ছোট গল্প
-
এ ঢাক নিয়ে রাজবিহারী এখন কী করবে…
না, শিবানন্দের মা, আর বুঝি পারলাম না। বুক-ভরা যন্ত্রণা নিয়ে মধুবালার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল রাজবিহারী। আর পারছি না শিবানন্দের মা, আর পারছি না। – আবার কী হলো? এ-কথা বলে স্বামীর দিকে কৌতূহলী চোখে তাকালো মধুবালা। – কী আর হবে? তোমার সুপুত্র বলে দিয়েছে ও আর কোনোদিন ঢাক ধরবে না – বাজাবে না আর…
-
ছিঃ
প্রেম দিয়েই শুরু হয়েছিল সম্পর্ক। ক্যাম্পাস-সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তছনছ করে প্রেমের পাগলা ঘোড়া ছুটিয়ে তারপর বিয়ে করে ক্ষান্ত হলো ওরা দুজন। দুজন বলতে ধ্বনি আর আশরাফ। তাদের কথাই এখানে বলা হচ্ছে। যে-সময়ে প্রেমিক-যুগল হিসেবে ক্যাম্পাসে ওদের নিরন্তর দৌড়ঝাঁপ, সেটা আশির দশকের একেবারে গোড়ার দিককার সময়। ওরা সে-সময়ের নায়ক-নায়িকা। খুল্লামখুল্লা প্রেমের জন্য রীতিমতো বৈরী সময়; তবু দেশি…
-
জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে
শেষ পর্যন্ত ভাগ্য যেন সহায় হলো অনিমেষের। আগে থেকেই কিছু লোক দাঁড়িয়ে ছিল। অনিমেষ এসেছিল ঘণ্টাখানেক পরে। তার পরও আর কেউ কেউ এসেছে। ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন মহিলাও আছে। সবাই লম্বা বোরখায় আবৃত। লঞ্চঘাটে এতগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেই কখন থেকে। সবার মুখে চোখে উৎকণ্ঠা, আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। গলায় তেমন জোর নেই। কথাবার্তা হচ্ছে খুবই কম।…
-
আয়েশাপাগলির গর্ভফুল
স্কুলে যাওয়ার সময় দেখি আয়েশাপাগলি রাস্তার ড্রেনের পাশে বসে বমি করছে। পথযাত্রীরা যাওয়ার সময় বকে বকে যাচ্ছে। কেউ নাকে রুমাল চেপে চলে যাচ্ছে। আমরা কয়েক বান্ধবী একটু নিরাপদ দূরত্ব রেখে চলে গেলাম। আমার বয়স তখন বারো কী তেরো বছর। সেদিন স্কুল থেকে ফিরেই দেখি সবাই যেন কীসব বলাবলি করছে। জিজ্ঞেস করলে কেউ কিছু বলে না।…
-
মম আসেনি
কথা ছিল, কার্জন হলের সামনের চত্বরে অপেক্ষা করবে। সময় জানিয়েছিল এগারোটা। সাজিদ কথামতো ঠিক সময়ই এসেছে। এবং তারপর থেকে অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ সদ্য চারা গজানো ফুলের বেডগুলো দেখে, তারপর দেখে মাঝারি সাইজের মেহগিনি গাছের সারি। ডালে ডালে নোনা ফলের সাইজের ফল ধরেছে। কিছুটা আগাম হলেও অশোক গাছের ডালে একটা দুটো লাল রঙের ফলের থোকাও চোখে…
-
পিশাচ
স্যার, আমি পিশাচ-সাধনা করি। আমি কৌতূহল নিয়ে পিশাচ- সাধকের দিকে তাকালাম। মামুলি চেহারা। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথায় চুল নেই। শরীরের তুলনায় মাথা বেশ ছোট। সেই মাথা শারীরিক কোনো অসুবিধার কারণেই হয়তো সারাক্ষণ বামদিকে ঝুঁকে আছে। তার হাতে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা পাখির খাঁচা। খাঁচায় যে পাখিটা আছে সেটা খুব সম্ভব কাক। পা ছাড়া পাখিটার…
-
স্বপ্ন
বেসমেন্টের অন্ধকার তখনো ভালো করে কাটেনি। কে জানে দিন কী রাত! রাতই হবে। যদিও মাটির তলার ঘর, কিন্তু খুদে একটা জানালা আছে। সেটা এ-বাড়ির বাগানের সঙ্গে সংযুক্ত। সুতরাং একটু হলেও আলো আসে। দেখা যায় কর্নারে একলা দাঁড়িয়ে-থাকা নাসপাতি গাছটা। শুধু একলা নয় দারুণ শীতে সবগুলো পাতা ঝরা ন্যাড়া ন্যাংটা। সামারে দুটো পাখির বাসা ছিল। কী…
-
জাদুকর
মেঘে মেঘে আকাশের নীল সমুদ্র ঢাকা পড়েছে। ঝাপসা অন্ধকারে প্রায় তলিয়ে গেল পৃথিবী। ঝেঁপে বৃষ্টি আসছে, সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস – না, ঝড় নয়, শোঁ-শোঁ বেগে প্রবল বাতাস। ভিজে কম্বলের মতো ভারি আকাশ মাথার ওপর চেপে বসেছিল। এখন বৃষ্টির সরল ধারায় মেঘ গলে গলে আছড়ে পড়ছে আর প্রবল বাতাসে বৃষ্টির ফিন্কি ধোঁয়া ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে ফিনফিনে…
-
শূন্যতার ভার
কোনটি বেশি, কোনটি কম, পরিমাপ করা কঠিন। আনন্দ এবং বেদনার দুটি অনুভূতির মিশেলে এ-এক নতুন অনুভূতি। গুরু মহর্ষি বিশ্বামিত্র, তাঁর প্রিয় শিষ্য গালব, দুজনই আনন্দ-বেদনার যৌথ স্রোতধারায় ভাসছেন। গালবের শিক্ষালাভ শেষ হয়েছে। গুরু বিশ্বামিত্র শিষ্য গালবকে বললেন, এবার যাও, গার্হস্থ্য জীবনে ফিরে যাও। যা-বিদ্যা অর্জন করেছ, জীবজগতের কল্যাণ করো। বিশ্বামিত্রের ঠোঁট কাঁপছে, চোখে অশ্রুরেখা। গালবের…
-
সহসা দুপুরে দহন
একদিন ছাদে হাঁটতে হাঁটতে নিশি দেখলো, বাহ, মজার ব্যাপার তো! কোত্থেকে যেন এক জোড়া দোয়েল এসে ঘর-সংসার পেতে বসেছে পশ্চিমকোণে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের ফিরোজা রঙের স্যানিটারি পাইপটার খোপে। জগৎ-সংসারের কিছু নিয়মনীতি সম্পর্কে নিশির ইদানীং কেমন একটা অনীহার ভাব জন্মেছে, নিতান্তই অবহেলায় বেড়ে ওঠা তৃণাঙ্কুরের মতো। জীবনপ্রদীপ নিভে আসা মানুষের ফ্যাকাশে দৃষ্টির মতোই বহির্বিশ্বটা ওর কাছে…
-
শূন্য মাঠের রেফারি
একটাও বাদ দেবে না, সব – সব আনবে কিন্তু – হাতে লম্বা একটা ফর্দ ধরিয়ে হুঁশিয়ার করে দেয় মর্জিনা বেগম। জানে স্বামী আবু কালাম বেভুলা ধরনের মানুষ। জীবনে ঠিকঠাক বাজার করতে পারলো না বা শিখলো না। অনেক সময়ে মর্জিনা বেগমের প্রশ্ন জাগে, এই বেভুলা মানুষটা আমার লগে মশকরা করে? নাইলে অফিস-আদালত, বন্ধু-বান্ধব, রাস্তাঘাটের এত ভজঘট…
-
কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়
ঘরের উত্তর দিকের রাস্তামুখী দরজাটা খুলে তিনি অনুভব করেন হেমন্ত এসে গিয়েছে। বাতাসে হিম ভাব, গাছের পাতায় শিশিরের মৃদু শব্দও শোনা যাচ্ছে। চারটে কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শান্তভাবে পৌরসভার ল্যাম্পপোস্টের নিচে শুয়ে আছে। ওদের মধ্যে একটা হলদে কুকুরের শরীরে কোনো লোম নেই, সম্ভবত বার্ধক্য। ভোর হতে আরো দু-ঘণ্টার বেশি সময় বাকি। আজকাল প্রায়ই রাত তিনটা কি…