদুপরি স্বাস্থ্যটাও ঝরঝরে রাখতে সমর্থ হয়েছেন, তাঁকে বিয়ে করাটাকে তো সুবিবেচনা বলেই মনে করবেন, নাকি?

বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিলাম তা কিন্তু নয়, বরং এতো বছর যেভাবে বেশ চালিয়ে যাচ্ছিলাম হাত-পা ঝাড়া, সেরকমই চলতে পারত। এমনও তো নয় যে, যে-মহিলাকে বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়ে বসেছি, তাঁকে প্রথম দেখেই দিওয়ানা হয়ে পড়েছিলাম।

সুন্দরী-স্বাস্থ্যবতী একজন মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলে এই অসময়েও, মানে পঞ্চাশের পর থেকে, যেকোনো দিন করতে পারতাম। সানন্দে রাজি হওয়ার পাত্রীর অভাব যে হতো না, তা-ও নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ বিত্তবান বলতে আপনারা যাদের বোঝান, আমি তাদের দলে তো বটেই, বরং এই শহরে একটু বেশি বিত্তবানদের একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হলে সেখানেও আমার নামটা রাখতে হবে আপনাকে। চেহারা-সুরত আহামরি নয়, তবে পার্টি-ফার্টিতে সুবেশী মধ্যবয়েসি লোকদের ভিড়ে বাকি দশজনের চেয়ে খারাপ দেখায় না; মানে পেট মোটা, থপথপ করে হাঁটে, ছোট চোখ দুটো দিয়ে চারপাশে পিটপিট করে তাকায়, খ্যাক্‌খ্যাক্‌ করে হাসে, আর ব্যুফে মেন্যু থেকে একগাদা খাবার নিয়ে প্লেট ভর্তি করে ফেলে, তাদের দলে আপনি আমাকে কিছুতেই ফেলতে পারবেন না। তো আমি যখন সুন্দরী বিধবা ভদ্রমহিলাকে প্রস্তাব দিলাম তিনি প্রথমে বিস্মিত, তারপর আমার উদ্দেশ্য নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ও শংকিত এবং সবশেষে একটি কন্যাসন্তান নিয়ে দীর্ঘকাল কষ্টের জীবন, মানে যাকে আপনারা বলেন জীবনসংগ্রাম থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন।

আপনারা বলবেন ভীমরতি। এই বয়সে এসে এরকম একটি অঙ্গীকারে জড়ানোটা নিশ্চয় ভীমরতির পর্যায়েই পড়ে, বিশেষত যার কি না নারীসঙ্গের জন্য বিবাহের মতো সামাজিক প্রথা মেনে নেওয়ার দায় নেই। সত্যি কথা বলতে কী, অবিবাহিত এবং সব অর্থেই সমর্থ একজন পুরুষ মানুষ হিসেবে দেশের বাইরে নানা সময়ে অর্থের বিনিময়ে নারীসঙ্গ লাভের সুযোগ আমি নিয়েছি, নিতে হয়েছে। প্রকৃতি আমার-আপনার সবার মধ্যেই কিছু স্বাভাবিক চাহিদা তৈরি করে দিয়েছে, যার কাছে অনেক সময় আমরা অসহায় হয়ে পড়ি। ঋতুবৈচিত্র্যের প্রভাব থেকে অবিবাহিত ব্যক্তিরা নিষ্কৃতি পাবেন – এমন কোনো নিয়ম নেই। সুতরাং ‘দুশ্চরিত্র’ হিসেবে আমাকে দেগে দেবেন না, আপনাদের বিবেচনা-শক্তির ওপর এটুকু ভরসা করতে চাই আমি।

শিল্পপতি হিসেবে দেশে আমার মোটামুটি সুখ্যাতি আছে; কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে কি জানেন, আমি আদতে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলিনি। যেসব পণ্য গুণ ও মানের জন্য বিশ্বজুড়ে গ্রাহকদের কাছে আদৃত, সেরকম কিছু কিছু পণ্য এদেশে বাজারজাত করার স্বত্ব ক্রয় করেছি আমি এবং বলা বাহুল্য সে-ব্যবসায় যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছি। আসলে এই পরামর্শ আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন আমার মরহুম পিতা আলী হোসেন চৌধুরী। স্বাধীনতা-পূর্বকালে তাঁর তিনটি পাটকল ছিল; কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব পাটকল জাতীয়করণ করা হলে আমার শৈশবেই প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক আলী হোসেনকে প্রায় নিঃস্ব হয়ে যেতে দেখেছিলাম আমি। বেচারা শেষ জীবনে প্রায় নিম্নবিত্তের জীবনযাপন করেই বিদায় নিয়েছিলেন। তিনি আমাকে মূলধন কিছুই দিয়ে যেতে পারেননি, শুধু পরামর্শটাই দিয়েছিলেন, যেন উৎপাদনের মতো জটিল পদ্ধতির পরিবর্তে কেনাবেচার সহজ পথটা বেছে নিই। নিয়েছিলাম। হাজার হোক রক্তে তো ব্যবসা ছিল, আর ছিল আলী হোসেনের ব্যবসায়িক সততার সুনাম। ফলে শূন্য থেকে আবার শয়ে যাওয়া দুরূহ হলেও দুঃসাধ্য ছিল না; কিন্তু এর মধ্যে সময়টা চলে গেল। ভাবতেও পারবেন না, কোনদিক দিয়ে যে গেল নিজেই টের পাইনি! কেন বিয়ে-সংসার করার সময় পেলাম না এবার বুঝতে পারছেন তো?

ধান ভানতে শিবের গীতের মতো অনেক কথা বলা হয়ে গেল না? এটা বয়সের দোষ, সব কথার সঙ্গে একটু অতীতের প্রসঙ্গ তুলতে না পারলে স্বস্তি পাওয়া যায় না। আমার বিয়ের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ফিরি। আমার মতো একজন ভীমরতিপ্রাপ্ত কী রকম ফাঁদে পড়েছিল এবং একজন ঈশ্বর (যদি আপনাদের তাঁর সম্পর্কে বিশ্বাস ও ভক্তি থাকে) কীভাবে তাকে চোরাবালি থেকে তুলে সঠিক পথে আনন্দদায়ক বিচরণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন এ তারই গল্প।

আমার প্রতিষ্ঠানে এখন কয়েক হাজার ছোট-বড় কর্মী, যাদের অনেককেই আমি ঠিকমতো চিনি না। নিজের কাজকর্মও অনেকটাই গুটিয়ে এনেছি। বছরশেষে ব্যালান্সশিটে চোখ বুলাই, আর শেষ লাইনে গিয়ে অংকটা আমার সৌভাগ্যের দিকে ঝুঁকে আছে দেখলেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। মনোরঞ্জন বিশ্বাস নামে আমার একজন ব্যক্তিগত সহকারী আছেন। এই নামটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে খুব মজা পাই আমি। যেমন, মন রঞ্জনের জন্য বিশ্বাস রাখা যায় যার ওপর সে-ই মনোরঞ্জন বিশ্বাস, হা হা হা। মনোরঞ্জনকে আমি পছন্দ করি, আবার তার পাছায় কষে লাথি দিতেও ইচ্ছে করে আমার। সর্বক্ষণ প্রভুভক্ত কুকুরের মতো কুঁইকুঁই করা লোককে আসলে বিত্ত ও ক্ষমতাবান মানুষ পছন্দ করে, আমিও করি। তবে ওই যে বললাম, পাছায় কষে লাথি দেওয়ার ইচ্ছা, সেটাও আছে, দিই না অবশ্য। ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে আমার বিদেশ ভ্রমণে প্রায় নিয়মিত সঙ্গী মনোরঞ্জন। আমার দুষ্কর্মের সহযোগীও। বিদেশে সারাদিন ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে রাতে হোটেলে ঢুকলে কোন মেয়েটা আমাকে সঙ্গ দেবে – এসব দায়িত্ব স্বউদ্যোগে পালন করে মনোরঞ্জন। বেশিরভাগ সময় তার জ্বেলে রাখা প্রদীপের আলোর দিকেই ছুটতে বাধ্য হই আমি। কদাচিৎ বিবমিষা জাগে, তখন এসব কাজকর্ম নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করি, মনোরঞ্জন আমার মনের অবস্থা বুঝে নিয়ে রাতের সুন্দরীকে বিদায় দেয় এবং হাত কচলাতে থাকে, তখন তার পাছায় একটা লাথি দেওয়ার দুর্মর বাসনা অতি কষ্টে দমন করতে হয় আমাকে।

এই ব্যাপারগুলো ঘটত কেবল দেশের বাইরে গেলে; কিন্তু এবার মনোরঞ্জন আমাকে অন্যভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করল।

‘এইচআর ডিপার্টমেন্টে জিনিয়া নামে একটি মেয়ে জয়েন করেছে, দেখেছেন স্যার?’

‘নামে তো চিনি না, বিশ-বাইশ বছরের একটা নতুন মুখ দেখেছি দু-একবার এসেছে কাগজপত্র নিয়ে। সুন্দরী, চটপটে …।’

‘হুঁ হুঁ …, দারুণ স্যার …।’ লেজ নাড়তে লাগল মনোরঞ্জন।

‘কেন বলছ?’

‘আমাদের নেক্সট ট্রিপ তো জাপানে, লিয়াজোঁ অফিসে রিক্রুটমেন্টের একটা ব্যাপার আছে, এইচআরের একজনকে সঙ্গে নিয়ে তো যেতেই পারি আমরা।’

‘এই পুঁচকে মেয়ে রিক্রুটমেন্টের কী বুঝবে?’

‘ওর বোঝার দরকার কী, যা বোঝার বুঝবেন আপনি, ও শুধু সঙ্গে থাকবে, মানে …।’

‘বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ও কি রাজি হবে?’

‘আলবৎ হবে, নিডি ফ্যামিলির মেয়ে স্যার, ওপরে উঠতে চায়, প্রমোশন চায় …।’

আমি অসহায় কণ্ঠে বললাম, ‘দেখো …।’

মনোরঞ্জন হাসল। ওর চোখগুলো খুব ছোট, হাসলে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

জাপান ট্রিপে আমাদের সফরসঙ্গী হলো জিনিয়া। দেখতে যেমন সুন্দরী, সাজপোশাকটাও তেমন আকর্ষণীয়, কিন্তু বাহুল্যবর্জিত। ব্লু ডেনিমের ওপর সাদা সিøভলেস একটা শার্ট পরে বিমানবন্দরে যখন সালাম দিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল সত্যি বলতে কী আমি মুগ্ধ। মেয়েটার চেহারায় একটা শিশুসুলভ ব্যাপার আছে, সারল্য আর মায়ায় মাখামাখি।

বিমানে পাশাপাশি বসেছিলাম আমরা। মনোরঞ্জন একটু দূরে, ইচ্ছে করেই বিমানের টিকিট এভাবে ব্যবস্থা করেছে। এসব ব্যাপারে তার হিসাব-নিকাশে কোনোদিন ভুল হতে দেখিনি আমি। তবে পাশাপাশি বসেও যাত্রাপথে পরিবারে কে কে আছে,

কোথায় পড়াশোনা করেছে ইত্যাদি দু-একটি কথা ছাড়া গাম্ভীর্য ব্যাহত হতে পারে এমন কোনো কথার আশপাশ দিয়েও গেলাম না। মেয়েটা সপ্রতিভ হলেও বাচাল নয়, বোঝা গেল।

টোকিওতে একটা পাঁচতারকা হোটেলে উঠেছিলাম আমরা। বিস্ফারিত চোখে হোটেল লবির সজ্জা ও আয়োজনের দিকে জিনিয়ার তাকানো দেখেই অনুমান করা যায়, জীবনে এরকম কোনো হোটেলে আগে পা রাখেনি; কিন্তু ওই যে বললাম সপ্রতিভতা, মেয়েটা তার এই সহজাত গুণ দিয়ে নিজের বিস্ময়কে চাপা দিতে পারল, স্বচ্ছন্দ একটা ভঙ্গিতে মানিয়ে নিল পরিবেশের সঙ্গে।

পাশাপাশি দুটো কামরা আমাদের জন্য ব্যবস্থা করে রেখেছিল মনোরঞ্জন। রাতে আমি ডাইনিংয়ে না গিয়ে দুজনের জন্য খাবার দিয়ে যেতে বলেছিলাম আমার কক্ষেই। হোটেলের পরিচালক জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনার মেয়ে কি এ-ঘরেই খেতে আসবেন?’

আমি পরিচারককে আমাদের সম্পর্ক শুধরে দেওয়ার পরিবর্তে বলেছি, ‘হ্যাঁ।’

রাতে একসঙ্গে বসে নৈশভোজ সারলাম। জিনিয়ার খাওয়া-দাওয়ার ভঙ্গি খুবই পরিশীলিত। তাছাড়া খাওয়ার সময় খুব বেশি কথাও বলল না সে। শেষ করে আমাকে শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিল। কিন্তু আমি তো জানতাম, এই রাতে এটাই আমাদের শেষ দেখা নয়।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আমার ঘরে টোকা পড়ল। জিনিয়া বলল, তার বাথরুমে গ্রিজারটা কাজ করছে না, পানি খুব ঠান্ডা, রাতে তার স্নান করার অভ্যাস। জানতে চাইল, আমার বাথরুমটা সে ব্যবহার করতে পারে কি না।

আমি জানি এটা মনোরঞ্জনের শিখিয়ে দেওয়া কৌশল।  আমি তাকে অনুমতি দিলাম। 

মেয়েটা বাথরুমে ঢোকার আগেই তার জামা-কাপড় ছাড়ল। বিশাল বিছানায় শুয়ে লেপের তলায় সারা শরীর ঢেকে রেখে আমি দেখতে পেলাম মেয়েটা বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ সময় নিয়ে এক এক করে শার্টের ওপর থেকে জ্যাকেট, শার্ট, জিন্সের প্যান্ট খুলছে। এখন শুধু দুটি অন্তর্বাস আছে তার শরীরে। ফর্সা সরু হাত-পা, ব্রার নিচে তার হালকা উড়ুউড়ু স্তন – এসব এখন আমার চোখের সামনে উন্মুক্ত। জিনিয়া কি আমাকে লোভাতুর করে তুলতে চাইছে? স্বাভাবিক, সেভাবেই নিশ্চয় শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। কিন্তু ওই শরীরের দিকে তাকিয়ে কিছুতেই নিজের শরীরকে উদ্দীপ্ত করতে পারলাম না আমি। চেহারাটা আগেই শিশুর মতো মনে হয়েছিল, এখন শরীরটা দেখেও নিতান্তই বাচ্চা মেয়ে মনে হচ্ছে তাকে। জিনিয়া বাথরুমে ঢুকে পড়ল।

এসময় জগৎ-সংসার নিয়ে নানা চিন্তায় ডুবে গেলাম আমি। এই বয়সের মেয়েটা কেন বাপের বয়েসি একজন লোকের সঙ্গে রাত কাটাতে এলো? মনোরঞ্জন বলছিল, ‘নিডি ফ্যামিলির মেয়ে।’ বসের সঙ্গে রাত কাটিয়ে সে চাকরিতে উন্নতি করতে চায়, চাকরিটা পোক্ত করতে চায়। তার মানে, সর্বক্ষণ একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হয় তাকে, চাকরিতে টিকে থাকা না থাকার অনিশ্চয়তা! এই মেয়ে কী আগেও কারো সঙ্গে রাত কাটিয়েছে? কেন যেন আমার তা মনে হচ্ছে না, কারণ অভ্যস্ত মেয়েদের আচরণে সেটা প্রকাশ পায়। তাহলে চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগা এই বিশ-বাইশ বছরের মেয়েটার কৌমার্য হরণের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর? নিজেকে অদ্ভুত জন্তুর মতো মনে হচ্ছে আমার, না ঠিক জন্তু নয়, জন্তুদের অগাধ টাকা-পয়সা থাকে না, এতো কৌশল তাদের আয়ত্ত নয়, একটা মানুষই, কিন্তু বিকৃতরুচির কুৎসিত মানুষ!

জিনিয়া বেরিয়ে এলো একটি বাথ স্কার্ট টাওয়াল পরে, নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা। এই পোশাক তাকে নিশ্চয় হোটেল থেকে দেওয়া হয়নি, আসার সময় ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তাকে এই পোশাকে দেখেও আমার মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি, যৌন আবেদনময়ী নয়, বরং একটি আদুরে বেড়াল মনে হচ্ছিল তাকে।

দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে আমার বিছানার পাশে দাঁড়াল, ‘আমি কি চলে যাব স্যার?’

‘না, তুমি বরং আমার পাশে একটু বসো।’ আমি বললাম।

জিনিয়া বসল, দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছে সে। এবার আমি সরাসরি জানতে চাইলাম, ‘তুমি এর আগে কোনো পুরুষের সঙ্গে শুয়েছো?’

‘না, না স্যার …।’ গলাটা কেঁপে গেল তার।

‘তাহলে কী মনে করে আমার কাছে চলে এলে?’

‘আসলে, আমার চাকরিটা পার্মানেন্ট হয়নি স্যার …।’

‘পার্মানেন্ট চাকরির জন্য অফিসের বড় সাহেবের সঙ্গে শুতে হয়?’

‘আমি তো জানি না স্যার …, মনোরঞ্জন স্যার বললেন …।’

‘হুমম। আমার না অনেকদিন ধরে ওর পাছায় একটা লাথি দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু দিতে পারছি না, কী করি বলো তো?’

এ-প্রশ্নের উত্তর জানা নেই জিনিয়ার, সে শুধু চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

‘এসো, তুমি আমার পাশে

শোও…।’ আমি জিনিয়াকে লেপের তলায় টেনে নিলাম।

মেয়েটা আমার পাশের বালিশে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে পড়ে রইল। আমি তার মাথাটা আমার বুকের কাছে টেনে নিলাম। মেয়েটার শরীর থিরথির করে কাঁপছে। আমি গভীর মমতায় তার মাথায় হাত বুলোতে লাগলাম। তার চুল থেকে সুন্দর একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। এরকম বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর মনে হলো খুব সরু ও প্রায় অস্ফুট একটা নাক ডাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমি নিশ্চিত হলাম জিনিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। ভ্রমণক্লান্তি আর দাফতরিক কাজ শেষে ক্লান্ত মেয়েটা।

আরো দুদিন টোকিও অবস্থানকালে দরকারি কাজ সেরে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়ানো হলো। মনোরঞ্জন একটু অবাক, কারণ আমি এর আগে কখনো পর্যটন বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করিনি। তবে তার মনোভাব মুখ ফুটে প্রকাশ করল না সে। বাকি দুদিনও আমি আর জিনিয়া আমার কক্ষে বসেই নৈশভোজ সেরেছি। তারপর সে ফিরে গেছে নিজের কামরায়।

দেশে ফিরে দ্রুত নিজের জন্য দুটো কাজ নির্ধারণ করে ফেলেছিলাম আমি। মনোরঞ্জনকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমার বয়স যেন কত হলো মনোরঞ্জন?’

‘আপনার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় হবো স্যার …।’

‘ও অনেক বয়স, তুমি এবার অবসর নাও।’

মনোরঞ্জন হতবাক। সরকারি অফিসের মতো আমাদের প্রতিষ্ঠানে বয়স মেপে অবসর নেওয়ার রেওয়াজ গড়ে ওঠেনি। কিন্তু বড় কর্তা অবসর নিতে বললে তার জন্য যে কোনো নিয়ম-নীতির প্রয়োজন হয় না এটা মনোরঞ্জনের চেয়ে বেশি বুঝবে কে!

জিনিয়াকে বলেছিলাম, ‘একবার তোমার বাসায় বেড়াতে যেতে চাই।’ মেয়েটা কিছুটা বিব্রত, বিস্মিত ও ততোধিক আনন্দিত হয়ে আমাকে তার বাসায় একদিন নিমন্ত্রণ করল।

আমার কপাল ভালো, জিনিয়ার মা লুৎফুন্নেসা দেখতে এখনো যথেষ্ট সুন্দরী। না হলেও আমার কিছু করার ছিল না, কারণ না দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই বিধবা মহিলাকে আমি বিয়ের প্রস্তাব দেব। জীবনের এ-পর্যায়ে এসে ভাগ্য আমাকে নানাভাবে সাহায্য করতে শুরু করেছে। প্রথমে হতভম্ব হলেও পরে ধাতস্থ হয়ে আমার প্রস্তাবটা সানন্দে গ্রহণ করেছে জিনিয়া ও তার মা।

একটা কথা বলি, দয়া করে দার্শনিকতা ফলানোর চেষ্টা মনে করবেন না, এই বয়সে এসে এটা আমার উপলব্ধি, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে একটা অশ্রুত সুর আছে। কখনো সেই সুর মেলে না, কখনো অল্প কিছু মেলে, আর কখনো সুর, তাল, লয় একেবারে একাকার হয়ে যায়। এরকম মিলে গেলে এটা হয়ে ওঠে চিরকালের গান।

জিনিয়ার সঙ্গে আমার সুরটা অসাধারণ একটা গান হয়ে উঠেছিল। নইলে হোটেলের কামরায় যখন তাকে প্রায়-অনাবৃত শরীরে দেখেছিলাম, তখন আমার মধ্যে এতোটুকু যৌনতার বোধ তৈরি হলো না কেন? কেন হঠাৎ প্রায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে মনে হলো, এই মেয়েটিকে যদি শিশুকাল থেকে কোলে-পিঠে নিয়ে বড় করতে পারতাম আমি! আবার জিনিয়ার দিক থেকেও সুরটা যদি মর্মে স্পর্শ করার মতো ব্যাপার না হতো তাহলে একটা অপরিচিত ও অনাত্মীয় বয়স্ক লোকের বুকে মাথা রেখে কী করে অকাতরে ঘুমোতে পারল মেয়েটা! অবিবাহিত জীবন নিয়ে এতোকাল কোনো আফসোস ছিল না আমার; কিন্তু সেদিনই প্রথম সন্তান-সংসার নিয়ে নিজের মধ্যে এক ধরনের কাঙালপনা, কিংবা আপনারা যাকে বলেন অপত্য  স্নেহ, অনুভব করেছিলাম। ওর সঙ্গে সম্পর্কটাকে বাকি জীবন বয়ে নিয়ে যেতে চাই, কেননা আমি বুঝে নিয়েছি বিশাল এক অপ্রাপ্তির জীবনে মেয়েটা আমার চিরকালের সুর।