October
- 
 কার্তিকের নীল কুয়াশায়রাত দশটা। চা-বাগানের অফিস। ম্যানেজার কৈয়ারীলাল হেড টিলাবাবু আনোয়ারকে সজোরে ধমকে দিলেন। তার পর যা আসে মুখে তাই বললেন। পাতা কমে যাওয়ায় দোষারোপ করলেন। শীতের এই সময়ে চা-পাতা স্বাভাবিকভাবেই কমে আসে। কিন্তু তিনি মানতে রাজি নন। তিনি মনে করেন, এখানে হেড টিলাবাবুর গাফিলতি আছে। তাই নিজের আক্রোশটা ঝেড়ে দিলেন তার ওপর। বিরূপ আবহাওয়া, শ্রমিক সংকট… 
- 
 অভিমানের দরজাঢাকার মোহাম্মদপুরে পুরনো একতলা বাড়ির জানালার ধারে বসে আছেন সরোজিনী। বয়স পঁচাত্তর ছুঁইছুঁই, কিন্তু শরীরটাকে এখনো যত্নে রেখেছেন। সাদা শাড়ি, হাতে কাঁপা কাঁপা চুড়ি, চুলে হালকা পাক ধরা। জানালার ওপাশে স্কুলছুট ছেলেমেয়েরা ঝগড়া করছে – কেউ বল কাড়ছে, কেউ কারো ঠোঁট বাঁকিয়ে তাকাচ্ছে। অথচ এই ছোট ছোট ঝগড়ার মধ্যেই আছে মিষ্টি মিষ্টি মান-অভিমান, অভিমানের দরজা… 
- 
 টিফিন ক্যারিয়ারশেফালী বেগমের বাস বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে, রোহিতপুর গ্রামে। গ্রামের ভেতর সরু গলির শেষ মাথায় দোচালা টিনের ঘর। ঘরের সামনেই একটা কদমগাছ, বর্ষাকালে সাদা ফুলে ভরে যায়। সকালের হাওয়া নদীর কোল ঘেঁষে আসে; কখনো কচুরিপানার পাতায় জমে থাকা শিশিরের গন্ধ নিয়ে, কখনোবা ভেজা কাদামাটির। এই গন্ধ তার ভালো লাগে, আবার কষ্টও দেয়। কারণ এই নদীই তাকে… 
- 
 নোবেলজয়ী হান ক্যাং-এর একগুচছ ছোটগল্পনবজাতককে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে রাখার ফালি কাপড় তুষারশুভ্র ফালি কাপড় দিয়ে নবজাতককে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে নেওয়া হয়েছে। মাতৃগর্ভ নিশ্চয়ই আরামদায়ক আঁটসাঁট জায়গা হয়ে থাকবে, নার্স নবজাতককে তাই ফালি কাপড়ে বেশ টানটান করে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে নেয়। যাতে এই অনমেত্ম ওর অভিক্ষপ্ত হওয়ার আকস্মিক ধাক্কাটা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়। সদ্য জন্মলাভ করে, এইমাত্র শ্বাস নিতে শুরু করেছে যে, সে ফুসফুসে পরিপূর্ণ করে… 
- 
 রাতের রবীন্দ্রনাথরাত যখন নেমে আসে, তখন পৃথিবী তার সমস্ত কোলাহল গুটিয়ে নেয়। তখন যেন ভাষার ভেতর থেকে ঝরে পড়ে গোপন কোনো জ্যোৎস্না, শূন্য আকাশে বাজে অশ্রম্নত বীণা। ঠিক তখনই রবীন্দ্রনাথকে অন্যরকমভাবে পাওয়া যায় – দিনের আলোকিত জনসমক্ষ নয়, রাতের গভীর নির্জনতায়। সেই রাতের রবীন্দ্রনাথ, যিনি কোনো রাজনৈতিক সভায় বক্তা নন, কোনো সমাজসংস্কারক নন, কোনো কবিদের গুরু… 
- 
দিনশেষেদিনশেষে ঘাসি নৌকা সব ঘরে ফিরে যায় সার বেঁধে নদীতে তখন জোয়ারের টান পাথরের খোয়াই পার হয়ে দু’পাশে বৃক্ষর সারি – বর্ষীয়ান বৃক্ষর হলুদ পাতারা ঝরে টুপটাপ সন্ধ্যার নিরাক অাঁধারে। পুরনো গন্ধে ভরা হাওয়ার ভেতরে পাঠায় কে চিরকুট – চলে যাওয়ার দিন এসে পড়ে। চলে আয়োজন। শ্রাবণের উড়ুক্কু মেঘের সওয়ারি কে চলে যায় সময়ের চিহ্নিত… 
- 
জেনে যেতে পারোজেনে যেতে পারো একদিন নিসর্গের সৌন্দর্যে আমিও অভিভূত হয়েছিলাম কত আকাশ ও নক্ষত্র দেখে, জেনেছিলাম মানুষ আঙুলের সদ্ব্যবহারে জল, মাটি ও আলোর স্পর্শে তারাফুল ফুটিয়েছিল; জল দিয়েছিল গাছে – মাটিতে উৎপাদিত শস্যের দৃশ্য মানুষের মনোজগতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে সে-নিসর্গের যোগ্য হয়ে ওঠে; জেনে যেতে পারো, বৃক্ষের সান্নিধ্যে মানুষ সৃজনশীল হয়েছিল – দেখে যেতে পারো এই… 
- 
না, কোনো এলিজি নয়(বনানীর গোরস্তানে আফতাব শেষ ঘুমে চলে গেলে) আপনাকে কবরে শুইয়ে দেওয়ার পর আপনাকে নিয়ে কবিতা লেখার কোনো মানেই হয় না। আজ রাত থেকে আপনার কোনো বন্ধু নেই, পরিবার নেই, দায় নেই, দয়া ও মমতা আপনার চারপাশ ঘুরঘুর করলেও আর স্পর্শ করতে পারবে না কিছুতেই। হ্যাঁ মশাই, আপনাকে। আপনার স্পর্শ পাওয়া ল্যাপটপ, কিন্ডেল, সেলফোন, আইপ্যাড –… 
- 
আরণ্যিক মেঘের চোখেযা দেখি তার চেয়ে বেশি দেখি ধুলোর প্রলেপ ভাঙা রোদ, বিচূর্ণ ইচ্ছের স্বপ্নহীন মাতামাতি। রংধনু নকশা বলো, আর জোছনা মাখা ছায়াই বলো দৃষ্টিসীমায় পড়ে থাকে বন্ধ্যা জমিন, তৃষ্ণার্ত নদী। আরণ্যিক মেঘের চোখে যে বিচ্ছুরিত দ্যুতি তাতেও দেখি লৌকিকতার অসার ফুলঝুড়ি। আচ্ছন্ন হয়ে থাকা সমস্ত অভিজ্ঞানে জুড়ে থাকে নগ্ন ক্ষুধা, রক্ত মাটির মনছোঁয়া বেদনার্ত ঋণ। পাঁজর… 
- 
রূপের মাছচল্ যাই পদ্মায় – এ রাতে ধরি মাছ – বেশ তো দেখলাম নদীর ভাব ঝিলমিল-জোছনায় তারারা জ্বালে দীপ – চক্ষু মেললেই ঝিলিকলাভ ঝলমল ওই জল, নাচে কী আহা ঢেউ! উড়ছে গাঙচিল, ডানায় জ্বর আয় এই সন্ধ্যায় – গোপনে ছাড়ি নাও – জলদি দাঁড়, পাল জোগাড় কর্ স্বপ্নের নৌকায় দুজনে… 
- 
সে তো, আজন্ম পিপাসার জলে হতাশার আধেক নুনমনে পড়ে না : সুখ নিয়ে সাত-সতেরো ভাবনায় কবিতা লিখতে চেয়েছে – বিবাগী এই মন! স্বল্প-আয়ুর সুখ? কবিতা লেখার টেবিল অবধি যেতে যেতে ফিরে গেছে সে অন্যের সিংহ-দরোজায় – বিষণ্ণতা? আনন্দের বিপরীত স্রোতে তীরের ফলার মতো ছুটে এসে, ভেঙেছে সে হৃদয়, হৃদয়ের নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব! দুঃখ? কারণে অকারণে সে আমার বুকের মধ্যে মায়াবন-বিহারিণী, অথৈ বেনোজলে… 
- 
ডেভেলস ব্রেথসৌগন্ধহীন সাদা পাউডার যখন দিগন্তের পেছনে ছুটতে থাকে তখন হাওয়ায় উড়তে থাকে শূন্যতা! নৈঃশব্দ্যের ভেতরে মুদ্রিত হতে থাকে রঙের খেলা! নিঃশব্দে অচেনা পথ অচেনা মানুষের অনুগত হতে হতে জীবন খেয়ে ফেলে ডেভেলস ব্রেথ! কতটা নতজানু হলে বেমালুম সব ভুলে গিয়ে সর্বস্বান্ত হলে মুক্ত হওয়া যায়? এই রক্তাক্ত বিকেল বিমূঢ় অসিত্মত্ব, পচে যাওয়া মগজ, পাঁজর ভাঙার… 
