সুপ্তবীজ

রুপালি রোদের পরশ নিয়ে মাঠের দিকে এগোতে লাগল চন্দা।

আগে এ-গাঁয়ে কার্তিক মাসের শুরুতে এতো সকালে কেউ মাঠের দিকে যেত না। ঋতু-বৈচিত্র্যে কার্তিক মরা মাস হলেও দিন পাল্টে যাচ্ছে। চন্দাদের পরিবারের অনেকেই একসঙ্গে মাঠে যাচ্ছে। মরা মাসেও কিষান-কিষানিরা মাঠে সবুজ ঢেউ ওঠায়। মঙ্গা মোকাবিলায় গ্রামের প্রায় সবাই এখন চাষ করছে আগাম জাতের ব্রি-৩৩ ও বীণা-৭ জাতের ধান। এক সপ্তাহ আগে শেষ হয়েছে ধানকাটা। ধান মাড়াইও শেষ। তবে মাঠ শূন্য হয়ে থাকেনি। ধান কাটা শেষ হতেই বিভিন্ন জাতের আলু আবাদের জন্য উৎসবে মেতেছে চন্দাদের গ্রাম। গত দুদিন ধরে লাঙলের ফলার টানে মাটির বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে তৈরি করা ভূমিতে আলুবীজ লাগানোর উদ্দেশ্যে ঝুড়িতে বীজ নিয়ে মা-সহ আরো অনেকের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া চন্দা।

বীজ রোপণ করার পর জাতভেদে পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন দিন পর আলু বাজারে তোলা যায়। আগাম আলু তুলতে পারলে লাভও প্রচুর, জানে ওরা। মরা কার্তিকের মরা সুর পালিয়ে যায় তখন। গ্রামের ঘরে ঘরে হাজির হয় সোনালি কার্তিক; এ-সময় সপরিবারে সবাই মাঠে নামে, কামলাও পাওয়া যায় সুলভে।

মাঠে গিয়ে চন্দার মনে উৎসবের ধুম জাগল।

মাইলের পর মাইল জুড়ে আলু আবাদের এ-উৎসবে শরিক হতে পেরে ও গোপন উল্লাসে মেতে উঠল। মাথা থেকে ঝুড়ি নামাতে গিয়ে দেখল চন্দার বাবা মজিদ মিয়া তিনজন কামলাসহ নিরানির কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছেন।

চন্দাদের দেখে এগিয়ে এসে মজিদ মিয়া বললেন, ঝুড়ি আইলের ওপরেই রাহ, চন্দা।

চন্দা বলল, এতো সরু আইলের উপরে ঝুড়ি রাহন যাইব না, মাঠে রাহি?

মেয়ের কথা মেনে নিয়ে মজিদ মিয়া মাথা ঘুরিয়ে কাজে ব্যস্ত কামলা রশিদকে ডেকে বললেন, এই রশিদ, হগলের মাথাথুন ঝুড়িগুলা নামাও। বলেই স্ত্রীর মাথার ঝুড়ি নামাতে এগিয়ে গেলেন তিনি।

হাতের কাজ থামিয়ে চন্দার দিকে এগিয়ে গেল রশিদ। ধরাধরি করে মাথা থেকে ঝুড়ি নামিয়ে বলল, এত্ত বড় ঝুড়ি আনলা ক্যামনে, তুমি?

অসুবিধা কী? ঝুড়ি বইয়া তো আনন্দ পাইতাছি। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জবাব দিলো চন্দা।

চন্দার কথার উচ্ছ্বাসে আচমকা মুখের কথা হারিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল রশিদ। মলিন মুখে এগিয়ে গেল ক্ষেতের দিকে। একসময় স্কুলে যেত রশিদ। এখন কামলার কাজ করে মাঠে মাঠে। রশিদের বাবা রহিম মাওলার হঠাৎ মৃত্যু হলে ওদের পরিবারে নেমে আসে দুর্ভোগ। বড় ছেলে হিসেবে পরিবারের দায়-দায়িত্ব এসে পড়ে রশিদের ঘাড়ে। আয়-রোজগারের স্থায়ী কোনো সুযোগ না-থাকায় কামলার কাজ করতে বাধ্য হয়েছে রশিদ।

রশিদের মন খারাপ হওয়ার বিষয়টা চোখ এড়াল না চন্দার। কথার দাপটে মøান হয়ে যাওয়া রশিদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ওরও মন খারাপ হয়ে গেল। আচমকা যেন শুভ্র আকাশে উড়াল দিয়ে ছুটে এসেছে কালো মেঘ। ওই মেঘের আড়ালে কী আছে? মনে প্রশ্ন এলেও উত্তর খুঁজে পেল না চন্দা। কেবল মনে পড়ল ওদের স্কুলে পড়ত রশিদ। ভালো ফুটবল খেলত। ওদের দু-বছরের সিনিয়র রশিদ পড়াশোনা ছেড়ে এখন পিছিয়ে পড়েছে। কেমন যেন মায়া লাগল। এতো দাপটের সঙ্গে কথা না-বললেও চলত।

মন বেশিক্ষণ খারাপ থাকার সুযোগ পেল না। কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে সবাই। লাঙলের ফলায় কর্ষিত মাটিতে লম্বালম্বি নালার মতো সারিবদ্ধ চিকন নাইল বরাবর আলুবীজ ঢুকিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে ওরা। চন্দার হাতের গতিও বাড়ছে দ্রুততার সঙ্গে। সময় নেই কারো। রোদ কড়া হওয়ার আগেই কাজ সেরে নিতে হবে। হাঁটু  গেড়ে বসে দু-হাতে আলুবীজ মাটির নাইলে ঢুকিয়ে গর্তের দুপাশে দু-পা রেখে লাইন বরাবর এগিয়ে যাওয়ার সময় মাথা তুলে একবার জমিনের শেষ সীমা পর্যন্ত দেখল চন্দা। দাঁড়ানো অবস্থার চেয়ে বসা অবস্থায় সারিবদ্ধ লাইনগুলো অনেক বেশি লম্বা মনে হলো। ডানে-বাঁয়ে তাকাতে গিয়ে দেখল লাইনগুলো ঠিক রুলটানা খাতার লাইনের মতো সারিবদ্ধ, সুশৃঙ্খল। রশিদই তৈরি করেছে এসব। জমিনের দিকে তাকিয়ে ভাবল, এটা কেবল কামলার কাজ নয়; কোনো নিপুণ শিল্পী যেন ক্ষেতে এঁকে রেখে গেছে শিল্পিত রেখা। শিল্প না-হলেও শিল্পের কাছাকাছি দৃষ্টিনন্দন ভূমির দিকে তাকাতে গিয়ে কিশোরীর মনভুবনে কম্পন উঠল। মাথা ঘুরিয়ে রশিদের দিকে তাকাল। তাকাতে গিয়ে থেমে গেল হাতের কাজ। লাইন ধরে এগোতে থাকা অন্যদের চেয়ে ও পেছনে পড়ে গেল। রশিদের পেশিবহুল উদোম শরীরে চোখ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখল তার শরীর থেকে ঝরতে থাকা লোনাজলে উর্বর হয়ে উঠছে মাটি। এ-মাটিতে শস্য বুনে মরা কার্তিক জেগে উঠবে, হেসে উঠবে। মরা মাটি আর মরা থাকবে না, শূন্য জমিনে খেলবে চকচকে সবুজ ঢেউ। দামাল হাওয়ায় উড়বে চুল, নড়বে গাছ-গাছালির সবুজ পাতা। ভোরের শিশিরের ওপর আছড়ে পড়া প্রথম রোদের মতো পরশ বয়ে গেল চন্দার কচি মনে। অজানা শঙ্কার ঘন ঘন নিশ্বাসে নড়ে উঠে ও আবার কাজে মনোযোগ দিলো।

মজিদ মিয়া বললেন, তাড়াতাড়ি হাত চালাও , চন্দা। পিছনে পইড়ে যাচ্ছ তুমি।

বাবার কথার জবাব না-দিয়ে দু-হাতের আঙুলের নিপুণ চালনায় মাটিতে বুনতে থাকল আলুবীজ। লোনাজল আর আলুবীজের সম্পর্ক টের পেতে পেতে চন্দা ভাবল, রশিদ ভাইকে বলতে হবে স্কুল যেন ছেড়ে না-দেয়। দু-বছর নষ্ট হলেও আবার যেন ভর্তি হয় স্কুলে।

শব্দ আর নিঃশব্দের ভেলায় চড়ে কড়া রোদ উঠল আকাশে। চড়া রোদও নিষ্প্রভ করতে পারল না চন্দার মনের সবুজ ঢেউ, ভোরের সূর্যের রশ্মির মতো উজ্জ্বলতর মায়াময় আলো। কেবলই মনে হতে লাগল রশিদকে কামলার কাজে মানায় না। তার তামাটে শরীরে রোদের ঢেউ চকচক করতে দেখল চন্দা। সেই রোদ ছুঁয়ে মাটিতে ঘাম ঝরছে। উর্বর মাটিতে ঢেলে দেওয়া ঘাম মেখে বুনছে সে শস্যবীজ। এ-বীজ থেকে শেকড় গজাবে মাটির দিকে, আর পাতা বেরোবে আকাশের দিকে। আলোর দিকে। বাতাসের দিকে। চন্দাও এগোতে লাগল আলো-বাতাস আর আকাশের দিকে।

দুই

বন্ধের দিন বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই একসঙ্গে মাঠে কাজ করলেও স্কুল ফাঁকি দেয় না চন্দা। পড়াশোনায় ও বেশ ভালো। দেখতেও লাবণ্যময়ী। জেএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আজো এসেছে ক্লাসে। আজ মন বসছে না শ্রেণিকক্ষে। স্কুলে আসার পথে কয়েকজন বখাটে পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল। কথা বলার চেষ্টা করেছিল। দাঁড়ায়নি ও। ক্ষুব্ধ চোখে একবার মাথা তুলে তাকিয়েছিল তাদের চোখের দিকে। চোখ থেকে জল নয়, ছুটে বেরিয়েছিল আগুন-শিখা। আগুন-নদীর স্রোতের মতো দেহের মধ্যে তৈরি হয়েছিল উত্তপ্ত জলধারা। আগুন থেকে জল, জল থেকে নদী। খরস্রোতা তরঙ্গ তুলে মাথা উঁচিয়ে দুরন্ত নদীর মতোই স্কুলে চলে এসেছে চন্দ্রা। আগুন তাকে পোড়ায়নি। পুড়িয়েছে চারপাশ। বখাটেরা ভীত হয়ে সরে দাঁড়ালেও পথ ছেড়ে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। আবারো হয়তো দাঁড়াবে ওরা পথের ধারে। ওদের দাপটে স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ছাত্রীর। বাল্য বয়সেই অনেককে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন মা-বাবারা। নিজেকে ওই দলে দেখতে চায় না চন্দা। তীব্র ইচ্ছা, ও পড়াশোনা করবে। কলেজে যাবে। ভার্সিটিতে যাবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না ওকে।

তেজ নিয়ে চলে এলেও এ-মুহূর্তে সেই তেজ নেই। মনে পড়ছে নিরীহ বাবার কথা। নিজেদের ভাঙা ঘরবাড়ি, আর্থিক দীনতা, অসহায় ছোট বোনদুটোর কথাও মনে পড়ছে। অশিক্ষিত সহজ-সরল মায়ের মুখ ভাসছে চোখে। আগুন-শিখার বদলে লোনাজলে ভরে উঠছে দু-চোখ। টপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল কোলে রাখা হাতের ওপর। জলের ফোঁটা চট করে মনে করিয়ে দিলো তীব্র রোদে ঘাম ঝরানো রশিদের কথা। মনে হলো, বুকের মাঝখান চিরে বয়ে গেছে সমান্তরাল এক রেললাইন। লাইনের অপর পাড় দিয়ে ছুটে যাচ্ছে রশিদ। ও এপারে। ওপারে রশিদের পথ ভিন্ন। এপারে ওর পথ বাধাগ্রস্ত। দুই পথ মিলবে না কখনো। তবু কেন মনে পড়ছে রশিদের কথা!

সে কী চন্দা! তোমাকে অন্যমনস্ক লাগছে কেন? চোখে জল কেন? একথা বলতে বলতে বাংলার শিক্ষক কোহিনুর বেগম পাশে দাঁড়ালেন।

হাতের উল্টোপিঠে গড়িয়ে পড়া চোখের পানি মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল চন্দা। প্রশ্নের জবাব না-দিয়ে ও এখন তাকিয়ে রইল নিচের দিকে।

কোহিনুর বেগম আবার বললেন, আমি জানি গ্রামীণ পরিবেশে তোমার মতো মেয়ের স্কুলে আসা-যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। পাড়ার মাস্তানদের জ্বালাতনে অতিষ্ঠ মা-বাবা অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন। পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়ে তারা। তোমার কি সেরকম কিছু ঘটেছে?

এবার মাথা উঁচিয়ে চন্দা জবাব দিলো, আপনার কথার প্রথম অংশ ঠিক আছে, ম্যাডাম; দ্বিতীয় অংশটি ঠিক নয়। তবে বাবা জানলে ভয় পেতে পারেন। দ্বিতীয় অংশের দিকে এগোতেও পারেন, মেয়েকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে শঙ্কামুক্ত হওয়ার জন্য ব্যাকুল হতে পারেন। এ-আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

না। তোমার মতো ভালো ছাত্রীকে স্কুল থেকে হারাতে চাই না। তোমাকে এগোতে হবে সামনে। প্রতিকূল  পরিবেশ মোকাবিলায় শক্ত হতে হবে।

শিক্ষিকার কথার আভাস ক্রমশই চোখের সামনে থেকে মুছে দিলো শ্বশুরবাড়ির ছবি। বাবার বাড়ি নয়, শ্বশুরবাড়ি নয়, ওকে নির্মাণ করতে নিজের বাড়ি। এ-দৃপ্ত বিশ্বাসে ঋদ্ধ চন্দা জবাব দিলো, হারিয়ে যাব না ম্যাম। আমার সাহস আছে। সর্বোচ্চ সাহস নিয়েই চলব আমি। এ-ধরনের অশুভ ফাঁদ ঠেকাব।

গুড। ভেরি গুড, চন্দা। এরকম তেজস্বিনী মেয়ের চোখে জল শোভা পায় না। সবার জন্যই তোমাকে শক্ত হতে হবে। তুমি ভেঙে পড়লে অন্যরাও ভেঙে পড়বে।

চোখের জল ঝরাতে চায়নি চন্দা। ও শক্তই ছিল। বখাটের ভয়ে নত হয়নি। দিশেহারা হয়নি। মাথা উঁচিয়ে চলে এসেছে ক্লাসে। রশিদের প্রসঙ্গ মনে আসায় লোনাজলের বেগ বেড়ে গেছে। কেন? ও কিছুই বুঝল না। এ-মুহূর্তে ম্যামের কথা শুনে কিছুটা স্থিত হয়ে জবাব দিলো, ভাঙব না ম্যাডাম। শক্তই থাকব।

পাশে বসা ঋতু এসময় চেপে ধরল চন্দার হাত। দু-হাত এক হওয়াতে সাহস আরো বেড়ে গেল চন্দার। নিজেকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হলো।

ঋতু বলল, ম্যাডাম বখাটেদের সামলানোর জন্য আমরা একত্রে চলাফেরা করব। তবু স্কুল ছাড়ব না।

উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে কোহিনুর বেগম বললেন, এটাই চাই আমি। সবাই জোটবেঁধে চললে বখাটেরা তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।

চন্দা ও ঋতুর কথা শুনে ক্লাসে বেড়ে গেল গুনগুন আওয়াজ। সবার সমস্যা একই। গ্রামের মেয়ে, ক্লাস এইটে পড়া মানে লোকজন মনে করে অনেক বড় হয়ে গেছে ওরা। ঘটক আসতে শুরু করে বাড়িতে। ঘটকের জ্বালার চেয়ে বড় জ্বালা হচ্ছে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েদের লাবণ্য, চেহারার মিষ্টি রূপ। মুরুব্বিরা অভিজ্ঞতার আলোকে দেখে আসছেন এ-বয়সের উপচেপড়া লাবণ্য থাকা অবস্থায় বিয়ে না-হলে পরবর্তীকালে ভালো বিয়ে হয় না। গ্রামে রূপ পরিচর্চার সুযোগ নেই। কঠোর পরিশ্রম করতে হয় মেয়েদের। ফলে তারা আর কিশোরী থাকে না। নারী হয়ে ওঠে অল্প বয়সেই। চেহারার মধ্যে রুক্ষতা ও মলিনতা দেখা দেয় দ্রুত। এ-কারণে তাড়াতাড়ি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় মেয়েদের। উটকো ঝামেলা হচ্ছে রাস্তাঘাটে চলাচলের নিরাপত্তাহীনতা। এ-মুহূর্তে ক্লাসে গুনগুন আলাপের বিষয় হচ্ছে কোহিনুর বেগমের বলা কথাটা। বিয়ের বিষয়টা লুফে নিয়ে চন্দা জবাব দিলো, জি ম্যাডাম। আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা সবাই জোটবেঁধে চলব। বখাটেদের রুখব। অসময়ে মেয়েদের বিয়ে ঠেকাব। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত অবৈতনিক পড়াশোনা শেষ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হবো। আমাদের চলার পথে আপনার গাইডেন্স চাই, ম্যাডাম।

উর্বশী, ক্লাসের অন্য এক ছাত্রী,

কথাটা লুফে নিয়ে বলল, গাইডেন্স পেলেই কি জোট বাঁধা যাবে?

চন্দাকে উদ্দেশ করে সে আরো বলল, তুমি আসো উত্তরপাড়া থেকে। আমার বাড়ি পূর্বপাড়ায়। একেক জন আমরা একেক দিক থেকে আসি। সবাই মিলে জোট বাঁধব কীভাবে? স্কুল ছুটি হলেই তো যে যার পথে চলে যাই। কে কোথায় উত্যক্তের শিকার হবো, জানি না আমরা।

উর্বশীর কথা উড়িয়ে না-দিয়ে চন্দা জবাব দিলো, প্রত্যেক পাড়া থেকেই এখন একাধিক মেয়ে আসি আমরা। একই পাড়ার সবাই জোটবেঁধে চলব। স্কুলে এলে সবার সমস্যা আলাপ করব। ম্যাডামের পরামর্শ নেব।

চন্দার কথায় সায় দিয়ে কোহিনুর ম্যাডাম বললেন, ও ঠিক বলেছে। কেউ তোমাদের উত্ত্যক্ত করলে মিডিয়ার সাপোর্ট নেব আমরা। মিডিয়া বেশ শক্তিশালী এখন। ঘাবড়ানোর কিছু নেই।

কোহিনুর বেগমের কথা শুনে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল ছাত্রীদের দল। চন্দার মনের শক্তি আরো বেড়ে গেল। কিছুক্ষণ আগে ভাবনার আড়াল থেকে জেগে ওঠা অনিশ্চিত শঙ্কার ঢেউ মিলিয়ে গেল মন থেকে।

কোহিনুর বেগম পড়ানো শুরু করেছেন। শান্ত হলেও পড়ার প্রতি মন বসছে না চন্দার। বারবার রশিদ ভাইয়ের মলিন চেহারা ভেসে উঠছে মনের ক্যানভাসে। ওদের পাশের বাড়ির রশিদ ভাই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন; সজ্জন, সুবোধ বালক হিসেবেও খ্যাতি আছে তার। ফুটবল খেলায় রশিদ ভাইয়ের বিকল্প প্লেয়ার নেই। স্কুলে না-এসে মাঠে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন তিনি। বিষয়টা মানতে পারছে না চন্দা। মানতে না-পারার কারণে চাপ বোধ করছে। এ-চাপে এখন বিক্ষিপ্ত হচ্ছে মন। অথচ ভালো রেজাল্ট করতে হলে পড়ায় মনোযোগী হতে হবে, বোঝে সব। বুঝেও সামাল দিতে পারছে না মনের গতি-প্রকৃতি। কেবলই মন ছুটে যাচ্ছে ক্ষেতের দিকে। বেপরোয়া মনকে আটকাতে চাচ্ছে। পারছে না। বড় করে শ্বাস টেনে নিশ্বাস ছেড়ে হালকা হয়ে বসল। হালকা মনেও ভেসে উঠল রশিদ ভাইয়ের মুখ। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে, হেমন্তের নবান্নের উৎসবে ও যোগ দিয়েছে। ধান মাড়াই করছে। আর পাকা ধান কেটে বাঁকে নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরছেন রশিদ ভাই। মাথায় জড়ানো রঙিন গামছা, গায়ে ছেঁড়া শার্ট। শার্টের অর্ধেক খোলা। বুক দেখা যাচ্ছে তার। ওই বুকে কী আছে? এমন দৃশ্য কেন ভেসে উঠছে চোখে?

ঋতু ফিসফিস করে বলল, আমরা যতই জোট বাঁধি না কেন, আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই হবে। রক্ষণশীল বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন আমাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। ওদের মুখের ওপর কথা বলার সাহস নেই আমার।

চন্দা বলল, বাল্যবিবাহ আইনত নিষিদ্ধ। আমরা সবাই গিয়ে তোর বাবা-মার কাছে হাজির হবো বিয়ে ঠেকাতে।

কোহিনুর বেগম বললেন, এখন পড়াচ্ছি আমি। পড়ানোর সময় কোনো গল্প চলবে না। পড়ার সময় কথা বলা উচিত নয়।

লজ্জা পেয়ে চন্দা ও ঋতু চুপ হয়ে ম্যাডামের কথা শুনতে লাগল।

কিছুক্ষণ আগে ছাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করেছেন, কথা বলেছেন, দেখে এখন বোঝার উপায় নেই। কোহিনুর ম্যাডামের এ-দৃঢ়তা ভালো লাগল চন্দার। ম্যাডামের দিকে মনোযোগ চলে এলো। প্রত্যয়ী ভাবতে পারল নিজেকেও।

তিন

খুব ভোরে মজিদ মিয়া আদর দিয়ে চন্দাকে বললেন, মা, আইজ বাড়িত থাইকো। বাইর হইয়ো না।

 কেন? আইজ তো ছুটির দিন। ক্ষেতে কাজে যাওনের লাইগা তৈয়ার হইছি, বাড়িত থাহনের দরকার কী, বাপজান?

নানাজনে নানা কথা কয়। গা-গতরে বড় হইছ তুমি। সাবধানে চলন ভালা।

অসাবধানে তো চলি না আমি। কী কন, আফনি?

না। তুমারে দুষ দিই না। তো, তুমার জন্য একটা সম্বন্ধ আহনের কথা আইজ।

মজিদ মিয়ার কথা শুনে বুকের পাঁজর ভীষণ ক্রোধে ফেঁপে উঠল, শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো বুকফাটা আর্তনাদ। বুকের গহন থেকে ছুটে আসা অশ্রুঝরা বোবা চিৎকার হিম নীরবতায় স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বাপজানের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে চন্দা বলল, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার আগে কোনো মেয়ের বিয়ে হবে না এ-গ্রামে। তোমরা সব বাবারা শুনে রেখো কথাটি। বিয়ে হলে আইনত দণ্ড হবে তোমাদের। বাল্যবিয়ে রোধে আমরা জোট বেঁধেছি।

মেয়ের কথার দাপটে আচমকা বোকা বনে গেলেন মজিদ মিয়া। মেয়ে সাধারণত বাড়িতে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে না। গ্রাম্য ভাষায় কথা বলে। এখন কথা বলছে শিক্ষিত মেয়ের মতো। মেয়ের মনের তেজ দেখে ভালো লাগলেও শঙ্কিত হয়ে বললেন, কী কও, মা?

বাবার এ-প্রশ্নের জবাব না-দিয়ে হনহন করে ক্ষেতের দিকে এগিয়ে গেল চন্দা। বাড়ির পাশেই ক্ষেত। আইলের ওপর ও বসে পড়ল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, এখানকার আকাশে মেঘ উড়িয়ে নিয়ে এসেছে অন্য দেশের বাতাস। তৃষ্ণায় কাতর আইলের ঘাসগুলো অজস্র আকাক্সক্ষা ছড়িয়ে কচি মাথা উঁচিয়ে রেখেছে আকাশের দিকে। কুয়াশার বুকে হাত চালিয়ে পরশ দিতে গিয়ে নিজের বুকের ভেতর জমাট আকাক্সক্ষার চাক ভেঙে দিলো ও। চোখ জোড়ায় ঝিলিক দিয়ে উঠল স্বপ্নের রংধনু। রংধনুর সাত রং চোখে  মেখে সামনে তাকাল চন্দা। দেখতে পেল রশিদকে। ক্ষেতের দিকে এগিয়ে আসছে রশিদ। বাবার কথায় মরে যাওয়া মনে জ্বলে উঠলো আবার প্রতিরোধের  আলো। কালবৈশাখির ঝড়ের মতো ঘূর্ণি বাতাস বইতে লাগল পাঁজরের ভেতর। রশিদ সামনে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চোখের পাতায় ভেসে উঠল আলপনা। টান লাগল রঙিন চরকিতে, নড়ে উঠল ভেতরের শেকড়। চন্দার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল রশিদ। কিছু বলতে গিয়েও বলল না, পাশ কেটে এগিয়ে যাচ্ছিল। 

বাবার কথা ধার করে চন্দা বলল, ‘গা-গতরে বড় হইয়া ওডা’ মাইয়াডার দিকে চোখ গেল না, রশিদ ভাইজান? না দেইখ্যাই পথ হাঁটচুন?

হাঁটা থামিয়ে রশিদ তাকাল চন্দার দিকে। চোখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকাল চন্দা।

রশিদ বলল, কী কও তুমি?

বাপজানকে প্রশ্ন করেছিল, ‘কী কন, আফনি?’ আর রশিদ প্রশ্ন করল, ‘কী কও, তুমি?’ দুই তার থেকে একই সুর বেরিয়েছে! ভাবতে গিয়ে চমকে উঠল চন্দা। চমকানো মুখ বলে বসল, আমি কিছু কই না। বাপজান কইছে ‘গা-গতরে বড় হইছি’ আমি। বিয়ার কথাবার্তা চলতেছে অহন।

ওঃ। বলে থেমে গেল রশিদ।

রশিদকে চুপ থাকতে দেখে চন্দা আবার বলল, আফনি আবার স্কুল যাইবেন কবে?

প্রশ্নের জবাব না-দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল রশিদ। মা আর দু-বোনের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার জন্য দিনভর পরিশ্রম করে সে। স্কুলে গেলে কে খাওয়াবে ওদের। স্কুলে যেতে ইচ্ছা করলেও বাস্তবতার শেকলে আটকে গেছে পা। একথা চন্দাকে বলা গেল না। মাথা নিচু করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকল রশিদ।

কথার জবাব না-পেয়ে ক্ষেপে উঠল চন্দা। চিৎকার করে বলল, স্কুলে যাওন লাগব আফনাকে। বুঝলেন, স্কুলে যাওন লাগব। যাইতেই অইব।

রশিদের বুকের ভেতর থেকে উড়াল দিয়ে পালিয়ে গেল কষ্টের পাখিরা। বুকের সাদা পৃষ্ঠায় ছাপ বসে গেল চিৎকার-ধ্বনির। মমতার পরশ পেল রশিদ। শুনল কাব্যধ্বনির তীব্র হাহাকার। মাথা নিচু না-করে, উঁচু করেই হেঁটে যেতে লাগল সে সামনে।

চার

পূজার ছুটির পর স্কুলে এসে স্তব্ধ হয়ে গেল চন্দা। জোট বাঁধার কথা থাকলেও জোট বাঁধতে পারেনি ওরা। গতকাল বিয়ে হয়ে গেছে সহপাঠিনী ঋতুর। শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে সে। ক্লাসের মেধাবী ছাত্রী ঋতুর বিয়ে হওয়াতে ভেঙে পড়েছে সবাই।

কোহিনুর বেগম বললেন, ভেঙে পড়লে চলবে না। ভবিষ্যতে যেন এমনটা ঘটতে না পারে – সতর্ক হতে হবে সবাইকে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দফতরে স্মারকলিপি জমা দেবে তোমরা। পারবে না?

সমস্বরে সবাই চিৎকার করে বলল, পারব ম্যাডাম।

তাহলে স্কুলের সব মেয়ে মিলে একটা সংগঠন গড়ে তোলো – ‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ সংঘ’। এ-সংগঠনের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দেবে, পত্রিকার রিপোর্টারদের কপি দেবে, পারবে না তোমরা?

আবারো সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, পারব, ম্যাডাম।

তাহলে প্রস্তুত হও সবাই।

চন্দা বলল, তার আগে আমার একটা প্রস্তাব আছে, ম্যাম।

কী প্রস্তাব?

অল্প বয়সে স্কুলপড়ুয়া ঋতুর বিয়ে আমাদের জন্য একটা শোকের

ঘটনা। আসুন সবাই মিলে আমরা এক মিনিট নীরবতা পালন করি। শোক পালন করি।

চন্দার কথায় রাজি হলেন কোহিনুর বেগম। এক মিনিট নীরবতা পালন করা হলো। এর পর একটা কমিটি করা হলো। কমিটির সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হলো চন্দাকে। উর্বশীকে করা হলো সাধারণ সম্পাদক। চিঠি ড্রাফট করা হলো। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে চিঠিটি দিয়ে আসা হলো উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দফতরে। জনপ্রিয় দুটি পত্রিকার রিপোর্টারদেরও দেওয়া হলো কপি।

পরদিন খড়গপুর গ্রামের ‘বাল্য-বিবাহ প্রতিরোধ সংঘে’র খবর ছাপা হলো পত্রিকায়। উপজেলা কর্মকর্তার দফতর থেকে প্রথমে সাড়া পাওয়া না-গেলেও পত্রিকায় নিউজ ছাপা হওয়ার পর নড়েচড়ে বসলেন তাঁরা। এ-সংবাদ রটে গেল পুরো গ্রামে। সেই সঙ্গে রটে গেল চন্দা ও উর্বশীর নামও।

পাঁচ

স্কুলে যাওয়ার পথে চন্দার পথ আগলে দাঁড়াল পাড়ার উঠতি মাস্তান মোহাম্মদ আলি। সবাই তাকে ডাকে ‘নরক আলি’ বলে।

অতিভক্তি ভরে নরক আলি বলল, হুনলাম তুমি নাহি আমাগো পাড়ার নেত্রী হইছ।

চন্দা বলল, ঠিকই শুনেছেন। সে-কারণে আপনার কোনো অসুবিধা হয়েছে? সাধারণত ক্লাস ছাড়া শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে না। নরক আলির কথার জবাব শুদ্ধ ভাষাতেই দিলো চন্দা।

চন্দার কথা বলার দাপট দেখে হোঁচট খেল নরক। পাড়ার মেয়েরা তাকে দেখলে মাথা নিচু করে চলে। এই মেয়েকে উদ্ধত ভঙিতে কথা বলতে দেখে তার আঁতে ঘা লেগে গেল।

তো, তোমাগো দলে কি রাইখবা আমারে?

রাখব। তবে শর্ত হলো, নরক আলির ‘নরক’ শব্দটা ঝেড়ে ‘ভদ্র’ আলি হতে হবে আপনাকে।

ওঃ। আমি তাইলে অভদ্র?

হ্যাঁ, অভদ্র আপনি। অভদ্রতার প্রমাণ রেখেছেন গ্রামে।

কী কইলা? প্রম্মাণ রাহিছি, আমি?

বললাম তো। ভদ্র হন। তারপর ভালো কাজে অংশ নিন।

ওঃ! তুমি তিন মাসের পোয়াতি হইছিলা, হুনছিলাম। পোয়াতি খালাস কইরা কি ভদ্র হইছ? হের লাইগ্যা নেত্রী হইবার ক্ষেমতা পাইছ?

দুম করে মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। পায়ের স্যান্ডেল হাতে নিয়ে রুখে দাঁড়াল চন্দা। জ্বলে ওঠা চন্দার এতো সাহস কোত্থেকে এলো, নিজেই বোঝার সুযোগ পেল না। চন্দার উগ্রমূর্তির সামনে থেকে সরে পড়ার মুহূর্তে নরক আলি বলে গেল, তোমার পোয়াতি হইবার খবর চাউর কইরা দিমু না, গোপন রাখুম। তবে সোজা লাইনে না আইলে … কথা শেষ না-করেই সরে পড়ল নরক আলি।

ছয়

ভোরের সূর্য তখনো ওঠেনি আকাশে। হেমন্তের শিশির জমে আছে গাছে গাছে, ঘরের চালে, দূর্বা ঘাসে, মাঠে। ঘুম থেকে উঠে উঠোন পেরিয়ে এ-দৃশ্য দেখল চন্দা। হঠাৎ ও কান্নার রোল শুনতে পেল। রশিদদের বাড়ির দিক থেকেই ভেসে আসছে বিলাপ। মনের ক্যানভাসে আতঙ্কের নীল ছোবল বসে গেল। চট করে উঠোন পেরিয়ে বাড়ির বাইরে এলো। দূর থেকে দেখতে পেল কয়েকজন পুলিশ বেরিয়ে আসছে ওই বাড়ি থেকে।

পুলিশ কেন?

মনে প্রশ্ন আসার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর খুঁজে পেল চন্দা। রশিদকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কাঁদছে রশিদের মা-বোন।

ছুটে গিয়ে পুলিশের সামনে দাঁড়াল চন্দা।

চিৎকার করে প্রশ্ন করল, ওনাকে এভাবে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন কেন?

প্রশ্নের জবাব দিলো না পুলিশ। আসামি ধরার সাফল্য ফুটে উঠেছে তাদের চোখেমুখে।

এবার রশিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল চন্দা।

কী অইছে? পুলিশ আপনারে ধরছে ক্যান?

শান্ত গলায় রশিদ জবাব দিলো, একজনের চোখ উপড়াইয়া ফালাইছি আমি।

কার চোখ? ক্যান্ উপড়াইলেন?

হের নাম নরক আলি। গাঁয়ে হে তোমার বদনাম রটাইয়া বেড়াইতেছিল।

উত্তর শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল চন্দা। ওর বুকে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আবেগের খড়কুটো। চোরা ভালোবাসার ঘরে লেগে গেল আগুন। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের আন্দোলনে প্রথমেই পোড় খেল রোমাঞ্চভরা অভিমানী চঞ্চল মন। এ নিখাদ মনের কচি ভূমিতে আগাম লাঙলের ফলা টেনে পুলিশের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে রশিদ আর খরস্রোতা মনের মঙ্গা মোকাবিলায় সরু আইলের মধ্যে চন্দা পুড়ে নিচ্ছে ভালোবাসার আগাম শস্যবীজ। মরা কার্তিককে আর মরা মনে হচ্ছে না। উজ্জ্বল শস্যবীজ বুকে ভরে কার্তিকে লেগেছে বসন্তের ছোঁয়া। উর্বর হয়ে উঠছে মনভূমি। ভালোবাসার এ-উর্বর ভূমি কেবলই রশিদের জন্য। অন্তরে-বাইরে জ্বলে উঠল অফুরান আলো, কেবলই আলো। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ সংঘের ভিন্ন ধাঁচের আলো বুকে নিয়ে চন্দাও এগিয়ে যেতে লাগল থানার দিকে …