ময়ূরের পালক

রাজস্থানের এক বিচারক বলেছেন, ময়ূরের অশ্রু পান করে ময়ূরী গর্ভবতী হয়। আর অনেকের মতো আমার প্রতিবেশী বন্ধু জামালপুরের মিলু বলেছে, ময়ূরের পালককে মোম খিলাবি, বাচ্চা ফুটবে।

বইয়ের ভেতর ময়ূরের পালক জমিয়ে রাখতে না পারাটা আসলেই খুব কষ্টের। আপনারা যারা ছোটবেলায় এটা করতে না পেরে খুব মনোকষ্টে ভুগেছেন, তারা জানবেন, আমিও তাদের মধ্যে একজন। আমার কোনো ময়ূরপালক ছিল না জমিয়ে রাখার মতো এবং আমার মতো আরো অনেকেই ছিল পালকবিহীনতার কষ্টে। বাবা মাছ ধরতেন ধানমণ্ডি লেকে, ফাতনার জন্য সম্পূর্ণ পালক না কিনে তিনি শুধু সাদা লম্বা বস্তুটা নিয়ে আসতেন আর আমি বাবার এই ক্ষমার অযোগ্য কাজটা দেখে ভেতরে ভেতরে ভীষণ রেগে থাকতাম। রেগে থেকে আর কী লাভ বলুন, এ-কথা তো বাবাকে বলার সাহস ছিল না। তিনি সদা সর্বদাই রেগে থাকতেন গুষ্টির সবার ওপর, এমনকি গাঁ থেকে থার্ড ডিভিশনে পাশ করা চাকরিইচ্ছু গরিব ছেলেটার ওপরও। সে যে কত কষ্ট করে লোকের বাড়ির বেড়া বেঁধে, ছাত্র পড়িয়ে, লজিং মাস্টার থেকে, এর-ওর কাছে হাত পেতে ফরম ফিলাপ করার টাকা জোগাড় করে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার হল অবধি পৌঁছে যেতে পেরেছে মায়ের আশীর্বাদে তা দেখাদেখি নাই, ‘এই রে তুই কেমনে থার্ড ডিভিশান পাইলি!’ মা যে কথা কম বলে, সে পর্যন্ত বাবার এই কাণ্ডে বলে, ‘দেখছোছ তোর বাপের কাণ্ডটা! লোকমানের বাপ নাই, মা মানুষের বাড়িতে ধান ভানে!’ বাবার এসব দেখে দেখে আমরা ক্লান্ত। তো আমাদের আর বলার সাহস হয় না – বাবা ময়ূরের পালকসহ ফাতনাটা কিনলে কী হয়! তুমি আসলে কিছুই জানো না, পালক সত্যি কত পয়মন্ত একটা বস্তু ঘরে রাখলে, বইয়ের ভেতর রাখলে কিংবা ঘরের দরজায় রাখলে; সত্যি সব ভালো ভালো কাণ্ড ঘটতে থাকে, অবাক করার মতো! ভালো মানে কী সেটা আমার কাছে যেমন সেটা বলি। ভালো মানে, আমাদের গরু পালা মবিন ছেলেটা বাজার থেকে টাকা চুরি করে তোমার হাতে ধরাও খাবে না, থাপ্পড়ও খাবে না, ভাইয়া পরীক্ষায় গণিতে পুরো নাম্বারই পাবে কেননা পরীক্ষার আগের রাতভর তুমিই তাকে অঙ্ক কষিয়েছ, বেচারা ঘুমের ঘোরে, যা হোক! আবার ধরো কোনো কারণে তোমার মেজাজ খারাপ থাকলে ফাইভ, এইট আর টেনে পড়া তিন সন্তানকে গালিভারস ট্রাভেলস থেকে ডিকটেশান দিলে সবাই নির্ভুল বানানে লিখে দেবে তোমাকে, কিছুতেই এমন হবে না যে তোমার ভয়ে জানা বানান ভুল করে তোমার থাপ্পড় খেয়ে রক্তজমা চোখ নিয়ে পরদিন স্কুলে যাবে ইত্যাদি। 

সে সব যাক, বলছিলাম ময়ূরের পালকের কথা। আমাদের কলোনিতে আমাদের ফুলবাগানের পাশে বাবার গরুর ঘরটা ততদিনে মক্তবে পরিণত করেছেন বাবাই। প্রকৌশল বিভাগে চাকরির এই বোধহয় মজা। বাবাকে গরুর নেশা ছেড়ে মাছ ধরার নেশায় পেয়েছিল যুদ্ধের পরপর, সে-নেশাও ছাড়ি ছাড়ি করে তখনো ছাড়েন নাই। মাছ ধরা ছাড়বেন কেন? ছাড়বেন কারণ পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা না করে ধানমণ্ডি লেকে মাঝরাত অবধি মাছ ধরার খেসারত আমাদের পুরো পরিবারকে দিতে হয়েছে যে! হ্যাঁ, তাঁকে তাঁর দুই শিকারি বন্ধুসহ এক রাত হাজতবাস করতে হয়েছিল কারফিউ উপেক্ষা করে মধ্যরাতে মাছ ধরার শাস্তিস্বরূপ। হাজতবাস ব্যাপারটায় তিনি এতোটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন যে, তাঁকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল, ভাবুন কী অবস্থা! বাবা যদি চাকরি ছেড়ে ঘরে বসে থাকেন তো কর্তৃপক্ষ কয়দিন বাবাকে বেতন দেবে! বাবার বস দবিরউদ্দিন সাহেব ভালো মানুষ, প্রতিদিন এসে বাবাকে দেখে যেতেন, ওষুধ খাইয়ে যেতেন। সত্যি বলতে, এরই ফলাফল গরুঘর মক্তবে রূপান্তর, কী থেকে কী! 

তো আমরা বাবার গড়া কলোনির সেই মক্তবে যাই, হুজুর চাচার ছেলে রাফি ভাই মক্তবে পড়ান। না পড়িয়ে করার আর তার যে কিছু নাই, বরখাস্ত হয়ে আছে অবৈধভাবে বাসা দখল করার অভিযোগে। ছোট চাকরি তার বিশ^বিদ্যালয়ে, ভালো চাকরি করা তার বাবা মানে আমাদের প্রিয় চাচার অনেক চেষ্টা-তদবিরে হয়েছিল রাফি ভাইয়ের চাকরি। চুপি চুপি বলি, সে কিন্তু সত্যি বখে গিয়েছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, আরো আরো অনেকের মতো! তো চাচা রিটায়ার করে বাসা ছাড়ার সময় হলো কিন্তু ছেলে বাসা ছাড়ে না, মানে রাফি ভাই বাসা ছাড়ে না। এতো বড়ো বাসা তো তার জন্য বরাদ্দ হবে না কোনো কালে। ছাড়ে না তো ছাড়েই না। বাসা না ছাড়ায় চাচার অবসরকালীন টাকা-পয়সা সব আটকে যাচ্ছে, সেদিকেও কোনো খেয়াল নাই পুত্রের। তো রাফি ভাইয়ের অসুবিধা বিশেষ হলো না, বিশাল বাসার প্রায় পুরোটাই ভাড়া দিয়ে ভালোই রোজগার হচ্ছে, এমনকি বিশাল বারান্দাটাও ঘিরে ঘর বানিয়ে ফেলল নিপুণতায়।

তো সেই কালে মক্তবে মিলু একদিন কায়দা পড়তে পড়তে, কায়দার ভেতর ময়ূরের পাখা দেখাতে দেখাতে বললো, আমার খালার বাড়িতে ময়ূর আছে, খালার অনেক বড়ো বাগানবাড়ি মালিবাগে।

খালু তার আদম ব্যাপারী, সেটা অবশ্য অগৌরবের কিছু না। আদম ব্যাপারী পেশাটার সঙ্গে একটা কাঁচা পয়সার গন্ধ লেগে থাকে, এইটুকুই যা। তো সেখানে ময়ূরের সঙ্গে আর কী কী প্রাণী আছে সেসব কখনো বলে না। যদি বলি, তোমার খালার অজগর সাপ আছে! সে বোকার মতো মুখ করে বলে, ছিঃ, ওসব থাকবে কেন! বলি, চিড়িয়াখানায় তো এসব থাকে। বানর থাকে! হরিণ থাকে! প্রোভস্টের বাড়িতে হরিণ ছিল, আমি দেখি নাই আমার আপা দেখেছে লোহার গেটের ফাঁক দিয়ে, যুদ্ধের আগে। প্রভোস্টের নাম উচ্চারণে আমাদের সমীহ জাগে অল্পক্ষণের জন্য। তারপরই আমাদের মনে পড়ে একটা রোববারের কথা। রোববার সকালে আমাদের মক্তব। মক্তবের সামনের রাস্তায় যেদিন রোকন নামে বিশ^বিদ্যালয়ের গণিতের ছাত্রটা ভাষণ দিচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর মতো আঙুল উঁচিয়ে, সেদিন সারাদিন আমি আর মিলু প্রোভস্টের ওপর খুব রেগে ছিলাম, তিনি কেন রোকন নামের এই ভাইটাকে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করছেন না! বাবা-মায়ের অবর্তমানে তিনিই তো অভিভাবক, বাবা বলেছেন। রোকন যে গণিতের ছাত্র সেটাও বাবাই বলেছেন। শুনেছি সেই রোকন আর আমাদের সিঁড়িতে বাস করা ময়নার মা পাগলি আমাদের নীলক্ষেত বাবুপুরা দিয়ে যাওয়া ছিয়াত্তরের নভেম্বরে মিছিলের অগ্রভাগ দখলে রেখেছিল ট্যাঙ্ক কি জঙ্গি জাহাজ মারুইন্যার সঙ্গে। পথের ধারে কৌতূহলী মুজিববিদ্বেষী কি বিদ্বেষী নয় – সকলেই এ-দৃশ্য দেখে ভারি আহলাদিত হয়েছিল। জনে জনে জানিয়েছিল, ময়নার মাকে খুব মানিয়েছিল মিছিলের অগ্রভাগে মাথায় আমের ডাল বাঁধা অবস্থায়, আহা কি নৃত্য! তখন অবশ্য আমাদের ময়ূরের পাখাকে মোম খাইয়ে বাচ্চা ফোটার খবর জানা ছিল না যে আমরা ভাববো, ময়নার মা পাগলির মাথায় ময়ূরের পালক থাকলে কেমন দেখাত।

তো ময়ূরের পাখনার মাথায় যে অপূর্ব নীলাভ, প্রুশিয়ান ব্লু আর সোনালি মেশানো ঘুরনিটা থাকে সেটা কিন্তু কারো কাছে থাকত না, থাকত চিকন সুতার মতো সোনালি কালোয় মেশা বস্তুটা, একটা-দুইটা। তা আবার কাগজে মুড়ে রাখে কেউ কেউ। চিকন সাদা ফাতনাটা দিয়ে আলিফ বে তে সে জিম হে খে পড়ে, ফাতনা হাতে ওরা একটু ভাব নেয়, আমাদের আঙুলের ডগায় কাগজের তীর। তীরের ডগায় আলিফ বে তে সে। তখনো আরবি বা তা সা আসে নাই দেশে, বে তে সে জিম হে খে দিয়েই চলছি। মানে উর্দুয়ানি আরবি শিক্ষা আরকি, উর্দু ঘাড় থেকে নামলেও তার নমুনা স্বাক্ষর চলছিল।

আমাদের তখন জুতার চেয়ে জুতার বাক্স নিয়ে কাড়াকাড়ির সময়, পুতুল খেলি। সামলে না রাখলে মায়ের ব্লাউজের কাপড় কেটে পুতুলের কোলবালিশ তৈরি করে ফেলি, তারপর উত্তম-মধ্যম, যা হোক। সেই সময় মক্তব আমাদের পুতুল বিয়ে পাকাপাকি করার উপযুক্ত স্থান। মায়ের সঙ্গে রাগ করে বাবা বাজারের টাকা বন্ধ করে দিয়েছেন, টানা তিনদিন মা নিজের পুঁজি ভেঙে শুধু ভাত, আলুভর্তা আর টমেটোর টক রান্না করে চললেও পুতুল বিয়ের পরিকল্পনায় কোনো অসুবিধা নাই আমাদের, বাবা-মায়ের ওসব তো হামেশাই হয়! টমেটোর টক রান্নার রেসেপি চান! এক টাকায় টসটসে এক সের টমেটো, সঙ্গে কিছু মিষ্টি আলু আর ভাতের ফ্যান, রসুন-কাঁচামরিচ বেটে একটু না দিলে হবে না, রসুনের বাগাড়ও চাই শেষকালে। ক্ষুধায় চমৎকার বস্তু, সত্যি! সেই সময় পুতুল বিয়ে ঠিক হয়, হাতে সময় সাতদিন। গরমকাল চলে এসেছে, রোদ আর পুকুর পাড়ের সোনালু ফুল পাল্লা দিয়ে চোখ চমকায়। মনও চমকায়, পুতুল খেললেও জীবনের কিছু অভাবিত গোপন উন্মোচনে, – যা ছিঃ! তো প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই বিয়ে। সেই বিয়েতে আমরা ময়ূরের পাখায় জুতার বাক্স সাজাতে পারি না, সাজানোর চিন্তাও করি না। আমার পুরনো ঢাকার বন্ধুরা নাকি তাই সাজায়, শুনে হতবাক আর কি। আমরা সাজাই লাল-নীল রঙিন সুতায়। সুতা কুড়িয়ে এনেছি আমাদের জহুরুল হক হলের সবুজ মাঠ থেকে। ডাইং কারখানার লোকেরা হলের মাঠ বাৎসরিক লিজ নিয়ে রং করা কাপড় শুকাতে দেয়। কাপড় তুলে নেওয়ার পর শুকনা ঘাসে লেপটে থাকে রঙিন সুতা, সে সব, লাল-নীল-হলুদ-সবুজ।

একদিন মিলু দুটো চিকন পালক হাতে দিয়ে বলে, বইয়ের ভেতর রাখ কাগজ দিয়ে মুড়ে, মাঝে মাঝে একটু একটু মোম খিলাবি। খিলাবি মানে খাওয়াবি। মিলুদের বাড়ি জামালপুর, ঢাকাইয়ারাও খিলাবি বলে, মিলুও খিলাবি বলে। আমি বলি, মোম খায় পালক!

– হুম, খেয়ে বাচ্চা দেয়। বাচ্চা শব্দটা বলে খুব গলা নামিয়ে, যেন খুব গোপন। বলে, অনেক পালক হলে আমরা সেই পালক দিয়ে পুতুলের ঘর সাজাবো একদিন।

বাচ্চা দেওয়ার কথা গিয়ে রাফি ভাইয়ের কানে ঢোকে, কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে আধঘণ্টা। রাফিভাই অবৈধভাবে বাসা দখল করে রাখে, অবৈধভাবে আমাদের দাঁড় করিয়ে রাখে। লোকটা দেখি অবৈধে ভরা! তার কিছুদিন পর অবশ্য বউ-বাচ্চাকে ওই অবৈধ বাসায় রেখে বৈধভাবে মালয়েশিয়া চলে যায় রাফি ভাই। আমাদের কায়দা পড়া বন্ধ হয়ে গেল কিছুদিনের জন্য এবং মক্তব হয়ে গেল পুতুল বিয়ের আসর, মাঝে মাঝে চালেডালে খিচুড়ির পিকনিক যখন-তখন। আর পুতুল বিয়ের ঘর সাজানোর জন্য আমরা তখন ময়ূরের পালকের সুতাবৎ ঝিলিমিলিকে মোম খিলাতে লাগলাম উঠে পড়ে।

মাস না যেতেই নতুন হুজুর এলেন, মাস গেলে বেতন পাবেন আর মাসে দুদিন করে তাকে ভাত খাওয়াতে হবে কলোনির ষোলো বাসার গৃহিণীদের। খবরটা জেনে মায়েরা খুব খুশি হয়ে গেল বাড়তি সোয়াবের প্রত্যাশায়, স্বল্প আয়ের বাবাদের তেমন কোনো হেলদোল দেখা গেল না। হুজুর বয়স্ক কিন্তু ভারি রসিক, বড়ো যে দু-একজন আপা মক্তবে আসে, তাদের নিজের আসনের ডানে-বাঁয়ে বসান, তাদের হাত ধরে ধরে কায়দা কি কুরআন শিক্ষা দেন। মাঝে মাঝে তাদের দৈহিক খবরাখবরও রাখেন, মানে তাদের মাসিক কবে ইত্যাদি। হুজুরের ফিসফিসে উৎকর্ণ দু-একটা ছেলেমেয়েও। তারপর হুজুরকে ভর্ৎসনার সঙ্গে বিদায়, বেচারা নাকি যাওয়ার সময় কান্না করেছেন, কান্নার কারণ এখানে আর কিছুদিন থাকলে বিশ^বিদ্যালয়ে একটা চাকরির সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হতো অন্তত। বছরখানেক পর রাফি ভাই ফিরে এসে পলাশীতে দোকান দিলে আর চাকরিতে পুনর্বহাল হলে এমনকি মক্তবে পড়াতে শুরু করলে এমনকি বাসাটাও নিজের নামে করাতে পারলে আমাদেরও স্বস্তি আসে।

দুই

পুতুল বিয়ের ময়ূরপালক নিয়ে আমাদের কথা বলার দিন শেষ হয়ে আসে, কুরআন শরিফ এক খতম দেওয়ার পর মক্তব ছাড়ার নিয়ম মেয়েদের, ছেলেরা যতদিন খুশি পড়ো। মাঠেও সেই নিয়ম, মাসিক হয়ে গেলে মেয়েরা গৃহবন্দি, স্কুল আর বাসা। পায়জামা-ওড়না অবধারিত।

মিলুর বাবা চাকরি থেকে অবসরে গেলেন, এলপিআরও শেষ হয়ে এলো। মিলুরা চলে গেল যাত্রাবাড়ী নিজেদের নতুন টিনশেড বাড়িতে। মাস্টার্স শেষ করা চাকরিরত মিলুর বিয়ের খবর পাই, তারপর বছর না ঘুরতেই সন্তানসহ মৃত্যুর। সন্তান পেটেই মারা গেছে, মিলুর জন্ডিস ধরা পড়ে শেষ মুহূর্তে। অপারেশনের সাতদিন পর মিলুর মৃত্যুসংবাদ আমাদের কলোনিতে শোকের ছায়া বয়ে আনে।

বছর দু-এক পর আমাদেরও বাসা ছাড়ার সময় আসে। মা বলেন, কাঁকনের বাসাটা ছোট, বেশি জিনিস নিলে রাখার জায়গা পাবে না। কাঁকন আমার বড়ো ভাই, বিদেশে থাকে বউ-বাচ্চাসহ। তার একটা ফ্ল্যাট আছে আগারগাঁওয়ে। ভাড়া উঠিয়ে বাবা-মাকে কিছুদিনের জন্য থাকতে দিয়েছে। বাবা তাড়াতাড়ি বাসাবো বাড়িটারি করে চলে যাবে, এই শর্তে। পুরনো জিনিস ফেলে যাব, বিশেষত পুরনো কাগজপত্র। কাগজপত্র গোছানোর দায়িত্ব আমার। কী রাখি কী ফেলি মহাজ¦ালা! শত শত গল্পের বই, পত্রিকা, পাঠ্যবই, অভিধান। কুরআন শরিফ, আমপাড়া, কায়দা। শেষোক্তগুলো ফেলবে না, মা বললেন। বাছাবাছির ততো সময়ও ছিল না হাতে, কোনো রকম দরকারি কিছু বস্তাবন্দি করা হলো। মায়ের চল্লিশ বছরের সংসার, এই বাসায় তার ত্রিশ, শেকড় কখনো এখান থেকে উপড়াতে হবে ভাবেনইনি বোধহয়।

 ভোরবেলা সারাবাড়ি তছনছ, এমন কি বিমর্ষ সূর্যের আলোও যেন কেমন এঁকেবেঁকে পড়েছে সাতানব্বইয়ে জুলাইয়ের প্রথমদিন। বারান্দার কাপড় মেলার মোটা তারগুলো ফাঁকা, বারবার চোখ আটকে যাচ্ছে। আটপৌরে কাপড় তোলার নিয়ম ছিল না, তার থেকে কাপড় যায় বাথরুমে। বাথরুমের সামনে পড়ে আছে পায়খানার হলুদ প্যান মাজা নষ্ট ব্রাশ, মোথা শলার ঝাড়ু। বানেজার মায়ের আজকে শেষদিন, সতেরো বছর ধরে কাজ করে। গত দুই বছর সে অনুরোধে কাজ করে যাচ্ছিল, ছেলেরা তার রোজগেরে।

সকালে নাস্তা বাইরে থেকে এলো, পাউরুটি-কলা। গ্যাসের চুলা খুলে ফেলায় ডিম ছাড়া নাস্তা বাবার। একটু পর চলে যাব। মা বললেন, বানেজার মা ছড়ানো-ছিটানো কাগজগুলো একটা বস্তায় ঢুকায় রাখো ফেলে দেওয়ার জন্য, আর শেষবার ঘরগুলা ঝাড়ু দাও।

বানেজার মা ঝাড়ু দিচ্ছে আমি তার পিছু পিছু তুলে তুলে দেখছি। বিয়ের কার্ড, রেশন কার্ড, পোস্টকার্ড, চিঠির খাম, রেশন তোলার রসিদ, ঝাপসা তারিখ বিশ বছরের পুরনো। ঝাড়ুর আগায় ভাঙা সেফটিপিন, মরিচাধরা আলপিন, খাতা সেলাইয়ের ঘুঙুর, আল ভাঙা। নানারঙের বোতাম ছিটকে পড়ছে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে। তারপর বইয়ের আলগা পাতা কয়েকটা, হাত দিয়ে তুলতেই ঝরঝর করে ঝরে পড়ে হালকা হলুদ পাতা আর পালক, ময়ূরের পালক। রেখেছিলাম তো একটা-দুটো পনেরো বছর আগে। পড়ছে অনেক। অনেক মানে অজস্র, শত শত, হাজার হাজার পালক। সকালের গুমটি মেঘলা আকাশ ঘনীভূত হয়ে একটু যেন বাতাস ছাড়ল, পালক উড়তে লাগল যথেচ্ছ, যত্রতত্র।  ঘরে কেউ ছিল না, শুধু মা আর আমি। বাবা পান আনতে পলাশী বাজারে শেষবারের মতো গেছেন। আমি বলি, এসব কী! মা বলেন, এসব কী! কোথা থেকো এলো! আমি মনে করার চেষ্টা করি, মনে পড়ে না। মিলুর কথা মনে আসে, জটিল কিডনিরোগে আক্রান্ত রাফি ভাইয়ের কথা মনে আসে, এমনকি আগারগাঁও যাওয়ার আজকের রাস্তাটা কেমন তা মনে করার চেষ্টা করি, মনে আসে না। বানেজার মা ঝাড়ু বাদ দিয়ে পালকের ওড়াউড়ি দেখতে থাকে। সাদা ঘোলাটে চুনকাম করা বিশ^বিদ্যালয়ের দেয়াল-সিলিং অজস্র পালকে ঢেকে যায়, অথচ আমাদের কারো পুতুল বিয়ে হচ্ছে না।