ছোট গল্প
-
পদ্মাপুরাণ
ফেসবুকে পোস্টটা দেখার পর থেকেই বিন্তি ভাবছে ঢাকার কথা। নিউইয়র্কে অনেকদিন থেকে আছে। ঢাকা যাবে দুই মাস পরে। ওর স্বামী বারো বছর নেই। মারা গেছেন। তারায় তারায় সে-মুখ কোথায় যে লুকিয়ে আছে কে জানে। আগে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তারা দেখার অভ্যাস ছিল। এখন নেই। পোস্টটা দিয়েছিল হাশিম। পদ্মা ব্রিজের পোস্ট। ‘বাংলাদেশের একটি স্বপ্ন পূরণ’। হাশিম ওর…
-
শিকার
ভোররাতে একটু দূরে চোখের সামনে দিয়ে ছোট পাখিগুলি দলবেঁধে উড়ে গিয়ে বসল আরেকটা ক্ষেতের মধ্যে। মফিজ আর সাজু তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখল। আসলে জালটা ঠিকমতো পাতা হয়নি। একপাশ খোলা ছিল। না হলে এমনটা হওয়ার কথা নয়। মফিজ তাকায় সাজুর দিকে, কেমুন হলো রে, তুই কোনো কামের না। এতদিনেও জাল-পাতা শিখলিনে! মফিজের চাইতে সাজু বয়সে কিছুটা…
-
নিতান্তই সহজ-সরল
ক্যানভাস জুড়ে ধীরে ধীরে একজন মানুষের আকৃতি স্পষ্ট হচ্ছে । মানুষটি একটা ভাঙা বাড়ির দাওয়ায় উবু হয়ে বসে রয়েছেন। লম্বাটে মুখজুড়ে ক্ষুরধার দুটো চোখ; খড়ের মতো ঘন ঝাঁকড়া সাদা চুলের ঠিক মাঝখান বরাবর পাহাড়ি রাস্তার মতো চিকন সিঁথি। পরনে ধুতি আর সাদা ফতুয়া। রেজা মাসুদের খুব চেনা লাগছে উবু হয়ে বসে থাকা ক্যানভাসের মানুষটিকে। তবু…
-
কাঁটাতারের গল্প
প্রেমের গল্প কি কখনো মৃত্যুর আখ্যানে শুরু হয়! মৃত্যু তো শেষ পর্যন্ত সব নেয়। ভালোবাসা সেখানে ছাড় পাবে কেন! কিন্তু সুদর্শনের চলে যাওয়ায় তো তাই হলো। চিতাভস্ম থেকে জেগে উঠল অন্য আখ্যান। মণিরেখা ফোন পেয়েছিলেন সুদর্শন চলে যাওয়ার এক মাসের মাথায়। জানুয়ারির পনেরো, ফেব্রুয়ারির সতেরো। বিকেলের দিকে ফোন এসেছিল। হোয়াটসঅ্যাপ কল। মণিরেখা স্কুল থেকে ফিরেছেন।…
-
নেক
একটি সৎ, পরিশ্রমী আর অনুগত ছেলে চেয়েছিলাম আমি। যে চলে গিয়েছিল, তার মধ্যে স্পষ্টতই এগুলির অভাব ছিল। ওদিকে আমার সামনে পোস্টিং অর্ডার নিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে হ্যাংলা-পাতলা ছেলেটি, সেও কোনোভাবেই আস্থা কুড়োতে পারল না আমার। ও যে-কাজগুলি করবে, তা এমনিতে গুরুত্বহীন মনে হতে পারে; কিন্তু কোনো ভুলটুল হয়ে গেলে বড় খেসারত গুনতে হতে পারে কোম্পানিকে এবং…
-
স্বর্ণতৃষা
নাহ, এয়ারপোর্টে কোনো অসুবিধা হয়নি। যদিও ঢাকা এয়ারপোর্টে সমস্যা হতে পারে – এরকম একটা আশঙ্কা মেজর আজমত শিরওয়ানীর ছিল। তবে পাসপোর্টের তথ্যে তিনি তো কোনো ‘মেজর’ নন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রাক্তন অফিসারও নন। স্রেফ ‘আজমত শিরওয়ানী’ নামে দুবাইয়ের এক ব্যবসায়ী। ফলে সমস্যা হওয়ার কথাও ছিল না। তবে ঢাকা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে মেজর আজমত শিরওয়ানীর যে কোনো সমস্যা…
-
ভুখ
তোর বহুত ভুখ, তাই না রে বউ? জাবেদ আলি পাশে শুয়ে থাকা কমলার তপ্ত পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো। প্রথমে কিছু বুঝতে পারলো না কমলা, তারপর বালিশ থেকে মাথা তুলে জাবেদ আলির মুখের দিকে তাকিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। দুপুর পর্যন্ত চালকলে কাজ করে খুব ক্লান্ত। তার ওপর ফিরে এসে জাবেদ আলিকে গোসল করিয়ে খাইয়ে…
-
মজা নদীর মানুষ
লু ঙ্গি পর্যন্ত খোলা পিঠটা চিকচিক করছে। ঘামের ওপর পড়ছে জ্যৈষ্ঠের রোদ। খালি গায়ে আছে কুদ্দুস। লুঙ্গিটা অবশ্য আঁটসাঁট করে বাঁধা। তার গিঁটের মতো কুদ্দুসের শরীরখানাতেও গিঁট পড়ে গেছে। যেভাবে নদীটা শুকিয়ে খোল পড়ে গেছে, তার শরীরটাও সেরকম একটা খোল। বিত্তির খিলের মতো হাড় বেরিয়ে এসেছে কবেই! এই হাড়গিলে শরীরটায় রোদ পড়লে বুকের বাতিগুলি স্পষ্ট…
-
শামুকখোল
অঘ্রান শেষে পৌষের কুয়াশার ভোর। বিলের শান্ত গভীর জলের ওপর অলস অজগরের মতো জমাট কুয়াশার চাদরটা কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে এক টুকরো রোদের আশায়। ওদিকে পুব কোণে কপট কুয়াশার আবরণ ভেঙে সূর্য উঁকি দিতে এখনো বেশ কিছুটা সময় বাকি। সেই অপেক্ষায় পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘোট পাকানো কুয়াশাটা হালকা হচ্ছে ধীরে ধীরে – যেন…
-
দীঘলার চরের হাহাকার
এম্নে চাইয়া রইছোস ক্যান? দেখতাছি তোমারে। আমারে দেহনের কিছু আছে? হ, আছে। তুমি য্যামনে ধোঁয়া ছাড়ো সোন্দর লাগে। টানবি? না। আরে টাইন্যা দ্যাখ। মনে হইবো সাম্পানে ভাসতেছোস। কী কও? রেজিয়া বেগম মিছা কতা কয় না বুজলি? আসমানের কালা মেঘরে জাদু কইরা এইটার ভেতর ভরছি। না টানলে বুজবি কেমতে কইলজার ভিত্রে মেঘের ধুমা কেমন কইরা ধাক্কা…
-
কেবলই ছবি
ল্যাম্পপোস্টের ফটকা আলোর নিচে দাঁড়ানো এক মহিলা। মাথার ওপর জন্ডিস রোগীর চোখের মতো রাজধানীর সোডিয়াম বাতি। এসব বাতি সাধারণত সন্ধ্যাবেলায় যেরকম ঝাপসা হলদেটে রং ছড়ায় চারপাশে, মহিলার মুখাবয়বও সেরকম ম্লান অস্পষ্ট আলোর প্রলেপে ঢাকা। কাছে এগিয়ে না এলে চটজলদি বোঝা মুশকিল মানুষ নাকি অন্যকিছু। রাস্তায় মানুষজন একেবারে হাতেগোনা। করোনা-মুখোশে সবার মুখ ঢাকা। বেশিরভাগ দোকান বন্ধ।…
-
ঘর ছাড়ার গান
কেরাসিন তো দ্যাশে মেলে না/ জামাই বিয়াই আইলে পরে/ সকাল করে খাওয়ায় তারে/ শুইতে নিয়া যায় উত্তরের ঘরে/ বলে, তাই তো, বাত্তি দিইতে পারলাম না/ কেরাসিন তো দ্যাশে মেলে না… গান গেয়ে গেয়ে বাউলের দল আসে ভিক্ষা করতে। দেশের অবস্থা খারাপ। একদিকে স্বদেশি আন্দোলন। আরেকদিকে যুদ্ধ। কেরাসিনের মতোই অনেক জিনিস উধাও হয়ে গেছে বাজার থেকে।…